09-03-2020, 10:55 PM
(Update No. 124)
রচনা ফোন নামিয়ে রাখতেই রতীশ তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি মন্তিকে ও’সব মিথ্যে কথা বললে কেন রচু”?
রচনা স্বামীর একটা হাত ধরে বলল, “তুমি রাগ করেছ? না সোনা রাগ কোর না। আসলে ভেবেছিলাম যে আমি সত্যি কথাটা বললে দিদিভাই আমাকে বকবেন। হয়ত বলবেন কি দরকার ছিল তার জন্যে শাড়ি কিনতে যাবার। আর তাছাড়া দিদিভাই এখানে আসবার পর তাকে আমি সত্যি কথাটা বলবই। শাড়িটা দিয়ে তাকে আমি একটা শুধু সারপ্রাইজ দিতে চাই। তুমি প্লীজ আমার ওপর রাগ কোর না সোনা”।
রতীশ রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও, এই কথা? তবে ঠিক আছে। এবার এস তো আমার আদরের বৌটাকে একটু ভাল করে আদর করি”।
রচনাও রতীশকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।
*****************
দশ তারিখ ভোর বেলা রতীশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই রচনা খুশী ভরা মনে আলুর দম বানাবার যোগার যন্ত্র করতে লাগল। রতীশ আগের দিন সব্জী আর মুদির দোকান থেকে অনেক কিছু কিনে এনেছে। রচনা ভেবেছে সীমন্তিনীর জন্যে ছোলার ডালের রসা বানাবে। সীমন্তিনী নিজেই বলেছে সেটার কথা। আর সীমন্তিনীর কথাতেই সে আগের রাতে ছোলার ডাল জলে ভিজিয়ে রেখেছিল। রচনা মনে মনে ভাবল, আগে আলুর দমটা বানিয়ে হাতে সময় থাকলে ছোলার ডালগুলো বেঁটে মুঠো করে সেদ্ধ করে রাখতে পারলে রান্নার সময় সময়টা কম লাগবে। সকাল সাতটার মধ্যেই আলুর দম তৈরী হয়ে গেল। তারপর ছোলার ডাল গুলো বাটতে শুরু করতেই সীমন্তিনীর ফোন এল। জানাল যে সে হাওড়ায় পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে সোজা বাড়ি আসবে। রচনা খুব খুশী হয়ে ডাল বাটতে শুরু করল।
আটটা বাজতে না বাজতেই রতীশের ফোন এল। জিজ্ঞেস করল “মন্তি ফোন করেছিল রচু? ও কি হাওড়া পৌঁছে গেছে”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ সোনা, দিদিভাই সাতটার দিকেই হাওড়া পৌঁছে গেছেন। প্রায় একঘণ্টা তো হয়েই গেল। নিশ্চয়ই আর খানিকক্ষণের ভেতরেই চলে আসবেন”।
ফোনে কথা বলতে বলতে রচনা তাদের ব্যালকনিতে এসে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাল। একটু দুরে পানের দোকানটার সামনে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন ট্যাক্সি বা অটো দেখা যাচ্ছে না। ফোনে কথা শেষ করতেই মনে হল ব্যালকনির নিচে রাস্তায় একটা গাড়ি স্টার্ট হবার শব্দ পাওয়া গেল। তাদের বিল্ডিঙের সামনেটা ব্যালকনি থেকে চোখে পড়ে না। রচনা মনে মনে ভাবল এ গাড়িটা কার? এ গাড়িতেই আসেননি তো দিদিভাই? ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেল একটা ট্যাক্সি বাড়ির দিক থেকে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তার ঠিক পেছনেই আরেকটা ট্যাক্সি দেখা গেল। দ্বিতীয় ট্যাক্সিটা পানের দোকানটার কাছে গিয়ে থামতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো লোক গাড়িটার কাছে এগিয়ে গেল। আর খানিক বাদে দু’জন লোক গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা আবার বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। আর প্রায় সাথে সাথে ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। রচনা চমকে উঠে ড্রয়িং রুমের ভেতর ঢুকে সামনের দরজার ম্যাজিক আইয়ের ফুটোয় চোখ রেখে সীমন্তিনীকে দেখেই “দিদিভাই” বলে চেঁচিয়ে উঠে দরজা খুলে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল।
সীমন্তিনীও “রচু, রচু, সোনা বোন আমার” বলতে বলতে রচনাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। খুশীতে রচনার দু’চোখ জলে ভরে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে আবেগ সামলে রচনা বলল, “এস দিদিভাই, ভেতরে এস। তোমার লাগেজ কোথায়”?
সীমন্তিনী দরজার বাইরে থেকে নিজের লাগেজটা ভেতরে আনতেই রচনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তোমার দাদাভাই এইমাত্র ফোন করেছিলেন। খোঁজ নিচ্ছিলেন তুমি এসে পৌঁছেছ কি না। দাঁড়াও এখন ওনার ব্রেকফাস্ট ব্রেক চলছে। খবরটা এখনই জানিয়ে দিই। নইলে চিন্তায় থাকবেন। তুমি বোসো দিদিভাই” বলে রতীশকে ফোন করল। রতীশ ফোন ধরতেই রচনা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁ শোনো, দিদিভাই এইমাত্র ঘরে এসে পৌঁছেছেন। তুমি তোমার ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ শোনো, বলছি কি, আজ আর তোমাকে মাছ আনতে হবে না। দিদিভাইকে বরং কাল মাছ খাওয়াব। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এস। এই নাও দিদিভাইয়ের সাথে একটু কথা বল” বলে ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল।
সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বলল “দাদাভাই, আমি এই জাস্ট এসে পৌঁছলাম। তুই কখন আসবি রে”?
রতীশ বলল, “ন’টা থেকে সাড়ে দশটা আমার একটা কোচিং আছে। তারপরই ছুটি”।
সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তোর সেশন শেষ হলে তাড়াতাড়ি চলে আসিস। তোকে আজ আর কোথাও গিয়ে মাছ টাছ আনতে হবে না। কাল দেখা যাবে। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় শুধু”।
“আচ্ছা ঠিক আছে” বলে রতীশ ফোন কেটে দিতেই সীমন্তিনী রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে রচু, আলুর দম আর লুচি বানিয়েছিস তো”?
রচনা নিজের আলমারি খুলে একটা ধোয়া নাইটি বের করে সীমন্তিনীকে দিয়ে বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। আলুর দম হয়ে গেছে। লুচির আয়োজনও করে রেখেছি। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এস। আমি গরম গরম ভেজে দিচ্ছি”।
রচনা সীমন্তিনীকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কিচেনে গিয়ে লুচি বানাবার আয়োজন করতে লাগল। হঠাৎ ড্রয়িং রুমের ভেতর থেকে ফোন বেজে ওঠার শব্দ পেয়েই রচনা ছুটে এসে দেখল সীমন্তিনীর ফোনটা বেজে যাচ্ছে। সীমন্তিনী বাথরুমের ভেতর থেকে নিজের ফোনের শব্দ চিনতে পেরে দরজা না খুলেই চেঁচিয়ে বলল, “রচু ফোনটা ধরে একটু বলে দে আমি খানিকক্ষণ বাদে কলব্যাক করব”।
রচনা কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগাতেই ভারিক্কি পুরুষকণ্ঠে কেউ একজন বলে উঠল, “তুমি যে তোমার দাদাভাইয়ের বাড়ীতে পৌঁছে গেছ সে খবর তো আমি পেয়েই গেছি। কিন্তু ডার্লিং, তুমি নিজে একটা ফোন করে আমাকে একটু আশ্বস্ত করলে আমি আরেকটু খুশী হতাম”।
সীমন্তিনীকে কেউ “ডার্লিং” বলে সম্মোধন করছে শুনেই রচনা এক মূহুর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেল। সে কী বলবে না বলবে ভাবতে ভাবতেই পুরুষ কণ্ঠটি আবার বলে উঠল, “কি ব্যাপার সুইট হার্ট, একেবারে সাড়া শব্দটি নেই যে? তুমি ঠিক আছ তো? এনি প্রব্লেম? দাদা-বৌদি ভালভাবে আপ্যায়ন করেছে তো তোমাকে? না কি”?
রচনা একটা ঢোঁক গিলে তাড়াতাড়ি বলল, “দিদিভাই বাথরুমে স্নান করছেন। আপনাকে একটু বাদে ফোন করবেন বলেছেন”।
কোনরকমে কথাটুকু বলে ফোনটা অফ করতে যেতেই ও’পাশ থেকে আবার বলল, “স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি যে ফোনটা অন্য কেউ ধরেছে। আপনি নিশ্চয়ই মন্তির বৌদিসোনা। কিন্তু ওভাবে না জেনে শুনেই ও’কথাগুলো বলা আমার ঠিক হয়নি। কিছু মনে করবেন না প্লীজ। রাখছি” বলতেই লাইন কেটে গেল।
রচনা ফোনটা দেখে বুঝল ‘পরি’ বলে কোন একজন ফোনটা করেছিল। ফোনটা টেবিলে রেখে সে আবার কিচেনে আসতে আসতে ভাবতে লাগল, লোকটা কে? ‘পরি’ বলে কারুর কথা তো সে দিদিভাইয়ের মুখে কখনও শোনেনি। কিন্তু লোকটা তো দিদিভাইকে মন্তি বলে ডাকছে! তাকে ডার্লিং, সুইট হার্ট বলছিল ফোনে। এমন ভাবে তো প্রেমিক বা স্বামীরাই কথা বলে। দিদিভাই কি তাহলে এ লোকটার সাথে প্রেম করছে? এ’কথা মনে হতেই রচনার মনটা খুশীতে ভরে উঠল। মনে মনে বলল, “হে ভগবান, তাই যেন হয়। আমার দিদিভাইয়ের একটা ঘর-বর হলে এর চেয়ে সুখের খবর আর কি হতে পারে”।
সীমন্তিনী স্নান সেরে বেরোতে রচনা কিচেন থেকেই বলল, “দিদিভাই, চুল আঁচড়ে এ ঘরে চলে এস। হয়ে গেছে আমার”।
লুচি, আলুর দম, ছোলার ডালের ধোকার রসা, আর পায়েস। আলুর দম দিয়ে লুচির একটা টুকরো মুখে ফেলেই সীমন্তিনী একহাত দিয়ে পাশে বসা রচনার একটা হাত ধরে বলল, “উম্মম কী বানিয়েছিস রে রচু সোনা! তোর মনে আছে? তোদের বিয়ের পরদিন বাড়িতে তুই জোর করে লুচি আলুর দম বানিয়েছিলি। জেঠু বাবা কাকু সবাই খুব খুব প্রশংসা করেছিল তোর। মায়েরা সেদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও তারাও যে খেয়ে খুব খুশী হয়েছিলেন সেটাও মনে আছে আমার। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশী টেস্টি হয়েছে রে। আঃ দারুণ। এতদিন তোর হাতের রান্না বড্ড মিস করেছি রে”।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “লক্ষীদির হাতের রান্না কেমন গো দিদিভাই? ভাল”?
সীমন্তিনী খেতে খেতেই জবাব দিল, “ঠিকই আছে মোটামুটি। চলে যায় কোনরকম। মাঝে মাঝে সত্যিই খুব ভালো রাঁধে। মাঝে মধ্যে আবার অতটা ভাল হয় না। আচ্ছা রচু, আমি যখন স্নান করছিলাম তখন কে ফোন করেছিল রে? ফোনটা তো আর দেখাও হল না”।
রচনা খেতে খেতেই জবাব দিল, “নামটা তো ঠিক বলেননি দিদিভাই। তবে আমি কলটা রিসিভ করে কিছু বলে ওঠবার আগেই, বাড়ি পৌছে তুমি তাঁকে কোন খবর দাওনি বলেই একটু অনুযোগ করছিলেন। তুমি বাথরুমে আছ শুনে, আর তেমন কিছু বলেননি। কলটা কেটে যাবার পর দেখলাম “পরি” নামের কেউ একজন ফোন করেছিলেন”।
রচনার মুখে এ’কথা শুনেই সীমন্তিনী নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এই সেরেছে রে। নিশ্চয়ই কথা বলবার আগেই ডার্লিং, প্রেয়সী, সুইটহার্ট- এসব বলেছে তাই না”?
রচনা একটু মনঃক্ষুণ্ণ ভাবে বলল, “এ ভদ্রলোকের কথা তো কখনও আমাকে বলনি দিদিভাই। কতদিন ধরে তার সাথে জানা শোনা তোমার? আমাকেও তুমি জানতে দাও নি”?
সীমন্তিনী খেতে খেতে রচনার হাতটা ধরেই বলল, “হু, যা ভেবেছি, ঠিক তাই। তুই নিশ্চয়ই ভেবেছিস ওর সাথে আমি প্রেম করছি। তাই না”?
রচনা বেশ শান্ত গলায় বলল, “অমন ভাষায় প্রেমিক আর স্বামী ছাড়া আর কেউ কথা বলে বলে তো আমার জানা নেই দিদিভাই। কিন্তু অবাক হচ্ছি এই ভেবে, যে তুমি আমার কাছে থেকেও সে’সব কথা বেমালুম চেপে গেছ এতদিন”?
সীমন্তিনী আর থাকতে না পেরে জোরে ‘হাহা হা’ করে হেসে উঠে বলল, “আমি ঠিক জানতুম। তুই এ’সব কথাই বলবি। আরে পাগলী, তুই তো আমার জান রে। তোর কাছে আমি কিছু লুকোতে পারি? তুই যা ভাবছিস তা নয়রে পাগলী। ওর কথা বার্তাই অমন। যখনই ফোন করবে তখন আগে ওই সব শব্দ গুলো ব্যবহার করবেই। ডার্লিং, সুইট হার্ট, প্রেয়সী, প্রিয়তমা - যা মুখে আসে তাই বলে। কিন্তু খুব ভাল লোক রে। আমার কলিগ আইপিএস অফিসার। আমার চেয়ে বছর চারেকের সিনিয়র। বয়সে অবশ্য অত বড় নয় আমার চেয়ে। মোটে বছর দুয়েকের মত বড়। ও আমার বড় বলেই আমাকে নাম ধরে ডাকে। আর ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বলে আমিও ওকে ছোট নামে ডাকি। পরি বলে। ওর আসল নাম হচ্ছে পরিতোষ। তবে তুই একেবারেই ভাবিস না যে তার সাথে আমার কোনরকম প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক আছে”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছ তো? না আমাকে টুপি পড়াচ্ছ দিদিভাই”?
সীমন্তিনী রচনার হাতটা ধরেই বলল, “তুই এ কথা ভাবছিস কি করে যে আমি তোর কাছে মিথ্যে কথা বলব? তুই জানিসনা? যেদিন থেকে তুই সম্পর্কে আমার বৌদি হয়েছিস সেদিন থেকেই তুই যে আমার জীবনের সব কিছু হয়ে উঠেছিস রে। আমি হয়ত নিজের মনকে ধোকা দিতেও মনে মনে কোন মিথ্যে কথা বলতে পারি। কিন্তু তোকে কখনও মিথ্যে বলতে পারব না। খুব বেশী প্রয়োজন হলে তোর কাছে হয়ত আমি কিছু কথা গোপন রেখে যেতে পারি। তবে সেটাও সাময়িক। তোর কাছে কিছু গোপন করে রাখলেও সময়মত তোকে সেটা খুলে বলবই আমি। আর তুই তো জানিসই আমার জীবনের একটা কথাই শুধু আমি তোর কাছে এখনও গোপন রেখেছি। সেটাও তোকে ঠিক সময়ে বলব। আর তখন গোপন রাখার কারনটাও জানতে পারবি তুই। তবে তুই বিশ্বেস কর বোন। এই পরি আমার শুধুই একজন খুব ভাল বন্ধু। আমার জীবনে বর্তমানে ওর চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই। তাই ওর ওই আবোল তাবোল কথাগুলো শুনেও না শোনা করে উড়িয়ে দিই”।
রচনা একটু সহজ হয়ে উঠে বলল, “তার মানে তুমি বলছ আমার কাছেও কিছু গোপন কর তুমি”?
সীমন্তিনীও সহজেই জবাব দিল, “হ্যা করিই তো। আর সে কি আজকের থেকে? তোর সাথে আমার যেদিন পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকেই তো এমন গোপন রাখতে শুরু করেছি। পুরনো কথাগুলো সব কি ভুলে গেছিস তুই? তোর সাথে যখন আমার পরিচয় হয়েছিল, তখন তোরা কেউ কি জানতিস যে আমি রতীশ ভট্টাচার্যির ছোট বোন। বা এটাও কি বুঝতে পেরেছিলিস যে তোকে আমার দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দেব বলেই তোর সাথে আর ভাই, মাসি মেসোর সাথে ভাব করেছিলাম। নিজের পরিচয় গোপন রেখেই তো তোর সাথে ভাব করেছিলাম আমি। কিন্তু ঠিক সময়ে আমি নিজেই তো সে গোপনতার ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়েছিলাম তোদের কাছে। এখনও অনেকের কাছে অনেক কথা আমি গোপন যাই। আবার সঠিক সময় এলে এসব কথাও সবাইকে খুলে বলি। এ’কথাও তো তোকে আগেই বলেছি আমি। আর পুলিশের কাজে আমাদের নানা সময় নানা জনের কাছে অনেক কিছু গোপন রাখতেই হয় রে। নিজের লোকদের কাছেও। সেটা আমাদের সার্ভিসেরই একটা অঙ্গ বলতে পারিস। এই তো দেখনা, তোদের দিদিভাই যে একজন পুলিশ অফিসার এটা তো কলকাতায় সকলের কাছ থেকে আমি গোপন রাখতে চাইছি। তোদেরকেও সে সত্যিটা গোপন রাখতে বলেছি। প্রয়োজন আছে বলেই। আর সে প্রয়োজনটা কিসের সেটাও পরে কখনও নিশ্চয়ই জানতে পারবি তোরা। তবে এই মূহুর্তে তোর কাছে পরিকে নিয়ে আমি যে কোন কথা গোপন করছি না, এটা তুই বিশ্বাস করতে পারিস”।
রচনা খেতে খেতেই বলল, “তা তোমার এই পরির সাথে তোমার কতদিনের পরিচয় দিদিভাই? এটা বলা যাবে? না এটাও গোপন রাখবে আপাততঃ”?
সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে রচনার একটা গাল টিপে দিয়ে বলল, “খুব দুষ্টুমি করতে শিখেছিস না? খুব পেকেছিস। তবে শোন, পরিতোষকে আমি আগে চিনতুমই না। তোদের বিয়ের পর পুলিশের ট্রেনিং নিতে হায়দ্রাবাদ যখন গিয়েছিলাম, তখনই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ও আমাদের ট্রেনিং-এ একজন গেস্ট ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের ক্লাস নিতে আসত। সেই থেকেই পরিচয়। আর ওই ব্যাচে আমিই একমাত্র বাঙালী মেয়ে ছিলাম বলে স্বাভাবিক কারণেই আমার সাথে ও একটু বেশী কথা বলত। আর অবিবাহিত বলে স্বাভাবিক ভাবেই আমার ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরিচয় হবার মাস ছয়েক বাদেই ও আমাকে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আমি তো তোকে আগেই বলেছি যে আমি কখনও বিয়ে করব না। ওকেও একই কথা বলেছিলাম। ও একটু দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু আমাকে কোনরকম জোরাজুরি না করে আমার বন্ধু হতে চাইল। লোক হিসেবে ভাল লাগত বলে আমিও তাকে বন্ধু করে নিয়েছি। আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর ওর সাথে আমার আর দেখাই হয়নি। কিন্তু আমাদের মধ্যে নিয়মিত ফোন যোগাযোগ আছে। ও দু’বছর ধরে কলকাতাতেই পোস্টেড আছে। আর যখনই ফোন করবে তখন প্রথমেই ডার্লিং, সুইটহার্ট এসব বলে। অনেক বারন করেও ওকে এটা থেকে বিরত করতে পারিনি আমি। তাই এখন আর ওই কথাগুলো গায়ে মাখি না। আর একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করি বলে আমাদের বন্ধুত্বটা দিনে দিনে বাড়ছেই। কিন্তু ও নিজেও যেমন বুঝে গেছে যে আমি সত্যিই কোনদিন কাউকে বিয়ে করব না, তেমনি আমিও ওর আবোল তাবোল কথাগুলো শুনেও মনে মনে বিশ্বাস করি, ও আর কোনদিন আমাকে বিয়ে করবার কথা বলবে না। এখন আমরা দু’জনেই দু’জনার খুব ভাল বন্ধু। ওকে যখন যা অনুরোধ করি, ও আমার সব কথা রাখে। তাই আমিও ওকে পরম বন্ধু বলে ভাবতে শুরু করেছি। ওর নিজের বলতে কেউ নেই। মাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছে। পুলিশে চাকরী পাবার মাস দু’য়েকের ভেতরেই ওর বাবাও মারা যান। সেই থেকে ওর মাথার ওপর আর কেউ নেই। এখন ওর থার্টি প্লাস চলছে বলে আমি চাইছি ও এখন একটা বিয়ে করুক। এটাও আমার এবারের একটা কাজ। ওর সাথে কাল বা পরশু একটা মেয়ে দেখবার কথা আছে। এবারে বুঝেছিস তো পাগলী? তুই যা ভাবছিস, তা একেবারেই নয়”।
খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে খুশী হলেও মনে মনে একটু হতাশ হল। সে ভেবেছিল তার দিদিভাই বুঝি আগের সবকথা ভুলে গিয়ে নিজের জন্য একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সীমন্তিনী যে তাকে মিথ্যে কিছু বলছে না, এ ব্যাপারেও তার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না।
সীমন্তিনী হাত ধুতে ধুতে বলল, “রচু সোনা, আমি একটু পরিকে একটা ফোন করে নিই রে। ও বোধহয় এতক্ষণে অফিসে চলেই গেছে” বলে ড্রয়িং রুমে এসে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ডাইনিং রুমে এসে পরিতোষকে ফোন করল। পরিতোষ কল রিসিভ করতেই সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা পরি, এতদিনেও তুমি শোধরালে না। আমি বাথরুমে স্নান করছিলাম বলে রচুকে ফোনটা ধরতে বলেছিলাম। আর তুমি ওই সব বলে মেয়েটাকে ঘাবড়ে দিলে? আমি এখন আমার রচু সোনাকে বোঝাতেই পারছি না যে আমি তোমার ডার্লিং প্রেমিকা সুইটহার্ট কিছুই নয়। আমরা শুধু একে অপরের বন্ধু”।
সীমন্তিনী ফোনের স্পীকার অন করে রচনার গলা জড়িয়ে ধরতেই ও’পাশ থেকে পরিতোষ বলল, “সরি ডার্লিং। আই এম ভেরি সরি। কিন্তু ফোনটা যে তোমার রচুসোনা তুলবে, এটা কি আমার জানা ছিল? আর তাছাড়া আমি নিজেই তো তার কাছে আমার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা সে করেছ, করেছ। এবার আসল কথাটা বল দেখি। ওই মেয়েটার কাছে আমাকে কবে নিয়ে যাচ্ছ”?
পরিতোষ বলল, “সকালে তার সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি তাকে দেখতে চাও বলাতে সে কোন আপত্তি করেনি। কাল সকাল ন’টায় তোমার সাথে দেখা করতে রাজি আছে। পরশু সে সময় দিতে পারবে না। কিন্তু একটা মুস্কিল আছে সুইট হার্ট”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কিসের মুস্কিল? কালই প্রগ্রামটা ফিক্স করে ফ্যাল তাহলে”।
পরিতোষ বলল, “না না ডার্লিং সমস্যাটা অন্য জায়গায়। উনি নিজে যেখানে আছেন সে ফ্ল্যাটটা তার এক বান্ধবীর ফ্ল্যাট বলে সেখানে দেখা করতে চান না। আবার কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টেও আসতে চাইছেন না। তুমি যেখানে আছ সেখানেও তো তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। আর আমার নিজের বাড়ির কথা না বলাই ভাল। সব কিছু যাচ্ছেতাই অবস্থায় আছে। ওটাকে ঠিকঠাক করে তোলাও আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আবার বেলা এগারোটার পর থেকে তার মোবাইল সুইচড অফ থাকে। আজ আর আধঘণ্টার মধ্যে প্ল্যানটা পাকাপাকি না করলে কাল সকালের আগে তাকে আর ফোনে পাওয়া যাবে না। কি করি বল তো”?
সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “তাহলে তো সমস্যাই। আচ্ছা পরি, একটা নিউট্রাল ভেনিউ খুঁজে পাচ্ছ না? যেখানে আমিও যেতে পারি আর তারও কোন অসুবিধে না হয়”।
পরিতোষ বলল, “তেমন কিছু তো মাথায় আসছে না ডার্লিং। তবে একটা জায়গা আছে। আমার এক পরিচিতের বাড়ি। ছেলেটা আমাকে দাদা বলে ডাকে। সে বাড়িতে শুধু বৃদ্ধা মা আর তার ছেলে থাকে। কিন্তু সে ছেলেটাও তো এতক্ষণে কাজে বেরিয়ে গেছে। ওর সাথে বোধহয় কন্টাক্টও করতে পারব না”।
সীমন্তিনী বলল, “একটু চেষ্টা করে দেখ না। তুমি তো জানই আমার হাতেও অনেক কাজ আছে। কাল হলেই সবচেয়ে ভাল হয়”।
পরিতোষ বলল, “ওকে দেখছি আমি কি করা যায়। আমি তোমাকে পরে কল করছি আবার” বলে ফোন কেটে দিল।
রচনা দু’জনের কথোপকথন শুনে নিজের মনের সব সন্দেহ নিরসন করে সীমন্তিনীকে বলল, “তোমার বন্ধু তো দেখছি খুবই সমস্যায় পড়েছেন। পাত্রী দেখবার জায়গাই খুঁজে পাচ্ছেন না। আচ্ছা দিদিভাই, পরিতোষ বাবুকে বলে দাও না। মেয়েটাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসুক। আমাদের এখানে তো কোন সমস্যা হবে না। তোমার দাদাভাই তো ভোর পাঁচটা থেকে এগারোটা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বাড়িতেই থাকে না”।
সীমন্তিনী বলল, “নারে সেটা হবে না। এ’কথা আমি আগেই পরিকে বলেছিলাম। কিন্তু এতে পরিতোষেরই আপত্তি আছে। দাদাভাই বা তোর ওপর কোন ঝামেলা চাপাতে চায় না সে। দেখা যাক কি হয়”।
______________________________
রচনা ফোন নামিয়ে রাখতেই রতীশ তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি মন্তিকে ও’সব মিথ্যে কথা বললে কেন রচু”?
রচনা স্বামীর একটা হাত ধরে বলল, “তুমি রাগ করেছ? না সোনা রাগ কোর না। আসলে ভেবেছিলাম যে আমি সত্যি কথাটা বললে দিদিভাই আমাকে বকবেন। হয়ত বলবেন কি দরকার ছিল তার জন্যে শাড়ি কিনতে যাবার। আর তাছাড়া দিদিভাই এখানে আসবার পর তাকে আমি সত্যি কথাটা বলবই। শাড়িটা দিয়ে তাকে আমি একটা শুধু সারপ্রাইজ দিতে চাই। তুমি প্লীজ আমার ওপর রাগ কোর না সোনা”।
রতীশ রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও, এই কথা? তবে ঠিক আছে। এবার এস তো আমার আদরের বৌটাকে একটু ভাল করে আদর করি”।
রচনাও রতীশকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।
*****************
দশ তারিখ ভোর বেলা রতীশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই রচনা খুশী ভরা মনে আলুর দম বানাবার যোগার যন্ত্র করতে লাগল। রতীশ আগের দিন সব্জী আর মুদির দোকান থেকে অনেক কিছু কিনে এনেছে। রচনা ভেবেছে সীমন্তিনীর জন্যে ছোলার ডালের রসা বানাবে। সীমন্তিনী নিজেই বলেছে সেটার কথা। আর সীমন্তিনীর কথাতেই সে আগের রাতে ছোলার ডাল জলে ভিজিয়ে রেখেছিল। রচনা মনে মনে ভাবল, আগে আলুর দমটা বানিয়ে হাতে সময় থাকলে ছোলার ডালগুলো বেঁটে মুঠো করে সেদ্ধ করে রাখতে পারলে রান্নার সময় সময়টা কম লাগবে। সকাল সাতটার মধ্যেই আলুর দম তৈরী হয়ে গেল। তারপর ছোলার ডাল গুলো বাটতে শুরু করতেই সীমন্তিনীর ফোন এল। জানাল যে সে হাওড়ায় পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে সোজা বাড়ি আসবে। রচনা খুব খুশী হয়ে ডাল বাটতে শুরু করল।
আটটা বাজতে না বাজতেই রতীশের ফোন এল। জিজ্ঞেস করল “মন্তি ফোন করেছিল রচু? ও কি হাওড়া পৌঁছে গেছে”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ সোনা, দিদিভাই সাতটার দিকেই হাওড়া পৌঁছে গেছেন। প্রায় একঘণ্টা তো হয়েই গেল। নিশ্চয়ই আর খানিকক্ষণের ভেতরেই চলে আসবেন”।
ফোনে কথা বলতে বলতে রচনা তাদের ব্যালকনিতে এসে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাল। একটু দুরে পানের দোকানটার সামনে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন ট্যাক্সি বা অটো দেখা যাচ্ছে না। ফোনে কথা শেষ করতেই মনে হল ব্যালকনির নিচে রাস্তায় একটা গাড়ি স্টার্ট হবার শব্দ পাওয়া গেল। তাদের বিল্ডিঙের সামনেটা ব্যালকনি থেকে চোখে পড়ে না। রচনা মনে মনে ভাবল এ গাড়িটা কার? এ গাড়িতেই আসেননি তো দিদিভাই? ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেল একটা ট্যাক্সি বাড়ির দিক থেকে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তার ঠিক পেছনেই আরেকটা ট্যাক্সি দেখা গেল। দ্বিতীয় ট্যাক্সিটা পানের দোকানটার কাছে গিয়ে থামতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো লোক গাড়িটার কাছে এগিয়ে গেল। আর খানিক বাদে দু’জন লোক গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা আবার বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। আর প্রায় সাথে সাথে ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। রচনা চমকে উঠে ড্রয়িং রুমের ভেতর ঢুকে সামনের দরজার ম্যাজিক আইয়ের ফুটোয় চোখ রেখে সীমন্তিনীকে দেখেই “দিদিভাই” বলে চেঁচিয়ে উঠে দরজা খুলে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল।
সীমন্তিনীও “রচু, রচু, সোনা বোন আমার” বলতে বলতে রচনাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। খুশীতে রচনার দু’চোখ জলে ভরে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে আবেগ সামলে রচনা বলল, “এস দিদিভাই, ভেতরে এস। তোমার লাগেজ কোথায়”?
সীমন্তিনী দরজার বাইরে থেকে নিজের লাগেজটা ভেতরে আনতেই রচনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তোমার দাদাভাই এইমাত্র ফোন করেছিলেন। খোঁজ নিচ্ছিলেন তুমি এসে পৌঁছেছ কি না। দাঁড়াও এখন ওনার ব্রেকফাস্ট ব্রেক চলছে। খবরটা এখনই জানিয়ে দিই। নইলে চিন্তায় থাকবেন। তুমি বোসো দিদিভাই” বলে রতীশকে ফোন করল। রতীশ ফোন ধরতেই রচনা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁ শোনো, দিদিভাই এইমাত্র ঘরে এসে পৌঁছেছেন। তুমি তোমার ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ শোনো, বলছি কি, আজ আর তোমাকে মাছ আনতে হবে না। দিদিভাইকে বরং কাল মাছ খাওয়াব। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এস। এই নাও দিদিভাইয়ের সাথে একটু কথা বল” বলে ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল।
সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বলল “দাদাভাই, আমি এই জাস্ট এসে পৌঁছলাম। তুই কখন আসবি রে”?
রতীশ বলল, “ন’টা থেকে সাড়ে দশটা আমার একটা কোচিং আছে। তারপরই ছুটি”।
সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তোর সেশন শেষ হলে তাড়াতাড়ি চলে আসিস। তোকে আজ আর কোথাও গিয়ে মাছ টাছ আনতে হবে না। কাল দেখা যাবে। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় শুধু”।
“আচ্ছা ঠিক আছে” বলে রতীশ ফোন কেটে দিতেই সীমন্তিনী রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে রচু, আলুর দম আর লুচি বানিয়েছিস তো”?
রচনা নিজের আলমারি খুলে একটা ধোয়া নাইটি বের করে সীমন্তিনীকে দিয়ে বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। আলুর দম হয়ে গেছে। লুচির আয়োজনও করে রেখেছি। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এস। আমি গরম গরম ভেজে দিচ্ছি”।
রচনা সীমন্তিনীকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কিচেনে গিয়ে লুচি বানাবার আয়োজন করতে লাগল। হঠাৎ ড্রয়িং রুমের ভেতর থেকে ফোন বেজে ওঠার শব্দ পেয়েই রচনা ছুটে এসে দেখল সীমন্তিনীর ফোনটা বেজে যাচ্ছে। সীমন্তিনী বাথরুমের ভেতর থেকে নিজের ফোনের শব্দ চিনতে পেরে দরজা না খুলেই চেঁচিয়ে বলল, “রচু ফোনটা ধরে একটু বলে দে আমি খানিকক্ষণ বাদে কলব্যাক করব”।
রচনা কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগাতেই ভারিক্কি পুরুষকণ্ঠে কেউ একজন বলে উঠল, “তুমি যে তোমার দাদাভাইয়ের বাড়ীতে পৌঁছে গেছ সে খবর তো আমি পেয়েই গেছি। কিন্তু ডার্লিং, তুমি নিজে একটা ফোন করে আমাকে একটু আশ্বস্ত করলে আমি আরেকটু খুশী হতাম”।
সীমন্তিনীকে কেউ “ডার্লিং” বলে সম্মোধন করছে শুনেই রচনা এক মূহুর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেল। সে কী বলবে না বলবে ভাবতে ভাবতেই পুরুষ কণ্ঠটি আবার বলে উঠল, “কি ব্যাপার সুইট হার্ট, একেবারে সাড়া শব্দটি নেই যে? তুমি ঠিক আছ তো? এনি প্রব্লেম? দাদা-বৌদি ভালভাবে আপ্যায়ন করেছে তো তোমাকে? না কি”?
রচনা একটা ঢোঁক গিলে তাড়াতাড়ি বলল, “দিদিভাই বাথরুমে স্নান করছেন। আপনাকে একটু বাদে ফোন করবেন বলেছেন”।
কোনরকমে কথাটুকু বলে ফোনটা অফ করতে যেতেই ও’পাশ থেকে আবার বলল, “স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি যে ফোনটা অন্য কেউ ধরেছে। আপনি নিশ্চয়ই মন্তির বৌদিসোনা। কিন্তু ওভাবে না জেনে শুনেই ও’কথাগুলো বলা আমার ঠিক হয়নি। কিছু মনে করবেন না প্লীজ। রাখছি” বলতেই লাইন কেটে গেল।
রচনা ফোনটা দেখে বুঝল ‘পরি’ বলে কোন একজন ফোনটা করেছিল। ফোনটা টেবিলে রেখে সে আবার কিচেনে আসতে আসতে ভাবতে লাগল, লোকটা কে? ‘পরি’ বলে কারুর কথা তো সে দিদিভাইয়ের মুখে কখনও শোনেনি। কিন্তু লোকটা তো দিদিভাইকে মন্তি বলে ডাকছে! তাকে ডার্লিং, সুইট হার্ট বলছিল ফোনে। এমন ভাবে তো প্রেমিক বা স্বামীরাই কথা বলে। দিদিভাই কি তাহলে এ লোকটার সাথে প্রেম করছে? এ’কথা মনে হতেই রচনার মনটা খুশীতে ভরে উঠল। মনে মনে বলল, “হে ভগবান, তাই যেন হয়। আমার দিদিভাইয়ের একটা ঘর-বর হলে এর চেয়ে সুখের খবর আর কি হতে পারে”।
সীমন্তিনী স্নান সেরে বেরোতে রচনা কিচেন থেকেই বলল, “দিদিভাই, চুল আঁচড়ে এ ঘরে চলে এস। হয়ে গেছে আমার”।
লুচি, আলুর দম, ছোলার ডালের ধোকার রসা, আর পায়েস। আলুর দম দিয়ে লুচির একটা টুকরো মুখে ফেলেই সীমন্তিনী একহাত দিয়ে পাশে বসা রচনার একটা হাত ধরে বলল, “উম্মম কী বানিয়েছিস রে রচু সোনা! তোর মনে আছে? তোদের বিয়ের পরদিন বাড়িতে তুই জোর করে লুচি আলুর দম বানিয়েছিলি। জেঠু বাবা কাকু সবাই খুব খুব প্রশংসা করেছিল তোর। মায়েরা সেদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও তারাও যে খেয়ে খুব খুশী হয়েছিলেন সেটাও মনে আছে আমার। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশী টেস্টি হয়েছে রে। আঃ দারুণ। এতদিন তোর হাতের রান্না বড্ড মিস করেছি রে”।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “লক্ষীদির হাতের রান্না কেমন গো দিদিভাই? ভাল”?
সীমন্তিনী খেতে খেতেই জবাব দিল, “ঠিকই আছে মোটামুটি। চলে যায় কোনরকম। মাঝে মাঝে সত্যিই খুব ভালো রাঁধে। মাঝে মধ্যে আবার অতটা ভাল হয় না। আচ্ছা রচু, আমি যখন স্নান করছিলাম তখন কে ফোন করেছিল রে? ফোনটা তো আর দেখাও হল না”।
রচনা খেতে খেতেই জবাব দিল, “নামটা তো ঠিক বলেননি দিদিভাই। তবে আমি কলটা রিসিভ করে কিছু বলে ওঠবার আগেই, বাড়ি পৌছে তুমি তাঁকে কোন খবর দাওনি বলেই একটু অনুযোগ করছিলেন। তুমি বাথরুমে আছ শুনে, আর তেমন কিছু বলেননি। কলটা কেটে যাবার পর দেখলাম “পরি” নামের কেউ একজন ফোন করেছিলেন”।
রচনার মুখে এ’কথা শুনেই সীমন্তিনী নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এই সেরেছে রে। নিশ্চয়ই কথা বলবার আগেই ডার্লিং, প্রেয়সী, সুইটহার্ট- এসব বলেছে তাই না”?
রচনা একটু মনঃক্ষুণ্ণ ভাবে বলল, “এ ভদ্রলোকের কথা তো কখনও আমাকে বলনি দিদিভাই। কতদিন ধরে তার সাথে জানা শোনা তোমার? আমাকেও তুমি জানতে দাও নি”?
সীমন্তিনী খেতে খেতে রচনার হাতটা ধরেই বলল, “হু, যা ভেবেছি, ঠিক তাই। তুই নিশ্চয়ই ভেবেছিস ওর সাথে আমি প্রেম করছি। তাই না”?
রচনা বেশ শান্ত গলায় বলল, “অমন ভাষায় প্রেমিক আর স্বামী ছাড়া আর কেউ কথা বলে বলে তো আমার জানা নেই দিদিভাই। কিন্তু অবাক হচ্ছি এই ভেবে, যে তুমি আমার কাছে থেকেও সে’সব কথা বেমালুম চেপে গেছ এতদিন”?
সীমন্তিনী আর থাকতে না পেরে জোরে ‘হাহা হা’ করে হেসে উঠে বলল, “আমি ঠিক জানতুম। তুই এ’সব কথাই বলবি। আরে পাগলী, তুই তো আমার জান রে। তোর কাছে আমি কিছু লুকোতে পারি? তুই যা ভাবছিস তা নয়রে পাগলী। ওর কথা বার্তাই অমন। যখনই ফোন করবে তখন আগে ওই সব শব্দ গুলো ব্যবহার করবেই। ডার্লিং, সুইট হার্ট, প্রেয়সী, প্রিয়তমা - যা মুখে আসে তাই বলে। কিন্তু খুব ভাল লোক রে। আমার কলিগ আইপিএস অফিসার। আমার চেয়ে বছর চারেকের সিনিয়র। বয়সে অবশ্য অত বড় নয় আমার চেয়ে। মোটে বছর দুয়েকের মত বড়। ও আমার বড় বলেই আমাকে নাম ধরে ডাকে। আর ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বলে আমিও ওকে ছোট নামে ডাকি। পরি বলে। ওর আসল নাম হচ্ছে পরিতোষ। তবে তুই একেবারেই ভাবিস না যে তার সাথে আমার কোনরকম প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক আছে”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছ তো? না আমাকে টুপি পড়াচ্ছ দিদিভাই”?
সীমন্তিনী রচনার হাতটা ধরেই বলল, “তুই এ কথা ভাবছিস কি করে যে আমি তোর কাছে মিথ্যে কথা বলব? তুই জানিসনা? যেদিন থেকে তুই সম্পর্কে আমার বৌদি হয়েছিস সেদিন থেকেই তুই যে আমার জীবনের সব কিছু হয়ে উঠেছিস রে। আমি হয়ত নিজের মনকে ধোকা দিতেও মনে মনে কোন মিথ্যে কথা বলতে পারি। কিন্তু তোকে কখনও মিথ্যে বলতে পারব না। খুব বেশী প্রয়োজন হলে তোর কাছে হয়ত আমি কিছু কথা গোপন রেখে যেতে পারি। তবে সেটাও সাময়িক। তোর কাছে কিছু গোপন করে রাখলেও সময়মত তোকে সেটা খুলে বলবই আমি। আর তুই তো জানিসই আমার জীবনের একটা কথাই শুধু আমি তোর কাছে এখনও গোপন রেখেছি। সেটাও তোকে ঠিক সময়ে বলব। আর তখন গোপন রাখার কারনটাও জানতে পারবি তুই। তবে তুই বিশ্বেস কর বোন। এই পরি আমার শুধুই একজন খুব ভাল বন্ধু। আমার জীবনে বর্তমানে ওর চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই। তাই ওর ওই আবোল তাবোল কথাগুলো শুনেও না শোনা করে উড়িয়ে দিই”।
রচনা একটু সহজ হয়ে উঠে বলল, “তার মানে তুমি বলছ আমার কাছেও কিছু গোপন কর তুমি”?
সীমন্তিনীও সহজেই জবাব দিল, “হ্যা করিই তো। আর সে কি আজকের থেকে? তোর সাথে আমার যেদিন পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকেই তো এমন গোপন রাখতে শুরু করেছি। পুরনো কথাগুলো সব কি ভুলে গেছিস তুই? তোর সাথে যখন আমার পরিচয় হয়েছিল, তখন তোরা কেউ কি জানতিস যে আমি রতীশ ভট্টাচার্যির ছোট বোন। বা এটাও কি বুঝতে পেরেছিলিস যে তোকে আমার দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দেব বলেই তোর সাথে আর ভাই, মাসি মেসোর সাথে ভাব করেছিলাম। নিজের পরিচয় গোপন রেখেই তো তোর সাথে ভাব করেছিলাম আমি। কিন্তু ঠিক সময়ে আমি নিজেই তো সে গোপনতার ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়েছিলাম তোদের কাছে। এখনও অনেকের কাছে অনেক কথা আমি গোপন যাই। আবার সঠিক সময় এলে এসব কথাও সবাইকে খুলে বলি। এ’কথাও তো তোকে আগেই বলেছি আমি। আর পুলিশের কাজে আমাদের নানা সময় নানা জনের কাছে অনেক কিছু গোপন রাখতেই হয় রে। নিজের লোকদের কাছেও। সেটা আমাদের সার্ভিসেরই একটা অঙ্গ বলতে পারিস। এই তো দেখনা, তোদের দিদিভাই যে একজন পুলিশ অফিসার এটা তো কলকাতায় সকলের কাছ থেকে আমি গোপন রাখতে চাইছি। তোদেরকেও সে সত্যিটা গোপন রাখতে বলেছি। প্রয়োজন আছে বলেই। আর সে প্রয়োজনটা কিসের সেটাও পরে কখনও নিশ্চয়ই জানতে পারবি তোরা। তবে এই মূহুর্তে তোর কাছে পরিকে নিয়ে আমি যে কোন কথা গোপন করছি না, এটা তুই বিশ্বাস করতে পারিস”।
রচনা খেতে খেতেই বলল, “তা তোমার এই পরির সাথে তোমার কতদিনের পরিচয় দিদিভাই? এটা বলা যাবে? না এটাও গোপন রাখবে আপাততঃ”?
সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে রচনার একটা গাল টিপে দিয়ে বলল, “খুব দুষ্টুমি করতে শিখেছিস না? খুব পেকেছিস। তবে শোন, পরিতোষকে আমি আগে চিনতুমই না। তোদের বিয়ের পর পুলিশের ট্রেনিং নিতে হায়দ্রাবাদ যখন গিয়েছিলাম, তখনই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ও আমাদের ট্রেনিং-এ একজন গেস্ট ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের ক্লাস নিতে আসত। সেই থেকেই পরিচয়। আর ওই ব্যাচে আমিই একমাত্র বাঙালী মেয়ে ছিলাম বলে স্বাভাবিক কারণেই আমার সাথে ও একটু বেশী কথা বলত। আর অবিবাহিত বলে স্বাভাবিক ভাবেই আমার ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরিচয় হবার মাস ছয়েক বাদেই ও আমাকে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আমি তো তোকে আগেই বলেছি যে আমি কখনও বিয়ে করব না। ওকেও একই কথা বলেছিলাম। ও একটু দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু আমাকে কোনরকম জোরাজুরি না করে আমার বন্ধু হতে চাইল। লোক হিসেবে ভাল লাগত বলে আমিও তাকে বন্ধু করে নিয়েছি। আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর ওর সাথে আমার আর দেখাই হয়নি। কিন্তু আমাদের মধ্যে নিয়মিত ফোন যোগাযোগ আছে। ও দু’বছর ধরে কলকাতাতেই পোস্টেড আছে। আর যখনই ফোন করবে তখন প্রথমেই ডার্লিং, সুইটহার্ট এসব বলে। অনেক বারন করেও ওকে এটা থেকে বিরত করতে পারিনি আমি। তাই এখন আর ওই কথাগুলো গায়ে মাখি না। আর একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করি বলে আমাদের বন্ধুত্বটা দিনে দিনে বাড়ছেই। কিন্তু ও নিজেও যেমন বুঝে গেছে যে আমি সত্যিই কোনদিন কাউকে বিয়ে করব না, তেমনি আমিও ওর আবোল তাবোল কথাগুলো শুনেও মনে মনে বিশ্বাস করি, ও আর কোনদিন আমাকে বিয়ে করবার কথা বলবে না। এখন আমরা দু’জনেই দু’জনার খুব ভাল বন্ধু। ওকে যখন যা অনুরোধ করি, ও আমার সব কথা রাখে। তাই আমিও ওকে পরম বন্ধু বলে ভাবতে শুরু করেছি। ওর নিজের বলতে কেউ নেই। মাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছে। পুলিশে চাকরী পাবার মাস দু’য়েকের ভেতরেই ওর বাবাও মারা যান। সেই থেকে ওর মাথার ওপর আর কেউ নেই। এখন ওর থার্টি প্লাস চলছে বলে আমি চাইছি ও এখন একটা বিয়ে করুক। এটাও আমার এবারের একটা কাজ। ওর সাথে কাল বা পরশু একটা মেয়ে দেখবার কথা আছে। এবারে বুঝেছিস তো পাগলী? তুই যা ভাবছিস, তা একেবারেই নয়”।
খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে খুশী হলেও মনে মনে একটু হতাশ হল। সে ভেবেছিল তার দিদিভাই বুঝি আগের সবকথা ভুলে গিয়ে নিজের জন্য একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সীমন্তিনী যে তাকে মিথ্যে কিছু বলছে না, এ ব্যাপারেও তার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না।
সীমন্তিনী হাত ধুতে ধুতে বলল, “রচু সোনা, আমি একটু পরিকে একটা ফোন করে নিই রে। ও বোধহয় এতক্ষণে অফিসে চলেই গেছে” বলে ড্রয়িং রুমে এসে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ডাইনিং রুমে এসে পরিতোষকে ফোন করল। পরিতোষ কল রিসিভ করতেই সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা পরি, এতদিনেও তুমি শোধরালে না। আমি বাথরুমে স্নান করছিলাম বলে রচুকে ফোনটা ধরতে বলেছিলাম। আর তুমি ওই সব বলে মেয়েটাকে ঘাবড়ে দিলে? আমি এখন আমার রচু সোনাকে বোঝাতেই পারছি না যে আমি তোমার ডার্লিং প্রেমিকা সুইটহার্ট কিছুই নয়। আমরা শুধু একে অপরের বন্ধু”।
সীমন্তিনী ফোনের স্পীকার অন করে রচনার গলা জড়িয়ে ধরতেই ও’পাশ থেকে পরিতোষ বলল, “সরি ডার্লিং। আই এম ভেরি সরি। কিন্তু ফোনটা যে তোমার রচুসোনা তুলবে, এটা কি আমার জানা ছিল? আর তাছাড়া আমি নিজেই তো তার কাছে আমার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা সে করেছ, করেছ। এবার আসল কথাটা বল দেখি। ওই মেয়েটার কাছে আমাকে কবে নিয়ে যাচ্ছ”?
পরিতোষ বলল, “সকালে তার সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি তাকে দেখতে চাও বলাতে সে কোন আপত্তি করেনি। কাল সকাল ন’টায় তোমার সাথে দেখা করতে রাজি আছে। পরশু সে সময় দিতে পারবে না। কিন্তু একটা মুস্কিল আছে সুইট হার্ট”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কিসের মুস্কিল? কালই প্রগ্রামটা ফিক্স করে ফ্যাল তাহলে”।
পরিতোষ বলল, “না না ডার্লিং সমস্যাটা অন্য জায়গায়। উনি নিজে যেখানে আছেন সে ফ্ল্যাটটা তার এক বান্ধবীর ফ্ল্যাট বলে সেখানে দেখা করতে চান না। আবার কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টেও আসতে চাইছেন না। তুমি যেখানে আছ সেখানেও তো তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। আর আমার নিজের বাড়ির কথা না বলাই ভাল। সব কিছু যাচ্ছেতাই অবস্থায় আছে। ওটাকে ঠিকঠাক করে তোলাও আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আবার বেলা এগারোটার পর থেকে তার মোবাইল সুইচড অফ থাকে। আজ আর আধঘণ্টার মধ্যে প্ল্যানটা পাকাপাকি না করলে কাল সকালের আগে তাকে আর ফোনে পাওয়া যাবে না। কি করি বল তো”?
সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “তাহলে তো সমস্যাই। আচ্ছা পরি, একটা নিউট্রাল ভেনিউ খুঁজে পাচ্ছ না? যেখানে আমিও যেতে পারি আর তারও কোন অসুবিধে না হয়”।
পরিতোষ বলল, “তেমন কিছু তো মাথায় আসছে না ডার্লিং। তবে একটা জায়গা আছে। আমার এক পরিচিতের বাড়ি। ছেলেটা আমাকে দাদা বলে ডাকে। সে বাড়িতে শুধু বৃদ্ধা মা আর তার ছেলে থাকে। কিন্তু সে ছেলেটাও তো এতক্ষণে কাজে বেরিয়ে গেছে। ওর সাথে বোধহয় কন্টাক্টও করতে পারব না”।
সীমন্তিনী বলল, “একটু চেষ্টা করে দেখ না। তুমি তো জানই আমার হাতেও অনেক কাজ আছে। কাল হলেই সবচেয়ে ভাল হয়”।
পরিতোষ বলল, “ওকে দেখছি আমি কি করা যায়। আমি তোমাকে পরে কল করছি আবার” বলে ফোন কেটে দিল।
রচনা দু’জনের কথোপকথন শুনে নিজের মনের সব সন্দেহ নিরসন করে সীমন্তিনীকে বলল, “তোমার বন্ধু তো দেখছি খুবই সমস্যায় পড়েছেন। পাত্রী দেখবার জায়গাই খুঁজে পাচ্ছেন না। আচ্ছা দিদিভাই, পরিতোষ বাবুকে বলে দাও না। মেয়েটাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসুক। আমাদের এখানে তো কোন সমস্যা হবে না। তোমার দাদাভাই তো ভোর পাঁচটা থেকে এগারোটা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বাড়িতেই থাকে না”।
সীমন্তিনী বলল, “নারে সেটা হবে না। এ’কথা আমি আগেই পরিকে বলেছিলাম। কিন্তু এতে পরিতোষেরই আপত্তি আছে। দাদাভাই বা তোর ওপর কোন ঝামেলা চাপাতে চায় না সে। দেখা যাক কি হয়”।
______________________________