13-03-2020, 12:22 PM
রঞ্জন ফেরা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে বলল দেখা যাক।যদি ভালো লাগে কালকেও থেকে যেতে পারি।
আপনার এই অরণ্য জীবন আর পাহাড় কিন্তু চমৎকার লাগছে।
রঞ্জন থেমে আবার বলল শহরের জীবন আমাদেরও একঘেয়ে লাগে।মাঝে মাঝে যদি এরকম জায়গায় এসে থাকা যায়।বিদেশের ছেলে মেয়েরা তো প্রায়ই যায়--একটা তাঁবু সামান্য নিয়ে আর কিছু জিনিস পত্র।--কিন্তু এই পাহাড়টাতে যে সাপ আছেন বলছেন--
----আর বেশি নেই।আমি প্রায় ধরে ফেলেছি।আর পাহাড়, জঙ্গলে সাপতো থাকবেই--
ভাস্বতী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো আপনার বাড়ীতে কে কে আছেন?
লোকটি না শোনার ভান করে মাথা নিচু করে খেতে থাকলো।লম্বা চওড়া কাঁধ- স্যান্ডোর ফাঁক দিয়ে হাতের স্ফীত পেশী দেখা দিচ্ছে।যেন মনে হচ্ছে লোকটা নিজেকে কঠোর করে রেখেছে।
ভাস্বতী উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে।জিম করা পর্দার নায়কদের মত নয়--শরীরের বাঁধন যেন তার খানিকটা জন্মগত খানিকটা পাহাড়ে ওঠা নামার ফসল।এরকম পুরুষের গায়ের রং তামাটেই মানায়।
লোকটি বোধ হয় বুঝতে পারলো ভাস্বতী এখনো অপেক্ষা করছে তার উত্তরের জন্য।
----এখন আর কেউ নেই।বাবা ছিলেন মারা গেছেন।
----মা?
----এক বছর বয়সে মারা গেছেন।
----এরকম আর কতদিন থাকবেন?
----কোনো পরিকল্পনা নেই--যতদিন চলে---
ভাস্বতী লোকটির চোখ খোঁজার চেষ্টা করে।
মাত্র একবছরে মা হারানোর কথা এত নিষ্প্রাণ গলায় বলে কি করে?মাতৃস্নেহে বঞ্চিত পুরুষরাই কি এরকম নির্জন পাহাড়ে সাপ ধরার কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে।
রঞ্জন তাকিয়ে বলল ওটা কি সতী!
একটা পাহাড়ী ব্যাঙ।মেটে রঙের তেলতেলে।
লোকটা বলল এবার মজা দেখুন--খাঁচায় সাপ আছে জেনেও ব্যাঙটি সেদিকে যাবে।
ব্যাঙটা সত্যি সত্যিই খাঁচার দিকে লাফিয়ে গেল।অমনি বড় সাপটা ফণা উঁচিয়ে ফোঁস করে উঠলো।
ব্যাঙটা লাফিয়ে উঠলো।লোকটা একটা লাঠি দিয়ে ব্যাঙটা খাঁচায় ছুড়ে দিল।সাপটা ধরতে পারলো না,কিন্তু ছোঁবল দিল।ব্যাঙটা উল্টে উৎপটাং হয়ে পড়লো।লোকটি হেসে উঠলো।লাঠি দিয়ে আবার ছুঁড়ে দিতে যেতেই ভাস্বতী বলল করছেন কি?
----লোকটি শুনলো না।খাঁচার মধ্যে ব্যাঙটিকে চেপে ধরতে যায়।
ভাস্বতী লোকটির হাত চেপে কাঠিটা সরিয়ে দিয়ে বলল কি হচ্ছে কি? ছেড়ে দিন?আপনার কি একটু ইয়ে নেই?
সামান্য একটু অবসর পেয়েই ব্যাঙটি লাফাতে শুরু করলো।লোকটি পা দিয়ে সেটাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বলল যাঃ!
ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল আপনি বেচারা সাপটাকে খেতে দিলেন না।এমন বিচলিত হচ্ছিলেন কেন?এটাই জীবজগতের নিয়ম!
----তবু চোখের সামনে দেখতে ভালো লাগে না।
----আপনারা শহরে থাকেন।আপনাদের এসব চোখে পড়ে না।ঘন জঙ্গলে এসব অহরহ হচ্ছে।
সুন্দর পাখিটাকে কে গাছ থেকে পেড়ে খাচ্ছে সাপ। আমি অপেক্ষা করলাম।সাপটা তক্ষুনি ধরলাম না।
----আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন?
----হ্যাঁ, এটাইতো নিয়ম।এরপর তো সাপটা কবে খেতে পাবে ঠিক নেই।শুনতে আপনার খারাপ লাগছে?
----হ্যাঁ।
----এসব তো আপনাদের শহরেও হয়।কিন্তু একটু আব্রু থাকে।সেখানেও তো একদল মানুষকে তিলতিল করে মেরে একদল মানুষ উপভোগ করে--তাই না? বিশেষত সর্বত্র সাপ আর ব্যাঙ এর ব্যাপারটা চলছে,, কিন্তু সেটা সহজে বুঝতে দেওয়া হয় না; বিশেষত মেয়েদের--
রঞ্জন বলল ঠিকই বলেছেন এরকম চলে আসছে।
খাওয়ার শেষে বলা স্বত্বেও লোকটি প্লেট গুলো ধুতে বাইরে চলে গেল।
রঞ্জন বলল আমরা এখানে পেট পুরে খেলাম।ওই সাপগুলো অনাহারে থাকলো।
ভাস্বতী বলল আমার এখানে আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না।
----কেন?
----আমার এক্ষুনি এখন থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করছে।
----একটা ব্যাঙ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল?
----চুপ করো তো একটু !
----তুমি যে বলেছিলে এরকম একটা জঙ্গলে বাড়ী বানিয়ে থাকবে?
----উনি বোধ হয় ভেবেছিলেন সব বনই তপোবনের মত শান্ত স্নিগ্ধ জায়গা।কিছুক্ষনের জন্য এলে তাই মনে হতে পারে---কিন্তু জঙ্গল মানেই হিংসার রাজত্ব।দেখলেন না একটা সামান্য নদী পর্যন্ত কতটা বিপজ্জনক হতে পারে!
সে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল।অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা।
রঞ্জন বলল এক্ষুণি কি শুয়ে পড়া হবে?
----কি করবেন? চাইলে একটু ঘুরে আসতে পারেন।তবে না যাওয়াই ভালো।বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে আছে।আবার পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙতে পারে।
----আপনি অন্যদিন এই সময় কি করেন?
----কি করি? খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুম।আলো থাকলে জঙ্গলের হিংস্রতাকে পর্যবেক্ষণ করি।কখনো চাঁদের আলোয় জঙ্গল দেখেছেন?
----কিন্ত এখানে তো তেমন হিংস্র প্রাণী নেই।
----নেই।তবে এই পাহাড়ের পিছনে একটা লাগোয়া পাহাড় আছে সেখানে কয়েকটা মহুয়া গাছ আছে,ভাল্লুকের এক আধবার যাতায়ত দেখেছি।
----ভাল্লুক! তবে তারা তো এ পাহাড়েও আসতে পারে?
----আসতে পারে।তবে কখনো এ পাহাড়ে আসতে দেখিনি।
ভাস্বতী বলল আপনি তো গান জানেন?
----আমি?
---- হ্যাঁ ওই যে 'যেদিন সুনীল জলধি হইতে...'
---হা হা।সে গান এই বোবা পাহাড় আর গাছপালা সহ্য করতে পারে কোনো সভ্য মানুষের কানে সহ্য হবে না।আপনি জানেন না?
ভাস্বতী রঞ্জনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল---ইনি জানেন।
ভাস্বতী নিজে রবীন্দ্রসংগীতে পারদর্শী।কিন্তু রঞ্জনেরও গানের গলা খারাপ নয়।
রাত বাড়তে থাকে।লোকটি বলে এবার শোবার ব্যাবস্থা করা যাক।
দুটিমাত্র খাট---কিন্তু ফোল্ডিং খাট এমনই ছোট আর গড়ানে ধরনের হয় তাতে দুজনের শোয়া সম্ভব নয়।
রঞ্জন তবু সেই প্রস্তাব করলো এক খাটে আমরা দুজনে শুই অন্য খাটটা আপনি নিন।
লোকটি বলল একটি খাটে দুজন? এই একটি খাটে দুটো বাচ্চাও ঘুমাতে পারবে না।
----সে আমরা ঠিক চালিয়ে নেব।
----অবাস্তব কথা বলে লাভ নেই।তার চেয়ে না শোওয়া ভালো।আপনারা বরং একটি খাট নিন আমি রান্নার জায়গাটায় জায়গা করে শুয়ে যাবো।
রঞ্জনের উন্নত হৃদয় এই স্বার্থপর ব্যাবস্থায় কিছুতেই সম্মত হতে পারে না।
রঞ্জন বলে তারচেয়ে বরং এক কাজ করি আমরা তিনজনেই নিচে বিছানা করে শুতে পারি।
রঞ্জনের কথায় একটা আতিশয্যের সুর আছে।ভাস্বতী তাকালো রঞ্জনের দিকে।ওরকম ভাবে শুতে ভাস্বতীর আপত্তি নেই।সামাজিক রীতি সে গ্রাহ্য করে না।কিন্তু লোকটির হাত? ওই দুরন্ত হাতকে কে রুখবে?
রঞ্জনকে দুঃখ দেওয়া হবে তাতে।
সে মানিনীর মতন গলায় আনুনাসিক সুর ফুটিয়ে বলল আমি বাবা মাটিতে শুতে পারবো না।আবার যদি ব্যাঙ-ট্যাঙ আসে---
রঞ্জন লোকটির দিকে তাকিয়ে পুরুষদের নিজস্ব ধরনের সহাস্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো,যার অর্থ মেয়েদের নিয়ে আর পারা যায় না।
লোকটি বলল ঠিক আছে এ ঘরের খাট দুটোতে আপনারা শোবেন।আমি অন্যঘরে শোওয়ার ব্যাবস্থা করছি।
----ওই সাপের ঘরে আপনি শোবেন?
----মেছনির যেমন মাছের গন্ধ ছাড়া ঘুম আসে না।তেমনই আমার সাপের ফোঁসফাঁস ছাড়া ঘুম আসে না।
অনেক কথা বার্তার পরও লোকটি মেনে নিল না।সেই যেন শ্রেষ্ঠ উপায় বের করেছে।
এ যদি কোনো ডাকবাংলোর চৌকিদার হত তাহলে রঞ্জন এখুনি একে হাজার টাকার বখশিশ দিয়ে দিত।কিন্তু বিনিময়ে একে এখন কিছুই দেওয়া যাচ্ছে না--রঞ্জন মনে মনে বিব্রত বোধ করলো।
ভাস্বতী ততক্ষনে একটা খাটে শুয়ে পড়েছে।আরাম করে দেহ ছড়িয়ে বলে উঠলো আঃ।
রঞ্জন বলল সতী তুমি প্লিজ ওর বিছানাটা পেতে দিয়ে এসো।
ভাস্বতী বলল আমার এখন উঠতে ইচ্ছা করছে না।
রঞ্জনের ভদ্রতাবোধ এতো বেশি যে সে লোকটির কাছে কৃতজ্ঞতার বোঝায় কিন্তু কিন্তু হয়ে আছে।
সে বলল এরকম কোরো না।ছেলেটি এতকিছু করেছে আমাদের জন্য---এটা না করলে খারাপ দেখায়।
ভাস্বতী আর দ্বিরুক্তি না করে তোষক আর বালিশ নিয়ে চলে এলো অন্যঘরে।
লোকটি ততক্ষনে জায়গাটা সাফসূতরো করে ফেলেছে।
ভাস্বতী বলল সরুন আমি বিছানা করে দিচ্ছি।
হাঁটু গেড়ে বসে ভাস্বতী বিছানাটা ঠিক করছে।লোকটি খুব আস্তে আস্তে বলল আমার বিছানায় কোনো দিন আপনার মত লোকের হাতের ছোঁয়া লাগবে--বিশ্বাসই করতে পারছি না।
ভাস্বতী মুখ না ফিরিয়ে বলল এবার বিয়ে করলে পারেন?
----কেউ এখানে আসবে না।আপনি শুধু এসে পড়েছেন।
তারপর লোকটি ভাস্বতীর চিবুক ছুঁয়ে বলল আপনি কি সুন্দর ! ভাস্বতী মুখটা সরিয়ে নিল।
লোকটি তবু ভাস্বতীর হাতের উপর হাত রেখে বলল এমন সুন্দর আঙ্গুল--এরকম ছবির মতন হাত।
যেন লোকটি ভাস্বতীর অনেকদিনের চেনা।
লোকটি তার শক্ত লোহার মত দৃঢ় হাতখানা ভাস্বতীর নরম গালে রেখে বলল কি সুন্দর ! কতদিন এমন সুন্দর কিছু দেখিনি।
যে কোন মুহূর্তে রঞ্জন এ ঘরে আসতে পারে।ভাস্বতী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো।লোকটি হাঁটু গেড়ে বসে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্বতীর উরু দুটোকে জড়িয়ে রাখলো।যেন কোনো ক্রীতদাস রাজকুমারীর কাছে প্রাণভিক্ষা করছে।ভাস্বতী ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে দর্পের সঙ্গে চলে গেল পাশের ঘরে।
দুটি ঘরেই দরজা আছে বাইরের দিকে।দুটি ঘরের মাঝখানের দরজায় কোনো পাল্লা নেই।তাই বন্ধ করার কোনো প্রশ্ন আসে না।
যে যার ঘরের বিছানায় শুয়ে দু ঘর থেকে গল্প করতে থাকলো।
হ্যাজাকটি মৃদু করে দিল লোকটি।রঞ্জন আর ভাস্বতীর খাট ঘরের দুপাশে রাখা।মাঝে ভাস্বতীর শাড়িটা মেলে রাখা আছে দড়িতে।ফলে ওরা তিনজনেই তিনটি আধার দ্বারা আড়াল করা।কেউ কাউকে দেখতে মেলে না।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করলো আপনি লাস্ট কবে কলকাতা গিয়েছিলেন?
----সতেরো বছর বয়সে।তখন একবার বাড়ী থেকে পালিয়েছিলাম।কলকাতা আমার ভালো লাগেনি।
----সেটা বুঝতে পারছি।কারন আপনি কলকাতার কথা একবারও জিজ্ঞেস করেননি।সব প্রবাসী বাঙালিরাই জিজ্ঞেস করে।
----আমি ঠিক বাঙালীও তো নই।
----আপনি ইউনিক।এখন দেখছি আপনি এখানে বেশ ভালোই আছেন।আমাদেরও আজকাল কলকাতা ভালো লাগে না।যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছে--তাই সুযোগ পেলে একবার বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছা হয়।
রঞ্জন আর ভাস্বতীর খাটদুটো দুপাশে--অনায়াসেই দুটো খাট জুড়ে শোওয়া যেত।এ চিন্তা রঞ্জনের মাথায়ও এসেছিল--কিন্তু পাশের ঘরে একজনকে নীচে ঘুমোতে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী কাছকাছি শোওয়ার মধ্যে একটা লজ্জার ব্যাপার আছে।
হ্যাজাকের অস্পষ্ট আলো থাকলেও ভাস্বতীকে রঞ্জনের খাট থেকে ভালো করে দেখা যায় না।
ভাস্বতী চুপচাপ শুয়ে আছে।তার চোখে ঘুম আসে না।খাট থেকে ফাঁকা জায়গাটা দেখা যায়।যে খাটটা থেকে দেখা যায় ভাস্বতী সেই খাটটাই ইচ্ছা করে নিয়েছে।সে সর্বক্ষণ তাকিয়ে আছে সেই দিকে।
কথাবার্তা থেমে যায়।চারিদিকের নিস্তব্ধতা টের পাওয়া যায়।যেন মনে হয় অরণ্যে গভীর রাত্রি থমকে গেছে।
একটুক্ষণ পরেই শোনা গেল রঞ্জনের নাসিকাধ্বনি।পাশের ঘরেও চুপচাপ।ভাস্বতীর তবু ঘুম আসে না।সে যে কেন পাশের ঘরে তাকিয়ে রয়েছে,তা সে নিজেও জানে না।
একসময় দেখলো অন্ধকারে সেই ফাঁকা জায়গায় একটা মনুষ্যমুর্তি।
ভাস্বতী প্রথমে ভাবলো চোখের ভুল।পরক্ষনেই দেখলো না সত্যিই কেউ নেই।পাশের ঘরে কেবলই সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ।
ভাস্বতী কি এরকমই কিছু দেখবার জন্য প্রতীক্ষা করেছিল এতক্ষন?প্রতীক্ষা নাকি আশঙ্কা?
হালকা আলো আর অন্ধকারে চেয়ে থাকলো অনেকক্ষন।এরকম ভাবেই মানুষ ভূত দেখে।সত্যিই চোখের ভুল।
ভাস্বতী এবার পেছন ফিরে শুলো।
তন্দ্রার ঘোরে ছোট ছোট স্বপ্ন।...একটা ফুটফুটে বাচ্চা সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে--দুলে দুলে হাঁটছে..ইস কি মিষ্টি কি মিষ্টি- -কার ছেলে?এ কাদের ছেলে? ভাস্বতী দু হাত বাড়িয়ে ডাকলো আয় আয়...'
দ্বিতীয় স্বপ্ন--তার পাশে কে যেন শুয়ে আছে..মানুষতো নয়, একটা মোটা ময়াল সাপ,না পাইথন।যে সাপটা ধরা পড়েনি এখন সেটাই লুকিয়ে লুকিয়ে তার বিছানায় উঠে এসেছে।ভাস্বতীর গা দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে,নড়তে পারছে না। যদি নড়তে গেলে কামড়ে দেয়...সাপটা তাকে পেঁচিয়ে ধরছে...
কত ঘন্টা,কত মিনিট বা কত যুগ কেটে গেল কে জানে?ভাস্বতী তা জানে না।একটু তন্দ্রা এসেছিল,রঞ্জনের নাক ডাকার শব্দে তা ভেঙে গেল।অমনি ভাস্বতী দুই ঘরের দরজার মুখে তাকালো।একটি মনুষ্য অবয়বের রেখা সেখানে দাঁড়িয়ে।সত্যি? না চোখের ভুল?
ভাস্বতী কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।ভাস্বতী চোখের পাতা বুজলো আবার খুলল।তখনও ছায়ামুর্তিটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ভাস্বতী পাশ ফিরলো।সে আর ওদিকে তাকাবে না।
কিন্তু এভাবে কি থাকা যায়?যদি সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে! রঞ্জনকে ডাকতে হবে।এমনি ডাকলে রঞ্জনের ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা কম।
ভাস্বতী আবার সেদিকে না তাকিয়ে থাকতে পারলো না।তখনো ছায়ামুর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে।এতে কি চোখের ভুল হতে পারে?মনে হল এবার ছায়ামুর্তিটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
ছায়ামুর্তিটি এগিয়ে আসলো তার দিকে।তার হাতে পুরুষের স্পর্শ।পুরুষটি যে রঞ্জন নয় সে বুঝতে পারলো।ওপাশের খাটে রঞ্জনের ঘুমন্ত নিশ্বাস।
পুরুষটি হাত ধরে ভাস্বতীকে টানলো।সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মুহূর্ত মাত্র সময় লাগলো ভাস্বতীর।মৃত্যুর আগেও মানুষ এত দ্রত চিন্তা করে না।
ভাস্বতী যদি চেঁচিয়ে ওঠে? তাহলে রঞ্জন কি করবে? নিজের স্ত্রীর পাশে পরপুরুষকে দেখলে!-কোমর থেকে রিভলবার বের করে গুলি করবে?কিংবা তা যদি না হয়-দুজন পুরুষ পরস্পরকে সহ্য করতে না পেরে তুমুল যুদ্ধ করবে?
তাতে যদি একজন মারা যায়?যদি রঞ্জন...?
নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে এলো ভাস্বতী।লোকটি তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।এক হাতে তার রাইফেল ধরা।
ভাস্বতী ঘুমন্ত রঞ্জনের দিকে একপলক তাকালো।লোকটিকে একবারও বাধা দিল না,কোনো কথা বললো না।পূর্ব নির্দিষ্ট অভিসারের মতন চলে এলো পাশের ঘরে।সেখান থেকে বাইরে।আকাশ অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে।আকাশের জোৎস্নার উজ্জ্বল প্রভা ছড়িয়ে পড়েছে বনে বনান্তরে।এই রকম জোৎস্না রাতের কথাই কি লোকটি বলেছিল?
রাইফেলটা পাথরে ঠেস দিয়ে লোকটি ভাস্বতীর দুহাত ধরে দাঁড়ালো।তার চোখ দুটি যেন হীরের মত জ্বলছে...কিংবা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত।
ভাস্বতী খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো কি চান?
লোকটি উত্তেজনাজনিত ভাঙা গলায় বলল আমি আপনাকে চাই।
----কেন?
----আমি কখনো সুন্দর কিছু পাইনি।
----এইরকম ভাবে কি পাওয়া যায়?
----কি রকম ভাবে পেতে হয় জানি না।আমাকে তো কেউ নিজের থেকে কিছু দেবে না।তাই আমার যাকে প্রয়োজন আমি জোর করে কেড়ে নেব।
----এখন বুঝতে পারছি আমি সুন্দর-টুন্দর কিছু না,কেবল রক্ত মাংস।
----ওসব আমি বুঝি না।আপনাকে আমার এখনি চাই।দরকার হলে আপনার স্বামীকে খুন পর্যন্ত করতে পারি।
----এভাবে কি কোনো মেয়ে কে পাওয়া যায়?
----কি ভাবে জানি না।আমি কি জীবনে কিছুই পাবো না?
----গোড়া থেকেই কি আপনার ওরকম উদ্দেশ্য ছিল?
----তা যদি থাকতো অনেক আগেই আমি আপনার স্বামীকে খুন করে ফেলতাম।
----আমি জানি,আপনি ওরকম কিছু করবেন না।
----কেন?
----আপনাকে ওরকম মানায় না।জন্তু জানোয়াররা ওরকম করে।
----আপনাকে আমি বলিনি আমার ডাকনাম পশু?
----তা হোক,আপনার ভালো নাম মানুষ,মানুষ এরকম করে না।
----করে না?আপনি মানুষকে চেনেন না তাহলে?সারা পৃথিবীতে কি হচ্ছে তাহলে?মানুষের চেয়ে হিংস্র কি কেউ আছে?
----সে হোক।সব মানুষই ভালো হবার চেষ্টা করে।
----এর মধ্যে ভালো মন্দ কি দেখছেন? এই পৃথিবীতে যারা শুধু বঞ্চিত হয়ে থাকে আমি তাদের একজন।আমি আর বঞ্চিত থাকবো না।আমি চাই-আমি চাই-আমি চাই--
আপনার এই অরণ্য জীবন আর পাহাড় কিন্তু চমৎকার লাগছে।
রঞ্জন থেমে আবার বলল শহরের জীবন আমাদেরও একঘেয়ে লাগে।মাঝে মাঝে যদি এরকম জায়গায় এসে থাকা যায়।বিদেশের ছেলে মেয়েরা তো প্রায়ই যায়--একটা তাঁবু সামান্য নিয়ে আর কিছু জিনিস পত্র।--কিন্তু এই পাহাড়টাতে যে সাপ আছেন বলছেন--
----আর বেশি নেই।আমি প্রায় ধরে ফেলেছি।আর পাহাড়, জঙ্গলে সাপতো থাকবেই--
ভাস্বতী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো আপনার বাড়ীতে কে কে আছেন?
লোকটি না শোনার ভান করে মাথা নিচু করে খেতে থাকলো।লম্বা চওড়া কাঁধ- স্যান্ডোর ফাঁক দিয়ে হাতের স্ফীত পেশী দেখা দিচ্ছে।যেন মনে হচ্ছে লোকটা নিজেকে কঠোর করে রেখেছে।
ভাস্বতী উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে।জিম করা পর্দার নায়কদের মত নয়--শরীরের বাঁধন যেন তার খানিকটা জন্মগত খানিকটা পাহাড়ে ওঠা নামার ফসল।এরকম পুরুষের গায়ের রং তামাটেই মানায়।
লোকটি বোধ হয় বুঝতে পারলো ভাস্বতী এখনো অপেক্ষা করছে তার উত্তরের জন্য।
----এখন আর কেউ নেই।বাবা ছিলেন মারা গেছেন।
----মা?
----এক বছর বয়সে মারা গেছেন।
----এরকম আর কতদিন থাকবেন?
----কোনো পরিকল্পনা নেই--যতদিন চলে---
ভাস্বতী লোকটির চোখ খোঁজার চেষ্টা করে।
মাত্র একবছরে মা হারানোর কথা এত নিষ্প্রাণ গলায় বলে কি করে?মাতৃস্নেহে বঞ্চিত পুরুষরাই কি এরকম নির্জন পাহাড়ে সাপ ধরার কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে।
রঞ্জন তাকিয়ে বলল ওটা কি সতী!
একটা পাহাড়ী ব্যাঙ।মেটে রঙের তেলতেলে।
লোকটা বলল এবার মজা দেখুন--খাঁচায় সাপ আছে জেনেও ব্যাঙটি সেদিকে যাবে।
ব্যাঙটা সত্যি সত্যিই খাঁচার দিকে লাফিয়ে গেল।অমনি বড় সাপটা ফণা উঁচিয়ে ফোঁস করে উঠলো।
ব্যাঙটা লাফিয়ে উঠলো।লোকটা একটা লাঠি দিয়ে ব্যাঙটা খাঁচায় ছুড়ে দিল।সাপটা ধরতে পারলো না,কিন্তু ছোঁবল দিল।ব্যাঙটা উল্টে উৎপটাং হয়ে পড়লো।লোকটি হেসে উঠলো।লাঠি দিয়ে আবার ছুঁড়ে দিতে যেতেই ভাস্বতী বলল করছেন কি?
----লোকটি শুনলো না।খাঁচার মধ্যে ব্যাঙটিকে চেপে ধরতে যায়।
ভাস্বতী লোকটির হাত চেপে কাঠিটা সরিয়ে দিয়ে বলল কি হচ্ছে কি? ছেড়ে দিন?আপনার কি একটু ইয়ে নেই?
সামান্য একটু অবসর পেয়েই ব্যাঙটি লাফাতে শুরু করলো।লোকটি পা দিয়ে সেটাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বলল যাঃ!
ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল আপনি বেচারা সাপটাকে খেতে দিলেন না।এমন বিচলিত হচ্ছিলেন কেন?এটাই জীবজগতের নিয়ম!
----তবু চোখের সামনে দেখতে ভালো লাগে না।
----আপনারা শহরে থাকেন।আপনাদের এসব চোখে পড়ে না।ঘন জঙ্গলে এসব অহরহ হচ্ছে।
সুন্দর পাখিটাকে কে গাছ থেকে পেড়ে খাচ্ছে সাপ। আমি অপেক্ষা করলাম।সাপটা তক্ষুনি ধরলাম না।
----আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন?
----হ্যাঁ, এটাইতো নিয়ম।এরপর তো সাপটা কবে খেতে পাবে ঠিক নেই।শুনতে আপনার খারাপ লাগছে?
----হ্যাঁ।
----এসব তো আপনাদের শহরেও হয়।কিন্তু একটু আব্রু থাকে।সেখানেও তো একদল মানুষকে তিলতিল করে মেরে একদল মানুষ উপভোগ করে--তাই না? বিশেষত সর্বত্র সাপ আর ব্যাঙ এর ব্যাপারটা চলছে,, কিন্তু সেটা সহজে বুঝতে দেওয়া হয় না; বিশেষত মেয়েদের--
রঞ্জন বলল ঠিকই বলেছেন এরকম চলে আসছে।
খাওয়ার শেষে বলা স্বত্বেও লোকটি প্লেট গুলো ধুতে বাইরে চলে গেল।
রঞ্জন বলল আমরা এখানে পেট পুরে খেলাম।ওই সাপগুলো অনাহারে থাকলো।
ভাস্বতী বলল আমার এখানে আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না।
----কেন?
----আমার এক্ষুনি এখন থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করছে।
----একটা ব্যাঙ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল?
----চুপ করো তো একটু !
----তুমি যে বলেছিলে এরকম একটা জঙ্গলে বাড়ী বানিয়ে থাকবে?
----উনি বোধ হয় ভেবেছিলেন সব বনই তপোবনের মত শান্ত স্নিগ্ধ জায়গা।কিছুক্ষনের জন্য এলে তাই মনে হতে পারে---কিন্তু জঙ্গল মানেই হিংসার রাজত্ব।দেখলেন না একটা সামান্য নদী পর্যন্ত কতটা বিপজ্জনক হতে পারে!
সে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল।অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা।
রঞ্জন বলল এক্ষুণি কি শুয়ে পড়া হবে?
----কি করবেন? চাইলে একটু ঘুরে আসতে পারেন।তবে না যাওয়াই ভালো।বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে আছে।আবার পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙতে পারে।
----আপনি অন্যদিন এই সময় কি করেন?
----কি করি? খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুম।আলো থাকলে জঙ্গলের হিংস্রতাকে পর্যবেক্ষণ করি।কখনো চাঁদের আলোয় জঙ্গল দেখেছেন?
----কিন্ত এখানে তো তেমন হিংস্র প্রাণী নেই।
----নেই।তবে এই পাহাড়ের পিছনে একটা লাগোয়া পাহাড় আছে সেখানে কয়েকটা মহুয়া গাছ আছে,ভাল্লুকের এক আধবার যাতায়ত দেখেছি।
----ভাল্লুক! তবে তারা তো এ পাহাড়েও আসতে পারে?
----আসতে পারে।তবে কখনো এ পাহাড়ে আসতে দেখিনি।
ভাস্বতী বলল আপনি তো গান জানেন?
----আমি?
---- হ্যাঁ ওই যে 'যেদিন সুনীল জলধি হইতে...'
---হা হা।সে গান এই বোবা পাহাড় আর গাছপালা সহ্য করতে পারে কোনো সভ্য মানুষের কানে সহ্য হবে না।আপনি জানেন না?
ভাস্বতী রঞ্জনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল---ইনি জানেন।
ভাস্বতী নিজে রবীন্দ্রসংগীতে পারদর্শী।কিন্তু রঞ্জনেরও গানের গলা খারাপ নয়।
রাত বাড়তে থাকে।লোকটি বলে এবার শোবার ব্যাবস্থা করা যাক।
দুটিমাত্র খাট---কিন্তু ফোল্ডিং খাট এমনই ছোট আর গড়ানে ধরনের হয় তাতে দুজনের শোয়া সম্ভব নয়।
রঞ্জন তবু সেই প্রস্তাব করলো এক খাটে আমরা দুজনে শুই অন্য খাটটা আপনি নিন।
লোকটি বলল একটি খাটে দুজন? এই একটি খাটে দুটো বাচ্চাও ঘুমাতে পারবে না।
----সে আমরা ঠিক চালিয়ে নেব।
----অবাস্তব কথা বলে লাভ নেই।তার চেয়ে না শোওয়া ভালো।আপনারা বরং একটি খাট নিন আমি রান্নার জায়গাটায় জায়গা করে শুয়ে যাবো।
রঞ্জনের উন্নত হৃদয় এই স্বার্থপর ব্যাবস্থায় কিছুতেই সম্মত হতে পারে না।
রঞ্জন বলে তারচেয়ে বরং এক কাজ করি আমরা তিনজনেই নিচে বিছানা করে শুতে পারি।
রঞ্জনের কথায় একটা আতিশয্যের সুর আছে।ভাস্বতী তাকালো রঞ্জনের দিকে।ওরকম ভাবে শুতে ভাস্বতীর আপত্তি নেই।সামাজিক রীতি সে গ্রাহ্য করে না।কিন্তু লোকটির হাত? ওই দুরন্ত হাতকে কে রুখবে?
রঞ্জনকে দুঃখ দেওয়া হবে তাতে।
সে মানিনীর মতন গলায় আনুনাসিক সুর ফুটিয়ে বলল আমি বাবা মাটিতে শুতে পারবো না।আবার যদি ব্যাঙ-ট্যাঙ আসে---
রঞ্জন লোকটির দিকে তাকিয়ে পুরুষদের নিজস্ব ধরনের সহাস্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো,যার অর্থ মেয়েদের নিয়ে আর পারা যায় না।
লোকটি বলল ঠিক আছে এ ঘরের খাট দুটোতে আপনারা শোবেন।আমি অন্যঘরে শোওয়ার ব্যাবস্থা করছি।
----ওই সাপের ঘরে আপনি শোবেন?
----মেছনির যেমন মাছের গন্ধ ছাড়া ঘুম আসে না।তেমনই আমার সাপের ফোঁসফাঁস ছাড়া ঘুম আসে না।
অনেক কথা বার্তার পরও লোকটি মেনে নিল না।সেই যেন শ্রেষ্ঠ উপায় বের করেছে।
এ যদি কোনো ডাকবাংলোর চৌকিদার হত তাহলে রঞ্জন এখুনি একে হাজার টাকার বখশিশ দিয়ে দিত।কিন্তু বিনিময়ে একে এখন কিছুই দেওয়া যাচ্ছে না--রঞ্জন মনে মনে বিব্রত বোধ করলো।
ভাস্বতী ততক্ষনে একটা খাটে শুয়ে পড়েছে।আরাম করে দেহ ছড়িয়ে বলে উঠলো আঃ।
রঞ্জন বলল সতী তুমি প্লিজ ওর বিছানাটা পেতে দিয়ে এসো।
ভাস্বতী বলল আমার এখন উঠতে ইচ্ছা করছে না।
রঞ্জনের ভদ্রতাবোধ এতো বেশি যে সে লোকটির কাছে কৃতজ্ঞতার বোঝায় কিন্তু কিন্তু হয়ে আছে।
সে বলল এরকম কোরো না।ছেলেটি এতকিছু করেছে আমাদের জন্য---এটা না করলে খারাপ দেখায়।
ভাস্বতী আর দ্বিরুক্তি না করে তোষক আর বালিশ নিয়ে চলে এলো অন্যঘরে।
লোকটি ততক্ষনে জায়গাটা সাফসূতরো করে ফেলেছে।
ভাস্বতী বলল সরুন আমি বিছানা করে দিচ্ছি।
হাঁটু গেড়ে বসে ভাস্বতী বিছানাটা ঠিক করছে।লোকটি খুব আস্তে আস্তে বলল আমার বিছানায় কোনো দিন আপনার মত লোকের হাতের ছোঁয়া লাগবে--বিশ্বাসই করতে পারছি না।
ভাস্বতী মুখ না ফিরিয়ে বলল এবার বিয়ে করলে পারেন?
----কেউ এখানে আসবে না।আপনি শুধু এসে পড়েছেন।
তারপর লোকটি ভাস্বতীর চিবুক ছুঁয়ে বলল আপনি কি সুন্দর ! ভাস্বতী মুখটা সরিয়ে নিল।
লোকটি তবু ভাস্বতীর হাতের উপর হাত রেখে বলল এমন সুন্দর আঙ্গুল--এরকম ছবির মতন হাত।
যেন লোকটি ভাস্বতীর অনেকদিনের চেনা।
লোকটি তার শক্ত লোহার মত দৃঢ় হাতখানা ভাস্বতীর নরম গালে রেখে বলল কি সুন্দর ! কতদিন এমন সুন্দর কিছু দেখিনি।
যে কোন মুহূর্তে রঞ্জন এ ঘরে আসতে পারে।ভাস্বতী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো।লোকটি হাঁটু গেড়ে বসে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্বতীর উরু দুটোকে জড়িয়ে রাখলো।যেন কোনো ক্রীতদাস রাজকুমারীর কাছে প্রাণভিক্ষা করছে।ভাস্বতী ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে দর্পের সঙ্গে চলে গেল পাশের ঘরে।
দুটি ঘরেই দরজা আছে বাইরের দিকে।দুটি ঘরের মাঝখানের দরজায় কোনো পাল্লা নেই।তাই বন্ধ করার কোনো প্রশ্ন আসে না।
যে যার ঘরের বিছানায় শুয়ে দু ঘর থেকে গল্প করতে থাকলো।
হ্যাজাকটি মৃদু করে দিল লোকটি।রঞ্জন আর ভাস্বতীর খাট ঘরের দুপাশে রাখা।মাঝে ভাস্বতীর শাড়িটা মেলে রাখা আছে দড়িতে।ফলে ওরা তিনজনেই তিনটি আধার দ্বারা আড়াল করা।কেউ কাউকে দেখতে মেলে না।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করলো আপনি লাস্ট কবে কলকাতা গিয়েছিলেন?
----সতেরো বছর বয়সে।তখন একবার বাড়ী থেকে পালিয়েছিলাম।কলকাতা আমার ভালো লাগেনি।
----সেটা বুঝতে পারছি।কারন আপনি কলকাতার কথা একবারও জিজ্ঞেস করেননি।সব প্রবাসী বাঙালিরাই জিজ্ঞেস করে।
----আমি ঠিক বাঙালীও তো নই।
----আপনি ইউনিক।এখন দেখছি আপনি এখানে বেশ ভালোই আছেন।আমাদেরও আজকাল কলকাতা ভালো লাগে না।যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছে--তাই সুযোগ পেলে একবার বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছা হয়।
রঞ্জন আর ভাস্বতীর খাটদুটো দুপাশে--অনায়াসেই দুটো খাট জুড়ে শোওয়া যেত।এ চিন্তা রঞ্জনের মাথায়ও এসেছিল--কিন্তু পাশের ঘরে একজনকে নীচে ঘুমোতে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী কাছকাছি শোওয়ার মধ্যে একটা লজ্জার ব্যাপার আছে।
হ্যাজাকের অস্পষ্ট আলো থাকলেও ভাস্বতীকে রঞ্জনের খাট থেকে ভালো করে দেখা যায় না।
ভাস্বতী চুপচাপ শুয়ে আছে।তার চোখে ঘুম আসে না।খাট থেকে ফাঁকা জায়গাটা দেখা যায়।যে খাটটা থেকে দেখা যায় ভাস্বতী সেই খাটটাই ইচ্ছা করে নিয়েছে।সে সর্বক্ষণ তাকিয়ে আছে সেই দিকে।
কথাবার্তা থেমে যায়।চারিদিকের নিস্তব্ধতা টের পাওয়া যায়।যেন মনে হয় অরণ্যে গভীর রাত্রি থমকে গেছে।
একটুক্ষণ পরেই শোনা গেল রঞ্জনের নাসিকাধ্বনি।পাশের ঘরেও চুপচাপ।ভাস্বতীর তবু ঘুম আসে না।সে যে কেন পাশের ঘরে তাকিয়ে রয়েছে,তা সে নিজেও জানে না।
একসময় দেখলো অন্ধকারে সেই ফাঁকা জায়গায় একটা মনুষ্যমুর্তি।
ভাস্বতী প্রথমে ভাবলো চোখের ভুল।পরক্ষনেই দেখলো না সত্যিই কেউ নেই।পাশের ঘরে কেবলই সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ।
ভাস্বতী কি এরকমই কিছু দেখবার জন্য প্রতীক্ষা করেছিল এতক্ষন?প্রতীক্ষা নাকি আশঙ্কা?
হালকা আলো আর অন্ধকারে চেয়ে থাকলো অনেকক্ষন।এরকম ভাবেই মানুষ ভূত দেখে।সত্যিই চোখের ভুল।
ভাস্বতী এবার পেছন ফিরে শুলো।
তন্দ্রার ঘোরে ছোট ছোট স্বপ্ন।...একটা ফুটফুটে বাচ্চা সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে--দুলে দুলে হাঁটছে..ইস কি মিষ্টি কি মিষ্টি- -কার ছেলে?এ কাদের ছেলে? ভাস্বতী দু হাত বাড়িয়ে ডাকলো আয় আয়...'
দ্বিতীয় স্বপ্ন--তার পাশে কে যেন শুয়ে আছে..মানুষতো নয়, একটা মোটা ময়াল সাপ,না পাইথন।যে সাপটা ধরা পড়েনি এখন সেটাই লুকিয়ে লুকিয়ে তার বিছানায় উঠে এসেছে।ভাস্বতীর গা দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে,নড়তে পারছে না। যদি নড়তে গেলে কামড়ে দেয়...সাপটা তাকে পেঁচিয়ে ধরছে...
কত ঘন্টা,কত মিনিট বা কত যুগ কেটে গেল কে জানে?ভাস্বতী তা জানে না।একটু তন্দ্রা এসেছিল,রঞ্জনের নাক ডাকার শব্দে তা ভেঙে গেল।অমনি ভাস্বতী দুই ঘরের দরজার মুখে তাকালো।একটি মনুষ্য অবয়বের রেখা সেখানে দাঁড়িয়ে।সত্যি? না চোখের ভুল?
ভাস্বতী কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।ভাস্বতী চোখের পাতা বুজলো আবার খুলল।তখনও ছায়ামুর্তিটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ভাস্বতী পাশ ফিরলো।সে আর ওদিকে তাকাবে না।
কিন্তু এভাবে কি থাকা যায়?যদি সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে! রঞ্জনকে ডাকতে হবে।এমনি ডাকলে রঞ্জনের ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা কম।
ভাস্বতী আবার সেদিকে না তাকিয়ে থাকতে পারলো না।তখনো ছায়ামুর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে।এতে কি চোখের ভুল হতে পারে?মনে হল এবার ছায়ামুর্তিটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
ছায়ামুর্তিটি এগিয়ে আসলো তার দিকে।তার হাতে পুরুষের স্পর্শ।পুরুষটি যে রঞ্জন নয় সে বুঝতে পারলো।ওপাশের খাটে রঞ্জনের ঘুমন্ত নিশ্বাস।
পুরুষটি হাত ধরে ভাস্বতীকে টানলো।সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মুহূর্ত মাত্র সময় লাগলো ভাস্বতীর।মৃত্যুর আগেও মানুষ এত দ্রত চিন্তা করে না।
ভাস্বতী যদি চেঁচিয়ে ওঠে? তাহলে রঞ্জন কি করবে? নিজের স্ত্রীর পাশে পরপুরুষকে দেখলে!-কোমর থেকে রিভলবার বের করে গুলি করবে?কিংবা তা যদি না হয়-দুজন পুরুষ পরস্পরকে সহ্য করতে না পেরে তুমুল যুদ্ধ করবে?
তাতে যদি একজন মারা যায়?যদি রঞ্জন...?
নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে এলো ভাস্বতী।লোকটি তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।এক হাতে তার রাইফেল ধরা।
ভাস্বতী ঘুমন্ত রঞ্জনের দিকে একপলক তাকালো।লোকটিকে একবারও বাধা দিল না,কোনো কথা বললো না।পূর্ব নির্দিষ্ট অভিসারের মতন চলে এলো পাশের ঘরে।সেখান থেকে বাইরে।আকাশ অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে।আকাশের জোৎস্নার উজ্জ্বল প্রভা ছড়িয়ে পড়েছে বনে বনান্তরে।এই রকম জোৎস্না রাতের কথাই কি লোকটি বলেছিল?
রাইফেলটা পাথরে ঠেস দিয়ে লোকটি ভাস্বতীর দুহাত ধরে দাঁড়ালো।তার চোখ দুটি যেন হীরের মত জ্বলছে...কিংবা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত।
ভাস্বতী খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো কি চান?
লোকটি উত্তেজনাজনিত ভাঙা গলায় বলল আমি আপনাকে চাই।
----কেন?
----আমি কখনো সুন্দর কিছু পাইনি।
----এইরকম ভাবে কি পাওয়া যায়?
----কি রকম ভাবে পেতে হয় জানি না।আমাকে তো কেউ নিজের থেকে কিছু দেবে না।তাই আমার যাকে প্রয়োজন আমি জোর করে কেড়ে নেব।
----এখন বুঝতে পারছি আমি সুন্দর-টুন্দর কিছু না,কেবল রক্ত মাংস।
----ওসব আমি বুঝি না।আপনাকে আমার এখনি চাই।দরকার হলে আপনার স্বামীকে খুন পর্যন্ত করতে পারি।
----এভাবে কি কোনো মেয়ে কে পাওয়া যায়?
----কি ভাবে জানি না।আমি কি জীবনে কিছুই পাবো না?
----গোড়া থেকেই কি আপনার ওরকম উদ্দেশ্য ছিল?
----তা যদি থাকতো অনেক আগেই আমি আপনার স্বামীকে খুন করে ফেলতাম।
----আমি জানি,আপনি ওরকম কিছু করবেন না।
----কেন?
----আপনাকে ওরকম মানায় না।জন্তু জানোয়াররা ওরকম করে।
----আপনাকে আমি বলিনি আমার ডাকনাম পশু?
----তা হোক,আপনার ভালো নাম মানুষ,মানুষ এরকম করে না।
----করে না?আপনি মানুষকে চেনেন না তাহলে?সারা পৃথিবীতে কি হচ্ছে তাহলে?মানুষের চেয়ে হিংস্র কি কেউ আছে?
----সে হোক।সব মানুষই ভালো হবার চেষ্টা করে।
----এর মধ্যে ভালো মন্দ কি দেখছেন? এই পৃথিবীতে যারা শুধু বঞ্চিত হয়ে থাকে আমি তাদের একজন।আমি আর বঞ্চিত থাকবো না।আমি চাই-আমি চাই-আমি চাই--