Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 131)

লক্ষ্মী ভেতর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে বলল, “ছোড়দি, ভেতরে এস। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালব এখন। এ সময় ঘরের বাইরে থাকতে নেই”।
 

নবনীতা কোনও কথা না বলে ঘরের ভেতর চলে এল। কয়েক মিনিট বাদে লক্ষ্মী ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁখে ফুঁ দেবার সাথে সাথেই কলিংবেল বেজে উঠল। নবনীতা হাত জোড় করে ঠাকুরকে প্রণাম করেই দরজার দিকে ছুটে গেল। সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “আজ তো ফিরতে দেরী হবে বলে বলনি দিদি? তাহলে এত দেরী হল যে”?
 

সীমন্তিনী নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি গো ঠাকুমা আমার। খুব ভুল হয়ে গেছে। আর এমন ভুল হবে না কক্ষনো” বলে নবনীতার হাত ধরে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “আসলে অফিস থেকে ঠিক সময়েই বেড়িয়েছি গো। কিন্তু ফেরবার পথে একটু মার্কেটে গিয়েছিলাম একটা কাজ সারতে। তাই একটু দেরী হয়ে গেল”।

নবনীতা হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ। তুমি ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি চা বানিয়ে আনছি”।

সীমন্তিনী নবনীতার হাত ছেড়ে দিলেও জিজ্ঞেস করল, “ওমা, তুমি চা বানাতে যাবে কেন? লক্ষ্মীদির কি হয়েছে”?

নবনীতা বলল, “কিচ্ছু হয়নি লক্ষ্মীদির। কিন্তু সে তো সব ঘরে ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ দেখাচ্ছে। তাই এখন চা টা আমিই করে আনছি। আর অমন করছ কেন? সারাটা দিন তো ঘরে শুয়ে বসেই থাকি। তেমন কোন কাজই তো আমাকে করতে হয় না। এখন না হয় তোমার জন্যে এক কাপ চা-ই বানালুম। একবার খেয়েই দেখ না আমার হাতের চা। একেবারে অখাদ্য কিছু হবে না”।

সীমন্তিনী এবার নবনীতার হাত ছেড়ে দিয়ে তার একটা গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। আমিও পোশাক পাল্টে তৈরী হয়ে নিই। তারপর চা খেতে খেতে তোমার সাথে একটা দরকারী কথা বলব। ঠিক আছে”?

মিনিট পনেরো বাদে ঘরের তিনজনে একসাথে চা খেতে খেতে সীমন্তিনী নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল “নীতা আজ কি পরিতোষ তোমাকে ফোন করেছিল”?

নবনীতা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদি, লাঞ্চ আওয়ারে ফোন করেছিল একবার। জিজ্ঞেস করছিল, তুমি আমার জন্যে কোনও কাজের খোঁজ করেছ কি না। আমি তাকে বলেছি, এখানে এসে আমি খুব ভাল আছি। জীবনে এত ভাল বোধহয় আমি আগে আর কখনও ছিলুম না। কিন্তু সবে তো মাত্র দিন সাতেকই হল এখানে এসেছি। আর এখানে আসবার পর অফিসে জয়েন করে তুমিও খুব ব্যস্ত আছো। তাই হয়তো আমার কাজের ব্যাপারে কোনও খবরাখবর করতে পার নি। একটু ফুরসৎ না পেলে আর কী করে কি করবে”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “আজ আমার পরিতোষের সাথে কোনও কথা হয়নি। কিন্তু কাল রাতে ঘুমোবার আগে ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। তোমার জন্যে যে কাজের কথা আমি ভেবেছি। সেটা নিয়েই ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। আমার মুখে সবকিছু শুনে পরিতোষও বলল তোমার জন্যে কাজটা ভালই হবে। তাই আজ অফিস থেকে ফেরার পথেই সেখানে গিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম একবারে তোমাকে সাথেই নিয়ে যাব। কিন্তু সেটা করতে গেলে আজ আর যাওয়া হত না। কারণ আমি ভাবছি আগামীকাল আমি কালচিনি যাব। অর্চনাকে কয়েকটা দিনের জন্য এখানে নিয়ে আসি। তাহলে ওর মনটা আরও খানিকটা ভাল হবে। তাই কাল আর মার্কেটে যেতে পারব না বলে আজই কাজটা সেরে এলুম। আচ্ছা শোনো, তোমার কি টেইলারিং বা ডিজাইনিং-এর কাজ কিছু জানা আছে”?

নবনীতা একটু দ্বিধান্বিত স্বরে জবাব দিল, “না গো দিদি, আমার ওসব কিছুই জানা নেই। পরিতোষের বাবার মৃত্যুর পর ও যখন আবার হায়দ্রাবাদ চলে গেল তখন ভেবেছিলুম ডিজাইনিংএর একটা কোর্স করব। কিন্তু তখনই তো আমার জীবনটা ওলোট পালট হয়ে গিয়েছিল”।
 

সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে একটু চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলল, “সেসব পুরনো কথা মনে এনে আর কষ্ট পেওনা নীতা। শোনো, তোমাকে তো সেদিন বলেছিলাম, এখানে মার্কেটে বসাক গারমেন্টস বলে একটা দোকান, মানে বেশ বড়সড় একটা শো-রুম আছে। তার মালকিন আমার পরিচিত এক বিধবা ভদ্রমহিলা। জয়া বসাক। শো-রুমের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ডিজাইনিং আর টেলারিং-এর একটা বেশ বড়সড় ইউনিট আছে। সেখানে পনের ষোল জন মেয়ে কাজ করে নিত্য নতুন ডিজাইনের পোশাক আশাক তৈরী করে। এ তল্লাটে অমন সুন্দর কালেকশন আর কোথাও নেই। আর তাদের ফ্যাক্টরীর প্রোডাকশন গুলো কেবল মাত্র তাদের নিজস্ব শো-রুমেই বিক্রী হয়। তাই দোকানটায় বিক্রী বাট্টাও বেশ। আশেপাশের এলাকা থেকেও লোকেরা এখানে অন্য ধরণের নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক পাবে বলে আশা করে আসে। কিছুদিন আগে একটা উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে ওই ভদ্রমহিলাকে আমি কিছুটা সাহায্য করেছিলাম। তখন ওই মহিলা আমাকে কিছু দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য অনেক পুলিশ অফিসারের মত আমার তো ঘুষ নেবার অভ্যেস বা প্রয়োজন কোনটাই নেই। তাই তখন তাকে বলেছিলাম, যে আমার যদি কখনও তার সাহায্যের দরকার পড়ে তখন আমি তাকে বলব। আজ আমি সেখানেই গিয়েছিলুম। গিয়ে তোমার কথা বললুম। আর তাকে অনুরোধ করলুম, তোমাকে তাদের ওখানে কোন একটা কাজে নিয়ে নিতে। তখন উনি বললেন, যে তারা তাদের মূল শো-রুমের জন্য একজন ভাল স্বভাবের সেলস গার্লের খোঁজ করছেন। তাছাড়া তাদের ফ্যাক্টরীতেও ডিজাইনিং বা টেলারিং জানা মেয়ে বা মহিলার দরকার। আমার সিফারিসে তিনি তোমাকে কাজে নিতে রাজি আছেন। তাই আমি মনে মনে ভাবছিলুম তোমাকে ওই ফ্যাক্টরীতেই টেলারিং বা ডিজাইনিংএর কাজে লাগিয়ে দেব। কারণ তাতে ভবিষ্যতে একটা ভালো কিছু করতে পারবে। কিন্তু সে কাজ করতে গেলে তো প্রাথমিক ভাবে আগে থেকে কিছুটা জানা দরকার। এখন তুমি যখন বলছ যে এ ব্যাপারে তোমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তাহলে তো সেখানে কাজ করতে গেলে তোমাকে সেলস গার্লের কাজেই আপাততঃ ঢুকতে হবে। তুমি কি তাতে রাজি আছো”?

নবনীতা নিজের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “আগের কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেলস গার্লের কাজ মনে হয় করতে পারব দিদি। কিন্তু তুমি যেমন বললে, পরিতোষও সেদিন একই কথা বলেছিল। ডিজাইনিং বা টেলারিং ইউনিটে চান্স পেলেই মনে হয় বেশী ভাল হত। কিন্তু ও সব কাজ তো আগে থেকে জানা না থাকলে করা সম্ভব নয়”।

সীমন্তিনীও নিজের চা শেষ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার দেখে বলল, “সেলস গার্লের কাজেও তোমাকে তারা নিয়ে নেবেন বলেছেন। কিন্তু আমি চাই না তুমি সারাজীবন ওই সেলস গার্লের কাজই করে যাও। আমি চাই তুমি এমন কিছু একটা কর, যাতে করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারো। ভবিষ্যতে স্বাধীন ভাবে কিছু একটা করতে পারো। তাই আমি চাই তুমি আপাততঃ সেখানে সেলস গার্লের কাজে যোগ দিলেও রোজ কয়েক ঘন্টা করে তাদের কারখানায় যাবে। অন্যান্য কর্মীদের সাথে ভাব করে তাদের কাজের নমুনা দেখে শুনে সবকিছু শেখার চেষ্টা করবে। এভাবে যদি তুমি ডিজাইনিং বা টেলারিংএর কাজ শিখে নিতে পারো তাহলে একদিন তুমি নিজেই সেসব করতে পারবে। আর আমি মনে মনে সেটাই চাই। আমি ওই ভদ্রমহিলাকে সেভাবে অনুরোধ করলে তিনি আমার অনুরোধ নিশ্চয়ই রাখবেন। তোমাকে তাদের কারখানায় যাবার অনুমতি দেবেন। বাকিটা ডিপেন্ড করবে তোমার নিজের ওপর”।

একটু থেমে আরেকবার দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “তুমি ব্যাপারটা ভালভাবে ভেবে দেখ। চাইলে পরিতোষের সাথেও পরামর্শ কর। তারপর যেটা সিদ্ধান্ত নাও আমাকে বোলো। আমি সেভাবেই বন্দোবস্ত করব। তবে এখন আমি কিছুক্ষণ এঘরে একা থাকতে চাই। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে আমার বলা কথাগুলো ভেবে দেখ, কেমন”?
 

নবনীতা খালি চায়ের কাপগুলো নেবার জন্যে হাত বাড়াতেই লক্ষ্মী নিজেই কাপগুলো তুলে নিতে নিতে বলল, “ও দিদিমণি, তুমি তো বললে কাল কালচিনি যাবে বৌদিমণির বাপের বাড়ি। আমার না বৌদিমণির মা বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে গো। আমায় সঙ্গে নেবে”?

সীমন্তিনী একমূহুর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাদের সবাইকেই তুমি দেখতে পাবে লক্ষ্মীদি। ভেব না। কিন্তু কাল তোমাকে নিয়ে যাব কি করে গো? নীতাকে এ বাড়িতে একা ফেলে আমরা দু’জনে মিলে চলে যাব, এটা তো ঠিক হবে না। আর আমি অফিসের কাজে আগে যাব আলিপুরদুয়ার, ফেরার পথে কালচিনি হয়ে ফিরব। তাছাড়া ফিরতে ফিরতে তো আমাদের সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তুমি ঘরে থাকলে তো অর্চুর জন্যে কিছু খাবার টাবার বানিয়ে রাখতে পারবে। নইলে আমার ঘরে এসে অর্চুকে তো খালি মুখে বসে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। আর তেমন হলে তোমার বৌদিমণি কিন্তু .......”

সীমন্তিনীকে তার কথা শেষ করতে না দিয়েই লক্ষ্মী বলে উঠল, “হ্যাঁ গো দিদিমণি। তুমি তো ঠিকই বলছ। আমি তো কোনকিছু না ভেবেই যাবার বায়না ধরে বসলুম। আমি যদি আগে ভাগে খাবার তৈরী না করি তাহলে বৌদিমণির দিদিকে তো কিছুটা সময় না খেয়েই বসে থাকতে হবে। না না, সেটা করা একেবারেই ঠিক হবে না। বৌদিমণি তাহলে আমার ওপর রেগে যাবেন। না না দিদিমণি, তুমিই যাও। আর তুমি যখন বলছ যে তাদের আমি দেখতে পাবোই, তাহলে আর অত তাড়াহুড়ো করবার কি আছে”?
 

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে লক্ষ্মীদি। তবে আমি তোমাকে বলছি, খুব অল্প দিনের ভেতরেই তুমি তোমার বৌদিমণির মা, বাবা, ভাই সবাইকেই দেখতে পাবে। আমি সে বন্দোবস্তই করবার চেষ্টা করব। এবার খুশী তো”?
 

লক্ষ্মীও সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে একটু হেসে কিচেনের দিকে চলে যেতে সীমন্তিনী নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “নীতা, সোনা বোন আমার। সেদিনও তোমাকে তোমার ঘরে পাঠিয়ে আমি কিছুক্ষণ আমার ঘরে একা ছিলুম। আর আজ এখনও আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই বলেছি বলে রাগ বা অভিমান কোর না প্লীজ। তবে ব্যাপারটা তোমাকে একটু পরিস্কার করে বোঝানো দরকার। আসলে নীতা, এ’কথাগুলো তোমাকে সেদিনও বলেছি। তবু আজ আবার বলছি, পুলিশের কাজটা তো সাধারণ অন্য যে কোনও কাজের থেকে আলাদা। এ কাজে অনেক সময়েই আমাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই সব রকম সতর্কতা আমাদের অবলম্বন করতে হয়। তাই কাজের খাতিরেই আমাদের নিজেদের লোকের কাছেও নানারকম মিথ্যে কথা বলতে হয়। নানা কথা লুকিয়ে যেতে হয়। আর এ এলাকাটা গত কয়েকবছর ধরে এতই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে আমাদের সামান্য একটু অবহেলাও নিজেদের ওপর চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই সব সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। তাই আজ তোমাকে একটা কথা বুঝিয়ে বলছি। আমি যখন এর পরেও কখনো একা থাকতে চাইব তখন বুঝে নিও যে আমি ইম্পর্ট্যান্ট কোনও অফিসিয়াল ব্যাপারে কারুর সাথে কোন ডিসকাশন করছি। আর সেসব ডিসকাশন আমি তোমাকে বা লক্ষ্মীদিকে শোনাতে চাই না। কারন পুলিশের অনেক গোপন কর্মসুচী থাকে যা আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব এমপ্লয়ীরাও জানতে পারে না। সেসব পুলিশের টপ লেভেলের কিছু অফিসার আর গোয়েন্দাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সে সব ব্যাপারে আলোচনা ও খবরের আদান প্রদান আমাদের খুবই গোপনীয় ভাবে করতে হয়। আর সে জন্যেই আমি তোমার আর লক্ষীদির বর্তমানে সেসব ব্যাপার নিয়ে ফোনে আলাপ করব না। আর শুধু তোমরাই নও, যে দুটো ব্যক্তি আমার জীবনে সবচাইতে মূল্যবান, যারা আমার সবচাইতে কাছের মানুষ, সব চাইতে প্রিয়জন, সেই দাদাভাই আর রচুর কাছেও আমাকে সেসব কথা গোপন রেখে চলতে হয়। তাই বলছি ভাই, তুমি তো এখানে নতুন এসেছ। আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে সরে তোমার ঘরে যেতে বলেছি বলে তোমার মনে দুঃখ হতে পারে। তুমি ভাবতে পারো যে যার মুখের একটি কথায় তুমি সব কিছু ছেড়ে তার সাথে চলে এসেছ, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার তুমি মনে মনে আশা করনি। কিন্তু সেটা একেবারেই ঠিক নয় বোন। তাই তোমাকে আমি সেদিনও এভাবে বুঝিয়েছিলুম। আজও আবার একই কথা বলছি। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পারবে। তোমাকে আমি আজ আরও পরিস্কার করে বলছি, আমার দাদাভাই আর রচুসোনা আমার জীবনের সবকিছু। ওদের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। আমার প্রাণটাও বিসর্জন দিয়ে দিতে পারি। আর বর্তমানে আমার দাদাভাই আর রচুর পরেই আমার প্রিয়জনের তালিকায় আমার মাসি মেসো, মানে রচুর মা বাবা, ভাই বোন ছিল। আজ সে তালিকায় তোমার নামটাও ঢুকে গেছে। তোমাকে আমি আমার নিজের ছোটবোনের মতই আগলে আগলে রাখব। শুধু তুমি আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কোরো বোন। অ্যাট লিস্ট যখন আমি একা থাকতে চাইব, তখন যেন আমাকে ভুল বুঝোনা বোন। বুঝেছ তো”? বলে নবনীতার গালে আলতো করে হাত রাখল।

নবনীতাও সীমন্তিনীর আরেকটা হাত নিজের হাতে নিয়ে একটু ম্লান হেসে বলল, “বুঝেছি দিদি। আমি এ ব্যাপারে তোমাকে ভুল বুঝব না। তবে সত্যি কথা বলছি দিদি, সেদিন তুমি ওভাবে বলতে আমার মনে একটু ধাক্কা লেগেছিল সত্যি। কিন্তু এখন তোমার কথাগুলো শুনে আমার মন একেবারে ভাল হয়ে গেছে। পরিতোষও তার পরের দিন আমাকে এসব বুঝিয়েছে”।

সীমন্তিনী নবনীতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “লক্ষ্মী বোন আমার। আমার কথাগুলো যে তুমি বুঝেছ সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তবে শোনো, আমার হাতে আর সময় নেই। এখনই আমাকে জলপাইগুড়ি আর কলকাতা অফিসের সাথে কথা বলতে হবে। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে তোমার কাজের ব্যাপারে যে কথাগুলো বললুম সেগুলো নিয়ে ভাল করে ভাবো। ফোনে কথা বলা শেষ হলেই আমি তোমাকে আমার ঘরে ডেকে নেব, কেমন”?

নবনীতা সীমন্তিনীকে ছেড়ে মিষ্টি হেসে বলল, “ঠিক আছে দিদি” বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
 

*******************

প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর সীমন্তিনী নবনীতার ঘরে ঢুকে দেখে নবনীতা হাতে মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে। তার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এবার আমি আমার ছোটবোনটার সাথে গল্প করব। তা তুমি মোবাইল নিয়ে কী করছ নীতা? জরুরী কিছু”?

নবনীতা মোবাইল বিছানায় রেখে বলল, “নাগো দিদি, কিছুই করছিলাম না। গেমস খেলে একটু সময় কাটাচ্ছিলুম। কি করব বল? লক্ষ্মীদিও রান্না ঘরে ঢুকতে দিল না। একা একা কি চুপচাপ বসে থাকা যায়”?

সীমন্তিনী নবনীতার হাতে একটা চুমু খেয়ে বলল, “একা একা চুপচাপ একেবারেই বসে থাকবে না। মোবাইলে গেমস খেলো, প্রয়োজন হলে আমার ঘর থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে এসেও সময় কাটাতে পারো। কাগজ ম্যাগাজিন পড়তে পারো। আমার ঘরের আলমারির ভেতর কিছু বই আছে। ইচ্ছে হলে সেসবও পড়তে পারো। তবু একা একা থেকে নিজের জীবনের আগের ঘটণাগুলো নিয়ে একেবারেই ভাববে না। যা কিছু হয়েছে, সেসব ভুলে গিয়ে তোমাকে এখন থেকে নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে”।

নবনীতা একটু দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, “ল্যাপটপ তো আমি চালাতেই পারি না দিদি”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তাতে কোন সমস্যা হবে না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। খুবই সহজ ব্যাপার। তবে আরেকটা কথা শোনো বোন। কাল আমাকে অফিসের কাজেই আলিপুরদুয়ার যেতে হচ্ছে। ফেরার পথে কালচিনি হয়ে আসব। অর্চনাকে নিয়ে আসব। ওকে নিয়ে আসাটা খুবই দরকারী। কিছুদিন ওকে যদি আমাদের এখানে রাখতে পারি তাহলে আশা করি ও আরও খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠবে”।

নবনীতা বলল, “দিদি সেদিনও তুমি এ কথাগুলো বলছিলে। কিন্তু অর্চনাদির এমন কী হয়েছে গো”?

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “ওর জীবনে খুব বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে গো। মেয়েটা যেমন গুণী তেমনি সুন্দরী। গরীব পরিবারের হলেও বাবা-মার সুশিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু কপালের লেখা কে খন্ডাতে পারে বল? আচ্ছা তুমি একটু লক্ষ্মীদিকে বলে এস আমাদের জন্যে যেন দু’কাপ চা বানিয়ে আনে। তারপর তোমাকে সব কথা বলছি”।
 

নবনীতা রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে চা বানাবার কথা বলে ফিরে আসতেই সীমন্তিনী তার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বলল, “অর্চনা হচ্ছে আমাদের রচু সোনার বড় বোন। আমার রচু সোনা কে, বুঝেছ তো”?

নবনীতা হেসে বলল, “বারে বুঝব না কেন? তোমার রচুসোনা তো তোমার সেই বৌদি, রচনা বৌদি, তাই না? আচ্ছা দিদি, তুমি তাকে বৌদি বলে ডাক না কেন গো? তোমার চেয়ে বয়সে ছোট বলে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “সেকথা বলতে গেলে তোমাকে তো মহাভারতের উপাখ্যান বলতে হবে বোন। সে’সব না হয় অন্য কোন সময় শুনো। আজ তোমাকে অর্চনার কথা বলি” বলে অর্চনার বিয়ে থেকে শুরু করে বর্তমানে তার বাপের বাড়িতে এসে উপস্থিত হবার পুরো ঘটণাটাই সবিস্তারে খুলে বলল। এর মাঝে লক্ষ্মীর বানিয়ে আনা চা খেয়ে শেষ করেছে তারা।

সব ঘটণা শুনে নবনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কি আশ্চর্যের ব্যাপার। ২০০৫ থেকে ২০১২। এ সাতটা বছর আমার জীবনেও যেমন বিভীষিকাময় ছিল, অর্চনাদির ক্ষেত্রেও তাই। আমি তো তবু বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি নিজের মান সম্মান ইজ্জত সব কিছু বিসর্জন দিয়ে। শেষ অব্দি কিছুটা হলেও হয়ত সফল হয়েছিলাম। কিন্তু অর্চনাদি বেচারী তো কোন সুযোগই পায়নি। তার জীবনটা তো শেষই হয়ে গিয়েছিল। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার দু’জনেরই সেই ঘোর বিভীষিকার সমাপ্তি হল তোমার সাথে দেখা হবার পর। তুমি কি পরশ পাথর দিদি”?

সীমন্তিনী শান্ত স্বরে বলল, “নারে বোন। আমি কোনও পরশ পাথর নই। আমিও একটা অভাগী মেয়ে। আমার নিজস্ব পরিবারের কেউ আমাকে ভাল মেয়ে বলে ভাবে না। আমার মা বাবার কাছে আমি ছোটবেলা থেকেই অলক্ষ্মী। আমি সব আত্মীয় পরিজন ছেড়ে দিয়ে সেই ছোট্টবেলা থেকেই শুধু আমার দাদাভাইকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলুম। আমার মা বাবা কেউ আমার সাথে কথা বলেন না বহু বছর হয়ে গেল। বাড়ি থেকে শুধু বড়মা মানে আমার জেঠিমা, দাদাভাইয়ের মা আর আমার ছোটকাকুই শুধু মাঝে মধ্যে আমার খবরাখবর নিয়ে থাকেন। তবে বাড়ির তরফ থেকে আমি ফাইনেন্সিয়াল সাপোর্টটা আগাগোড়া পেয়েছিলাম বলেই আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। সেজন্যে তাদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। দাদাভাইই ছিল আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। আর সেই দাদাভাইয়ের মাধ্যমেই রচু, রচুর বাবা মা ভাই বোনকে কাছে পেয়েছি। ওরা সকলেই বড় অমায়িক। আমাকেও তাদের আরেকটি মেয়ের মত ভালবাসেন। পরিতোষের মত একটা বন্ধু পাওয়াও আমার জীবনের একটা উপরি পাওনা। ভগবানকে এ জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আর আজ সেই পরিতোষের মাধ্যমেই তোমাকেও আমার ছোটবোনের মত কাছে পেয়েছি। তোমাদের সবাইকে নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই। তবে যার যেটা কপালে লেখা থাকে সেটা থেকে কেউই রেহাই পায় না। তোমার কপালে, অর্চুর কপালে যে দুর্ভোগ ছিল সেটাই তোমরা ভোগ করেছ। কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারে না রে। যদি পারতো তাহলে আমি আরও তিন চার বছর আগে অর্চুকে ওই নরক থেকে উদ্ধার করে আনতে পারতুম। আর পরিতোষ কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে এসেছে ২০১০এ। তোমার সাথেও পরিতোষের দেখাও আরও অন্ততঃ কয়েক মাস আগে হতে পারত। কিন্তু সেসব হয়নি। কারন তোমাদের কপালে লেখা দুর্ভোগের আরও খানিকটা বাকি ছিল বলে। আমি কেউ না, আমি কিচ্ছু না। শুধুই উপলক্ষ্য মাত্র। মানুষের জীবনে সুখ যেমন চিরস্থায়ী নয় তেমনি দুঃখেরও একটা না একটা সময় সমাপ্তি আসে। নিয়তির নিয়মেই তোমাদের দুঃসময়টা কেটে গেছে। এখন আমি শুধু চাই আমার আশে পাশের মানুষগুলো সবাই ভাল থাকুক। ভগবানের কাছে আর কিছু আমার চাইবার নেই এখন”। বলতে বলতে সীমন্তিনীর গলা ধরে এল।

______________________________
 
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 11-03-2020, 10:13 PM



Users browsing this thread: 9 Guest(s)