11-03-2020, 10:11 PM
(Update No. 128)
সীমন্তিনীও মিষ্টি হেসে বলল, “আমায় ভুল বুঝোনা পরিতোষ। ওদের ঘরে যে টিভি ফ্রিজ নেই সেটা আমি নিজেও জানতুম না। খবরটা আমার আগেই নেওয়া উচিৎ ছিল। এবার এসেই সেটা জানতে পেরেছি। তাই তোমাকে আগে বলতে পারিনি”।
পরিতোষ বলল, “ওকে, নো প্রোব্লেম। সেটা এবার আমি দেখছি। তাহলে আর তো কিছু আলোচনা করবার নেই তাই না? চলো, তাহলে বেরিয়ে পড়ি। এখন না বেরোলে সাড়ে এগারোটার আগে তোমাদের পৌছে দিতে পারব না”।
বিট্টু আর বিট্টুর মা-র সাথে দেখা করে সবাই বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে যেতে যেতে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি, তুমি সত্যি যে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যেতে চাইছ, এতে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমি তো ওখানে একা থাকি। তুমি থাকলে তো তবু আমি একটা সঙ্গী পাব। আর দেখো, তোমারও ভাল লাগবে। তুমিও একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। তবু বলছি তোমার যদি কখনও এমন মনে হয় যে তুমি আমার ওখানে ভাল থাকছ না, তাহলে আমি তোমাকে কথা দিলাম, তোমাকে আবার কলকাতায় পৌছে দেব আমি। তবে আমরা ওখানে গিয়ে দু’জনে মিলে ভাল করে পরামর্শ করে দেখব এ ব্যাপারে। আপাততঃ তুমি শুধু আমার সাথে যাচ্ছ, আমরা দু’জন মিলে পরিতোষের জন্য একটা ভাল মেয়ে খুঁজব, এটাই ফাইনাল হয়ে রইল”।
নবনীতা মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল, “কিন্তু দিদি, আমার বান্ধবীকে আর ম্যাডামকে বলে যাওয়া উচিৎ ছিল না? ব্যাপারটা কেমন হচ্ছে না? তাছাড়া আমার কাপড়চোপড় গুলোও তো নিতে হবে। ওগুলো ছেড়ে গেলে তো আমারই অসুবিধে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমার জামা কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপাততঃ আমরা কলকাতা থেকে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার বান্ধবীর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছ না। তোমার ম্যাডামের সাথে তো একেবারেই নয়। ওখানে চলে যাবার পর ভেবে দেখব তোমার বান্ধবীকে জানানো উচিৎ হবে কি না। আপাততঃ তুমি ধরে নাও তোমাকে আমরা কিডন্যাপ করছি। আর তুমি সেভাবেই থাক”।
রচনাদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এসে পরিতোষ বলল, “আমি তোমাদের বাড়ির সামনে ড্রপ করে দিয়েই চলে যাচ্ছি মন্তি”।
সীমন্তিনী সে কথার জবাবে কিছু না বললেও রচনা বলে উঠল, “এ মা, এ কী বলছেন আপনি পরিতোষদা? আপনি আমাদের ঘরে না ঢুকে কিছুতেই যেতে পারবেন না”।
এবার পরিতোষ কিছু বলার আগেই সীমন্তিনী বলল, “নারে রচু, এখন পরিতোষকে আটকে রাখা একেবারে ঠিক হবে না। ওকে অনেকগুলো কাজ করতে দিয়েছি আমি। সে কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি ও সেরে ফেলতে পারবে ততই ভাল”।
এবার পরিতোষ বলল, “হ্যা বৌদি। আজ তোমার সাথে পরিচয় যখন হয়েই গেল তখন তোমার বাড়িতেও আমি অবশ্যই যাব। কিন্তু তোমার দিদিভাইয়ের দেওয়া কাজগুলো সমাধা করাই এখন জরুরী বেশী”।
বাড়ির সামনে তিনকন্যাকে নামিয়ে দিয়েই পরিতোষ গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। রচনা সীমন্তিনী আর নবনীতাকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে ঢুকল। রতীশ তখনও বাড়ি এসে পৌঁছয় নি। রচনা সীমন্তিনীকে নবনীতার কাছে রেখে নিজে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। খানিক বাদে রতীশও বাড়ি এসে হাজির। রতীশের সাথে সীমন্তিনী নবনীতার পরিচয় করিয়ে দিতেই নবনীতা রতীশের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর তিনজনে নানা ধরণের গল্প করতে করতেই পরিতোষের ফোন এল সীমন্তিনীর নাম্বারে। সে জানাল, নবনীতার ট্রেণের টিকিট কাটা আর মোবাইল কেনা হয়ে গেছে। আর তার টেম্পোরারি শেল্টারও ঠিক হয়ে গেছে। তবে সেখানে সন্ধ্যের পর পরিতোষ নিজে নবনীতাকে পৌঁছে দেবে। আরও জানাল রতীশের ফ্ল্যাটের জন্য টিভি আর ফ্রিজ কিছুক্ষণ বাদেই কেনা হয়ে যাবে। আজ রাতেই হয়ত হোম ডেলিভারি দিয়ে দেবে।
সীমন্তিনী সব কথা শুনে রতীশ আর নবনীতার কাছ থেকে সরে গিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বলল, “পরিতোষ শোনো না। নবনীতার জন্য কিছু পোশাক তো এখনই কেনা উচিৎ। তাই বলছিলাম কি তোমার কাছে দাদাভাইয়ের যে ফাণ্ডটা আছে, সেখান থেকেই আমাকে আপাততঃ কুড়ি পঁচিশ হাজার দিতে পারবে? তাহলে আজই মার্কেটে গিয়ে ওর জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনে আনতাম”।
পরিতোষ একটু সময় নিয়ে বলল, “ওকে তাহলে এক কাজ কর ডার্লিং। আমি বিকেল পাঁচটা নাগাদ তোমার কাছে ফাণ্ড পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তোমরা কোন মার্কেটে যেতে চাইছ বলো তো”?
সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই বুঝি বিকেলে গরিয়াহাট যাবেন। ভাবছি আমরাও তখন তার সাথেই যাব”।
পরিতোষ আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে শোন ডার্লিং। টিভি আর ফ্রিজটা আমি কাল সকালের দিকে ডেলিভারি দিতে বলি। আমি বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার ভেতর সকালে যে জায়গায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সেখানে পৌঁছে যাব। তোমরা সাড়ে পাঁচটার ভেতরেই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এস। আমি তোমাদের গড়িয়াহাটে পৌঁছে দেব। আবার তোমাদের মার্কেটিং শেষ হলে তোমাদের পৌঁছেও দিতে পারব”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমার ওপর তো বড্ড চাপ পড়ে যাবে পরিতোষ। আমার হাতে অত ফাণ্ড থাকলে তোমাকে আর কষ্ট দিতাম না। এমনিতেই তোমার ওপর অনেক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি”।
পরিতোষ সীমন্তিনীকে আশ্বস্ত করে বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল। ডাল, ভাজা আর ইলিশ ভাঁপা দিয়ে রচনার হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে সকলেই খুব পরিতৃপ্ত হল। রচনার অমায়িক ব্যবহারে নবনীতা অভিভূত হয়ে পড়ল। খেতে খেতেই গড়িয়াহাট যাবার প্ল্যান করা হল।
***************
বিকেল সাড়ে পাঁচটার কিছু আগেই রতীশ, রচনা, সীমন্তিনী আর নবনীতা বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই পরিতোষ গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। গাড়িতে উঠেই সীমন্তিনী পরিতোষের সাথে রতীশের পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর বলল, “দাদাভাই, রচু, তোদের জন্যে একটা সুখবর আছে”।
রতীশ আর রচনা দু’জনেই উন্মুখ হয়ে তার দিকে চাইতেই সীমন্তিনী বলল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ আর তার দুই সাকরেদ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আর তার চেয়েও বড় সুখবর হচ্ছে টাকাটা ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করা গেছে। তাও সুদ এবং জরিমানা সমেত”।
রতীশ আর রচনা দু’জনেই খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠল। সীমন্তিনী বলল, “এর পেছনে পরিতোষের একটা বড় ভূমিকা আছে। তবে টাকাটা পুলিশ হাতে হাতে দেবে না। তোদের ব্যাঙ্ক একাউন্টেই টাকাটা এসে জমা হবে। শুনেছি জরিমানা আর সুদ সমেত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নাকি পুলিশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু দাদাভাই তোর তো এখানে ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই। তাই আমি ভাবছি কাল রচুর নামে এখানে কোন একটা ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলে দেব, তাহলে টাকাটা এ একাউন্টে এসে জমা হবে। তবে দাদাভাই পরিতোষের কাছ থেকে আমি তিয়াত্তর হাজার টাকা ধার নিয়ে তোদের ফ্ল্যাটের জন্য ফ্রিজ আর টিভি আনছি। আগামীকালই এসে যাবে ওগুলো। আর নীতার জন্যে কিছু জামা কাপড় কিনছি। পুলিশ যে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে, তার থেকেই পরিতোষকে ওই তিয়াত্তর হাজার ঘুরিয়ে দেব। বাকি চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকাই আমি এখন রচুর একাউন্টে জমা করে দিয়ে যাব। এবার তুই নিশ্চিন্তে তোর মনের মত করে নিজের একটা যোগা সেন্টার খুলতে পারবি”।
রতীশ বলল, “কিন্তু আমার তো কালও ইনস্টিটিউটে যেতে হবে। তাহলে ব্যাঙ্কে যাব কি করে”?
সীমন্তিনী বলল, “সেজন্যেই তো বলছি একাউন্টটা রচুর নামে খুলে দেব। টাকাটা ওখানে এসে জমা হোক। তারপর যখন তোদের প্রয়োজন হবে তখন রচুই ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলতে পারবে। আর এটিএম কার্ডটা পেয়ে গেলে তো আর টাকা ওঠাতেও ব্যাঙ্কে যেতে হবে না। এটিএম থেকেই টাকা তুলতে পারবি। তাই তুই সঙ্গে না থাকলেও আমি রচুকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলতে পারব বলে মনে হয়”।
*********************
সেদিন বিকেলে গরিয়াহাট থেকে নবনীতার জন্য কিছু পোশাক আর রচনা আর সীমন্তিনীর ব্লাউজ গুলো ডেলিভারি নেওয়া হল। পরিতোষ নবনীতাকে তার নতুন মোবাইল দিল। তারপর রাত আটটা নাগাদ পরিতোষ রতীশ ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে নবনীতাকে নিয়ে চলে গেল। রচনা আর রতীশের অনেক অনুরোধ সত্বেও পরিতোষ তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকল না। তবে কথা দিয়ে গেল খুব শিগগীরই সে রতীশের ফ্ল্যাটে আসবে।
ঘরে ঢুকে সকলে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেবার পর রচনা সকলের জন্যে চা করে আনল। ড্রয়িং রুমে বসে চা খাবার পর রচনা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই তুমি আগে ব্লাউজ গুলো দেখ তো? ঠিকঠাক বানিয়েছে কি না” বলে রতীশকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি একটু সময় এ’ঘরেই থেক সোনা। আমি দিদিভাইকে নিয়ে একটু বেডরুমে যাচ্ছি”।
বেডরুমে এসে ব্লাউজ গুলো দেখতে দেখতে রচনা আলমারি থেকে নতুন কেনা শাড়িটা বের করে সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই এ শাড়িটার সাথে ওই ম্যাচিং ব্লাউজটা একটু পড় না তুমি”।
সীমন্তিনী শাড়িটা দেখে বলল, “ওমা, এটা তো তোর কেনা সেই শাড়িটা তাই না? কিন্তু এটা আমাকে পড়তে বলছিস কেন তুই? তুই পড়”।
রচনা সীমন্তিনীর দুটো হাত ধরে বলল, “রাগ কোরনা দিদিভাই। তোমার কাছে একটা কথা আমি গোপন করে গিয়েছিলাম। এ শাড়িটা আসলে তোমার জন্যেই কিনেছিলুম আমি। তোমাকে দেব বলে। তোমার দাদাভাইয়ের কাছ থেকে তুমি তো কখনও কিছু নাও নি। আমারও খুব সখ ছিল তোমাকে কিছু একটা দেবার। কিন্তু সে সুযোগ তো কখনও পাইনি। তাই আমি আর তোমার দাদাভাই যেদিন শুনলাম তুমি আসছ, সেদিনই মার্কেটে গিয়ে তোমার জন্যে এটা কিনেছিলাম। তুমি শুনে রাগ করবে বলেই আগে তোমাকে বলিনি। তাই এটার ব্লাউজটাও তোমার মাপেই বানিয়ে এনেছি। প্লীজ দিদিভাই, রাগ কোর না তুমি। তোমার রচু সোনার এ অনুরোধটুকু তুমি রাখো প্লীজ। তোমার দাদাভাইয়ের দেওয়া প্রথম উপহারটুকু তোমার হাতে তুলে দেবার সুযোগ আমাকে দাও”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর নতুন শাড়ি আর ব্লাউজটা তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। রচনা খুশী হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে রতীশের সাথে বসল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনী নতুন শাড়ি ব্লাউজ পড়ে সামনের ঘরের দরজার সামনে এসে রচনার নাম ধরে ডাকতেই রচনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই এস”।
সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে রচনা একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল। সীমন্তিনীকে বিনা প্রসাধনেও ওই শাড়ি ব্লাউজে অসাধারণ সুন্দরী লাগছিল। রচনা সীমন্তিনীকে ধরে ঠাকুরঘরে নিয়ে গেল। সীমন্তিনী ঠাকুরকে প্রণাম করে আবার রচনার হাত ধরে ড্রয়িং রুমে এসে রতীশকে প্রণাম করল। রতীশও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সীমন্তিনীকে দেখতে দেখতে বলল, “বাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে মন্তি। রচু ঠিকই বলেছিল। এ শাড়িটাতেই তোকে খুব সুন্দর মানিয়েছে”।
সীমন্তিনীর চোখ দুটোতে জল টলমল করছিল। রচনা সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের উচ্ছ্বাস চাপতে চাপতে খুশী মাখা গলায় বলল, “সত্যি দিদিভাই, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে”।
সীমন্তিনী নিজের উদ্গত কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আজকের এ দিনটা আমি কখনও ভুলব না রে রচু। তোর আর দাদাভাইয়ের এ উপহার আমি খুব যত্ন করে রাখব”।
পরের কয়েকটা দিন রচনার যেন স্বপ্নের মত কাটল। পরের দিন সীমন্তিনী রচনাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যাবার আগেই ঘরে টিভি আর ফ্রিজ এসে গেল। পরিতোষই এসে তাদের ব্যাঙ্কে নিয়ে গেল। ব্যাঙ্কে কাগজ জমা দেবার পর পরিতোষের অনুরোধে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার নিজে উদ্যোগ নিয়ে আধঘন্টার ভেতরে রচনার নামে একাউন্ট খুলে দিল। পাসবুক আর চেকবুক নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে এল। পরের দিন পরিতোষ তার জিমের লকার থেকে টাকা এনে রচনার সেই একাউন্টে চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকা জমা করে দিয়েছিল। সীমন্তিনীকে এতদিন বাদে কাছে পেয়ে রচনার আর খুশীর সীমা ছিল না। নবনীতা চারটে রাত আব্দুলের বাড়িতে পরিতোষের প্রীতিদির হেফাজতে ছিল। পনেরই আগস্ট পরিতোষের গাড়ি চড়েই রচনা আর রতীশ সীমন্তিনী আর নবনীতাকে ট্রেনে তুলে দিল।
*****************
দুপুর প্রায় এগারোটা নাগাদ সীমন্তিনী নবনীতাকে নিয়ে নিজের কোয়ার্টের এসে পৌঁছল। পাহাড়ের ওপর চারধারে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বাড়িটা দেখে নবনীতার খুব ভাল লাগল। কিন্তু কোনকিছুই যেন সে মন দিয়ে উপভোগ করতে পারছিল না। যে মহিলা তার কাছে পুরোপরি অচেনা ছিল, প্রথম দেখাতেই সে মহিলা তাকে নিজের সাথে রাখবে বলে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, এটা ভাবতেও যেন তার কেমন লাগছিল। তবে প্রথমদিন কয়েকটা ঘন্টা রচনা আর সীমন্তিনীর সাথে কাটিয়ে আর ট্রেনে দীর্ঘ সময় সীমন্তিনীর সাথে নানারকম কথাবার্তা বলে বুঝেছে সীমন্তিনী সত্যিই খুব ভাল মনের মানুষ। এখানে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তার মনের দ্বন্দ অনেকটা কমে গেলেও, সে যেন পুরোপুরি সহজ হতে পারছিল না।
সীমন্তিনী ঘরে ঢুকেই প্রথমে লক্ষ্মীদির সাথে নবনীতার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “নীতা আজ থেকে এখানেই আমাদের সাথে থাকবে। তুমি ওকে ছোড়দি বলে ডেকো লক্ষ্মীদি”।
লক্ষ্মীকে সীমন্তিনী আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার সাথে আরও একজন আসছে, তাই লক্ষ্মীও তিনজনের খাবার বানিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সীমন্তিনী তারপর রচনাকে আর পরিতোষকে ফোন করে জানিয়ে দিল তারা ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছে গেছে। আর পরে ভাল করে কথা বলবে।
তারপর নবনীতাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বলল, “নীতা, তুমি একেবারেই কোনরকম অস্বস্তি বোধ কোর না। এটা কে নিজের বাড়ি বলেই ভেব। আর আমাকে তোমার দিদি বলেই ভাববে কেমন? আর এখন তো দুপুর হতেই চলল। তুমি কি চা-টা কিছু খাবে? না স্নান সেরে একেবারে দুপুরের খাবার খাবে”?
নবনীতা বলল, “না দিদি, এখন আর চা-টা কিছু খাব না। আগে বরং স্নানটা করে নিলেই ভাল হবে”।
সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে তাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “এখন থেকে এটাই তোমার ঘর। এ ঘরেও এটাচড বাথরুম আছে। খাট বিছানা আলমারি টেবিল চেয়ারও আছে। কিন্তু ড্রেসিং টেবিল নেই। তবে আলমারির ভেতরের পাল্লায় আয়না লাগানো আছে। আপাততঃ সেটাতেই কাজ চালাও। অসুবিধে হলে পরে একটা ড্রেসিং টেবিল যোগার করে দেব”।
নবনীতা বলল, “না না দিদি, আলমারির পাল্লার ভেতর যদি আয়না থেকে থাকে, তাহলে আর আলাদা ড্রেসিং টেবিলের কোনও দরকার পড়বে না। কিন্তু দিদি, আমি তোমার কথায় এভাবে চলে এসে তোমাকেই অসুবিধেয় ফেলে দিলাম কি না বুঝতে পাচ্ছি না”।
সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে খাটে বসে বলল, “নীতা, ও’সব একেবারেই ভাববে না। দেখ অনেক বছর থেকে আমি আমার বাড়ি ঘর আত্মীয় পরিজনদের ছেড়ে দুরে দুরে থাকছি। মাধ্যমিক পাশ করবার পর থেকেই। ধর সে প্রায় বারো বছর। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বাড়ি ভর্তি লোকজন। জেঠু, বড়মা, বাবা, মা, কাকু ছোটমা ছাড়াও আমরা ছ’ ভাই বোন। আমার দাদাভাই, যাকে তুমি কলকাতায় দেখে এসেছ, তিনিই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে বড়। তারপর আমি। দাদাভাই আর আমি মাত্র ছ’মাসের ছোট বড়। একই ক্লাসে পড়তাম আমরা। মাধ্যমিক পাশ করবার পর আমাদের দাদাভাই দেরাদুনে পড়তে গিয়েছিলেন। আর আমি চলে গিয়েছিলাম আমাদের জেলা শহর জলপাইগুড়িতে। তারপর থেকে আমি আর কখনও তেমন পাকাপাকি ভাবে বাড়িতে থাকিনি। ছোট ভাই বোন গুলোর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। কষ্ট হয় খুবই। সারাদিন তো অফিসের কাজে কর্মেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ঘরে ফিরে আসবার পরেই ভীষণ একা লাগে নিজেকে। দাদাভাই আর রচুর সাথে আমি রোজ নিয়ম করে দু’ তিনবার ফোনে কথা বলি। বাড়ির লোকদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না আমার। তাই ঘরে যতক্ষণ থাকি নিজেকে ভীষন একা একা লাগে মাঝে মাঝে। এখন থেকে তুমি আমার সাথে থাকলে আমাকে তো অত লনলি ফীল করতে হবে না। তাই তুমি আমার সাথে থাকলে আমারই তো লাভ। আমি তোমার সদ্য পরিচিত বলে তুমি একেবারে অস্বস্তি বোধ করবে না। তুমি এটাকে একেবারে নিজের বাড়ি নিজের ঘর বলেই ভেব। আমরা দু’বোন মিলে হাসিতে খুশীতে সময় কাটাব” একটু থেমে বলল, “আচ্ছা বলার শোনার তো আরও অনেক কথা আছে। কিন্তু আপাততঃ আর কোনও কথা নয়। তুমি স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও স্নান সেরে নিচ্ছি। আজ তো আর আমি অফিসে যাচ্ছি না। খাবার পর থেকে একসাথে বসে অনেক গল্প করব আমরা”।
আগের রাতে ট্রেনে কারুরই ভাল ঘুম হয়নি। স্নানের পর দুপুরের খাবার খেতে খেতে সীমন্তিনী বলল, “নীতা কাল রাতে তো কেউই ভাল ভাবে ঘুমোতে পারিনি। তুমি কি খেয়েদেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেবে”?
নবনীতা বলল, “এমনিতে দিনের বেলা ঘুমোনোর অভ্যাস আমার নেই দিদি। কিন্তু কাল রাতে সত্যি একেবারে ঘুম হয়নি। ভাবছি একটু ঘুমিয়ে নিই”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ একটু ঘুমিয়েই নাও। আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা গল্প করব”।
****************
______________________________
সীমন্তিনীও মিষ্টি হেসে বলল, “আমায় ভুল বুঝোনা পরিতোষ। ওদের ঘরে যে টিভি ফ্রিজ নেই সেটা আমি নিজেও জানতুম না। খবরটা আমার আগেই নেওয়া উচিৎ ছিল। এবার এসেই সেটা জানতে পেরেছি। তাই তোমাকে আগে বলতে পারিনি”।
পরিতোষ বলল, “ওকে, নো প্রোব্লেম। সেটা এবার আমি দেখছি। তাহলে আর তো কিছু আলোচনা করবার নেই তাই না? চলো, তাহলে বেরিয়ে পড়ি। এখন না বেরোলে সাড়ে এগারোটার আগে তোমাদের পৌছে দিতে পারব না”।
বিট্টু আর বিট্টুর মা-র সাথে দেখা করে সবাই বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে যেতে যেতে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি, তুমি সত্যি যে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যেতে চাইছ, এতে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমি তো ওখানে একা থাকি। তুমি থাকলে তো তবু আমি একটা সঙ্গী পাব। আর দেখো, তোমারও ভাল লাগবে। তুমিও একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। তবু বলছি তোমার যদি কখনও এমন মনে হয় যে তুমি আমার ওখানে ভাল থাকছ না, তাহলে আমি তোমাকে কথা দিলাম, তোমাকে আবার কলকাতায় পৌছে দেব আমি। তবে আমরা ওখানে গিয়ে দু’জনে মিলে ভাল করে পরামর্শ করে দেখব এ ব্যাপারে। আপাততঃ তুমি শুধু আমার সাথে যাচ্ছ, আমরা দু’জন মিলে পরিতোষের জন্য একটা ভাল মেয়ে খুঁজব, এটাই ফাইনাল হয়ে রইল”।
নবনীতা মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল, “কিন্তু দিদি, আমার বান্ধবীকে আর ম্যাডামকে বলে যাওয়া উচিৎ ছিল না? ব্যাপারটা কেমন হচ্ছে না? তাছাড়া আমার কাপড়চোপড় গুলোও তো নিতে হবে। ওগুলো ছেড়ে গেলে তো আমারই অসুবিধে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমার জামা কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপাততঃ আমরা কলকাতা থেকে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার বান্ধবীর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছ না। তোমার ম্যাডামের সাথে তো একেবারেই নয়। ওখানে চলে যাবার পর ভেবে দেখব তোমার বান্ধবীকে জানানো উচিৎ হবে কি না। আপাততঃ তুমি ধরে নাও তোমাকে আমরা কিডন্যাপ করছি। আর তুমি সেভাবেই থাক”।
রচনাদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এসে পরিতোষ বলল, “আমি তোমাদের বাড়ির সামনে ড্রপ করে দিয়েই চলে যাচ্ছি মন্তি”।
সীমন্তিনী সে কথার জবাবে কিছু না বললেও রচনা বলে উঠল, “এ মা, এ কী বলছেন আপনি পরিতোষদা? আপনি আমাদের ঘরে না ঢুকে কিছুতেই যেতে পারবেন না”।
এবার পরিতোষ কিছু বলার আগেই সীমন্তিনী বলল, “নারে রচু, এখন পরিতোষকে আটকে রাখা একেবারে ঠিক হবে না। ওকে অনেকগুলো কাজ করতে দিয়েছি আমি। সে কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি ও সেরে ফেলতে পারবে ততই ভাল”।
এবার পরিতোষ বলল, “হ্যা বৌদি। আজ তোমার সাথে পরিচয় যখন হয়েই গেল তখন তোমার বাড়িতেও আমি অবশ্যই যাব। কিন্তু তোমার দিদিভাইয়ের দেওয়া কাজগুলো সমাধা করাই এখন জরুরী বেশী”।
বাড়ির সামনে তিনকন্যাকে নামিয়ে দিয়েই পরিতোষ গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। রচনা সীমন্তিনী আর নবনীতাকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে ঢুকল। রতীশ তখনও বাড়ি এসে পৌঁছয় নি। রচনা সীমন্তিনীকে নবনীতার কাছে রেখে নিজে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। খানিক বাদে রতীশও বাড়ি এসে হাজির। রতীশের সাথে সীমন্তিনী নবনীতার পরিচয় করিয়ে দিতেই নবনীতা রতীশের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর তিনজনে নানা ধরণের গল্প করতে করতেই পরিতোষের ফোন এল সীমন্তিনীর নাম্বারে। সে জানাল, নবনীতার ট্রেণের টিকিট কাটা আর মোবাইল কেনা হয়ে গেছে। আর তার টেম্পোরারি শেল্টারও ঠিক হয়ে গেছে। তবে সেখানে সন্ধ্যের পর পরিতোষ নিজে নবনীতাকে পৌঁছে দেবে। আরও জানাল রতীশের ফ্ল্যাটের জন্য টিভি আর ফ্রিজ কিছুক্ষণ বাদেই কেনা হয়ে যাবে। আজ রাতেই হয়ত হোম ডেলিভারি দিয়ে দেবে।
সীমন্তিনী সব কথা শুনে রতীশ আর নবনীতার কাছ থেকে সরে গিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বলল, “পরিতোষ শোনো না। নবনীতার জন্য কিছু পোশাক তো এখনই কেনা উচিৎ। তাই বলছিলাম কি তোমার কাছে দাদাভাইয়ের যে ফাণ্ডটা আছে, সেখান থেকেই আমাকে আপাততঃ কুড়ি পঁচিশ হাজার দিতে পারবে? তাহলে আজই মার্কেটে গিয়ে ওর জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনে আনতাম”।
পরিতোষ একটু সময় নিয়ে বলল, “ওকে তাহলে এক কাজ কর ডার্লিং। আমি বিকেল পাঁচটা নাগাদ তোমার কাছে ফাণ্ড পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তোমরা কোন মার্কেটে যেতে চাইছ বলো তো”?
সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই বুঝি বিকেলে গরিয়াহাট যাবেন। ভাবছি আমরাও তখন তার সাথেই যাব”।
পরিতোষ আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে শোন ডার্লিং। টিভি আর ফ্রিজটা আমি কাল সকালের দিকে ডেলিভারি দিতে বলি। আমি বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার ভেতর সকালে যে জায়গায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সেখানে পৌঁছে যাব। তোমরা সাড়ে পাঁচটার ভেতরেই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এস। আমি তোমাদের গড়িয়াহাটে পৌঁছে দেব। আবার তোমাদের মার্কেটিং শেষ হলে তোমাদের পৌঁছেও দিতে পারব”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমার ওপর তো বড্ড চাপ পড়ে যাবে পরিতোষ। আমার হাতে অত ফাণ্ড থাকলে তোমাকে আর কষ্ট দিতাম না। এমনিতেই তোমার ওপর অনেক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি”।
পরিতোষ সীমন্তিনীকে আশ্বস্ত করে বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল। ডাল, ভাজা আর ইলিশ ভাঁপা দিয়ে রচনার হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে সকলেই খুব পরিতৃপ্ত হল। রচনার অমায়িক ব্যবহারে নবনীতা অভিভূত হয়ে পড়ল। খেতে খেতেই গড়িয়াহাট যাবার প্ল্যান করা হল।
***************
বিকেল সাড়ে পাঁচটার কিছু আগেই রতীশ, রচনা, সীমন্তিনী আর নবনীতা বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই পরিতোষ গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। গাড়িতে উঠেই সীমন্তিনী পরিতোষের সাথে রতীশের পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর বলল, “দাদাভাই, রচু, তোদের জন্যে একটা সুখবর আছে”।
রতীশ আর রচনা দু’জনেই উন্মুখ হয়ে তার দিকে চাইতেই সীমন্তিনী বলল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ আর তার দুই সাকরেদ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আর তার চেয়েও বড় সুখবর হচ্ছে টাকাটা ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করা গেছে। তাও সুদ এবং জরিমানা সমেত”।
রতীশ আর রচনা দু’জনেই খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠল। সীমন্তিনী বলল, “এর পেছনে পরিতোষের একটা বড় ভূমিকা আছে। তবে টাকাটা পুলিশ হাতে হাতে দেবে না। তোদের ব্যাঙ্ক একাউন্টেই টাকাটা এসে জমা হবে। শুনেছি জরিমানা আর সুদ সমেত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নাকি পুলিশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু দাদাভাই তোর তো এখানে ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই। তাই আমি ভাবছি কাল রচুর নামে এখানে কোন একটা ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলে দেব, তাহলে টাকাটা এ একাউন্টে এসে জমা হবে। তবে দাদাভাই পরিতোষের কাছ থেকে আমি তিয়াত্তর হাজার টাকা ধার নিয়ে তোদের ফ্ল্যাটের জন্য ফ্রিজ আর টিভি আনছি। আগামীকালই এসে যাবে ওগুলো। আর নীতার জন্যে কিছু জামা কাপড় কিনছি। পুলিশ যে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে, তার থেকেই পরিতোষকে ওই তিয়াত্তর হাজার ঘুরিয়ে দেব। বাকি চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকাই আমি এখন রচুর একাউন্টে জমা করে দিয়ে যাব। এবার তুই নিশ্চিন্তে তোর মনের মত করে নিজের একটা যোগা সেন্টার খুলতে পারবি”।
রতীশ বলল, “কিন্তু আমার তো কালও ইনস্টিটিউটে যেতে হবে। তাহলে ব্যাঙ্কে যাব কি করে”?
সীমন্তিনী বলল, “সেজন্যেই তো বলছি একাউন্টটা রচুর নামে খুলে দেব। টাকাটা ওখানে এসে জমা হোক। তারপর যখন তোদের প্রয়োজন হবে তখন রচুই ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলতে পারবে। আর এটিএম কার্ডটা পেয়ে গেলে তো আর টাকা ওঠাতেও ব্যাঙ্কে যেতে হবে না। এটিএম থেকেই টাকা তুলতে পারবি। তাই তুই সঙ্গে না থাকলেও আমি রচুকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলতে পারব বলে মনে হয়”।
*********************
সেদিন বিকেলে গরিয়াহাট থেকে নবনীতার জন্য কিছু পোশাক আর রচনা আর সীমন্তিনীর ব্লাউজ গুলো ডেলিভারি নেওয়া হল। পরিতোষ নবনীতাকে তার নতুন মোবাইল দিল। তারপর রাত আটটা নাগাদ পরিতোষ রতীশ ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে নবনীতাকে নিয়ে চলে গেল। রচনা আর রতীশের অনেক অনুরোধ সত্বেও পরিতোষ তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকল না। তবে কথা দিয়ে গেল খুব শিগগীরই সে রতীশের ফ্ল্যাটে আসবে।
ঘরে ঢুকে সকলে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেবার পর রচনা সকলের জন্যে চা করে আনল। ড্রয়িং রুমে বসে চা খাবার পর রচনা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই তুমি আগে ব্লাউজ গুলো দেখ তো? ঠিকঠাক বানিয়েছে কি না” বলে রতীশকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি একটু সময় এ’ঘরেই থেক সোনা। আমি দিদিভাইকে নিয়ে একটু বেডরুমে যাচ্ছি”।
বেডরুমে এসে ব্লাউজ গুলো দেখতে দেখতে রচনা আলমারি থেকে নতুন কেনা শাড়িটা বের করে সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই এ শাড়িটার সাথে ওই ম্যাচিং ব্লাউজটা একটু পড় না তুমি”।
সীমন্তিনী শাড়িটা দেখে বলল, “ওমা, এটা তো তোর কেনা সেই শাড়িটা তাই না? কিন্তু এটা আমাকে পড়তে বলছিস কেন তুই? তুই পড়”।
রচনা সীমন্তিনীর দুটো হাত ধরে বলল, “রাগ কোরনা দিদিভাই। তোমার কাছে একটা কথা আমি গোপন করে গিয়েছিলাম। এ শাড়িটা আসলে তোমার জন্যেই কিনেছিলুম আমি। তোমাকে দেব বলে। তোমার দাদাভাইয়ের কাছ থেকে তুমি তো কখনও কিছু নাও নি। আমারও খুব সখ ছিল তোমাকে কিছু একটা দেবার। কিন্তু সে সুযোগ তো কখনও পাইনি। তাই আমি আর তোমার দাদাভাই যেদিন শুনলাম তুমি আসছ, সেদিনই মার্কেটে গিয়ে তোমার জন্যে এটা কিনেছিলাম। তুমি শুনে রাগ করবে বলেই আগে তোমাকে বলিনি। তাই এটার ব্লাউজটাও তোমার মাপেই বানিয়ে এনেছি। প্লীজ দিদিভাই, রাগ কোর না তুমি। তোমার রচু সোনার এ অনুরোধটুকু তুমি রাখো প্লীজ। তোমার দাদাভাইয়ের দেওয়া প্রথম উপহারটুকু তোমার হাতে তুলে দেবার সুযোগ আমাকে দাও”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর নতুন শাড়ি আর ব্লাউজটা তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। রচনা খুশী হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে রতীশের সাথে বসল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনী নতুন শাড়ি ব্লাউজ পড়ে সামনের ঘরের দরজার সামনে এসে রচনার নাম ধরে ডাকতেই রচনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই এস”।
সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে রচনা একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল। সীমন্তিনীকে বিনা প্রসাধনেও ওই শাড়ি ব্লাউজে অসাধারণ সুন্দরী লাগছিল। রচনা সীমন্তিনীকে ধরে ঠাকুরঘরে নিয়ে গেল। সীমন্তিনী ঠাকুরকে প্রণাম করে আবার রচনার হাত ধরে ড্রয়িং রুমে এসে রতীশকে প্রণাম করল। রতীশও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সীমন্তিনীকে দেখতে দেখতে বলল, “বাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে মন্তি। রচু ঠিকই বলেছিল। এ শাড়িটাতেই তোকে খুব সুন্দর মানিয়েছে”।
সীমন্তিনীর চোখ দুটোতে জল টলমল করছিল। রচনা সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের উচ্ছ্বাস চাপতে চাপতে খুশী মাখা গলায় বলল, “সত্যি দিদিভাই, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে”।
সীমন্তিনী নিজের উদ্গত কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আজকের এ দিনটা আমি কখনও ভুলব না রে রচু। তোর আর দাদাভাইয়ের এ উপহার আমি খুব যত্ন করে রাখব”।
পরের কয়েকটা দিন রচনার যেন স্বপ্নের মত কাটল। পরের দিন সীমন্তিনী রচনাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যাবার আগেই ঘরে টিভি আর ফ্রিজ এসে গেল। পরিতোষই এসে তাদের ব্যাঙ্কে নিয়ে গেল। ব্যাঙ্কে কাগজ জমা দেবার পর পরিতোষের অনুরোধে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার নিজে উদ্যোগ নিয়ে আধঘন্টার ভেতরে রচনার নামে একাউন্ট খুলে দিল। পাসবুক আর চেকবুক নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে এল। পরের দিন পরিতোষ তার জিমের লকার থেকে টাকা এনে রচনার সেই একাউন্টে চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকা জমা করে দিয়েছিল। সীমন্তিনীকে এতদিন বাদে কাছে পেয়ে রচনার আর খুশীর সীমা ছিল না। নবনীতা চারটে রাত আব্দুলের বাড়িতে পরিতোষের প্রীতিদির হেফাজতে ছিল। পনেরই আগস্ট পরিতোষের গাড়ি চড়েই রচনা আর রতীশ সীমন্তিনী আর নবনীতাকে ট্রেনে তুলে দিল।
*****************
দুপুর প্রায় এগারোটা নাগাদ সীমন্তিনী নবনীতাকে নিয়ে নিজের কোয়ার্টের এসে পৌঁছল। পাহাড়ের ওপর চারধারে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বাড়িটা দেখে নবনীতার খুব ভাল লাগল। কিন্তু কোনকিছুই যেন সে মন দিয়ে উপভোগ করতে পারছিল না। যে মহিলা তার কাছে পুরোপরি অচেনা ছিল, প্রথম দেখাতেই সে মহিলা তাকে নিজের সাথে রাখবে বলে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, এটা ভাবতেও যেন তার কেমন লাগছিল। তবে প্রথমদিন কয়েকটা ঘন্টা রচনা আর সীমন্তিনীর সাথে কাটিয়ে আর ট্রেনে দীর্ঘ সময় সীমন্তিনীর সাথে নানারকম কথাবার্তা বলে বুঝেছে সীমন্তিনী সত্যিই খুব ভাল মনের মানুষ। এখানে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তার মনের দ্বন্দ অনেকটা কমে গেলেও, সে যেন পুরোপুরি সহজ হতে পারছিল না।
সীমন্তিনী ঘরে ঢুকেই প্রথমে লক্ষ্মীদির সাথে নবনীতার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “নীতা আজ থেকে এখানেই আমাদের সাথে থাকবে। তুমি ওকে ছোড়দি বলে ডেকো লক্ষ্মীদি”।
লক্ষ্মীকে সীমন্তিনী আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার সাথে আরও একজন আসছে, তাই লক্ষ্মীও তিনজনের খাবার বানিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সীমন্তিনী তারপর রচনাকে আর পরিতোষকে ফোন করে জানিয়ে দিল তারা ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছে গেছে। আর পরে ভাল করে কথা বলবে।
তারপর নবনীতাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বলল, “নীতা, তুমি একেবারেই কোনরকম অস্বস্তি বোধ কোর না। এটা কে নিজের বাড়ি বলেই ভেব। আর আমাকে তোমার দিদি বলেই ভাববে কেমন? আর এখন তো দুপুর হতেই চলল। তুমি কি চা-টা কিছু খাবে? না স্নান সেরে একেবারে দুপুরের খাবার খাবে”?
নবনীতা বলল, “না দিদি, এখন আর চা-টা কিছু খাব না। আগে বরং স্নানটা করে নিলেই ভাল হবে”।
সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে তাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “এখন থেকে এটাই তোমার ঘর। এ ঘরেও এটাচড বাথরুম আছে। খাট বিছানা আলমারি টেবিল চেয়ারও আছে। কিন্তু ড্রেসিং টেবিল নেই। তবে আলমারির ভেতরের পাল্লায় আয়না লাগানো আছে। আপাততঃ সেটাতেই কাজ চালাও। অসুবিধে হলে পরে একটা ড্রেসিং টেবিল যোগার করে দেব”।
নবনীতা বলল, “না না দিদি, আলমারির পাল্লার ভেতর যদি আয়না থেকে থাকে, তাহলে আর আলাদা ড্রেসিং টেবিলের কোনও দরকার পড়বে না। কিন্তু দিদি, আমি তোমার কথায় এভাবে চলে এসে তোমাকেই অসুবিধেয় ফেলে দিলাম কি না বুঝতে পাচ্ছি না”।
সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে খাটে বসে বলল, “নীতা, ও’সব একেবারেই ভাববে না। দেখ অনেক বছর থেকে আমি আমার বাড়ি ঘর আত্মীয় পরিজনদের ছেড়ে দুরে দুরে থাকছি। মাধ্যমিক পাশ করবার পর থেকেই। ধর সে প্রায় বারো বছর। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বাড়ি ভর্তি লোকজন। জেঠু, বড়মা, বাবা, মা, কাকু ছোটমা ছাড়াও আমরা ছ’ ভাই বোন। আমার দাদাভাই, যাকে তুমি কলকাতায় দেখে এসেছ, তিনিই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে বড়। তারপর আমি। দাদাভাই আর আমি মাত্র ছ’মাসের ছোট বড়। একই ক্লাসে পড়তাম আমরা। মাধ্যমিক পাশ করবার পর আমাদের দাদাভাই দেরাদুনে পড়তে গিয়েছিলেন। আর আমি চলে গিয়েছিলাম আমাদের জেলা শহর জলপাইগুড়িতে। তারপর থেকে আমি আর কখনও তেমন পাকাপাকি ভাবে বাড়িতে থাকিনি। ছোট ভাই বোন গুলোর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। কষ্ট হয় খুবই। সারাদিন তো অফিসের কাজে কর্মেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ঘরে ফিরে আসবার পরেই ভীষণ একা লাগে নিজেকে। দাদাভাই আর রচুর সাথে আমি রোজ নিয়ম করে দু’ তিনবার ফোনে কথা বলি। বাড়ির লোকদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না আমার। তাই ঘরে যতক্ষণ থাকি নিজেকে ভীষন একা একা লাগে মাঝে মাঝে। এখন থেকে তুমি আমার সাথে থাকলে আমাকে তো অত লনলি ফীল করতে হবে না। তাই তুমি আমার সাথে থাকলে আমারই তো লাভ। আমি তোমার সদ্য পরিচিত বলে তুমি একেবারে অস্বস্তি বোধ করবে না। তুমি এটাকে একেবারে নিজের বাড়ি নিজের ঘর বলেই ভেব। আমরা দু’বোন মিলে হাসিতে খুশীতে সময় কাটাব” একটু থেমে বলল, “আচ্ছা বলার শোনার তো আরও অনেক কথা আছে। কিন্তু আপাততঃ আর কোনও কথা নয়। তুমি স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও স্নান সেরে নিচ্ছি। আজ তো আর আমি অফিসে যাচ্ছি না। খাবার পর থেকে একসাথে বসে অনেক গল্প করব আমরা”।
আগের রাতে ট্রেনে কারুরই ভাল ঘুম হয়নি। স্নানের পর দুপুরের খাবার খেতে খেতে সীমন্তিনী বলল, “নীতা কাল রাতে তো কেউই ভাল ভাবে ঘুমোতে পারিনি। তুমি কি খেয়েদেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেবে”?
নবনীতা বলল, “এমনিতে দিনের বেলা ঘুমোনোর অভ্যাস আমার নেই দিদি। কিন্তু কাল রাতে সত্যি একেবারে ঘুম হয়নি। ভাবছি একটু ঘুমিয়ে নিই”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ একটু ঘুমিয়েই নাও। আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা গল্প করব”।
****************
______________________________