12-03-2020, 07:57 PM
(Update No. 145)
সকালের ব্রেকফাস্ট আর চা খাবার পর মহিমার সাথে গত রাতে যা যা কথা হয়েছে সীমন্তিনী তার সবটুকু নবনীতা আর অর্চনাকে খুলে বলল। সবটুকু শুনে অর্চনা আর নবনীতা দু’জনেই খুব ঘাবড়ে গেল।
অর্চনা শুকনো মুখে সীমন্তিনীকে বলল, “রচুর তো তবে ভারী বিপদ গো দিদিভাই। কি হবে বল তো”?
সীমন্তিনী তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ভেবো না অর্চু। আমি আছি তো। আমার ওপর তোমার ভরসা নেই? কিচ্ছুটি হতে দেব না রচুর। তুমি শুধু আমার কথাগুলো মেনে চলো। কাউকে কিচ্ছুটি জানাবে না। বাকি সব কিছু আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি বেঁচে থাকতে রচুর একটা চুলের ডগাও কেউ ছুঁতে পারবে না” বলে সে এবার নবনীতাকে বলল, “আচ্ছা নীতা, তুমি আমাকে একটা কথা বলো তো। দ্যাখো আমরা কেউ তো আর মহিমা বৌদিকে চিনি না। তুমি তার সাথে কিছুদিন কাজ করেছ। আর তোমার বান্ধবী বীথিকার কাছ থেকেও তুমি হয়ত তার ব্যাপারে কিছু কিছু কথা শুনে থাকতে পার। তোমার কি মনে হয় সে আমার কাছে কোনও মিথ্যে কথা বলেছে। কিংবা তার ব্যাপারে যেসব কথা আমি তোমাদের এখন বললুম, মানে সে আমাকে নিজের সম্মন্ধে যা কিছু বলেছে, সে সব কি তোমার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে”?
নবনীতা অনায়াসেই জবাব দিল, “না দিদি। আমার তেমন কিছু মনে তো একেবারেই হচ্ছে না। বরং এটা ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি যে ম্যাডাম নিজে মুখে এ’সব কথা তোমাকে বলেছেন। তুমি যে একজন আইপিএস অফিসার, এ’কথা না জানলেও তার গোপন ব্যবসার ভেতরের এতসব কথা উনি স্বেচ্ছায় তোমাকে বলে দিলেন এটা ভেবেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য অবিশ্বাস্য লাগছে আমার। কিন্তু বৌদি, আমি তার সম্মন্ধে যতটুকু জানি, তাতে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে উনি হয়তো আরও কিছু কথা তোমার কাছে গোপন করেও যেতে পারেন। যেতে পারেনই বা বলছি কেন, নিশ্চয়ই গোপন করে গেছেন। তবে রচনা বৌদির ব্যাপারে যতটুকু তোমাকে বলা প্রয়োজন মনে করেছেন ঠিক ততটুকুই বলেছেন। এ ছাড়াও তার জীবনে গোপন অনেক কথাই হয়তো আছে। কিন্তু যতটুকু বলেছেন এতে কোনও মিথ্যে নেই। বীথির মুখে আমি এ’সবের অনেকটাই শুনেছি। অনৈতিক বা সমাজের কাছে নিন্দনীয় এবং অপরাধমূলক ওই ব্যবসা করলেও উনি কাউকে তার ইচ্ছের বিরূদ্ধে তার ব্যবসায় টেনে নামান না। আমি নিজেই তো তার সাক্ষী আছি। আমি যখন তার কাছে গিয়েছিলাম তিনি বারবার জানতে চেয়েছেন যে আমি বীথির বা অন্য কারুর প্ররোচনায় তার ব্যবসায় নামতে রাজি হয়েছি কি না। তিনি তো আমাকে এ’কথাও বলেছিলেন যে দু’তিন মাসের জন্য তিনি নিজে আমার থাকা খাওয়া পড়ার সমস্ত দায়িত্ব নেবেন। ওই সময়ের মধ্যে আমি যেন আবার ভদ্র সভ্য হয়ে বাঁচবার মত কিছু একটা কাজ খুঁজে নিই। আর বীথিকার মুখেই শুনেছি, যেসব মেয়ে মহিলা তার এজেন্সীতে কাজ করে তাদের সকলের প্রতিই তিনি খুব সহানুভূতিশীল। প্রত্যেকের সুবিধে অসুবিধের দিকে তার নজর থাকে। নানাভাবে তাদের সাহায্য করে থাকেন। কোন মেয়ে যদি ওই পথ ছেড়ে সৎ ভাবে নিজের জীবন কাটানোর কোনও সুযোগ পায়, তাহলে অন্যদের মত বাধা তো তিনি দেনই না, উল্টে তাকে সাহায্যই করেন। তাই ম্যাডামের কাছে যত মেয়ে মহিলা কাজ করে তারা সবাই ম্যাডামের খুব অনুগত। তারা কেউ ম্যাডামকে কোন রকম ঝুট ঝামেলায় ফেলতে চায় না। তার এজেন্সীতে যেসব ছেলে ছোকড়া কাজ করে তাদের ব্যাপারে আমি অত জোর দিয়ে কিছু না বলতে পারলেও, এটা আমি জানি যে যেসব মেয়েরা শুধুই শারিরীক ক্ষুধা আর কেবলই পয়সা কামাবার জন্যে এ’পথে আসতে চায়, ম্যাডাম তাদের কাউকে তার এজেন্সীতে সুযোগ দেন না। যেসব মেয়েরা অন্য কোন কিছু করতে না পেরে, অন্য কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে নিজের বা পরিবারের ভরন পোষনের জন্য এ পথে নামতে বাধ্য হয়, ম্যাডাম শুধু সে’সব মেয়েদেরই তার ওখানে সুযোগ দিয়ে থাকেন। আর তিনি শুধু নিজের উপার্জনটাকেই বড় করে দেখেন না। নিজের ক্ষতি স্বীকার করেও তার এজেন্সীর মেয়ে মহিলাদের সাহায্য করে থাকেন। তাই তার ব্যবসাটা যতই নিন্দনীয় হোক না কেন, ম্যাডাম কখনও কাউকে এক্সপ্লয়েট করে নিজের সিন্দুক ভরেন না। বরং বিপদে আপদে তিনি সকলের পাশেই দাঁড়ান। বীথিকার মুখে এমন অনেক ঘটণা আমি শুনেছি। আমাকেও কাজে নেবার সময় তিনি বলেছিলেন যে আমার ইচ্ছে হলে আমি যে কোন সময় তার কাজ ছেড়ে দিতে পারি। আর সে জন্যেই তুমি যখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে বলেছিলে তখন আমি তাকে কথাটা বলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আর পরি কিছু একটা ভেবেই বোধহয় আমাকে সেটা করতে দাও নি। আমি যে তার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাকে কিছু না বলে, কিছু না জানিয়েই তোমার সাথে চলে এসেছি, তাতে আমার মনে একটা গ্লানিভাব কিন্তু থেকেই গেছে। আমি যদি তাকে সবকিছু বলেই তোমার সাথে চলে আসতাম, তবুও উনি আমায় কিচ্ছু বলতেন না। হয়তো আমার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য আমাকে শুভেচ্ছাই জানাতেন। তাই আমার মনে হয় না ম্যাডাম তোমাকে কোনও মিথ্যে কথা বলেছেন”।
সীমন্তিনী নবনীতার কথায় বেশ অবাকই হল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেক্স র*্যাকেটের ব্যবসায় লিপ্ত থাকা এক মহিলা কি সত্যিই এতোটা সংবেদনশীল হতে পারে? এমনটা তো সে কোনও গল্প কাহিনীতেও পড়ে নি। এ কেমন ধরণের মহিলা? একদিকে সমাজ, পুলিশ, আইন আদালতকে ফাঁকি দিয়ে এতগুলো ছেলে মেয়েকে নিয়ে এমন অনৈতিক একটা ব্যবসা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে অপরের দুঃখে পাশে থেকে তাদের সাহায্য করে যাচ্ছে!
এমন সময় অর্চনা বলল, “আচ্ছা দিদিভাই, মহিমা বৌদি কি রচুর সেই ছবিটা পাঠিয়েছে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “আমি যখন স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলুম তখন মোবাইলে একটা এলার্ট সাউন্ড হয়েছিল। বোধহয় পাঠিয়েছে, দাঁড়াও দেখছি” বলে নিজের পার্সোনাল মোবাইলটা হাতে নিয়ে মহিমার পাঠানো ফোল্ডারটা খুলে রচনার ছবিটা বের করেই বলল, “হ্যাঁ এই তো। এই দ্যাখো” বলে খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। নবনীতা আর অর্চনাও তার দু’পাশ থেকে রচনার ছবিটা দেখতে লাগল। ছবিটা যে কেউ মোবাইলেই তুলেছে সেটা সীমন্তিনী এক নজরেই বুঝতে পারল। হাল্কা গোলাপী কামিজ পড়া রচনার ছবিটা সত্যিই খুব সুন্দর লাগছিল দেখতে। ঘন সবুজ রঙের একটা ওড়না পড়ে আছে। রচনার পাশে ঘিয়ে রঙের শার্ট পড়া কেউ একজন আছে। তবে তার মুখ বা শরীরের কিছুই ছবির ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে না। সীমন্তিনী খুব ভালভাবে ছবিতে রচনার পেছনের দিকের জিনিসগুলো দেখে বুঝতে পারল যে ছবিটা কোনও ট্রেণের কামরার ভেতরে তোলা। রচনার মাথার ওপর ট্রেনের কামরার ওপরের দিকের একটা বার্থের ছবি বেশ পরিস্কারই বোঝা যাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবল, বিয়ের পর রতীশ আর রচনা হানিমুনে গিয়েছিল সাউথ ইন্ডিয়ায়। ট্রেনেই যাতায়াত করেছিল তখন। আর বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যাবার সময়েও তারা ট্রেনেই জার্নি করেছিল। এ ছাড়া রচনা তো অন্য কোনও সময় ট্রেন জার্নি করেনি। অন্ততঃ বিয়ের পর তো আর করেনি। কিন্তু ছবিতে রচনার কপালে আর সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাহলে ওদের বিয়ের পর ট্রেণের কামরার ভেতরের এ ছবিটা কে কবে কখন তুলেছিল। আরও একটু ভাবতে তার মনে হল রচনার পাশে বসা লোকটার যে শার্টটা খানিকটা দেখা যাচ্ছে, এরকম একটা ঘিয়ে রঙের শার্ট সে হায়দ্রাবাদ ট্রেনিংএ থাকবার সময় রতীশকে পুজোর উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল। তাই মনে হচ্ছে রচনার পাশে ঘিয়ে শার্ট পড়ে রতীশই বসে ছিল তখন। তার মানে এটা তো পরিস্কার যে ছবিটা রতীশ তোলেনি। অন্য কেউ কামরার রচনাদের সীটের উল্টোদিকের সীটে বসে ছবিটা তুলেছে। তার হঠাতই মনে হল, রচনা আর রতীশ হানিমুনে গিয়েছিল ২০০৯ এর এপ্রিল মাসে। ওদের বিয়ের প্রায় মাসখানেক বাদে। আর সীমন্তিনী হায়দ্রাবাদ থেকে বাড়ির সকলের জন্য পূজোর উপহার পাঠিয়েছিল সে বছরের অক্টোবর মাসে। তাই রচনার পাশে বসা লোকটা যদি সত্যিই রতীশই হয়ে থাকে, তাহলে এটা ওদের হানিমুনের সময়কার ছবি হতে পারে না। তার ধারণা সত্যি হলে এটা ধরে নেওয়া যায় যে রচনা আর রতীশ যখন কলকাতা যাচ্ছিল তখনই ট্রেণে এ ছবিটা কেউ তুলেছিল। কিন্তু কে তুলে থাকতে পারে? হঠাতই রবিশঙ্করের কথা মনে পড়ল। কলকাতা যাবার পথে রবিশঙ্কর রচনা আর রতীশের সহযাত্রী ছিল। তাহলে রবিশঙ্করই কি এ ছবি তুলেছিল? তার পুলিশি মন বলছে এটা রবিশঙ্করই হবে। কিন্তু বিমল আগরওয়ালা তো রতীশকে বলেছিল যে সে রবিশঙ্কর নামে কাউকে চেনে না। তাহলে এ ছবি বিমলের হাতে কি করে যেতে পারে! সীমন্তিনী বুঝল তার ধারণা অনুযায়ী যদি রবিশঙ্করই এ ছবি তুলে থাকে তাহলে ধরে নিতেই হচ্ছে যে রবিশঙ্করের কাছ থেকেই বিমল এ ছবি পেয়েছে। আর তাহলে এটাও পরিস্কার যে বিমল আগরওয়ালা রতীশকে তখন মিথ্যে কথা বলেছিল। রবিশঙ্করকে সে নিশ্চয়ই চিনত। আর ওই চেনাজানার সূত্রেই বিমলের ওই কমপ্লেক্সের চাবি রবিশঙ্করের হাতে এসে থাকতে পারে। মহিমার ধারণা বিমল আগে রচনার ব্যাপারে যার সাথে কন্টাক্ট করেছিল, ছবিটা সে-ই দিয়েছে বিমলকে। তাহলে রবিশঙ্করই কি সে লোক? সে রতীশের দু’লক্ষ টাকা লুট করে নেবার পাশাপাশি রচনাকে বিমলের হাতে তুলে দিয়েও আরও কিছু পয়সা রোজগারের মতলবে ছিল? মহিমাকে বিমল তো এমন কথাও বলেছে যে সে আগে যে লোকটার সাথে রচনার ব্যাপারে কন্টাক্ট করেছিল সে লোকটা নাকি অন্য একটা কেসে ফেঁসে গিয়ে এখন জেলে আছে। রবিশঙ্করও তো এখন জেলেই আছে। তাহলে তো দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাচ্ছে। তবু একটা ব্যাপারে আরেকটু শিওর হতে পারলেই একেবারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সীমন্তিনী মোবাইলটা অর্চনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে উঠে ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে রচনাকে ফোন করল। রচনা ফোন ধরেই বলল, “হ্যাঁ বল দিদিভাই। আবার কী মনে করে ফোন করলে এখন”?
সীমন্তিনী হাল্কা ভাবে বলল, “অফিসে না গিয়ে ঘরে বসে আর সময় কাটতে চাইছে না রে। এতক্ষণ বকর বকর করে অর্চু আর নীতার মাথা খেয়েছি। এবার ভাবলাম, একটু তোর মাথাটা চিবিয়ে খাই। তা কি রান্না করছিস? রান্না হয়ে গেছে? না বাকি আছে”?
রচনাও হেসে জবাব দিল, “তুমি এ সময়ে ফোন করাতে আমারও যেন কেমন লাগছে গো দিদিভাই। মনে হচ্ছে তুমি নও, অন্য কারো সাথে কথা বলছি। আসলে এ সময়ে তো আমাদের কোনদিন কথা হয় না। তা যাই হোক, আমার রান্না প্রায় শেষের মুখে। ডাল, ভাজা, কচু শাক আর চিকেন বানিয়েছি আজ। শুধু ভাতটাই এখন বাকি আছে”।
সীমন্তিনী বলল, “অর্চু আর নীতার সাথে তোর কলকাতা যাবার সময় তুই যে কত কান্নাকাটি করেছিলি, কলকাতা অব্দি সারাটা রাস্তাই যে ট্রেনে বসে কেঁদেছিস, এসব গল্প করছিলাম রে। আচ্ছা রচু, তোর কি মনে আছে? তুই আর দাদাভাই সেদিন কোন রঙের কোন পোশাক পড়ে ট্রেনে উঠেছিলি”?
রচনা গলাটা একটু ভার করে জবাব দিল, “সে দিনটা কি আমি কোনদিন ভুলতে পারব দিদিভাই। সারাটা ক্ষণ বাড়ির লোকগুলোর কথা ভেবেছি আমি। বারবার চন্দুর কথা মনে হতেই আমার চোখ জলে ভরে যেত। তা সেদিন আমরা কী পোষাক পড়ে এসেছি সেটা দিয়ে এখন কি করবে তুমি”?
সীমন্তিনী বলল, “আরে এরমধ্যেই ক’দিন আগে সতুর সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। সতু বলছিল তুই নাকি সেদিন গোলাপী রঙের কামিজের সাথে সবুজ শালোয়ার পড়েছিলি। আর দাদাভাই না কি ঘিয়ে রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়েছিল। আমি নিজে তো সেখানে ছিলুম না। কিন্তু ওর কথা বিশ্বাস হয়নি আমার। আজ অর্চুদের সাথে কথা বলতে বলতে সে কথাটা মনে হতেই তোকে জিজ্ঞেস করছি। তা তোর কি মনে আছে সে’কথা”?
রচনা বলল, “মেজদাভাই একদম ঠিক বলেছে দিদিভাই। আমি সত্যিই হাল্কা গোলাপী রঙের কামিজ আর ডার্ক গ্রীন কালারের শালোয়ার পড়েছিলুম। আর তুমি আমাদের বিয়ের পর প্রথম পূজোয় হায়দ্রাবাদ থেকে যখন সকলের জন্যে পূজোর জামাকাপড় পাঠিয়েছিলে, তখন তোমার দাদাভাইয়ের জন্য যে ঘিয়ে রঙের শার্টটা পাঠিয়েছিলে, উনি সেদিন ওটাই পড়েছিলেন। আর সাথে পড়েছিলেন একটা কালো জীনসের প্যান্ট। কিন্তু মেজদাভাইয়ের এসব কথা মনে আছে শুনে বেশ অবাক হচ্ছি। বেশ উন্নতি হয়েছে তার, বলতে হবে কথাটা তাকে”।
সীমন্তিনী বলল, “হু আমার ভাইটার বেশ উন্নতি হয়েছে। নইলে তোদের বিয়ের আগে আমরা দু’জন যখন জলপাইগুড়িতে থাকতুম, তখন ও আগের দিন কি খেয়েছে সেটা আর পরের দিন মনে করতে পারত না। আর এখন দ্যাখ, প্রায় দু’মাস আগে তোরা সেদিন কে কি পড়েছিলিস, সেটা একেবারে ঠিক ঠিক বলে দিল। দু’শ টাকার বাজিটা হারলাম আমি। আচ্ছা সে যাক, দাদাভাই কি ঘরে ফিরেছে”?
রচনা বলল, “তার ঘরে ফিরতে ফিরতে তো বারোটা সাড়ে বারোটা হয়েই যায় দিদিভাই। তবে এখন বোধহয় তাদের ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। হয়তো রাস্তায় আছেন”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে রে রচু। রাখছি এখন। দুপুরে দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলব’খন”।
ফোন কেটে দিয়েই সে সতীশের নাম্বার ডায়াল করল। সতীশ ফোনে সাড়া দিতেই সীমন্তিনী বলল, “ভাই, কেমন আছিস”?
সতীশ জবাব দিল, “ভাল আছি রে দিদি। একটা সুখবর আছে রে”।
সীমন্তিনী উৎসুক ভাবে জিজ্ঞেস করল, “কি সুখবর রে”?
সতীশ বলল, “কিছুদিন আগে ব্যাঙ্কের একটা রিটেন টেস্ট দিয়েছিলুম। কাল তার রেজাল্ট বেড়িয়েছে। আর আমি তাতে কোয়ালিফাই করেছি। এরপর ভাইভাতে অ্যাপিয়ার হতে হবে। সেটা হয়তো মাস দুয়েক বাদে শিলিগুড়িতে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “বাহ, সত্যি একটা ভালো খবর। তুই তো ব্যাঙ্কের চাকরীই চাস। তাহলে রিটেনে যখন কোয়ালিফাই করেছিস, এবার ভাইভার জন্যে ভালো করে প্রিপারেশন নিস। আর বাড়ির সবাই কে কেমন আছে রে”?
সতীশ বলল, “সবাই ভাল আছে রে দিদি। সবাই আগের মতই আছে, তবে দাদা আর বৌদিভাইকে এখনও সকলেই মিস করছে। কিন্তু চন্দুকে দেখলে তুই অবাক হয়ে যাবি। ও অনেক বদলে গেছে। আগে যেমন সব সময় ছুটোছুটি করত। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধূলা বেশী করত, এখন ঠিক তার উল্টো। আগের চেয়ে এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে ও। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। আগের মত খেলাধূলোও করতে চায় না। ও এখন ভাবে ওকে বৌদিভাইয়ের মত ব্রিলিয়ান্ট হতে হবে পড়াশোনায়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস? এবারের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় ও সেকেন্ড পজিশন পেয়েছে ক্লাসে। এর আগে তো টপ টেনের মধ্যেও থাকত না। কত চেঞ্জ হয়েছে বুঝতে পারছিস”?
সীমন্তিনী মনে মনে খুশী হয়ে বলল, “সত্যি খুব ভাল লাগল রে কথাটা শুনে। আসলে রচু বাড়ি থেকে চলে যেতেই বুঝি ও নিজেকে পাল্টে ফেলেছে। রচুই যে ওর চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মেয়ে। তাই বোধহয় ও রচুকেই নিজের রোল মডেল করে নিয়েছে”।
সতীশ বলল, “হ্যারে দিদি, তুই একেবারে ঠিক বলেছিস। আমি দেখেছি, ওর পড়ার টেবিলে আর কলেজের ব্যাগে সব সময় বৌদিভাইয়ের ছবি রাখে। ছোটমা একদিন বলছিলেন, ও নাকি রোজ রাতে পড়তে বসবার আগে বৌদিভাইয়ের ছবির সামনে হাতজোড় করে চোখ বুজে কয়েক মিনিট কাটায়। তবে মেয়েটার মুখ থেকে হাসিটা যেন হারিয়ে গেছে রে দিদি। ও বোধহয় হাসতেই ভুলে গেছে এখন”।
সীমন্তিনী বলল, “সেটা নিয়ে ভাবিস নে ভাই। পূজোর সময় রচু বাড়ি এলেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠবে, দেখিস। আচ্ছা ভাই আমার একটা অনুরোধ তোকে রাখতে হবে”।
সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কিসের অনুরোধ”?
সীমন্তিনী বলল, “আসলে ভাই আমি রচুকে আজ একটা মিথ্যে কথা বলেছি। বলেছি যে ক’দিন আগে তুই আমাকে ফোন করে রচু আর দাদাভাইয়ের ব্যাপারে এমন একটা কথা বলেছিস যা আমি বিশ্বেস করিনি। তুই আমাকে বলেছিলি যে ওরা কলকাতা যাবার দিন দাদাভাই ঘিয়ে রঙের শার্ট আর কালো রঙের জীনস পড়েছিল। আর রচু পড়েছিল হাল্কা গোলাপী রঙের কামিজ আর ডীপ গ্রীন কালারের শালোয়ার। আমি তোর কথা বিশ্বেস না করে তোর সাথে দু’শ টাকার বাজি ধরেছিলুম। আর তোর কথাই ঠিক ছিল বলে আমি বাজিটা হেরে গেছি। এ’কথাটুকুই শুধু বলতে হবে”।
সতীশ বলল, “বলতে হবে, সে না হয় বুঝলুম। কিন্তু কথাটা কাকে বলতে হবে সেটা তো বল”।
সীমন্তিনী বলল, “কেউ তোকে জিজ্ঞেস না করলে কাউকেই বলবার দরকার নেই। তবে আমার মনে হয় রচু তোর কাছে জানতে চাইবে যে এমন একটা বাজি তোর আমার মধ্যে হয়েছিল কি না। তখন রচুকে তুই বলিস যে কথাটা সত্যি। ওই কথাগুলো তুই আমাকে বলেছিলিস। আর আমি বাজি হেরে গেছি। তাই এখন আমার তোকে দু’শ টাকা দিতে হবে”।
সতীশ এবার আঁতকে উঠে বলল, “কি বলছিস তুই দিদি? বৌদিভাইকে আমি মিথ্যে বলব”?
সীমন্তিনী বলল, “প্লীজ লক্ষ্মী ভাই আমার কথাটা রাখিস। আর যে মিথ্যে কথায় কারো কোন ক্ষতি হয় না তেমন মিথ্যে বলাতে দোষের কিছু নেই। আমি ওকে মিথ্যে কথাটা বলেছি বলেই তোকে এ’কথা বলছি। আর তুই তো নিজে থেকে ওকে মিথ্যে বলছিস না। তুই তো জানিস, রচু যদি বুঝতে পারে যে আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছি, তাহলে ও কতটা দুঃখ পাবে। তুই যদি আমার অনুরোধ না মেনে ওকে সত্যি কথা বলে দিস তাহলে যে সেটাই হবে। তাই তো তোকে এ অনুরোধ করছি ভাই। আর তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ না এতে তোর আমার, রচুর বা অন্য কারো তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। প্লীজ ভাই, আমার কথাটা রাখিস। তবে রচু যদি এ ব্যাপারে তোকে কিছু জিজ্ঞেস না করে তাহলে তো তোকে আর নিজে থেকে এমন কথা বলতে হবে না। ও জানতে চাইলেই শুধু তুই এটুকু মিথ্যে বলিস, আমার আর রচুর মুখের দিকে চেয়ে। প্লীজ ভাই”।
সতীশ আবার জিজ্ঞেস করল, “তা তুইই বা বৌদিভাইকে এমন একটা মিথ্যে কথা বলতে গেলি কেন রে দিদি”?
সীমন্তিনী অসহায় ভাব করে বলল, “জানিনে রে ভাই। এমনি কথায় কথায় বলে ফেলেছিলুম। কিন্তু ও যদি জানতে পারে যে আমি ওকে মিথ্যে বলেছি, তবে খুব দুঃখ পাবে রে। তাই তো তোকে এমন অনুরোধ করছি। প্লীজ ভাই, আমি তো একটা ভুল করে ফেলেছিই। কিন্তু তোর সাথে আমার এমন কোন ধরণের কথা হয়নি বলে রচুকে আর দুঃখ দিস না ভাই”।
সতীশ এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তোর কথা এবারের মত মেনে নিচ্ছি আমি। কিন্তু প্লীজ দিদি, বৌদিভাইয়ের কাছে আর কখনও আমাকে মিথ্যে কথা বলতে অনুরোধ করিস না”।
সীমন্তিনী বলল, “আর কক্ষনো বলব না ভাই। আমি তোকে এ’কথা দিলুম। লক্ষ্মী ভাই আমার। কথাটা মনে রাখিস। আর ভালো থাকিস। হ্যারে, তোর মেজকাকু আর মেজোমা ভালো আছেন তো”?
সতীশ এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিল, “হ্যাঁ ওনারা ও সূর্য্য ভাল আছে”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “ঠিক আছে রে সতু। রাখছি” বলেই ফোন কেটে দিল।।
*****************
নবনীতা আর অর্চনা এতক্ষণ অবাক হয়ে সীমন্তিনীর ফোনে কথা বলা শুনে যাচ্ছিল। ফোন নামিয়ে রেখে সীমন্তিনীকে নিজের চোখ মুছতে দেখে অর্চনা ছুটে তার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “কাঁদছো কেন তুমি দিদিভাই। কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? আবার অন্য কারো কিছু হয়েছে নাকি”?
সীমন্তিনী নিজের চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে করতে মুখে হাসি এনে বলল, “নারে বোন। কিচ্ছু হয়নি। অনেকদিন বাদে আমার এক ভাইয়ের সাথে কথা বললুম তো। তাই কেন যেন চোখে জল এসে পড়েছিল”।
নবনীতা তখন বলল, “কিন্তু দিদি তুমি বৌদির সাথে কথা বলবার সময় ও’সব কি বললে গো? বৌদিরা কলকাতা যাবার সময় কে কী পড়েছিল এ নিয়ে তো আমরা কোন কথাই বলিনি। আবার তুমি বৌদিকে বললে যে একজনের সাথে তুমি বাজি ধরে হেরে গেছ। পরে আবার তোমার কোন ভাইকে বললে যে সেও যেন বৌদির কাছে মিথ্যে কথা বলে। আমি তো এসবের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে সাথে নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “নিজেদের কাজ হাসিল করতে পুলিশ অফিসারদের অনেক সময়ই এমন মিথ্যে কথা বলতে হয়। অনেক রকম অভিনয় করতে হয়। শুধু সত্যিটাকে খুঁজে বের করবার জন্যে। ও’সব নিয়ে তোমরা মাথা ঘামিও না। তবে তোমরা দু’জন যেহেতু আমার সঙ্গে আছো, তাই প্রয়োজনে আমার সাথে সাথে তোমাদেরকেও কিন্তু একটু অভিনয় করে যেতে হবে ভাই। তোমরা তো এতক্ষণে বুঝেই গেছ যে আমি রচুকে মিথ্যে কথা বলেছি একটু আগে। কিন্তু যে কথাগুলো রচুকে বলেছি সেগুলো যে সত্যি, এটা প্রয়োজন হলে তোমরাও ওকে বলবে। রচুকে বিপদমুক্ত করতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে এমন একটা বিপদের সম্ভাবনা ওর ওপর এল কিভাবে? কোন দিক থেকে? আর এর পেছনে কে বা কারা আছে, এসব আমাদের জানতে হবে। তবেই না আমরা তার মোকাবিলা করতে পারব। রচুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে ওর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। এমনিতেই ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু ভাবলেই ও বুঝে যাবে দু’মাস আগে ওদের কলকাতা যাবার ব্যাপার নিয়ে আমি কেন হঠাৎ উঠে পড়ে লাগলুম। ওর মনে নিশ্চয়ই কোনও সন্দেহের উদয় হবে। তখন আমাকে বা তোমাদেরকে নানাভাবে প্রশ্ন করে ও ওর মনে জেগে ওঠা সন্দেহ দুর করতে চাইবে। তখন ওকে নিবৃত্ত করতে আমাদের হয়তো আরও অনেক মিথ্যে কথা বলতে হবে। তাই গোড়াতেই একটা মিথ্যে বলে ওর মনে যাতে কোন সন্দেহ দেখা না দেয় সে চেষ্টাই করলুম। অবশ্য তোমাদের মনে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যে রচু সোনাকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসি, তাকে আমি কেন মিথ্যে কথা বললুম এভাবে। আমার মনেও যে কষ্ট হয়নি তা নয়। কিন্তু রচুকে বিপদমুক্ত করতে মিছে কথা বলে ওর কাছ থেকে এ ইনফরমেশনটুকু নেওয়া খুব দরকার ছিল। নইলে আমি গোটা ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারতুম না। কিন্তু এখন আমার কাছে সব ব্যাপার স্পষ্ট”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝতে পারলে দিদিভাই? বলবে না আমাদের”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “অন্ততঃ এ ব্যাপারে তো তোমাদের কাছে কিছু লুকোবো না অর্চু। কারন সেটা করলে তোমরা দু’জনেই নানারকম দুশ্চিন্তায় ভুগবে। তবে একটু ধৈর্য ধরো তোমরা ভাই। এক্ষুনি জানতে পারবে। তবে একটু আগে ফোনে ভাইকে আমি যে কথাটা বললুম, তোমাদের দু’জনকেও ঠিক একই কথা বলবো। দু’মাস আগে কলকাতা যাবার সময় দাদাভাই আর রচু কি পোশাক পড়ে গিয়েছিল সেটা জানতে আমি যে রচুকে মিথ্যে কথা বলেছি, সেটা কোনভাবেই রচুকে জানাবে না তোমরা। রচু যদি কখনো তোমাদের কাউকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে তোমরাও কিন্তু ভাইয়ের মত মিথ্যে কথাই বলবে। আর নিতান্তই যদি তা করতে না পারো তাহলে রচুকে বোলো যে তোমরা কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানো না। তোমরা আমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো” বলে নিজের হাত সামনে মেলে ধরল।
নবনীতা আর অর্চনা পরস্পরের দিকে দেখে নিজেদের হাত বাড়িয়ে সীমন্তিনীর হাতের ওপর রেখে বলল, “আমরা কথা দিলাম তোমাকে”।
______________________________
সকালের ব্রেকফাস্ট আর চা খাবার পর মহিমার সাথে গত রাতে যা যা কথা হয়েছে সীমন্তিনী তার সবটুকু নবনীতা আর অর্চনাকে খুলে বলল। সবটুকু শুনে অর্চনা আর নবনীতা দু’জনেই খুব ঘাবড়ে গেল।
অর্চনা শুকনো মুখে সীমন্তিনীকে বলল, “রচুর তো তবে ভারী বিপদ গো দিদিভাই। কি হবে বল তো”?
সীমন্তিনী তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ভেবো না অর্চু। আমি আছি তো। আমার ওপর তোমার ভরসা নেই? কিচ্ছুটি হতে দেব না রচুর। তুমি শুধু আমার কথাগুলো মেনে চলো। কাউকে কিচ্ছুটি জানাবে না। বাকি সব কিছু আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি বেঁচে থাকতে রচুর একটা চুলের ডগাও কেউ ছুঁতে পারবে না” বলে সে এবার নবনীতাকে বলল, “আচ্ছা নীতা, তুমি আমাকে একটা কথা বলো তো। দ্যাখো আমরা কেউ তো আর মহিমা বৌদিকে চিনি না। তুমি তার সাথে কিছুদিন কাজ করেছ। আর তোমার বান্ধবী বীথিকার কাছ থেকেও তুমি হয়ত তার ব্যাপারে কিছু কিছু কথা শুনে থাকতে পার। তোমার কি মনে হয় সে আমার কাছে কোনও মিথ্যে কথা বলেছে। কিংবা তার ব্যাপারে যেসব কথা আমি তোমাদের এখন বললুম, মানে সে আমাকে নিজের সম্মন্ধে যা কিছু বলেছে, সে সব কি তোমার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে”?
নবনীতা অনায়াসেই জবাব দিল, “না দিদি। আমার তেমন কিছু মনে তো একেবারেই হচ্ছে না। বরং এটা ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি যে ম্যাডাম নিজে মুখে এ’সব কথা তোমাকে বলেছেন। তুমি যে একজন আইপিএস অফিসার, এ’কথা না জানলেও তার গোপন ব্যবসার ভেতরের এতসব কথা উনি স্বেচ্ছায় তোমাকে বলে দিলেন এটা ভেবেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য অবিশ্বাস্য লাগছে আমার। কিন্তু বৌদি, আমি তার সম্মন্ধে যতটুকু জানি, তাতে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে উনি হয়তো আরও কিছু কথা তোমার কাছে গোপন করেও যেতে পারেন। যেতে পারেনই বা বলছি কেন, নিশ্চয়ই গোপন করে গেছেন। তবে রচনা বৌদির ব্যাপারে যতটুকু তোমাকে বলা প্রয়োজন মনে করেছেন ঠিক ততটুকুই বলেছেন। এ ছাড়াও তার জীবনে গোপন অনেক কথাই হয়তো আছে। কিন্তু যতটুকু বলেছেন এতে কোনও মিথ্যে নেই। বীথির মুখে আমি এ’সবের অনেকটাই শুনেছি। অনৈতিক বা সমাজের কাছে নিন্দনীয় এবং অপরাধমূলক ওই ব্যবসা করলেও উনি কাউকে তার ইচ্ছের বিরূদ্ধে তার ব্যবসায় টেনে নামান না। আমি নিজেই তো তার সাক্ষী আছি। আমি যখন তার কাছে গিয়েছিলাম তিনি বারবার জানতে চেয়েছেন যে আমি বীথির বা অন্য কারুর প্ররোচনায় তার ব্যবসায় নামতে রাজি হয়েছি কি না। তিনি তো আমাকে এ’কথাও বলেছিলেন যে দু’তিন মাসের জন্য তিনি নিজে আমার থাকা খাওয়া পড়ার সমস্ত দায়িত্ব নেবেন। ওই সময়ের মধ্যে আমি যেন আবার ভদ্র সভ্য হয়ে বাঁচবার মত কিছু একটা কাজ খুঁজে নিই। আর বীথিকার মুখেই শুনেছি, যেসব মেয়ে মহিলা তার এজেন্সীতে কাজ করে তাদের সকলের প্রতিই তিনি খুব সহানুভূতিশীল। প্রত্যেকের সুবিধে অসুবিধের দিকে তার নজর থাকে। নানাভাবে তাদের সাহায্য করে থাকেন। কোন মেয়ে যদি ওই পথ ছেড়ে সৎ ভাবে নিজের জীবন কাটানোর কোনও সুযোগ পায়, তাহলে অন্যদের মত বাধা তো তিনি দেনই না, উল্টে তাকে সাহায্যই করেন। তাই ম্যাডামের কাছে যত মেয়ে মহিলা কাজ করে তারা সবাই ম্যাডামের খুব অনুগত। তারা কেউ ম্যাডামকে কোন রকম ঝুট ঝামেলায় ফেলতে চায় না। তার এজেন্সীতে যেসব ছেলে ছোকড়া কাজ করে তাদের ব্যাপারে আমি অত জোর দিয়ে কিছু না বলতে পারলেও, এটা আমি জানি যে যেসব মেয়েরা শুধুই শারিরীক ক্ষুধা আর কেবলই পয়সা কামাবার জন্যে এ’পথে আসতে চায়, ম্যাডাম তাদের কাউকে তার এজেন্সীতে সুযোগ দেন না। যেসব মেয়েরা অন্য কোন কিছু করতে না পেরে, অন্য কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে নিজের বা পরিবারের ভরন পোষনের জন্য এ পথে নামতে বাধ্য হয়, ম্যাডাম শুধু সে’সব মেয়েদেরই তার ওখানে সুযোগ দিয়ে থাকেন। আর তিনি শুধু নিজের উপার্জনটাকেই বড় করে দেখেন না। নিজের ক্ষতি স্বীকার করেও তার এজেন্সীর মেয়ে মহিলাদের সাহায্য করে থাকেন। তাই তার ব্যবসাটা যতই নিন্দনীয় হোক না কেন, ম্যাডাম কখনও কাউকে এক্সপ্লয়েট করে নিজের সিন্দুক ভরেন না। বরং বিপদে আপদে তিনি সকলের পাশেই দাঁড়ান। বীথিকার মুখে এমন অনেক ঘটণা আমি শুনেছি। আমাকেও কাজে নেবার সময় তিনি বলেছিলেন যে আমার ইচ্ছে হলে আমি যে কোন সময় তার কাজ ছেড়ে দিতে পারি। আর সে জন্যেই তুমি যখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে বলেছিলে তখন আমি তাকে কথাটা বলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আর পরি কিছু একটা ভেবেই বোধহয় আমাকে সেটা করতে দাও নি। আমি যে তার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাকে কিছু না বলে, কিছু না জানিয়েই তোমার সাথে চলে এসেছি, তাতে আমার মনে একটা গ্লানিভাব কিন্তু থেকেই গেছে। আমি যদি তাকে সবকিছু বলেই তোমার সাথে চলে আসতাম, তবুও উনি আমায় কিচ্ছু বলতেন না। হয়তো আমার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য আমাকে শুভেচ্ছাই জানাতেন। তাই আমার মনে হয় না ম্যাডাম তোমাকে কোনও মিথ্যে কথা বলেছেন”।
সীমন্তিনী নবনীতার কথায় বেশ অবাকই হল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেক্স র*্যাকেটের ব্যবসায় লিপ্ত থাকা এক মহিলা কি সত্যিই এতোটা সংবেদনশীল হতে পারে? এমনটা তো সে কোনও গল্প কাহিনীতেও পড়ে নি। এ কেমন ধরণের মহিলা? একদিকে সমাজ, পুলিশ, আইন আদালতকে ফাঁকি দিয়ে এতগুলো ছেলে মেয়েকে নিয়ে এমন অনৈতিক একটা ব্যবসা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে অপরের দুঃখে পাশে থেকে তাদের সাহায্য করে যাচ্ছে!
এমন সময় অর্চনা বলল, “আচ্ছা দিদিভাই, মহিমা বৌদি কি রচুর সেই ছবিটা পাঠিয়েছে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “আমি যখন স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলুম তখন মোবাইলে একটা এলার্ট সাউন্ড হয়েছিল। বোধহয় পাঠিয়েছে, দাঁড়াও দেখছি” বলে নিজের পার্সোনাল মোবাইলটা হাতে নিয়ে মহিমার পাঠানো ফোল্ডারটা খুলে রচনার ছবিটা বের করেই বলল, “হ্যাঁ এই তো। এই দ্যাখো” বলে খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। নবনীতা আর অর্চনাও তার দু’পাশ থেকে রচনার ছবিটা দেখতে লাগল। ছবিটা যে কেউ মোবাইলেই তুলেছে সেটা সীমন্তিনী এক নজরেই বুঝতে পারল। হাল্কা গোলাপী কামিজ পড়া রচনার ছবিটা সত্যিই খুব সুন্দর লাগছিল দেখতে। ঘন সবুজ রঙের একটা ওড়না পড়ে আছে। রচনার পাশে ঘিয়ে রঙের শার্ট পড়া কেউ একজন আছে। তবে তার মুখ বা শরীরের কিছুই ছবির ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে না। সীমন্তিনী খুব ভালভাবে ছবিতে রচনার পেছনের দিকের জিনিসগুলো দেখে বুঝতে পারল যে ছবিটা কোনও ট্রেণের কামরার ভেতরে তোলা। রচনার মাথার ওপর ট্রেনের কামরার ওপরের দিকের একটা বার্থের ছবি বেশ পরিস্কারই বোঝা যাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবল, বিয়ের পর রতীশ আর রচনা হানিমুনে গিয়েছিল সাউথ ইন্ডিয়ায়। ট্রেনেই যাতায়াত করেছিল তখন। আর বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যাবার সময়েও তারা ট্রেনেই জার্নি করেছিল। এ ছাড়া রচনা তো অন্য কোনও সময় ট্রেন জার্নি করেনি। অন্ততঃ বিয়ের পর তো আর করেনি। কিন্তু ছবিতে রচনার কপালে আর সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাহলে ওদের বিয়ের পর ট্রেণের কামরার ভেতরের এ ছবিটা কে কবে কখন তুলেছিল। আরও একটু ভাবতে তার মনে হল রচনার পাশে বসা লোকটার যে শার্টটা খানিকটা দেখা যাচ্ছে, এরকম একটা ঘিয়ে রঙের শার্ট সে হায়দ্রাবাদ ট্রেনিংএ থাকবার সময় রতীশকে পুজোর উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল। তাই মনে হচ্ছে রচনার পাশে ঘিয়ে শার্ট পড়ে রতীশই বসে ছিল তখন। তার মানে এটা তো পরিস্কার যে ছবিটা রতীশ তোলেনি। অন্য কেউ কামরার রচনাদের সীটের উল্টোদিকের সীটে বসে ছবিটা তুলেছে। তার হঠাতই মনে হল, রচনা আর রতীশ হানিমুনে গিয়েছিল ২০০৯ এর এপ্রিল মাসে। ওদের বিয়ের প্রায় মাসখানেক বাদে। আর সীমন্তিনী হায়দ্রাবাদ থেকে বাড়ির সকলের জন্য পূজোর উপহার পাঠিয়েছিল সে বছরের অক্টোবর মাসে। তাই রচনার পাশে বসা লোকটা যদি সত্যিই রতীশই হয়ে থাকে, তাহলে এটা ওদের হানিমুনের সময়কার ছবি হতে পারে না। তার ধারণা সত্যি হলে এটা ধরে নেওয়া যায় যে রচনা আর রতীশ যখন কলকাতা যাচ্ছিল তখনই ট্রেণে এ ছবিটা কেউ তুলেছিল। কিন্তু কে তুলে থাকতে পারে? হঠাতই রবিশঙ্করের কথা মনে পড়ল। কলকাতা যাবার পথে রবিশঙ্কর রচনা আর রতীশের সহযাত্রী ছিল। তাহলে রবিশঙ্করই কি এ ছবি তুলেছিল? তার পুলিশি মন বলছে এটা রবিশঙ্করই হবে। কিন্তু বিমল আগরওয়ালা তো রতীশকে বলেছিল যে সে রবিশঙ্কর নামে কাউকে চেনে না। তাহলে এ ছবি বিমলের হাতে কি করে যেতে পারে! সীমন্তিনী বুঝল তার ধারণা অনুযায়ী যদি রবিশঙ্করই এ ছবি তুলে থাকে তাহলে ধরে নিতেই হচ্ছে যে রবিশঙ্করের কাছ থেকেই বিমল এ ছবি পেয়েছে। আর তাহলে এটাও পরিস্কার যে বিমল আগরওয়ালা রতীশকে তখন মিথ্যে কথা বলেছিল। রবিশঙ্করকে সে নিশ্চয়ই চিনত। আর ওই চেনাজানার সূত্রেই বিমলের ওই কমপ্লেক্সের চাবি রবিশঙ্করের হাতে এসে থাকতে পারে। মহিমার ধারণা বিমল আগে রচনার ব্যাপারে যার সাথে কন্টাক্ট করেছিল, ছবিটা সে-ই দিয়েছে বিমলকে। তাহলে রবিশঙ্করই কি সে লোক? সে রতীশের দু’লক্ষ টাকা লুট করে নেবার পাশাপাশি রচনাকে বিমলের হাতে তুলে দিয়েও আরও কিছু পয়সা রোজগারের মতলবে ছিল? মহিমাকে বিমল তো এমন কথাও বলেছে যে সে আগে যে লোকটার সাথে রচনার ব্যাপারে কন্টাক্ট করেছিল সে লোকটা নাকি অন্য একটা কেসে ফেঁসে গিয়ে এখন জেলে আছে। রবিশঙ্করও তো এখন জেলেই আছে। তাহলে তো দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাচ্ছে। তবু একটা ব্যাপারে আরেকটু শিওর হতে পারলেই একেবারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সীমন্তিনী মোবাইলটা অর্চনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে উঠে ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে রচনাকে ফোন করল। রচনা ফোন ধরেই বলল, “হ্যাঁ বল দিদিভাই। আবার কী মনে করে ফোন করলে এখন”?
সীমন্তিনী হাল্কা ভাবে বলল, “অফিসে না গিয়ে ঘরে বসে আর সময় কাটতে চাইছে না রে। এতক্ষণ বকর বকর করে অর্চু আর নীতার মাথা খেয়েছি। এবার ভাবলাম, একটু তোর মাথাটা চিবিয়ে খাই। তা কি রান্না করছিস? রান্না হয়ে গেছে? না বাকি আছে”?
রচনাও হেসে জবাব দিল, “তুমি এ সময়ে ফোন করাতে আমারও যেন কেমন লাগছে গো দিদিভাই। মনে হচ্ছে তুমি নও, অন্য কারো সাথে কথা বলছি। আসলে এ সময়ে তো আমাদের কোনদিন কথা হয় না। তা যাই হোক, আমার রান্না প্রায় শেষের মুখে। ডাল, ভাজা, কচু শাক আর চিকেন বানিয়েছি আজ। শুধু ভাতটাই এখন বাকি আছে”।
সীমন্তিনী বলল, “অর্চু আর নীতার সাথে তোর কলকাতা যাবার সময় তুই যে কত কান্নাকাটি করেছিলি, কলকাতা অব্দি সারাটা রাস্তাই যে ট্রেনে বসে কেঁদেছিস, এসব গল্প করছিলাম রে। আচ্ছা রচু, তোর কি মনে আছে? তুই আর দাদাভাই সেদিন কোন রঙের কোন পোশাক পড়ে ট্রেনে উঠেছিলি”?
রচনা গলাটা একটু ভার করে জবাব দিল, “সে দিনটা কি আমি কোনদিন ভুলতে পারব দিদিভাই। সারাটা ক্ষণ বাড়ির লোকগুলোর কথা ভেবেছি আমি। বারবার চন্দুর কথা মনে হতেই আমার চোখ জলে ভরে যেত। তা সেদিন আমরা কী পোষাক পড়ে এসেছি সেটা দিয়ে এখন কি করবে তুমি”?
সীমন্তিনী বলল, “আরে এরমধ্যেই ক’দিন আগে সতুর সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। সতু বলছিল তুই নাকি সেদিন গোলাপী রঙের কামিজের সাথে সবুজ শালোয়ার পড়েছিলি। আর দাদাভাই না কি ঘিয়ে রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়েছিল। আমি নিজে তো সেখানে ছিলুম না। কিন্তু ওর কথা বিশ্বাস হয়নি আমার। আজ অর্চুদের সাথে কথা বলতে বলতে সে কথাটা মনে হতেই তোকে জিজ্ঞেস করছি। তা তোর কি মনে আছে সে’কথা”?
রচনা বলল, “মেজদাভাই একদম ঠিক বলেছে দিদিভাই। আমি সত্যিই হাল্কা গোলাপী রঙের কামিজ আর ডার্ক গ্রীন কালারের শালোয়ার পড়েছিলুম। আর তুমি আমাদের বিয়ের পর প্রথম পূজোয় হায়দ্রাবাদ থেকে যখন সকলের জন্যে পূজোর জামাকাপড় পাঠিয়েছিলে, তখন তোমার দাদাভাইয়ের জন্য যে ঘিয়ে রঙের শার্টটা পাঠিয়েছিলে, উনি সেদিন ওটাই পড়েছিলেন। আর সাথে পড়েছিলেন একটা কালো জীনসের প্যান্ট। কিন্তু মেজদাভাইয়ের এসব কথা মনে আছে শুনে বেশ অবাক হচ্ছি। বেশ উন্নতি হয়েছে তার, বলতে হবে কথাটা তাকে”।
সীমন্তিনী বলল, “হু আমার ভাইটার বেশ উন্নতি হয়েছে। নইলে তোদের বিয়ের আগে আমরা দু’জন যখন জলপাইগুড়িতে থাকতুম, তখন ও আগের দিন কি খেয়েছে সেটা আর পরের দিন মনে করতে পারত না। আর এখন দ্যাখ, প্রায় দু’মাস আগে তোরা সেদিন কে কি পড়েছিলিস, সেটা একেবারে ঠিক ঠিক বলে দিল। দু’শ টাকার বাজিটা হারলাম আমি। আচ্ছা সে যাক, দাদাভাই কি ঘরে ফিরেছে”?
রচনা বলল, “তার ঘরে ফিরতে ফিরতে তো বারোটা সাড়ে বারোটা হয়েই যায় দিদিভাই। তবে এখন বোধহয় তাদের ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। হয়তো রাস্তায় আছেন”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে রে রচু। রাখছি এখন। দুপুরে দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলব’খন”।
ফোন কেটে দিয়েই সে সতীশের নাম্বার ডায়াল করল। সতীশ ফোনে সাড়া দিতেই সীমন্তিনী বলল, “ভাই, কেমন আছিস”?
সতীশ জবাব দিল, “ভাল আছি রে দিদি। একটা সুখবর আছে রে”।
সীমন্তিনী উৎসুক ভাবে জিজ্ঞেস করল, “কি সুখবর রে”?
সতীশ বলল, “কিছুদিন আগে ব্যাঙ্কের একটা রিটেন টেস্ট দিয়েছিলুম। কাল তার রেজাল্ট বেড়িয়েছে। আর আমি তাতে কোয়ালিফাই করেছি। এরপর ভাইভাতে অ্যাপিয়ার হতে হবে। সেটা হয়তো মাস দুয়েক বাদে শিলিগুড়িতে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “বাহ, সত্যি একটা ভালো খবর। তুই তো ব্যাঙ্কের চাকরীই চাস। তাহলে রিটেনে যখন কোয়ালিফাই করেছিস, এবার ভাইভার জন্যে ভালো করে প্রিপারেশন নিস। আর বাড়ির সবাই কে কেমন আছে রে”?
সতীশ বলল, “সবাই ভাল আছে রে দিদি। সবাই আগের মতই আছে, তবে দাদা আর বৌদিভাইকে এখনও সকলেই মিস করছে। কিন্তু চন্দুকে দেখলে তুই অবাক হয়ে যাবি। ও অনেক বদলে গেছে। আগে যেমন সব সময় ছুটোছুটি করত। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধূলা বেশী করত, এখন ঠিক তার উল্টো। আগের চেয়ে এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে ও। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। আগের মত খেলাধূলোও করতে চায় না। ও এখন ভাবে ওকে বৌদিভাইয়ের মত ব্রিলিয়ান্ট হতে হবে পড়াশোনায়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস? এবারের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় ও সেকেন্ড পজিশন পেয়েছে ক্লাসে। এর আগে তো টপ টেনের মধ্যেও থাকত না। কত চেঞ্জ হয়েছে বুঝতে পারছিস”?
সীমন্তিনী মনে মনে খুশী হয়ে বলল, “সত্যি খুব ভাল লাগল রে কথাটা শুনে। আসলে রচু বাড়ি থেকে চলে যেতেই বুঝি ও নিজেকে পাল্টে ফেলেছে। রচুই যে ওর চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মেয়ে। তাই বোধহয় ও রচুকেই নিজের রোল মডেল করে নিয়েছে”।
সতীশ বলল, “হ্যারে দিদি, তুই একেবারে ঠিক বলেছিস। আমি দেখেছি, ওর পড়ার টেবিলে আর কলেজের ব্যাগে সব সময় বৌদিভাইয়ের ছবি রাখে। ছোটমা একদিন বলছিলেন, ও নাকি রোজ রাতে পড়তে বসবার আগে বৌদিভাইয়ের ছবির সামনে হাতজোড় করে চোখ বুজে কয়েক মিনিট কাটায়। তবে মেয়েটার মুখ থেকে হাসিটা যেন হারিয়ে গেছে রে দিদি। ও বোধহয় হাসতেই ভুলে গেছে এখন”।
সীমন্তিনী বলল, “সেটা নিয়ে ভাবিস নে ভাই। পূজোর সময় রচু বাড়ি এলেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠবে, দেখিস। আচ্ছা ভাই আমার একটা অনুরোধ তোকে রাখতে হবে”।
সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কিসের অনুরোধ”?
সীমন্তিনী বলল, “আসলে ভাই আমি রচুকে আজ একটা মিথ্যে কথা বলেছি। বলেছি যে ক’দিন আগে তুই আমাকে ফোন করে রচু আর দাদাভাইয়ের ব্যাপারে এমন একটা কথা বলেছিস যা আমি বিশ্বেস করিনি। তুই আমাকে বলেছিলি যে ওরা কলকাতা যাবার দিন দাদাভাই ঘিয়ে রঙের শার্ট আর কালো রঙের জীনস পড়েছিল। আর রচু পড়েছিল হাল্কা গোলাপী রঙের কামিজ আর ডীপ গ্রীন কালারের শালোয়ার। আমি তোর কথা বিশ্বেস না করে তোর সাথে দু’শ টাকার বাজি ধরেছিলুম। আর তোর কথাই ঠিক ছিল বলে আমি বাজিটা হেরে গেছি। এ’কথাটুকুই শুধু বলতে হবে”।
সতীশ বলল, “বলতে হবে, সে না হয় বুঝলুম। কিন্তু কথাটা কাকে বলতে হবে সেটা তো বল”।
সীমন্তিনী বলল, “কেউ তোকে জিজ্ঞেস না করলে কাউকেই বলবার দরকার নেই। তবে আমার মনে হয় রচু তোর কাছে জানতে চাইবে যে এমন একটা বাজি তোর আমার মধ্যে হয়েছিল কি না। তখন রচুকে তুই বলিস যে কথাটা সত্যি। ওই কথাগুলো তুই আমাকে বলেছিলিস। আর আমি বাজি হেরে গেছি। তাই এখন আমার তোকে দু’শ টাকা দিতে হবে”।
সতীশ এবার আঁতকে উঠে বলল, “কি বলছিস তুই দিদি? বৌদিভাইকে আমি মিথ্যে বলব”?
সীমন্তিনী বলল, “প্লীজ লক্ষ্মী ভাই আমার কথাটা রাখিস। আর যে মিথ্যে কথায় কারো কোন ক্ষতি হয় না তেমন মিথ্যে বলাতে দোষের কিছু নেই। আমি ওকে মিথ্যে কথাটা বলেছি বলেই তোকে এ’কথা বলছি। আর তুই তো নিজে থেকে ওকে মিথ্যে বলছিস না। তুই তো জানিস, রচু যদি বুঝতে পারে যে আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছি, তাহলে ও কতটা দুঃখ পাবে। তুই যদি আমার অনুরোধ না মেনে ওকে সত্যি কথা বলে দিস তাহলে যে সেটাই হবে। তাই তো তোকে এ অনুরোধ করছি ভাই। আর তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ না এতে তোর আমার, রচুর বা অন্য কারো তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। প্লীজ ভাই, আমার কথাটা রাখিস। তবে রচু যদি এ ব্যাপারে তোকে কিছু জিজ্ঞেস না করে তাহলে তো তোকে আর নিজে থেকে এমন কথা বলতে হবে না। ও জানতে চাইলেই শুধু তুই এটুকু মিথ্যে বলিস, আমার আর রচুর মুখের দিকে চেয়ে। প্লীজ ভাই”।
সতীশ আবার জিজ্ঞেস করল, “তা তুইই বা বৌদিভাইকে এমন একটা মিথ্যে কথা বলতে গেলি কেন রে দিদি”?
সীমন্তিনী অসহায় ভাব করে বলল, “জানিনে রে ভাই। এমনি কথায় কথায় বলে ফেলেছিলুম। কিন্তু ও যদি জানতে পারে যে আমি ওকে মিথ্যে বলেছি, তবে খুব দুঃখ পাবে রে। তাই তো তোকে এমন অনুরোধ করছি। প্লীজ ভাই, আমি তো একটা ভুল করে ফেলেছিই। কিন্তু তোর সাথে আমার এমন কোন ধরণের কথা হয়নি বলে রচুকে আর দুঃখ দিস না ভাই”।
সতীশ এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তোর কথা এবারের মত মেনে নিচ্ছি আমি। কিন্তু প্লীজ দিদি, বৌদিভাইয়ের কাছে আর কখনও আমাকে মিথ্যে কথা বলতে অনুরোধ করিস না”।
সীমন্তিনী বলল, “আর কক্ষনো বলব না ভাই। আমি তোকে এ’কথা দিলুম। লক্ষ্মী ভাই আমার। কথাটা মনে রাখিস। আর ভালো থাকিস। হ্যারে, তোর মেজকাকু আর মেজোমা ভালো আছেন তো”?
সতীশ এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিল, “হ্যাঁ ওনারা ও সূর্য্য ভাল আছে”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “ঠিক আছে রে সতু। রাখছি” বলেই ফোন কেটে দিল।।
*****************
নবনীতা আর অর্চনা এতক্ষণ অবাক হয়ে সীমন্তিনীর ফোনে কথা বলা শুনে যাচ্ছিল। ফোন নামিয়ে রেখে সীমন্তিনীকে নিজের চোখ মুছতে দেখে অর্চনা ছুটে তার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “কাঁদছো কেন তুমি দিদিভাই। কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? আবার অন্য কারো কিছু হয়েছে নাকি”?
সীমন্তিনী নিজের চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে করতে মুখে হাসি এনে বলল, “নারে বোন। কিচ্ছু হয়নি। অনেকদিন বাদে আমার এক ভাইয়ের সাথে কথা বললুম তো। তাই কেন যেন চোখে জল এসে পড়েছিল”।
নবনীতা তখন বলল, “কিন্তু দিদি তুমি বৌদির সাথে কথা বলবার সময় ও’সব কি বললে গো? বৌদিরা কলকাতা যাবার সময় কে কী পড়েছিল এ নিয়ে তো আমরা কোন কথাই বলিনি। আবার তুমি বৌদিকে বললে যে একজনের সাথে তুমি বাজি ধরে হেরে গেছ। পরে আবার তোমার কোন ভাইকে বললে যে সেও যেন বৌদির কাছে মিথ্যে কথা বলে। আমি তো এসবের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে সাথে নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “নিজেদের কাজ হাসিল করতে পুলিশ অফিসারদের অনেক সময়ই এমন মিথ্যে কথা বলতে হয়। অনেক রকম অভিনয় করতে হয়। শুধু সত্যিটাকে খুঁজে বের করবার জন্যে। ও’সব নিয়ে তোমরা মাথা ঘামিও না। তবে তোমরা দু’জন যেহেতু আমার সঙ্গে আছো, তাই প্রয়োজনে আমার সাথে সাথে তোমাদেরকেও কিন্তু একটু অভিনয় করে যেতে হবে ভাই। তোমরা তো এতক্ষণে বুঝেই গেছ যে আমি রচুকে মিথ্যে কথা বলেছি একটু আগে। কিন্তু যে কথাগুলো রচুকে বলেছি সেগুলো যে সত্যি, এটা প্রয়োজন হলে তোমরাও ওকে বলবে। রচুকে বিপদমুক্ত করতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে এমন একটা বিপদের সম্ভাবনা ওর ওপর এল কিভাবে? কোন দিক থেকে? আর এর পেছনে কে বা কারা আছে, এসব আমাদের জানতে হবে। তবেই না আমরা তার মোকাবিলা করতে পারব। রচুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে ওর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। এমনিতেই ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু ভাবলেই ও বুঝে যাবে দু’মাস আগে ওদের কলকাতা যাবার ব্যাপার নিয়ে আমি কেন হঠাৎ উঠে পড়ে লাগলুম। ওর মনে নিশ্চয়ই কোনও সন্দেহের উদয় হবে। তখন আমাকে বা তোমাদেরকে নানাভাবে প্রশ্ন করে ও ওর মনে জেগে ওঠা সন্দেহ দুর করতে চাইবে। তখন ওকে নিবৃত্ত করতে আমাদের হয়তো আরও অনেক মিথ্যে কথা বলতে হবে। তাই গোড়াতেই একটা মিথ্যে বলে ওর মনে যাতে কোন সন্দেহ দেখা না দেয় সে চেষ্টাই করলুম। অবশ্য তোমাদের মনে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যে রচু সোনাকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসি, তাকে আমি কেন মিথ্যে কথা বললুম এভাবে। আমার মনেও যে কষ্ট হয়নি তা নয়। কিন্তু রচুকে বিপদমুক্ত করতে মিছে কথা বলে ওর কাছ থেকে এ ইনফরমেশনটুকু নেওয়া খুব দরকার ছিল। নইলে আমি গোটা ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারতুম না। কিন্তু এখন আমার কাছে সব ব্যাপার স্পষ্ট”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝতে পারলে দিদিভাই? বলবে না আমাদের”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “অন্ততঃ এ ব্যাপারে তো তোমাদের কাছে কিছু লুকোবো না অর্চু। কারন সেটা করলে তোমরা দু’জনেই নানারকম দুশ্চিন্তায় ভুগবে। তবে একটু ধৈর্য ধরো তোমরা ভাই। এক্ষুনি জানতে পারবে। তবে একটু আগে ফোনে ভাইকে আমি যে কথাটা বললুম, তোমাদের দু’জনকেও ঠিক একই কথা বলবো। দু’মাস আগে কলকাতা যাবার সময় দাদাভাই আর রচু কি পোশাক পড়ে গিয়েছিল সেটা জানতে আমি যে রচুকে মিথ্যে কথা বলেছি, সেটা কোনভাবেই রচুকে জানাবে না তোমরা। রচু যদি কখনো তোমাদের কাউকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে তোমরাও কিন্তু ভাইয়ের মত মিথ্যে কথাই বলবে। আর নিতান্তই যদি তা করতে না পারো তাহলে রচুকে বোলো যে তোমরা কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানো না। তোমরা আমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো” বলে নিজের হাত সামনে মেলে ধরল।
নবনীতা আর অর্চনা পরস্পরের দিকে দেখে নিজেদের হাত বাড়িয়ে সীমন্তিনীর হাতের ওপর রেখে বলল, “আমরা কথা দিলাম তোমাকে”।
______________________________