04-03-2020, 10:42 PM
(Update No. 105)
হসপিটালের গেটের ভেতর গাড়ি ঢুকতেই সীমন্তিনী দেখল আরেকটা পুলিশের জীপ কম্পাউণ্ডে পার্ক করা আছে। দেখেই বুঝল এটা কালচিনি থানার গাড়ি। সবাইকে নিয়ে হসপিটালের মূল দরজার কাছে আসতেই ভেতর থেকে কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়, আর দু’জন কনস্টেবল বেরিয়ে আসতেই সীমন্তিনীকে দেখে মিঃ রায় বললেন, “গুড আফটারনুন ম্যাডাম”।
সীমন্তিনীও ‘গুড আফটারনুন’ বলে মিঃ রায়ের সাথে করমর্দন করে জিজ্ঞেস করল, “আবার কোনও প্রব্লেম হয়েছে নাকি মিঃ রায়”?
মিঃ রায় বললেন, “না ম্যাডাম, আর কোন নতুন প্রব্লেম হয় নি। আসলে ভিক্টিমের জবানবন্দীটায় সই নেবার জন্যেই এসেছিলাম। কাল তো শুধু তার ভার্বাল স্টেটমেন্টের ওপর ভিত্তি করেই ত্রিলোচন আচার্য্যির পরিবারের সব ক’টাকে গারদে এনে পুরেছি। কিন্তু কাল তো ওদের সবাইকে কোর্টে প্রডিউস করতে হবে। তাই ভিক্টিমের রিটেন স্টেটমেন্টটার প্রয়োজন। তাই ওটা কালেক্ট করে নিলাম। আর ডক্টর সোমের রিপোর্টটাও পেয়ে গেলাম”।
সীমন্তিনী বলল, “সই হয়ে গেছে তো”?
মিঃ রায় বললেন, “হ্যা ম্যাডাম, হয়ে গেছে। তা আজ তো দেখছি দলটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে আপনাদের। দু’জন নতুন সদস্য দেখতে পাচ্ছি”।
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যা মিঃ রায়। আমার দাদা আর ভিক্টিমের ছোট বোন মানে আমার নিজের বৌদি। ঘন্টা দুয়েক আগেই এসে পৌঁছেছে এরা। আসুন পরিচয় করে দিচ্ছি” বলে রতীশ আর রচনার সাথে মিঃ রায়ের পরিচয় করিয়ে দিল। রচনা হাতজোড় করে নমস্কার করলেও রতীশ মিঃ রায়ের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “আপনি আমাদের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার”।
মিঃ রায় হেসে বললেন, “এভাবে বলবেন না দাদা। আমি তো শুধু আমার ডিউটিই করেছি। তবে হ্যা, আপনার এই বোন যদি আগে থেকে আমাকে ব্রীফিং দিয়ে না রাখতেন, তাহলে হয়ত ঘটণাটা অন্য দিকেই মোড় নিত। যাহোক, ভগবানকে ধন্যবাদ দিন, যে আমি সময় মত গিয়ে স্পটে পৌঁছতে পেরেছিলাম। তা আপনারা থাকবেন তো দু’চারদিন। পরে কথা হবে আবার”।
রতীশ হাতজোড় করে বলল, “অবশ্যই দেখা হবে স্যার”।
মিঃ রায় সীমন্তিনীর কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠতে সীমন্তিনী সবাইকে নিয়ে হসপিটালের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে রচনাকে বলল, “রচু সোনা। দিদির কাছে গিয়ে কিন্তু আর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করিস না বোন। মনে রাখিস এটা হসপিটাল। আর তোকে কাঁদতে দেখে তোর দিদিও কাঁদবে। তাতে তার শরীর কিন্তু আরো খারাপ হয়ে পড়তে পারে”।
অর্চনার কেবিনের সামনে আসতেই পাহারারত কনস্টেবল দু’জন সীমন্তিনীকে স্যালিউট করল। সীমন্তিনী বিধুবাবুকে বলল, “মেসো তুমি মাসি আর রচুকে নিয়ে কেবিনের ভেতরে যাও। আমি দাদাভাইকে নিয়ে একটু ডক্টর সোমের সাথে কথা বলে আসছি” বলে রতীশের হাত ধরে ডক্টর সোমের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল।
ডক্টর সোমের চেম্বারে ঢুকে রতীশের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আজ আপনার পেশেন্ট কেমন আছে ডক্টর”?
ডক্টর সোম বললেন, “অনেকটাই বেটার ম্যাম। বাইরের ইনজুরিগুলো বেশ শুকিয়েছে। তাই তার ব্যাণ্ডেজ খুলে দিয়েছি আজ। তবে অভুক্ত থাকতে থাকতে তার ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের কয়েকটা অর্গান খুব বেশী পরিমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেটা পুরোপুরি ভাবে সারতে মনে হয় বেশ লম্বা সময় লাগবে। তবে ততদিন তাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে হবে না। এই দু’দিনে পেশেন্ট যতটুকু সুস্থ হয়ে উঠেছে তাতে মনে হয় কাল না হলেও, পরশু দিন তাকে রিলিজ করে দিতে পারব। আপনারা পরশু দিন বিকেলে তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু আমার প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী মেডিসিন কিন্তু তাকে দিয়ে যেতে হবে। আর রিলিজ হবার পনের দিন বাদে তাকে যদি আরেকবার এখানে এনে চেকআপ করিয়ে নিয়ে যান, তাহলে ভাল হয়”।
সীমন্তিনী বলল, “অবশ্যই আনব স্যার। আপনার প্রেসক্রিপশন আর উপদেশ সবটাই আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। কিন্তু ডক্টর একটা কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে। অবশ্য আমার আশঙ্কা সত্যি হলে আপনি প্রথম দিনেই সে’কথাটা আমাদের বলে দিতেন জানি। তবু যেহেতু পেশেন্ট আমার রিলেটিভ, সে সূত্রেই ব্যক্তিগত ভাবে আমি জানতে চাই, আপনার কি মনে হয়ে পেশেন্ট কোন ভাবে সেক্সুয়ালি হ্যারাসড হয়েছে”?
ডক্টর সোম বললেন, “না ম্যাম, একেবারেই না। এসব ধরণের কেসে আমরা সেদিকটাই আগে লক্ষ্য করি। তবে আপনি শুনে খুশী হবেন যে, পেশেন্ট প্রায় অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের শিকার হলেও সেক্সুয়ালি তাকে একেবারেই হ্যারাস করা হয়নি। আমি তো আপনার মুখেই শুনেছি পাঁচ বছর বিবাহিত জীবন কাটাবার পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বছর দুয়েক আগে। কিন্তু আমি তাকে পরীক্ষা করে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি যে তার জেনাইটাল সিস্টেম একেবারে একজন অক্ষত কুমারী মেয়ের মত। ইভেন, আমি যদি শুনতাম যে সে অবিবাহিতা, আমি তাতেও অবাক হতাম না। কিন্তু পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘর করবার পরেও তার হাইমেন এখনও ইনট্যাক্ট আছে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়েছি। তাই আপনি এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে তার স্বামী বেঁচে থাকতেও তার সাথে কখনও সহবাস করেনি। এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি”।
সীমন্তিনী বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। তা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে কতটা সময় লাগতে পারে বলে ভাবছেন আপনি”?
ডক্টর সোম বললেন, “আমার দেওয়া প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী ঠিক ঠিক সময় মত ওষুধ খেলে দু’ মাসের মধ্যে সে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে যাবে বলে মনে হয়। তবে দিন পনের পর তাকে আরেকবার চেকআপ করলে তখন আরও ভালভাবে সেটা বলতে পারব”।
সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে ডক্টরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, “আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ডক্টর সোম। আপনার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তবে একটা কথা। আপনি তো জানেনই আমার পোস্টিং এখানে নয়। তবু বলছি, কখনও কোন আনওয়ান্টেড সিচুয়েশনে জড়িয়ে পড়লে আমাকে জানাবেন। আমি সাধ্যমত আপনাকে হেল্প করবার চেষ্টা করব”।
ডক্টর সোমও বেশ খুশী হয়ে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। আপনার কথা মনে রাখব”।
সীমন্তিনী রতীশকে নিয়ে ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অর্চনার কেবিনে এসে ঢুকল। রচনা দিদির পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তার চোখ জলে ভেজা। অর্চনাও রচনার কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুক পাশের খালি বেডের ওপর বসে আছে। কিংশুক লাফ দিয়ে নেমে রতীশের হাত ধরে অর্চনার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, “এই বড়দি দেখ, ইনি হচ্ছেন আমার রতু-দা। আমাদের বাড়ির ছোট জামাই”।
কিংশুকের কথা শুনে অর্চনা চোখ মেলে চাইল। রতীশের মুখের দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রচনার একটা হাত টেনে নিয়ে আরেকহাত বাড়িয়ে রতীশের একটা হাত কাছে এনে রতীশের হাতের ওপর রচনার হাতটা বসিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলল, “ভগবান তোদের দু’জনকে যেন সবসময় এমন পাশাপাশি রাখেন” কথা বলতে বলতেই রতীশের পাশে দাঁড়ানো পুলিশের পোশাক পড়া সীমন্তিনীর দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
রচনা দিদির দৃষ্টি অনুসরন করেই অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চিনতে পাচ্ছিস না? উনিই তো আমার দিদিভাই” বলেই সীমন্তিনীর উদ্দেশ্যে বলল, “ও দিদিভাই, অত দুরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কাছে এস না”।
সীমন্তিনী রতীশের পাশ কাটিয়ে অর্চনার বিছানার কাছাকাছি আসতেই অর্চনা দু’হাতে সীমন্তিনীর একটা হাত জাপটে ধরে তার মুখের কাছে টেনে এনে একের পর এক অনেকগুলো চুমু খেল। সীমন্তিনী অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল। অর্চনা চোখ বুজে পাগলের মত সীমন্তিনীর হাতে চুমু খেয়ে যাচ্ছিল। সেই দেখে ঘরের সকলের চোখ জলে ভরে এল।
পরিস্থিতি সামাল দিল কিংশুক। নিজের চোখের জল মুছে সে রচনাকে বলল, “তুই তো খুব স্বার্থপর রে ছোড়দি। দিদিভাই বুঝি শুধু তোর একারই দিদিভাই? আমার বুঝি নয়? আর বাবা মা-ও দিদিভাইকে মন্তিমা বলে ডাকেন, এসব বুঝি এমনি এমনি? আমাদের সকলের কথা না বলে তুই শুধু নিজের কথাটাই বললি”!
কিংশুকের কথা শুনে সকলেই হেসে ফেলল। সীমন্তিনী কিংশুককে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে তার মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলল, “ভাই, তোমার বড়দিকে আমি কি বলে ডাকব বল তো? সে তো আমার বৌদির দিদি। তাকে তো তাহলে দিদি বলেই ডাকতে হবে, তাইনা”?
কিংশুক বলল, “না না, দিদি কেন বলবে তুমি দিদিভাই? বড়দি তো তোমার থেকে অনেক ছোট। তাছাড়া তোমার মুখে দিদি ডাকটা ভালও শোনাবে না। তাই তুমি ছোড়দিকে যেমন রচুসোনা বলে ডাক তেমনি বড়দিকেও নাম ধরে বলে ডেকো। তোমার মুখে এ ডাকটা শুনতেই আমার বেশী ভাল লাগবে”?
অর্চনা সীমন্তিনীর হাতটা ধরে রেখেই চোখে জল নিয়েই একটুখানি হেসে বলল, “হ্যা দিদিভাই। ভাই একদম ঠিক বলেছে। আর আমাকেও তোমাকে দিদিভাই বলতে দিও”।
সীমন্তিনী অর্চনার কাছে এসে তার মাথাটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “বেশ তাই হবে। কিন্তু আর একদম কান্নাকাটি নয়। আর শোনো, আমি এইমাত্র ডক্টরের সাথে কথা বলে এলাম। তোমাকে হয়ত পরশু দিনই এখান থেকে রিলিজ দিয়ে দেবে। কিন্তু তোমাকে মাস দুয়েক ডক্টরের উপদেশ মত ওষুধ পত্র খেয়ে যেতে হবে নিয়ম করে। তারপর তুমি পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে উঠবে। দুটো দিন তো রচু এখানে থাকবে। ও থাকতে থাকতেই তুমি বাড়ি যেতে পারবে। দিন পনের বাদে আরেকবার হসপিটালে এসে ডক্টর সোমকে দিয়ে চেকআপ করিয়ে যাবে। আমি হয়ত সব সময় আসতে পারব না। তুমি হয়ত শুনেছ যে আমি এখান থেকে প্রায় ষাট সত্তর কিলোমিটার দুরে থাকি। আর তাছাড়া পুলিশের চাকরিতে সবসময় তো হুটহাট করে আসাও সম্ভব নয় ভাই। আর এখন থেকে তুমি তো বাড়িতেই থাকবে। মা বাবা ভাইদের সাথে থাকবে। তাই আমার ঘণ ঘণ না এলেও চলবে। আর শোনো, মেসো, ভাই, তোমরাও শুনে রাখ। আদালতে যখন ত্রিলোচন আচার্য্যি আর তার পরিবারের লোকগুলোর বিচার হবে তখন তোমাদেরও কোর্টে যেতে হবে। তবে ভয়ের কিছু নেই। তখন আমি আসতে না পারলেও যা যা করা প্রয়োজন, সব কিছু করব। তোমরা আদালতে গিয়ে ওদের বিয়ের সময় থেকে যা যা হয়েছে সব সত্যি সত্যি বিচারকের সামনে বলবে। আর অর্চু। তুমিও তোমার বিয়ের পর থেকে ও বাড়ির লোকগুলো তোমার সাথে যে যা করেছে সব খুলে বলবে। একদম ভয় পাবে না। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি মনে রেখো। আর আমি তোমাদের হাতের কাছে না থাকলেও যে কোন প্রয়োজনে আমাকে একটা ফোন করে দিলেই আমি সব সামলে নেব। আর কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়ও তোমাদের সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন। তাই কোনকিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা করবে না। কেমন”?
অর্চনা মন্ত্রমুগ্ধের মত সীমন্তিনীর কথাগুলো শুনে রচনাকে বলল, “রচু আমাকে একটু ধর না বোন। আমি নেমে দিদিভাইকে একটা প্রণাম করতে চাই রে”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে আবার বুকে জাপটে ধরে বলল, “না অর্চু। অমন কথা বোল না বোন। আমাকে প্রণাম করতে হবে না। তুমি শুধু ডক্টরের কথা মত নিজের ওষুধ গুলো ঠিক ঠিক খেও। আর আমার কথা মত কোর্টে গিয়ে সত্যি কথা বলে ওই বদমাশ লোকগুলোকে পাকাপাকিভাবে জেলে ঢোকাতে সাহায্য কোর”।
অর্চনাও সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে উদ্গত কান্না সামলাতে সামলাতে বলল, “করব দিদিভাই। তুমি যা বললে, সেসব কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ, তোমার কথার অন্যথা কি আমি করতে পারি”?
সীমন্তিনী বলল, “দুর বোকা মেয়ে। কেউ কারুর জন্যে কিছু করতে পারে না। ভগবান যার কপালে যা লিখে দিয়েছেন, ঠিক সেটাই হয়। আমরা শুধু তার মাধ্যম গুলোকেই ভুল করে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। আমার তো অনেকদিন আগে থেকেই ইচ্ছে করছিল তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকগুলোর হাত থেকে তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার হয়ে কোন লিখিত অভিযোগ ছাড়া সেটা করা তো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তবে আপাততঃ আর নয়। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে আসছে। এবার আমাদের সবাইকে যেতে হবে। কিন্তু মাসি, আজ রাতে কে এখানে থাকছে? আর অর্চুর রাতের খাবার কে কখন নিয়ে আসবে, সেটা ঠিক করো। আর এখন যে যে বাড়ি যেতে চাও তারা সবাই বেরিয়ে পড়ো। আমি তোমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই রওনা হব”।
রচনা বলল, “আমি এখন দিদির কাছে থাকব। ভাই তুই মা বাবার সাথে বাড়ি চলে যা। রাতে দিদির খাবার নিয়ে তোর জামাইবাবুর সাথে চলে আসিস। আমি তখন তোকে রেখে বাড়ি চলে যাব”।
কেউই আর রচনার কথার প্রতিবাদ করল না। সীমন্তিনী সবাইকে নিজের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের জায়গায় রওনা হবার আগে রতীশকে বলল পরে ফোনে কথা বলতে।
সীমন্তিনী ঘরে ফিরে আসবার মিনিট দশেক বাদেই পরিতোষের ফোন পেল। পরিতোষ জানাল রতীশ আর রচনাকে কাল সন্ধ্যের পর শিয়ালদা ষ্টেশনে যেতে দেখা গেছে। সঙ্গে দুটো লাগেজও ছিল। তাদের ফ্ল্যাট তালা বন্ধ। তারা যে কলকাতার বাইরে গেছে এটা তো শিওর। কিন্তু তাদের গন্তব্য সম্বন্ধে পরিতোষের লোকেরা সঠিক ভাবে না বলতে পারলেও তারা যে উত্তরবঙ্গগামী একটা ট্রেনে উঠেছে তার খবর পাওয়া গেছে। পরিতোষ সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল সীমন্তিনী এ ব্যাপারে কিছু জানে কি না। সীমন্তিনী পরিতোষের কথার জবাবে তাকে জানিয়ে দিল যে রতীশ রচনাকে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়ি এসেছে। সতের তারিখ সকালে হাওড়া গিয়ে পৌছবে।
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সীমন্তিনী রচনাকে ফোন করল। রচনা তখন অর্চনার মাথাটাকে কোলের ওপর নিয়ে দিদির সাথে কথা বলছিল। অনেকক্ষণ এদিক সেদিকের কথা বলার পর রচনা বলল, “ও দিদিভাই, শোনো না। আমাদের তো ষোল তারিখের রিটার্ন টিকিট কাটা আছে। আজ তো তের তারিখ পেরিয়েই গেল। আর মাত্র দুটো দিন এখানে থাকতে পারব। পরশুদিন দিদি বাড়ি যাবে। আর তারপর দিনই আমাদের চলে যেতে হবে। তোমার ওখানে কি তাহলে যাবার সুযোগ পাব না”?
সীমন্তিনী দুষ্টুমি করে বলল, “ওমা! এ তুই কেমন কথা বলছিস? এবারে তোরা এসেছিস তোর দিদিকে দেখতে। আমার এখানে ঘুরতে তো আসিস নি। তাই দিদির সাথেই তো এ সময়টুকু তোদের কাটানো উচিৎ”।
রচনা সীমন্তিনীর দুষ্টুমি বুঝতে না পেরে বলল, “হ্যা তা তো ঠিকই বলেছ তুমি। কিন্তু তুমি তো এখান থেকে মাত্র সত্তর কিলোমিটার দুরেই আছ। এত কাছে এসেও তোমার বাড়ি না গিয়ে আমরা চলে যেতে পারি”?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু দুটো দিন বাবা মা ভাই আর দিদির সাথে কাটালেই তো তোর ভাল লাগবে বেশী। আমার এখানে আর কে আছে? শুধু এই পেত্নী পুলিশ ছাড়া এ বাড়িতে তো কেবল লক্ষ্মীদিই আছে”।
রচনা অভিমানী গলায় বলে উঠল, “দিদিভাই, ভাল হচ্ছে না কিন্তু। তুমি কী সব আবোল তাবোল বলছ বল তো? তুমি কি জানো না, তুমি আমার কে আর কী? নিজেকে পেত্নী বলে তুমি আমাকে কাঁদাতে চাইছ”?
সীমন্তিনী সাথে সাথে দুষ্টুমি ছেড়ে বলল, “আরে পাগলী, তোর সাথে একটু মজা করছিলাম রে। তুই না এত বুদ্ধিমতী! আর আমার ঠাট্টাটা বুঝতে পারলি না? আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কক্ষনো বলব না, ঠিক আছে? তবে শোন, সিরিয়াসলি বলছি। তোরা কালচিনি এসেছিস শুনে লক্ষ্মীদি তো আমার মাথা খেয়ে ফেলছে রে। বার বার অনুযোগ করছে, আমি তোদের আমার সাথে করে এখানে নিয়ে এলুম না কেন। কিন্তু তোদের হাতে মাত্র আর দুটো দিনই আছে। পরশু দিন তোর দিদি হসপিটাল থেকে রিলিজ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে। সেদিন তো তোদেরকে আর আসতে বলতে পারিনা। তাহলে হাতে থাকছে শুধু কালকের দিনটা। যদি আমার এখানে আসতেই চাস, তাহলে তো কালই আসতে হবে তোদের। কিন্তু আমি যে কাল কালচিনি যেতে পারবনা রে। কাল আমার দু’বেলা দুটো ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এটেণ্ড করতে হবে। বিকেল চারটে অব্দি ব্যস্ত থাকব আমি। আর তারপর এখান থেকে কালচিনি গিয়ে আবার তোদেরকে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে তো অনেক রাত হয়ে যাবে। অত রাতে আমাকে অন ডিউটি জার্নি করতেও বারণ করেছে আমার ওপরওয়ালারা। তাহলে তোদের আমি গিয়ে আনব কি করে বল? আর তাছাড়া তোরা মাত্র দু’দিনের জন্য এসেছিস। এরই মধ্যে মাসিকে আমি কি করে বলি কথাটা বল তো? মাসিরও তো ইচ্ছে করছে এই দুটো দিন মেয়ে আর মেয়েজামাইয়ের সাথে কাটাতে”।
রচনা সীমন্তিনীর সব কথা শুনে বলল, “মা তো সেটা চাইবেনই দিদিভাই। কিন্তু তোমার ওখানে যেতেও মা বাবা আমাদের বারণ করবেন না”।
সীমন্তিনী বলল, “তোরা এত কাছে এসেও আমার ঘরে না এসেই চলে যাবি ভাবতে তো আমারও কষ্ট হচ্ছে রে রচু সোনা। কিন্তু মাসিকে তোদের এখানে আনবার কথাটা তো বলতেই পাচ্ছিনা রে বোন। তুই বরং আজ রাতেই একটু মা বাবার সাথে আলোচনা করে দেখনা, তারা কি বলেন”।
ফোনে কথা শেষ করতেই অর্চনা বলল, “তোদের কিন্তু অন্ততঃ একবেলার জন্যে হলেও দিদিভাইয়ের ওখানে যাওয়া উচিৎ রে রচু। এতদিন তো বাড়ির কারো সাথে কথাই বলতে পারিনি। এখন ভাই, মা আর বাবার মুখে দিদিভাইয়ের কথা শুনেই সময় কাটছে আমার। তোর বিয়ের আগে থেকেই তিনি যে আমাদের বাড়ি আসছিলেন, সে সময়কার থেকে শুরু করে সব কথাই তিনজনে মিলে পালা করে শোনাচ্ছে। তুই জানিস রচু, গত সাতটা বছর ধরে আমি শুধু ভগবানের কাছে অভিযোগই করেছি। বার বার মনে মনে তাকে জিজ্ঞেস করেছি যে আমি এমন কোন পাপ করেছি যে আমায় এমন নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। আর দেখ মরেই তো গিয়েছিলুম প্রায়। বাড়ি থেকে কে কখন কিভাবে আমাকে ওই রেল লাইনের ওপর নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল, আমি তো তা কিছুই জানি না। হসপিটালে জ্ঞান ফিরে আসবার পর মা, বাবা আর ভাইকে দেখতে পেয়েছিলুম। আর পরশু সন্ধ্যায় থানার ওসি আর গতকাল ভাইয়ের মুখে সব কথা শুনে বুঝলুম। দিদিভাই আমার ওপর দুরে থেকেই নজর রেখে যাচ্ছিলেন, আর থানার ওসিও নাকি তার অনুরোধেই আচার্য্যি বাড়ির ওপর নজর রেখেছিলেন। তাই তো আমাকে রেল লাইনের ওপর ফেলে চলে যাবার খবর পেয়েই ওসি নিজে ছুটে এসে আমাকে সেখান থেকে তুলে হসপিটালে নিয়ে এসেছিলেন। তাই বুঝতে পারছি, আমি যে আজও বেঁচে আছি, মা বাবা ভাইকে দেখতে পাচ্ছি, তাদের সাথে কথা বলতে পারছি, আর এই যে এ মূহুর্তে তোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, এ সবই করতে পারছি একমাত্র ওই দিদিভাইয়ের জন্যেই। তাই সাত বছর বাদে কাল থেকে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাদের পরিবারের সকলের পাশে দিদিভাই আছেন বলে”।
রচনা দিদির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তুই এত কথা বলিস না দিদি। তোর শরীর খারাপ করতে পারে। একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর না লক্ষ্মীটি। দিদিভাইয়ের কথা তো বাড়ি গিয়েও শুনতে পারবি”।
অর্চনা রচনার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “নারে আমি বুঝতে পারছি, আজ আমি অনেক ভাল আছি। তোকে আর দিদিভাইকে দেখেই বুঝি আমি ভাল হয়ে উঠেছি। তুই বলনা বোন, দিদিভাইয়ের কথা বল না। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে রে”।
______________________________
হসপিটালের গেটের ভেতর গাড়ি ঢুকতেই সীমন্তিনী দেখল আরেকটা পুলিশের জীপ কম্পাউণ্ডে পার্ক করা আছে। দেখেই বুঝল এটা কালচিনি থানার গাড়ি। সবাইকে নিয়ে হসপিটালের মূল দরজার কাছে আসতেই ভেতর থেকে কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়, আর দু’জন কনস্টেবল বেরিয়ে আসতেই সীমন্তিনীকে দেখে মিঃ রায় বললেন, “গুড আফটারনুন ম্যাডাম”।
সীমন্তিনীও ‘গুড আফটারনুন’ বলে মিঃ রায়ের সাথে করমর্দন করে জিজ্ঞেস করল, “আবার কোনও প্রব্লেম হয়েছে নাকি মিঃ রায়”?
মিঃ রায় বললেন, “না ম্যাডাম, আর কোন নতুন প্রব্লেম হয় নি। আসলে ভিক্টিমের জবানবন্দীটায় সই নেবার জন্যেই এসেছিলাম। কাল তো শুধু তার ভার্বাল স্টেটমেন্টের ওপর ভিত্তি করেই ত্রিলোচন আচার্য্যির পরিবারের সব ক’টাকে গারদে এনে পুরেছি। কিন্তু কাল তো ওদের সবাইকে কোর্টে প্রডিউস করতে হবে। তাই ভিক্টিমের রিটেন স্টেটমেন্টটার প্রয়োজন। তাই ওটা কালেক্ট করে নিলাম। আর ডক্টর সোমের রিপোর্টটাও পেয়ে গেলাম”।
সীমন্তিনী বলল, “সই হয়ে গেছে তো”?
মিঃ রায় বললেন, “হ্যা ম্যাডাম, হয়ে গেছে। তা আজ তো দেখছি দলটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে আপনাদের। দু’জন নতুন সদস্য দেখতে পাচ্ছি”।
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যা মিঃ রায়। আমার দাদা আর ভিক্টিমের ছোট বোন মানে আমার নিজের বৌদি। ঘন্টা দুয়েক আগেই এসে পৌঁছেছে এরা। আসুন পরিচয় করে দিচ্ছি” বলে রতীশ আর রচনার সাথে মিঃ রায়ের পরিচয় করিয়ে দিল। রচনা হাতজোড় করে নমস্কার করলেও রতীশ মিঃ রায়ের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “আপনি আমাদের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার”।
মিঃ রায় হেসে বললেন, “এভাবে বলবেন না দাদা। আমি তো শুধু আমার ডিউটিই করেছি। তবে হ্যা, আপনার এই বোন যদি আগে থেকে আমাকে ব্রীফিং দিয়ে না রাখতেন, তাহলে হয়ত ঘটণাটা অন্য দিকেই মোড় নিত। যাহোক, ভগবানকে ধন্যবাদ দিন, যে আমি সময় মত গিয়ে স্পটে পৌঁছতে পেরেছিলাম। তা আপনারা থাকবেন তো দু’চারদিন। পরে কথা হবে আবার”।
রতীশ হাতজোড় করে বলল, “অবশ্যই দেখা হবে স্যার”।
মিঃ রায় সীমন্তিনীর কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠতে সীমন্তিনী সবাইকে নিয়ে হসপিটালের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে রচনাকে বলল, “রচু সোনা। দিদির কাছে গিয়ে কিন্তু আর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করিস না বোন। মনে রাখিস এটা হসপিটাল। আর তোকে কাঁদতে দেখে তোর দিদিও কাঁদবে। তাতে তার শরীর কিন্তু আরো খারাপ হয়ে পড়তে পারে”।
অর্চনার কেবিনের সামনে আসতেই পাহারারত কনস্টেবল দু’জন সীমন্তিনীকে স্যালিউট করল। সীমন্তিনী বিধুবাবুকে বলল, “মেসো তুমি মাসি আর রচুকে নিয়ে কেবিনের ভেতরে যাও। আমি দাদাভাইকে নিয়ে একটু ডক্টর সোমের সাথে কথা বলে আসছি” বলে রতীশের হাত ধরে ডক্টর সোমের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল।
ডক্টর সোমের চেম্বারে ঢুকে রতীশের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আজ আপনার পেশেন্ট কেমন আছে ডক্টর”?
ডক্টর সোম বললেন, “অনেকটাই বেটার ম্যাম। বাইরের ইনজুরিগুলো বেশ শুকিয়েছে। তাই তার ব্যাণ্ডেজ খুলে দিয়েছি আজ। তবে অভুক্ত থাকতে থাকতে তার ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের কয়েকটা অর্গান খুব বেশী পরিমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেটা পুরোপুরি ভাবে সারতে মনে হয় বেশ লম্বা সময় লাগবে। তবে ততদিন তাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে হবে না। এই দু’দিনে পেশেন্ট যতটুকু সুস্থ হয়ে উঠেছে তাতে মনে হয় কাল না হলেও, পরশু দিন তাকে রিলিজ করে দিতে পারব। আপনারা পরশু দিন বিকেলে তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু আমার প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী মেডিসিন কিন্তু তাকে দিয়ে যেতে হবে। আর রিলিজ হবার পনের দিন বাদে তাকে যদি আরেকবার এখানে এনে চেকআপ করিয়ে নিয়ে যান, তাহলে ভাল হয়”।
সীমন্তিনী বলল, “অবশ্যই আনব স্যার। আপনার প্রেসক্রিপশন আর উপদেশ সবটাই আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। কিন্তু ডক্টর একটা কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে। অবশ্য আমার আশঙ্কা সত্যি হলে আপনি প্রথম দিনেই সে’কথাটা আমাদের বলে দিতেন জানি। তবু যেহেতু পেশেন্ট আমার রিলেটিভ, সে সূত্রেই ব্যক্তিগত ভাবে আমি জানতে চাই, আপনার কি মনে হয়ে পেশেন্ট কোন ভাবে সেক্সুয়ালি হ্যারাসড হয়েছে”?
ডক্টর সোম বললেন, “না ম্যাম, একেবারেই না। এসব ধরণের কেসে আমরা সেদিকটাই আগে লক্ষ্য করি। তবে আপনি শুনে খুশী হবেন যে, পেশেন্ট প্রায় অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের শিকার হলেও সেক্সুয়ালি তাকে একেবারেই হ্যারাস করা হয়নি। আমি তো আপনার মুখেই শুনেছি পাঁচ বছর বিবাহিত জীবন কাটাবার পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বছর দুয়েক আগে। কিন্তু আমি তাকে পরীক্ষা করে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি যে তার জেনাইটাল সিস্টেম একেবারে একজন অক্ষত কুমারী মেয়ের মত। ইভেন, আমি যদি শুনতাম যে সে অবিবাহিতা, আমি তাতেও অবাক হতাম না। কিন্তু পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘর করবার পরেও তার হাইমেন এখনও ইনট্যাক্ট আছে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়েছি। তাই আপনি এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে তার স্বামী বেঁচে থাকতেও তার সাথে কখনও সহবাস করেনি। এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি”।
সীমন্তিনী বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। তা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে কতটা সময় লাগতে পারে বলে ভাবছেন আপনি”?
ডক্টর সোম বললেন, “আমার দেওয়া প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী ঠিক ঠিক সময় মত ওষুধ খেলে দু’ মাসের মধ্যে সে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে যাবে বলে মনে হয়। তবে দিন পনের পর তাকে আরেকবার চেকআপ করলে তখন আরও ভালভাবে সেটা বলতে পারব”।
সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে ডক্টরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, “আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ডক্টর সোম। আপনার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তবে একটা কথা। আপনি তো জানেনই আমার পোস্টিং এখানে নয়। তবু বলছি, কখনও কোন আনওয়ান্টেড সিচুয়েশনে জড়িয়ে পড়লে আমাকে জানাবেন। আমি সাধ্যমত আপনাকে হেল্প করবার চেষ্টা করব”।
ডক্টর সোমও বেশ খুশী হয়ে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। আপনার কথা মনে রাখব”।
সীমন্তিনী রতীশকে নিয়ে ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অর্চনার কেবিনে এসে ঢুকল। রচনা দিদির পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তার চোখ জলে ভেজা। অর্চনাও রচনার কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুক পাশের খালি বেডের ওপর বসে আছে। কিংশুক লাফ দিয়ে নেমে রতীশের হাত ধরে অর্চনার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, “এই বড়দি দেখ, ইনি হচ্ছেন আমার রতু-দা। আমাদের বাড়ির ছোট জামাই”।
কিংশুকের কথা শুনে অর্চনা চোখ মেলে চাইল। রতীশের মুখের দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রচনার একটা হাত টেনে নিয়ে আরেকহাত বাড়িয়ে রতীশের একটা হাত কাছে এনে রতীশের হাতের ওপর রচনার হাতটা বসিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলল, “ভগবান তোদের দু’জনকে যেন সবসময় এমন পাশাপাশি রাখেন” কথা বলতে বলতেই রতীশের পাশে দাঁড়ানো পুলিশের পোশাক পড়া সীমন্তিনীর দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
রচনা দিদির দৃষ্টি অনুসরন করেই অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চিনতে পাচ্ছিস না? উনিই তো আমার দিদিভাই” বলেই সীমন্তিনীর উদ্দেশ্যে বলল, “ও দিদিভাই, অত দুরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কাছে এস না”।
সীমন্তিনী রতীশের পাশ কাটিয়ে অর্চনার বিছানার কাছাকাছি আসতেই অর্চনা দু’হাতে সীমন্তিনীর একটা হাত জাপটে ধরে তার মুখের কাছে টেনে এনে একের পর এক অনেকগুলো চুমু খেল। সীমন্তিনী অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল। অর্চনা চোখ বুজে পাগলের মত সীমন্তিনীর হাতে চুমু খেয়ে যাচ্ছিল। সেই দেখে ঘরের সকলের চোখ জলে ভরে এল।
পরিস্থিতি সামাল দিল কিংশুক। নিজের চোখের জল মুছে সে রচনাকে বলল, “তুই তো খুব স্বার্থপর রে ছোড়দি। দিদিভাই বুঝি শুধু তোর একারই দিদিভাই? আমার বুঝি নয়? আর বাবা মা-ও দিদিভাইকে মন্তিমা বলে ডাকেন, এসব বুঝি এমনি এমনি? আমাদের সকলের কথা না বলে তুই শুধু নিজের কথাটাই বললি”!
কিংশুকের কথা শুনে সকলেই হেসে ফেলল। সীমন্তিনী কিংশুককে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে তার মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলল, “ভাই, তোমার বড়দিকে আমি কি বলে ডাকব বল তো? সে তো আমার বৌদির দিদি। তাকে তো তাহলে দিদি বলেই ডাকতে হবে, তাইনা”?
কিংশুক বলল, “না না, দিদি কেন বলবে তুমি দিদিভাই? বড়দি তো তোমার থেকে অনেক ছোট। তাছাড়া তোমার মুখে দিদি ডাকটা ভালও শোনাবে না। তাই তুমি ছোড়দিকে যেমন রচুসোনা বলে ডাক তেমনি বড়দিকেও নাম ধরে বলে ডেকো। তোমার মুখে এ ডাকটা শুনতেই আমার বেশী ভাল লাগবে”?
অর্চনা সীমন্তিনীর হাতটা ধরে রেখেই চোখে জল নিয়েই একটুখানি হেসে বলল, “হ্যা দিদিভাই। ভাই একদম ঠিক বলেছে। আর আমাকেও তোমাকে দিদিভাই বলতে দিও”।
সীমন্তিনী অর্চনার কাছে এসে তার মাথাটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “বেশ তাই হবে। কিন্তু আর একদম কান্নাকাটি নয়। আর শোনো, আমি এইমাত্র ডক্টরের সাথে কথা বলে এলাম। তোমাকে হয়ত পরশু দিনই এখান থেকে রিলিজ দিয়ে দেবে। কিন্তু তোমাকে মাস দুয়েক ডক্টরের উপদেশ মত ওষুধ পত্র খেয়ে যেতে হবে নিয়ম করে। তারপর তুমি পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে উঠবে। দুটো দিন তো রচু এখানে থাকবে। ও থাকতে থাকতেই তুমি বাড়ি যেতে পারবে। দিন পনের বাদে আরেকবার হসপিটালে এসে ডক্টর সোমকে দিয়ে চেকআপ করিয়ে যাবে। আমি হয়ত সব সময় আসতে পারব না। তুমি হয়ত শুনেছ যে আমি এখান থেকে প্রায় ষাট সত্তর কিলোমিটার দুরে থাকি। আর তাছাড়া পুলিশের চাকরিতে সবসময় তো হুটহাট করে আসাও সম্ভব নয় ভাই। আর এখন থেকে তুমি তো বাড়িতেই থাকবে। মা বাবা ভাইদের সাথে থাকবে। তাই আমার ঘণ ঘণ না এলেও চলবে। আর শোনো, মেসো, ভাই, তোমরাও শুনে রাখ। আদালতে যখন ত্রিলোচন আচার্য্যি আর তার পরিবারের লোকগুলোর বিচার হবে তখন তোমাদেরও কোর্টে যেতে হবে। তবে ভয়ের কিছু নেই। তখন আমি আসতে না পারলেও যা যা করা প্রয়োজন, সব কিছু করব। তোমরা আদালতে গিয়ে ওদের বিয়ের সময় থেকে যা যা হয়েছে সব সত্যি সত্যি বিচারকের সামনে বলবে। আর অর্চু। তুমিও তোমার বিয়ের পর থেকে ও বাড়ির লোকগুলো তোমার সাথে যে যা করেছে সব খুলে বলবে। একদম ভয় পাবে না। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি মনে রেখো। আর আমি তোমাদের হাতের কাছে না থাকলেও যে কোন প্রয়োজনে আমাকে একটা ফোন করে দিলেই আমি সব সামলে নেব। আর কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়ও তোমাদের সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন। তাই কোনকিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা করবে না। কেমন”?
অর্চনা মন্ত্রমুগ্ধের মত সীমন্তিনীর কথাগুলো শুনে রচনাকে বলল, “রচু আমাকে একটু ধর না বোন। আমি নেমে দিদিভাইকে একটা প্রণাম করতে চাই রে”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে আবার বুকে জাপটে ধরে বলল, “না অর্চু। অমন কথা বোল না বোন। আমাকে প্রণাম করতে হবে না। তুমি শুধু ডক্টরের কথা মত নিজের ওষুধ গুলো ঠিক ঠিক খেও। আর আমার কথা মত কোর্টে গিয়ে সত্যি কথা বলে ওই বদমাশ লোকগুলোকে পাকাপাকিভাবে জেলে ঢোকাতে সাহায্য কোর”।
অর্চনাও সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে উদ্গত কান্না সামলাতে সামলাতে বলল, “করব দিদিভাই। তুমি যা বললে, সেসব কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ, তোমার কথার অন্যথা কি আমি করতে পারি”?
সীমন্তিনী বলল, “দুর বোকা মেয়ে। কেউ কারুর জন্যে কিছু করতে পারে না। ভগবান যার কপালে যা লিখে দিয়েছেন, ঠিক সেটাই হয়। আমরা শুধু তার মাধ্যম গুলোকেই ভুল করে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। আমার তো অনেকদিন আগে থেকেই ইচ্ছে করছিল তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকগুলোর হাত থেকে তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার হয়ে কোন লিখিত অভিযোগ ছাড়া সেটা করা তো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তবে আপাততঃ আর নয়। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে আসছে। এবার আমাদের সবাইকে যেতে হবে। কিন্তু মাসি, আজ রাতে কে এখানে থাকছে? আর অর্চুর রাতের খাবার কে কখন নিয়ে আসবে, সেটা ঠিক করো। আর এখন যে যে বাড়ি যেতে চাও তারা সবাই বেরিয়ে পড়ো। আমি তোমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই রওনা হব”।
রচনা বলল, “আমি এখন দিদির কাছে থাকব। ভাই তুই মা বাবার সাথে বাড়ি চলে যা। রাতে দিদির খাবার নিয়ে তোর জামাইবাবুর সাথে চলে আসিস। আমি তখন তোকে রেখে বাড়ি চলে যাব”।
কেউই আর রচনার কথার প্রতিবাদ করল না। সীমন্তিনী সবাইকে নিজের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের জায়গায় রওনা হবার আগে রতীশকে বলল পরে ফোনে কথা বলতে।
সীমন্তিনী ঘরে ফিরে আসবার মিনিট দশেক বাদেই পরিতোষের ফোন পেল। পরিতোষ জানাল রতীশ আর রচনাকে কাল সন্ধ্যের পর শিয়ালদা ষ্টেশনে যেতে দেখা গেছে। সঙ্গে দুটো লাগেজও ছিল। তাদের ফ্ল্যাট তালা বন্ধ। তারা যে কলকাতার বাইরে গেছে এটা তো শিওর। কিন্তু তাদের গন্তব্য সম্বন্ধে পরিতোষের লোকেরা সঠিক ভাবে না বলতে পারলেও তারা যে উত্তরবঙ্গগামী একটা ট্রেনে উঠেছে তার খবর পাওয়া গেছে। পরিতোষ সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল সীমন্তিনী এ ব্যাপারে কিছু জানে কি না। সীমন্তিনী পরিতোষের কথার জবাবে তাকে জানিয়ে দিল যে রতীশ রচনাকে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়ি এসেছে। সতের তারিখ সকালে হাওড়া গিয়ে পৌছবে।
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সীমন্তিনী রচনাকে ফোন করল। রচনা তখন অর্চনার মাথাটাকে কোলের ওপর নিয়ে দিদির সাথে কথা বলছিল। অনেকক্ষণ এদিক সেদিকের কথা বলার পর রচনা বলল, “ও দিদিভাই, শোনো না। আমাদের তো ষোল তারিখের রিটার্ন টিকিট কাটা আছে। আজ তো তের তারিখ পেরিয়েই গেল। আর মাত্র দুটো দিন এখানে থাকতে পারব। পরশুদিন দিদি বাড়ি যাবে। আর তারপর দিনই আমাদের চলে যেতে হবে। তোমার ওখানে কি তাহলে যাবার সুযোগ পাব না”?
সীমন্তিনী দুষ্টুমি করে বলল, “ওমা! এ তুই কেমন কথা বলছিস? এবারে তোরা এসেছিস তোর দিদিকে দেখতে। আমার এখানে ঘুরতে তো আসিস নি। তাই দিদির সাথেই তো এ সময়টুকু তোদের কাটানো উচিৎ”।
রচনা সীমন্তিনীর দুষ্টুমি বুঝতে না পেরে বলল, “হ্যা তা তো ঠিকই বলেছ তুমি। কিন্তু তুমি তো এখান থেকে মাত্র সত্তর কিলোমিটার দুরেই আছ। এত কাছে এসেও তোমার বাড়ি না গিয়ে আমরা চলে যেতে পারি”?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু দুটো দিন বাবা মা ভাই আর দিদির সাথে কাটালেই তো তোর ভাল লাগবে বেশী। আমার এখানে আর কে আছে? শুধু এই পেত্নী পুলিশ ছাড়া এ বাড়িতে তো কেবল লক্ষ্মীদিই আছে”।
রচনা অভিমানী গলায় বলে উঠল, “দিদিভাই, ভাল হচ্ছে না কিন্তু। তুমি কী সব আবোল তাবোল বলছ বল তো? তুমি কি জানো না, তুমি আমার কে আর কী? নিজেকে পেত্নী বলে তুমি আমাকে কাঁদাতে চাইছ”?
সীমন্তিনী সাথে সাথে দুষ্টুমি ছেড়ে বলল, “আরে পাগলী, তোর সাথে একটু মজা করছিলাম রে। তুই না এত বুদ্ধিমতী! আর আমার ঠাট্টাটা বুঝতে পারলি না? আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কক্ষনো বলব না, ঠিক আছে? তবে শোন, সিরিয়াসলি বলছি। তোরা কালচিনি এসেছিস শুনে লক্ষ্মীদি তো আমার মাথা খেয়ে ফেলছে রে। বার বার অনুযোগ করছে, আমি তোদের আমার সাথে করে এখানে নিয়ে এলুম না কেন। কিন্তু তোদের হাতে মাত্র আর দুটো দিনই আছে। পরশু দিন তোর দিদি হসপিটাল থেকে রিলিজ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে। সেদিন তো তোদেরকে আর আসতে বলতে পারিনা। তাহলে হাতে থাকছে শুধু কালকের দিনটা। যদি আমার এখানে আসতেই চাস, তাহলে তো কালই আসতে হবে তোদের। কিন্তু আমি যে কাল কালচিনি যেতে পারবনা রে। কাল আমার দু’বেলা দুটো ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এটেণ্ড করতে হবে। বিকেল চারটে অব্দি ব্যস্ত থাকব আমি। আর তারপর এখান থেকে কালচিনি গিয়ে আবার তোদেরকে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে তো অনেক রাত হয়ে যাবে। অত রাতে আমাকে অন ডিউটি জার্নি করতেও বারণ করেছে আমার ওপরওয়ালারা। তাহলে তোদের আমি গিয়ে আনব কি করে বল? আর তাছাড়া তোরা মাত্র দু’দিনের জন্য এসেছিস। এরই মধ্যে মাসিকে আমি কি করে বলি কথাটা বল তো? মাসিরও তো ইচ্ছে করছে এই দুটো দিন মেয়ে আর মেয়েজামাইয়ের সাথে কাটাতে”।
রচনা সীমন্তিনীর সব কথা শুনে বলল, “মা তো সেটা চাইবেনই দিদিভাই। কিন্তু তোমার ওখানে যেতেও মা বাবা আমাদের বারণ করবেন না”।
সীমন্তিনী বলল, “তোরা এত কাছে এসেও আমার ঘরে না এসেই চলে যাবি ভাবতে তো আমারও কষ্ট হচ্ছে রে রচু সোনা। কিন্তু মাসিকে তোদের এখানে আনবার কথাটা তো বলতেই পাচ্ছিনা রে বোন। তুই বরং আজ রাতেই একটু মা বাবার সাথে আলোচনা করে দেখনা, তারা কি বলেন”।
ফোনে কথা শেষ করতেই অর্চনা বলল, “তোদের কিন্তু অন্ততঃ একবেলার জন্যে হলেও দিদিভাইয়ের ওখানে যাওয়া উচিৎ রে রচু। এতদিন তো বাড়ির কারো সাথে কথাই বলতে পারিনি। এখন ভাই, মা আর বাবার মুখে দিদিভাইয়ের কথা শুনেই সময় কাটছে আমার। তোর বিয়ের আগে থেকেই তিনি যে আমাদের বাড়ি আসছিলেন, সে সময়কার থেকে শুরু করে সব কথাই তিনজনে মিলে পালা করে শোনাচ্ছে। তুই জানিস রচু, গত সাতটা বছর ধরে আমি শুধু ভগবানের কাছে অভিযোগই করেছি। বার বার মনে মনে তাকে জিজ্ঞেস করেছি যে আমি এমন কোন পাপ করেছি যে আমায় এমন নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। আর দেখ মরেই তো গিয়েছিলুম প্রায়। বাড়ি থেকে কে কখন কিভাবে আমাকে ওই রেল লাইনের ওপর নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল, আমি তো তা কিছুই জানি না। হসপিটালে জ্ঞান ফিরে আসবার পর মা, বাবা আর ভাইকে দেখতে পেয়েছিলুম। আর পরশু সন্ধ্যায় থানার ওসি আর গতকাল ভাইয়ের মুখে সব কথা শুনে বুঝলুম। দিদিভাই আমার ওপর দুরে থেকেই নজর রেখে যাচ্ছিলেন, আর থানার ওসিও নাকি তার অনুরোধেই আচার্য্যি বাড়ির ওপর নজর রেখেছিলেন। তাই তো আমাকে রেল লাইনের ওপর ফেলে চলে যাবার খবর পেয়েই ওসি নিজে ছুটে এসে আমাকে সেখান থেকে তুলে হসপিটালে নিয়ে এসেছিলেন। তাই বুঝতে পারছি, আমি যে আজও বেঁচে আছি, মা বাবা ভাইকে দেখতে পাচ্ছি, তাদের সাথে কথা বলতে পারছি, আর এই যে এ মূহুর্তে তোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, এ সবই করতে পারছি একমাত্র ওই দিদিভাইয়ের জন্যেই। তাই সাত বছর বাদে কাল থেকে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাদের পরিবারের সকলের পাশে দিদিভাই আছেন বলে”।
রচনা দিদির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তুই এত কথা বলিস না দিদি। তোর শরীর খারাপ করতে পারে। একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর না লক্ষ্মীটি। দিদিভাইয়ের কথা তো বাড়ি গিয়েও শুনতে পারবি”।
অর্চনা রচনার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “নারে আমি বুঝতে পারছি, আজ আমি অনেক ভাল আছি। তোকে আর দিদিভাইকে দেখেই বুঝি আমি ভাল হয়ে উঠেছি। তুই বলনা বোন, দিদিভাইয়ের কথা বল না। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে রে”।
______________________________