11-03-2020, 10:23 PM
(Update No. 140)
নবনীতা আর অর্চনা পাশের ঘরে চলে যেতে সীমন্তিনী একবার দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত সাতটা পঁয়ত্রিশ। রচনা বলেছিল রাত সাতটার পর মহিমাকে ফোন করতে। কিন্তু সীমন্তিনীর মন বলছে নবনীতার বলা কথাগুলো নিয়ে আগে ভাল ভাবে ভেবে দেখা দরকার। নবনীতা নিশ্চয়ই বানিয়ে বা বাড়িয়ে কিছু বলে নি। তাই রতীশকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা যথেষ্ট যুক্তিসংগত। কিন্তু রতীশ গত দেড় মাসের ভেতরে মহিমার ওপর একবিন্দু সন্দেহও প্রকাশ করেনি, তাহলে ধরেই নিতে হয়, নীতা যেমনটা বলছে, রতীশ মহিমার ওই এসকর্ট ব্যবসার বিষয়ে এখনও সত্যি কিছু জানে না। রচনাও তো মহিমাকে দেখেছে। সেও নাকি একদিন মহিমার ইনস্টিটিউটে গিয়েছিল। মহিমাও দু’দিন তাদের ফ্ল্যাটে এসে অনেকটা করে সময় কাটিয়ে গেছে। রতীশ খুব সহজেই সবকিছু সাদা বলে ধরে নেয়। কিন্তু রচনা তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। মহিমার কাজে কথায় তার ওপর যে রচনার একটুও সন্দেহ হয়নি, এ তো বলাই বাহুল্য। কারন রচনার মনে তেমন কোনও সন্দেহের ছোঁয়া লেগে থাকলে সে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই সীমন্তিনীকে জানাতো। আর নবনীতা যেমন বলল তাতে মহিমার ওই দেহব্যবসার কাজে শুধু মেয়েরাই নয় অনেক পুরুষও কাজ করে। বড় বড় শহরে অনেক ধনী ও বিত্ত পরিবারের এবং হাই সোসাইটির অনেক মহিলাই নিজেদের দাম্পত্য জীবনে যৌনতার সুখ হারিয়ে ফেলার পর বারমুখো হয়। এদের মধ্যে যাদের আর্থিক সংগতি কিছুটা কম, তারা অনেকেই তাদের পরিচিত সার্কেলের ভেতর নিজেদের চাইতে কমবয়সী বা সমবয়সী ছেলে বা পুরুষের সাথে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর যাদের পয়সার অভাব নেই তারা কোন রকম বাধ্য বাধকতা বা বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে বিভিন্ন এজেন্সী বা দালালের মাধ্যমে সাময়িক যৌনসঙ্গী খুঁজে নিয়ে নিজেদের শারীরিক চাহিদা মিটিয়ে থাকে। রতীশের মত সুন্দর দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী এক পুরুষের ওপর তারা খুব সহজেই আকর্ষিত হবে, এ তো খুবই সহজবোধ্য ব্যাপার। রতীশের মত এক যুবককে নিজেদের শয্যাসঙ্গী করতে তারা অতিরিক্ত টাকাও খরচ করতে রাজী হবে। তাই মহিমা যদি চায় তাহলে রতীশকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর অর্থ কামাতে পারবে সে। আর মহিমা তো রচনাকেও দেখেছে। রচনাকেও ভগবান এতোটাই রূপ সৌন্দর্য দিয়ে পাঠিয়েছেন যে তার মত মেয়ের ওপর কম বয়সী বেশী বয়সী সব পুরুষই আকৃষ্ট হবে। মহিমা কি রচনাকেও তার ওই ব্যবসায় টেনে নেবার অপেক্ষায় আছে? এ’কথা মনে হতেই সীমন্তিনীর শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা বেদনা হতে শুরু করল।
নিজেকে সংযত করে সীমন্তিনী আবার ভাবতে লাগল রচনা আর রতীশকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক প্রশ্ন করে তাকে জানতে হবে মহিমার আচার ব্যবহারে তাদের কখন কেমন মনে হয়েছে। পরিতোষ অবশ্য আগে থেকেই রতীশের ওপর নজর রাখছে। রতীশ ভোরবেলা ঘর থেকে বের হবার পর থেকে সে কখন কোথায় যায়, কতক্ষণ সেন্টারে থাকে, সেন্টার থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যায় এসব কিছুর ওপরেই পরিতোষের নিজস্ব নেটওয়ার্কের লোকেরা নজর রাখছে। পরিতোষের কাছেও তো মনে হয় এমন কোন রিপোর্ট আসেনি। এলে পরিতোষ তাকে অবশ্যই জানাতো। তার মানে ধরে নেওয়া যায় যে রতীশ এখন পর্যন্ত এদিক দিয়ে নিরাপদে আছে। কিন্তু সে তো মহিমার নাগালের ভেতরেই আছে। নবনীতা যেমন ভাবছে তেমনই যে কোন সময় সে মহিমার ওই অনৈতিক ব্যবসার জালে জড়িয়ে পড়তে পারে। মহিমা গত দেড় মাসের ভেতরেও যে রতীশকে এ কাজে নামাবার চেষ্টা করেনি সেটাই একটা আশ্চর্যের বিষয়। আর একবার যদি রতীশ তার ওই জালে জড়িয়ে পড়ে তাহলে রচনাও বেশীদিন মুক্ত থাকবে না। সীমন্তিনীর একবার মনে হল পরিতোষের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে এখনই আলোচনা করা দরকার। আবার পরক্ষণেই মনে হল নাহ এখনই সেটা করা ঠিক হবে না। তার নিজেকে আগে একটা পরিষ্কার ধারণা করে নিতে হবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আর মহিমার সাথেও আগে কথা বলে নিতে হবে। মহিমাই বা তার সাথে আলাপ করবার জন্য হঠাৎ করেই এত উতলা হয়ে উঠেছে কেন? সে সীমন্তিনীর কাছ থেকে কি আশা করতে পারে? অবশ্য মহিমার সাথে কথা বললেই সে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাই সীমন্তিনী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রচনাকে বা রতীশকে এ ব্যাপারে তো কিছু বলবেই না, এমনকি নিজের কাছে গোটা ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার করে নেবার আগে সে পরিতোষকেও কিছু জানাবে না। পরিতোষ তো রতীশের ওপর ভোর সাড়ে চারটে থেকে রাত এগারটা বারোটা অব্দি নজর রাখছেই। তাই এখনই বিচলিত হবার মত কিছু নেই।
এমন সময় ঘরের ল্যান্ড লাইন ফোনটা বেজে উঠল।নিজের ভাবনা ছেড়ে উঠে ফোনের রিসিভার হাতে নিতেই ওপাশে রচনার গলা শোনা গেল, “দিদিভাই কি করছ”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “তেমন কিছু না রে, একটা কাজের ব্যাপারেই একটু ভাবছিলুম। তা তুই হঠাৎ এ সময়ে ফোন করলি? কি ব্যাপার রে? কিছু হয়েছে”?
রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা, কী আবার হবে। আমি তো রোজই রাতের রান্না শেষ করে তোমাকে একবার ফোন করি। আজও তাই করছি। আর তুমি বলছ আমি অসময়ে .........”
দেয়াল ঘড়িতে রাত প্রায় ন’টা বাজতে চলেছে দেখতে পেয়েই সীমন্তিনী রচনাকে মাঝপথে বাঁধা দিয়েই বলল, “ওমা, সত্যি তো রে। রাত ন’টা বেজে গেছে! আমি তো খেয়ালই করিনি রে। সরি সোনা, আমাকে ভুল বুঝিস না বোন। আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে মনে মনে এত ব্যস্ত ছিলুম যে ঘড়ির দিকে নজরই দিই নি” বলতে বলতে দরজার দিকে চোখ যেতেই দেখল নবনীতা আর অর্চনা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। সে হাতের ঈশারায় তাদের ভেতরে আসবার ঈঙ্গিত করতেই রচনা ও’পাশ থেকে বলল, “সরি গো দিদিভাই। তুমি যে এখন ব্যস্ত থাকবে সেটা তো আমি ভাবিনি। রোজকার মতই আমি তোমার সাথে কথা বলব বলে ফোনটা করেছি”।
সীমন্তিনী ফোনের স্পীকার অন করে দিয়ে বলল, “আরে নারে পাগলী। আমার কোনও ডিস্টার্ব হয়নি। আর তুই ফোন করে ভালই করেছিস। জানিস অফিস থেকে ফেরার পর থেকে আজ অর্চুর সাথে গল্পই করতে পারিনি আমি। অর্চু আর নীতা ওদের ঘরে বসে কথা বলছে আর আমি আমার ঘরে আমার অফিসের কাজ নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। অবশ্য তুই সে জন্যে আমার ওপর একটু রাগ করতেই পারিস। তুই ভাবতেই পারিস যে আমি তোর দিদির প্রতি খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছি না”।
রচনা সাথে সাথে বলল, “দিদিভাই ভাল হচ্ছে না কিন্তু। তুমি কিন্তু এবার আমাকে দুঃখ দিচ্ছ। আমার মা বাবা ভাই বোনকে তুমি কী চোখে দেখ, সেটা আমাকে আজ নতুন করে ভেবে দেখতে বলছ তুমি? আর তুমি বলছ অফিস থেকে ফিরে তুমি দিদির সাথে একটুও গল্প করোনি আজ। কথাটা আমি একদম বিশ্বাস করছি না”।
অর্চনা এবার সীমন্তিনীর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ফোনের মাউথপিচের সামনে নিজের মুখ নিয়ে বলল, “তুই একদম ঠিক বলেছিস রচু। আমি, নীতাদি আর দিদিভাই মিলে সাড়ে সাতটা অব্দি গল্প করার পর নীতাদি আর আমি আমাদের ঘরে চলে গিয়েছিলুম রে। দিদিভাই তোর সাথে দুষ্টুমি করছে”।
রচনা এবার অর্চনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সেটা কি আর আমি বুঝিনি রে দিদি। তা হ্যারে দিদি। আজ মা বাবার সাথে কথা হয়েছে তোর”?
অর্চনা জবাব দিল, “হ্যারে, সবার সাথেই কথা হয়েছে। বাড়ির সকলেই ভাল আছে। আমিও খুব ভাল আছি। আচ্ছা তুই দিদিভাইয়ের সাথে কি কথা বলবি সেটা আগে সেরে নে”।
এবার রচনা বলল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি কি বৌদিকে ফোন করেছিলে”?
সীমন্তিনী বলল, “নারে সোনা। তোর কথাটা আমার মনে ছিল ঠিকই কিন্তু একটা কাজ নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফোন করার কথাটা খেয়ালই হয়নি রে। এখন তো রাত ন’টা বেজে গেল। আর এখন তো তোদের সাথে কথা বলার পর আমাকে আবার কালচিনি ফোন করতে হবে। হয়ত পরিতোষও ফোন করবে। তাই ভাবছি আজ আর তোর সেই বৌদিকে ফোন করব না। কাল সন্ধ্যের পর করব। আচ্ছা সে আমার ফোন না পেয়ে তোকে কি আবার সে’কথা জিজ্ঞেস করছিল না কি”?
রচনা বলল, “তুমি এটাও বুঝে ফেললে দিদিভাই? সত্যি গো। সাড়ে আটটা নাগাদ বৌদি ফোন করে বললেন যে উনি তোমার ফোনের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তুমি তখন অব্দি তাকে ফোন করনি। তাই কথাটা জিজ্ঞেস করলুম তোমাকে। বেশ তো। আজ যখন আর করতে চাইছ না তাহলে বরং কালই করো। বৌদি আবার ফোন করলে আমি তাকে সেভাবে বলে দেব। আর উনি ফোন না করলে তোমার ভাই কাল সকালে ইনস্টিটিউটে গিয়ে বৌদিকে বলে দেবেন’খন। আচ্ছা দিদিভাই, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো তোমার”?
সীমন্তিনী স্নেহমাখা গলায় জবাব দিল, “হ্যারে বাবা, আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার। আচ্ছা দাদাভাই কোথায় রে? তাকে ফোনটা একটু দে তো, একটু কথা বলি”।
ও’পাশ থেকে রতীশ ‘হ্যা বল মন্তি’ বলতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “দাদাভাই কেমন আছিস”?
রতীশ বলল, “ভাল আছি রে মন্তি। তুই, অর্চুদি, নীতাদি আর লক্ষ্মীদি তোরা সবাই ভাল আছিস তো”?
সীমন্তিনী ফোন সেটটা হাতে নিয়ে নবনীতার দিকে ঈশারা করতেই নবনীতা ফোনের গুটিয়ে রাখা তারটাকে খুলে দিল। সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, “আমরা সবাই ভাল আছিরে দাদাভাই। আর জানিস? নীতার জন্য একটা কাজ ঠিক করে ফেলেছি। সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই সে ওখানে যোগ দেবে”।
সীমন্তিনী বিছানায় বসে হাতের ঈশারায় নবনীতা আর অর্চনাকেও বিছানায় বসতে বলল। ওদিক থেকে রচনার গলা শোনা গেল, “ওমা, তাই দিদিভাই? খুব ভাল হয়েছে। তা কাজটা কিসের গো? নীতাদির পছন্দ হয়েছে”?
সীমন্তিনী বলল, “আমাদের এখানে একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরী আছে। সেখানে দু’ঘন্টা ও ডিজাইনিং আর টেলারিং-এর কাজ শিখবে। তারপর দুপুর দুটো থেকে রাত আটটা অব্দি ওই শোরুমে সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করবে। আর তোর নীতাদির পছন্দ হয়েছে কিনা, সেটা তুই তার মুখ থেকেই শুনে নে। আমাকে তো তেমনভাবে এখনও কিছু বলেনি সে” বলে নীতার দিকে রিসিভারটা বাড়িয়ে দিতে নবনীতা বলল, “বৌদি, আমার প্রণাম নিও। দিদির সাথে থেকেই আমি কাজটা করার সুযোগ পাচ্ছি বলেই আমি খুশী। তা তোমরা দু’জন ভাল আছ তো বৌদি”?
রচনা বলল, “হ্যাঁ নীতাদি, ভালই আছি। তবে শোনো, ফোনে সব সময় প্রণাম নিও প্রণাম নিও কথাটা বোলনা তো। তুমি আমার থেকে অনেক বড়। তোমাকে আমি দিদি বলে ডাকি। তোমার কাছ থেকে আমি প্রণাম নিতে পারি”?
নবনীতা বলল, “আচ্ছা আচ্ছা বৌদি, ঠিক আছে আর বলব না। নাও, এবার দিদির সাথে কথা বল”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “দাদাভাই, তুই শুনছিস তো? আচ্ছা তোর বৌদি হঠাৎ আমার সাথে কথা বলবার জন্যে এমন পাগল হয়ে উঠল কেন রে? কি ব্যাপার? তোর সাথে কি কিছু কথা কাটাকাটি বা আর কিছু হয়েছে”?
রতীশ বলল, “নারে মন্তি, সেসব কিছু নয়। বৌদি যে কেন তোর ফোন নাম্বার নিতে এতটা পীড়াপীড়ি করছিলেন, সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি রে। বরং একটু অবাকই হয়েছি। তোর কথা রাখতেই তাকে আমরা তোর কন্টাক্ট নাম্বার দিইনি। তার বদলে তাকে বলেছি যে তুই নিজেই তাকে ফোন করবি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আজ সে কেন এসেছিল তোদের ফ্ল্যাটে? কোনও কাজ ছিল”?
রতীশ বলল, “না তো। কোনও কাজ ছিল না। আর কাজ থাকবেই বা কি? তার কয়েক ঘন্টা আগেই তো আমি সেন্টারে ছিলুম। তাকে বলেই বেরিয়ে এসেছিলুম। উনি তো হঠাতই বিকেলে এসে উপস্থিত। এসে বললেন যে এদিকে কোথাও নাকি কি একটা জরুরী কাজে এসেছিলেন। তাই রচুর সাথে দেখা করতে চলে এসেছেন। এমনি এটা সেটা নিয়ে গল্প করলেন। রচু তাকে প্রথমে শরবৎ পরে কফি বানিয়ে খাওয়ালো। তারপর চলে গেলেন”।
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “কি কি নিয়ে তোদের সাথে কথা বলল? তার সেন্টারের ব্যাপারে? না অন্য কিছু নিয়ে”?
রতীশ জবাব দিল, “নারে ইনস্টিটিউট নিয়ে কিছু বলেননি। আমাদের চেনাজানা পরিচিত বা আত্মীয় কেউ কলকাতায় আছে কি না। আমাকে আর রচুকে কে সবচাইতে বেশী ভাল বাসে, এইসব। যখন শুনলেন যে তুই আমাদের সবচেয়ে বেশী ভালবাসিস, আর ক’দিন আগেই তুই কলকাতা এসেছিলি, সেটা শুনেই উনি খুব অভিমান করেছিলেন যে আমরা তার সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দিলুম না কেন। তখনই তোর ফোন নাম্বার চেয়ে বসলেন। তোর সাথে কথা বলবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন। রচু তো তখনই তোকে একবার ফোন করেছিল। কিন্তু তুই রিসিভ করিস নি। তাই আমরা তোকে তার সাথে কথা বলার অনুরোধ করব বলে তাকে বিদেয় করেছি। ব্যস এটুকুই”।
সীমন্তিনী একটু চিন্তান্বিত ভাবে বলল, “এ ছাড়া আর কোনকিছু বলে নি”?
রতীশ জবাব দিল, “নারে মন্তি, আর তেমন কিছু তো বলেন নি। তা তুই এ ব্যাপারে এত প্রশ্ন করছিস কেন রে? তুই কি অন্য কিছু ভাবছিস না কি”?
সীমন্তিনী বলল, “না অন্য আর কি ভাবব। যাকে আমি চিনি না জানিনা, তার সম্বন্ধে আর অন্য কি ভাবব। আচ্ছা দাদাভাই, রচু আমাকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে তাকে ফোন করতে বলেছিল। কিন্তু আমি তো আজ সন্ধ্যের পর অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলুম। তাই ফোন করে উঠতে পারিনি রে। আর এরপরেও কালচিনিতে একবার ফোন করতে হবে। আর কলকাতা থেকে পরিতোষও হয়ত একবার ফোন করতে পারে। তাই আজ বোধহয় আর তোর বৌদির সাথে কথা বলতে পারব না রে। যদি সে আবার তোদের আজ এ ব্যাপারে ফোন করে, তাহলে তাকে একটু বুঝিয়ে বলিস দাদাভাই। আর বলিস আমি কাল সন্ধ্যের পর তাকে নিশ্চয়ই ফোন করব, কেমন”?
রতীশ বলল, “ঠিক আছে মন্তি। সেটা আমরা বলে দেব। কিন্তু মন্তি, অর্চুদি কেমন আছে রে? তোর ওখানে এসে সে খুশি তো? ওষুধপত্র খাবার দাবার ঠিকঠাক মত খাচ্ছে তো রে”?
সীমন্তিনী অর্চনার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “হ্যারে দাদাভাই। অর্চু একদম ঠিক আছে। আর লক্ষ্মীদি ওর খাবার দাবার আর ওষুধপত্রের ব্যাপারে সর্বক্ষণ নজর রাখছে। তুই তাকেই জিজ্ঞেস কর না। ও তো আমার সাথেই আছে”।
অর্চনা হাতের ঈশারায় ‘না’ করতে ওদিক থেকে রতীশও বলল, “ঠিক আছে মন্তি। রচুর সাথে তো কথা হয়েছেই। আমি শুধু একটু তোর কাছ থেকে জানতে চাইছিলুম, সে সত্যিই ঠিক আছে কি না”।
সীমন্তিনীও আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “আচ্ছা দাদাভাই, এবার রাখছি কেমন? নইলে কালচিনিতে ফোন করতে দেরী হয়ে যাবে। মাসি রোজ এমন সময়ে আমার ফোনের অপেক্ষা করেন। তাই ছাড়ছি এখন। রচু সোনা, তোরা দুটিতে এবার খাবার দাবার খেয়ে শুয়ে পড়, কেমন? গুড নাইট”।
সীমন্তিনীর সাথে সাথে নবনীতা আর অর্চনাও ফোনের কাছাকাছি এসে “গুড নাইট” বলতে ওদিক থেকে রতীশ আর রচনাও “গুড নাইট” বলল।
সীমন্তিনী প্রায় সাথে সাথেই কালচিনির বাড়িতে ফোন করে বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুকের সাথে কথা বলল। অর্চুও তাদের সাথে সংক্ষেপে কথা বলে নিল।
*****************
ফোনের কথা শেষ হতে নবনীতা ফোনটাকে আবার ঘরের কোনায় যথাস্থানে রেখে দিয়ে ফিরে আসতেই অর্চনা উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, কি বুঝছো গো? ভেবে চিন্তে কিছু বুঝতে পারলে কি”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অর্চু সোনা বোন আমার, তুমি এত ভাবছ কেন। আমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভেবে দেখলুম, দাদাভাই আর রচুর ওপর এখনও তেমন কোনও বিপদ নেমে আসেনি। আর ওরা যে নিশ্চিন্তে আছে, ভাল আছে তা কি ওদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারো নি তুমি? তবে নীতা আমাদের মহিমার ব্যাপারে সব খুলে বলে খুব ভাল করেছে” বলে নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “তুমি কথা গুলো খুলে বলাতে আমরা আগে থেকেই আরও সাবধান হতে পারব। তাই তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ নীতা” বলে নীতার হাতে একটা চুমু দিল।
অর্চনা তখন বলল, “আমার মনটাও এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে দিদিভাই। তোমার বন্ধু পরিতোষবাবু যে রতু-দা আর রচুর ওপর নজর রাখছেন এ’কথা শুনেই আমার দুর্ভাবনা অনেকটা কমেছে। আর এখন ওদের সাথে কথা বলে ওরা ভাল আছে জেনে আরও স্বস্তি পেলাম গো”।
সীমন্তিনী নবনীতার দিকে একবার দেখে আবার অর্চনাকে বলল, “যে কথাটা আমি দাদাভাই আর রচুকেও আজ পর্যন্ত জানতে দিই নি, আজ তুমি সে’কথাটা জেনেই ফেললে? একদিক দিয়ে অবশ্য ভালই হয়েছে যে এতে তোমার দুশ্চিন্তা একটু কমেছে। কিন্তু বোন, আমার একটা অনুরোধ কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে। বলো, রাখবে তো”?
অর্চনা বলল, “এমন করে বলছ কেন দিদিভাই। তুমি আমাকে অনুরোধ করবে কেন? তুমি তো শুধু আমাকে আদেশ আর পরামর্শ দেবে গো। বলো না কী করতে হবে আমায়”।
সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বলল, “একই কথা তোমাকে খানিক আগেও বলেছি। কিন্তু তখন প্রসঙ্গটা কিছুটা আলাদা ছিল। দাদাভাই আর রচু যে একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে, এ ব্যাপারটা আমরা নীতার কথাতেই তো জানতে পারলুম। তাই শুধু আমরা এই তিনজনই এখন পর্যন্ত শুধু ব্যাপারটা জানি। তোমাদের দু’জনকে আমি আগেই অনুরোধ করেছি, যে এ ব্যাপারটা যেন আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানতে না পারে। রাজগঞ্জ, কালচিনির কেউ যেন এসব কথা ঘূণাক্ষরেও জানতে না পারে। কথাটা কেন বলেছি সেটা তোমরা কেউ বুঝতে পেরেছো কি? দ্যাখো, দাদাভাই বা রচুর ওপর যে কোনও বিপদ নেমে আসুক না কেন, আমি তার মোকাবেলা করতে পারবো। আর এ কাজে পরিতোষই আমার সবচেয়ে বড় ভরসা। কিন্তু কলকাতার সব কিছু সামাল দিতে পারলেও রাজগঞ্জ আর কালচিনির এতগুলো লোককে আমি সামলাতে পারব না গো। আমাকে নিয়ে রাজগঞ্জের বাড়ির লোকেরা খুব বেশী কিছু ভাবেন না। তারা সকলেই জানেন যে ছোটবেলা থেকেই আমি তাদের সকলের কথা অগ্রাহ্য করে আসছি। আমি তাদের আয়ত্বের বাইরে। আমি তাদের বংশের কুলাঙ্গার। কিন্তু দাদাভাই আর রচুকে তো বাড়ির প্রত্যেকটা লোক ভালবাসে। বিশেষ করে আমার ছোটবোনটা, চন্দু। ও যে রচুকে কতটা ভালবাসে সে’কথা আমি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। যেদিন থেকে রচু আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে ও বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকে ও যতক্ষণ বাড়িতে থাকত সবসময় যেন রচুর ছায়া হয়ে থাকতো। দাদাভাই আর রচু কলকাতা চলে যাবার পর ও প্রায় দু’দিন কোনকিছু খায়নি। কারুর সাথে কথা বলত না। শুধু ঘরে বসে কাঁদতো। কলেজ কিংবা টিউশনিতেও যেতে চাইত না। তার মুখে তখন শুধু একটাই কথা ছিল ‘আমার বৌমণিকে ফিরিয়ে এনে দাও’। তখন আমিও ওকে ফোনে কিছু বোঝাতে পারতুম না। আর বাড়ির প্রত্যেকটা লোক ওকে নিয়ে হিমশিম খেত। দাদাভাই আর রচুর বিপদের কথা শুনলে ওকে তো কেউ সামলাতে পারবেই না। আর বাড়ির অন্যান্য লোকগুলোও শুধু হাঁ হুতোস করতে শুরু করবে। কেউ কেউ হয়ত পাগলের মত কলকাতা ছুটে যাবেন। আর ওদিকে কালচিনির বাড়ির সকলেরই তো প্রায় পাগল হবার মত অবস্থা হবে। তাই আমি তোমাদের দু’জনকে অনুরোধ করছি, তোমরা যখন বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলবে তখন কোনভাবেই যেন দাদাভাই আর রচুর ওপর বিপদের যে ছায়ার কথা আমরা জানতে পারছি, সেসব কথা যেন মুখ ফসকেও বের না হয়। এ জন্যেই তোমাদের দু’জনকে আমি অমন অনুরোধ করেছি”।
______________________________
নবনীতা আর অর্চনা পাশের ঘরে চলে যেতে সীমন্তিনী একবার দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত সাতটা পঁয়ত্রিশ। রচনা বলেছিল রাত সাতটার পর মহিমাকে ফোন করতে। কিন্তু সীমন্তিনীর মন বলছে নবনীতার বলা কথাগুলো নিয়ে আগে ভাল ভাবে ভেবে দেখা দরকার। নবনীতা নিশ্চয়ই বানিয়ে বা বাড়িয়ে কিছু বলে নি। তাই রতীশকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা যথেষ্ট যুক্তিসংগত। কিন্তু রতীশ গত দেড় মাসের ভেতরে মহিমার ওপর একবিন্দু সন্দেহও প্রকাশ করেনি, তাহলে ধরেই নিতে হয়, নীতা যেমনটা বলছে, রতীশ মহিমার ওই এসকর্ট ব্যবসার বিষয়ে এখনও সত্যি কিছু জানে না। রচনাও তো মহিমাকে দেখেছে। সেও নাকি একদিন মহিমার ইনস্টিটিউটে গিয়েছিল। মহিমাও দু’দিন তাদের ফ্ল্যাটে এসে অনেকটা করে সময় কাটিয়ে গেছে। রতীশ খুব সহজেই সবকিছু সাদা বলে ধরে নেয়। কিন্তু রচনা তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। মহিমার কাজে কথায় তার ওপর যে রচনার একটুও সন্দেহ হয়নি, এ তো বলাই বাহুল্য। কারন রচনার মনে তেমন কোনও সন্দেহের ছোঁয়া লেগে থাকলে সে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই সীমন্তিনীকে জানাতো। আর নবনীতা যেমন বলল তাতে মহিমার ওই দেহব্যবসার কাজে শুধু মেয়েরাই নয় অনেক পুরুষও কাজ করে। বড় বড় শহরে অনেক ধনী ও বিত্ত পরিবারের এবং হাই সোসাইটির অনেক মহিলাই নিজেদের দাম্পত্য জীবনে যৌনতার সুখ হারিয়ে ফেলার পর বারমুখো হয়। এদের মধ্যে যাদের আর্থিক সংগতি কিছুটা কম, তারা অনেকেই তাদের পরিচিত সার্কেলের ভেতর নিজেদের চাইতে কমবয়সী বা সমবয়সী ছেলে বা পুরুষের সাথে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর যাদের পয়সার অভাব নেই তারা কোন রকম বাধ্য বাধকতা বা বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে বিভিন্ন এজেন্সী বা দালালের মাধ্যমে সাময়িক যৌনসঙ্গী খুঁজে নিয়ে নিজেদের শারীরিক চাহিদা মিটিয়ে থাকে। রতীশের মত সুন্দর দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী এক পুরুষের ওপর তারা খুব সহজেই আকর্ষিত হবে, এ তো খুবই সহজবোধ্য ব্যাপার। রতীশের মত এক যুবককে নিজেদের শয্যাসঙ্গী করতে তারা অতিরিক্ত টাকাও খরচ করতে রাজী হবে। তাই মহিমা যদি চায় তাহলে রতীশকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর অর্থ কামাতে পারবে সে। আর মহিমা তো রচনাকেও দেখেছে। রচনাকেও ভগবান এতোটাই রূপ সৌন্দর্য দিয়ে পাঠিয়েছেন যে তার মত মেয়ের ওপর কম বয়সী বেশী বয়সী সব পুরুষই আকৃষ্ট হবে। মহিমা কি রচনাকেও তার ওই ব্যবসায় টেনে নেবার অপেক্ষায় আছে? এ’কথা মনে হতেই সীমন্তিনীর শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা বেদনা হতে শুরু করল।
নিজেকে সংযত করে সীমন্তিনী আবার ভাবতে লাগল রচনা আর রতীশকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক প্রশ্ন করে তাকে জানতে হবে মহিমার আচার ব্যবহারে তাদের কখন কেমন মনে হয়েছে। পরিতোষ অবশ্য আগে থেকেই রতীশের ওপর নজর রাখছে। রতীশ ভোরবেলা ঘর থেকে বের হবার পর থেকে সে কখন কোথায় যায়, কতক্ষণ সেন্টারে থাকে, সেন্টার থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যায় এসব কিছুর ওপরেই পরিতোষের নিজস্ব নেটওয়ার্কের লোকেরা নজর রাখছে। পরিতোষের কাছেও তো মনে হয় এমন কোন রিপোর্ট আসেনি। এলে পরিতোষ তাকে অবশ্যই জানাতো। তার মানে ধরে নেওয়া যায় যে রতীশ এখন পর্যন্ত এদিক দিয়ে নিরাপদে আছে। কিন্তু সে তো মহিমার নাগালের ভেতরেই আছে। নবনীতা যেমন ভাবছে তেমনই যে কোন সময় সে মহিমার ওই অনৈতিক ব্যবসার জালে জড়িয়ে পড়তে পারে। মহিমা গত দেড় মাসের ভেতরেও যে রতীশকে এ কাজে নামাবার চেষ্টা করেনি সেটাই একটা আশ্চর্যের বিষয়। আর একবার যদি রতীশ তার ওই জালে জড়িয়ে পড়ে তাহলে রচনাও বেশীদিন মুক্ত থাকবে না। সীমন্তিনীর একবার মনে হল পরিতোষের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে এখনই আলোচনা করা দরকার। আবার পরক্ষণেই মনে হল নাহ এখনই সেটা করা ঠিক হবে না। তার নিজেকে আগে একটা পরিষ্কার ধারণা করে নিতে হবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আর মহিমার সাথেও আগে কথা বলে নিতে হবে। মহিমাই বা তার সাথে আলাপ করবার জন্য হঠাৎ করেই এত উতলা হয়ে উঠেছে কেন? সে সীমন্তিনীর কাছ থেকে কি আশা করতে পারে? অবশ্য মহিমার সাথে কথা বললেই সে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাই সীমন্তিনী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রচনাকে বা রতীশকে এ ব্যাপারে তো কিছু বলবেই না, এমনকি নিজের কাছে গোটা ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার করে নেবার আগে সে পরিতোষকেও কিছু জানাবে না। পরিতোষ তো রতীশের ওপর ভোর সাড়ে চারটে থেকে রাত এগারটা বারোটা অব্দি নজর রাখছেই। তাই এখনই বিচলিত হবার মত কিছু নেই।
এমন সময় ঘরের ল্যান্ড লাইন ফোনটা বেজে উঠল।নিজের ভাবনা ছেড়ে উঠে ফোনের রিসিভার হাতে নিতেই ওপাশে রচনার গলা শোনা গেল, “দিদিভাই কি করছ”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “তেমন কিছু না রে, একটা কাজের ব্যাপারেই একটু ভাবছিলুম। তা তুই হঠাৎ এ সময়ে ফোন করলি? কি ব্যাপার রে? কিছু হয়েছে”?
রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা, কী আবার হবে। আমি তো রোজই রাতের রান্না শেষ করে তোমাকে একবার ফোন করি। আজও তাই করছি। আর তুমি বলছ আমি অসময়ে .........”
দেয়াল ঘড়িতে রাত প্রায় ন’টা বাজতে চলেছে দেখতে পেয়েই সীমন্তিনী রচনাকে মাঝপথে বাঁধা দিয়েই বলল, “ওমা, সত্যি তো রে। রাত ন’টা বেজে গেছে! আমি তো খেয়ালই করিনি রে। সরি সোনা, আমাকে ভুল বুঝিস না বোন। আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে মনে মনে এত ব্যস্ত ছিলুম যে ঘড়ির দিকে নজরই দিই নি” বলতে বলতে দরজার দিকে চোখ যেতেই দেখল নবনীতা আর অর্চনা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। সে হাতের ঈশারায় তাদের ভেতরে আসবার ঈঙ্গিত করতেই রচনা ও’পাশ থেকে বলল, “সরি গো দিদিভাই। তুমি যে এখন ব্যস্ত থাকবে সেটা তো আমি ভাবিনি। রোজকার মতই আমি তোমার সাথে কথা বলব বলে ফোনটা করেছি”।
সীমন্তিনী ফোনের স্পীকার অন করে দিয়ে বলল, “আরে নারে পাগলী। আমার কোনও ডিস্টার্ব হয়নি। আর তুই ফোন করে ভালই করেছিস। জানিস অফিস থেকে ফেরার পর থেকে আজ অর্চুর সাথে গল্পই করতে পারিনি আমি। অর্চু আর নীতা ওদের ঘরে বসে কথা বলছে আর আমি আমার ঘরে আমার অফিসের কাজ নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। অবশ্য তুই সে জন্যে আমার ওপর একটু রাগ করতেই পারিস। তুই ভাবতেই পারিস যে আমি তোর দিদির প্রতি খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছি না”।
রচনা সাথে সাথে বলল, “দিদিভাই ভাল হচ্ছে না কিন্তু। তুমি কিন্তু এবার আমাকে দুঃখ দিচ্ছ। আমার মা বাবা ভাই বোনকে তুমি কী চোখে দেখ, সেটা আমাকে আজ নতুন করে ভেবে দেখতে বলছ তুমি? আর তুমি বলছ অফিস থেকে ফিরে তুমি দিদির সাথে একটুও গল্প করোনি আজ। কথাটা আমি একদম বিশ্বাস করছি না”।
অর্চনা এবার সীমন্তিনীর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ফোনের মাউথপিচের সামনে নিজের মুখ নিয়ে বলল, “তুই একদম ঠিক বলেছিস রচু। আমি, নীতাদি আর দিদিভাই মিলে সাড়ে সাতটা অব্দি গল্প করার পর নীতাদি আর আমি আমাদের ঘরে চলে গিয়েছিলুম রে। দিদিভাই তোর সাথে দুষ্টুমি করছে”।
রচনা এবার অর্চনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সেটা কি আর আমি বুঝিনি রে দিদি। তা হ্যারে দিদি। আজ মা বাবার সাথে কথা হয়েছে তোর”?
অর্চনা জবাব দিল, “হ্যারে, সবার সাথেই কথা হয়েছে। বাড়ির সকলেই ভাল আছে। আমিও খুব ভাল আছি। আচ্ছা তুই দিদিভাইয়ের সাথে কি কথা বলবি সেটা আগে সেরে নে”।
এবার রচনা বলল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি কি বৌদিকে ফোন করেছিলে”?
সীমন্তিনী বলল, “নারে সোনা। তোর কথাটা আমার মনে ছিল ঠিকই কিন্তু একটা কাজ নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফোন করার কথাটা খেয়ালই হয়নি রে। এখন তো রাত ন’টা বেজে গেল। আর এখন তো তোদের সাথে কথা বলার পর আমাকে আবার কালচিনি ফোন করতে হবে। হয়ত পরিতোষও ফোন করবে। তাই ভাবছি আজ আর তোর সেই বৌদিকে ফোন করব না। কাল সন্ধ্যের পর করব। আচ্ছা সে আমার ফোন না পেয়ে তোকে কি আবার সে’কথা জিজ্ঞেস করছিল না কি”?
রচনা বলল, “তুমি এটাও বুঝে ফেললে দিদিভাই? সত্যি গো। সাড়ে আটটা নাগাদ বৌদি ফোন করে বললেন যে উনি তোমার ফোনের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তুমি তখন অব্দি তাকে ফোন করনি। তাই কথাটা জিজ্ঞেস করলুম তোমাকে। বেশ তো। আজ যখন আর করতে চাইছ না তাহলে বরং কালই করো। বৌদি আবার ফোন করলে আমি তাকে সেভাবে বলে দেব। আর উনি ফোন না করলে তোমার ভাই কাল সকালে ইনস্টিটিউটে গিয়ে বৌদিকে বলে দেবেন’খন। আচ্ছা দিদিভাই, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো তোমার”?
সীমন্তিনী স্নেহমাখা গলায় জবাব দিল, “হ্যারে বাবা, আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার। আচ্ছা দাদাভাই কোথায় রে? তাকে ফোনটা একটু দে তো, একটু কথা বলি”।
ও’পাশ থেকে রতীশ ‘হ্যা বল মন্তি’ বলতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “দাদাভাই কেমন আছিস”?
রতীশ বলল, “ভাল আছি রে মন্তি। তুই, অর্চুদি, নীতাদি আর লক্ষ্মীদি তোরা সবাই ভাল আছিস তো”?
সীমন্তিনী ফোন সেটটা হাতে নিয়ে নবনীতার দিকে ঈশারা করতেই নবনীতা ফোনের গুটিয়ে রাখা তারটাকে খুলে দিল। সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, “আমরা সবাই ভাল আছিরে দাদাভাই। আর জানিস? নীতার জন্য একটা কাজ ঠিক করে ফেলেছি। সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই সে ওখানে যোগ দেবে”।
সীমন্তিনী বিছানায় বসে হাতের ঈশারায় নবনীতা আর অর্চনাকেও বিছানায় বসতে বলল। ওদিক থেকে রচনার গলা শোনা গেল, “ওমা, তাই দিদিভাই? খুব ভাল হয়েছে। তা কাজটা কিসের গো? নীতাদির পছন্দ হয়েছে”?
সীমন্তিনী বলল, “আমাদের এখানে একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরী আছে। সেখানে দু’ঘন্টা ও ডিজাইনিং আর টেলারিং-এর কাজ শিখবে। তারপর দুপুর দুটো থেকে রাত আটটা অব্দি ওই শোরুমে সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করবে। আর তোর নীতাদির পছন্দ হয়েছে কিনা, সেটা তুই তার মুখ থেকেই শুনে নে। আমাকে তো তেমনভাবে এখনও কিছু বলেনি সে” বলে নীতার দিকে রিসিভারটা বাড়িয়ে দিতে নবনীতা বলল, “বৌদি, আমার প্রণাম নিও। দিদির সাথে থেকেই আমি কাজটা করার সুযোগ পাচ্ছি বলেই আমি খুশী। তা তোমরা দু’জন ভাল আছ তো বৌদি”?
রচনা বলল, “হ্যাঁ নীতাদি, ভালই আছি। তবে শোনো, ফোনে সব সময় প্রণাম নিও প্রণাম নিও কথাটা বোলনা তো। তুমি আমার থেকে অনেক বড়। তোমাকে আমি দিদি বলে ডাকি। তোমার কাছ থেকে আমি প্রণাম নিতে পারি”?
নবনীতা বলল, “আচ্ছা আচ্ছা বৌদি, ঠিক আছে আর বলব না। নাও, এবার দিদির সাথে কথা বল”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “দাদাভাই, তুই শুনছিস তো? আচ্ছা তোর বৌদি হঠাৎ আমার সাথে কথা বলবার জন্যে এমন পাগল হয়ে উঠল কেন রে? কি ব্যাপার? তোর সাথে কি কিছু কথা কাটাকাটি বা আর কিছু হয়েছে”?
রতীশ বলল, “নারে মন্তি, সেসব কিছু নয়। বৌদি যে কেন তোর ফোন নাম্বার নিতে এতটা পীড়াপীড়ি করছিলেন, সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি রে। বরং একটু অবাকই হয়েছি। তোর কথা রাখতেই তাকে আমরা তোর কন্টাক্ট নাম্বার দিইনি। তার বদলে তাকে বলেছি যে তুই নিজেই তাকে ফোন করবি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আজ সে কেন এসেছিল তোদের ফ্ল্যাটে? কোনও কাজ ছিল”?
রতীশ বলল, “না তো। কোনও কাজ ছিল না। আর কাজ থাকবেই বা কি? তার কয়েক ঘন্টা আগেই তো আমি সেন্টারে ছিলুম। তাকে বলেই বেরিয়ে এসেছিলুম। উনি তো হঠাতই বিকেলে এসে উপস্থিত। এসে বললেন যে এদিকে কোথাও নাকি কি একটা জরুরী কাজে এসেছিলেন। তাই রচুর সাথে দেখা করতে চলে এসেছেন। এমনি এটা সেটা নিয়ে গল্প করলেন। রচু তাকে প্রথমে শরবৎ পরে কফি বানিয়ে খাওয়ালো। তারপর চলে গেলেন”।
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “কি কি নিয়ে তোদের সাথে কথা বলল? তার সেন্টারের ব্যাপারে? না অন্য কিছু নিয়ে”?
রতীশ জবাব দিল, “নারে ইনস্টিটিউট নিয়ে কিছু বলেননি। আমাদের চেনাজানা পরিচিত বা আত্মীয় কেউ কলকাতায় আছে কি না। আমাকে আর রচুকে কে সবচাইতে বেশী ভাল বাসে, এইসব। যখন শুনলেন যে তুই আমাদের সবচেয়ে বেশী ভালবাসিস, আর ক’দিন আগেই তুই কলকাতা এসেছিলি, সেটা শুনেই উনি খুব অভিমান করেছিলেন যে আমরা তার সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দিলুম না কেন। তখনই তোর ফোন নাম্বার চেয়ে বসলেন। তোর সাথে কথা বলবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন। রচু তো তখনই তোকে একবার ফোন করেছিল। কিন্তু তুই রিসিভ করিস নি। তাই আমরা তোকে তার সাথে কথা বলার অনুরোধ করব বলে তাকে বিদেয় করেছি। ব্যস এটুকুই”।
সীমন্তিনী একটু চিন্তান্বিত ভাবে বলল, “এ ছাড়া আর কোনকিছু বলে নি”?
রতীশ জবাব দিল, “নারে মন্তি, আর তেমন কিছু তো বলেন নি। তা তুই এ ব্যাপারে এত প্রশ্ন করছিস কেন রে? তুই কি অন্য কিছু ভাবছিস না কি”?
সীমন্তিনী বলল, “না অন্য আর কি ভাবব। যাকে আমি চিনি না জানিনা, তার সম্বন্ধে আর অন্য কি ভাবব। আচ্ছা দাদাভাই, রচু আমাকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে তাকে ফোন করতে বলেছিল। কিন্তু আমি তো আজ সন্ধ্যের পর অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলুম। তাই ফোন করে উঠতে পারিনি রে। আর এরপরেও কালচিনিতে একবার ফোন করতে হবে। আর কলকাতা থেকে পরিতোষও হয়ত একবার ফোন করতে পারে। তাই আজ বোধহয় আর তোর বৌদির সাথে কথা বলতে পারব না রে। যদি সে আবার তোদের আজ এ ব্যাপারে ফোন করে, তাহলে তাকে একটু বুঝিয়ে বলিস দাদাভাই। আর বলিস আমি কাল সন্ধ্যের পর তাকে নিশ্চয়ই ফোন করব, কেমন”?
রতীশ বলল, “ঠিক আছে মন্তি। সেটা আমরা বলে দেব। কিন্তু মন্তি, অর্চুদি কেমন আছে রে? তোর ওখানে এসে সে খুশি তো? ওষুধপত্র খাবার দাবার ঠিকঠাক মত খাচ্ছে তো রে”?
সীমন্তিনী অর্চনার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “হ্যারে দাদাভাই। অর্চু একদম ঠিক আছে। আর লক্ষ্মীদি ওর খাবার দাবার আর ওষুধপত্রের ব্যাপারে সর্বক্ষণ নজর রাখছে। তুই তাকেই জিজ্ঞেস কর না। ও তো আমার সাথেই আছে”।
অর্চনা হাতের ঈশারায় ‘না’ করতে ওদিক থেকে রতীশও বলল, “ঠিক আছে মন্তি। রচুর সাথে তো কথা হয়েছেই। আমি শুধু একটু তোর কাছ থেকে জানতে চাইছিলুম, সে সত্যিই ঠিক আছে কি না”।
সীমন্তিনীও আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “আচ্ছা দাদাভাই, এবার রাখছি কেমন? নইলে কালচিনিতে ফোন করতে দেরী হয়ে যাবে। মাসি রোজ এমন সময়ে আমার ফোনের অপেক্ষা করেন। তাই ছাড়ছি এখন। রচু সোনা, তোরা দুটিতে এবার খাবার দাবার খেয়ে শুয়ে পড়, কেমন? গুড নাইট”।
সীমন্তিনীর সাথে সাথে নবনীতা আর অর্চনাও ফোনের কাছাকাছি এসে “গুড নাইট” বলতে ওদিক থেকে রতীশ আর রচনাও “গুড নাইট” বলল।
সীমন্তিনী প্রায় সাথে সাথেই কালচিনির বাড়িতে ফোন করে বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুকের সাথে কথা বলল। অর্চুও তাদের সাথে সংক্ষেপে কথা বলে নিল।
*****************
ফোনের কথা শেষ হতে নবনীতা ফোনটাকে আবার ঘরের কোনায় যথাস্থানে রেখে দিয়ে ফিরে আসতেই অর্চনা উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, কি বুঝছো গো? ভেবে চিন্তে কিছু বুঝতে পারলে কি”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অর্চু সোনা বোন আমার, তুমি এত ভাবছ কেন। আমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভেবে দেখলুম, দাদাভাই আর রচুর ওপর এখনও তেমন কোনও বিপদ নেমে আসেনি। আর ওরা যে নিশ্চিন্তে আছে, ভাল আছে তা কি ওদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারো নি তুমি? তবে নীতা আমাদের মহিমার ব্যাপারে সব খুলে বলে খুব ভাল করেছে” বলে নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “তুমি কথা গুলো খুলে বলাতে আমরা আগে থেকেই আরও সাবধান হতে পারব। তাই তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ নীতা” বলে নীতার হাতে একটা চুমু দিল।
অর্চনা তখন বলল, “আমার মনটাও এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে দিদিভাই। তোমার বন্ধু পরিতোষবাবু যে রতু-দা আর রচুর ওপর নজর রাখছেন এ’কথা শুনেই আমার দুর্ভাবনা অনেকটা কমেছে। আর এখন ওদের সাথে কথা বলে ওরা ভাল আছে জেনে আরও স্বস্তি পেলাম গো”।
সীমন্তিনী নবনীতার দিকে একবার দেখে আবার অর্চনাকে বলল, “যে কথাটা আমি দাদাভাই আর রচুকেও আজ পর্যন্ত জানতে দিই নি, আজ তুমি সে’কথাটা জেনেই ফেললে? একদিক দিয়ে অবশ্য ভালই হয়েছে যে এতে তোমার দুশ্চিন্তা একটু কমেছে। কিন্তু বোন, আমার একটা অনুরোধ কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে। বলো, রাখবে তো”?
অর্চনা বলল, “এমন করে বলছ কেন দিদিভাই। তুমি আমাকে অনুরোধ করবে কেন? তুমি তো শুধু আমাকে আদেশ আর পরামর্শ দেবে গো। বলো না কী করতে হবে আমায়”।
সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বলল, “একই কথা তোমাকে খানিক আগেও বলেছি। কিন্তু তখন প্রসঙ্গটা কিছুটা আলাদা ছিল। দাদাভাই আর রচু যে একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে, এ ব্যাপারটা আমরা নীতার কথাতেই তো জানতে পারলুম। তাই শুধু আমরা এই তিনজনই এখন পর্যন্ত শুধু ব্যাপারটা জানি। তোমাদের দু’জনকে আমি আগেই অনুরোধ করেছি, যে এ ব্যাপারটা যেন আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানতে না পারে। রাজগঞ্জ, কালচিনির কেউ যেন এসব কথা ঘূণাক্ষরেও জানতে না পারে। কথাটা কেন বলেছি সেটা তোমরা কেউ বুঝতে পেরেছো কি? দ্যাখো, দাদাভাই বা রচুর ওপর যে কোনও বিপদ নেমে আসুক না কেন, আমি তার মোকাবেলা করতে পারবো। আর এ কাজে পরিতোষই আমার সবচেয়ে বড় ভরসা। কিন্তু কলকাতার সব কিছু সামাল দিতে পারলেও রাজগঞ্জ আর কালচিনির এতগুলো লোককে আমি সামলাতে পারব না গো। আমাকে নিয়ে রাজগঞ্জের বাড়ির লোকেরা খুব বেশী কিছু ভাবেন না। তারা সকলেই জানেন যে ছোটবেলা থেকেই আমি তাদের সকলের কথা অগ্রাহ্য করে আসছি। আমি তাদের আয়ত্বের বাইরে। আমি তাদের বংশের কুলাঙ্গার। কিন্তু দাদাভাই আর রচুকে তো বাড়ির প্রত্যেকটা লোক ভালবাসে। বিশেষ করে আমার ছোটবোনটা, চন্দু। ও যে রচুকে কতটা ভালবাসে সে’কথা আমি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। যেদিন থেকে রচু আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে ও বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকে ও যতক্ষণ বাড়িতে থাকত সবসময় যেন রচুর ছায়া হয়ে থাকতো। দাদাভাই আর রচু কলকাতা চলে যাবার পর ও প্রায় দু’দিন কোনকিছু খায়নি। কারুর সাথে কথা বলত না। শুধু ঘরে বসে কাঁদতো। কলেজ কিংবা টিউশনিতেও যেতে চাইত না। তার মুখে তখন শুধু একটাই কথা ছিল ‘আমার বৌমণিকে ফিরিয়ে এনে দাও’। তখন আমিও ওকে ফোনে কিছু বোঝাতে পারতুম না। আর বাড়ির প্রত্যেকটা লোক ওকে নিয়ে হিমশিম খেত। দাদাভাই আর রচুর বিপদের কথা শুনলে ওকে তো কেউ সামলাতে পারবেই না। আর বাড়ির অন্যান্য লোকগুলোও শুধু হাঁ হুতোস করতে শুরু করবে। কেউ কেউ হয়ত পাগলের মত কলকাতা ছুটে যাবেন। আর ওদিকে কালচিনির বাড়ির সকলেরই তো প্রায় পাগল হবার মত অবস্থা হবে। তাই আমি তোমাদের দু’জনকে অনুরোধ করছি, তোমরা যখন বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলবে তখন কোনভাবেই যেন দাদাভাই আর রচুর ওপর বিপদের যে ছায়ার কথা আমরা জানতে পারছি, সেসব কথা যেন মুখ ফসকেও বের না হয়। এ জন্যেই তোমাদের দু’জনকে আমি অমন অনুরোধ করেছি”।
______________________________