Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 129)

সীমন্তিনীর ঘুম ভাঙল বেলা প্রায় সাড়ে চারটেয়। বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে বেরোতেই লক্ষ্মী তার ঘরে ঢুকে বলল, “চা খাবে তো দিদিমণি”?

সীমন্তিনী সে কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নীতা উঠেছে”?

লক্ষ্মী জবাব দিল, “না দিদিমণি, ছোড়দি এখনও ওঠেনি। অবশ্য আমি তার ঘরে ঢুকিনি”।

সীমন্তিনী নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে নবনীতার রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “তুমি চা বানিয়ে নীতার ঘরেই নিয়ে এস। ওখানেই চা খাব”।

লক্ষ্মী কিচেনের দিকে চলে যেতে সীমন্তিনী নবনীতার ঘরে ঢুকে দেখে নবনীতা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে নবনীতার শিয়রের পাশে বসে তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে নীতাকে। সীমন্তিনী ভাবতে লাগল, এমন সুন্দর ফুটফুটে দেখতে মেয়েটাকে এই টুকু জীবনে কত দুঃখ যন্ত্রণাই না সইতে হয়েছে। বিনা দোষে ওর গোটা জীবনটাই ছাড়খার হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে আনমনে সে নবনীতার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল।

নবনীতার ঘুম ভেঙে যেতেই চোখের সামনে সীমন্তিনীকে দেখে সে হুড়মুড় করে উঠে বসে বলল, “ওমা দিদি তুমি? কতক্ষণ এসেছ তুমি”?

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “এখনই এলাম গো। তা তুমি চা খাবে তো? যাও, চটপট মুখটা ধুয়ে এস। লক্ষ্মীদি এখনই চা নিয়ে আসবে”।
 

নবনীতা বাথরুমে ঢুকে পড়ল। খানিক বাদে লক্ষ্মী ট্রেতে করে তিনকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। চায়ের ট্রেটা বিছানায় নামিয়ে রাখতে রাখতে লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ গো দিদিমণি, দাদাবাবু আর বৌদিমণির খবর তো কিছুই বললে না আমাকে। তারা ভাল আছেন তো”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি, তারা দু’জনেই ভাল আছে। রচু তো রোজই তোমার কথা ওঠাতো। ওই একটা রাত শুধু এ বাড়ীতে ছিল রচু। কিন্তু তোমার কথা বলতে পঞ্চমুখ। কী যাদু করেছ তুমি তোমার বৌদিমণিকে”?
 

লক্ষ্মী একটা মোড়া টেনে বসতে বসতে বলল, “আমি আর কোথায় কি করেছি গো দিদিমণি। বৌদিমণি আসলেই খুব ভাল মেয়ে। আর কী সুন্দর দেখতে! আমার বাপ-মা যে তাদের এই পেঁচিমুখো মেয়েটার নাম লক্ষ্মী কেন রেখেছিল কে জানে। আমার বৌদিমণিই হল আসল মা লক্ষ্মী। যেমন দেখতে, তেমন সুন্দর কথা, আর তেমনি সুন্দর তার ব্যবহার। আহা হা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। তার মুখটা দেখলেই আমার মনে হত সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মীই যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন”।

নবনীতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মীর শেষ কথা গুলো শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করল, “কার কথা বলছ লক্ষ্মীদি”?

লক্ষ্মী খুশী খুশী মুখে বলল, “দিদিমণির বৌদিদির কথা বলছি গো ছোড়দি। আমি শুধু একদিন তাকে দেখেছি। কিন্তু তার কথা সব সময় আমার মনে পড়ে। বৌদিমণির কথা মনে হলেই মনটা ভাল হয়ে যায় যেন” বলতে বলতে লক্ষ্মী সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল। নবনীতা সীমন্তিনীর পাশে বসে বলল, “হ্যাঁ গো লক্ষ্মীদি। তুমি একদম ঠিক বলেছে। আমিও তো তাকে বলতে গেলে একটা দিনই দেখেছি। কিন্তু আমারও মনে হয়েছে, হাজারটা মেয়ের মধ্যে একজনই বৌদির মত মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে। তা হ্যাঁগো দিদি, রতীশদা-দের বিয়ের কতদিন হল গো”?

সীমন্তিনী চা খেতে খেতেই জবাব দিল, “প্রায় সাড়ে তিন বছর হল”।

নবনীতা এবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার দাদা বৌদি, দু’জনেই খুব চমৎকার মানুষ। দু’জনকে মানিয়েছেও বেশ। তা দিদি, ওরা বাচ্চা নিচ্ছে না কেন”?

সীমন্তিনী বলল, “নেবেনা কেন, নিশ্চয়ই নেবে। সময় তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ওদের বয়স কম আছে। একটু দেরী হলে ক্ষতি কিসের? আসলে দাদাভাই আর রচু তো এতদিন বাড়িতেই থাকত। দাদাভাই তখন একটা কলেজে টিচারি করত। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একটা যোগা সেন্টার খুলবার। সে উদ্দেশ্য নিয়েই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাত্র আড়াই মাস আগে কলকাতা গেছে। রচুকেও সাথে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে বাড়ির সবাই। আর ওখানে গিয়েই এক ঠগের পাল্লায় পড়ে দু’লাখ টাকা খুইয়ে বসেছে। তাই এখন অন্য একটা যোগা সেন্টারে কাজ করছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ভাল একটা জায়গায় একটা কমপ্লেক্স ভাড়া নিতে পারলেই হয়ত সেন্টার খুলে বসবে। আর সেন্টার না খোলা পর্যন্ত রচু মা হচ্ছে না। ওরা এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে”।

নবনীতা বলল, “ও, তাহলে তো ঠিকই আছে। তবে বৌদি কিন্তু সত্যিই যেমন রূপে তেমন গুনে। লক্ষ্মীদি একেবারে ঠিক বলেছে”।

সীমন্তিনী বলল, “যেদিন রচুকে আমি প্রথম দেখেছিলাম, সেদিনই দাদাভাইয়ের জন্য ওকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। বাড়ি থেকে জেঠু কাকুদের ওদের ওখানে পাঠালাম। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। তারপর আমি ওর সাথে, ওর বাড়ির সকলের সাথে ভাব করি। তারপর আমার দাদাভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে দিতে পেরেছিলাম। রচু সত্যিই খুব ভাল। এখন তো দাদাভাই আর রচুই আমার সব। আমি ওদের জন্য আমার প্রাণটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারি। ওহ, লক্ষ্মীদি, তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। তোমার বৌদিমণি তো তোমার জন্য একটা শাড়ি পাঠিয়েছে গো। রাতে বের করে দেব তোমায়। আমাকেও খুব সুন্দর একটা শাড়ি দিয়েছে এবার। পরে দেখাব, তোমাকে”।

নবনীতা আবার কিছু একটা বলতে যেতেই সীমন্তিনী বলে উঠল, “দাঁড়াও নীতা। আগে একটা জরুরী ফোন সেরে নিই। এ’ ক’টা দিন কলকাতা থেকে একবারও খবর নিতে পারিনি” বলে হাতের মোবাইল থেকে ডক্টর সোমকে ফোন করল। ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই বলল, “গুড ইভিনিং ডক্টর সোম। আমি সীমন্তিনী বলছি”।

ডক্টর সোম জবাব দিলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম। ভেরি গুড ইভিনিং। সেদিন শুনলাম আপনি নাকি কলকাতা গিয়েছেন। কেমন আছেন বলুন”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ ডক্টর, আমি ভালই আছি। আজই ফিরেছি কলকাতা থেকে। ভাবলাম আপনার কাছ থেকে আগে অর্চনার খবরটা নিই। সে চেকআপের দিন এসেছিল তো? এখন তার কণ্ডিশন কেমন দেখলেন”?

ডক্টর সোম বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম এসেছিল। আর খুব ভাল রিপোর্ট। শারিরীক সমস্যাগুলো প্রায় কেটেই গেছে। তবে মনের ওপর চাপটা একটু আছেই। আর ও’টুকু তো এত তাড়াতাড়ি সারবেও না ম্যাডাম। বোঝেনই তো কতগুলো বছর মেয়েটাকে শারিরীক আর মানসিক ভাবে নির্যাতিতা হতে হয়েছে। সব কথা ভুলতে একটু সময় তো লাগবেই। তবে আমার প্রেসক্রিপশান মেনে ঠিকঠাক ওষুধগুলো খেয়েছে বলে শারিরীক ভাবে সে এখন প্রায় পুরোপুরিই সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন মা, বাবা, ভাইদের সাথে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে মনের বোঝাগুলোও হাল্কা হতে শুরু করবে। আর আমার মনে হয় আপনি যখন তার সাথে আছেন, তাহলে আর কোন সমস্যা হবে না। তবে এবারেও আমি দুটো মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছি। সে ওষুধ দুটো দু’মাস কন্টিনিউ করতে হবে। আশা করি আর কোনও প্রব্লেম হবে না”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “ডক্টর, আমি আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে একটু পরামর্শ করতে চাইছিলুম। আপনি কি খুব ব্যস্ত আছেন”?

ডক্টর সোম জবাব দিলেন, “না খুব একটা ব্যস্ত নই আমি এখন। বলুন কি বলতে চান”?

সীমন্তিনী বলল, “ডক্টর আসলে আমি ভাবছিলুম যে অর্চনাকে কিছু দিনের জন্য আমার এখানে নিয়ে আসব। কিন্তু ও আপনার ট্রিটমেন্টে আছে। আপনার অনুমতি ছাড়া ওকে নিয়ে আসাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তাই আপনার মতামতটা জানতে চাইছিলুম”।

ডক্টর সোম বেশ উৎফুল্ল ভাবে বলে উঠলেন, “ম্যাডাম, আমি তো ভেবেছিলাম যে এর পরের বার আপনার সাথে দেখা হলে আমিই আপনাকে এমন একটা পরামর্শ দেব। আসলে অর্চনা শারীরিক ভাবে ইতিমধ্যেই প্রায় নাইনটি পার্সেন্ট রিকভারড হয়ে গেছে। এখন ওর মানসিক স্থিতিটা নর্মাল হলেই ও পুরোপুরি ভাবে সেরে উঠবে। আর এমন সময়ে ওর প্রাণের খুব কাছের একজনের সাথে ও যদি কিছুটা দিন হেসে খেলে কাটাতে পারে তাহলে ও আরও তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে”।

সীমন্তিনী মনে মনে খুব খুশী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে, আপনার এতে আপত্তি নেই তো? আমি আমার এখানে ওকে নিয়ে আসতে পারি? কিন্তু ওর চেকআপের বা অন্য রকম কোন অসুবিধে হবেনা তো”?
 

ডক্টর সোম সহজ গলাতেই জবাব দিলেন, “ওর পরের চেকআপ করব প্রায় দু’মাস বাদে। ওই দুটো মাস মেডিসিন গুলোকে সময় মত খেলেই হবে। কোনও আনটুয়ার্ডস কিছু হবে না বলেই আশা করছি আমি। আর ইন কেস কোনও রকম কমপ্লিসিটি যদি সত্যিই দেখা দেয়, তাহলে এনি টাইম এনি ডে, আপনি আমায় কন্টাক্ট করবেন। তাতে তো কোনও প্রব্লেম নেই ম্যাডাম”।
 

সীমন্তিনী খুব খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা ডক্টর, আজ তাহলে আপনাকে আর বিরক্ত করছি না। প্রয়োজন হলে যে কোন ব্যাপারে আমাকে ফোন করবেন। রাখছি তাহলে এখন? গুড নাইট”।

সীমন্তিনী ফোন কেটে দিতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “অর্চনা কে গো দিদি? তোমার বোন”?

লক্ষ্মী খালি কাপগুলো ট্রেতে উঠিয়ে নিতে নিতে বলল, “বোন বলছ কি গো ছোড়দি। সে তো আমাদের বৌদিমণির দিদি গো। এক মায়ের পেটের দু’বোন তারা। ভারী বিপদে পড়েছিল মেয়েটা। দিদিমণি তো কত দৌড়ঝাঁপ করে মেয়েটার চিকিৎসা করিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলল”।
 

নবনীতা অবাক হয়ে বলল, “বৌদির দিদি? তার এমন কী হয়েছিল গো দিদি”?

সীমন্তিনী বলল, “আমার কাছে যখন এসেই পড়েছ, ধীরে ধীরে সবটাই জানতে পারবে নীতা। তবে দাঁড়াও একটু। আমি আরেকটা ফোন করে নিই আগে” বলে কিংশুককে ফোন করল। কিংশুক ফোন ধরেই বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই বল। তোমরা ঠিকমত এসে পৌঁছেছ তো? রাস্তায় কোন অসুবিধে কিছু হয়নি তো”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ ভাই, আমরা ঠিকমতই এসে পৌঁছেছি। কোনও অসুবিধে হয়নি। তা তোমরা সবাই কেমন আছ বল তো? কলকাতায় ক’টা দিন এমন ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাকে একেবারেই ফোন করার সময় করে উঠতে পারিনি। মাসি, মেসো, দিদি সবাই ভাল আছে তো”?

কিংশুক বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সবাই ভাল আছে। দিদির চেকআপও হয়ে গেছে। ডক্টর বলেছেন অন্য কোনও কমপ্লিকেশন দেখা না দিলে দু’মাসের ভেতর আর কোন চেকআপের দরকার নেই। তবে দুটো ওষুধ আরও দু’মাস ধরে খেতে বলে দিয়েছেন। এই নাও, মা তোমার সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন”।

বিভাদেবীর গলা শোনা গেল প্রায় সাথে সাথে, “মন্তি মা। তোরা ঠিক মত বাড়ি পৌঁছেছিস তো মা? আমি যে বড্ড চিন্তায় ছিলুম রে”?

ভালোবাসা মাখা কথা গুলো শুনে সীমন্তিনীর চোখের কোলে হঠাতই জল চলে এল যেন। নিজেকে সামলে সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “হ্যাঁ মাসি। আমরা ভালভাবেই বাড়ি পৌছে গেছি গো। ভাল আছি। তোমরা সবাই ভাল আছ তো”?

বিভাদেবী জবাব দিলেন, “হ্যাঁরে মা, আমরাও সবাই ভাল আছি। তোর মেসোর দোকানেও বিক্রীবাট্টা ভালই হচ্ছে। তিনিও এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল আছেন। এমন একটা দিন যায়না, যেদিন তিনি তোর কথা না বলে থাকেন। সত্যি রে মা। নিজের পেটের মেয়েও বুঝি আমাদের জন্য এতসব করত না”।

সীমন্তিনী বলল, “মাসি আবার তুমি সে’সব কথা বলছ? এখনও আমাকে নিজের মেয়েদের সমান ভাবতে পারছনা তুমি, তাই না”?
 

বিভাদেবী বললেন, “রাগ করিস নে মা। আগের জন্মে আমিই বোধহয় তোর মেয়ে ছিলুম রে। তাই মা যেভাবে তার সন্তানদের সুখ দুঃখের কথা ভাবে সব সময়। তুইও ঠিক তেমনি করেই আমাদের সকলের কথা ভাবিস। আচ্ছা শোন মা। রচু কাল রাতেই ফোন করে জানিয়েছিল তোরা আজ পৌঁছবি। তোর ফোন পেয়ে এখন মনটা শান্ত হল। তা বাড়ি কবে আসছিস”?

সীমন্তিনী বলল, “মাসি, আমি তো সবে আজই এলাম। কাল অফিসে জয়েন করব। তারপর অফিসের কাজকর্ম একটু বুঝে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। কিন্তু মাসি আমার একটা আবদার আছে তোমার কাছে”।

বিভাদেবী বললেন, “ওমা। মেয়ের কথা শোন। বল না কি বলবি”?

সীমন্তিনী বলল, “আমি দিন সাতেকের মধ্যেই একবার চেষ্টা করব যাবার। কিন্তু মাসি, এবার আমি অর্চুদিকে কয়েকটা দিনের জন্য আমার কাছে নিয়ে আসতে চাই। তোমরা আপত্তি করবে না তো”?

বিভাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “ওমা আপত্তি কিসের? অর্চু তোর ওখানে যাবে, এতে কে আপত্তি করবে। আর অর্চুও এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর শোন, তুই আবার ওকে অর্চুদি বলছিস যে বড়”?

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে মাসি, তার খবর আমি জানি। একটু আগেই ডক্টর সোমের সাথে কথা বলেছি আমি। তার কাছ থেকে ওর কথা সব শুনেছি। তা সে কোথায় গো? একটু কথা বলতে পারি তার সাথে”?

বিভাদেবী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ রে মা। অর্চুও তো তোর সাথে কথা বলতে চাইছে। এই নে”।

একটু বাদেই ফোনে অর্চনার গলা শোনা গেল, “হ্যাঁ দিদিভাই বল। রচু তোমাকে যে শাড়িটা দিয়েছে সেটা পড়লে তোমাকে নাকি মা দুর্গার মত লাগে দেখতে। শাড়িটা সত্যি এত সুন্দর”?
 

সীমন্তিনী অর্চনার গলার এমন স্বাভাবিক সুর শুনে মনে মনে খুব খুশী হয়ে বলল, “ওই পাগলীটার কথা আর বোলো না অর্চু। সে শাড়ি কিনতে গিয়ে তো ছিনতাইবাজের খপ্পরে পড়ে শাড়িটা খুইয়েই বসেছিল। ভাগ্যিস তখন একজন পুলিশ সাদা পোশাকে ওর পেছন পেছন যাচ্ছিল”।

অর্চনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, রচু আমাকে বলেছে সে’সব কথা। আর সে পুলিশ অফিসার নাকি তোমারই খুব ভাল বন্ধু? রচু তো সে’কথা বলতে বলতে আনন্দে লাফাচ্ছিল”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা অর্চু শোনো। মাসিকে আমি বলেছি। আমি দিন সাতেকের মধ্যে একবার কালচিনি যাব। আর ফেরার সময় আমি তোমাকে সাথে করে আমার এখানে নিয়ে আসতে চাই কয়েক দিনের জন্য। তোমার আপত্তি নেই তো ভাই”?

অর্চনা বলল, “তুমি আমাকে তোমার ওখানে নিয়ে যাবে, আর আমি তাতে আপত্তি করব। এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে দিদিভাই? আমার এ জীবনটা যে তোমারই দান গো। তোমার কোন নির্দেশ না মেনে আমি থাকতে পারি? তুমি যা বলবে তাই হবে। আর মনে হয় না মা-বাবাও এতে কোনও রকম আপত্তি করবেন”।

সীমন্তিনী বলল, “বেশ তাহলে ওই কথাই রইল। আর শোনো, ডক্টরের সাথে আমি একটু আগেই কথা বলেছি। উনিও বললেন আর ভয়ের কিছু নেই। তবে যে অসুধ দুটো খেতে বলেছে সেটা নিয়ম করে খেয়ে যাবে। আর কক্ষনও একা একা থাকবে না। সব সময় মাসি, মেসো বা ভাইয়ের সাথে থাকবে। পুরোনো কথাগুলো একেবারেই ভাববে না। আর হ্যাঁ, থানা থেকে মিঃ রায় কি আর কিছু বলেছেন”?

অর্চনা বলল, “না দিদিভাই। থানা থেকে কেউ আর কিছু বলেনি। তবে তুমি কলকাতা যাবার আগেই তো এখানকার ওসি বলেছেন যে কেসটা কোর্টে উঠে গেছে। আমাদের হয়ত সামনের মাসে গিয়ে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “বেশ, সময় মত মিঃ রায়ই সেটা জানিয়ে দেবেন। কিন্তু জানো অর্চু, আমি কলকাতা যাবার আগে ভেবেছিলাম তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব। রচুর ওখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলে তোমারও ভাল লাগত। কিন্তু ডক্টর সোমের ওখানে তোমার চেকআপটা করা বেশী দরকারি ছিল বলেই সেটা আর করিনি। সেজন্যে তুমি আমার ওপর রাগ কোর না ভাই। তা আমার এখানে আসছ তো? না ভয় পাচ্ছ”?
 

অর্চনা বলল, “তোমার কথায় আমি মরতেও দ্বিধা করব না দিদিভাই”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “ছিঃ, অমন কথা মুখেও এনো না অর্চু। আচ্ছা শোনো। আমি এখন রাখছি। মেসো এখন নিশ্চয়ই দোকানে আছেন। তাকে আমার প্রণাম জানিও। সামনের সপ্তাহে আসছি আমি। তুমি আমার সঙ্গে চলে আসবার জন্য তৈরী থেকো, কেমন”?

অর্চনা বলল, “ঠিক আছে দিদিভাই। তুমিও ভাল থেক” বলে একটু থেমেই আবার বলল, “ওঃ দিদিভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি গো। রচু বলছিল তুমি নাকি কলকাতা থেকে কাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে এসেছ। সে কি তোমার সাথে এসেছে”?

সীমন্তিনী নবনীতার দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ অর্চু। ওর নাম নবনীতা। আমার আরেকটা বোন বলে ধরে নিতে পার। তুমি এলে তার সাথে তোমার পরিচয় হবে। ঠিক আছে? ছাড়ছি তাহলে, কেমন? সবাই ভাল থেকো তোমরা” বলে ফোন কেটে দিয়ে একটা বড় করে শ্বাস নিল।

সীমন্তিনীর ফোনে কথা বলা শুনতে শুনতে নবনীতা চুপ করে ছিল। এবার সে বলল, “অর্চনাদি কি সত্যি আমাদের বৌদির দিদিই”?
 

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ নীতা। রচু ওরা দু’বোন এক ভাই। রচুর মাকে আমি মাসি বলে ডাকি। কিন্তু মায়ের মতই শ্রদ্ধা করি। ওদের তিনজনের সাথেই কথা বললাম। কয়েকদিন কলকাতায় এত ব্যস্ততার মধ্যে ওদের খবর নিতে পারিনি। রচুর দিদি অর্চনার খুব বড় একটা দুর্ঘটণা ঘটেছিল। এখনও চিকিৎসা চলছে। তবে আজ যা শুনলাম তাতে মনে হয় প্রায় সেরে উঠেছে”।

নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছিল বৌদির দিদির? বল না আমাকে”।

সীমন্তিনী অর্চনার ব্যাপারে সংক্ষেপে সব কিছু শুনিয়ে বলল, “মেয়েটা যে কী সুন্দর দেখতে তা তোমায় কি বলব নীতা। রচুর থেকেও সুন্দরী। কিন্তু ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে মেসো ওর বিয়েটা দিয়েই খুব বড় ভুল করে ফেলেছিলেন। তুমি ভাবতে পার নবনীতা? পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘর করেও সে এখনও কূমারী। সুতরাং বুঝতেই পাচ্ছ স্বামী সোহাগ বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই সে পায় নি। ওর বর নাকি বিয়ের পরদিন থেকেই রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি এসে ওকে শুধু মারধোর করত। স্বামী মারা যাবার পরেও প্রায় দুটো বছর সে শ্বশুর বাড়িতেই ছিল। তার শ্বশুর শাশুড়ি সৎ ছেলেরা তার ওপর অকথ্য অত্যাচার করত। ওর স্বামীর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর পেনশনের টাকা গুলো হাতে পাবার পরেই ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরাই ওকে মেরে ধরে আধমরা করে রাতের অন্ধকারে ওকে রেল লাইনের ওপর ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। লোকাল থানার পুলিশকে আমি আগে থেকেই আমার সন্দেহের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম বলে ওর ওপর তারা আগে থেকেই নজর রেখে যাচ্ছিল। তারা সময়মত খবর পেয়েই তাকে রেল লাইন থেকে তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও ওর অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল। মাস দেড়েক চিকিৎসা চলবার পর এখন নাকি বেশ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। ভাবছি আগামী সপ্তাহে গিয়ে ক’দিনের জন্য ওকে এখানে নিয়ে আসব। ওর মনের ওপর থেকে পুরনো বোঝা গুলো এখনও পুরোপুরি সরে যায়নি। কয়েকটা দিন আমাদের সাথে কাটালে হয়ত আরও একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর আমি অফিসে চলে গেলেও তুমি ওকে কম্পানি দিতে পারবে। তোমারও ভাল লাগবে”।

নবনীতা সব শুনে বলল, “সত্যি দিদি। বিনা দোষে কত মেয়েকে যে কত দুর্ভোগই না সইতে হয়। ওই সাতটা বছর বৌদির দিদি তো অমানুষিক কষ্ট পেয়েছে। আর তার সাথে বৌদির মা বাবাও তাদের মেয়েকে চোখের দেখা দেখতে না পেয়ে কতই না কষ্টে ছিলেন”।

সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে বলল, “ভগবান যার ভাগ্যে যা লিখে দিয়েছেন তাকে তো সেটা ভোগ করতে হবেই হবে। নইলে তোমারই বা কি দোষ ছিল বল তো? কোন অপরাধে তোমাকে এতগুলো বছর অমন নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে”।

নবনীতা ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার কথা আর তুলো না দিদি। থাক। ও’সব কথা যত ভাবব, ততই তো কষ্ট হবে”।

সীমন্তিনী নবনীতার বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল, “আচ্ছা ছাড়ো এসব কথা। চল, আজ আর বাইরে কোথাও যাব না। এমনই ঘরের পেছনের বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি”।

পেছনের বাগানে আসতেই সীমন্তিনীর হাতের মোবাইল বেজে উঠল। পরিতোষের ফোন। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে দু’জনেই পরিতোষের সাথে কথা বলল। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘণিয়ে আসতেই তারা ঘরে ফিরে গেল।


****************
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 11-03-2020, 10:12 PM



Users browsing this thread: 11 Guest(s)