Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 149)

পরের দিন সন্ধ্যে ছ’টার পর সীমন্তিনী অফিস থেকে বাড়ি ফিরল। নবনীতা দরজা খুলে দিতেই সে একটু অবাক হল। রোজ অফিস থেকে ফিরে এসে ঘরে ঢোকবার সময় অর্চনা আর নবনীতা একসঙ্গে এসে দরজা খুলে দেয়। অর্চনা আসবার পরের দিনটি থেকেই এটা যেন একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। আজ নবনীতাকে একা দরজা খুলতে দেখে সীমন্তিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার নীতা? আজ তুমি একা দরজা খুললে! অর্চু কোথায়”?

নবনীতা দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সীমন্তিনীর কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “ঝগড়া করছে গো দিদি। এসো দেখবে এসো” বলতে বলতে সীমন্তিনীর হাত ধরে তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

সে ঘরটার দরজার কাছাকাছি আসতেই শুনতে পেল, অর্চু বলছে, “ভাই, তুই দিনে দিনে যত বড় হচ্ছিস ততই কিন্তু দুষ্টু আর হিংশুটে হয়ে উঠছিস। তোরা বাড়ির সকলেই তো চার বছর আগে থেকে দিদিভাইকে পেয়েছিস। আমি কি তেমন পেয়েছি বল? আমি তো তখন জানতুমও না যে আমাদের পরিবারে এমন এক দিদিভাই এসেছেন। মাত্র দেড় মাস আগেই তো দিদিভাইকে আমার জীবনে পেলুম। আর আজ তার কাছে এসে দুটো দিন থাকছি বলেই তুই বলছিস যে আমি তোর কাছ থেকে দিদিভাইকে কেড়ে নিচ্ছি”?

ভাইবোনের ভেতর মিষ্টি ঝগড়া হচ্ছে বুঝতে পেরে সীমন্তিনীরও বেশ মজা লাগল। সে নবনীতার একটা হাত ধরে চুপ থাকবার ইঙ্গিত করে তাকে টেনে নিজের ঘরে এসে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, “কতক্ষণ থেকে এমন ভাইবোনের ঝগড়া চলছে”?

নবনীতাও একটু হেসে চাপা গলায় বলল, “মিনিট দশেক তো হয়েছেই। ছ’টার সময় যে তার একটা ট্যাবলেট খেতে হবে সে’কথাও বুঝি ভুলে গেছে তোমার অর্চু সোনা। এই দ্যাখো তখন থেকে আমি তার ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন তাদের ফোন ঝগড়া শেষ হবে” বলে নিজের হাতের মুঠো খুলে দেখাল।

সীমন্তিনী নিজের কাঁধের ওপর থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ঘরের কোনার টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “থাক, কিচ্ছু বোল না ওকে। এমন ঝগড়ায় কোন ক্ষতি নেই। বরং ভাই বোনেদের সাথে এভাবে ও যত খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারবে এখন, ওর পক্ষে সেটা ততই ভাল হবে। তুমি বরং ট্যাবলেটটা আমার হাতে দাও। আজ আমি ওকে খাইয়ে দেব। তুমি গিয়ে লক্ষ্মীদির সাথে হাত মিলিয়ে চায়ের বন্দোবস্ত করো”।

নবনীতা সীমন্তিনীর হাতে ট্যাবলেটটা দিয়ে হাসিমুখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী ঘরে পড়ার পোশাক হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ভেজা ইউনিফর্ম গুলো বাইরের ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে অর্চনার ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে তাদের ঘরে গিয়ে দেখল, কিংশুক আর অর্চনার মিষ্টি ঝগড়া তখনও চলছে। সীমন্তিনী পা টিপে টিপে অর্চনার পেছনে গিয়ে তার হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিয়ে ফোনে বলল, “ব্যস, টাইম আপ হয়ে গেছে ভাই। এবার আমি এসে গেছি। তাই বড়দির সাথে কথা বলার পালা এবার আমার। তাই বাই বাই। তবে হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আর একটা আদরের চুমু রইল তোমার জন্যে” বলে দু’ঠোট এক করে চুমু খেল শব্দ করে।

অর্চনা একটু লজ্জা পেয়ে সীমন্তিনীর হাত ধরে বলল, “ওমা, দিদিভাই! তুমি কখন এসেছ এ ঘরে”?

সীমন্তিনী ফোনটা অর্চনার হাতে দিতে দিতে বলল, “অনেকক্ষণ। এতক্ষণ তোমাদের দু’ভাইবোনের ঝগড়া শুনছিলাম। কিন্তু ম্যাডাম, শুধু ঝগড়া করলেই তো চলবে না। ছ’টার সময় যে একটা ট্যাবলেট খেতে হবে, সে’ কথা ভুলে গেলে চলবে? নাও, আগে এটা খেয়ে নাও তো লক্ষ্মী মেয়ের মত”।

অর্চনা ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে জলের বোতলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “ভাইটা সত্যি দিনে দিনে খুব হিংশুটে হয়ে উঠছে গো দিদিভাই। মাত্র চারটে দিন হল আমি তোমার এখানে এসেছি। বলে কিনা আমি ওর দিদিভাইকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছি। আমাকে কাছে পেয়ে তুমি নাকি ভাইকে আর ও বাড়ির আর সকলকে ভুলে যেতে বসেছো”।

অর্চনা ট্যাবলেট মুখে দিতেই নবনীতা ওদিক থেকে বলে উঠল, “দিদি, এসে পড়ো। চা জল খাবার এসে গেছে”।

সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে ডাইনিং রুমে এসে চা খাবার খেতে বসলো। খেতে খেতে নবনীতা প্রশ্ন করল, “দিদি, কলকাতার আর কিছু নতুন খবর আছে? পরির সাথে আর কথা হয়েছে তোমার”?
 

সীমন্তিনী কিচেনের দিকে একনজর দেখে লক্ষ্মীকে কোন কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখে চাপা গলায় বলল, “হ্যাঁ, লাঞ্চ আওয়ারে কথা হয়েছে। রচুর ওপর নজর রাখবার জন্য আরও দু’তিনজন সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে। ওরা চব্বিশ ঘন্টা রচুর ওপর নজর রাখবে। রচুদের ফ্ল্যাটের উল্টোদিকে একটা ঘরে ওরা রাতে থাকবে। সেখান থেকে রচুদের ব্যালকনিটা নাকি একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়। সেখান থেকে আর ওদের ফ্ল্যাটের কাছেই রাস্তায় ডিউটি দেবে, রচু যদি কখনও একা বা দাদাভাইয়ের সাথেও কোথাও বের হয়, ওরা সবসময় তাদের পেছনে পেছনে থেকে ওদের গার্ড করে যাবে”।
 

অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “আর ওই মাড়োয়াড়ি লোকটা? তাকে কিছু করা যাবে না”?

সীমন্তিনী আগের মতই শান্ত ভাবে জবাব দিল, “তার পেছনেও পরিতোষ লেগে গেছে। তবে কিভাবে কি করছে সেটা সে আমাকে খুলে বলেনি। আর আমি নিজেই জানি, ও কিভাবে কী করবে সেসব কথা পুরো খুলে আমাকে কখনোই জানাবে না। কিন্তু কাজ যে সে সমাধা করবেই, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এটা বলেছে যে আগামি পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ দিনের ভেতর সে এমন কিছু করবে যে তারপর থেকে রচুর আর কোনও বিপদের আশঙ্কা থাকবে না। আর আমি জানি, পরিতোষের কথা আর কাজে কোনও তফাৎ থাকে না। তাই আমিও বিশ্বাস করি রচনা দিন চল্লিশেক বাদে একেবারে বিপদমুক্ত হয়ে যাবে। আমাদের আর দুর্ভাবনার কিছু নেই। তুমিও একেবারেই দুশ্চিন্তা কোর না অর্চু”।

অর্চনা তবু বলল, “দিদিভাই আমি নিজের মনটাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না গো। তোমার পরামর্শ মত কাউকে কিছু না বললেও আমার মনের ভেতরের দুশ্চিন্তা যে কিছুতেই কাটতে চাইছে না গো। বারবার মনে হচ্ছে ছুটে যাই রচুর কাছে”।
 

সীমন্তিনী অর্চনার একটা হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বলল, “ক’দিন আগেই তো ওরা এসে তোমার সাথে দেখা করে গেল বোন। আর দু’মাস বাদেই তো পূজো। ওরা তো পূজোর সময় আসছেই। তখন তো তোমার সাথে দেখা হবেই। ততদিনে ওর ওপর নেমে আসা বিপদটাও কেটে যাবে। আমার ওপর ভরসা রাখো অর্চু। তবে ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ যে সময় থাকতে আমরা সব কিছু জানতে পেরেছিলাম। তবে এ ক্ষেত্রে ভগবানের চাইতেও বেশী ধন্যবাদ প্রাপ্য বোধহয় নীতার ম্যাডামের। উনি যদি ব্যাপারটা আমাকে খুলে না বলতেন, তাহলে তো বিপদটা ঘটে যাবার আগে পর্যন্ত কিচ্ছুটি জানতে পারতুম না”।

অর্চনা আবার কিছু একটা বলতে চাইতেই সীমন্তিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে আর কোন কথা নয় অর্চু। নীতা তুমি আমাদের তিনজনের চা নিয়ে আমার রুমে চলে এস। আমরা ওখানে বসেই চা খাব”।

সীমন্তিনী টেবিল থেকে উঠে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। লক্ষ্মীকে কাপে কাপে চা ঢালতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি খাওনি লক্ষ্মীদি? ওদিকে ও’সব কি ঢেকে রেখেছো”?

লক্ষ্মী কাজ না থামিয়েই বলল, “ওটাই আমার খাবার গো দিদিমণি। তোমাদের চা টা দিয়েই খাবো”।

নবনীতা ডাইনিং টেবিল থেকে এঁটো থালা প্লেটগুলো এনে রান্নাঘরের সিঙ্কে রাখতে রাখতে বলল, “লক্ষ্মীদি, টেবিলটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এবার তুমি খাবার খেয়ে এগুলো ধুয়ে রেখো। চা আমি নিয়ে যাচ্ছি দিদির ঘরে। ওখানে গল্প করতে করতে সবাই খাবো”।

সীমন্তিনী আর অর্চনা আগেই সীমন্তিনীর ঘরে এসে তার বিছানায় বসে পড়েছিল। নবনীতা চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শুনলো অর্চনা সীমন্তিনীকে বলছে, “সত্যি গো দিদিভাই। নীতাদির মুখে তার ম্যাডামের কথা শুনে তো আমরা সকলেই ধরে নিয়েছিলাম যে ওই ম্যাডাম খুবই বাজে মহিলা। সে-ই রতু-দা আর রচুর সর্বনাশ করবে। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখো? নিজে বিপথগামীনি হয়েও, আরও অনেক ছেলেমেয়েকে বিপথে নামিয়েও, রচুর ওপর বিপদ নেমে আসছে দেখে অমন বাজে স্বভাবের এক মহিলাও কেমন চঞ্চল কেমন উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়েছে। সে নিজে কিছু করতে পারছে না বলে, তার সমস্ত পাপকর্মের কথা অবলীলায় তোমার মত এক পুলিশ অফিসারকে খুলে বলে তোমার সাহায্য চাইছে, এ ব্যাপারটা আমি ঠিক হজম করতে পারছি না গো। মনে হচ্ছে গল্পকথা। বাস্তবে কি এমন সত্যি হতে পারে দিদিভাই”?

সীমন্তিনী চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “ইংরেজীতে একটা কথা আছে শুনেছ তো? ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’। কথাটা যে কতটা সত্যি, তার প্রমাণ আমরা পুলিশেরা মাঝে মধ্যেই পাই। এমন অনেক খুন জখম চুরি ডাকাতি রাহাজানির কেস আমাদের হাতে আসে, যা প্রায় অবিশ্যাস্য। প্রায় অলৌকিক এবং অবাস্তব। কিন্তু সে সবও যে সত্যি, সেটা আমরাই প্রমাণ করি। আমার এই তিন বছরের চাকুরি জীবনে এমন ঘটণা আমিও দেখেছি। তোমার নিজের জীবনেও তো এমনই কিছু ঘটেছিল দু’মাস আগে। তবে এই মহিমা ম্যাডাম আমাকেও সত্যি অবাক করে দিয়েছেন গো অর্চু। কোনরকম চাপে না পড়ে, কোনরকম বাধ্য বাধকতায় না জড়িয়েও শুধু এক প্রিয়জনকে বিপদমুক্ত করবার উদ্দেশ্যে তার সদ্য পরিচিত প্রায় অচেনা একজনের কাছে কিভাবে নিজের পাপ আর অপরাধের কথা সব স্বীকার করলেন! এমনটা সত্যি দেখা যায় না। অবিশ্বাস্য ব্যাপার”।

এবার নবনীতা বলল, “হ্যাঁ গো দিদি। এ ব্যাপারটা আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। তবে অর্চুদি কিন্তু একটা কথা ভুল বলেছে। ম্যাডাম কিন্তু কাউকে বিপথগামী করে তাদের অনিচ্ছায় নিজের ওই ব্যবসায় টেনে আনেন নি। আর তার সাক্ষী তো আমি নিজেই। বীথিকার মুখেই শুনেছি এমন ব্যবসা আরো যারা করে, তারা সবাই নিজের নিজের পছন্দের নিয়ম বানিয়ে সবাইকে নিজেদের বশে, নিজেদের কাছে আটকে রাখতে চায়। তারা কাজ ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তাদের পেছনে গুণ্ডা বদমাশ লেলিয়ে দেয়। প্রয়োজনে খুনও করে ফেলে। কিন্তু ম্যাডাম তো এমন কিছু করেন না। তার কাজ থেকে কেউ সরে যেতে চাইলেও ম্যাডাম তাকে একেবারেই বাঁধা দেন না। উল্টে তার সাধ্যমত সাহায্যই করেন। পরিতোষের সাথে কথা বলবার পর তুমি যখন আমাকে তোমার সাথে নিয়ে আসতে চাইছিলে, তখন তোমাদের মতের বিরূদ্ধে যেতে পারিনি আমি। কিন্তু আমি যদি ম্যাডামকে সব কিছু জানিয়েই তার কাজ ছেড়ে চলে আসতে চাইতাম, তাহলেও বোধহয় তিনি আমাকে আটকাতেন না। আর সেটা করিনি বলেই মনটা একটু খচখচ করছে আমার। তবে দিদি, তুমি পরিতোষকে ম্যাডামকে হেনস্থা না করবার যে অনুরোধ করেছ, তাতে আমি সত্যি খুব খুশী হয়েছি গো। জানি, ম্যাডাম একটা অনৈতিক কাজ করছেন। আইনের চোখে সেটা একটা অপরাধ। কিন্তু সে তো শুধু নিজের স্বার্থে এসব করেন না। আরও অনেকগুলো অসহায় মেয়ে মহিলাকে সংসার প্রতিপালনে সাহায্য করছে। আমার কথা, বীথির কথা তো তোমাদের সব বলেছি। কিন্তু শুধু আমরা দু’জনই নয়, ম্যাডামের কাছে যত মেয়ে বা মহিলা কাজ করে তারা সকলেই কেবলমাত্র পরিস্থিতির শিকার হয়েই এসব কাজ করছে। আর এতে ম্যাডাম শুধু তার সাধ্যমত তাদের সমর্থন আর সাহায্য দিয়ে যাচ্ছেন। মানবিকতার দিক দিয়ে দেখতে গেলে, তাকে তো সত্যিই একজন অপরাধী বলা যায় না, তাই না দিদি”?

সীমন্তিনী আনমনে জবাব দিল, “জানিনে রে ভাই। তবে দেশের আইন কানুনকে উপেক্ষা করাও তো একটা অপরাধ। সেই যুগে যদি এখনকার মত আইন ব্যবস্থা থাকত, তাহলে রামায়ন রচনা করবার আগেই দস্যু রত্নাকরের ফাঁসি হয়ে যেত। মহর্ষি বাল্মিকীর জন্মও যেমন হত না, তেমনি রামায়ন রচনাও হত না। আজকের যুগে কোন রত্নাকর কি আর বাল্মিকী হয়ে উঠতে পারবে, বলো”?

সীমন্তিনীর কথা শুনে কেউ কোন জবাব না দিলেও সে একা একাই প্রায় স্বগতোক্তির মত করে বলল, “কিন্তু পরিতোষের বিবেক বা চিন্তাধারা একটু অন্যরকম। ও অনেক অপরাধীকে আইনের হাতকড়া না পড়িয়ে তাদেরকে এ যুগের বাল্মিকী বানাবার চেষ্টা করেছে। আবার এমন অনেক অপরাধী যারা নিজেদের ক্ষমতা, অর্থ আর প্রতিপত্তির সাহায্যে আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে আসে, তাদেরকে অন্যভাবে শাস্তি দেয়। আর অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। কিন্তু আইনের পরিভাষায় এমন কিছু করাটাও আইন বহির্ভূত ব্যাপার। এটাও এক ধরণের শাস্তি যোগ্য অপরাধ। তাই এসব কাজ খুব গোপনে, খুব চাতুর্য আর বুদ্ধিমত্তার সাথে করতে হয়। নইলে অন্যকে শোধরাতে গিয়ে নিজেই জেল হাজতে গিয়ে ঢুকতে হবে। তাই পরিতোষ কিভাবে কী করবে তার সবকিছু সে নিজের লোকদেরকেও খুলে বলে না। এমনকি আমাকেও বলে না”।

একটু থেমে নবনীতার একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে সীমন্তিনী বলল, “তুমি তোমার ম্যাডামকে অপরাধী বলে ভাবো আর না ভাবো, তাতে কি এসে যায় নীতা। আইনের চোখে তো সে অপরাধী। আর আইনের ধারায় তার তো জেল হাজত হবারই কথা। আর এ কাজটা করতে হয় আমাদের মত পুলিশকেই। শুধু তার কথাই বা বলছি কেন। আইনের চোখে তুমিও তো একই সমান অপরাধী নীতা। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কোন পরিস্থিতিতে পড়ে তুমি ও’ধরণের কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলে, আদালতে সেটা একেবারেই বিচার্য নয়। আইনের চোখে তুমি সমাজকে কলুষিত করেছ, এটাই তোমার অপরাধ। আর এ অপরাধের শাস্তিই আদালত তোমাকে দিত। কিন্তু পরিতোষ আর আমি তো তোমাকে শুধু আইনের অপরাধী বলে ভাবি না। নিজের বিবেক আর মানবিকতাবোধের বশবর্তী হয়েই তো তোমাকে ওই অপরাধের জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। আর তোমাকে ওই পাকে পড়তে আমি আর দেব না। জানিনে, পরিতোষের মত আমার ভেতরেও একজনকে বাল্মিকী করে তোলার মত ক্ষমতা আমার আছে কিনা। কিন্তু তুমি যদি আমার এ প্রচেষ্টায় আমাকে সাহায্য করো, তাহলে আমি নিশ্চিত যে তোমার আগামি জীবনটা সুন্দর আর সহজ হয়ে উঠবে। সমাজে তোমাকে আর মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে না। মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। তুমি শুধু আমাকে একটু সাহায্য কোর ভাই”।

নবনীতা সীমন্তিনীর কাঁধে মাথা রেখে কান্না ভেজা গলায় বলল, “আমি তোমার প্রচেষ্টায় কখনও বাঁধা হয়ে দাঁড়াব না দিদি। তোমার প্রতিটি নির্দেশ প্রতিটি উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। কথা দিলাম। কিন্তু দিদি ম্যাডামকে নিয়েও কি এমনই কিছু ভাবছ? না মানে, পরিতোষের সাথে কাল ফোনে যেসব বললে তুমি সে কথার পরিপ্রেক্ষিতেই এ কথাটা জিজ্ঞেস করছি। কিছু মনে কোর না”।
 

সীমন্তিনী নবনীতার হাতটা ধরে রেখেই বলল, “সেটা এখনই বলা সম্ভব হবে না নীতা। শুধু আমি চাইলেই কি হবে? তোমার ম্যাডামের নিজের মনেও এমন চাহিদা না থাকলে সেটা একেবারেই সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি তার সম্বন্ধে অনেক কথা বললেও এ’কথা কিন্তু একবারও বলনি যে সে নিজেও এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে চায়, বা তার নিজের মনেও এ ব্যবসা করছে বলে কোন লজ্জা বা গ্লানি আছে। সে নিজেও আমাকে অনেক কথা বললেও তার মনে এমন কোন ইচ্ছে আছে, সে’কথা কিন্তু বলেনি একবারও। তবে আমাদের রচুকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে, নিজের কূকর্মের কথা যে এত সহজে আমার মত এক সদ্য পরিচিতাকে এমন ভাবে খুলে বলতে পারে, তার মনে কিছুটা হলেও নৈতিকতা আর বিবেক জেগে থাকবারই কথা। সেটাই আগে আমাকে ভাল করে বুঝে নিতে হবে। তারপর যদি বুঝতে পারি যে তোমার মত তার মনেও এমন অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আসবার একটা ইচ্ছে আছে, তাহলে তাকেও আমি সাধ্যমত সাহায্য করবো। তবে তোমার ম্যাডাম যে রচু আর দাদাভাই দু’জনকেই খুব ভালবাসে, সেটা তো আগেও শুনেছিলুম, আর এবারেও তার নিজের মুখ থেকেই শুনতে পেলুম। তাই তাকে অপরাধের দুনিয়া থেকে সরিয়ে আনবার সুযোগ পেলে, সে সুযোগ আমি হাতছাড়া করব না, এটুকু তোমাকে বলতে পারি”।

অর্চনা এরপর বলল, “আচ্ছা দিদিভাই, আমার মনে আরেকটা প্রশ্ন আছে। তুমি রাগ করবে না তো”?

সীমন্তিনী সহজ গলায় জবাব দিল, “পাগলী মেয়ে। রাগ করব কেন? বলো কি জানতে চাও”?

অর্চনা তখন বলল, “রতু-দার ওপর নজর রাখবার জন্যে তো তোমার বন্ধু আগে থেকেই লোক লাগিয়ে রেখেছেন, এখন আবার রচুর এ বিপদের কথা জানতে পেরে তিনি আরও তিনজন লোক নিয়োগ করলেন। আচ্ছা দিদিভাই, এই লোকগুলো বিনে পয়সাতেই রতু-দা আর রচুর ওপর নজর রাখবে? এতে তাদের কী নিজেদের কোনও স্বার্থ আছে? যদি মেনেও নেই যে তারা তোমার বন্ধুর আদেশেই এ সব করছে, কিন্তু তাদেরও তো ঘর সংসার আছে। আর ঘর সংসার চালাতে তো তাদেরও টাকা পয়সার দরকার। তারা যদি দিনরাত রচু আর রতু-দার পেছনেই লেগে থাকে, তবে তারা সংসার খরচের টাকা কোত্থেকে কিভাবে যোগাড় করবে? আর যদি তাদের কোন টাকা পায়সা দিতেই হয়, তাহলে সেটা কে দেবে? তুমি? না তোমার সেই বন্ধুই? না কি রতু-দাকে দিতে হবে”?
 

সীমন্তিনী অর্চনার কথা শুনে মনে মনে বেশ অবাক হল। একেবারেই হেসে উড়িয়ে দেবার মত প্রশ্ন নয়। সীমন্তিনী নিজে পরিতোষকে এ বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও, মনে মনে এই ভেবে আশ্বস্ত ছিল যে পরিতোষই সেটা মেটাচ্ছে। রবিশঙ্কর আর দিবাকরের কাছ থেকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী টাকা আদায় করতে পেরেছিল পরিতোষ। যাদেরকে ওই কাজদুটোতে নিযক্ত করেছিল, তা হয়ত ওই আদায় করা টাকা থেকেই মিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এবারের কাজটায় তো অর্থ সমাগমের তেমন সম্ভাবনা নেই। রতীশের পেছনে তো এক দেড় মাস আগে থেকেই তিনজন সিকিউরিটি নিয়োগ করা হয়েছে। এবার আরও তিনজন সিকিউরিটি পার্সোনাল রাখা হচ্ছে। পরের তিনজনকে তো চল্লিশ পঞ্চাশ দিনের ডিউটির পারিশ্রমিক দিতে হবে। আর আগের তিনজনকেও তো হয়ত আরও মাস দুয়েক কাজে রাখতে হবে। এই ছ’জন লোকের পারিশ্রমিক তো কম হবে না। পরিতোষ কী করে সে সব মেটাবে? নাহ, পরিতোষের সাথে একবারও এদিকটা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি বলে নিজেকে খুব স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে রতীশ আর রচনার সুরক্ষার জন্য সে শুধু পরিতোষের ওপর একের পর এক অনুরোধ চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ কাজগুলো করতে যে কী পরিমান টাকা পয়সার প্রয়োজন হতে পারে, আর পরিতোষ কিকরে তার যোগান দেবে, এ’কথাটা তো তার মাথাতেই আসেনি। নাহ, সত্যি বড্ড ভুল হয়ে গেছে। পরিতোষের সাথে এ ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা নিতান্তই প্রয়োজন। ভাগ্যিস, অর্চনা কথাটা তুলল।

সীমন্তিনীকে চুপ করে থাকতে দেখে অর্চনা ভাবল, সে বুঝি বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। তাই সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে সে মিনতি ভরা গলায় বলল, “কিছু মনে কোর না দিদিভাই। আমি হয়ত ভুল কিছু বলে ফেলেছি”।

সীমন্তিনী অর্চনার একটা হাত ধরে বলল, “না সোনা। তুমি ভুল কিছু বলো নি একেবারেই। খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা বলেছো তুমি। কিন্তু অবাক হয়ে ভাবছিলুম, এ’কথাটা এতদিন আমার মাথাতেই আসেনি! আমার দাদাভাইয়ের ওপর দেড় দু’মাস হল নজর রাখা হচ্ছে, ওদের টাকাটা উদ্ধার করতে দু’ দুটো অপারেশন করতে হয়েছে পরিতোষকে তা আমি জানি। কিন্তু ওই দুটো অপারেশনে যে কত টাকা খরচ হয়েছিল, বা দাদাভাইয়ের ওপর যারা নজর রাখছে তাদের কত টাকা দিতে হয়েছে বা দিতে হচ্ছে, এসব আমি একবারও জানতে চেষ্টা করিনি। সব খরচ খরচা মিটিয়ে দাদাভাইয়ের জন্য মোট সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা রেখেছিল পরি, এ’টুকুই শুধু আমি জানি। কিন্তু যাদেরকে দিয়ে সে কাজগুলো করাচ্ছে, তাদেরকে যে কত টাকা দিতে হয়েছে, বা কত টাকা দেবার আরো প্রয়োজন আছে, এ কথাগুলো নিয়ে আমি ভাবিই নি। আমি শুধু কার্যসিদ্ধি হয়েছে শুনেই খুশী হয়েছি। ইশ, ছিঃ ছিঃ, সাংঘাতিক একটা স্বার্থপরের মত কাজ করে ফেলেছি গো। দাঁড়াও, আমি এখনই খবর নিচ্ছি” বলেই সে মোবাইল থেকে পরিতোষকে ফোন করল।

পরিতোষ ফোনে “হ্যালো মুন ডার্লিং। বলো, কোন নতুন ইনফর্মেশন কিছু আছে কি”? বলতেই সীমন্তিনী বলল, “না পরি, এখন তোমাকে জানাবার মত কোন আপডেট আমার কাছে নেই। উল্টে তোমার কাছ থেকেই কিছু জানতে চাইছি আমি। আসলে এ কথাটা আমার আরও অনেক আগেই তোমাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। কিন্তু স্বার্থপরের মত শুধু নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করবার কথাই আমি ভেবে গেছি। সেজন্যে তোমার কাছে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। প্লীজ আমাকে ভুল বুঝো না। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাবটা এড়িয়ে যেও না প্লীজ”।

পরিতোষ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে কথা বলছ কেন তুমি ডার্লিং? এমন কী কথা তুমি জানতে ভুলে গেছ”?

সীমন্তিনী বলল, “দ্যাখো পরি, দিবাকর আর রবিশঙ্করের ব্যাপারে যে দুটো অপারেশন করা হয়েছিল, তাতে কত টাকা খরচ হয়েছিল, সেটা তো জানতেই চাইনি তোমার কাছে। তুমি আমায় বলেছিলে যে ওই দুটো অপারেশনে সব খরচ খরচা মিটিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা তোমার হাতে জমা হয়েছিল। সে টাকা থেকেই রচুর ফ্ল্যাটে টিভি, ফ্রিজ আর ডিশ কিনে দেওয়া হয়েছিল। আর বাকি চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকার পুরোটাই তো আমরা রচুর একাউন্টে জমা করে দিয়েছি। কিন্তু যাদের মাধ্যমে অপারেশনগুলো করা হয়েছিল তাদের কতটাকা দেবার কথা ছিল, কতটুকু দেওয়া হয়েছে, বা আরও কতটুকু দেবার আছে, এসবের কোন খবরই তো আমি নিই নি। তুমি কিকরে ব্যাপারটা সামলেছ বল তো? তোমার নিজের কাছ থেকে তোমাকে কিছু খরচ করতে হয়েছে নিশ্চয়ই? এছাড়া প্রায় মাস দুয়েক হল দাদাভাইয়ের পেছনে সিকিউরিটি রাখছ। এখন আবার রচুর জন্যেও আরও তিনজনকে রিক্রুট করতে হচ্ছে। এদের সবাইকেও তো তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। আর এ তো দু’ চার হাজারের ব্যাপার নিশ্চয়ই হবেনা যে তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে নিজের পকেট থেকেই দিয়ে দেবে। আর যদি তেমন কিছু তুমি করেই থাকো, তাহলে সেটা তোমাকে রিইমবার্স করার দায়িত্ব তো আমারই। আমি কখনও এসব কথা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইনি। আমার দাদাভাই আর রচুসোনা তোমার তত্ত্বাবধানে নিরাপদে আছে, ভাল আছে, এ খবর নিয়েই আমি স্বার্থপরের মত খুশী আছি। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তোমাকে যে কতকিছুর মোকাবেলা করতে হচ্ছে, কত অর্থের যোগান দিতে হচ্ছে, একটি বারের জন্যও এসব ভেবে দেখিনি আমি। আজ কথাটা মাথায় আসতেই আমার খুব লজ্জা লাগছে। প্লীজ পরি, আমার এ প্রশ্নগুলোর জবাব দাও”।


______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 12-03-2020, 07:59 PM



Users browsing this thread: 5 Guest(s)