11-03-2020, 10:10 PM
(Update No. 127)
নবনীতা আগের মতই শান্ত স্বরে বলে চলল, “সেটা প্রথমে আমিও ওই মূহুর্তে বুঝতে পারিনি বৌদি। আমি একটা বন্ধ ঘরের ভেতর একটা খাটিয়ার ওপর পড়ে ছিলাম। নিজের চরম সর্বনাশের কথা বুঝতে পেরে আমি অনেক কষ্টে খাটিয়া থেকে উঠে সে ঘরটা থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখেছিলাম ওই ঘরটায় শুধু মাত্র একটাই দরজা ছিল যেটা বাইরে থেকে আটকানো ছিল। অনেক চেষ্টা করেও সে দরজা খুলতে পারিনি আমি। নিরাশ হয়ে আবার সেই খাটিয়াটাতেই বসে পড়েছিলাম। আবছা অন্ধকারে শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে বাইরে দিনের আলো আছে। কিছুক্ষণ বাদে মনে হল বাইরে থেকে কেউ দরজাটা খুলছে। ছিন্ন ভিন্ন পোশাকটাকে টেনে টুনে নিজের শরীর ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করতে করতেই দেখলাম দুটো ছেলে সে ঘরে ঢুকছে। আবছা অন্ধকারে অবাক হয়ে দেখেছিলাম ওই দুটো ছেলেই আমার পরিচিত। তারা আমাদের বস্তিতেই থাকত। একজনের নাম বিরজু, আর আরেক জনের নাম ছিল কালু। বিরজু আমাকে বস্তিতে নানাভাবে উত্যক্ত করত। মাঝে মধ্যেই আমাকে একা পেলেই আমার ওপর চড়াও হবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি নিজেকে সব সময় ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিতাম। পরে জানতে পেরেছিলাম ওই রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে অজ্ঞান করে আমার বাড়ি থেকে বিরজু আর কালু আমাকে নিয়ে চলে এসেছিল। তারপর অজ্ঞান অবস্থাতেই তারা আমার শরীরটাকে ভোগ করেছিল। বিরজু আর কালু ঘরে ঢুকে আবার আমাকে ভোগ করল। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও ওই দুই বদমাশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না। প্রায় তিন মাস আমাকে তারা ওই ঘরেই বন্দী করে রেখে রোজ একাধিকবার আমাকে পিষে মারত। জায়গাটা কোথায় ছিল আমি সেটাও বুঝতে পারিনি। আজও জানি না। শুধু টয়লেট আর বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলেই সে ঘরটা থেকে বেরোতে পারতাম। তারা দু’জন পাহারা দিয়ে আমাকে বাথরুমে বা টয়লেটে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে সেখানেও আমাকে ''. করত। বাথরুম টয়লেটে যাবার সময় আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম ওটা একটা পোড়ো বাড়ির মত ছিল। আশেপাশে কোনও জনমানুষ দেখতে পেতাম না। তিনমাস সেখানে থাকবার পর বিরজু আর কালু আমাকে আসানসোলের দিকে কোন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে যাবার পরেও আমার দুর্ভোগের শেষ হয়নি। দু’জন মিলে যখন খুশী তখনই আমার শরীরটাকে ভোগ করত। কিছুদিন পর আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লাম। কোন একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তারা আমার গর্ভপাত করিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওই হাসপাতালের ডাক্তার আর ওয়ার্ড বয়েরাও আমাকে নিয়মিত ভোগ করতে শুরু করল। তখন আমাকে নিয়ে তারা দু’জন গ্রামের শেষ ভাগে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। একসময় তাদের পক্ষে বাড়ির ভাড়া মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়তেই রোজ আলাদা আলাদা পুরুষ বাড়ি এসে আমাকে ভোগ করতে শুরু করল। এভাবে আমাকে রোজ অগুনতি পুরুষের কামনার শিকার হতে বাধ্য করা হত। ঘরের বাইরে আমাকে একেবারেই যেতে দেওয়া হত না। আর একা বাথরুম বা টয়লেটেও যেতে দিত না। ২০০৫ সালে আমাকে ওরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অত্যাচারিত হতে হতে আমার ভেতর আর প্রতিরোধের ক্ষমতা একবিন্দুও অবশিষ্ট ছিল না। নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার সামনে আর অন্য কোন পথ ছিল না। কাউকে একটা খবর পর্যন্ত দেবার সাধ্য আমার ছিল না। প্রায় বছরদেড়েক বাদে বাইরের যেসব পুরুষ আমায় ভোগ করতে আসত তাদের একজনের কাছ থেকে কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়ে পরিতোষকে ওই চিঠিটা আমি লিখেছিলাম। তারপর ওই লোকটার মাধ্যমেই চিঠিটা পোস্ট করতে পাঠিয়েছিলাম। সে চিঠি আদৌ পোস্ট করা হয়েছিল কি না বা আদৌ পরি সে চিঠি পেয়েছিল কি না, সেটাও আমি বুঝতে পারিনি। সেদিন পরিই বলল ২০০৭ সালে ওর ট্রেনিং শেষ হবার পর দু’দিনের জন্য বাড়ি এসে ও আমার সেই চিঠিটা পেয়েছিল। বছরের পর বছর এভাবে লাঞ্ছিতা হতে হতে আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমার প্রতিরোধ কমতে কমতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রতিরোধ কমে আসছে দেখে আমার ওপর নজদাড়িতে একটু ঢিল দেওয়া হয়েছিল। আর তখনই সুযোগ পেতেই একদিন সেখান থেকে পালিয়ে বিনা টিকিটেই কলকাতার কোন একটা ট্রেনে চেপেছিলাম। সেটা বছর দেড়েক আগের কথা। হাতে টিকিট ছিল না। দ্বিতীয় আর কেউ সঙ্গেও ছিল না। সুযোগ বুঝে ট্রেনের টিটিও আমাকে ভোগ করল, ট্রেনের টইলেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে। কলকাতা পৌঁছেই আমি আমাদের বস্তিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা আর দাদা আমাকে তাড়িয়ে দিল। ইজ্জত খোয়ানো মেয়েকে তারা নিজের কাছে রাখতে রাজী হলেন না। শুনলাম আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার দিন তিনেক পরই নাকি মা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর শুনেছিলাম গোটা বস্তির লোকেরা এটাই জানে যে আমি কোন ছেলের সাথে স্বেচ্ছায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরিতোষের কথা মনে হয়েছিল তখন। যদিও পরিতোষের সাথে দেখা করার ইচ্ছে আমার ছিল না, তবু যাবার আর কোন জায়গা ছিল না বলে ওর বাড়িতেই গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু বাড়িটা তখন তালা বন্ধ। পরি ছিল না। পরে শুনেছি, ওই সময় সে অন্ধ্রপ্রদেশে ছিল। আর তার সপ্তাহ খানেক বাদেই ও কলকাতা বদলি হয়ে এসেছিল। অভুক্ত অস্নাত অবস্থায় আর কোন জায়গা না পেয়ে রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়েছিলাম। পরের প্রায় এক বছর ভিক্ষে করে যা পেতাম তাই খেতাম। আর রাতে কোন ষ্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়তাম। সেখানেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম না। রেল পুলিশ, রেলের স্টাফ, ষ্টেশনের কুলিরা ছাড়াও অনেকেই খুশী মত আমাকে প্লাটফর্ম থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে আমার শরীরটাকে ভোগ করত। প্রথমবার আসানসোলে গর্ভপাত করাবার সময়ই ভবিষ্যতে আমার সন্তান হবার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে আর প্রেগন্যান্ট হইনি কখনও। আসানসোল থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও নিজেকে আর দশটা লোকের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি আমি। প্রায় রোজ রাতেই কেউ না কেউ আমাকে ভোগ করত। একটা সময় আমিও এটাকেই আমার ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছিলাম। মাস ছয়েক আগে আমার কলেজের এক সহপাঠিনী আমাকে রাস্তায় ভিক্ষে করতে দেখে তার সাথে নিয়ে যায়। সে একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। আমার ওই বিধ্বস্ত চেহারাতেও ও যে কি করে আমাকে চিনতে পেরেছিল জানিনা। আমি তো নিজেই নিজেকে চিনতে পারতাম না। কিন্তু ও আমাকে প্রায় জোর করেই ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। আমি খানিকটা স্বস্তি পেয়ে কোন একটা কাজ টাজ যোগাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারলাম না” এতখানি বলে নবনীতা একটু থামল।
ঘরের সবাই নিশ্চুপ নিথর। বোতল থেকে কিছুটা জল খেয়ে নবনীতা আবার বলল, “এখানে আমার সে বান্ধবীর নাম ঠিকানা আমি ইচ্ছে করেই গোপন রেখে যাব। আমার চরম বিপদের দিনে যে আমায় আশ্রয় দিয়েছে তার কোন ক্ষতি হোক, এ আমি চাই না। আমার বান্ধবীর বস্তির বাড়িতে তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। একটা পঙ্গু ভাইয়ের ভরন পোষনও তাকেই করতে হয়। আমারই মত সেও খুব বেশী লেখাপড়া করেনি। তাই ভাল কোন কাজও জোটাতে পারেনি। ও একটা প্রাইভেট যোগা ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করে। কিছু মনে করো না তোমরা। সে ট্রেনিং সেন্টারের নাম ঠিকানাও আমি গোপন করতে বাধ্য হচ্ছি। সেখানে আমার বান্ধবী পনেরো হাজারের মত মাইনে পায়। কিন্তু অতটুকু পয়সায় নিজের পরিবারের ভরণ পোষন কুলিয়ে উঠত না বলে ও এসকর্ট ব্যবসায় নেমেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। এখন আর ওর পয়সার অভাব তেমন একটা নেই। তাই বস্তির বাড়ি ছেড়ে ও আলাদা এক জায়গায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ওর কাজের ব্যাপারে ও আমাকে সব কিছু বললেও কখনও আমাকে ওর মত এসকর্ট হবার পরামর্শ দেয় নি। আমি ওর ফ্লাটে থেকে ওর পয়সায় খেয়ে অন্য কাজের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চার মাস কেটে যাবার পরেও কোন কাজ জোটাতে সক্ষম হলাম না। ওর আশ্রয়ে আমি অনেক নিরাপদে থাকলেও ওর ঘাড়ের ওপর চেপে থাকতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল। তারপর একদিন আমি নিজেই ওকে বললাম যে আমিও ওর মত এসকর্ট ব্যবসায় নামতে চাই। ততদিনে আমার শরীর স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম যে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তো কত পুরুষ আমার দেহটাকে লুটে পুটে খেয়েছে। এখন না হয় নিজে বেঁচে থাকার তাগিদেই নিজের দেহটাকে পুরুষদের হাতে তুলে দেব। নতুন করে আর কোন ক্ষতি তো হবার ছিল না। আমার বান্ধবী তখন আমাকে ওর ম্যাডামের কাছে নিয়ে যায়। ওর ম্যাডাম আমার একটা ইন্টারভিউ নেন তারপর আমাকেও তার ব্যবসার এসকর্ট বানিয়ে নিলেন। এখন আমিও আমার বান্ধবীর মতই একজন এসকর্ট। সোজা বাংলায় যাকে একটা বেশ্যা বলা হয়। অবশ্য বেশ্যাবৃত্তি তো আমাকে অনেক বছর আগে থাকতেই করতে হত। কিন্তু তখন হাতে কোন পয়সা পেতাম না। এখন আমার শরীরের দাম আমিই পাই। আমার বান্ধবীর সাথে একসাথে থাকি, ওর ফ্ল্যাটের ভাড়া শেয়ার করি, আর দুপুরের পর থেকে নানা পুরুষের মনোরঞ্জন করে পয়সা উপার্জন করি। এই হচ্ছে মোটামুটি ভাবে আমার বর্তমান জীবনের কথা। পরির সাথে আমার আর কখনো দেখা হোক এটা আমি মন থেকেই চাইতাম না। কিন্তু কয়েকদিন আগে পরির মুখোমুখি পড়ে যাই। তারপর পরি আমাকে আবার তার কাছে ডেকেছিল। কিন্তু আমার নোংড়া অপবিত্র শরীরটা নিয়ে ওর ঘরে গিয়ে ওঠা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। পরির প্রতি আমার ভালবাসা এখনও অপবিত্র আছে বলে মনে করি আমি। সেই পবিত্র ভালবাসাকে আমি কিছুতেই কলঙ্কিত করে ফেলতে পারব না। যাকে একটা সময় মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি, সেই নিষ্পাপ লোকটার জীবন কি আমি কলঙ্কময় করে তুলতে পারি? আর ওকে দেবার মত আমার কাছে আর আছেই বা কি? আমি তো আমার শরীর, আত্মা, মান মর্য্যাদা সব কিছু হারিয়ে বসে আছি। মা হবার যোগ্যতাটুকুও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এ অবস্থায় হাজার প্রলোভনেও আমি পরির জীবনটা নষ্ট করতে পারব না। তোমাদের সকলের কাছে আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। এমন অনুরোধ তোমরা কেউ কোর না আমাকে”।
নবনীতা অদ্ভুত দৃঢ়তার সাথে এতগুলো কথা বললেও কথা শেষ করে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সীমন্তিনী পাশ থেকে নবনীতাকে নিজের বুকে চেপে ধরল। সকলের মুখ থেকেই যেন শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিতোষ চেয়ার থেকে উঠে নবনীতার কাছে এসে বলল, “সত্যি কথাটা না জেনে আমি তোমার ওপর অনেক অভিমান করেছিলাম নীতা। অনেক অভিযোগ জমা হয়েছিল আমার মনের মধ্যে তোমার বিরূদ্ধে। তোমার ওপর দিয়ে যে এত ঝড় বয়ে গেছে, সে তো আমি ভাবতেও পারিনি। কিন্তু আজ সব কথা শোনার পর তোমার ওপর আর আমার কোন অভিযোগ রইল না। এখন শুধু ভাগ্যের দোহাই দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ রইল না আমার কাছে। বাবা তোমাকে তার পূত্রবধূ হিসেবে মেনে নিলেও আমার ভাগ্যই তোমাকে আমার কাছে আমার জীবনে আসতে দেয়নি। তোমার চিন্তাধারাকে আমি সম্মান জানাচ্ছি। তবু শেষবারের মত আমি তোমায় বলতে চাই, এত সব কিছু হওয়া সত্বেও আমি তোমাকে নিজের করে নিতে রাজি আছি। আরেকবার তোমাকে অনুরোধ করছি আমার এ প্রার্থনাটুকু স্বীকার করে নাও। সব পরিস্থিতির মোকাবেলা আমি করতে প্রস্তুত আছি”।
অশ্রু ভেজা চোখে পরিতোষের দিকে চেয়ে কান্না ভেজা গলায় নবনীতা বলল, “আমায় ক্ষমা কর পরি। আমি কিছুতেই আমার পবিত্র ভালবাসাকে অসম্মান করতে পারব না। যদি তুমি মন থেকে আমাকে সত্যি ভালবেসে থাক তাহলে আমার অনুরোধ মেনে তুমি একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করে তার সাথে সুখে সংসার কর। তোমাকে সুখী দেখতে পেলেই আমার জীবনের সব চাওয়া আমার পূর্ণ হয়ে যাবে। আমি আর কিচ্ছুটি চাই না। আমি হাতজোড় করে তোমার কাছে এ ভিক্ষাটুকু চাইছি পরি। তোমার ভালবাসার বনি জীবনে এই প্রথমবার তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছে। তুমি তাকে ফিরিয়ে দিও না প্লীজ”।
পরিতোষ হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। সীমন্তিনী কান্নায় ভেঙে পড়া নবনীতাকে নিজের বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল। রচনা নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে বাকি তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছিল।
অনেকক্ষণের প্রচেষ্টায় নবনীতা খানিকটা শান্ত হলে সীমন্তিনী ভারী গলায় পরিতোষকে বলল, “সর্বস্য হারিয়ে বসা একটা মেয়ের মনের দুঃখ সবাই বুঝতে পারবে না পরি। কিন্তু নীতার সব কথা শোনার পর ওর অমন সিদ্ধান্তের জন্য আমি ওকে একেবারেই দোষারোপ করতে পারছি না। নিজের ভালবাসাকে পবিত্র করে রাখতে অনেক মেয়েই এমন ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমি নিজেও তো অনেকটা তাই করেছি। তাই আমি যদি আমার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে ভাবি, তাহলে ওর সিদ্ধান্তের মর্যাদাও আমাকে দিতেই হবে। যে আশা নিয়ে আমি আজ এখানে এসেছিলাম, সে আশা পূর্ণ হচ্ছে না বলে মনটা খারাপ হলেও নীতাকে আমি আর কোন রিকোয়েস্ট করতে পারব না। আমার এখন ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে তোমার জীবনের দুটো পছন্দের মেয়েই তোমার ভালবাসার পূর্ণ পরিণতি দিতে পারল না। কিন্তু পরি, এভাবে তো চিরটা কাল চলতে পারে না। আমি আমার ভবিষ্যৎ স্থির করে নিয়েছি। নীতাও তাই। তোমার মা বাবা বেঁচে থাকলে তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়ত তারাই ভাবতেন। কিন্তু তারা নেই বলেই তুমি তো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারো না। যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। তাই তোমার বন্ধু হিসেবে আমি এটাই চাই যে যত শীঘ্র সম্ভব একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করে তোমাকে এখন সংসারী হতেই হবে। আর এ চাওয়া শুধু আমার নয়। আমি জানি, নীতাও ঠিক এটাই চাইছে”।
পরিতোষ হতাশ ভাবে বলল, “আমার জীবনে তোমরা দু’জন ছাড়া আর তো কেউ নেই মন্তি। এতদিন আসল ব্যাপারটা না জেনে নবনীতার ওপর আমার অনেক অভিমান হয়েছিল। কিন্তু আজ আর ওর ওপর আমার কোন অভিমান নেই। আমার দুর্ভাগ্য। আমার জীবনের দুই নারীই নিজের নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে, সেটা আমি খুব ভালভাবে বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাদের অনুরোধও বা কি করে স্বীকার করে নিই বল? বিয়েটা তো আর একটা ছেলেখেলা নয়”।
সীমন্তিনীর হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে নবনীতা বলল, “জানি পরি, বিয়েটা কোন ছেলেখেলা নয়। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে অনেক ছেলে মেয়েই এখনও তাদের অভিভাবকদের পছন্দ করা অজানা অচেনা পাত্র পাত্রীকে বিয়ে করে খুব সুখেই সংসার করতে পারে। আমার এটুকু জীবনে দুঃখ কষ্ট তো আমি কম কিছু পাইনি। সে’সব ভুলে গিয়ে নিজেকে সকলের কাছে বিলিয়ে দিয়েও আমি এখন অনেক স্বস্তিতে আছি। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করে সংসারী হতে না দেখলে আমি যে সারাটা জীবন একেবারেই শান্তি পাব না। আমার কেবলই মনে হবে তোমার জীবনটাকে আমি ছন্নছাড়া করে দিয়েছি। প্লীজ পরি, আমার এই একটা অনুরোধ তুমি রাখো। আমি আর কক্ষনও তোমার আমার ভালবাসার দোহাই দিয়ে তোমার কাছে কিচ্ছুটি চাইব না”।
নবনীতার কথা শেষ হলে সীমন্তিনীও বলল, “হ্যাঁ পরি, আমিও সেটাই চাই। আমি জানি তোমার মাথার ওপর কোন অভিভাবক নেই। কিন্তু আমি খুব খুশী মনে সে দায়িত্ব পালন করতে রাজি আছি। তোমার জন্যে আমি নিজে একটা উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করব। তোমার যদি তাকে পছন্দ হয় তাহলে তাকেই তুমি বিয়ে কোর। কিন্তু আমাদের এই দুই অভাগীর মত তুমিও বিয়ে করব না বলে পণ করে বোস না প্লীজ। বন্ধু হিসেবে আমি কি তোমার কাছে এতটুকু দাবী করতে পারি না”?
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “আমি তো আগে থেকেই জানতাম, তোমরা কেউ আমার প্রার্থনা শুনবে না। আর এটাও জানতাম যে, আজকের এই দেখা সাক্ষাতের পর ঠিক কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই আলোচনাটা মনে হয় শেষ করা উচিৎ। এবার নিরপেক্ষ হিসেবে বৌদি যা বলবে আমি সেটাই মেনে নেব। বৌদি, তুমি বল। কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়”।
রচনা একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “আমি যে কী বলব সেটা তো বুঝতেই পাচ্ছি না পরিতোষদা। এখানে এসেছিলাম এক উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু ঘটণা এমন একটা দিকে ঘুরে গেল যার কল্পনাই করিনি। আমি তো আপনাদের তিনজনের অবস্থাই বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনারা যে যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে কারুর সিদ্ধান্তকেই আমি ভুল বলতে পাচ্ছি না। কিন্তু এটাও তো ঠিক নয় যে দিদিভাই বা নীতাদিকে নিজের করে নিতে পারছেন না বলে আপনি সারাজীবন বিয়ে না করে এভাবে জীবন কাটিয়ে যাবেন। তাছাড়া একটা মেয়ে হয়ে আমি নীতাদির মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। দিদিভাইয়ের শপথের কথা তো আমি আমাদের বিয়ের আগে থেকেই জানি। আমি এদের কাউকেই নিজের শপথ ভুলে যাবার কথা বলতে পারি না। নিজের নিজের ভালবাসাকে পবিত্র রাখতে এনারা দু’জন যা করছেন, তাকে আমি মোটেও অসমর্থন করতে পাচ্ছি না। তাই আমার মনে হয় দিদিভাই যে সমাধানটা দিচ্ছেন, সেটাই আপনার মেনে নেওয়া উচিৎ। দেখুন পরিতোষদা, এ বয়সে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনিও হয়ত নিশ্চিন্তেই থাকবেন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথাও তো একটু ভেবে দেখতে হবে। আপনি যদি একটা জয়েন্ট ফ্যামিলীর সদস্য হতেন তবু না হয় কথা ছিল। বিপদে আপদে পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরা আপনার দিকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিত। কিন্তু আপনার মাথার ওপর তো কেউ নেই। আজ আপনি শারিরীক ভাবে সুস্থ আছেন বলে একজন জীবনসঙ্গীর কথা হয়ত তেমন ভাবে ভাবছেন না। কিন্তু একসময় এমনও তো হতে পারে যে আপনি একটা অবলম্বনের অভাব বোধ করবেন। তখন হয়ত হাজার চাইলেও দিদিভাই বা নীতাদি আপনার সে অবলম্বন হতে পারবে না। তখন এমন একজনের প্রয়োজন পড়বে যে আপনার একান্ত আপন। আর সেটা হতে পারে কেবল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভেতরেই। তাই আমার মনে হয় অন্য কোনও সুপাত্রীকে আপনার বিয়ে করাই উচিৎ। আর আপনি নিজে সেটা না পারলেও আমার দিদিভাই আপনার জন্য নিশ্চয়ই একটা ভাল মেয়ে খুঁজে বের করতে পারবেন”।
সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই রচনার কথার সমর্থন করতে পরিতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “উহ, আর ভাবতে পারছিনা আমি। ঠিক আছে। তোমরা সবাই যখন এমনটাই চাইছ, তবে তাই হোক। মন্তি যাকে খুঁজে আনবে আমি তাকেই বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলাম”।
নবনীতা সাথে সাথে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ পরি। মন্তিদি আমি তো অসামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। আর নিজে তো অনেক আগে থেকেই নোংরা হয়ে গেছি। তবু বলছি, এ কাজে আমার তরফ থেকে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে বোল। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমার সাহায্যের প্রয়োজন তো হবেই। সে জন্যে আমরা দু’জন কাছাকাছি থাকতে পারলে ভাল হত। তুমি কি কলকাতা ছেড়ে আমার সাথে যেতে পারবে”?
নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “কী বলছ দিদি? কলকাতা ছেড়ে কোথায় যাব আমি”?
সীমন্তিনী খুব সহজ ভাবেই বলল, “কেন কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে তোমার অসুবিধে আছে”?
নবনীতা একটু থতমত খেয়ে বলল, “না তা নয়। কিন্তু কোথায় যাব আমি? আর অন্য কোথাও গিয়ে করবই বা কি”?
সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে যাবে। আমার সাথে থাকবে। আর কী করবে বলছ? প্রথমে আপাততঃ তোমার জন্য একটা সম্মানজনক কাজ খুঁজে দেব আমি। আর তারপর আমরা পরিতোষের জন্য একটা ভাল মেয়ে খুঁজে বের করব। আমার ছোটবোনের মত তুমি তোমার দিদির সাথে থাকবে। তোমার বর্তমান জীবন তোমাকে আর কাটাতে হবে না”।
নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। কয়েক মূহুর্ত অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার দু’চোখ জলে ভরে গেল। কিছু বলার চেষ্টায় মুখ খুলতেই তার ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। মুখ থেকে আর কথা ফুটল না। রচনাও সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রথমটায় চমকে উঠেছিল। কিন্তু পর মূহুর্তেই ভাবল এমন সিদ্ধান্ত তার দিদিভাইই বুঝি শুধু নিতে পারেন। সে নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “হ্যাঁ নীতাদি। তুমি আপত্তি কোর না। আমার দিদিভাইয়ের কাছে গেলে তোমার কোন অমর্যাদা হবে না”।
সীমন্তিনী পরিতোষকে বলল, “পরি আমাদের হাতের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তোমার ব্যাপারে আমি দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি। আর সে দায়িত্ব পালন করবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। কিন্তু আপাততঃ আজ তোমাকে আমার জন্যে তিনটে কাজ করতে হবে”।
পরিতোষ বলল, “বল কী করতে হবে”?
সীমন্তিনী নবনীতার আরেকটা হাত ধরে বলল, “নীতা, তোমার কাছে নিশ্চয়ই মোবাইল আছে। সেটা আমাকে দাও তো আগে”।
নবনীতা কোন কথা না বলে নিজের মোবাইলটা সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে দিল। সীমন্তিনী নবনীতার ফোনের সিমকার্ডটা খুলতে খুলতে বলল, “পরি, নীতাকে এখন আমরা আমাদের সাথেই নিয়ে যাব। তবে সেখানে ওকে রাতে রাখব না। তোমার প্রথম কাজ হবে নবনীতার একটা থাকার জায়গা ঠিক করে দেওয়া। ও আর ওর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে ফিরে যাচ্ছে না। আর তার ওই ম্যাডাম বা তার বান্ধবীর সাথে আর কোন যোগাযোগ করবার চেষ্টাও করবে না। তাই তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে আজ রাত থেকে পনের তারিখ অব্দি নীতাকে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখা। আর তোমার দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে পনের তারিখ আমি যে ট্রেনে যাচ্ছি সেই ট্রেনে নীতার জন্য একটা টিকিট কাটা। পনের তারিখ নীতা আমার সঙ্গেই কলকাতা ছাড়বে। আর তোমার তিন নম্বর কাজ হচ্ছে নীতার জন্যে একটা নতুন মোবাইল যোগার করে দেওয়া। নীতার বর্তমান মোবাইলটা ও আর ইউজ করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ”?
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “বেশ হয়ে যাবে। আর কিছু”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ আরেকটা কাজ অবশ্য আছে। তবে সেটা যে আজই করতে হবে, এমন নয়। তোমার কাছে আমার যে ফাণ্ডটা আছে তা থেকে একটা মাঝারী সাইজের ভাল কোম্পানীর ফ্রিজ আর একটা ভাল কোম্পানীর এলইডি টিভিসেট আর তার সাথে ডিস কিনে আমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেবে প্লীজ”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে হা হা করে কিছু বলতে যেতেই সীমন্তিনী হাত তুলে তাকে বাধা দিয়ে বলল, “তোকে এর মধ্যে কিছু বলতে হবে না রচু” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “করতে পারবে তো”?
পরিতোষ হেসে বলল, “অবশ্যই পারব। তবে তোমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে যে টিভি ফ্রিজ নেই এ’কথা তুমি আমাকে আগেও বলতে পারতে”।
______________________________
নবনীতা আগের মতই শান্ত স্বরে বলে চলল, “সেটা প্রথমে আমিও ওই মূহুর্তে বুঝতে পারিনি বৌদি। আমি একটা বন্ধ ঘরের ভেতর একটা খাটিয়ার ওপর পড়ে ছিলাম। নিজের চরম সর্বনাশের কথা বুঝতে পেরে আমি অনেক কষ্টে খাটিয়া থেকে উঠে সে ঘরটা থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখেছিলাম ওই ঘরটায় শুধু মাত্র একটাই দরজা ছিল যেটা বাইরে থেকে আটকানো ছিল। অনেক চেষ্টা করেও সে দরজা খুলতে পারিনি আমি। নিরাশ হয়ে আবার সেই খাটিয়াটাতেই বসে পড়েছিলাম। আবছা অন্ধকারে শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে বাইরে দিনের আলো আছে। কিছুক্ষণ বাদে মনে হল বাইরে থেকে কেউ দরজাটা খুলছে। ছিন্ন ভিন্ন পোশাকটাকে টেনে টুনে নিজের শরীর ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করতে করতেই দেখলাম দুটো ছেলে সে ঘরে ঢুকছে। আবছা অন্ধকারে অবাক হয়ে দেখেছিলাম ওই দুটো ছেলেই আমার পরিচিত। তারা আমাদের বস্তিতেই থাকত। একজনের নাম বিরজু, আর আরেক জনের নাম ছিল কালু। বিরজু আমাকে বস্তিতে নানাভাবে উত্যক্ত করত। মাঝে মধ্যেই আমাকে একা পেলেই আমার ওপর চড়াও হবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি নিজেকে সব সময় ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিতাম। পরে জানতে পেরেছিলাম ওই রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে অজ্ঞান করে আমার বাড়ি থেকে বিরজু আর কালু আমাকে নিয়ে চলে এসেছিল। তারপর অজ্ঞান অবস্থাতেই তারা আমার শরীরটাকে ভোগ করেছিল। বিরজু আর কালু ঘরে ঢুকে আবার আমাকে ভোগ করল। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও ওই দুই বদমাশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না। প্রায় তিন মাস আমাকে তারা ওই ঘরেই বন্দী করে রেখে রোজ একাধিকবার আমাকে পিষে মারত। জায়গাটা কোথায় ছিল আমি সেটাও বুঝতে পারিনি। আজও জানি না। শুধু টয়লেট আর বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলেই সে ঘরটা থেকে বেরোতে পারতাম। তারা দু’জন পাহারা দিয়ে আমাকে বাথরুমে বা টয়লেটে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে সেখানেও আমাকে ''. করত। বাথরুম টয়লেটে যাবার সময় আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম ওটা একটা পোড়ো বাড়ির মত ছিল। আশেপাশে কোনও জনমানুষ দেখতে পেতাম না। তিনমাস সেখানে থাকবার পর বিরজু আর কালু আমাকে আসানসোলের দিকে কোন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে যাবার পরেও আমার দুর্ভোগের শেষ হয়নি। দু’জন মিলে যখন খুশী তখনই আমার শরীরটাকে ভোগ করত। কিছুদিন পর আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লাম। কোন একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তারা আমার গর্ভপাত করিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওই হাসপাতালের ডাক্তার আর ওয়ার্ড বয়েরাও আমাকে নিয়মিত ভোগ করতে শুরু করল। তখন আমাকে নিয়ে তারা দু’জন গ্রামের শেষ ভাগে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। একসময় তাদের পক্ষে বাড়ির ভাড়া মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়তেই রোজ আলাদা আলাদা পুরুষ বাড়ি এসে আমাকে ভোগ করতে শুরু করল। এভাবে আমাকে রোজ অগুনতি পুরুষের কামনার শিকার হতে বাধ্য করা হত। ঘরের বাইরে আমাকে একেবারেই যেতে দেওয়া হত না। আর একা বাথরুম বা টয়লেটেও যেতে দিত না। ২০০৫ সালে আমাকে ওরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অত্যাচারিত হতে হতে আমার ভেতর আর প্রতিরোধের ক্ষমতা একবিন্দুও অবশিষ্ট ছিল না। নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার সামনে আর অন্য কোন পথ ছিল না। কাউকে একটা খবর পর্যন্ত দেবার সাধ্য আমার ছিল না। প্রায় বছরদেড়েক বাদে বাইরের যেসব পুরুষ আমায় ভোগ করতে আসত তাদের একজনের কাছ থেকে কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়ে পরিতোষকে ওই চিঠিটা আমি লিখেছিলাম। তারপর ওই লোকটার মাধ্যমেই চিঠিটা পোস্ট করতে পাঠিয়েছিলাম। সে চিঠি আদৌ পোস্ট করা হয়েছিল কি না বা আদৌ পরি সে চিঠি পেয়েছিল কি না, সেটাও আমি বুঝতে পারিনি। সেদিন পরিই বলল ২০০৭ সালে ওর ট্রেনিং শেষ হবার পর দু’দিনের জন্য বাড়ি এসে ও আমার সেই চিঠিটা পেয়েছিল। বছরের পর বছর এভাবে লাঞ্ছিতা হতে হতে আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমার প্রতিরোধ কমতে কমতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রতিরোধ কমে আসছে দেখে আমার ওপর নজদাড়িতে একটু ঢিল দেওয়া হয়েছিল। আর তখনই সুযোগ পেতেই একদিন সেখান থেকে পালিয়ে বিনা টিকিটেই কলকাতার কোন একটা ট্রেনে চেপেছিলাম। সেটা বছর দেড়েক আগের কথা। হাতে টিকিট ছিল না। দ্বিতীয় আর কেউ সঙ্গেও ছিল না। সুযোগ বুঝে ট্রেনের টিটিও আমাকে ভোগ করল, ট্রেনের টইলেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে। কলকাতা পৌঁছেই আমি আমাদের বস্তিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা আর দাদা আমাকে তাড়িয়ে দিল। ইজ্জত খোয়ানো মেয়েকে তারা নিজের কাছে রাখতে রাজী হলেন না। শুনলাম আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার দিন তিনেক পরই নাকি মা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর শুনেছিলাম গোটা বস্তির লোকেরা এটাই জানে যে আমি কোন ছেলের সাথে স্বেচ্ছায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরিতোষের কথা মনে হয়েছিল তখন। যদিও পরিতোষের সাথে দেখা করার ইচ্ছে আমার ছিল না, তবু যাবার আর কোন জায়গা ছিল না বলে ওর বাড়িতেই গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু বাড়িটা তখন তালা বন্ধ। পরি ছিল না। পরে শুনেছি, ওই সময় সে অন্ধ্রপ্রদেশে ছিল। আর তার সপ্তাহ খানেক বাদেই ও কলকাতা বদলি হয়ে এসেছিল। অভুক্ত অস্নাত অবস্থায় আর কোন জায়গা না পেয়ে রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়েছিলাম। পরের প্রায় এক বছর ভিক্ষে করে যা পেতাম তাই খেতাম। আর রাতে কোন ষ্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়তাম। সেখানেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম না। রেল পুলিশ, রেলের স্টাফ, ষ্টেশনের কুলিরা ছাড়াও অনেকেই খুশী মত আমাকে প্লাটফর্ম থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে আমার শরীরটাকে ভোগ করত। প্রথমবার আসানসোলে গর্ভপাত করাবার সময়ই ভবিষ্যতে আমার সন্তান হবার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে আর প্রেগন্যান্ট হইনি কখনও। আসানসোল থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও নিজেকে আর দশটা লোকের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি আমি। প্রায় রোজ রাতেই কেউ না কেউ আমাকে ভোগ করত। একটা সময় আমিও এটাকেই আমার ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছিলাম। মাস ছয়েক আগে আমার কলেজের এক সহপাঠিনী আমাকে রাস্তায় ভিক্ষে করতে দেখে তার সাথে নিয়ে যায়। সে একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। আমার ওই বিধ্বস্ত চেহারাতেও ও যে কি করে আমাকে চিনতে পেরেছিল জানিনা। আমি তো নিজেই নিজেকে চিনতে পারতাম না। কিন্তু ও আমাকে প্রায় জোর করেই ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। আমি খানিকটা স্বস্তি পেয়ে কোন একটা কাজ টাজ যোগাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারলাম না” এতখানি বলে নবনীতা একটু থামল।
ঘরের সবাই নিশ্চুপ নিথর। বোতল থেকে কিছুটা জল খেয়ে নবনীতা আবার বলল, “এখানে আমার সে বান্ধবীর নাম ঠিকানা আমি ইচ্ছে করেই গোপন রেখে যাব। আমার চরম বিপদের দিনে যে আমায় আশ্রয় দিয়েছে তার কোন ক্ষতি হোক, এ আমি চাই না। আমার বান্ধবীর বস্তির বাড়িতে তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। একটা পঙ্গু ভাইয়ের ভরন পোষনও তাকেই করতে হয়। আমারই মত সেও খুব বেশী লেখাপড়া করেনি। তাই ভাল কোন কাজও জোটাতে পারেনি। ও একটা প্রাইভেট যোগা ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করে। কিছু মনে করো না তোমরা। সে ট্রেনিং সেন্টারের নাম ঠিকানাও আমি গোপন করতে বাধ্য হচ্ছি। সেখানে আমার বান্ধবী পনেরো হাজারের মত মাইনে পায়। কিন্তু অতটুকু পয়সায় নিজের পরিবারের ভরণ পোষন কুলিয়ে উঠত না বলে ও এসকর্ট ব্যবসায় নেমেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। এখন আর ওর পয়সার অভাব তেমন একটা নেই। তাই বস্তির বাড়ি ছেড়ে ও আলাদা এক জায়গায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ওর কাজের ব্যাপারে ও আমাকে সব কিছু বললেও কখনও আমাকে ওর মত এসকর্ট হবার পরামর্শ দেয় নি। আমি ওর ফ্লাটে থেকে ওর পয়সায় খেয়ে অন্য কাজের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চার মাস কেটে যাবার পরেও কোন কাজ জোটাতে সক্ষম হলাম না। ওর আশ্রয়ে আমি অনেক নিরাপদে থাকলেও ওর ঘাড়ের ওপর চেপে থাকতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল। তারপর একদিন আমি নিজেই ওকে বললাম যে আমিও ওর মত এসকর্ট ব্যবসায় নামতে চাই। ততদিনে আমার শরীর স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম যে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তো কত পুরুষ আমার দেহটাকে লুটে পুটে খেয়েছে। এখন না হয় নিজে বেঁচে থাকার তাগিদেই নিজের দেহটাকে পুরুষদের হাতে তুলে দেব। নতুন করে আর কোন ক্ষতি তো হবার ছিল না। আমার বান্ধবী তখন আমাকে ওর ম্যাডামের কাছে নিয়ে যায়। ওর ম্যাডাম আমার একটা ইন্টারভিউ নেন তারপর আমাকেও তার ব্যবসার এসকর্ট বানিয়ে নিলেন। এখন আমিও আমার বান্ধবীর মতই একজন এসকর্ট। সোজা বাংলায় যাকে একটা বেশ্যা বলা হয়। অবশ্য বেশ্যাবৃত্তি তো আমাকে অনেক বছর আগে থাকতেই করতে হত। কিন্তু তখন হাতে কোন পয়সা পেতাম না। এখন আমার শরীরের দাম আমিই পাই। আমার বান্ধবীর সাথে একসাথে থাকি, ওর ফ্ল্যাটের ভাড়া শেয়ার করি, আর দুপুরের পর থেকে নানা পুরুষের মনোরঞ্জন করে পয়সা উপার্জন করি। এই হচ্ছে মোটামুটি ভাবে আমার বর্তমান জীবনের কথা। পরির সাথে আমার আর কখনো দেখা হোক এটা আমি মন থেকেই চাইতাম না। কিন্তু কয়েকদিন আগে পরির মুখোমুখি পড়ে যাই। তারপর পরি আমাকে আবার তার কাছে ডেকেছিল। কিন্তু আমার নোংড়া অপবিত্র শরীরটা নিয়ে ওর ঘরে গিয়ে ওঠা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। পরির প্রতি আমার ভালবাসা এখনও অপবিত্র আছে বলে মনে করি আমি। সেই পবিত্র ভালবাসাকে আমি কিছুতেই কলঙ্কিত করে ফেলতে পারব না। যাকে একটা সময় মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি, সেই নিষ্পাপ লোকটার জীবন কি আমি কলঙ্কময় করে তুলতে পারি? আর ওকে দেবার মত আমার কাছে আর আছেই বা কি? আমি তো আমার শরীর, আত্মা, মান মর্য্যাদা সব কিছু হারিয়ে বসে আছি। মা হবার যোগ্যতাটুকুও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এ অবস্থায় হাজার প্রলোভনেও আমি পরির জীবনটা নষ্ট করতে পারব না। তোমাদের সকলের কাছে আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। এমন অনুরোধ তোমরা কেউ কোর না আমাকে”।
নবনীতা অদ্ভুত দৃঢ়তার সাথে এতগুলো কথা বললেও কথা শেষ করে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সীমন্তিনী পাশ থেকে নবনীতাকে নিজের বুকে চেপে ধরল। সকলের মুখ থেকেই যেন শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিতোষ চেয়ার থেকে উঠে নবনীতার কাছে এসে বলল, “সত্যি কথাটা না জেনে আমি তোমার ওপর অনেক অভিমান করেছিলাম নীতা। অনেক অভিযোগ জমা হয়েছিল আমার মনের মধ্যে তোমার বিরূদ্ধে। তোমার ওপর দিয়ে যে এত ঝড় বয়ে গেছে, সে তো আমি ভাবতেও পারিনি। কিন্তু আজ সব কথা শোনার পর তোমার ওপর আর আমার কোন অভিযোগ রইল না। এখন শুধু ভাগ্যের দোহাই দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ রইল না আমার কাছে। বাবা তোমাকে তার পূত্রবধূ হিসেবে মেনে নিলেও আমার ভাগ্যই তোমাকে আমার কাছে আমার জীবনে আসতে দেয়নি। তোমার চিন্তাধারাকে আমি সম্মান জানাচ্ছি। তবু শেষবারের মত আমি তোমায় বলতে চাই, এত সব কিছু হওয়া সত্বেও আমি তোমাকে নিজের করে নিতে রাজি আছি। আরেকবার তোমাকে অনুরোধ করছি আমার এ প্রার্থনাটুকু স্বীকার করে নাও। সব পরিস্থিতির মোকাবেলা আমি করতে প্রস্তুত আছি”।
অশ্রু ভেজা চোখে পরিতোষের দিকে চেয়ে কান্না ভেজা গলায় নবনীতা বলল, “আমায় ক্ষমা কর পরি। আমি কিছুতেই আমার পবিত্র ভালবাসাকে অসম্মান করতে পারব না। যদি তুমি মন থেকে আমাকে সত্যি ভালবেসে থাক তাহলে আমার অনুরোধ মেনে তুমি একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করে তার সাথে সুখে সংসার কর। তোমাকে সুখী দেখতে পেলেই আমার জীবনের সব চাওয়া আমার পূর্ণ হয়ে যাবে। আমি আর কিচ্ছুটি চাই না। আমি হাতজোড় করে তোমার কাছে এ ভিক্ষাটুকু চাইছি পরি। তোমার ভালবাসার বনি জীবনে এই প্রথমবার তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছে। তুমি তাকে ফিরিয়ে দিও না প্লীজ”।
পরিতোষ হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। সীমন্তিনী কান্নায় ভেঙে পড়া নবনীতাকে নিজের বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল। রচনা নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে বাকি তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছিল।
অনেকক্ষণের প্রচেষ্টায় নবনীতা খানিকটা শান্ত হলে সীমন্তিনী ভারী গলায় পরিতোষকে বলল, “সর্বস্য হারিয়ে বসা একটা মেয়ের মনের দুঃখ সবাই বুঝতে পারবে না পরি। কিন্তু নীতার সব কথা শোনার পর ওর অমন সিদ্ধান্তের জন্য আমি ওকে একেবারেই দোষারোপ করতে পারছি না। নিজের ভালবাসাকে পবিত্র করে রাখতে অনেক মেয়েই এমন ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমি নিজেও তো অনেকটা তাই করেছি। তাই আমি যদি আমার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে ভাবি, তাহলে ওর সিদ্ধান্তের মর্যাদাও আমাকে দিতেই হবে। যে আশা নিয়ে আমি আজ এখানে এসেছিলাম, সে আশা পূর্ণ হচ্ছে না বলে মনটা খারাপ হলেও নীতাকে আমি আর কোন রিকোয়েস্ট করতে পারব না। আমার এখন ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে তোমার জীবনের দুটো পছন্দের মেয়েই তোমার ভালবাসার পূর্ণ পরিণতি দিতে পারল না। কিন্তু পরি, এভাবে তো চিরটা কাল চলতে পারে না। আমি আমার ভবিষ্যৎ স্থির করে নিয়েছি। নীতাও তাই। তোমার মা বাবা বেঁচে থাকলে তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়ত তারাই ভাবতেন। কিন্তু তারা নেই বলেই তুমি তো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারো না। যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। তাই তোমার বন্ধু হিসেবে আমি এটাই চাই যে যত শীঘ্র সম্ভব একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করে তোমাকে এখন সংসারী হতেই হবে। আর এ চাওয়া শুধু আমার নয়। আমি জানি, নীতাও ঠিক এটাই চাইছে”।
পরিতোষ হতাশ ভাবে বলল, “আমার জীবনে তোমরা দু’জন ছাড়া আর তো কেউ নেই মন্তি। এতদিন আসল ব্যাপারটা না জেনে নবনীতার ওপর আমার অনেক অভিমান হয়েছিল। কিন্তু আজ আর ওর ওপর আমার কোন অভিমান নেই। আমার দুর্ভাগ্য। আমার জীবনের দুই নারীই নিজের নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে, সেটা আমি খুব ভালভাবে বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাদের অনুরোধও বা কি করে স্বীকার করে নিই বল? বিয়েটা তো আর একটা ছেলেখেলা নয়”।
সীমন্তিনীর হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে নবনীতা বলল, “জানি পরি, বিয়েটা কোন ছেলেখেলা নয়। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে অনেক ছেলে মেয়েই এখনও তাদের অভিভাবকদের পছন্দ করা অজানা অচেনা পাত্র পাত্রীকে বিয়ে করে খুব সুখেই সংসার করতে পারে। আমার এটুকু জীবনে দুঃখ কষ্ট তো আমি কম কিছু পাইনি। সে’সব ভুলে গিয়ে নিজেকে সকলের কাছে বিলিয়ে দিয়েও আমি এখন অনেক স্বস্তিতে আছি। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করে সংসারী হতে না দেখলে আমি যে সারাটা জীবন একেবারেই শান্তি পাব না। আমার কেবলই মনে হবে তোমার জীবনটাকে আমি ছন্নছাড়া করে দিয়েছি। প্লীজ পরি, আমার এই একটা অনুরোধ তুমি রাখো। আমি আর কক্ষনও তোমার আমার ভালবাসার দোহাই দিয়ে তোমার কাছে কিচ্ছুটি চাইব না”।
নবনীতার কথা শেষ হলে সীমন্তিনীও বলল, “হ্যাঁ পরি, আমিও সেটাই চাই। আমি জানি তোমার মাথার ওপর কোন অভিভাবক নেই। কিন্তু আমি খুব খুশী মনে সে দায়িত্ব পালন করতে রাজি আছি। তোমার জন্যে আমি নিজে একটা উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করব। তোমার যদি তাকে পছন্দ হয় তাহলে তাকেই তুমি বিয়ে কোর। কিন্তু আমাদের এই দুই অভাগীর মত তুমিও বিয়ে করব না বলে পণ করে বোস না প্লীজ। বন্ধু হিসেবে আমি কি তোমার কাছে এতটুকু দাবী করতে পারি না”?
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “আমি তো আগে থেকেই জানতাম, তোমরা কেউ আমার প্রার্থনা শুনবে না। আর এটাও জানতাম যে, আজকের এই দেখা সাক্ষাতের পর ঠিক কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই আলোচনাটা মনে হয় শেষ করা উচিৎ। এবার নিরপেক্ষ হিসেবে বৌদি যা বলবে আমি সেটাই মেনে নেব। বৌদি, তুমি বল। কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়”।
রচনা একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “আমি যে কী বলব সেটা তো বুঝতেই পাচ্ছি না পরিতোষদা। এখানে এসেছিলাম এক উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু ঘটণা এমন একটা দিকে ঘুরে গেল যার কল্পনাই করিনি। আমি তো আপনাদের তিনজনের অবস্থাই বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনারা যে যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে কারুর সিদ্ধান্তকেই আমি ভুল বলতে পাচ্ছি না। কিন্তু এটাও তো ঠিক নয় যে দিদিভাই বা নীতাদিকে নিজের করে নিতে পারছেন না বলে আপনি সারাজীবন বিয়ে না করে এভাবে জীবন কাটিয়ে যাবেন। তাছাড়া একটা মেয়ে হয়ে আমি নীতাদির মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। দিদিভাইয়ের শপথের কথা তো আমি আমাদের বিয়ের আগে থেকেই জানি। আমি এদের কাউকেই নিজের শপথ ভুলে যাবার কথা বলতে পারি না। নিজের নিজের ভালবাসাকে পবিত্র রাখতে এনারা দু’জন যা করছেন, তাকে আমি মোটেও অসমর্থন করতে পাচ্ছি না। তাই আমার মনে হয় দিদিভাই যে সমাধানটা দিচ্ছেন, সেটাই আপনার মেনে নেওয়া উচিৎ। দেখুন পরিতোষদা, এ বয়সে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনিও হয়ত নিশ্চিন্তেই থাকবেন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথাও তো একটু ভেবে দেখতে হবে। আপনি যদি একটা জয়েন্ট ফ্যামিলীর সদস্য হতেন তবু না হয় কথা ছিল। বিপদে আপদে পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরা আপনার দিকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিত। কিন্তু আপনার মাথার ওপর তো কেউ নেই। আজ আপনি শারিরীক ভাবে সুস্থ আছেন বলে একজন জীবনসঙ্গীর কথা হয়ত তেমন ভাবে ভাবছেন না। কিন্তু একসময় এমনও তো হতে পারে যে আপনি একটা অবলম্বনের অভাব বোধ করবেন। তখন হয়ত হাজার চাইলেও দিদিভাই বা নীতাদি আপনার সে অবলম্বন হতে পারবে না। তখন এমন একজনের প্রয়োজন পড়বে যে আপনার একান্ত আপন। আর সেটা হতে পারে কেবল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভেতরেই। তাই আমার মনে হয় অন্য কোনও সুপাত্রীকে আপনার বিয়ে করাই উচিৎ। আর আপনি নিজে সেটা না পারলেও আমার দিদিভাই আপনার জন্য নিশ্চয়ই একটা ভাল মেয়ে খুঁজে বের করতে পারবেন”।
সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই রচনার কথার সমর্থন করতে পরিতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “উহ, আর ভাবতে পারছিনা আমি। ঠিক আছে। তোমরা সবাই যখন এমনটাই চাইছ, তবে তাই হোক। মন্তি যাকে খুঁজে আনবে আমি তাকেই বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলাম”।
নবনীতা সাথে সাথে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ পরি। মন্তিদি আমি তো অসামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। আর নিজে তো অনেক আগে থেকেই নোংরা হয়ে গেছি। তবু বলছি, এ কাজে আমার তরফ থেকে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে বোল। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমার সাহায্যের প্রয়োজন তো হবেই। সে জন্যে আমরা দু’জন কাছাকাছি থাকতে পারলে ভাল হত। তুমি কি কলকাতা ছেড়ে আমার সাথে যেতে পারবে”?
নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “কী বলছ দিদি? কলকাতা ছেড়ে কোথায় যাব আমি”?
সীমন্তিনী খুব সহজ ভাবেই বলল, “কেন কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে তোমার অসুবিধে আছে”?
নবনীতা একটু থতমত খেয়ে বলল, “না তা নয়। কিন্তু কোথায় যাব আমি? আর অন্য কোথাও গিয়ে করবই বা কি”?
সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে যাবে। আমার সাথে থাকবে। আর কী করবে বলছ? প্রথমে আপাততঃ তোমার জন্য একটা সম্মানজনক কাজ খুঁজে দেব আমি। আর তারপর আমরা পরিতোষের জন্য একটা ভাল মেয়ে খুঁজে বের করব। আমার ছোটবোনের মত তুমি তোমার দিদির সাথে থাকবে। তোমার বর্তমান জীবন তোমাকে আর কাটাতে হবে না”।
নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। কয়েক মূহুর্ত অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার দু’চোখ জলে ভরে গেল। কিছু বলার চেষ্টায় মুখ খুলতেই তার ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। মুখ থেকে আর কথা ফুটল না। রচনাও সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রথমটায় চমকে উঠেছিল। কিন্তু পর মূহুর্তেই ভাবল এমন সিদ্ধান্ত তার দিদিভাইই বুঝি শুধু নিতে পারেন। সে নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “হ্যাঁ নীতাদি। তুমি আপত্তি কোর না। আমার দিদিভাইয়ের কাছে গেলে তোমার কোন অমর্যাদা হবে না”।
সীমন্তিনী পরিতোষকে বলল, “পরি আমাদের হাতের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তোমার ব্যাপারে আমি দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি। আর সে দায়িত্ব পালন করবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। কিন্তু আপাততঃ আজ তোমাকে আমার জন্যে তিনটে কাজ করতে হবে”।
পরিতোষ বলল, “বল কী করতে হবে”?
সীমন্তিনী নবনীতার আরেকটা হাত ধরে বলল, “নীতা, তোমার কাছে নিশ্চয়ই মোবাইল আছে। সেটা আমাকে দাও তো আগে”।
নবনীতা কোন কথা না বলে নিজের মোবাইলটা সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে দিল। সীমন্তিনী নবনীতার ফোনের সিমকার্ডটা খুলতে খুলতে বলল, “পরি, নীতাকে এখন আমরা আমাদের সাথেই নিয়ে যাব। তবে সেখানে ওকে রাতে রাখব না। তোমার প্রথম কাজ হবে নবনীতার একটা থাকার জায়গা ঠিক করে দেওয়া। ও আর ওর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে ফিরে যাচ্ছে না। আর তার ওই ম্যাডাম বা তার বান্ধবীর সাথে আর কোন যোগাযোগ করবার চেষ্টাও করবে না। তাই তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে আজ রাত থেকে পনের তারিখ অব্দি নীতাকে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখা। আর তোমার দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে পনের তারিখ আমি যে ট্রেনে যাচ্ছি সেই ট্রেনে নীতার জন্য একটা টিকিট কাটা। পনের তারিখ নীতা আমার সঙ্গেই কলকাতা ছাড়বে। আর তোমার তিন নম্বর কাজ হচ্ছে নীতার জন্যে একটা নতুন মোবাইল যোগার করে দেওয়া। নীতার বর্তমান মোবাইলটা ও আর ইউজ করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ”?
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “বেশ হয়ে যাবে। আর কিছু”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ আরেকটা কাজ অবশ্য আছে। তবে সেটা যে আজই করতে হবে, এমন নয়। তোমার কাছে আমার যে ফাণ্ডটা আছে তা থেকে একটা মাঝারী সাইজের ভাল কোম্পানীর ফ্রিজ আর একটা ভাল কোম্পানীর এলইডি টিভিসেট আর তার সাথে ডিস কিনে আমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেবে প্লীজ”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে হা হা করে কিছু বলতে যেতেই সীমন্তিনী হাত তুলে তাকে বাধা দিয়ে বলল, “তোকে এর মধ্যে কিছু বলতে হবে না রচু” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “করতে পারবে তো”?
পরিতোষ হেসে বলল, “অবশ্যই পারব। তবে তোমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে যে টিভি ফ্রিজ নেই এ’কথা তুমি আমাকে আগেও বলতে পারতে”।
______________________________