06-03-2020, 07:02 PM
(Update No. 106)
রচনা অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “দিদিভাইয়ের কথা আর কী বলবো তোকে দিদি? তার কথা তো সারা রাতেও ফুরোবে না। তবে দিদিভাই আমাদের জীবনে এসেছেন চার বছর আগে। আমাদের বিয়েরও বছর খানেক আগে। কিন্তু এই চার বছরে তিনি এত কিছু করেছেন যে অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবেনা রে দিদি। তবে তুই সত্যি বলেছিস। দিদিভাই আমাদের থেকে এত দুরে থাকলেও রোজ সকাল বিকেল আর রাত মিলিয়ে দু’তিনবার আমাদের সাথে কথা বলেন। কলকাতায় আমাদের সুবিধে অসুবিধের সমস্ত খবরাখবর রাখেন তিনি। আর আমাদের মা বাবা ভাই যেন তার নিজেরই মা বাবা ভাই হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। আমার বিয়ের সময় বাবাকে একটা টাকাও খরচ করতে হয়নি। মেয়ের বাড়ির সমস্ত খরচ খরচা দিদিভাইই দিয়েছেন। অবশ্য তখনও সে চাকরিতে ঢোকেননি। আমার শ্বশুর আর খুড়ো শ্বশুরদের কাছ থেকেই সবটা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই বা কে করে বল? আর এমন সুন্দর শ্বশুর বাড়ি আমার, এক মুখে আমি তা বয়ান করতে পারব নারে দিদি। সেখানে বাবা, মামনি, বড়কাকু, মেজোমা, ছোটকাকু, ছোটমা, সবগুলো ভাইবোন আমাকে যে কী ভালবাসে সে তুই নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবিনা দিদি। আর এমন একটা শ্বশুর বাড়ি, এমন একটা স্বামী পেয়েছি শুধু এই দিদিভাইয়ের জন্যেই। আর শুধু কি আমার বিয়ে? দিদিভাই চাকরি পাবার পর প্রথম আড়াই বছর হায়দ্রাবাদে ছিলেন। সেখান থেকেই পুজোর সময় বাড়ির সকলের জন্যে কাপড় চোপর পাঠাতেন। এখানে মা বাবা ভাইয়ের জন্যেও আলাদা প্যাকেট করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। আর ভাই মাধ্যমিক পাশ করবার পর থেকে দিদিভাইই তো তার পড়াশোনার পুরো খরচটা নিজে বহন করছেন। আর শুধু কি তাই? মা বাবার সব প্রয়োজনের দিকেও তার নজর আছে। বাবার শরীরটা মাঝে খুব খারাপ হয়েছিল। দিদিভাই বাবাকে আলিপুরদুয়ার নিয়ে গিয়ে ভাল ডাক্তারের কাছে সব রকম চেকআপ করে বাবার ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দিদিভাই এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে যজমানি করতে নিষেধ করেছেন বাবাকে। বাড়ি গেলেই দেখতে পাবি, রাস্তার দিকে আমাদের যে ফুলের বাগানটা ছিল, সেখানে একটা দোকান ঘর বানানো হচ্ছে। দিদিভাই সেখানে একটা দোকান করে দেবে বাবার জন্য। আর আমার তো মনে হয় বাড়ির সংসার খরচের অনেকটাই বোধ হয় দিদিভাইই বহন করে থাকেন। অবশ্য এ ব্যাপারে দিদিভাই আমাকে কিছু বলেননি। আর মা,বাবা, ভাইও এখনও কিছু বলেনি। কিন্তু আজ বাড়ির অবস্থা দেখে আমার তেমনই মনে হয়েছে। আমাদের বাড়িটা আগের থেকে অনেক ঝকঝকে তকতকে লাগছিল আমার। আর এখন তো তার জন্যেই আমরা তোকে ফিরে পেলাম। দিদিভাই আমাদের জন্যে যা করেছেন আর এখনও করে যাচ্ছেন, তাতে তার কাছে আমি অন্ততঃ চিরঋণী হয়ে গেছিরে দিদি”।
অর্চনা মন দিয়ে রচনার কথা শুনে যাচ্ছিল। রচনা থামতেই সে বলে উঠল, “জানিস রচু, মা কাল কথায় কথায় বলছিলেন যে তার মন্তিমা নাকি সাক্ষাৎ মা দুর্গা। আমি তো দিদিভাইকে আজই প্রথম দেখলুম। তোর বরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাকে দেখে আমারও মনে হচ্ছিল, মাদুর্গা স্বয়ং বুঝি পুলিশ অফিসারের পোশাক পড়ে এ কেবিনে এসে হাজির হয়েছেন। কী সুন্দর দেখতে! যেমন লম্বা তেমন সুন্দর স্বাস্থ্য আর একেবারে ফেটে পড়া গায়ের রঙ! তা হ্যারে রচু, দিদিভাই বিয়ে করেন নি? মা তো বলছিলেন, তিনি নাকি তোর বরের চেয়ে মাত্র ছ’মাসের ছোট। বয়স কেমন হবে রে”?
রচনা জবাব দিল, “ওনার এখন আটাশ বছর তিন মাস চলছে। দিদিভাইয়ের তাহলে সাতাশ বছর ন’মাস হবে। প্রায় আটাশই বলা যায়। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কোন কথাই বলতে চান না। আমার বিয়ের আগেও তো দিদিভাই বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তখন থেকেই আমরা দু’জন একেবারে বন্ধুর মত হয়ে গেছি। সব কথাই আমার সঙ্গে শেয়ার করেন। বিয়ের অনেক আগেই আমাকে একদিন শুধু বলেছিলেন যে তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কোন একটা ছেলেকে মনে মনে ভালবাসতেন। মনে মনে তিনি নাকি তাকেই নিজের স্বামী বলে মানেন। কিন্তু অত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কথা মেনে নেওয়া তো দুরের কথা, কেউ ভাবতেও পারবে না। কিন্তু তাদের বাড়ির সকলেই নাকি ঘটণাটা জানতেন। বাড়ির সবাই নাকি দিদিভাইকে অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টাও করেছেন। দিদিভাই সকলের কথা মেনে নিয়ে সে ছেলেটার থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এখনও তিনি মনে মনে সেই ছেলেটিকেই নিজের স্বামী বলে ভাবেন। আর দিদিভাইয়ের এ মানসিকতাটা বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারেননি। তাই বাড়ির লোকদের সাথে তার যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। একমাত্র মামনি, মানে আমার নিজের শাশুড়ি মা, আর ছোটকাকু ছাড়া কেউ দিদিভাইয়ের তেমন খোঁজখবর নেন না। আমার বৌভাতের দিন দিদিভাই শেষবারের মত সে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখন আমিও খেয়াল করেছি, মামনি আর ছোটকাকু ছাড়া কেউ তার সাথে কথা বলেনি। আর আমাকে যে কী ভালবাসেন তা বলে বোঝাতে পারব না আমি। আমি আর তার দাদাভাই ছাড়া তার জীবনে এখন যদি আর কেউ থেকে থাকে, তা হচ্ছে এই কালচিনি বাড়ির সবাই। আমাদের মা বাবা ভাই এখন তারও নিজের মা বাবা ভাই হয়ে গেছে যেন। তবে একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি রে দিদি। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা প্রত্যেকেই খুব ভাল মানুষ। তারা দিদিভাইয়ের সাথে কথা না বললেও, দিদিভাইয়ের কথার অন্যথা কিন্তু ও বাড়ির ছোটবড় কেউই করে না। দিদিভাই মামনি আর ছোটকাকুর মাধ্যমে যাকে যা করার নির্দেশ দেন, সবাই সেসব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই তোকে এত ভালবাসেন, তুই কখনও তার কাছে জানতে চাসনি তিনি কাকে ভালবাসতেন, বা তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার পাতুক”।
রচনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে ইচ্ছে তো মাঝে মধ্যেই হয় রে দিদি। কিন্তু কী করব? দিদিভাই যে গোড়াতেই জল ঢেলে রেখেছেন। আমাদের বিয়ের বছর খানেক আগেই সে আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে ও ব্যাপারে তাকে যেন কখনও কিছু আমি জিজ্ঞেস না করি। তিনি নিজেই একদিন আমাকে সে’সব কথা বলবেন। তাই তো সে রাস্তায় আর যেতে পারিনি। কিন্তু বাড়িতে মামনি আর মেজোমার সাথে এ ব্যাপারে দু’একবার কথা উঠিয়েছিলুম। মেজোমা তো পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন যে দিদিভাইকে নিয়ে তিনি কোনও রকম কথাই বলতে চান না। আর মামনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে দিদিভাইকে হাজারভাবে বুঝিয়েও কোন ফল হয়নি আর হবেও না। সে প্রচণ্ড রকমের জেদী স্বভাবের মেয়ে। তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাবার ক্ষমতা ভগবানেরও নেই। এরপর আর আমার কিছু বলার থাকে বল? কিন্তু বিয়ের আগেই দিদিভাইকে এত ভালবেসে ফেলেছি যে তিনি তখন থেকেই একাধারে আমার বান্ধবী, দিদি আর অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। দিদিভাইকে না জানিয়ে আমিও কক্ষনও কিচ্ছুটি করি না। দিদিভাইয়ের সাথে একবেলা কথা না হলে আমার মনটা ছটফট করতে শুরু দেয়। এই তো তোর এ ঘটনাটা যেদিন ঘটল, তার দুদিন আগে দিদিভাই দার্জিলিং বর্ডারের কাছাকাছি একটা ঘণ জঙ্গলে ঘেরা কোন একটা জায়গায় ডিউটিতে গিয়েছিলেন। সেখানে মোবাইলের সিগন্যাল ছিল না। তিনি যদি তখন তার ষ্টেশনে থাকতেন তাহলে হয়ত তোকে হসপিটালে নেবার সাথে সাথে তিনিও এখানে এসে পড়তেন। তখন দিদিভাইয়ের সাথে প্রায় তিনদিন আমাদের কোন কথা হয়নি। আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি। সেদিন বেলা এগারোটা নাগাদ আমাকে ফোন করে বলেছিলেন যে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি বাড়ি চলে আসবেন। কিন্তু তারপরই এখানকার ওসির ফোন পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছিলেন। মা বাবারা তো আগে খবরই পাননি। দিদিভাই আগে হসপিটালে এসে তোকে দেখে তারপর বাড়ি গিয়ে মা, বাবা ভাইকে নিয়ে তোর এখানে এনেছিলেন। তোর যখন জ্ঞান ফিরে এসেছিল, তখন দিদিভাই তো এ কেবিনেই ছিলেন। কিন্তু ডাক্তাররা তোকে আবার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছিল বলে তোর সাথে আর কথা বলবার সুযোগ পাননি”।
অর্চনা বলল, “হ্যারে, ভাইও আমাকে এ’কথা বলেছে। আর তখন থেকেই তো আমার মনে হচ্ছে আমি যে এখনও বেঁচে আছি, এ জীবনটা দিদিভাইয়ের দেওয়া জীবন” একটু থেমেই অর্চনা আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রচু, তোর শ্বশুর বাড়ির সকলের কথাই তো বললি। তা বরের সাথে তোর ভাব ভালবাসা কেমন রে? সে তোকে ভালবাসে তো”?
রচনা অর্চনার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে জবাব দিল, “খুব ভালবাসে রে দিদি। আর তাই তো রোজ ঠাকুর পুজো করবার সময় ঠাকুরকে প্রণাম করবার পর আমি মনে মনে দিদিভাইকেও একটা প্রণাম করি। তোর বিয়ের পরিণতি দেখে তো আমিও মনে মনে ভেবেছিলুম আমাকেও বুঝি বাবা কোন একটা বুড়ো হাবড়া দোজবরের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু কোত্থেকে দেবদূতের মত দিদিভাই আমার জীবনে এলেন। আর তার জন্যেই তো এমন একটা বর আমি পেয়েছি। আমি মনে মনে যেমন একটা বরের স্বপ্ন দেখতুম ও ঠিক তেমনটাই রে দিদি। আর সেই সাথে সাথে এমন একটা শ্বশুর বাড়িও পেয়েছি যে বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য আমাকে তাদের প্রাণভরা ভালবাসা দিয়েছে”।
অর্চনা বলল, “তোর কথা শুনে আমার মনটা খুশীতে ভরে গেল রে রচু। ভগবান যেন তোদের দু’জনের মধ্যেকার এ ভালবাসাটাকে চিরদিন অম্লান করে রাখেন। তা হ্যারে রচু, তোদের বিয়ের তো তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও বাচ্চাকাচ্চা নিসনি কেন রে”?
রচনা একটু লাজুক মুখে জবাব দিল, “আমার তো এখনও একুশ কমপ্লিট হয়নি। ওরও তেমন বয়স হয়নি। তাই বিয়ের পরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম যে আমার একুশ বছর পূর্ণ না হওয়া অব্দি আমরা অপেক্ষা করব। আর এখন ও আবার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কলকাতা গিয়ে স্বাধীন ভাবে একটা যোগা সেন্টার খুলবার চেষ্টা করছে। একমাসও হয়নি আমরা কলকাতা গিয়েছি। অবশ্য সব ঠিক থাকলে এতদিনে ওর সেন্টারটা চালু হয়ে যেত। কিন্তু যার ওপর ভরসা করেছিল, সে লোকটাই দু’লাখ টাকা মেরে দিয়েছে বলে সেটা আর করা হয়নি। আমি তো আবার বাড়িতেই ফিরে আসতে চেয়েছিলুম। কিন্তু ওর মনের স্বপ্নটা ভেঙে দিতে পারিনি। তাই আপাততঃ আরেকটা ভাল যোগা ইনস্টিটিউটে ট্রেনার হিসেবে জয়েন করছে। এখন আর কিছুদিন না গেলে বাচ্চা নেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে না। আর আমিও তাতে সায় দিয়েছি”।
অর্চনা রচনার কথা শুনে একটু চিন্তান্বিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছিস? মানে তোদের দু’জনের শারীরিক কোন অসুবিধে নেই তো”?
রচনা স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিল, “নারে দিদি, তেমন কোন ব্যাপারই নেই। কারুর কোন অসুবিধেও নেই, আর আমাদের ভেতরে শারীরিক সম্মন্ধও খুব ভালই আছে। কিন্তু প্রিকশান নিচ্ছি বলেই এখনও কনসিভ করিনি”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছিস বোন? কিছু লুকোচ্ছিস না তো আমার কাছে”?
রচনা মিষ্টি করে হেসে বলল, “তোর কাছে আমি কিছু লুকোবো, এ কথা তুই ভাবতে পারিস? এই তোকে ছুঁয়ে বলছি আমি। যা কিছু তোকে বললাম তা সব সত্যি সত্যি সত্যি”।
অর্চনা সেকথা শুনে নিজের দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, “ঠাকুর আমার বোনটাকে দেখো তুমি। ও যেন সবদিক দিয়ে পূর্ণতা পায় ঠাকুর”।
রচনার হঠাৎ খেয়াল হল কথায় কথায় আটটা বেজে গেছে। আটটায় একটা ট্যাবলেট খাওয়াবার কথা। সাইড কেবিনেট থেকে ট্যাবলেটটা নিয়ে অর্চনাকে খাইয়ে দিতেই রচনার মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। কিংশুকের ফোন। কিংশুক জানাল আর অল্পক্ষণের ভেতরেই রতীশ আর সে হসপিটালে এসে পড়বে।
**************
রাত আটটা নাগাদ পরিতোষ রেস্টুরেন্টে গাড়ি রেখে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে রেস্টুরেন্টের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বিট্টুদের বাড়ির সামনের দড়জায় এসে কড়া নাড়ল। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই বিট্টু দরজা খুলে পরিতোষকে দেখেই বলল, “আরে দাদা, আপনি? আসুন আসুন”।
পরিতোষ ভেতরে ঢুকতেই বিট্টু দরজা বন্ধ করে বলল, “কোন ঘরে বসবেন দাদা”?
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “বসবো তো পেছনের ওই ঘরেই। তবে তার আগে মাসিমার সাথে একটু কথা বলি। উনি কোথায়”?
বিট্টু বলল, “আসুন দাদা, আমার সাথে আসুন”।
রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে বিট্টু গলা তুলে বলল, “মা পরিতোষদা এসেছেন। একটু তোমার ঘরে আসবে”?
ভেতর থেকে ক্ষীণ গলায় এক নারীকন্ঠের জবাব শোনা গেল, “পরিতোষ এসেছে? খুব ভাল হয়েছে। তুই ওকে নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে বোস। আমি হাতের কাজটা সেরেই আসছি”।
বিট্টু পরিতোষকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকে পরিতোষকে একটা চেয়ারে বসতে দিল। পরিতোষ নিজের হাতঘড়ির দিকে দেখে বলল, “তোর খবর টবর কি রে? কোন কিছু হল”?
বিট্টু একটা মোড়ায় বসতে বসতে বলল, “না দাদা। এখনও কোন কিছু হয়নি। গত পরশু একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। খুব আশা ছিল এবারে হয়ত একটা জবাব পাব। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেরিয়ে যাবার পর দেখলাম, আমি কোয়ালিফাই করিনি। কয়েকদিন পর আরেকটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। সেটাতে কি হয় কে জানে। কিন্তু এ ইন্টারভিউটা ভালই দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এটায় হয়তো ঠিক কোয়ালিফাই করব”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “একটা প্রাইভেট কলেজে টিচারি করবি? বাচ্চাদের কলেজ। ইংলিশ মেডিয়াম। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে এগারোটা অব্দি ক্লাস হয়। প্রিপারেটরি থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে এখন। আর কলেজটা তোর বাড়ি থেকেও খুব বেশী দুরেও নয়। বাড়ি থেকে সাইকেলে যেতে পনেরো কুড়ি মিনিটের মত লাগবে। শুরুতে আট হাজার দেবে বলেছে”।
বিট্টু মনমরা হয়ে বলল, “এখন তো ঘরের এমন অবস্থা যে, পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আর মাথা ঘামানো চলে না। কলেজের মাস্টারীও করব। তা কবে যেতে হবে সেখানে দাদা”?
পরিতোষ বলল, “কাল শনিবার। কলেজ দু’দিন বন্ধ। তুই সোমবার সেখানে গিয়ে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হৈমন্তী চ্যাটার্জির সাথে দেখা করে আমার রেফারেন্স দিস। আমি তাকে বলে রাখব। হয়ত তিনি তোর একটা ছোট খাটো ইন্টারভিউ নেবেন। তারপর হয়ত তার ডিসিশন জানাবেন। তবে মনে হয় তোকে ফিরিয়ে দেবেন না। কিন্তু তুই ওই বেতনে কাজ করতে রাজি থাকলেই শুধু যাবি। নইলে গিয়ে লাভ নেই। কলেজটা সবেমাত্র বছর দুয়েক হল চালু করা হয়েছে। আরও কিছুটা বড় না হলে টিচারদের বেতন বাড়াতে পারছে না তারা”।
বিট্টু বলল, “যাব দাদা। এখন যা পাই তাই করব। সোমবার আমি অবশ্যই যাব। তারপর যা হয় সেটা আপনাকে জানিয়ে দেব”।
এমন সময় বিট্টুর মা দু’হাতে দুটো বাটিতে একটু একটু পায়েস নিয়ে ঘরে এসে ঢুকে বিট্টুকে বললেন, “খোকা, রান্না ঘরে দুটো গ্লাসে জল গড়িয়ে রেখে এসেছি। একটু নিয়ে আয় না বাবা” বলে পরিতোষের দিকে একটা বাটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও তো বাবা। একটুখানি পায়েস বানিয়েছিলাম আজ খোকার জন্মদিন বলে। তুমি এসেছ বলে খুব খুশী হয়েছি”।
পরিতোষ হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিয়ে বলল, “ইস দেখেছেন মাসিমা। আজ যে বিট্টুর জন্মদিন এটা তো আমার জানাই ছিল না। আমি যে একেবারে খালি হাতে এসেছি। ছিঃ ছিঃ”।
বিট্টুর মা একটু হেসে পাশের একটা মোড়ায় বসতে বসতে বললেন, “তুমি যে না জেনেও আজকের দিনে আমাদের বাড়ি এসেছ, এটাই তো আমাদের কাছে অনেক বড় পাওনা বাবা। তুমি আমার খোকাকে শুধু একটু আশীর্বাদই করে যেও। এটাই তো ওর কাছে বিরাট উপহার”।
বিট্টু জলের গ্লাস দুটো এনে মাটিতে রেখে বলল, “এ ঘরে কোন টেবিল নেই দাদা, দেখতেই পাচ্ছেন। তাই জলের গ্লাস দুটো এখানেই রাখছি”।
বিট্টুর মা বিট্টুকে বললেন, “দাদাকে প্রণাম করে তার আশীর্বাদ নে খোকা। তারপর তোর পায়েসটা মুখে দে”।
বিট্টু পরিতোষকে প্রণাম করতেই পরিতোষ তার মাথায় হাত রেখে বলল, “আজ তোর জন্মদিন, এ’কথাটা আমায় জানাসনি কেন”?
বিট্টু মোড়ায় বসে মায়ের হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে বলল, “না দাদা, মানে, আমরা তো আর ও’সব নিয়ে কোন আয়োজন করি না। আর ও’সব করার সামর্থ্যই বা কোথায়। তাই কাউকেই জানাই নি। আপনি হঠাৎ করে এসে পড়লেন বলেই ......”।
পরিতোষ পায়েস খাওয়া শেষ করে খালি বাটিটা মেঝেতে রেখে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, “হঠাৎ করে এসে তোর পায়েসে ভাগ বসালুম। মাসিমা হয়ত তোর জন্যে এইটুকু পায়েসই বানিয়েছিলেন। আর আমি এসে তার বেশীর ভাগটাই খেয়ে ফেললাম”।
বিট্টুর মা বললেন, “এ কী বলছ বাবা? আমরা গরীব। দিন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই তো ইচ্ছে থাকলেও কাউকে ডেকে কিছু খাওয়াবার সামর্থ্য আমাদের নেই। আর তোমার চেয়ে বড় হিতৈষী আমাদের আর কে আছে বলো? আমার খোকাটা তো তোমার একটু আশীর্বাদ পেল আজকের দিনে। এটা কি কম কিছু”?
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “আপনার শরীর কেমন আছে মাসিমা”?
বিট্টুর মা বললেন, “এই তো ক’দিন আগেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলুম। আগের থেকে বেশ কিছুটা ভাল আছি এখন। কিন্তু শরীরটা এখনও বেশ দুর্বল। ডাক্তাররা তো অনেক ওষুধ পত্র লিখে দিয়েছেন। খোকা তো অনেক কষ্ট করে সব কিছুই এনেছে। ওগুলো খেয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়”।
বিট্টু পায়েস আর জল খেয়ে মোড়া থেকে উঠে বলল, “মা আমি দাদাকে নিয়ে একটু পেছনের ঘরে বসিয়ে আসছি। তুমি এ সময়টুকু তোমার ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নাও” বলে খালি বাটি আর গ্লাসগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বিট্টুর সাথে পেছনের ঘরে এসে পরিতোষ বলল, “একটু বাদেই একজন পেছনের দরজায় কড়া নাড়বে। গেটটা খুলে দিস” বলে নিজের মানি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে বিট্টুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা রাখ। তোর জন্মদিনের দিন একেবারে খালি হাতে এসেছি। একটা শার্ট কিনে নিস পছন্দ করে”।
রচনা অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “দিদিভাইয়ের কথা আর কী বলবো তোকে দিদি? তার কথা তো সারা রাতেও ফুরোবে না। তবে দিদিভাই আমাদের জীবনে এসেছেন চার বছর আগে। আমাদের বিয়েরও বছর খানেক আগে। কিন্তু এই চার বছরে তিনি এত কিছু করেছেন যে অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবেনা রে দিদি। তবে তুই সত্যি বলেছিস। দিদিভাই আমাদের থেকে এত দুরে থাকলেও রোজ সকাল বিকেল আর রাত মিলিয়ে দু’তিনবার আমাদের সাথে কথা বলেন। কলকাতায় আমাদের সুবিধে অসুবিধের সমস্ত খবরাখবর রাখেন তিনি। আর আমাদের মা বাবা ভাই যেন তার নিজেরই মা বাবা ভাই হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। আমার বিয়ের সময় বাবাকে একটা টাকাও খরচ করতে হয়নি। মেয়ের বাড়ির সমস্ত খরচ খরচা দিদিভাইই দিয়েছেন। অবশ্য তখনও সে চাকরিতে ঢোকেননি। আমার শ্বশুর আর খুড়ো শ্বশুরদের কাছ থেকেই সবটা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই বা কে করে বল? আর এমন সুন্দর শ্বশুর বাড়ি আমার, এক মুখে আমি তা বয়ান করতে পারব নারে দিদি। সেখানে বাবা, মামনি, বড়কাকু, মেজোমা, ছোটকাকু, ছোটমা, সবগুলো ভাইবোন আমাকে যে কী ভালবাসে সে তুই নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবিনা দিদি। আর এমন একটা শ্বশুর বাড়ি, এমন একটা স্বামী পেয়েছি শুধু এই দিদিভাইয়ের জন্যেই। আর শুধু কি আমার বিয়ে? দিদিভাই চাকরি পাবার পর প্রথম আড়াই বছর হায়দ্রাবাদে ছিলেন। সেখান থেকেই পুজোর সময় বাড়ির সকলের জন্যে কাপড় চোপর পাঠাতেন। এখানে মা বাবা ভাইয়ের জন্যেও আলাদা প্যাকেট করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। আর ভাই মাধ্যমিক পাশ করবার পর থেকে দিদিভাইই তো তার পড়াশোনার পুরো খরচটা নিজে বহন করছেন। আর শুধু কি তাই? মা বাবার সব প্রয়োজনের দিকেও তার নজর আছে। বাবার শরীরটা মাঝে খুব খারাপ হয়েছিল। দিদিভাই বাবাকে আলিপুরদুয়ার নিয়ে গিয়ে ভাল ডাক্তারের কাছে সব রকম চেকআপ করে বাবার ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দিদিভাই এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে যজমানি করতে নিষেধ করেছেন বাবাকে। বাড়ি গেলেই দেখতে পাবি, রাস্তার দিকে আমাদের যে ফুলের বাগানটা ছিল, সেখানে একটা দোকান ঘর বানানো হচ্ছে। দিদিভাই সেখানে একটা দোকান করে দেবে বাবার জন্য। আর আমার তো মনে হয় বাড়ির সংসার খরচের অনেকটাই বোধ হয় দিদিভাইই বহন করে থাকেন। অবশ্য এ ব্যাপারে দিদিভাই আমাকে কিছু বলেননি। আর মা,বাবা, ভাইও এখনও কিছু বলেনি। কিন্তু আজ বাড়ির অবস্থা দেখে আমার তেমনই মনে হয়েছে। আমাদের বাড়িটা আগের থেকে অনেক ঝকঝকে তকতকে লাগছিল আমার। আর এখন তো তার জন্যেই আমরা তোকে ফিরে পেলাম। দিদিভাই আমাদের জন্যে যা করেছেন আর এখনও করে যাচ্ছেন, তাতে তার কাছে আমি অন্ততঃ চিরঋণী হয়ে গেছিরে দিদি”।
অর্চনা মন দিয়ে রচনার কথা শুনে যাচ্ছিল। রচনা থামতেই সে বলে উঠল, “জানিস রচু, মা কাল কথায় কথায় বলছিলেন যে তার মন্তিমা নাকি সাক্ষাৎ মা দুর্গা। আমি তো দিদিভাইকে আজই প্রথম দেখলুম। তোর বরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাকে দেখে আমারও মনে হচ্ছিল, মাদুর্গা স্বয়ং বুঝি পুলিশ অফিসারের পোশাক পড়ে এ কেবিনে এসে হাজির হয়েছেন। কী সুন্দর দেখতে! যেমন লম্বা তেমন সুন্দর স্বাস্থ্য আর একেবারে ফেটে পড়া গায়ের রঙ! তা হ্যারে রচু, দিদিভাই বিয়ে করেন নি? মা তো বলছিলেন, তিনি নাকি তোর বরের চেয়ে মাত্র ছ’মাসের ছোট। বয়স কেমন হবে রে”?
রচনা জবাব দিল, “ওনার এখন আটাশ বছর তিন মাস চলছে। দিদিভাইয়ের তাহলে সাতাশ বছর ন’মাস হবে। প্রায় আটাশই বলা যায়। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কোন কথাই বলতে চান না। আমার বিয়ের আগেও তো দিদিভাই বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তখন থেকেই আমরা দু’জন একেবারে বন্ধুর মত হয়ে গেছি। সব কথাই আমার সঙ্গে শেয়ার করেন। বিয়ের অনেক আগেই আমাকে একদিন শুধু বলেছিলেন যে তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কোন একটা ছেলেকে মনে মনে ভালবাসতেন। মনে মনে তিনি নাকি তাকেই নিজের স্বামী বলে মানেন। কিন্তু অত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কথা মেনে নেওয়া তো দুরের কথা, কেউ ভাবতেও পারবে না। কিন্তু তাদের বাড়ির সকলেই নাকি ঘটণাটা জানতেন। বাড়ির সবাই নাকি দিদিভাইকে অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টাও করেছেন। দিদিভাই সকলের কথা মেনে নিয়ে সে ছেলেটার থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এখনও তিনি মনে মনে সেই ছেলেটিকেই নিজের স্বামী বলে ভাবেন। আর দিদিভাইয়ের এ মানসিকতাটা বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারেননি। তাই বাড়ির লোকদের সাথে তার যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। একমাত্র মামনি, মানে আমার নিজের শাশুড়ি মা, আর ছোটকাকু ছাড়া কেউ দিদিভাইয়ের তেমন খোঁজখবর নেন না। আমার বৌভাতের দিন দিদিভাই শেষবারের মত সে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখন আমিও খেয়াল করেছি, মামনি আর ছোটকাকু ছাড়া কেউ তার সাথে কথা বলেনি। আর আমাকে যে কী ভালবাসেন তা বলে বোঝাতে পারব না আমি। আমি আর তার দাদাভাই ছাড়া তার জীবনে এখন যদি আর কেউ থেকে থাকে, তা হচ্ছে এই কালচিনি বাড়ির সবাই। আমাদের মা বাবা ভাই এখন তারও নিজের মা বাবা ভাই হয়ে গেছে যেন। তবে একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি রে দিদি। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা প্রত্যেকেই খুব ভাল মানুষ। তারা দিদিভাইয়ের সাথে কথা না বললেও, দিদিভাইয়ের কথার অন্যথা কিন্তু ও বাড়ির ছোটবড় কেউই করে না। দিদিভাই মামনি আর ছোটকাকুর মাধ্যমে যাকে যা করার নির্দেশ দেন, সবাই সেসব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই তোকে এত ভালবাসেন, তুই কখনও তার কাছে জানতে চাসনি তিনি কাকে ভালবাসতেন, বা তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার পাতুক”।
রচনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে ইচ্ছে তো মাঝে মধ্যেই হয় রে দিদি। কিন্তু কী করব? দিদিভাই যে গোড়াতেই জল ঢেলে রেখেছেন। আমাদের বিয়ের বছর খানেক আগেই সে আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে ও ব্যাপারে তাকে যেন কখনও কিছু আমি জিজ্ঞেস না করি। তিনি নিজেই একদিন আমাকে সে’সব কথা বলবেন। তাই তো সে রাস্তায় আর যেতে পারিনি। কিন্তু বাড়িতে মামনি আর মেজোমার সাথে এ ব্যাপারে দু’একবার কথা উঠিয়েছিলুম। মেজোমা তো পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন যে দিদিভাইকে নিয়ে তিনি কোনও রকম কথাই বলতে চান না। আর মামনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে দিদিভাইকে হাজারভাবে বুঝিয়েও কোন ফল হয়নি আর হবেও না। সে প্রচণ্ড রকমের জেদী স্বভাবের মেয়ে। তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাবার ক্ষমতা ভগবানেরও নেই। এরপর আর আমার কিছু বলার থাকে বল? কিন্তু বিয়ের আগেই দিদিভাইকে এত ভালবেসে ফেলেছি যে তিনি তখন থেকেই একাধারে আমার বান্ধবী, দিদি আর অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। দিদিভাইকে না জানিয়ে আমিও কক্ষনও কিচ্ছুটি করি না। দিদিভাইয়ের সাথে একবেলা কথা না হলে আমার মনটা ছটফট করতে শুরু দেয়। এই তো তোর এ ঘটনাটা যেদিন ঘটল, তার দুদিন আগে দিদিভাই দার্জিলিং বর্ডারের কাছাকাছি একটা ঘণ জঙ্গলে ঘেরা কোন একটা জায়গায় ডিউটিতে গিয়েছিলেন। সেখানে মোবাইলের সিগন্যাল ছিল না। তিনি যদি তখন তার ষ্টেশনে থাকতেন তাহলে হয়ত তোকে হসপিটালে নেবার সাথে সাথে তিনিও এখানে এসে পড়তেন। তখন দিদিভাইয়ের সাথে প্রায় তিনদিন আমাদের কোন কথা হয়নি। আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি। সেদিন বেলা এগারোটা নাগাদ আমাকে ফোন করে বলেছিলেন যে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি বাড়ি চলে আসবেন। কিন্তু তারপরই এখানকার ওসির ফোন পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছিলেন। মা বাবারা তো আগে খবরই পাননি। দিদিভাই আগে হসপিটালে এসে তোকে দেখে তারপর বাড়ি গিয়ে মা, বাবা ভাইকে নিয়ে তোর এখানে এনেছিলেন। তোর যখন জ্ঞান ফিরে এসেছিল, তখন দিদিভাই তো এ কেবিনেই ছিলেন। কিন্তু ডাক্তাররা তোকে আবার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছিল বলে তোর সাথে আর কথা বলবার সুযোগ পাননি”।
অর্চনা বলল, “হ্যারে, ভাইও আমাকে এ’কথা বলেছে। আর তখন থেকেই তো আমার মনে হচ্ছে আমি যে এখনও বেঁচে আছি, এ জীবনটা দিদিভাইয়ের দেওয়া জীবন” একটু থেমেই অর্চনা আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রচু, তোর শ্বশুর বাড়ির সকলের কথাই তো বললি। তা বরের সাথে তোর ভাব ভালবাসা কেমন রে? সে তোকে ভালবাসে তো”?
রচনা অর্চনার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে জবাব দিল, “খুব ভালবাসে রে দিদি। আর তাই তো রোজ ঠাকুর পুজো করবার সময় ঠাকুরকে প্রণাম করবার পর আমি মনে মনে দিদিভাইকেও একটা প্রণাম করি। তোর বিয়ের পরিণতি দেখে তো আমিও মনে মনে ভেবেছিলুম আমাকেও বুঝি বাবা কোন একটা বুড়ো হাবড়া দোজবরের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু কোত্থেকে দেবদূতের মত দিদিভাই আমার জীবনে এলেন। আর তার জন্যেই তো এমন একটা বর আমি পেয়েছি। আমি মনে মনে যেমন একটা বরের স্বপ্ন দেখতুম ও ঠিক তেমনটাই রে দিদি। আর সেই সাথে সাথে এমন একটা শ্বশুর বাড়িও পেয়েছি যে বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য আমাকে তাদের প্রাণভরা ভালবাসা দিয়েছে”।
অর্চনা বলল, “তোর কথা শুনে আমার মনটা খুশীতে ভরে গেল রে রচু। ভগবান যেন তোদের দু’জনের মধ্যেকার এ ভালবাসাটাকে চিরদিন অম্লান করে রাখেন। তা হ্যারে রচু, তোদের বিয়ের তো তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও বাচ্চাকাচ্চা নিসনি কেন রে”?
রচনা একটু লাজুক মুখে জবাব দিল, “আমার তো এখনও একুশ কমপ্লিট হয়নি। ওরও তেমন বয়স হয়নি। তাই বিয়ের পরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম যে আমার একুশ বছর পূর্ণ না হওয়া অব্দি আমরা অপেক্ষা করব। আর এখন ও আবার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কলকাতা গিয়ে স্বাধীন ভাবে একটা যোগা সেন্টার খুলবার চেষ্টা করছে। একমাসও হয়নি আমরা কলকাতা গিয়েছি। অবশ্য সব ঠিক থাকলে এতদিনে ওর সেন্টারটা চালু হয়ে যেত। কিন্তু যার ওপর ভরসা করেছিল, সে লোকটাই দু’লাখ টাকা মেরে দিয়েছে বলে সেটা আর করা হয়নি। আমি তো আবার বাড়িতেই ফিরে আসতে চেয়েছিলুম। কিন্তু ওর মনের স্বপ্নটা ভেঙে দিতে পারিনি। তাই আপাততঃ আরেকটা ভাল যোগা ইনস্টিটিউটে ট্রেনার হিসেবে জয়েন করছে। এখন আর কিছুদিন না গেলে বাচ্চা নেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে না। আর আমিও তাতে সায় দিয়েছি”।
অর্চনা রচনার কথা শুনে একটু চিন্তান্বিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছিস? মানে তোদের দু’জনের শারীরিক কোন অসুবিধে নেই তো”?
রচনা স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিল, “নারে দিদি, তেমন কোন ব্যাপারই নেই। কারুর কোন অসুবিধেও নেই, আর আমাদের ভেতরে শারীরিক সম্মন্ধও খুব ভালই আছে। কিন্তু প্রিকশান নিচ্ছি বলেই এখনও কনসিভ করিনি”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছিস বোন? কিছু লুকোচ্ছিস না তো আমার কাছে”?
রচনা মিষ্টি করে হেসে বলল, “তোর কাছে আমি কিছু লুকোবো, এ কথা তুই ভাবতে পারিস? এই তোকে ছুঁয়ে বলছি আমি। যা কিছু তোকে বললাম তা সব সত্যি সত্যি সত্যি”।
অর্চনা সেকথা শুনে নিজের দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, “ঠাকুর আমার বোনটাকে দেখো তুমি। ও যেন সবদিক দিয়ে পূর্ণতা পায় ঠাকুর”।
রচনার হঠাৎ খেয়াল হল কথায় কথায় আটটা বেজে গেছে। আটটায় একটা ট্যাবলেট খাওয়াবার কথা। সাইড কেবিনেট থেকে ট্যাবলেটটা নিয়ে অর্চনাকে খাইয়ে দিতেই রচনার মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। কিংশুকের ফোন। কিংশুক জানাল আর অল্পক্ষণের ভেতরেই রতীশ আর সে হসপিটালে এসে পড়বে।
**************
রাত আটটা নাগাদ পরিতোষ রেস্টুরেন্টে গাড়ি রেখে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে রেস্টুরেন্টের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বিট্টুদের বাড়ির সামনের দড়জায় এসে কড়া নাড়ল। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই বিট্টু দরজা খুলে পরিতোষকে দেখেই বলল, “আরে দাদা, আপনি? আসুন আসুন”।
পরিতোষ ভেতরে ঢুকতেই বিট্টু দরজা বন্ধ করে বলল, “কোন ঘরে বসবেন দাদা”?
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “বসবো তো পেছনের ওই ঘরেই। তবে তার আগে মাসিমার সাথে একটু কথা বলি। উনি কোথায়”?
বিট্টু বলল, “আসুন দাদা, আমার সাথে আসুন”।
রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে বিট্টু গলা তুলে বলল, “মা পরিতোষদা এসেছেন। একটু তোমার ঘরে আসবে”?
ভেতর থেকে ক্ষীণ গলায় এক নারীকন্ঠের জবাব শোনা গেল, “পরিতোষ এসেছে? খুব ভাল হয়েছে। তুই ওকে নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে বোস। আমি হাতের কাজটা সেরেই আসছি”।
বিট্টু পরিতোষকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকে পরিতোষকে একটা চেয়ারে বসতে দিল। পরিতোষ নিজের হাতঘড়ির দিকে দেখে বলল, “তোর খবর টবর কি রে? কোন কিছু হল”?
বিট্টু একটা মোড়ায় বসতে বসতে বলল, “না দাদা। এখনও কোন কিছু হয়নি। গত পরশু একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। খুব আশা ছিল এবারে হয়ত একটা জবাব পাব। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেরিয়ে যাবার পর দেখলাম, আমি কোয়ালিফাই করিনি। কয়েকদিন পর আরেকটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। সেটাতে কি হয় কে জানে। কিন্তু এ ইন্টারভিউটা ভালই দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এটায় হয়তো ঠিক কোয়ালিফাই করব”।
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “একটা প্রাইভেট কলেজে টিচারি করবি? বাচ্চাদের কলেজ। ইংলিশ মেডিয়াম। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে এগারোটা অব্দি ক্লাস হয়। প্রিপারেটরি থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে এখন। আর কলেজটা তোর বাড়ি থেকেও খুব বেশী দুরেও নয়। বাড়ি থেকে সাইকেলে যেতে পনেরো কুড়ি মিনিটের মত লাগবে। শুরুতে আট হাজার দেবে বলেছে”।
বিট্টু মনমরা হয়ে বলল, “এখন তো ঘরের এমন অবস্থা যে, পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আর মাথা ঘামানো চলে না। কলেজের মাস্টারীও করব। তা কবে যেতে হবে সেখানে দাদা”?
পরিতোষ বলল, “কাল শনিবার। কলেজ দু’দিন বন্ধ। তুই সোমবার সেখানে গিয়ে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হৈমন্তী চ্যাটার্জির সাথে দেখা করে আমার রেফারেন্স দিস। আমি তাকে বলে রাখব। হয়ত তিনি তোর একটা ছোট খাটো ইন্টারভিউ নেবেন। তারপর হয়ত তার ডিসিশন জানাবেন। তবে মনে হয় তোকে ফিরিয়ে দেবেন না। কিন্তু তুই ওই বেতনে কাজ করতে রাজি থাকলেই শুধু যাবি। নইলে গিয়ে লাভ নেই। কলেজটা সবেমাত্র বছর দুয়েক হল চালু করা হয়েছে। আরও কিছুটা বড় না হলে টিচারদের বেতন বাড়াতে পারছে না তারা”।
বিট্টু বলল, “যাব দাদা। এখন যা পাই তাই করব। সোমবার আমি অবশ্যই যাব। তারপর যা হয় সেটা আপনাকে জানিয়ে দেব”।
এমন সময় বিট্টুর মা দু’হাতে দুটো বাটিতে একটু একটু পায়েস নিয়ে ঘরে এসে ঢুকে বিট্টুকে বললেন, “খোকা, রান্না ঘরে দুটো গ্লাসে জল গড়িয়ে রেখে এসেছি। একটু নিয়ে আয় না বাবা” বলে পরিতোষের দিকে একটা বাটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও তো বাবা। একটুখানি পায়েস বানিয়েছিলাম আজ খোকার জন্মদিন বলে। তুমি এসেছ বলে খুব খুশী হয়েছি”।
পরিতোষ হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিয়ে বলল, “ইস দেখেছেন মাসিমা। আজ যে বিট্টুর জন্মদিন এটা তো আমার জানাই ছিল না। আমি যে একেবারে খালি হাতে এসেছি। ছিঃ ছিঃ”।
বিট্টুর মা একটু হেসে পাশের একটা মোড়ায় বসতে বসতে বললেন, “তুমি যে না জেনেও আজকের দিনে আমাদের বাড়ি এসেছ, এটাই তো আমাদের কাছে অনেক বড় পাওনা বাবা। তুমি আমার খোকাকে শুধু একটু আশীর্বাদই করে যেও। এটাই তো ওর কাছে বিরাট উপহার”।
বিট্টু জলের গ্লাস দুটো এনে মাটিতে রেখে বলল, “এ ঘরে কোন টেবিল নেই দাদা, দেখতেই পাচ্ছেন। তাই জলের গ্লাস দুটো এখানেই রাখছি”।
বিট্টুর মা বিট্টুকে বললেন, “দাদাকে প্রণাম করে তার আশীর্বাদ নে খোকা। তারপর তোর পায়েসটা মুখে দে”।
বিট্টু পরিতোষকে প্রণাম করতেই পরিতোষ তার মাথায় হাত রেখে বলল, “আজ তোর জন্মদিন, এ’কথাটা আমায় জানাসনি কেন”?
বিট্টু মোড়ায় বসে মায়ের হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে বলল, “না দাদা, মানে, আমরা তো আর ও’সব নিয়ে কোন আয়োজন করি না। আর ও’সব করার সামর্থ্যই বা কোথায়। তাই কাউকেই জানাই নি। আপনি হঠাৎ করে এসে পড়লেন বলেই ......”।
পরিতোষ পায়েস খাওয়া শেষ করে খালি বাটিটা মেঝেতে রেখে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, “হঠাৎ করে এসে তোর পায়েসে ভাগ বসালুম। মাসিমা হয়ত তোর জন্যে এইটুকু পায়েসই বানিয়েছিলেন। আর আমি এসে তার বেশীর ভাগটাই খেয়ে ফেললাম”।
বিট্টুর মা বললেন, “এ কী বলছ বাবা? আমরা গরীব। দিন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই তো ইচ্ছে থাকলেও কাউকে ডেকে কিছু খাওয়াবার সামর্থ্য আমাদের নেই। আর তোমার চেয়ে বড় হিতৈষী আমাদের আর কে আছে বলো? আমার খোকাটা তো তোমার একটু আশীর্বাদ পেল আজকের দিনে। এটা কি কম কিছু”?
পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “আপনার শরীর কেমন আছে মাসিমা”?
বিট্টুর মা বললেন, “এই তো ক’দিন আগেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলুম। আগের থেকে বেশ কিছুটা ভাল আছি এখন। কিন্তু শরীরটা এখনও বেশ দুর্বল। ডাক্তাররা তো অনেক ওষুধ পত্র লিখে দিয়েছেন। খোকা তো অনেক কষ্ট করে সব কিছুই এনেছে। ওগুলো খেয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়”।
বিট্টু পায়েস আর জল খেয়ে মোড়া থেকে উঠে বলল, “মা আমি দাদাকে নিয়ে একটু পেছনের ঘরে বসিয়ে আসছি। তুমি এ সময়টুকু তোমার ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নাও” বলে খালি বাটি আর গ্লাসগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বিট্টুর সাথে পেছনের ঘরে এসে পরিতোষ বলল, “একটু বাদেই একজন পেছনের দরজায় কড়া নাড়বে। গেটটা খুলে দিস” বলে নিজের মানি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে বিট্টুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা রাখ। তোর জন্মদিনের দিন একেবারে খালি হাতে এসেছি। একটা শার্ট কিনে নিস পছন্দ করে”।
(To be cont'd .........)
______________________________