Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 133)

বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ সীমন্তিনীর পুলিশের কনভয় বিধুবাবুর বাড়ির সামনে এসে থামতেই বাড়ির ভেতর থেকে বিভাদেবী প্রায় ছুটে বেড়িয়ে এলেন। কিংশুক আর বিধুবাবু তখন দোকানেই ছিল, পুলিশের গাড়ি থামতেই তারাও দোকান থেকে বেড়িয়ে এল। আশে পাশের দু’চারটে বাড়ি থেকেও অনেকে বেড়িয়ে এসেছিল।

বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এসেছিস মা? আয় আয়। সেই কখন থেকে তোর পথ চেয়ে বসে আছি। এত দেরী করলি আসতে”?
 

ততক্ষণে বিধুবাবুও কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। সীমন্তিনীর এসকর্টেরা তাকে বাঁধা দিতে গেলে সীমন্তিনী হাতের ঈশারায় তাদের বারন করে আগে বিধুবাবু ও পরে বিভাদেবীকে প্রণাম করতে করতে বলল, “দেরী কোথায় মাসি? সবে তো তিনটে বেজেছে। আর আলিপুরদুয়ারের কাজটা তো তাড়াতাড়িই সেরে চলে এলুম”।
 

সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কিংশুক সীমন্তিনীর পায়ের দিকে ঝুঁকতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাই কেমন আছো? পড়াশুনো ঠিক চলছে তো? ফাইনাল এক্সামের প্রিপারেশন ঠিক আছে তো”? বলে কিংশুকের কপালে স্নেহের চুম্বন একে দিল।

কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সব দিক দিয়েই আমি পুরো তৈরী আছি”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “এই না হলে আমার ভাই”? বলে কিংশুকের মাথার চুলগুলো একটু নেড়ে দিয়ে বলল, “চল মাসি ভেতরে চল। তা অর্চু কোথায়? ও সবকিছু গোছগাছ করে নিয়েছে তো”?

বলতে বলতে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই গেটের পাশে আড়ালে অর্চনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সীমন্তিনী থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সত্যি অর্চনার শরীর স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে। অপরূপা লাগছে তাকে দেখতে। চেহারার অনেক উন্নতি হলেও ওর মুখশ্রীতে মলিনতার আভাসও বড় সুস্পষ্ট। এক মূহুর্ত থমকে থেকেই প্রায় ছুটে গিয়ে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই তো আমার অর্চু সোনা। ইশ কী ভালো লাগছে গো তোমাকে দেখতে। ডাক্তার সোম অবশ্য কালই আমাকে বলেছেন। তবু আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না”।

অর্চনাও দু’হাতে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে “দিদিভাই” বলে কেঁদে ফেলল। বেশ কয়েক মূহুর্ত সেভাবেই কেটে যাবার পর প্রথম কথা বললেন বিধুবাবু। তিনি অর্চনার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “দিদিভাইকে নিয়ে আগে ঘরে গিয়ে বোস অর্চু। মেয়েটার নাজানি কত কষ্ট হয়েছে আজ। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে দেখ”।

অর্চনা সীমন্তিনীর শরীর থেকে হাতের বাঁধন আলগা করলেও তার একটা হাত ধরে রেখেই আরেকহাতে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে কান্না ভরা গলায় বলল, “এতদিন বাদে বুঝি এই বোনটার কথা মনে পড়ল তোমার”।

সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে ঘরের বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলল, “কে বলেছে এতদিন বাদে আজই আমার তোমার কথা মনে পড়ল? তোমাকে যেদিন থেকে দেখেছি, সেদিন থেকে একটা দিনও আমার এমন যায়নি যেদিন তোমার কথা আমার মনে না এসেছে। ডাক্তার সোমের সাথে তো আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতুম। রচুর সাথে রোজ কথা বলার সময় তোমার কথাও হয়। মাসি মেসো আর ভাইয়ের সাথে যখন কথা বলি তখন তো তোমার সাথেও কথা বলি আমি। তবু তোমার মনে হচ্ছে এতদিন আমি তোমাকে ভুলে ছিলুম”?
 

বারান্দায় উঠে কিংশুকের পেতে দেওয়া চেয়ারে সীমন্তিনীকে আদর করে বসিয়ে দিয়ে অর্চনা বলল, “তুমি যে আমার সব খবরাখবর রেখেছ তা কি আর আমি জানিনা দিদিভাই। কিন্তু সেই যে রচুর সাথে তোমাকে হাসপাতালে দেখেছিলুম তারপর থেকে তো আর কখনো আমার সাথে দেখা করনি। আজ পাক্কা এক মাস এগার দিন বাদে তোমার দেখা পেলুম। মনে হচ্ছে যেন কতদিন বাদে তোমাকে দেখছি”।

বিধুবাবু বিভাদেবীকে বললেন, “শুনছো, তুমি মন্তিমাকে একটু চা জল খাবার দাও। ও তো খুব বেশীক্ষণ বসবে না জানি” বলে কিংশুককে বললেন, “খোকা, আমরা দু’জনেই তো দোকান খুলে রেখেই চলে এসেছি রে। তুই একটু দোকানে গিয়ে বোস, আমি একটু মন্তিমার সাথে দুটো কথা বলে নিই চট করে। আমি গিয়েই তোকে আবার পাঠিয়ে দেব। তখন তুই দিদিভাইয়ের সাথে কথা বলিস”।

বিধুবাবুর কথায় কিংশুক উঠোন পেরিয়ে গেট দিয়ে বাইরে চলে গেল। বিভাদেবীও রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। সীমন্তিনী তখন অর্চনাকে বলল, “অর্চু সোনা, তুমি তোমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিয়েছ তো”?

অর্চনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, একটা ব্যাগে আমার কাপড় চোপড় ভরে নিয়েছি। শুধু পড়নের পোশাকটাই চেঞ্জ করতে হবে”।

সীমন্তিনী তখন বলল, “বেশ তবে তুমি চেঞ্জ করে রেডি হয়ে নাও। আমি মেসোর সাথে একটু কথা বলে নিই কেমন? আর হ্যাঁ, মনে করে তোমার ওষুধ আর ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন সঙ্গে নিতে কিন্তু ভুলো না”।

“আচ্ছা দিদিভাই” বলে অর্চনা ঘরের ভেতর ঢুকে যেতেই সীমন্তিনী বিধুবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “মেসো তুমি বল কী বলবে? তার আগে বল তোমার শরীর ঠিক আছে তো? আর দোকান কেমন চলছে? কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো”?
 

বিধুবাবু সীমন্তিনীর কাছাকাছি একটা মোড়া পেতে বসে বললেন, “শরীর এখন ভালই আছে মা। বেশ ভালই আছি। আগের থেকে অনেক জোর পাচ্ছি শরীরে। আর প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হলেও এখন দোকান চালাতে আর অত কষ্ট হচ্ছে না। বিক্রী বাট্টাও ভগবানের আশীর্বাদে বেশ ভালই হচ্ছে। তবে বাজারের চাইতে দাম এক দু’টাকা বেশী নিতে হচ্ছে বলে অনেক গ্রাহকই অনুযোগ করছে। তাই আমি ভাবছি এখন থেকে আলিপুরদুয়ারের মহাজনদের কাছ থেকে মালপত্র আনব। তাতে পর্তা আরও ভাল পড়বে। যার ফলে বাজারে যে রেটে মাল বিক্রী হয় আমিও সেই একই দামে বিক্রী করতে পারব। তাতে পুরোনো গ্রাহকরা যেমন খুশী হবে, তেমনি আরও নতুন নতুন গ্রাহক পাব। তাতে লাভও বাড়বে। তুমি কি বলো মা”?
 

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “কথাটা তো ঠিকই বলেছ মেসো। কিন্তু এখন লোকাল মহাজনদের কাছ থেকে যেমন সপ্তাহে সপ্তাহে মাল আনছ, তাতে সময়ও কম লাগছে আর পরিশ্রমও কম হচ্ছে। আলিপুরদুয়ার থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে মাল আনতে হলে তো তোমার খরচাও বেশী পড়বে আর যাতায়াতের ধকলও তোমাকে সইতে হবে”।

বিধুবাবু একটু ভেবে বললেন, “সপ্তাহে সপ্তাহে না এনে আমি পনের দিন পর পর যদি দু’সপ্তাহের যোগান একসাথে নিয়ে আসতে পারি তাহলে বাড়তি খরচার ব্যাপারটা পুষিয়ে যাবে। আর যাতায়াতের খরচাও মানিয়ে নেওয়া যাবে। তবে শারিরীক পরিশ্রমটুকু তো করতেই হবে। ওটুকু না করলে তো চলবে না। তবে শরীরে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী জোর পাচ্ছি বলেই সাহস করছি”।
 

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “তুমি যদি ভাবো যে তুমি সামলে নিতে পারবে সবকিছু তাহলে করতে পারো। কিন্তু আরেকটা কথাও ভেবে দেখো মেসো। ভাই এখনও এখানেই আছে বলে ও সকাল বিকেলে কিছুটা সময় দোকানে বসতে পারছে। কিছুটা হলেও তার কাছ থেকে একটা সাহায্য পাচ্ছ। কিন্তু মাস তিনেক বাদেই তো ভাই বারো ক্লাসের ফাইনাল দেবে। তারপর ওকে তো বাইরে চলে যেতে হবে। তখন তো তুমি একা হয়ে যাবে। তখন একা সব কিছু সামাল দিতে পারবে তো”?

বিধুবাবু বললেন, “মাগো, তুমি যখন আমায় যজমানি ছেড়ে দোকান করবার পরামর্শ দিয়েছিলে তখন আমার মনে খুব সংশয় ছিল। বাপ ঠাকুর্দারা কেউ তো ওসব করেন নি। ভয় হচ্ছিল, সামাল দিতে পারব কি না। কিন্তু এই মাস খানেকের ভেতর যা অভিজ্ঞতা অর্জন করলুম তাতে মনের জোর অনেকটাই বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে সব সামলে নিতে পারব। আর তুমি যখন খোকার পড়াশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছ তখন বারো ক্লাস পেরোলে যে ওকে বাইরে যেতেই হবে, এ কথা তো ঠিকই। কিন্তু তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভগবান সহায় হলে হয়ত একটা কর্মচারীও রাখতে পারি। সেটা করতে পারলে আর সমস্যা হবে না হয়ত। কিন্তু তুমি অনুমতি না দিলে আমি কিছুই করব না মা”।

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “ঠিক আছে মেসো, তোমার মনে জোর যখন আছে, তাহলে করতে পারো। তবে এর পরেও যদি কোনও সমস্যার সম্মুখীন হও, আমাকে জানাবে কিন্তু। আচ্ছা মেসো তোমাকে যে বলেছিলাম ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলতে, সেটা করেছ”?
 

বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা, তুমি যেমন বলেছিলে, আমার আর খোকার নামে একটা জয়েন্ট একাউন্ট খুলেছি সমবায় ব্যাঙ্কে। আর তোমার কথা মতই দু’দিন পর পর দোকানে যা আমদানী হচ্ছে তা ওই একাউন্টে জমা করে দিচ্ছি। এ ভাঙা ঘরে বেশী নগদ টাকা রাখিনা একদম। যখন মাল খরিদ করব তখন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেব”।

সীমন্তিনী বলল, “মেসো যেভাবে ভাল হয় বুঝে শুনে কোর। কিন্তু রান্নাঘরটার যা অবস্থা দেখছি তাতে করে এবারের বর্ষা কোনরকমে কেটে গেলেও সামনের বছর বর্ষা আসবার আগেই কিন্তু মেরামত করতে হবে। আর আমি ভাবছি এবার আর বাঁশের খুঁটি দড়মার বেড়া না দিয়ে পাকাপোক্ত ভাবে বানিয়ে দেব। তুমি সময় সুযোগ মত একজন ভাল রাজমিস্ত্রীর কাছ থেকে আনুমানিক একটা হিসেব বানিয়ে নিও তো। সেটা নিয়ে পরে আমি সময় মত আলোচনা করব”।

বিধুবাবু মাথা নিচু করে একটু সময় চুপ করে থেকে বললেন, “কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ মা। রান্নাঘরটা সামনের বর্ষার ধকল হয়ত সইতে পারবে না। কিন্তু তুমি আর কত করবে মা আমাদের জন্য। সংসারের খরচের জন্যে টাকা দিচ্ছ, খোকার কলেজের ............”।

সীমন্তিনী বিধুবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মেসো এই এক কথাগুলো আর কতবার বলবে গো তোমরা। যদি সত্যি আমাকে তোমাদের একটা মেয়ে বলে ভাবো তবে এই কথাগুলো কেন বারবার টেনে আনছো তোমরা বল তো? মেয়ের যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে মা বাবা ভাই বোনদের জন্য সে কি কিছু করতে পারে না”? একটু থেমে বিধুবাবু কিছু একটা বলবার আগেই আবার বলল, “আর কোনও কথা নয়। যদি আমি তোমাদের আরেকটা মেয়েই হয়ে থাকি, তবে এমন কথা আর কোনদিন যেন আমাকে শুনতে না হয়। যা বললাম সে কথাগুলো মনে রেখো। আর সেভাবে কাজ কোর। আর এর পরেও যদি তোমরা কেউ এ ধরণের কথা আবার বলো, তবে সেদিন থেকেই আমি কিন্তু আর তোমাদের সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখব না, এই পরিস্কার বলে দিলুম”।
 

বিধুবাবু হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, “এই দ্যাখ মা। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। আর কখনো এমন কথা বলব না। কিন্তু মা, মুখের কথা না হয় মুখ বুজে বন্ধ করে ফেলা যায়, কিন্তু মনের তো টুটি চেপে ধরা যায় না। তার মুখ কে কবে বন্ধ করতে পেরেছে বলো? যেদিন বিবেক বলে কিছু থাকবে না সেদিনই হয়ত মনেও এসব কথা আর আসবে না”।

বিধুবাবুর কথাটা শুনে সীমন্তিনী হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেল। সত্যিই তো, মুখে কুলুপ এঁটে মুখের সবকথা তো বন্ধ করে দেওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু মন যে কথা বলে তাকে আটকাবার কি উপায় আছে? সেই ছোট্ট বেলা থেকে তার নিজের মন যা বলে আসছিল, সে কথাগুলো তো মুখ ফুটে সে বেরোতে দেয়নি। কিন্তু মন কি তাই বলে সেসব কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে? সে যে তার হৃদয়ে লেখা নাম। সে নাম কি কেউ কখনো মুছে ফেলতে পারে?
 

সীমন্তিনীর মুখের গাম্ভীর্য্য দেখে বিধুবাবু সীমন্তিনীর একটা হাত নিজের দু’হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার কথায় কষ্ট পেলে মা? আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে মাগো। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কক্ষনো এমনভাবে তোমাকে দুঃখ দেব না”।

সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতদুটো ধরে ধরা গলায় বলল, “মেসো, তুমি শান্ত হও। আমি তোমার কথায় কিছুই মনে করিনি গো। তুমি তো ঠিকই বলেছ। হৃদয়ের কথা যে হৃদয়ে চিরতরেই থেকে যায়। নিজেরই দোষে সেই কোন ছোটবেলা থেকে নিজের জন্মদাতা মা বাবার সাথে আমার বার্তালাপ বন্ধ হয়ে গেছে। বাবার স্নেহ ভালবাসা মায়ের মমতাও সেদিন থেকেই হারিয়ে বসেছি। রচুর মাধ্যমে তোমাদের পেয়ে মনে হয়েছিল নতুন করে আমি আবার মায়ের মমতা আর বাবার ভালবাসার স্বাদ পাচ্ছি। তাই তোমাদের কাছে বার বার ছুটে আসি। আমার শুধু তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ, সারা জীবন তোমাদের স্নেহ ভালবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত কোর নাগো। আমি আর কিচ্ছুটি চাই না জীবনে” বলতে বলতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
 

ততক্ষণে বিভাদেবী প্লেটে করে বেশ কিছু খাবার দাবার নিয়ে এসেছেন। সীমন্তিনীকে ওভাবে কাঁদতে দেখেই বিধুবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি কি গো? দিলে তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে। ওঠো দেখি এবার। তুমি দোকানে গিয়ে খোকাকে পাঠিয়ে দাও বাড়িতে। ও এসে আমায় একটু সাহায্য করুক”।

বিধুবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি” বলেই সীমন্তিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন, “এই খাবারটুকু খেয়ে নাও মা। আর তুমি যা বললে আমি সেভাবেই সব কিছু করব। তবে মা, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। যেদিন পুজো করে দোকান উদ্বোধন করলুম সেদিন খুব আশা ছিল তুমি এসে লক্ষ্মী গনেশের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করবে। তুমি তো ব্যস্ত ছিলে বলে আসতে পারনি সেদিন। আর তারপর আজই তুমি প্রথম এলে। তাই বলছি মা, চলে যাবার আগে একবারটি দোকানের ভেতরে ঢুকে যেও। কাল থেকে আমি তাহলে ভাবতে পারব যে আমার অন্নপূর্ণা মা আমার দোকানে এই জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। এই জায়গায় বসেছিল। আমার এ কথাটা রাখবে মা”?
 

সীমন্তিনী মুখে হাসি এনে বলল, “আচ্ছা মেসো যাবো’খন। কিন্তু সকাল থেকেই এ ইউনিফর্ম পড়ে আছি। এত জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি। এ অবস্থায় তোমার ঠাকুরের আসন ধরাটা তো উচিৎ হবে না”।

বিধুবাবু আবার বললেন, “ঠিক আছে মা, ঠাকুরের আসন না হয় নাই বা ছুঁলে। কিন্তু তুমি তো আমার মা দুর্গা গো। তুমি ভেতরে ঢুকলে আমার দোকানের কিচ্ছু অশুচি হবে না। এসো কিন্তু মা। আচ্ছা, আমি গিয়ে খোকাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি” বলে চলে গেলেন।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর সামনে খাবার থালা রেখে জলের গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “একটু মুখটা ধুয়ে নে তো মা”।

সীমন্তিনী বলল, “আমি কলপারে গিয়ে ধুয়ে আসছি মাসি। সত্যি মুখটা ঘামে চটচট করছে গো”।

বিভাদেবী বলল, “কলপারে যেতে হবে না। এই গ্লাসের জলটা দিয়েই বারান্দার ওপাশে গিয়ে ধুয়ে নে মা। খাবার জল আমি পরে এনে দিচ্ছি। আয় এদিকে আয় তো”।

সীমন্তিনী আর কথা না বাড়িয়ে বারান্দার কোনার দিকে গিয়ে দাঁড়াতেই বিভাদেবী বললেন, “সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়া। আমি তোর মুখ ধুইয়ে দিচ্ছি”।

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত বিভাদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। বিভাদেবী হাতের আঁজলায় গ্লাস থেকে জল নিয়ে সীমন্তিনীর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলেন। যেন এক মা তার শিশুকন্যার মুখ ধুইয়ে দিচ্ছেন। দু’বার জল ছিটিয়ে দেবার পর তার হাত দিয়েই সীমন্তিনীর কপাল গাল চিবুক একটু ঘষে দিয়ে আবার দু’বার জলের ঝাপটা দিয়ে বললেন, “গ্লাস থেকে একটু জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করে ফেলে দে তো মা”।

সীমন্তিনীর বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তার নিজের মা কোনদিন এভাবে তার মুখ ধুইয়ে দিয়েছেন কিনা তা তার মনে পড়েনা। হ্যাঁ, তার বড়মার কাছ থেকে সে অনেক স্নেহ মমতা পেয়েছে। কিন্তু গত তিন সাড়ে বছরের ভেতর সে তার বড়মাকেও চোখে দেখেনি। ভেতর থেকে একটা কান্না যেন উথলে উঠতে চাইছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে সে গ্লাস থেকে জল মুখে নিয়ে দু’বার কুলকুচি করতেই বিভাদেবী নিজের কোমড়ে জড়ানো শাড়ির আঁচলটা খুলে নিয়ে সীমন্তিনীর মুখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর সীমন্তিনীর হাত ধরেই তাকে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে খাবারের প্লেটটা হাতে দিয়ে বললেন, “ইশ মুখটা সত্যি কেমন শুকনো শুকনো লাগছে রে। নে তো মা এ খাবারটুকু খেয়ে নে। সবটা খাবি কিন্তু। আমি তোর জন্যে খাবার জল নিয়ে আসছি”।

এমন সময় সীমন্তিনীর পেছন থেকে অর্চনার গলা শোনা গেল, “মা রচুর কথা ভুলে গেলে? কাল সে তোমায় কী বলেছিল”? অর্চনা যে কখন পোশাক বদলে সীমন্তিনীর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা সীমন্তিনী বুঝতেই পারেনি।

বিভাদেবী দাঁতে জিভ কেটে বললেন, “ইশ, সত্যিই তো রে। আমি তো একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস তুই মনে করিয়ে দিলি। আচ্ছা অর্চু, তুই তাহলে এ গ্লাসটা নিয়ে যা। ধুয়ে কলসী থেকে ঠাণ্ডা জল গড়িয়ে নিয়ে আয় তোর দিদিভাইয়ের জন্য”।
 

সীমন্তিনী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার গো মাসি? কী বলেছে রচু”?

বিভাদেবী খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে সীমন্তিনীর চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজ তুই বাড়ি আসবি জানতে পেরেই তোর রচুসোনা আমাকে নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিতে বলেছে মা। কিন্তু আমি কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম। নে হাঁ কর তো দেখি”।

সীমন্তিনী আর কথা না বলে হাঁ করতেই বিভাদেবী তার মুখে গ্রাস তুলে দিলেন। সীমন্তিনীর চোখ আবার জলে ভরে এল। ঠিক অমন সময় কিংশুক বাড়ির ভেতর এল। আর অর্চনাও জলের গ্লাস নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এল। বিভাদেবী সীমন্তিনীর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, “খোকা, রান্নাঘরে একটা বড় থালায় কিছু মিষ্টি আর খাবার রেখে এসেছি। থালাটা নিয়ে বাইরে গিয়ে মন্তিমার সাথে যারা এসেছে তাদেরকে খাইয়ে আয়। আর সাথে জলের জগটাও নিয়ে যাস কেমন”?

“আচ্ছা মা” বলে কিংশুক চলে যেতেই অর্চনা সীমন্তিনীর অন্যপাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখল সীমন্তিনীর চোখ দুটো জলে ভেজা। অর্চনা তখন সুতীর শালোয়ার কামিজ পড়ে ছিল। ওড়না দিয়ে সীমন্তিনীর চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “এ কি দিদিভাই, তুমি কি কাঁদছ নাকি? না মা ঠিকমত তোমার ভেজা চোখ দুটো মুছে দেননি”।

সীমন্তিনী খাবার চিবোতে চিবোতেই কোন কথা না বলে একটু মুচকি হাসল। সীমন্তিনীর খাওয়া শেষ হলে কিংশুক বাড়ির ভেতর ফিরে আসতেই সীমন্তিনী তাকে ডাকল। কিংশুক কাছে আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই নভেম্বরে পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই কিন্তু এরপর যা করবে তা নিয়ে উঠে পড়ে লাগতে হবে। কোন লাইনে পড়তে চাও তার এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হবে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু আগে থেকেই মনস্থির করতে হবে যে কোন লাইনে যেতে চাও। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যা-ই হতে চাও তার জন্য তোমাকে অল ইন্ডিয়া লেভেলের কম্পিটিটিভ এক্সাম গুলো দিতে হবে। তাই টুয়েল্ভথের পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই স্টাডি মেটেরিয়াল কালেক্ট করতে হবে। অবশ্য সে সব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সে সব আমিই জোগার করে দেব তোমাকে। কিন্তু কোন লাইনে যেতে চাও সেটার ডিসিশন নিয়ে আমাকে কিন্তু পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথে জানিয়ে দিও। আর পরীক্ষা শেষ হবার আগেই যদি জানিয়ে দিতে পারো তাহলে তো আরও ভাল হয়। তবে একটা কথা মনে রেখো। কোন লাইনে পড়লে খরচ বেশী হবে, কোন লাইনে পড়লে খরচ কম হবে সেসব নিয়ে একদম ভাববে না। তুমি যা পড়তে চাইবে তাই পড়তে পারবে। শুধু তোমার সিদ্ধান্তটা আমাকে জানিও। বাকি সব কিছু আমি সামলে নেব। কিন্তু বারো ক্লাসের পরীক্ষাই বলো আর কম্পিটিটিভ পরীক্ষাই বলো, সবটাতেই কিন্তু টপার হবার চেষ্টা করতে হবে তোমাকে”।

কিংশুক সীমন্তিনীর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “সে চেষ্টাই করব দিদিভাই। তুমি শুধু আমাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ কোর, তাহলেই হবে”।

সীমন্তিনী কিংশুকের মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলল, “ভাইদের ওপর দিদিদের আশীর্বাদ চিরদিনই থাকে ভাই। আর তুমি তো আমার এত মিষ্টি ছোট ভাই। তোমাকে আশীর্বাদ না করে থাকতে পারি? আমার আশীর্বাদ, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা সব কিছু তোমার জন্যে আলাদা করে তোলা আছে। সেটা থেকে আর কেউ কোনও ভাগ পাবে না”।
 

কিংশুক হেসে বলল, “আমিও তোমার চাওয়া পূরণ করে দেখাবো দিদিভাই। আমাকেও তো প্রমাণ করতে হবে যে আমি তোমার যোগ্য ভাই”।


 ------------------------------------
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 11-03-2020, 10:15 PM



Users browsing this thread: