06-03-2020, 07:02 PM
(Update No. 107)
বিট্টু বলল, “না না দাদা। এ আপনি কী করছেন। আপনি তো যখনই আসেন তখনই আমাকে কিছু না কিছু টাকা দিয়েই যান”।
পরিতোষ জোর করে বিট্টুর হাতে টাকাটা গুঁজে দিতেই পেছনের গেটে ঠকঠক শব্দ হল। বিট্টু সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিকক্ষণ বাদে বিট্টুর সাথে শেখর এসে ঘরে ঢুকল। তার হাতে মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগ ঝুলছে। বিট্টু শেখরকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে পরিতোষকে বলল, “দাদা আপনারা কথা বলুন। আমি পাশের ঘরেই আছি। প্রয়োজন হলে ডাকবেন” বলে চলে গেল।
পরিতোষ শেখরকে বসতে বলে বলল, “সকালে তো ফোন করে বললি, তোর কাজ কমপ্লিট হয়েছে। তা জিনিসগুলো এনেছিস”?
শেখর নিজের হাতে ঝোলান ব্যাগটার চেন খুলতে খুলতে বলল, “হ্যা স্যার, সব কমপ্লিট হয়ে গেছে। মোট আটটা সিডি বানানো হয়েছে। আর আপনি যেমন বলেছিলেন, একটা বাইরের কোন লোকেশনের বানাতে, সেটাও হয়েছে। একটা হোটেলের রুমের। আর সবগুলোই দারুণ ক্লিয়ার আর টপ ক্লাস ফিল্ম হয়েছে” বলতে বলতে সিডিগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল।
পরিতোষ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু অবাক হয়ে বলল, “হোটেলের রুমে গিয়েও রেকর্ডিং করেছিস। তোদের অসাধ্য বলে কিছু নেই না কি রে? হোটেলের কেউ এসব ব্যাপার জানতে পারেনি তো”?
শেখর হেসে বলল, “আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন স্যার। কাকপক্ষীটিও টের পায় নি। রেকর্ডিংটা যে করেছে একমাত্র সে-ই শুধু জানে। ফিল্মের হিরোইন নিজে পর্যন্ত কিচ্ছুটি টের পায়নি। তবে একটা ব্যাপারে একটু বেশী কশাস থাকতে হয়েছে বলেই, হোটেলের সিডিটায় হিরোইনের গ্রাহকের মুখটা একবারও দেখা যাবে না। কিন্তু তাতে ফিল্মের এন্টারটেইনমেন্টে কোন ঘাটতি হয়নি। বরং ওটাই সবচেয়ে ওয়াইল্ড হয়েছে”।
পরিতোষ হেসে বলল, “সে হোক গে। তাতে কিছু যায় আসে না। হিরোইনটাকে ভাল করে বোঝা গেলেই হল। তা এই সিডিগুলো ছাড়া অন্য কোথাও কোন কপি টপি রাখিস নি তো”?
শেখর জবাব দিল, “না স্যার, আমি নিজে হাতে সবগুলো প্রোজেক্ট ফাইল আর ক্যামেরার ফুটেজ সব কিছু ডিলিট করে দিয়েছি। কিন্তু স্যার আমার মনে হয় এ সিডিগুলোর একটা করে কপি বানিয়ে আপনার কাস্টডিতে রেখে দিলে ভাল হত। ভবিষ্যতে যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে”।
পরিতোষ বলল, “না। সেকেণ্ড ফেজে অপারেশনটা সাকসেসফুলি করতে পারলে এগুলোর আর দরকার পড়বে না কোনদিন। তবে ব্রহ্মাস্ত্র একটা তো হাতে রাখতেই হবে। ওটা হয়ে যাবে। আচ্ছা এবারে বল, তোরা ক’জন কাজে লেগেছিলি। আর তোদের বিল কত পেমেন্ট করতে হবে”?
শেখর জবাব দিল, “সব মিলিয়ে ছ’জনকে রিক্রুট করতে হয়েছে স্যার। আমি বাদে দু’জন ফুল টাইম ওয়াচার চারদিন কাজ করেছে, একজন কম্পিউটার এসিস্ট্যান্ট, যে রেকর্ডিং, এডিটিং আর মিক্সিং এক হাতে করেছে। চার দিন তিন রাত জেগে ওকে রেকর্ডিং করতে হয়েছে। আর তিনদিন লেগেছে ফাইলগুলো প্রসেসিং করে এডিটিং মিক্সিং করে সিডি বানাতে। ওকেই সবচেয়ে বেশী দিতে হবে। বেচারাকে রাত দিন কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। আর দু’জন ফিমেল পার্ট টাইমার। ফিমেল পার্টটাইমার দুটো পনের কুড়ি মিনিট করে সার্ভিস দিয়েছে। তাই ওদের দু’জনকে দশ হাজার করে দিলেই চলবে। আর ফুলটাইম ওয়াচার দু’জনকে চার দিনের ডিউটির জন্যে চল্লিশ হাজার করে দিতে হবে। কম্পিউটার এসিস্ট্যান্টটাকেই বেশী দিতে হবে। দেড় লাখ। আর আমার হাত থেকে প্রায় বারো হাজার খরচ হয়েছে”।
পরিতোষ মনে মনে হিসেব করে বলল, “তাহলে তোকে বাদ দিয়ে ওদের পাঁচজনকে দিতে হচ্ছে আড়াই লাখ। আর তোর জন্যে যদি এক লাখ হিসেব করে রাখি চলবে তো”?
শেখর বলল, “স্যার আপনার কাছ থেকে আমি যত ফেভার পেয়ে থাকি তার বিনিময়ে যেটুকু করেছি তা তো কিছুই নয়। এটা আপনার নিজস্ব কাজ। তাই এ কাজে আমি আলাদা করে কোন পারিশ্রমিক নেব না। আপনি শুধু আমার খরচের টাকাটাই দিয়ে দেবেন। আর কিছু চাই না আমি”।
পরিতোষ বলল, “আমি তোদের জন্য যা কিছু করি বা করেছি, তার জন্য আমাকে কখনও কোন প্রতিদান দেবার কথা তুলবি না। আমি তোদেরকে শুধু সৎ ভাবে বাঁচতে দেখলেই খুশী হব রে। আচ্ছা যাক সে কথা, তোকে সব মিলিয়ে আমি তাহলে তিন লাখ বাষট্টি হাজার দেব। তবে পেমেন্টটা কিন্তু এখনই দিতে পারবনা তোকে ভাই। সেকেণ্ড ফেজ অপারেশনটা শেষ হলেই সেটা দেওয়া সম্ভব হবে। অন্য টিমের বাজেট হিসেব করে অপারেশনের টাইমিং ঠিক করতে হবে। তাই তোর লোকজনদের একটু ধৈর্য্য ধরে থাকতে বলিস। অপারেশনটা ভাল ভাবে করে ফেলতে পারলেই সম্ভব হলে সেদিনই, নইলে পরের দিন তোদের সকলের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেব আমি”।
শেখর বলল, “ও নিয়ে সমস্যা হবে না স্যার। আমি সবাইকে ম্যানেজ করে নিতে পারব। আপনাকে অপারেশন শেষ করতে কোনরকম তাড়াহুড়ো করতে হবে না”।
পরিতোষ বলল, “ঠিক আছে, তুই তাহলে এখন যেতে পারিস। আমি সময় মত তোকে কন্টাক্ট করব। ঠিক আছে”?
শেখর চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “ঠিক আছে স্যার। আসছি তাহলে” বলে উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ বিট্টুকে ডাক দিল। বিট্টু আসতেই সে বলল, “একে পেছনের গেট দিয়েই বাইরে বের করে দে। আমি বসছি এখানে। আরেকজন আসবে খানিক বাদেই”।
বিট্টু শেখরকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই পরিতোষ একজনকে ফোন করল। ও’পাশের সাড়া পেতেই সে বলল, “কোথায় আছিস আব্দুল”?
ও’পাশ থেকে জবাব এল, “স্যার আপনার ফোনের জন্যেই অপেক্ষা করছি। আপনি যে ঠিকানার কথা বলেছিলেন, তার কাছাকাছিই আছি”।
পরিতোষ বলল, “তাহলে চলে আয় এখনই। আমি তোর জন্যে ওয়েট করছি”।
ও’পাশ থেকে আব্দুল জবাব দিল, “ঠিক আছে স্যার। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আপনার সামনে হাজির হয়ে যাব”।
পরিতোষ বলল, “তুই পেছনের গেটে এসে নক করবি। আমি গেটে লোক পাঠিয়ে দেব” বলে ফোন কেটে দিল।
মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই বিট্টু চায়ের কাপ হাতে ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল, “দাদা ভেতরে আসব”?
পরিতোষ জবাব দিল, “হ্যা আয়”।
বিট্টু ঘরে ঢুকে পরিতোষের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মা আপনার জন্যে চা বানিয়েছেন। নিন”।
পরিতোষ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বিট্টু, আর মিনিট দশেকের ভেতর পেছনের গেট দিয়ে আরেকজন আসবে। একটু দরজাটা খুলে দিস ভাই। তোকে খুব জ্বালাচ্ছি তাই না রে”?
বিট্টু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন এমন করে বলছেন দাদা। আমি আর এমন কী রাজকার্য করছি? ঘরে বসে জিকের বই পড়ছি শুধু। আমি একদম বিরক্ত হচ্ছি না। আপনি আপনার কাজ করুন। আমি পাশের ঘরেই আছি। গেটে শব্দ হলেই আমি বুঝতে পারব” বলে চলে গেল।
পরিতোষ চা খেতে খেতে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে থাকল। পেছনের গেটে খটখট শব্দে সে সজাগ হল। কিছুক্ষণ পরেই বিট্টু রুমের বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল, “দাদা আব্দুল ভাই এসেছে”।
পরিতোষ জবাব দিল, “ওকে ভেতরে পাঠিয়ে তুই পড়গে যা। আমি তোকে পরে ডেকে নেব”।
আব্দুল ঘরে ঢুকেই বলল, “নমস্কার স্যার”।
পরিতোষও প্রতি নমস্কার করে হেসে বলল, “প্রীতিদি তোকে ভালই শিক্ষা দিচ্ছে দেখি রে আব্দুল। এতদিন তো আসসালামওয়ালেকুম বলতিস। আজ একেবারে আমাদের স্টাইলে নমস্কার বলছিস”।
আব্দুল লাজুক হেসে হাতজোড় করে বলল, “তা যা বলেছেন স্যার। আমার ধর্মকর্ম সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে”।
পরিতোষ আব্দুলকে বসতে বলে বলল, “প্রীতিদি কেমন আছে রে? আর তোদের বাচ্চাটা? কি যেন নাম রেখেছিস”?
আব্দুল বলল, “আপ্রীত স্যার। মা বেটা দু’জনেই আপনার আশীর্বাদে ভাল আছে। স্যার প্রীতি আপনাকে ওর একটা অনুরোধ জানাতে বলেছে”।
পরিতোষ অবাক হয়ে বলল, “প্রীতিদির অনুরোধ? কী অনুরোধ বল তো শুনি”।
আব্দুল বলল, “স্যার আপ্রীতের বয়স তো ছ’মাস হয়ে গেছে। প্রীতি বলছিল ওর নাকি অন্নপ্রাশন দেবার সময় হয়ে এসেছে। আমার তো আর শ্বশুর বাড়ি বলতে কিছু নেই। তাই প্রীতি আপনাকে অনুরোধ করেছে ছেলের অন্নপ্রাশনের দিন আপনাকে আমাদের সাথে থাকতে হবে। আর ছেলের মামা হিসেবে ওর মুখে নাকি প্রথম ভাত তুলে দিতে হবে আপনাকে”।
পরিতোষ হেসে বলল, “তোর ছেলের মামা যখন হয়েই গেছি, তখন তোর বৌয়ের আদেশ তো মানতেই হবে। কিন্তু অন্নপ্রাশনের দিন তারিখটা আমাকে আগে থেকে জানিয়ে দিস। আর তোর গ্যারেজ কবে স্টার্ট হচ্ছে”?
আব্দুল বলল, “ট্রেড লাইসেন্সটা দিতে বড্ড দেরী করছে স্যার। যতবার যাই, একই কথা শোনায়। বলে যে পুলিশ ভেরিকেশন রিপোর্ট এখনও পাই নি আমরা। ওটা না পেলে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা যাবে না। তিন মাস ধরে এ কথাই শুনছি শুধু। আর সব কিছু তো একদম রেডি হয়ে গেছে”।
পরিতোষ একটু অবাক হয়ে বলল, “তিন মাস ধরে এমনটা চলছে, তো আমাকে জানাসনি কেন”?
আব্দুল নিজের হাত কচলে বলল, “এমন ছোটখাট ব্যাপারে আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি স্যার”।
পরিতোষ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। ব্যাপারটা আমি দেখব’খন। এবার আসল কথায় আসছি। তোর লেটেস্ট রিপোর্ট কি সেটা আগে বল তো”।
আব্দুল বলল, “মক্কেলের পাঁচটা কেসের হদিশ পেয়েছি স্যার। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আরেকটা বড় ডীল করতে যাচ্ছে। নকল কাগজ পত্র বের করে মফস্বলের এক বিজনেস ম্যানকে একটা ছোট দোকান ঘর বিক্রী করতে যাচ্ছে বদমাশটা। দর ঠিক হয়েছে ত্রিশ লাখ। অফিসের বাবুদের দেবে চার লাখ। বাকি ছাব্বিশ লাখ দু’জনের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। এ কাজে ওর পার্টনার সুখলাল যাদব নামের এক দালাল। যাদবপুরে থাকে। ডীলটা হবার কথা এ মাসের কুড়ি তারিখে। আমার লোক সব খবরাখবর রাখছে”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “খবর পাকা”?
আব্দুল বলল, “হ্যা স্যার। পুরোপুরি পাকা খবর”।
পরিতোষ একটু ভাবতে ভাবতে বলল, “আজ হচ্ছে তের তারিখ। ডীলটা হচ্ছে কুড়ি তারিখ। সেদিনই ও টাকা পাচ্ছে। তাহলে আমাদের অপারেশনটা করতে হবে একুশ তারিখেই। নইলে টাকাগুলো এদিক সেদিক হয়ে গেলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আচ্ছা ডীলটা কুড়ি তারিখ ঠিক কখন হবে, সেটা জানতে পেরেছিস”?
আব্দুল বলল, “লেনদেনটা হবে স্যার বেলা দুটোর পর। এটাও পাকা খবর”।
পরিতোষ মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল, “একটা কাজ করতে পারবি? কুড়ি তারিখ ও যেন টাকাগুলো নিজের বাড়িতেই নিয়ে আসতে বাধ্য হয়, সে ব্যবস্থা করতে পারবি”?
আব্দুল বলল, “অবশ্যই পারব স্যার। কোন অসুবিধেই হবে না আমার। আমি নিজে ওকে আমার ওখানে আঁটকে রাখব। রাত দশটার আগে ও আমার ওখান থেকে বেরোতেই পারবে না। তখন টাকার ব্যাগ সহ আমি নিজে ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেব রাত এগারোটা নাগাদ। তারপর সে রাতে ও আর ওই টাকাটা সরাবার সুযোগ পাবে না। কিন্তু পরের দিন সকালে আমাদের টিম ওর বাড়ি গিয়ে পৌঁছনোর আগে ওকে বাড়িতেই কিছু একটা করে আটকে রাখতে হবে। সেটা কি করে করা যায়, তাই ভাবছি”।
পরিতোষ বলল, “ইলেকশন অফিসার সেজে ওকে ফোন করে বলতে হবে যে সকাল ন’টার সময়ই ইলেকশন অফিসের স্টাফ তার বাড়িতে আসবে ভেরিফিকেশনে। সে যেন ইলেকশন অফিসের লোক না আসা পর্যন্ত বাড়ি থেকে না বেরোয়। আর ইলেকশন অফিসের লোকেরা এসে যদি তাকে বাড়িতে না পায়, তাহলে তাকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করে তাকে এরেস্ট করা হবে। ফোনটা তুই করবি। আর আমিও আলাদা ভাবে ওর বাড়ির সামনে ওয়াচ রাখবার ব্যবস্থা করব সকাল সাতটা থেকে। তোর টিম যেন সকাল ন’টার মধ্যে পৌঁছে যায়। গোটা অপারেশনটা শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে বলে ভাবছিস”?
আব্দুল বলল, “স্যার প্ল্যানটা যেভাবে বানানো হয়েছে তাতে তো ঘন্টা তিনেক কম করেও লাগবে। তবে আমি ওদের সবাইকে বলে দেব, যতটা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা যায়, ওরা যেন সে চেষ্টাই করে”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “টিম বাইরে থেকে আনছিস তো”?
আব্দুল জবাব দিল, “হ্যা স্যার। তিনজন ঝাড়খণ্ডের আর দু’জন ওড়িষ্যার”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “কততে কন্ট্রাক্ট করেছিস”?
আব্দুল বলল, “প্রত্যেককে এক এক লাখ দিতে হবে”।
পরিতোষ মনে মনে একটু হিসেব কষে বলল, “ফেজ ওয়ানে সব মিলে খরচ হয়েছে তিন লাখ বাষট্টি হাজার। আর এবারেও পাঁচ লাখ। তারপর তোর আর আমার কিছু ইনফর্মারকেও কিছু কিছু দিতে হবে। সব মিলে প্রায় সাড়ে দশ লাখ টাকার মত হচ্ছে। আর যার জন্যে এসব করতে হচ্ছে তাকে দু’লাখ ফিরিয়ে দিতে হবে। তার মানে সব মিলে দাঁড়াচ্ছে সাড়ে বারো লাখ। এ টাকাটা আদায় করেই অপারেশন শেষ করতে হবে”।
আব্দুল বলল, “হয়ে যাবে স্যার। ভাববেন না। কুড়ি তারিখ রাতে তিরিস লাখ টাকা নিয়ে ও ঘরে যাচ্ছে। কাজেই আমার টিম অনায়াসেই বারো লাখ টাকা আদায় করতে পারবে”।
পরিতোষ বলল, “তুই তাহলে একুশ তারিখ অপারেশন করতে হবে ধরে নিয়ে যা কিছু প্রিপারেশন নেবার নিয়ে নে। তবে শোন, একটা কথা মাথায় রাখবি। তুই যে এ ঘটণার ভেতর জড়িয়ে আছিস তা যেন ওরা একেবারে বুঝতে না পারে। তোর সাথে ওই বদমাশটার হয়ত পরেও কখনও মুখোমুখি হতে পারে। তাই ওরা যেন কিছুতেই তোকে কোনভাবে সন্দেহ না করতে পারে”।
আব্দুল বলল, “সে নিয়ে ভাববেন না স্যার। আমি সেদিকে সতর্ক থাকব। কিন্তু স্যার, সিডিগুলো কি রেডি হয়েছে? ওই অস্ত্রটার তো প্রয়োজন হবে”।
পরিতোষ সামনের টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছোট ব্যাগটার দিকে ঈশারা করে বলল, “সে’সব এই ব্যাগের মধ্যে আছে। নিয়ে যা। তবে তোকে একটা কাজ করতে হবে। অভির কাছে গিয়ে এ সব ক’টা সিডির একটা একটা করে কপি করে সেগুলো পরে আমাকে এক সময় দিয়ে যাবি। কিন্তু খুব সাবধানে রাখবি। অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোর সাথে আর আমার দেখা হবে না। তাই আজই নিয়ে যা এটা। আর অপারেশন শেষ হবার এক ঘন্টার মধ্যেই টিমের সবাই যেন কলকাতা ছেড়ে চলে যায়, সে ব্যবস্থা আগে থেকেই পাকা করে রাখবি। আর ওরা সবাই চলে যাবার পর তুই আমাকে ফোন করে সবটা জানাবি। গোটা প্ল্যানটা আরেকবার ভাল করে স্টাডি করিস। আর অপারেশনের সময় ওদের ওপর নজর রেখে যাবি। বেচাল কোন কিছু দেখলেই সাথে সাথে আমাকে ফোন করবি। ঠিক আছে”?
আব্দুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে চেন খুলে ভেতরের সিডিগুলো দেখতে দেখতে বলল, “ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। তবে আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত থাকুন। টিমের সকলেই এসব ব্যাপারে খুব প্রফেশনাল। কোনরকম হেরফের হবে না”।
পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “তাহলে আজ এ পর্যন্তই থাক। তুই পেছনের গেট দিয়েই বেরিয়ে যা” বলে পাশের ঘরের দিকে মুখ করে একটু গলা তুলে বিট্টুকে ডাকল। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই বিট্টু এসে আব্দুলকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিট্টু ফিরে আসতেই পরিতোষও বিট্টুর মার সাথে দেখা করে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।
*************
মা বাবার সাথে পরামর্শ করে পরদিন বিকেলের ট্রেণে রতীশকে নিয়ে রচনা সীমন্তিনীর ওখানে গেল। সীমন্তিনীর মিটিং শেষ হল বিকেল পাঁচটার পর। মিটিং শেষ হতেই সে রচনার মোবাইলে ফোন করল। রচনার মোবাইলটা বেজে বেজে একসময় কেটে গেল। কলটা রিসিভ করলনা কেউ। রতীশের মোবাইলে ফোন করেও একই অবস্থা। দু’জনের ফোনেই সাড়া না পেয়ে সীমন্তিনী চিন্তায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে কিংশুককে ফোন করতেই কিংশুক জানাল যে রতীশ আর রচনার বিকেল সাড়ে তিনটের ট্রেনে সীমন্তিনীর ওখানে যাবার কথা ছিল। কিংশুক তখন হসপিটালে। সে জানাল যে রচনা সকাল থেকে দুপুর অব্দি অর্চনার কাছে ছিল। কিংশুক বাড়ি থেকে খেয়ে অর্চনার খাবার নিয়ে এসে রচনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিকেলের পর থেকে কিংশুক হসপিটালেই আছে বলে সে পাকাপাকি ভাবে বলতে পারছিল না যে রচনা আর রতীশ সত্যি সত্যি ট্রেন ধরেছে কিনা। এ’কথা শুনে সীমন্তিনী একটু অবাকই হল। কিন্তু এ ব্যাপারে কিংশুককে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে সে ফোন কেটে দিয়ে রেলওয়ে এনকুয়ারিতে ফোন করে জানল যে ট্রেনটা কুড়ি মিনিট লেটে এসেছিল। আর এইমাত্রই সেটা এ ষ্টেশন থেকে ছেড়ে গেল। সীমন্তিনী সাথে সাথে তার কোয়ার্টারের ল্যাণ্ডলাইন নাম্বারে ফোন করল। লক্ষ্মীর সাথে কথা বলে বুঝল রচনা ওরা বাড়ি এসে পৌঁছয় নি এখনও।
সকালে রচনা একবার সীমন্তিনীর সাথে ফোনে কথা বলেছিল। রচনা ইচ্ছে করেই তখন সীমন্তিনীকে তাদের আসবার কথা বলেনি। মনে মনে ভেবেছিল, আগে থেকে কোন খবর না দিয়ে সোজা সীমন্তিনীর কোয়ার্টারে গিয়ে তাকে চমকে দেবে। রতীশকেও সে সেভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর কিংশুককেও একই ভাবে বলে এসেছিল তাদের আসার ব্যাপারটা গোপন রাখতে। তাই সীমন্তিনীর ফোন পেয়েও তারা কেউ সাড়া দেয়নি। নাগরাকাটা ষ্টেশনে নেমে রতীশ আর রচনা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সীমন্তিনীর কোয়ার্টারের সামনে এসে নামল প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছোট লাগেজটা হাতে করে রতীশ রচনাকে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামতেই রচনা চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “ইশ কী সুন্দর গো জায়গাটা। পাহাড়ের মাঝে দিদিভাইয়ের কোয়ার্টারটা একেবারে একটা ছবির মত মনে হচ্ছে, তাই না সোনা”?
______________________________
বিট্টু বলল, “না না দাদা। এ আপনি কী করছেন। আপনি তো যখনই আসেন তখনই আমাকে কিছু না কিছু টাকা দিয়েই যান”।
পরিতোষ জোর করে বিট্টুর হাতে টাকাটা গুঁজে দিতেই পেছনের গেটে ঠকঠক শব্দ হল। বিট্টু সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিকক্ষণ বাদে বিট্টুর সাথে শেখর এসে ঘরে ঢুকল। তার হাতে মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগ ঝুলছে। বিট্টু শেখরকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে পরিতোষকে বলল, “দাদা আপনারা কথা বলুন। আমি পাশের ঘরেই আছি। প্রয়োজন হলে ডাকবেন” বলে চলে গেল।
পরিতোষ শেখরকে বসতে বলে বলল, “সকালে তো ফোন করে বললি, তোর কাজ কমপ্লিট হয়েছে। তা জিনিসগুলো এনেছিস”?
শেখর নিজের হাতে ঝোলান ব্যাগটার চেন খুলতে খুলতে বলল, “হ্যা স্যার, সব কমপ্লিট হয়ে গেছে। মোট আটটা সিডি বানানো হয়েছে। আর আপনি যেমন বলেছিলেন, একটা বাইরের কোন লোকেশনের বানাতে, সেটাও হয়েছে। একটা হোটেলের রুমের। আর সবগুলোই দারুণ ক্লিয়ার আর টপ ক্লাস ফিল্ম হয়েছে” বলতে বলতে সিডিগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল।
পরিতোষ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু অবাক হয়ে বলল, “হোটেলের রুমে গিয়েও রেকর্ডিং করেছিস। তোদের অসাধ্য বলে কিছু নেই না কি রে? হোটেলের কেউ এসব ব্যাপার জানতে পারেনি তো”?
শেখর হেসে বলল, “আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন স্যার। কাকপক্ষীটিও টের পায় নি। রেকর্ডিংটা যে করেছে একমাত্র সে-ই শুধু জানে। ফিল্মের হিরোইন নিজে পর্যন্ত কিচ্ছুটি টের পায়নি। তবে একটা ব্যাপারে একটু বেশী কশাস থাকতে হয়েছে বলেই, হোটেলের সিডিটায় হিরোইনের গ্রাহকের মুখটা একবারও দেখা যাবে না। কিন্তু তাতে ফিল্মের এন্টারটেইনমেন্টে কোন ঘাটতি হয়নি। বরং ওটাই সবচেয়ে ওয়াইল্ড হয়েছে”।
পরিতোষ হেসে বলল, “সে হোক গে। তাতে কিছু যায় আসে না। হিরোইনটাকে ভাল করে বোঝা গেলেই হল। তা এই সিডিগুলো ছাড়া অন্য কোথাও কোন কপি টপি রাখিস নি তো”?
শেখর জবাব দিল, “না স্যার, আমি নিজে হাতে সবগুলো প্রোজেক্ট ফাইল আর ক্যামেরার ফুটেজ সব কিছু ডিলিট করে দিয়েছি। কিন্তু স্যার আমার মনে হয় এ সিডিগুলোর একটা করে কপি বানিয়ে আপনার কাস্টডিতে রেখে দিলে ভাল হত। ভবিষ্যতে যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে”।
পরিতোষ বলল, “না। সেকেণ্ড ফেজে অপারেশনটা সাকসেসফুলি করতে পারলে এগুলোর আর দরকার পড়বে না কোনদিন। তবে ব্রহ্মাস্ত্র একটা তো হাতে রাখতেই হবে। ওটা হয়ে যাবে। আচ্ছা এবারে বল, তোরা ক’জন কাজে লেগেছিলি। আর তোদের বিল কত পেমেন্ট করতে হবে”?
শেখর জবাব দিল, “সব মিলিয়ে ছ’জনকে রিক্রুট করতে হয়েছে স্যার। আমি বাদে দু’জন ফুল টাইম ওয়াচার চারদিন কাজ করেছে, একজন কম্পিউটার এসিস্ট্যান্ট, যে রেকর্ডিং, এডিটিং আর মিক্সিং এক হাতে করেছে। চার দিন তিন রাত জেগে ওকে রেকর্ডিং করতে হয়েছে। আর তিনদিন লেগেছে ফাইলগুলো প্রসেসিং করে এডিটিং মিক্সিং করে সিডি বানাতে। ওকেই সবচেয়ে বেশী দিতে হবে। বেচারাকে রাত দিন কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। আর দু’জন ফিমেল পার্ট টাইমার। ফিমেল পার্টটাইমার দুটো পনের কুড়ি মিনিট করে সার্ভিস দিয়েছে। তাই ওদের দু’জনকে দশ হাজার করে দিলেই চলবে। আর ফুলটাইম ওয়াচার দু’জনকে চার দিনের ডিউটির জন্যে চল্লিশ হাজার করে দিতে হবে। কম্পিউটার এসিস্ট্যান্টটাকেই বেশী দিতে হবে। দেড় লাখ। আর আমার হাত থেকে প্রায় বারো হাজার খরচ হয়েছে”।
পরিতোষ মনে মনে হিসেব করে বলল, “তাহলে তোকে বাদ দিয়ে ওদের পাঁচজনকে দিতে হচ্ছে আড়াই লাখ। আর তোর জন্যে যদি এক লাখ হিসেব করে রাখি চলবে তো”?
শেখর বলল, “স্যার আপনার কাছ থেকে আমি যত ফেভার পেয়ে থাকি তার বিনিময়ে যেটুকু করেছি তা তো কিছুই নয়। এটা আপনার নিজস্ব কাজ। তাই এ কাজে আমি আলাদা করে কোন পারিশ্রমিক নেব না। আপনি শুধু আমার খরচের টাকাটাই দিয়ে দেবেন। আর কিছু চাই না আমি”।
পরিতোষ বলল, “আমি তোদের জন্য যা কিছু করি বা করেছি, তার জন্য আমাকে কখনও কোন প্রতিদান দেবার কথা তুলবি না। আমি তোদেরকে শুধু সৎ ভাবে বাঁচতে দেখলেই খুশী হব রে। আচ্ছা যাক সে কথা, তোকে সব মিলিয়ে আমি তাহলে তিন লাখ বাষট্টি হাজার দেব। তবে পেমেন্টটা কিন্তু এখনই দিতে পারবনা তোকে ভাই। সেকেণ্ড ফেজ অপারেশনটা শেষ হলেই সেটা দেওয়া সম্ভব হবে। অন্য টিমের বাজেট হিসেব করে অপারেশনের টাইমিং ঠিক করতে হবে। তাই তোর লোকজনদের একটু ধৈর্য্য ধরে থাকতে বলিস। অপারেশনটা ভাল ভাবে করে ফেলতে পারলেই সম্ভব হলে সেদিনই, নইলে পরের দিন তোদের সকলের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেব আমি”।
শেখর বলল, “ও নিয়ে সমস্যা হবে না স্যার। আমি সবাইকে ম্যানেজ করে নিতে পারব। আপনাকে অপারেশন শেষ করতে কোনরকম তাড়াহুড়ো করতে হবে না”।
পরিতোষ বলল, “ঠিক আছে, তুই তাহলে এখন যেতে পারিস। আমি সময় মত তোকে কন্টাক্ট করব। ঠিক আছে”?
শেখর চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “ঠিক আছে স্যার। আসছি তাহলে” বলে উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ বিট্টুকে ডাক দিল। বিট্টু আসতেই সে বলল, “একে পেছনের গেট দিয়েই বাইরে বের করে দে। আমি বসছি এখানে। আরেকজন আসবে খানিক বাদেই”।
বিট্টু শেখরকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই পরিতোষ একজনকে ফোন করল। ও’পাশের সাড়া পেতেই সে বলল, “কোথায় আছিস আব্দুল”?
ও’পাশ থেকে জবাব এল, “স্যার আপনার ফোনের জন্যেই অপেক্ষা করছি। আপনি যে ঠিকানার কথা বলেছিলেন, তার কাছাকাছিই আছি”।
পরিতোষ বলল, “তাহলে চলে আয় এখনই। আমি তোর জন্যে ওয়েট করছি”।
ও’পাশ থেকে আব্দুল জবাব দিল, “ঠিক আছে স্যার। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আপনার সামনে হাজির হয়ে যাব”।
পরিতোষ বলল, “তুই পেছনের গেটে এসে নক করবি। আমি গেটে লোক পাঠিয়ে দেব” বলে ফোন কেটে দিল।
মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই বিট্টু চায়ের কাপ হাতে ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল, “দাদা ভেতরে আসব”?
পরিতোষ জবাব দিল, “হ্যা আয়”।
বিট্টু ঘরে ঢুকে পরিতোষের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মা আপনার জন্যে চা বানিয়েছেন। নিন”।
পরিতোষ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বিট্টু, আর মিনিট দশেকের ভেতর পেছনের গেট দিয়ে আরেকজন আসবে। একটু দরজাটা খুলে দিস ভাই। তোকে খুব জ্বালাচ্ছি তাই না রে”?
বিট্টু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন এমন করে বলছেন দাদা। আমি আর এমন কী রাজকার্য করছি? ঘরে বসে জিকের বই পড়ছি শুধু। আমি একদম বিরক্ত হচ্ছি না। আপনি আপনার কাজ করুন। আমি পাশের ঘরেই আছি। গেটে শব্দ হলেই আমি বুঝতে পারব” বলে চলে গেল।
পরিতোষ চা খেতে খেতে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে থাকল। পেছনের গেটে খটখট শব্দে সে সজাগ হল। কিছুক্ষণ পরেই বিট্টু রুমের বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল, “দাদা আব্দুল ভাই এসেছে”।
পরিতোষ জবাব দিল, “ওকে ভেতরে পাঠিয়ে তুই পড়গে যা। আমি তোকে পরে ডেকে নেব”।
আব্দুল ঘরে ঢুকেই বলল, “নমস্কার স্যার”।
পরিতোষও প্রতি নমস্কার করে হেসে বলল, “প্রীতিদি তোকে ভালই শিক্ষা দিচ্ছে দেখি রে আব্দুল। এতদিন তো আসসালামওয়ালেকুম বলতিস। আজ একেবারে আমাদের স্টাইলে নমস্কার বলছিস”।
আব্দুল লাজুক হেসে হাতজোড় করে বলল, “তা যা বলেছেন স্যার। আমার ধর্মকর্ম সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে”।
পরিতোষ আব্দুলকে বসতে বলে বলল, “প্রীতিদি কেমন আছে রে? আর তোদের বাচ্চাটা? কি যেন নাম রেখেছিস”?
আব্দুল বলল, “আপ্রীত স্যার। মা বেটা দু’জনেই আপনার আশীর্বাদে ভাল আছে। স্যার প্রীতি আপনাকে ওর একটা অনুরোধ জানাতে বলেছে”।
পরিতোষ অবাক হয়ে বলল, “প্রীতিদির অনুরোধ? কী অনুরোধ বল তো শুনি”।
আব্দুল বলল, “স্যার আপ্রীতের বয়স তো ছ’মাস হয়ে গেছে। প্রীতি বলছিল ওর নাকি অন্নপ্রাশন দেবার সময় হয়ে এসেছে। আমার তো আর শ্বশুর বাড়ি বলতে কিছু নেই। তাই প্রীতি আপনাকে অনুরোধ করেছে ছেলের অন্নপ্রাশনের দিন আপনাকে আমাদের সাথে থাকতে হবে। আর ছেলের মামা হিসেবে ওর মুখে নাকি প্রথম ভাত তুলে দিতে হবে আপনাকে”।
পরিতোষ হেসে বলল, “তোর ছেলের মামা যখন হয়েই গেছি, তখন তোর বৌয়ের আদেশ তো মানতেই হবে। কিন্তু অন্নপ্রাশনের দিন তারিখটা আমাকে আগে থেকে জানিয়ে দিস। আর তোর গ্যারেজ কবে স্টার্ট হচ্ছে”?
আব্দুল বলল, “ট্রেড লাইসেন্সটা দিতে বড্ড দেরী করছে স্যার। যতবার যাই, একই কথা শোনায়। বলে যে পুলিশ ভেরিকেশন রিপোর্ট এখনও পাই নি আমরা। ওটা না পেলে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা যাবে না। তিন মাস ধরে এ কথাই শুনছি শুধু। আর সব কিছু তো একদম রেডি হয়ে গেছে”।
পরিতোষ একটু অবাক হয়ে বলল, “তিন মাস ধরে এমনটা চলছে, তো আমাকে জানাসনি কেন”?
আব্দুল নিজের হাত কচলে বলল, “এমন ছোটখাট ব্যাপারে আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি স্যার”।
পরিতোষ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। ব্যাপারটা আমি দেখব’খন। এবার আসল কথায় আসছি। তোর লেটেস্ট রিপোর্ট কি সেটা আগে বল তো”।
আব্দুল বলল, “মক্কেলের পাঁচটা কেসের হদিশ পেয়েছি স্যার। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আরেকটা বড় ডীল করতে যাচ্ছে। নকল কাগজ পত্র বের করে মফস্বলের এক বিজনেস ম্যানকে একটা ছোট দোকান ঘর বিক্রী করতে যাচ্ছে বদমাশটা। দর ঠিক হয়েছে ত্রিশ লাখ। অফিসের বাবুদের দেবে চার লাখ। বাকি ছাব্বিশ লাখ দু’জনের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। এ কাজে ওর পার্টনার সুখলাল যাদব নামের এক দালাল। যাদবপুরে থাকে। ডীলটা হবার কথা এ মাসের কুড়ি তারিখে। আমার লোক সব খবরাখবর রাখছে”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “খবর পাকা”?
আব্দুল বলল, “হ্যা স্যার। পুরোপুরি পাকা খবর”।
পরিতোষ একটু ভাবতে ভাবতে বলল, “আজ হচ্ছে তের তারিখ। ডীলটা হচ্ছে কুড়ি তারিখ। সেদিনই ও টাকা পাচ্ছে। তাহলে আমাদের অপারেশনটা করতে হবে একুশ তারিখেই। নইলে টাকাগুলো এদিক সেদিক হয়ে গেলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আচ্ছা ডীলটা কুড়ি তারিখ ঠিক কখন হবে, সেটা জানতে পেরেছিস”?
আব্দুল বলল, “লেনদেনটা হবে স্যার বেলা দুটোর পর। এটাও পাকা খবর”।
পরিতোষ মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল, “একটা কাজ করতে পারবি? কুড়ি তারিখ ও যেন টাকাগুলো নিজের বাড়িতেই নিয়ে আসতে বাধ্য হয়, সে ব্যবস্থা করতে পারবি”?
আব্দুল বলল, “অবশ্যই পারব স্যার। কোন অসুবিধেই হবে না আমার। আমি নিজে ওকে আমার ওখানে আঁটকে রাখব। রাত দশটার আগে ও আমার ওখান থেকে বেরোতেই পারবে না। তখন টাকার ব্যাগ সহ আমি নিজে ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেব রাত এগারোটা নাগাদ। তারপর সে রাতে ও আর ওই টাকাটা সরাবার সুযোগ পাবে না। কিন্তু পরের দিন সকালে আমাদের টিম ওর বাড়ি গিয়ে পৌঁছনোর আগে ওকে বাড়িতেই কিছু একটা করে আটকে রাখতে হবে। সেটা কি করে করা যায়, তাই ভাবছি”।
পরিতোষ বলল, “ইলেকশন অফিসার সেজে ওকে ফোন করে বলতে হবে যে সকাল ন’টার সময়ই ইলেকশন অফিসের স্টাফ তার বাড়িতে আসবে ভেরিফিকেশনে। সে যেন ইলেকশন অফিসের লোক না আসা পর্যন্ত বাড়ি থেকে না বেরোয়। আর ইলেকশন অফিসের লোকেরা এসে যদি তাকে বাড়িতে না পায়, তাহলে তাকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করে তাকে এরেস্ট করা হবে। ফোনটা তুই করবি। আর আমিও আলাদা ভাবে ওর বাড়ির সামনে ওয়াচ রাখবার ব্যবস্থা করব সকাল সাতটা থেকে। তোর টিম যেন সকাল ন’টার মধ্যে পৌঁছে যায়। গোটা অপারেশনটা শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে বলে ভাবছিস”?
আব্দুল বলল, “স্যার প্ল্যানটা যেভাবে বানানো হয়েছে তাতে তো ঘন্টা তিনেক কম করেও লাগবে। তবে আমি ওদের সবাইকে বলে দেব, যতটা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা যায়, ওরা যেন সে চেষ্টাই করে”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “টিম বাইরে থেকে আনছিস তো”?
আব্দুল জবাব দিল, “হ্যা স্যার। তিনজন ঝাড়খণ্ডের আর দু’জন ওড়িষ্যার”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “কততে কন্ট্রাক্ট করেছিস”?
আব্দুল বলল, “প্রত্যেককে এক এক লাখ দিতে হবে”।
পরিতোষ মনে মনে একটু হিসেব কষে বলল, “ফেজ ওয়ানে সব মিলে খরচ হয়েছে তিন লাখ বাষট্টি হাজার। আর এবারেও পাঁচ লাখ। তারপর তোর আর আমার কিছু ইনফর্মারকেও কিছু কিছু দিতে হবে। সব মিলে প্রায় সাড়ে দশ লাখ টাকার মত হচ্ছে। আর যার জন্যে এসব করতে হচ্ছে তাকে দু’লাখ ফিরিয়ে দিতে হবে। তার মানে সব মিলে দাঁড়াচ্ছে সাড়ে বারো লাখ। এ টাকাটা আদায় করেই অপারেশন শেষ করতে হবে”।
আব্দুল বলল, “হয়ে যাবে স্যার। ভাববেন না। কুড়ি তারিখ রাতে তিরিস লাখ টাকা নিয়ে ও ঘরে যাচ্ছে। কাজেই আমার টিম অনায়াসেই বারো লাখ টাকা আদায় করতে পারবে”।
পরিতোষ বলল, “তুই তাহলে একুশ তারিখ অপারেশন করতে হবে ধরে নিয়ে যা কিছু প্রিপারেশন নেবার নিয়ে নে। তবে শোন, একটা কথা মাথায় রাখবি। তুই যে এ ঘটণার ভেতর জড়িয়ে আছিস তা যেন ওরা একেবারে বুঝতে না পারে। তোর সাথে ওই বদমাশটার হয়ত পরেও কখনও মুখোমুখি হতে পারে। তাই ওরা যেন কিছুতেই তোকে কোনভাবে সন্দেহ না করতে পারে”।
আব্দুল বলল, “সে নিয়ে ভাববেন না স্যার। আমি সেদিকে সতর্ক থাকব। কিন্তু স্যার, সিডিগুলো কি রেডি হয়েছে? ওই অস্ত্রটার তো প্রয়োজন হবে”।
পরিতোষ সামনের টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছোট ব্যাগটার দিকে ঈশারা করে বলল, “সে’সব এই ব্যাগের মধ্যে আছে। নিয়ে যা। তবে তোকে একটা কাজ করতে হবে। অভির কাছে গিয়ে এ সব ক’টা সিডির একটা একটা করে কপি করে সেগুলো পরে আমাকে এক সময় দিয়ে যাবি। কিন্তু খুব সাবধানে রাখবি। অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোর সাথে আর আমার দেখা হবে না। তাই আজই নিয়ে যা এটা। আর অপারেশন শেষ হবার এক ঘন্টার মধ্যেই টিমের সবাই যেন কলকাতা ছেড়ে চলে যায়, সে ব্যবস্থা আগে থেকেই পাকা করে রাখবি। আর ওরা সবাই চলে যাবার পর তুই আমাকে ফোন করে সবটা জানাবি। গোটা প্ল্যানটা আরেকবার ভাল করে স্টাডি করিস। আর অপারেশনের সময় ওদের ওপর নজর রেখে যাবি। বেচাল কোন কিছু দেখলেই সাথে সাথে আমাকে ফোন করবি। ঠিক আছে”?
আব্দুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে চেন খুলে ভেতরের সিডিগুলো দেখতে দেখতে বলল, “ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। তবে আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত থাকুন। টিমের সকলেই এসব ব্যাপারে খুব প্রফেশনাল। কোনরকম হেরফের হবে না”।
পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “তাহলে আজ এ পর্যন্তই থাক। তুই পেছনের গেট দিয়েই বেরিয়ে যা” বলে পাশের ঘরের দিকে মুখ করে একটু গলা তুলে বিট্টুকে ডাকল। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই বিট্টু এসে আব্দুলকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিট্টু ফিরে আসতেই পরিতোষও বিট্টুর মার সাথে দেখা করে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।
*************
মা বাবার সাথে পরামর্শ করে পরদিন বিকেলের ট্রেণে রতীশকে নিয়ে রচনা সীমন্তিনীর ওখানে গেল। সীমন্তিনীর মিটিং শেষ হল বিকেল পাঁচটার পর। মিটিং শেষ হতেই সে রচনার মোবাইলে ফোন করল। রচনার মোবাইলটা বেজে বেজে একসময় কেটে গেল। কলটা রিসিভ করলনা কেউ। রতীশের মোবাইলে ফোন করেও একই অবস্থা। দু’জনের ফোনেই সাড়া না পেয়ে সীমন্তিনী চিন্তায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে কিংশুককে ফোন করতেই কিংশুক জানাল যে রতীশ আর রচনার বিকেল সাড়ে তিনটের ট্রেনে সীমন্তিনীর ওখানে যাবার কথা ছিল। কিংশুক তখন হসপিটালে। সে জানাল যে রচনা সকাল থেকে দুপুর অব্দি অর্চনার কাছে ছিল। কিংশুক বাড়ি থেকে খেয়ে অর্চনার খাবার নিয়ে এসে রচনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিকেলের পর থেকে কিংশুক হসপিটালেই আছে বলে সে পাকাপাকি ভাবে বলতে পারছিল না যে রচনা আর রতীশ সত্যি সত্যি ট্রেন ধরেছে কিনা। এ’কথা শুনে সীমন্তিনী একটু অবাকই হল। কিন্তু এ ব্যাপারে কিংশুককে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে সে ফোন কেটে দিয়ে রেলওয়ে এনকুয়ারিতে ফোন করে জানল যে ট্রেনটা কুড়ি মিনিট লেটে এসেছিল। আর এইমাত্রই সেটা এ ষ্টেশন থেকে ছেড়ে গেল। সীমন্তিনী সাথে সাথে তার কোয়ার্টারের ল্যাণ্ডলাইন নাম্বারে ফোন করল। লক্ষ্মীর সাথে কথা বলে বুঝল রচনা ওরা বাড়ি এসে পৌঁছয় নি এখনও।
সকালে রচনা একবার সীমন্তিনীর সাথে ফোনে কথা বলেছিল। রচনা ইচ্ছে করেই তখন সীমন্তিনীকে তাদের আসবার কথা বলেনি। মনে মনে ভেবেছিল, আগে থেকে কোন খবর না দিয়ে সোজা সীমন্তিনীর কোয়ার্টারে গিয়ে তাকে চমকে দেবে। রতীশকেও সে সেভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর কিংশুককেও একই ভাবে বলে এসেছিল তাদের আসার ব্যাপারটা গোপন রাখতে। তাই সীমন্তিনীর ফোন পেয়েও তারা কেউ সাড়া দেয়নি। নাগরাকাটা ষ্টেশনে নেমে রতীশ আর রচনা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সীমন্তিনীর কোয়ার্টারের সামনে এসে নামল প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছোট লাগেজটা হাতে করে রতীশ রচনাকে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামতেই রচনা চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “ইশ কী সুন্দর গো জায়গাটা। পাহাড়ের মাঝে দিদিভাইয়ের কোয়ার্টারটা একেবারে একটা ছবির মত মনে হচ্ছে, তাই না সোনা”?
______________________________