04-03-2020, 10:28 PM
(Update No. 99)
ডক্টর সোম একটা প্রেসক্রিপশন লিখে সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে বললেন, “ম্যাম, এখানে দুটো মেডিসিন লিখে দিয়েছি। এ’গুলো আমাদের হাসপাতালের স্টকে নেই। বাইরের কোন বড় ফার্মাসিতে পাওয়া যাবে। যদি আপনারা এ দুটো এনে দিতে পারেন, তাহলে খুব ভাল হয়”।
সীমন্তিনী প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে ডক্টর আমি সে ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আপনি একটু এক্সট্রা নজর রাখবেন পেশেন্টের প্রতি প্লীজ”।
ডক্টর সোম বললেন, “অবশ্যই রাখব ম্যাম। সে নিয়ে ভাববেন না। আমি রুটিন চেকআপ ছাড়াও তার কেবিনে গিয়ে তার কণ্ডিশনের ওপর বিশেষ নজর রাখব। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আর এ মেডিসিন দুটো যত তাড়াতাড়ি পারেন এনে আমাকে দিয়ে যাবেন। পেশেন্ট এবার জেগে উঠলেই ওই মেডিসিন দুটোর দরকার পড়বে। আর আমার মনে হয় সওয়া ছ’টা বা সাড়ে ছ’টার দিকেই সে জেগে উঠবে। আমি রাত আটটা অব্দি হাসপাতালেই আছি। আর এ মেডিসিন দুটো দিতে পারলে রাতে আর কোন প্রব্লেম হবে বলে মনে হয় না। তবু আপনারা আমার পার্সোনাল নাম্বারটা নিয়ে নিন। যদি কখনও আপনাদের তেমন মনে হয়, তাহলে আমাকে ফোন করবেন”।
ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার নাম্বার নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সীমন্তিনী কিংশুককে জিজ্ঞেস করল, “ভাই তুমি মেডিসিনটা আনতে পারবে? এখানে সবচেয়ে বড় ওষুধের দোকনটায় যাবে”।
কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই পারব। কিন্তু .... “
সীমন্তিনী পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে প্রেসক্রিপশান সহ কিংশুকের হাতে দিয়ে বলল, “তুমি ওই গাড়িতে করে চলে যাও” বলেই গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে নির্দেশ দিতেই কিংশুক পুলিশের গাড়িতে চড়ে বাজারের দিকে চলে গেল।
সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে একটা জায়গায় রেখে মিঃ রায়কে সাথে নিয়ে একটু দুরে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল।
এক সময় মিঃ রায় সীমন্তিনীকে বললেন, “ম্যাম, আমি ভাবছি ত্রিলোচন আচার্য্যিকে আজ রাতটা থানার লকআপে ঢুকিয়ে রাখলে ভাল হত। তারপর কাল দিনের বেলায় ভিক্টিমের স্টেটমেন্ট নেবার পর আসল চার্জ লাগিয়ে তাকে অফিসিয়ালি কাস্টডিতে নেব”।
সীমন্তিনী বলল, “ভিক্টিমের স্টেটমেন্ট নেবার আগে সেটা কি আপনি অফিসিয়ালি করতে পারবেন স্যার”?
মিঃ রায় বললেন, “সেটা হয়ত পারা যায় না ঠিকই। তবে একটা ফলস এলিগেশন তুলে ইন্টারোগেশন করার অছিলায় তাকে একটা রাত তো থানার লকআপে রাখাই যায়। আমার মনে হচ্ছে, আমরা যতই গোপন রাখতে চাই না কেন, এমন ছোট একটা জায়গায় তাদের কানে খবরটা গিয়ে পৌঁছতেই পারে। তখন তারা হয়ত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে”।
সীমন্তিনী বলল, “না তাদেরকে পালিয়ে যাবার সুযোগ একেবারেই দেওয়া যাবে না মিঃ রায়। কারন কেসটা তো একেবারে পরিস্কার। ভিক্টিমের স্টেটমেন্ট নেবার পর তাকে আমাদের প্রয়োজন হবেই। আপনি ভেবে দেখুন। তেমন কিছু করতে পারলে করুন। আর এখানে কেবিনের সামনে দু’জন কনস্টেবল বসিয়ে দিন। আমাকে তো ষ্টেশনে ফিরতেই হবে। আমি কাল সকালে আবার আসব। ততক্ষণ আপনি একটু সবদিকে নজর রাখবেন প্লীজ”।
মিঃ রায় বললেন, “আপনি ভাববেন না ম্যাম। আমি সবদিকে নজর রাখব। তাহলে আমি আর দেরী না করে চলে যাই। একঘন্টার ভেতর ওই ফ্যামিলির সব ক’টাকে থানার লকআপে ঢোকাচ্ছি। আর কেবিনের সামনে এখন থেকেই দু’জন কনস্টেবল মোতায়েন করে দিচ্ছি। আর আমার মনে হয়, আপনারও আর বেশী দেরী করা উচিৎ হবে না। সন্ধ্যে হবার আগেই আপনার হোম ষ্টেশনে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ। আমি ওনাদের সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। আর আপনার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখব”।
সীমন্তিনী মিঃ রায়ের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “থ্যাঙ্কিউ মিঃ রায়। আপনার সাহায্য না পেলে সত্যি খুব বড় একটা বিপদ হয়ে যেত আজ। থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং”।
পনের কুড়ি মিনিট বাদেই কিংশুক ওষুধ দুটো নিয়ে এল। ডক্টর সোমের হাতে ওষুধটা দিয়ে বেরিয়ে এসে বিভাদেবী, বিধুবাবু আর কিংশুককে সব কিছু ভাল মত বুঝিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী কালচিনি থেকে রওনা হবার কথা বলতেই বিভাদেবী কেঁদে ফেললেন। সীমন্তিনীকে থেকে যাবার অনুরোধ করতে লাগলেন। সীমন্তিনী অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিভাদেবীকে শান্ত করল। গাড়িতে উঠবার আগে সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতে আরও কিছু টাকা দিয়ে বলল, “মেসো এটা রেখে দাও। হয়ত কোন ওষুধ পত্র কেনবার দরকার হতে পারে। আর মাসি, ঘরে টিফিন কেরিয়ার আছে না”?
বিভাদেবী ‘হ্যা’ বলতেই সীমন্তিনী কিংশুকের হাত ধরে বলল, “ভাই, তুমি সন্ধ্যে হবার আগেই হাসপাতালে চলে এস। আর সব ঠিক থাকলে রাত ন’টা নাগাদ আমাকে ফোন করে জানিও দিদি কেমন থাকে। কিন্ত কোন সমস্যা হলে যে কোনও সময় আমাকে ফোন কোর। আর মাসি তুমি তো শুনেছই ডাক্তার দিদিকে কী পথ্য দিতে বলেছে কাল থেকে। ভাইয়ের জন্য যাহোক করে একটু তাড়াতাড়ি কিছু বানিয়ে টিফিন কেরিয়ারে ভরে দিয়ে ছ’টার দিকেই ভাইকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিও। আর ঘর থেকে একটা বিছানার চাদর, বালিশ আর জলের বোতল দিয়ে দিও ওর হাতে। আমি আর থাকতে পাচ্ছি না গো। তবে কাল সকালেই আমি আবার আসব। তখন অবস্থা বুঝে সব ব্যবস্থা নেব। ঠিক আছে? আমি চলি তাহলে”?
বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সারাটা দিন না খেয়ে আছিস। একটা কিছু মুখে দিয়ে যেতিস মা”।
সীমন্তিনী বিভাদেবীকে প্রণাম করে বলল, “কাল তোমার হাতের রান্না খাবো। আজ আসি গো মাসি। আর দেরী করা একেবারেই ঠিক হবে না। পৌঁছতে পৌঁছতে বেশী রাত হয়ে গেলে কোন ঝামেলা হতে পারে”।
বিভাদেবী সীমন্তিনীর বাঁ হতের কড়ে আঙুলটায় একটা কামড় দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “সাবধানে যাস মা। আর পৌঁছেই একটা ফোন করে দিস”।
মাসি মেসোদের নিয়ে সীমন্তিনী হাসপাতালে ঢোকবার আগেই তার মোবাইলটাকে ভাইব্রেন্ট মোড করে দিয়েছিল। হাসপাতালে আসবার পর থেকেই একের পর এক অনেক গুলো কল এসেছে তার ফোনে। ভাইব্রেশনেই সে সেটা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে সে একটা কলও রিসিভ করেনি। এখন তার তিন গাড়ির কনভয় নিয়ে নিজের জায়গার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে রচনার আটটা কল আর কোয়ার্টারের দুটো কল সে মিস করেছে।
ফোনটাকে জেনারেল মোডে এনে সে লক্ষ্মীকে ফোন করল। লক্ষ্মী ফোন ধরেই উদবিঘ্ন গলায় বলে উঠল, “ও দিদিমণি, তোমার কী হয়েছে গো? দুপুরবেলা ফোন করে বললে যে দুটোর মধ্যেই ঘরে চলে আসবে। কিন্তু পাত্তাই নেই তোমার। এদিকে সন্ধ্যে হতে চলল। বৌদিমণিও তোমার ফোন না পেয়ে তিন চারবার আমাকে ফোন করেছিল। সে-ও তো প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তুমি কোথায় আছ গো? ঠিক আছ তো”?
সীমন্তিনী বলল, “লক্ষ্মীদি শোন। আমি ভাল আছি। আমার জন্যে ভেবো না। একট কাজে আঁটকে গেছি। তাই তোমাদের কারুর ফোন ধরা বা কাউকে ফোন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে শোনো, এখন আমি বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় আছি। হয়ত আর আধঘন্টা বা চল্লিশ মিনিটের ভেতর পৌঁছে যাব। তুমি আমার জন্যে কিছু একটা খাবার বানিয়ে রাখ। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আর বাথরুমের গিজারের সুইচটা দিয়ে দাও। বাদবাকি কথা আমি বাড়ি এলে শুনবে”।
সীমন্তিনী তারপর রচনার নাম্বারে ফোন করল। কিন্তু রচনার ফোন ব্যস্ত থাকাতে কথা বলতে পারল না। মিনিট পনের বাদে আরেকবার চেষ্টা করল রচনার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এবারেও তার ফোন ব্যস্ত।
এবার সীমন্তিনী রতীশের নাম্বারে ফোন করতেই রতীশ ফোন ধরে কিছু একটা বলতে যেতেই রচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দাদাভাই শোন। আমি খুব ব্যস্ত আছি। তাই তোর সাথে এখন বেশী কথা বলতে পারব না। শুধু একটা আর্জেন্ট কথা শোন। আমার মনে হচ্ছে কালচিনি থেকে কেউ না কেউ এখনই রচুকে ফোন করবে। একটা খারাপ খবর জানতে পারবে সে। তুই ওর পাশে থাকিস, ওকে সামলাস। আমি এখন কালচিনি থেকে কোয়ার্টারে ফিরছি। ডিটেইলস পরে বলব তোকে। তুই রচুর পাশে থাকিস। আর শুধু এটুকু বলিস ওর দিদিভাই খবর পেয়েই কালচিনি চলে এসেছে দুপুর দুটোয়। তারপর সব কিছুর মোকাবেলা করেছি। এখন আর ভয় নেই কিছু। বুঝেছিস? রাখছি আমি। কিছুক্ষণ বাদে রচুকে ফোন করব, তখন তুইও সবটা জানতে বুঝতে পারবি” বলেই ফোন কেটে দিল।
প্রায় ছ’টার সময় সীমন্তিনী নিজের জায়গাস এসে পৌঁছল। অফিসে না ঢুকে সে সোজা কোয়ার্টারে চলে এল। ফোর্সের গাড়ি দুটোর লগবুকে সাইন করে ফোর্সকে বিদায় দিয়ে নিজের ব্রীফকেসটা হাতে নিয়ে ঘরের সিঁড়ির দিকে একপা এগোতেই লক্ষ্মী ছুটে বেরিয়ে এসে তার হাত থেকে ব্রীফকেসটা নিয়ে বলল, “ওমা দিদিমণি! এ কী হাল হয়েছে গো তোমার? চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে একেবারে। সারাদিন কি খাওয়া দাওয়া কিছু করনি”?
সীমন্তিনী তার কথার কোন জবাব না দিয়ে কিংশুককে ফোন করে জানিয়ে দিল যে সে বাড়ি পৌঁছে গেছে। কিংশুকও জানাল সে তখনই হাসপাতালে যাচ্ছে।
ফোন কেটে সীমন্তিনী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে লক্ষ্মীকে বলল, “যে অবস্থায় পড়েছিলাম, তাতে নাওয়া খাওয়ার কথা আর মাথাতেই আসেনি গো লক্ষ্মীদি। তবে সকাল এগারোটা নাগাদ দুটো পরোটা খেয়েছিলাম একটা দোকানে। আচ্ছা শোনো লক্ষীদি, খাবার বানিয়েছ তো? আমি আর থাকতে পারছিনা গো। আমি চট করে স্নানটা সেরে আসি। তুমি ভাত বাড়ো। আর শোনো, রচু ফোন করতে পারে। ওকে বোল আমি স্নান করছি। স্নান সেরে কিছু একটা খাবার পর আমি ওকে ফোন করব বলে দিও”।
নিজের মোবাইল দুটো আর পড়ে থাকা ইউনিফর্ম খুলে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলেই সে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। লক্ষ্মী আগে থেকেই তার নাইটি, সায়া, ব্রা, টাওয়েল সবকিছু বাথরুমে রেখে দিয়েছিল। মিনিট দশেক বাদে বাথরুম থেকে বেরিয়েই সে লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি ভাত বেড়েছ তো? স্নানের পর ক্ষিদেটা যেন আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল গো” বলতে বলতে ভেজা চুলে টাওয়েল জড়াতে জড়াতে ডাইনিং রুমে এসে হাজির হল।
খেতে খেতে সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হল। রচনা এখনও ফোন করল না তাকে! সে যে কালচিনি গিয়েছিল, এ খবর কি রচনা এখনও জানতে পারেনি? দুপুরের পর থেকে ওর এতগুলো কলের একটাও সে ধরেনি বলে রচনা কি অভিমান করে আর ফোন করছে না? কিন্তু এতক্ষণে তো কালচিনির সব খবরই তার জেনে যাবার কথা। না এমনটা তো হবার কথা নয়! সে খবরটা শোনার সাথে সাথেই রচনা যে তাকে ফোন না করে থাকতে পারবে না, এটা সীমন্তিনী খুব ভালভাবেই জানে। মাসি মেসো আর কিংশুক বিকেল পাঁচটার দিকে মিঃ রায়ের গাড়িতে উঠেছিল। আর তখনই সীমন্তিনীও কালচিনি থেকে রওনা হয়েছিল। সীমন্তিনীর হিসেব মত অমন সময়েই কিংশুক রচনাকে ঘটণাটা জানাবে মনে হয়। সে ঘরে ফিরে আসবার সময় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রচনাকে দু’বার ফোন করে তার ফোন বিজি পেয়েছে। মনে মনে ভেবেছিল, রচনা নিশ্চয়ই কালচিনির কারো সাথে কথা বলছে। কিন্তু তারপর তো একঘন্টার ওপর সময় কেটে গেছে। এখনও ফোন করছে না কেন।
সীমন্তিনী খেতে খেতেই লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাগো লক্ষ্মীদি। আমি যখন বাথরুমে ছিলুম তখন রচু ফোন করেছিল”?
লক্ষ্মী জবাব দিল, “না তো দিদিমণি। বৌদিমণি শেষ ফোন করেছিল সাড়ে চারটের দিকে। তারপর তো আর করেনি”।
সীমন্তিনী আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করল। তারপর হাতমুখ ধুয়েই ল্যাণ্ডলাইন ফোনটাকে বিছানার কাছে টেনে এনে বিছানায় বসে রচনার মোবাইলে ফোন করল। কিন্তু অবাক হল, রচনার বদলে রতীশ ফোন ধরতে। রতীশ জিজ্ঞেস করল, “তোর স্নান খাওয়া হয়ে গেছে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যারে দাদাভাই, মাত্র খেয়ে উঠেই তোদের ফোন করছি। কিন্তু রচু কোথায়? তুই ফোন ধরলি যে বড়”?
রতীশ সীমন্তিনীর কথার জবাবে কিছু একটা জবাব দিল। কিন্তু রচনার চিৎকারে সেটা আর শোনা গেল না। রচনা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, আমার দিদিটা বাঁচবে তো? ও মরে যাবে না তো? আমি কি আর ওকে দেখতে পাব না”?
সীমন্তিনী রচনাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “ছিঃ রচু, এসব কী বলছিস তুই? কে তোকে এমন কথা বলেছে? তোর দিদি এখন সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত। আমি ডাক্তারের সাথে সব ব্যাপারে কথা বলেছি। অর্চনাদির কণ্ডিশনের ব্যাপারে সব খবরাখবর নিয়েছি। ডক্টর সোম লোকটাও ডাক্তার হিসেবে যতটা ভাল, একজন মানুষ হিসেবে তার চেয়েও বেশী ভাল। আর অর্চনাদির খুব ভালভাবে চিকিৎসা করছেন। তেমন সিরিয়াস অবস্থা হলে আমি কি মাসি মেসো ভাইকে ওভাবে ফেলে চলে আসতুম বলে ভেবেছিস? তুই কিচ্ছু ভাবিসনে বোন। আমার কথার ওপর ভরসা রাখতে পারছিস না তুই”?
রচনা আগের মতই কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি ডাক্তার পুলিশ কারুর কথার ওপর ভরসা করিনে গো দিদিভাই। আমি শুধু আমার দিদিভাইয়ের কথার ওপর ভরসা করি। তুমি ঠিক বলছ তো? দিদি সুস্থ হয়ে উঠবে তো”?
সীমন্তিনী রচনাকে আশ্বস্ত করে বলল, “হ্যারে। আমি বলছি তো। ভাবনার কিচ্ছুটি নেই। অর্চনাদি ঠিক সেরে উঠবে। তবে একটু সময় লাগবে রে। দিদির শরীরের আর মনের যেমন অবস্থা দেখেছি তাতে আমার তো মনে হয় দিন সাতেকের আগে ডক্টররা তাকে রিলিজ করবেন না। অবশ্য ডক্টর সোম বলেছেন, যে অবস্থার যদি আর অবনতি না ঘটে তাহলে হয়ত চৌদ্দ তারিখে হাসপাতাল থেকে ছাড়তে পারেন। দেখা যাক কি হয়। আর ভাবিস না। এতক্ষণে দিদির জ্ঞান নিশ্চয়ই ফিরেছে। ভাই দিদির সাথে আছে। দিদিও নিশ্চয়ই ভাল আছে। নইলে ভাই আমাকে ঠিক ফোন করত। আমি তো কাছাকাছিই আছি। আর কাল সকালেই তো আবার আমি যাচ্ছি কালচিনি। যা কিছু দরকার পড়বে আমি সব কিছু করব”।
রচনা বলল, “হ্যা, দিদিভাই। ভাইয়ের সাথে পাঁচ মিনিট আগেই আমার কথা হয়েছে। দিদির জ্ঞান ফিরেছে। ভাইয়ের সাথে নাকি দু’চারটে কথাও বলেছে। কিন্তু নার্সটা দিদিকে বেশী কথা বলতে দেয়নি। কিন্তু তুমি না থাকলে কী হত বল তো দিদিভাই? দিদি যদি বাঁচে তাহলে শুধু তোমার জন্যেই বাঁচবে। নইলে সে তো ওই রেল লাইনেই মরে পড়ে থাকত”।
সীমন্তিনী জবাব দিল, “দুর বোকা মেয়ে? আমি আর কি করেছি? যা কিছু করার সে তো ওই কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায় আর হাসপাতালের ডক্টর সোম করেছেন। মিঃ রায় যদি তোর দিদিকে ওই সময়ে হাসপাতালে নিয়ে না যেতেন, আর ডক্টর সোম যদি সঙ্গে সঙ্গে তার সাধ্যমত চেষ্টা না করতেন, তাহলে হয়ত বিপদ একটা হয়েই যেত। মিঃ রায় অবশ্য কাল রাত থেকেই আমাকে বারবার ফোন করছিলেন। কিন্তু তোরা তো জানিসই আমার ফোন আনরিচেবল ছিল। আজ ফেরার পথে মালবাজারের কাছাকাছি এসে যখন সিগন্যাল পেলাম তখনই তোকে ফোনে করেছিলুম। আর তোর সাথে কথা বলার ঠিক পড়েই মিঃ রায়ের ফোন পেয়ে ঘটণাটা জানলাম। আর তখনই আমার অফিসে না গিয়ে আমি সোজা কালচিনি চলে গিয়েছিলাম। আমি যখন সে হাসপাতালে গিয়ে অর্চনাদিকে দেখি, তখনও সে অজ্ঞান। ডক্টর সোম তখন বলেছিল যে সকালে একবার অর্চনাদির সেন্স ফিরে এসেছিল। কিন্তু তখন এমন চিৎকার চেঁচামেচি করছিল যে ডাক্তার নার্সরা কিছুতেই তাকে সামলাতে পারছিল না। তাই ডক্টরের কথাতেই আমি তোদের বাড়ি গিয়ে মাসি মেসো আর ভাইকে নিয়ে এসেছিলুম। আমি করার মধ্যে তো কেবল এটুকুই করেছি”।
রচনা এবার অনেকটা শান্তভাবে বলল, “সে তুমি আমাকে যতই বোকা বলে ভাবো না কেন দিদিভাই, আমি জানি তুমি কাছাকাছি ছিলে বলেই আমার দিদির চরম সর্বনাশটা হয়নি। নইলে সবাই যখন বলে যে পুলিশ ঘটণাস্থলে আসে সব কিছু শেষ হয়ে যাবার পর, সেখানে এমন একটা নির্জন স্থানে দিদির প্রাণটা চলে যাবার আগেই মিঃ রায়, সেখানে গিয়ে পৌছলেন কি করে? তুমি সত্যি করে আমার নামে দিব্যি করে বল তো দেখি। এর পেছনে তুমি নেই? পারবে বলতে”?
সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হবার সাথে সাথে বেশ খুশীও হল রচনার বুদ্ধির প্রখরতা দেখে। তবুও সে কপট ধমক দিয়ে বলল, “হয়েছে, আর কথায় কথায় তোমাকে দিব্যি দিতে হবে না। একটা কথা আছে তো জানিস। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যেই করেন। এখন থেকে তোর দিদি তোদের কালচিনির বাড়িতে গিয়ে থাকবে। শ্বশুর বাড়ি নামের ওই নরকটা থেকে মুক্তি পেল সে। মাসি, মেসোর মনেও আর দুঃখ রইল না। তারা এবার তাদের মেয়েকে নিজের কাছেই রাখতে পারবেন”।
রচনা ছোট শিশুর মত খুশী হয়ে বলল, “সত্যি বলছ দিদিভাই। দিদিকে আর তার শ্বশুর বাড়ি ফিরে যেতে হবে না? সে এখন থেকে মা বাবার সাথে থাকতে পারবে”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে রচু, ঠিক তাই হবে দেখিস। অর্চনাদি এখন থেকে মাসি মেসো আর ভাইয়ের সাথেই থাকবে দেখিস। ওই ত্রিলোচন আচার্য্যি আর কিচ্ছুটি করতে পারবে না। কাল বিকেলেই শুনতে পারবি, তোর দিদির বদমাশ শ্বশুর নিজেই তার শ্বশুর বাড়ি গেছেন”।
রচনা বলল, “তাই কর দিদিভাই, ওই বাড়ির সবক’টা বদমাশকেই জেলে ঢুকিয়ে দিও। আচ্ছা দিদিভাই, দিদিকে দেখে তুমি চিনলে কেমন করে গো? তুমি তো আগে কখনও দেখ নি তাকে। ভাই নাকি দিদিকে দেখে চিনতেই পারেনি? সেখানে তুমি তাকে কিকরে চিনে ফেলেছিলে”?
সীমন্তিনী বলল, “চাক্ষুষ দেখিনি সেটা তো ঠিক। তোদের বিয়ের আগে তুই তোর এ্যালবামে তোর দিদির ছবি দেখিয়েছিলিস, মনে আছে? আর তাছাড়া ক’দিন আগেই তার একখানা ছবি আমি মিঃ রায়ের অফিসে দেখেছিলুম। তোকে সেদিন তোর জামাইবাবুর নাম জিজ্ঞেস করছিলুম না? সেদিন। কিন্তু আজ কালচিনি হাসপাতালের বিছানায় তাকে চিনতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল আমার। তবু তোর মুখের আদলের সাথে খানিকটা মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম”।
রচনা জিজ্ঞেস করল, “তোমার সাথে দিদি কথা বলেছে”?
সীমন্তিনী বলল, “সেটা তো সম্ভবই ছিল না রে। অর্চনাদির সেন্স ফিরতেই তো সে হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছিল। মাসি মেসোর কথা তো বুঝি তার কানেই যাচ্ছিল না। শেষে তো ভাইয়ের কথা শুনেই সে শান্ত হল। কিন্তু শান্ত হবার সাথে সাথেই সে আবার সেন্স হারিয়ে ফেলেছিল। তাই তার সাথে আর আমার কথা হয়ে ওঠেনি”।
রচনা বলল, “ইশ দিদিটা খুব কষ্ট পাচ্ছে না গো দিদিভাই? কিন্তু তার মানে বাবা ভাইরা যখন হাসপাতাল থেকে রওনা হয়ে বাড়ি এসেছিল, তখনও দিদি অজ্ঞানই ছিল”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে ঠিক তাই। আর ডক্টর তখন তাকে আরেকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলেছিলেন যে ঘন্টা দুই বাদে দিদির জ্ঞান ফিরবে। তাই আমি মাসি মেসোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে চলে এসেছি। আর ভাই তো এতক্ষণে আবার হাসপাতালে চলে এসেছে, দিদির কাছেই আছে। রাতে দিদির কেবিনেই থাকবে সে। কর বেকর কিছু হলে ভাই নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবে। আর ডাক্তারকেও আমি একটু স্পেশাল নজর দিতে অনুরোধ করেছি। তাই বলছি, একেবারে দুর্ভাবনা করিস নে। দিদি ভালো হয়ে যাবে দেখিস”।
রচনা বলল, “জানো দিদিভাই, খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা খুব ছটফট করছে আমার। মনে হচ্ছে এখনই ছুটে গিয়ে দিদিকে একটু দেখে আসি। কতবছর হয়ে গেছে ওকে দেখিনি। কিন্তু এখানে আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি, তোমার দাদাভাইকে সে’কথা বলিই বা কি করে বল? তিনি নিজেও কি আর খুব স্বস্তিতে আছেন”?
সীমন্তিনী কিছু একটা বলতে যেতেই তার অফিসিয়াল মোবাইলটা বেজে উঠল। সীমন্তিনী তাই রচনাকে বলল, “রচু, আমি তোকে একটু পরই ফোন করছি। আমার অফিসের কেউ একজন ফোন করেছে” বলে রিসিভার নামিয়ে রেখেই সে অফিসের ফোন তুলে দেখল মিঃ রায়ের ফোন। কলটা রিসিভ করেই সে বলল, “হ্যা মিঃ রায় বলুন”।
______________________________
ডক্টর সোম একটা প্রেসক্রিপশন লিখে সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে বললেন, “ম্যাম, এখানে দুটো মেডিসিন লিখে দিয়েছি। এ’গুলো আমাদের হাসপাতালের স্টকে নেই। বাইরের কোন বড় ফার্মাসিতে পাওয়া যাবে। যদি আপনারা এ দুটো এনে দিতে পারেন, তাহলে খুব ভাল হয়”।
সীমন্তিনী প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে ডক্টর আমি সে ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আপনি একটু এক্সট্রা নজর রাখবেন পেশেন্টের প্রতি প্লীজ”।
ডক্টর সোম বললেন, “অবশ্যই রাখব ম্যাম। সে নিয়ে ভাববেন না। আমি রুটিন চেকআপ ছাড়াও তার কেবিনে গিয়ে তার কণ্ডিশনের ওপর বিশেষ নজর রাখব। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আর এ মেডিসিন দুটো যত তাড়াতাড়ি পারেন এনে আমাকে দিয়ে যাবেন। পেশেন্ট এবার জেগে উঠলেই ওই মেডিসিন দুটোর দরকার পড়বে। আর আমার মনে হয় সওয়া ছ’টা বা সাড়ে ছ’টার দিকেই সে জেগে উঠবে। আমি রাত আটটা অব্দি হাসপাতালেই আছি। আর এ মেডিসিন দুটো দিতে পারলে রাতে আর কোন প্রব্লেম হবে বলে মনে হয় না। তবু আপনারা আমার পার্সোনাল নাম্বারটা নিয়ে নিন। যদি কখনও আপনাদের তেমন মনে হয়, তাহলে আমাকে ফোন করবেন”।
ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার নাম্বার নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সীমন্তিনী কিংশুককে জিজ্ঞেস করল, “ভাই তুমি মেডিসিনটা আনতে পারবে? এখানে সবচেয়ে বড় ওষুধের দোকনটায় যাবে”।
কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই পারব। কিন্তু .... “
সীমন্তিনী পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে প্রেসক্রিপশান সহ কিংশুকের হাতে দিয়ে বলল, “তুমি ওই গাড়িতে করে চলে যাও” বলেই গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে নির্দেশ দিতেই কিংশুক পুলিশের গাড়িতে চড়ে বাজারের দিকে চলে গেল।
সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে একটা জায়গায় রেখে মিঃ রায়কে সাথে নিয়ে একটু দুরে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল।
এক সময় মিঃ রায় সীমন্তিনীকে বললেন, “ম্যাম, আমি ভাবছি ত্রিলোচন আচার্য্যিকে আজ রাতটা থানার লকআপে ঢুকিয়ে রাখলে ভাল হত। তারপর কাল দিনের বেলায় ভিক্টিমের স্টেটমেন্ট নেবার পর আসল চার্জ লাগিয়ে তাকে অফিসিয়ালি কাস্টডিতে নেব”।
সীমন্তিনী বলল, “ভিক্টিমের স্টেটমেন্ট নেবার আগে সেটা কি আপনি অফিসিয়ালি করতে পারবেন স্যার”?
মিঃ রায় বললেন, “সেটা হয়ত পারা যায় না ঠিকই। তবে একটা ফলস এলিগেশন তুলে ইন্টারোগেশন করার অছিলায় তাকে একটা রাত তো থানার লকআপে রাখাই যায়। আমার মনে হচ্ছে, আমরা যতই গোপন রাখতে চাই না কেন, এমন ছোট একটা জায়গায় তাদের কানে খবরটা গিয়ে পৌঁছতেই পারে। তখন তারা হয়ত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে”।
সীমন্তিনী বলল, “না তাদেরকে পালিয়ে যাবার সুযোগ একেবারেই দেওয়া যাবে না মিঃ রায়। কারন কেসটা তো একেবারে পরিস্কার। ভিক্টিমের স্টেটমেন্ট নেবার পর তাকে আমাদের প্রয়োজন হবেই। আপনি ভেবে দেখুন। তেমন কিছু করতে পারলে করুন। আর এখানে কেবিনের সামনে দু’জন কনস্টেবল বসিয়ে দিন। আমাকে তো ষ্টেশনে ফিরতেই হবে। আমি কাল সকালে আবার আসব। ততক্ষণ আপনি একটু সবদিকে নজর রাখবেন প্লীজ”।
মিঃ রায় বললেন, “আপনি ভাববেন না ম্যাম। আমি সবদিকে নজর রাখব। তাহলে আমি আর দেরী না করে চলে যাই। একঘন্টার ভেতর ওই ফ্যামিলির সব ক’টাকে থানার লকআপে ঢোকাচ্ছি। আর কেবিনের সামনে এখন থেকেই দু’জন কনস্টেবল মোতায়েন করে দিচ্ছি। আর আমার মনে হয়, আপনারও আর বেশী দেরী করা উচিৎ হবে না। সন্ধ্যে হবার আগেই আপনার হোম ষ্টেশনে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ। আমি ওনাদের সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। আর আপনার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখব”।
সীমন্তিনী মিঃ রায়ের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “থ্যাঙ্কিউ মিঃ রায়। আপনার সাহায্য না পেলে সত্যি খুব বড় একটা বিপদ হয়ে যেত আজ। থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং”।
পনের কুড়ি মিনিট বাদেই কিংশুক ওষুধ দুটো নিয়ে এল। ডক্টর সোমের হাতে ওষুধটা দিয়ে বেরিয়ে এসে বিভাদেবী, বিধুবাবু আর কিংশুককে সব কিছু ভাল মত বুঝিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী কালচিনি থেকে রওনা হবার কথা বলতেই বিভাদেবী কেঁদে ফেললেন। সীমন্তিনীকে থেকে যাবার অনুরোধ করতে লাগলেন। সীমন্তিনী অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিভাদেবীকে শান্ত করল। গাড়িতে উঠবার আগে সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতে আরও কিছু টাকা দিয়ে বলল, “মেসো এটা রেখে দাও। হয়ত কোন ওষুধ পত্র কেনবার দরকার হতে পারে। আর মাসি, ঘরে টিফিন কেরিয়ার আছে না”?
বিভাদেবী ‘হ্যা’ বলতেই সীমন্তিনী কিংশুকের হাত ধরে বলল, “ভাই, তুমি সন্ধ্যে হবার আগেই হাসপাতালে চলে এস। আর সব ঠিক থাকলে রাত ন’টা নাগাদ আমাকে ফোন করে জানিও দিদি কেমন থাকে। কিন্ত কোন সমস্যা হলে যে কোনও সময় আমাকে ফোন কোর। আর মাসি তুমি তো শুনেছই ডাক্তার দিদিকে কী পথ্য দিতে বলেছে কাল থেকে। ভাইয়ের জন্য যাহোক করে একটু তাড়াতাড়ি কিছু বানিয়ে টিফিন কেরিয়ারে ভরে দিয়ে ছ’টার দিকেই ভাইকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিও। আর ঘর থেকে একটা বিছানার চাদর, বালিশ আর জলের বোতল দিয়ে দিও ওর হাতে। আমি আর থাকতে পাচ্ছি না গো। তবে কাল সকালেই আমি আবার আসব। তখন অবস্থা বুঝে সব ব্যবস্থা নেব। ঠিক আছে? আমি চলি তাহলে”?
বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সারাটা দিন না খেয়ে আছিস। একটা কিছু মুখে দিয়ে যেতিস মা”।
সীমন্তিনী বিভাদেবীকে প্রণাম করে বলল, “কাল তোমার হাতের রান্না খাবো। আজ আসি গো মাসি। আর দেরী করা একেবারেই ঠিক হবে না। পৌঁছতে পৌঁছতে বেশী রাত হয়ে গেলে কোন ঝামেলা হতে পারে”।
বিভাদেবী সীমন্তিনীর বাঁ হতের কড়ে আঙুলটায় একটা কামড় দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “সাবধানে যাস মা। আর পৌঁছেই একটা ফোন করে দিস”।
মাসি মেসোদের নিয়ে সীমন্তিনী হাসপাতালে ঢোকবার আগেই তার মোবাইলটাকে ভাইব্রেন্ট মোড করে দিয়েছিল। হাসপাতালে আসবার পর থেকেই একের পর এক অনেক গুলো কল এসেছে তার ফোনে। ভাইব্রেশনেই সে সেটা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে সে একটা কলও রিসিভ করেনি। এখন তার তিন গাড়ির কনভয় নিয়ে নিজের জায়গার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে রচনার আটটা কল আর কোয়ার্টারের দুটো কল সে মিস করেছে।
ফোনটাকে জেনারেল মোডে এনে সে লক্ষ্মীকে ফোন করল। লক্ষ্মী ফোন ধরেই উদবিঘ্ন গলায় বলে উঠল, “ও দিদিমণি, তোমার কী হয়েছে গো? দুপুরবেলা ফোন করে বললে যে দুটোর মধ্যেই ঘরে চলে আসবে। কিন্তু পাত্তাই নেই তোমার। এদিকে সন্ধ্যে হতে চলল। বৌদিমণিও তোমার ফোন না পেয়ে তিন চারবার আমাকে ফোন করেছিল। সে-ও তো প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তুমি কোথায় আছ গো? ঠিক আছ তো”?
সীমন্তিনী বলল, “লক্ষ্মীদি শোন। আমি ভাল আছি। আমার জন্যে ভেবো না। একট কাজে আঁটকে গেছি। তাই তোমাদের কারুর ফোন ধরা বা কাউকে ফোন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে শোনো, এখন আমি বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় আছি। হয়ত আর আধঘন্টা বা চল্লিশ মিনিটের ভেতর পৌঁছে যাব। তুমি আমার জন্যে কিছু একটা খাবার বানিয়ে রাখ। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আর বাথরুমের গিজারের সুইচটা দিয়ে দাও। বাদবাকি কথা আমি বাড়ি এলে শুনবে”।
সীমন্তিনী তারপর রচনার নাম্বারে ফোন করল। কিন্তু রচনার ফোন ব্যস্ত থাকাতে কথা বলতে পারল না। মিনিট পনের বাদে আরেকবার চেষ্টা করল রচনার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এবারেও তার ফোন ব্যস্ত।
এবার সীমন্তিনী রতীশের নাম্বারে ফোন করতেই রতীশ ফোন ধরে কিছু একটা বলতে যেতেই রচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দাদাভাই শোন। আমি খুব ব্যস্ত আছি। তাই তোর সাথে এখন বেশী কথা বলতে পারব না। শুধু একটা আর্জেন্ট কথা শোন। আমার মনে হচ্ছে কালচিনি থেকে কেউ না কেউ এখনই রচুকে ফোন করবে। একটা খারাপ খবর জানতে পারবে সে। তুই ওর পাশে থাকিস, ওকে সামলাস। আমি এখন কালচিনি থেকে কোয়ার্টারে ফিরছি। ডিটেইলস পরে বলব তোকে। তুই রচুর পাশে থাকিস। আর শুধু এটুকু বলিস ওর দিদিভাই খবর পেয়েই কালচিনি চলে এসেছে দুপুর দুটোয়। তারপর সব কিছুর মোকাবেলা করেছি। এখন আর ভয় নেই কিছু। বুঝেছিস? রাখছি আমি। কিছুক্ষণ বাদে রচুকে ফোন করব, তখন তুইও সবটা জানতে বুঝতে পারবি” বলেই ফোন কেটে দিল।
প্রায় ছ’টার সময় সীমন্তিনী নিজের জায়গাস এসে পৌঁছল। অফিসে না ঢুকে সে সোজা কোয়ার্টারে চলে এল। ফোর্সের গাড়ি দুটোর লগবুকে সাইন করে ফোর্সকে বিদায় দিয়ে নিজের ব্রীফকেসটা হাতে নিয়ে ঘরের সিঁড়ির দিকে একপা এগোতেই লক্ষ্মী ছুটে বেরিয়ে এসে তার হাত থেকে ব্রীফকেসটা নিয়ে বলল, “ওমা দিদিমণি! এ কী হাল হয়েছে গো তোমার? চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে একেবারে। সারাদিন কি খাওয়া দাওয়া কিছু করনি”?
সীমন্তিনী তার কথার কোন জবাব না দিয়ে কিংশুককে ফোন করে জানিয়ে দিল যে সে বাড়ি পৌঁছে গেছে। কিংশুকও জানাল সে তখনই হাসপাতালে যাচ্ছে।
ফোন কেটে সীমন্তিনী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে লক্ষ্মীকে বলল, “যে অবস্থায় পড়েছিলাম, তাতে নাওয়া খাওয়ার কথা আর মাথাতেই আসেনি গো লক্ষ্মীদি। তবে সকাল এগারোটা নাগাদ দুটো পরোটা খেয়েছিলাম একটা দোকানে। আচ্ছা শোনো লক্ষীদি, খাবার বানিয়েছ তো? আমি আর থাকতে পারছিনা গো। আমি চট করে স্নানটা সেরে আসি। তুমি ভাত বাড়ো। আর শোনো, রচু ফোন করতে পারে। ওকে বোল আমি স্নান করছি। স্নান সেরে কিছু একটা খাবার পর আমি ওকে ফোন করব বলে দিও”।
নিজের মোবাইল দুটো আর পড়ে থাকা ইউনিফর্ম খুলে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলেই সে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। লক্ষ্মী আগে থেকেই তার নাইটি, সায়া, ব্রা, টাওয়েল সবকিছু বাথরুমে রেখে দিয়েছিল। মিনিট দশেক বাদে বাথরুম থেকে বেরিয়েই সে লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি ভাত বেড়েছ তো? স্নানের পর ক্ষিদেটা যেন আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল গো” বলতে বলতে ভেজা চুলে টাওয়েল জড়াতে জড়াতে ডাইনিং রুমে এসে হাজির হল।
খেতে খেতে সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হল। রচনা এখনও ফোন করল না তাকে! সে যে কালচিনি গিয়েছিল, এ খবর কি রচনা এখনও জানতে পারেনি? দুপুরের পর থেকে ওর এতগুলো কলের একটাও সে ধরেনি বলে রচনা কি অভিমান করে আর ফোন করছে না? কিন্তু এতক্ষণে তো কালচিনির সব খবরই তার জেনে যাবার কথা। না এমনটা তো হবার কথা নয়! সে খবরটা শোনার সাথে সাথেই রচনা যে তাকে ফোন না করে থাকতে পারবে না, এটা সীমন্তিনী খুব ভালভাবেই জানে। মাসি মেসো আর কিংশুক বিকেল পাঁচটার দিকে মিঃ রায়ের গাড়িতে উঠেছিল। আর তখনই সীমন্তিনীও কালচিনি থেকে রওনা হয়েছিল। সীমন্তিনীর হিসেব মত অমন সময়েই কিংশুক রচনাকে ঘটণাটা জানাবে মনে হয়। সে ঘরে ফিরে আসবার সময় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রচনাকে দু’বার ফোন করে তার ফোন বিজি পেয়েছে। মনে মনে ভেবেছিল, রচনা নিশ্চয়ই কালচিনির কারো সাথে কথা বলছে। কিন্তু তারপর তো একঘন্টার ওপর সময় কেটে গেছে। এখনও ফোন করছে না কেন।
সীমন্তিনী খেতে খেতেই লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাগো লক্ষ্মীদি। আমি যখন বাথরুমে ছিলুম তখন রচু ফোন করেছিল”?
লক্ষ্মী জবাব দিল, “না তো দিদিমণি। বৌদিমণি শেষ ফোন করেছিল সাড়ে চারটের দিকে। তারপর তো আর করেনি”।
সীমন্তিনী আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করল। তারপর হাতমুখ ধুয়েই ল্যাণ্ডলাইন ফোনটাকে বিছানার কাছে টেনে এনে বিছানায় বসে রচনার মোবাইলে ফোন করল। কিন্তু অবাক হল, রচনার বদলে রতীশ ফোন ধরতে। রতীশ জিজ্ঞেস করল, “তোর স্নান খাওয়া হয়ে গেছে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যারে দাদাভাই, মাত্র খেয়ে উঠেই তোদের ফোন করছি। কিন্তু রচু কোথায়? তুই ফোন ধরলি যে বড়”?
রতীশ সীমন্তিনীর কথার জবাবে কিছু একটা জবাব দিল। কিন্তু রচনার চিৎকারে সেটা আর শোনা গেল না। রচনা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, আমার দিদিটা বাঁচবে তো? ও মরে যাবে না তো? আমি কি আর ওকে দেখতে পাব না”?
সীমন্তিনী রচনাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “ছিঃ রচু, এসব কী বলছিস তুই? কে তোকে এমন কথা বলেছে? তোর দিদি এখন সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত। আমি ডাক্তারের সাথে সব ব্যাপারে কথা বলেছি। অর্চনাদির কণ্ডিশনের ব্যাপারে সব খবরাখবর নিয়েছি। ডক্টর সোম লোকটাও ডাক্তার হিসেবে যতটা ভাল, একজন মানুষ হিসেবে তার চেয়েও বেশী ভাল। আর অর্চনাদির খুব ভালভাবে চিকিৎসা করছেন। তেমন সিরিয়াস অবস্থা হলে আমি কি মাসি মেসো ভাইকে ওভাবে ফেলে চলে আসতুম বলে ভেবেছিস? তুই কিচ্ছু ভাবিসনে বোন। আমার কথার ওপর ভরসা রাখতে পারছিস না তুই”?
রচনা আগের মতই কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি ডাক্তার পুলিশ কারুর কথার ওপর ভরসা করিনে গো দিদিভাই। আমি শুধু আমার দিদিভাইয়ের কথার ওপর ভরসা করি। তুমি ঠিক বলছ তো? দিদি সুস্থ হয়ে উঠবে তো”?
সীমন্তিনী রচনাকে আশ্বস্ত করে বলল, “হ্যারে। আমি বলছি তো। ভাবনার কিচ্ছুটি নেই। অর্চনাদি ঠিক সেরে উঠবে। তবে একটু সময় লাগবে রে। দিদির শরীরের আর মনের যেমন অবস্থা দেখেছি তাতে আমার তো মনে হয় দিন সাতেকের আগে ডক্টররা তাকে রিলিজ করবেন না। অবশ্য ডক্টর সোম বলেছেন, যে অবস্থার যদি আর অবনতি না ঘটে তাহলে হয়ত চৌদ্দ তারিখে হাসপাতাল থেকে ছাড়তে পারেন। দেখা যাক কি হয়। আর ভাবিস না। এতক্ষণে দিদির জ্ঞান নিশ্চয়ই ফিরেছে। ভাই দিদির সাথে আছে। দিদিও নিশ্চয়ই ভাল আছে। নইলে ভাই আমাকে ঠিক ফোন করত। আমি তো কাছাকাছিই আছি। আর কাল সকালেই তো আবার আমি যাচ্ছি কালচিনি। যা কিছু দরকার পড়বে আমি সব কিছু করব”।
রচনা বলল, “হ্যা, দিদিভাই। ভাইয়ের সাথে পাঁচ মিনিট আগেই আমার কথা হয়েছে। দিদির জ্ঞান ফিরেছে। ভাইয়ের সাথে নাকি দু’চারটে কথাও বলেছে। কিন্তু নার্সটা দিদিকে বেশী কথা বলতে দেয়নি। কিন্তু তুমি না থাকলে কী হত বল তো দিদিভাই? দিদি যদি বাঁচে তাহলে শুধু তোমার জন্যেই বাঁচবে। নইলে সে তো ওই রেল লাইনেই মরে পড়ে থাকত”।
সীমন্তিনী জবাব দিল, “দুর বোকা মেয়ে? আমি আর কি করেছি? যা কিছু করার সে তো ওই কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায় আর হাসপাতালের ডক্টর সোম করেছেন। মিঃ রায় যদি তোর দিদিকে ওই সময়ে হাসপাতালে নিয়ে না যেতেন, আর ডক্টর সোম যদি সঙ্গে সঙ্গে তার সাধ্যমত চেষ্টা না করতেন, তাহলে হয়ত বিপদ একটা হয়েই যেত। মিঃ রায় অবশ্য কাল রাত থেকেই আমাকে বারবার ফোন করছিলেন। কিন্তু তোরা তো জানিসই আমার ফোন আনরিচেবল ছিল। আজ ফেরার পথে মালবাজারের কাছাকাছি এসে যখন সিগন্যাল পেলাম তখনই তোকে ফোনে করেছিলুম। আর তোর সাথে কথা বলার ঠিক পড়েই মিঃ রায়ের ফোন পেয়ে ঘটণাটা জানলাম। আর তখনই আমার অফিসে না গিয়ে আমি সোজা কালচিনি চলে গিয়েছিলাম। আমি যখন সে হাসপাতালে গিয়ে অর্চনাদিকে দেখি, তখনও সে অজ্ঞান। ডক্টর সোম তখন বলেছিল যে সকালে একবার অর্চনাদির সেন্স ফিরে এসেছিল। কিন্তু তখন এমন চিৎকার চেঁচামেচি করছিল যে ডাক্তার নার্সরা কিছুতেই তাকে সামলাতে পারছিল না। তাই ডক্টরের কথাতেই আমি তোদের বাড়ি গিয়ে মাসি মেসো আর ভাইকে নিয়ে এসেছিলুম। আমি করার মধ্যে তো কেবল এটুকুই করেছি”।
রচনা এবার অনেকটা শান্তভাবে বলল, “সে তুমি আমাকে যতই বোকা বলে ভাবো না কেন দিদিভাই, আমি জানি তুমি কাছাকাছি ছিলে বলেই আমার দিদির চরম সর্বনাশটা হয়নি। নইলে সবাই যখন বলে যে পুলিশ ঘটণাস্থলে আসে সব কিছু শেষ হয়ে যাবার পর, সেখানে এমন একটা নির্জন স্থানে দিদির প্রাণটা চলে যাবার আগেই মিঃ রায়, সেখানে গিয়ে পৌছলেন কি করে? তুমি সত্যি করে আমার নামে দিব্যি করে বল তো দেখি। এর পেছনে তুমি নেই? পারবে বলতে”?
সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হবার সাথে সাথে বেশ খুশীও হল রচনার বুদ্ধির প্রখরতা দেখে। তবুও সে কপট ধমক দিয়ে বলল, “হয়েছে, আর কথায় কথায় তোমাকে দিব্যি দিতে হবে না। একটা কথা আছে তো জানিস। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যেই করেন। এখন থেকে তোর দিদি তোদের কালচিনির বাড়িতে গিয়ে থাকবে। শ্বশুর বাড়ি নামের ওই নরকটা থেকে মুক্তি পেল সে। মাসি, মেসোর মনেও আর দুঃখ রইল না। তারা এবার তাদের মেয়েকে নিজের কাছেই রাখতে পারবেন”।
রচনা ছোট শিশুর মত খুশী হয়ে বলল, “সত্যি বলছ দিদিভাই। দিদিকে আর তার শ্বশুর বাড়ি ফিরে যেতে হবে না? সে এখন থেকে মা বাবার সাথে থাকতে পারবে”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে রচু, ঠিক তাই হবে দেখিস। অর্চনাদি এখন থেকে মাসি মেসো আর ভাইয়ের সাথেই থাকবে দেখিস। ওই ত্রিলোচন আচার্য্যি আর কিচ্ছুটি করতে পারবে না। কাল বিকেলেই শুনতে পারবি, তোর দিদির বদমাশ শ্বশুর নিজেই তার শ্বশুর বাড়ি গেছেন”।
রচনা বলল, “তাই কর দিদিভাই, ওই বাড়ির সবক’টা বদমাশকেই জেলে ঢুকিয়ে দিও। আচ্ছা দিদিভাই, দিদিকে দেখে তুমি চিনলে কেমন করে গো? তুমি তো আগে কখনও দেখ নি তাকে। ভাই নাকি দিদিকে দেখে চিনতেই পারেনি? সেখানে তুমি তাকে কিকরে চিনে ফেলেছিলে”?
সীমন্তিনী বলল, “চাক্ষুষ দেখিনি সেটা তো ঠিক। তোদের বিয়ের আগে তুই তোর এ্যালবামে তোর দিদির ছবি দেখিয়েছিলিস, মনে আছে? আর তাছাড়া ক’দিন আগেই তার একখানা ছবি আমি মিঃ রায়ের অফিসে দেখেছিলুম। তোকে সেদিন তোর জামাইবাবুর নাম জিজ্ঞেস করছিলুম না? সেদিন। কিন্তু আজ কালচিনি হাসপাতালের বিছানায় তাকে চিনতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল আমার। তবু তোর মুখের আদলের সাথে খানিকটা মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম”।
রচনা জিজ্ঞেস করল, “তোমার সাথে দিদি কথা বলেছে”?
সীমন্তিনী বলল, “সেটা তো সম্ভবই ছিল না রে। অর্চনাদির সেন্স ফিরতেই তো সে হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছিল। মাসি মেসোর কথা তো বুঝি তার কানেই যাচ্ছিল না। শেষে তো ভাইয়ের কথা শুনেই সে শান্ত হল। কিন্তু শান্ত হবার সাথে সাথেই সে আবার সেন্স হারিয়ে ফেলেছিল। তাই তার সাথে আর আমার কথা হয়ে ওঠেনি”।
রচনা বলল, “ইশ দিদিটা খুব কষ্ট পাচ্ছে না গো দিদিভাই? কিন্তু তার মানে বাবা ভাইরা যখন হাসপাতাল থেকে রওনা হয়ে বাড়ি এসেছিল, তখনও দিদি অজ্ঞানই ছিল”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে ঠিক তাই। আর ডক্টর তখন তাকে আরেকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলেছিলেন যে ঘন্টা দুই বাদে দিদির জ্ঞান ফিরবে। তাই আমি মাসি মেসোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে চলে এসেছি। আর ভাই তো এতক্ষণে আবার হাসপাতালে চলে এসেছে, দিদির কাছেই আছে। রাতে দিদির কেবিনেই থাকবে সে। কর বেকর কিছু হলে ভাই নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবে। আর ডাক্তারকেও আমি একটু স্পেশাল নজর দিতে অনুরোধ করেছি। তাই বলছি, একেবারে দুর্ভাবনা করিস নে। দিদি ভালো হয়ে যাবে দেখিস”।
রচনা বলল, “জানো দিদিভাই, খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা খুব ছটফট করছে আমার। মনে হচ্ছে এখনই ছুটে গিয়ে দিদিকে একটু দেখে আসি। কতবছর হয়ে গেছে ওকে দেখিনি। কিন্তু এখানে আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি, তোমার দাদাভাইকে সে’কথা বলিই বা কি করে বল? তিনি নিজেও কি আর খুব স্বস্তিতে আছেন”?
সীমন্তিনী কিছু একটা বলতে যেতেই তার অফিসিয়াল মোবাইলটা বেজে উঠল। সীমন্তিনী তাই রচনাকে বলল, “রচু, আমি তোকে একটু পরই ফোন করছি। আমার অফিসের কেউ একজন ফোন করেছে” বলে রিসিভার নামিয়ে রেখেই সে অফিসের ফোন তুলে দেখল মিঃ রায়ের ফোন। কলটা রিসিভ করেই সে বলল, “হ্যা মিঃ রায় বলুন”।
______________________________