Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 126)

পরিতোষ চেয়ারে বসে সকলকে চা খেতে বলে নিজেও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আর দেরী না করে আমাদের আলোচনাটা শুরু করে দিলেই ভাল হয়। আমার ধারণা দু’ এক কথায় আমাদের এ আসর শেষ হবে না। তবে মূল আলোচনা শুরু করবার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা না করে নিলে আলোচনাটা ফলপ্রসু হবে বলে মনে হয় না আমার। মন্তি আর নবনীতা, তোমরা দু’জনেই আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানো, আবার অনেক কিছুই জানো না। আর বৌদি তো বোধহয় আমার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানেন না। তুমি আর নবনীতা তো নিজের নিজের বক্তব্যই শুধু রাখবে। আমার মনের স্থিতি তোমরা সঠিকভাবে ধারণা করতে পারবে না। কিন্তু আমার মনে হয় বৌদিই আজ নিরপেক্ষভাবে নিজের মতামত জানাতে পারবেন। তাই আমার আগেকার কিছু কথা বৌদিকে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করছি আমি। আর এ’সব কথার কিছু কিছু হয়ত তোমাদের দুজনেরও অজানা। তাই আগে সে কথাগুলো বলছি”।

সকলেই চুপচাপ পরিতোষের কথা শুনে যাচ্ছিল। পরিতোষ বলতে লাগল, “শোনো বৌদি, আজ থেকে ন’বছর আগে আমি একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। তখনও আমি পুলিশের চাকরিতে ঢুকিনি। প্রায় বেকারই ছিলাম। এবাড়ি ও বাড়ি টিউশানি করে নিজের হাত খরচা যোগার করতাম। বাড়িতে বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না। মাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছিলাম আমি। ২০০৫এ আমি যখন আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করলাম তখন আমার প্রেমিকাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাবাকে বলেছিলাম যে আমরা পরস্পরকে বিয়ে করতে চাই। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি। আমরা ', হলেও আমার প্রেমিকা ছিল কায়স্থ পরিবারের মেয়ে। আর ওদের সংসারের আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। আমার ঠাকুর্দা ঠাকুমারা জাত পাতের ব্যাপারে বেশ কট্টর ছিলেন। তাই আমার মনে মনে একটু সংশয় ছিল যে বাবা হয়তো আমার সেই প্রেমিকাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করবেন না। কিন্তু কেন জানিনা, সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা এককথায় আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমাকে ইমিডিয়েট হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে যেতে হয়েছিল বলে বিয়ের ব্যাপারটা আর এগোয়নি। তবে বাবা সেদিনই বলেছিলেন, আমার ট্রেনিং শেষ হবার সাথে সাথেই আমাদের বিয়ে দেবেন। আমার প্রেমিকাকে তার পূত্রবধূ করে নেবেন ভেবে বাবা সেদিনই তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। কিন্তু বিধাতা বোধহয় সেটা চান নি। ট্রেনিং-এ যাবার মাস দুয়েক বাদেই বাবা হঠাৎ মারা যান, স্ট্রোকে। বাবার যে হাই ব্লাড প্রেসার ছিল, এটাই আমার অজানা ছিল। ট্রেনিং পেরিয়ডে ছুটি নেওয়া বারণ এ’কথা তো মন্তি তুমিও জানো। কিন্তু স্পেশাল কেস হিসেবে শুধু বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করবার জন্যেই আমাকে সাত দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। বাবাকে দাহ করবার সুযোগ আমি পাইনি। আমার বন্ধুরাই তার দাহ সৎকারের কাজটুকু করেছিল। শ্রাদ্ধের দু’দিন আগে এসে আমি তার শ্রাদ্ধ শান্তি করেছিলাম। তখন সে মেয়েটাও আমার অনেক উপকার করেছিল। মেয়েটা একটা বস্তিতে তার মা বাবা আর বখাটে এক দাদার সাথে থাকত। মেয়েটার বাবা একটা চটকলে কাজ করত। সামান্যই মাইনে পেত। তবু সে সামান্য আয়েই হয়ত তাদের সংসারটা কোন ভাবে চলে যেত। কিন্তু তার বাবার মদের নেশাতেই তার আয়ের প্রায় সবটুকুই চলে যেত। ছেলেটাও কোন রুজি রোজগার করত না। তার ফলে মেয়েটার মাকে অসীম লাঞ্ছণা গঞ্জনা সহ্য করে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে নিজের সংসার চালাতে হত। প্রায় তিন বছর ধরে আমার আর মেয়েটার সম্পর্ক তৈরী হলেও মেয়েটার বাড়ির লোকজনেরা সে ব্যাপারে কিছুই জানত না। তাই ওই সময়টায় মেয়েটার মা বাবা চেষ্টা করছিল কোনভাবে তাদের মেয়েটার একটা বিয়ে দিতে। বাবার শ্রাদ্ধের পর মৎস্যমুখীর পরের দিনই আমি মেয়েটার অনুরোধেই তাদের বাড়ি যাই। তার মা বাবা ও দাদাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলি। আর এ’ কথাও বলি যে আমরা একে অপরকে বিয়ে করতে চাই। মেয়ের বাড়ির সকলেই আমার প্রস্তাবে রাজী হয়েছিল। তখন আমি তাদের বলেছিলাম যে আমার বাবা যেমনটা চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর আমাদের বিয়ে হবে। মেয়েটা ততদিন তার মা বাবার কাছেই থাকবে। তবে তার বাড়ির লোকজনেরা যেন তাকে অন্যত্র বিয়ে দেবার চেষ্টা না করেন। সৌভাগ্যক্রমে তারা সকলেই আমার কথা মেনে নেন। পরের দিন আমি আবার হায়দ্রাবাদ ফিরে গিয়েছিলাম। হায়দ্রাবাদ পৌঁছোবার পরের দিনই খবর পেলাম যে মেয়েটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেদিন আমি তাদের বাড়ি গিয়ে আমাদের বিয়ের কথা বলেছিলাম সেদিন রাতের পর থেকেই তাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তখন আর আমার ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে আসা সম্ভব ছিল না। প্রায় পাগল হয়ে ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে, বন্ধু বান্ধবদের মাধ্যমে সব রকম চেষ্টা করেও কোন ফল হল না। শুধু এটুকু জানতে পারলাম যে যেদিন তার মা বাবার সাথে কথা বলে আমি বিয়ে ঠিক করেছিলাম সেদিন রাত থেকেই মেয়েটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাড়া পড়শিরা বলছিল যে মেয়েটার অমতে তার মা বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছিল বলেই সে রাতেই মেয়েটা তার কোন প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে। কথাটা আমার মোটেও বিশ্বাস হয়নি। কারন আমি তো তাকে তিন বছর আগে থেকে জানতাম। আমি ছাড়া তার জীবনে অন্য কোন ছেলে যে ছিল না, এটা আমি খুব ভাল ভাবেই জানতাম। তাই তার নিখোঁজ হয়ে যাবার পেছনের কারনটা আমি আর কোনদিনই জানতে পারিনি। আমার আড়াই বছরের ট্রেণিং শেষ হবার পর অন্ধ্রপ্রদেশেই আমার পোস্টিং হয়েছিল, ভাইজ্যাগে। আড়াই বছর বাদে ট্রেনিং শেষে ভাইজ্যাগ যাবার আগে আমি দু’দিনের জন্য কোলকাতা এসেছিলাম বাড়ি থেকে আমার কয়েকটা জরুরী জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ির লেটারবক্সে একটা বিবর্ণ চিঠির খাম পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। চিঠিটা কোত্থেকে লেখা হয়েছিল, কতদিন আগে সেটা এসে পৌঁছেছিল বা কতদিন ধরে সেটা আমাদের বাড়ির ওই লেটারবক্সে পড়ে ছিল, কিছুই সেদিন বুঝতে পারিনি। তবে চিঠিটা খুলে দেখেছিলাম আমার প্রেমিকা মেয়েটিই চিঠিটা লিখেছিল। সে তাতে লিখেছিল, আমি যেন তাকে ভুলে যাই, আর অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে আমি যেন সুখে থাকি। তখন মেয়েটার বাপের বাড়িতেও আমি গিয়েছিলাম। মেয়েটার খোঁজ তারাও কেউ দিতে পারেনি। আর শুনলাম মেয়েটা পালিয়ে যাবার পর তার মা-ও নাকি আত্মহত্যা করেছিল আগেই। নিজের জীবনের একমাত্র ভালবাসাকে হারিয়ে ফেলে আমি আবার ভাইজ্যাগে চলে গিয়েছিলাম। আজ থেকে বছর তিনেক আগে হায়দ্রাবাদ ট্রেনিং সেন্টারেই আমি মন্তিকে প্রথমবার দেখি। মন্তিকে দেখবার পর একসময় আমার মনে হল এ মেয়েটাকে জীবনসঙ্গী করতে পারলে হয়ত আমার আগের প্রেমিকাকে ভুলতে পারব। তবে আগের বারের মত প্রেমে অন্ধ হবার আগেই আমি মন্তিকে সোজাসুজি প্রোপোজ করেছিলাম। আর মন্তিও তার অপারগতার কথা বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে সোজাসুজিই জানিয়ে দিয়েছিল যে সে আজীবন অবিবাহিতা থাকবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সীমন্তিনী আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেও তার সহজ সোজা কথায় আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। আমাদের দু’জনের ভেতরে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও মন্তি আমার বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। সে বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। মন্তির হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং শেষ হবার আগেই আমি কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে এলাম। হঠাৎ সপ্তাহ তিনেক আগে আমি কোলকাতার এক রাস্তাতেই আমার প্রেমিকা সেই মেয়েটিকে দেখতে পাই। তার সাথে কথা বলে আমি আবার তাকে আমার জীবনে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে এবারেও আমার ডাকে সাড়া দিল না”।

এতখানি বলে পরিতোষ থামতেও কেউ কোন কথা বলল না। কয়েক সেকেণ্ড বিরতি দিয়ে পরিতোষ রচনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বৌদি তোমার দিদিভাই এখনও তার সে সিদ্ধান্তে অটল আছে। আর আমি জানি আজীবন সে তাই-ই থাকবে। কিন্তু সে চাইছে আমি যেন আমার পছন্দের কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হই। সে আমাকে আমার নিজের পছন্দের একটা মেয়ে খুঁজে বের করতে বলেছে। তাকে আমি কয়েকদিন আগে বলেছি এমন একজনকে আমি খুঁজে পেয়েছি ঠিকই। কিন্তু সেও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। আর এ’কথাও বলেছি যে মন্তি কলকাতা এলে আমি তাকে মেয়েটার কাছে নিয়ে আসব”।

বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “মন্তি, নবনীতাই সেই মেয়ে যার সাথে আমি তোমাকে দেখা করাব বলে কথা দিয়েছিলাম। নবনীতাও আমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত নয়। তাহলে বৌদি, এবার তুমি নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে বল তো আমার কি করা উচিৎ”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই মাথা নিচু করে চুপ করে বসেছিল। রচনা নিজের গলা পরিস্কার করে বলল, “আচ্ছা পরিতোষদা, আপনার কথা তো সবটাই শুনলুম। খুবই দুঃখজনক। কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না। দিদিভাইয়ের নাম তো আপনি বললেন। কিন্তু আপনার সেই প্রেমিকাটির নাম কিন্তু একটিবারও উচ্চারণ করেননি আপনি। এর কারনটা কি জানতে পারি”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “সেটা ইচ্ছে করেই এতক্ষণ বলিনি বৌদি। তবে আমার মনে হয় সেটা না বললে তুমি বা মন্তি গোটা ব্যাপারটা ঠিক মত বুঝতে পারবে না। আমার সেই প্রেমিকাটি হচ্ছে তোমার পাশে বসে থাকা অপর মহিলাটি। মানে নবনীতা”।

পরিতোষের কথা শুনে সীমন্তিনী আর রচনা এমনভাবে চমকে চিৎকার করে উঠল যেন ঘরের ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছে। আর নবনীতা মাথা নিচু করে নিজের চোখের জল মুছে যাচ্ছে। সীমন্তিনী আর রচনা অনেকক্ষণ হতভম্বের মত হাঁ করে বসে থাকবার পর সীমন্তিনীই প্রথম নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “পরি কি ঠিক বলছে নবনীতা? তোমাকেই ও ন’বছর আগে থেকে ভালবাসত”?

নবনীতা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ দিদি। ও যতটুকু জানতো তার সবটুকুই ঠিকঠাক বলেছে। কিচ্ছু বাড়িয়ে বলেনি। কিচ্ছু লুকিয়েও যায়নি। আমাকেই ও ন’বছর আগে ভাল বেসেছিল”।

রচনা এবার আর থাকতে না পেরে নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমিও কি তাকে ভালবাসতে না”?

নবনীতা মাথা নিচু করেই নিজের চোখের জল সামলাতে সামলাতে জবাব দিল, “বাসতাম বৌদি, আমিও ওকে ভালবাসতাম। নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতাম”।

রচনা আবার সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল, “আর এখন? এখন তুমি পরিতোষদাকে ভালবাস না”?

নবনীতা নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, “এখনও বাসি। হয়ত জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি শুধু ওকেই ভালবেসে যাব”।

রচনা এবার পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “তুমিও নীতাদিকে এখনও ভালবাস পরিতোষদা”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “আমি তো জীবনে শুধু মাত্র ওকেই ভালবেসেছি বৌদি। এখনও একই সমান ভালবাসি। আমি তো ওকে কয়েকদিন আগেও বলেছি যে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু ও সেটা কিছুতেই মানতে চাইছে না”।

রচনা আবার নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে সমস্যাটা কোথায় নীতাদি”?

নবনীতা কোন কথা বলার আগেই দরজার বাইরে থেকে বিট্টু বলে উঠল, “দাদা আপনাদের ব্রেকফাস্টটা এখানে এনে দিয়ে দিই”?

পরিতোষ একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ বিট্টু, নিয়ে আয়”।

নবনীতা তাড়াহুড়ো করে নিজের চোখ মুছে নিতেই বিট্টু ঘরে ঢুকে প্রথমে খালি চায়ের কাপগুলো নিয়ে গেল। তারপর একমাত্র টেবিলটার ওপর লাঞ্চ প্যাক গুলো রাখতে রাখতে বলল, “প্যাকেট শুদ্ধোই দেব? না প্লেটে সাজিয়ে আনব”?

সীমন্তিনী বলল, “না ভাই তোমাকে আর কিচ্ছু করতে হবে না। আমরা প্যাকেট হাতে নিয়েই বসে বসে খাব। তুমি শুধু চারটে জলের বোতল এখানে দিয়ে যাও”।

পরিতোষ বিট্টুকে বলল, “তুই আর মাসিমাও খেয়ে নিস কেমন”?

বিট্টু “ঠিক আছে দাদা” বলে জলের বোতল গুলো প্রত্যেকের কাছে একটা একটা রেখে ঘর থেকে চলে গেল। বিট্টু চলে যাবার পর নবনীতা বলল, “আমার কাছে তোমাদের যে অনেক প্রশ্ন আছে, আর তার জবাব যে আমাকে আজ দিতেই হবে, এটা আমি আগে থেকেই জানতাম মন্তিদি। কিন্তু আমি কিছু বলার আগে মনে হয় ব্রেকফাস্টটা সেরে নেওয়া উচিৎ। তাই কেউ আপাততঃ আর কোন প্রশ্ন না করে খেয়ে নাও”।

সকলেই নবনীতার কথা মেনে নিয়ে নিজের নিজের প্যাকেট হাতে নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। একেক জনের মনের ভেতর এক একরকম প্রশ্ন। সীমন্তিনী ভাবছে পরিতোষ তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসাকে আবার চোখের সামনে দেখতে পেয়ে তাকে নিয়েই বাঁচবার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু নবনীতা নিজেই তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রচনা ভাবছে, আগে যা হবার তাই নয় হয়েছে। কিন্তু এখনও যদি দু’জন দু’জনকে ভালবাসে তাহলে একসাথে ঘর বাঁধতে বাঁধাটা কিসের হতে পারে? পরিতোষ ভাবছে, এ জীবনে যে দুটো মেয়েকে নিয়ে ঘর বাঁধার কথা সে ভেবেছিল, তারা দু’জনেই এ মূহুর্তে তার সামনে বসে আছে। কিন্তু এমনই কপাল তার যে তাদের কাউকে নিজের করে নেবার ক্ষমতা তার নেই। আর নবনীতা ভাবছে, সে নিজে আর কোনভাবেই পরিতোষের সাথে নিজেকে জড়াতে চায় না। তার মনের এবং অতীতের সব কথা জানবার পর মন্তিদি যদি পরিতোষকে বিয়ে করতে রাজি হত তাহলে সে-ও খুব খুশী হত। কিন্তু মন্তিদির জীবনে এমন কী হয়েছে যে সেটার জন্যেই সে চির অবিবাহিতা থাকবার পণ করেছে!
 

খাওয়া শেষ করে পরিতোষ রচনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বৌদি, এরা দু’জনেই নিজ নিজ কথার স্বপক্ষে অনেক যুক্তি দেখাবে। তারা আমার দিকটা কেউ দেখতে চাইবে না আমি জানি। তুমি হয়ত তোমার দিদিভাইয়ের এমন ধনুকভাঙ্গা পণের ব্যাপারে জেনেই থাকবে। তোমার দিদিভাইকে আমি যতই ডার্লিং, প্রেয়সী, সুইটহার্ট বলে ডাকি না কেন, আমি খুব ভালভাবে জানি তার প্রতিজ্ঞা থেকে তাকে কিছুতেই টলানো যাবে না। হয়ত তুমিও জানো সে’কথা। আর সে চেষ্টাও আমি করি না। তার প্রতি আমার অনুরাগ বা ভালবাসা জন্মাবার আগেই সে আমাকে সবকিছু পরিস্কার করে বলেছিল। তার অমন প্রতিজ্ঞার কারণটা জানবার পর আমিও তার মতকে সমর্থন করেছি। করেছিই যে তা নয়, বরং বলা ভাল করতে বাধ্য হয়েছি। তাই মন্তিকে বিয়ে করার কথা আমি আর মনেই আনতে চাই না। কারন এখনও সেটা করতে চাইলে মন্তির মনের ওপর জোর খাটাতে হবে। কিন্তু আমি খুব ভালভাবেই জানি, জোর করে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও কারুর ভালবাসা পাওয়া যায় না। তাই মন্তি প্রথম যেদিন তার অসামর্থতার কথা বলেছিল সেদিন থেকেই আমি তার কথা মেনে নিয়েছি। কিন্তু সে যাকে মনে মনে ভালবাসে সে ভালবাসার প্রতি আমি নিজেও শ্রদ্ধা জানাই। কাউকে যে এভাবে সারাজীবন ভালবাসা যায় তা মন্তিকে না দেখলে আমি বুঝতেই পারতাম না। তাই আমিও সেভাবে মন্তিকে কখনও ভালবাসিনি। আমি ভালবেসেছিলাম তো শুধু এই নবনীতাকেই। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখ। নবনীতাকে ভালবেসে যে নামে একসময় ওকে ডাকতাম সে নামটাও এখন সে আর আমার মুখ থেকে শুনতে চায় না। আর সীমন্তিনী আমাকে কোন সম্বোধন করতেই বাঁধা দেয় না। আমাকে ভাল না বাসলেও আমার প্রেমিকা না হয়েও সে আমার মুখে প্রেমিকার সম্বোধন পেতে লজ্জা বোধ করে না। এতেই তো স্পষ্ট, নিজের ভালবাসার ওপর এখনও তার কতটা আস্থা আছে। প্রেম বিশ্বাস আর ভালবাসার দিক দিয়ে বিচার করলে মন্তি আমার থেকে অনেক অনেক ওপরে। সেই উঁচু আসন থেকে তাকে আমি টেনে নামিয়ে আনতে চাই না। তাই ওকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু যাকে আমি ন’বছর আগে থেকে ভালবেসে আসছি, যে নবনীতা আজও বলছে সে আমাকে এখনও ভালবাসে, তাকে নিয়েও ঘর বাঁধার স্বপ্ন আমি দেখতে পাচ্ছি না। মন্তি বলছে, ‘তুমি একটা ভাল মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে কর’। আর নবনীতাও বলছে ‘তুমি বিয়ে করে সংসারী হও। তাহলে আমিও খুশী হব’। কিন্তু আমি যে আমার জীবনে অন্য কোনও মেয়েকে খুঁজে পাইনি। এবার তুমি নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে বল তো দেখি বৌদি, এ অবস্থায় আমার কী করণীয়”?
 

ততক্ষণে সকলেরই খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রচনা পরিতোষের কথা শুনে নবনীতাকে বলল, “নীতাদি, এখানে আসবার আগে দিদিভাই বলেছিল যে আমরা পরিতোষদার জন্য একটা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। তুমি যখন গাড়িতে উঠলে তখন আমার মনটা খুশীতে ভরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম তোমাদের জুটিটাকে খুব ভাল মানাবে। কিন্তু পরিতোষদার মুখে এতক্ষণ যা শুনলাম তাতে আমিও অবাক হবার সাথে সাথে দুঃখও পাচ্ছি। পরিতোষদাকে তুমি এখনও ভালবাস বলছ। তা সত্বেও বিয়েতে রাজি হচ্ছ না কেন সেটা তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না”।

নবনীতা এবার বেশ ধীর শান্ত গলায় বলল, “বৌদি, পরিস্কার আকাশে পুর্ণিমার চাঁদকে দেখতে তো সকলেরই ভাল লাগে। আমি মাঝে মাঝে সে দৃশ্য দেখে ভাবি ওই চাঁদটার গলায় যদি একটা গন্ধরাজ ফুলের মালা পড়িয়ে দিতে পারতাম, তাহলে কী অসাধারণ সুন্দরই না লাগত। কিন্তু বাস্তবে কি সেটা হয়? চাঁদের গলায় মালা কেউ কি আর পড়াতে পারে? তাই পরিতোষ চিরটা কাল আমার কাছে সুদুর আকাশের চাঁদ হয়েই থাকবে। দুর থেকে আমি তাকে দেখতে পাব। কিন্তু তার গলায় আমার হাতের মালা কিছুতেই পড়াতে পারব না আমি”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “কিন্তু তুমি এমন ভাবছ কেন নীতা? পরিতোষ তো তোমাকে এখনও চাইছে? সে তো তোমার হাতের মালা নিজের গলায় নিতে প্রস্তুত আছে”।

নবনীতা আগের মতই শান্তভাবে জবাব দিল, “পরিতোষকে আমি আজও ভালবাসি মন্তিদি। পরিতোষ সুখে থাকুক এটাই আমার জীবনের একমাত্র কাম্য। কিন্তু তার পবিত্র ভালবাসাকে কলুষিত করার অধিকার যে আমার নেই। যেদিন পরি আমার মা বাবার সাথে কথা বলে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করে গিয়েছিল সেদিন আমার খুশীর সীমা ছিল না। সে রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সুখের দিনটার কল্পণা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, তখন নিজেকে একটা অপরিচিত ঘরের ভেতর দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। আমার পরণের নাইটিটা ফালা ফালা হয়ে আমার শরীরের সাথে এদিক ওদিক দিয়ে ঝুলছিল। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম। খানিক বাদেই বুঝতে পেরেছিলাম কেউ আমার চরম সর্বনাশ করে গেছে”।

এটুকু শুনেই ঘরের বাকি তিনজন চমকে উঠল। রচনা থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “ওমা সেকি? কে তোমার অমন অবস্থা করেছিল নীতাদি”?
 

(To be continued .......)
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 11-03-2020, 10:09 PM



Users browsing this thread: 11 Guest(s)