04-03-2020, 10:26 PM
(Update No. 97)
রচনা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “সেটা হতে আরও কিছুদিন লাগবে গো বৌদি। তোমার দেবর পাকাপাকি ভাবে কিছু একটা করে থিতু হয়ে বসলেই সেটা সম্ভব। ওর তেমনই ইচ্ছে”।
মহিমা অবাক হয়ে বলল, “এ আবার কী কথা রে? তা আমার দেবরটা কী করতে চায় বল তো? আমি সব কিছুর বন্দোবস্ত করে দেব। বল তো শুনি ও কি করতে চায়”?
রচনা বলল, “তোমার দেবর যা করতে চায় সেটা তিনি নিজেই করবেন। তোমাকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না বৌদি। তোমার মত একটা বৌদি আমাদের পাশে থাকলেই আমরা আর কিছু চাইনে গো”।
মহিমা বলল, “কিছু ভেবো না রচনা। আজ থেকে আমি সব সময় তোমাদের পাশে আছি”।
রচনা বলল, “শুনে খুশী হলাম বৌদি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ”।
মহিমা বলল, “ধন্যবাদ তো তোমাদের আমি দেব রচনা। তুমি আমাকে আজ কত দামী একটা উপহার দিলে, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। তাই তোমাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর শোন, রতীশকে বোল, ও যদি আমার ইনস্টিটিউটে কাজ না করতে চায়, তাহলেও কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু আমার সাথে সম্পর্কটা যেন রাখে। ঠিক আছে”?
রচনা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বৌদি। তোমার দেবর তোমার কথা শুনেছেন”।
মহিমা বলল, “ঠিক আছে তাহলে। আর তোমার চালতার ডালের স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে গো। রাতে কমলার হাতের রান্না খেয়ে আজ কেমন লাগবে কে জানে। আচ্ছা রচনা, এখন রাখছি তাহলে। কাল আবার কথা বলব তোমাদের সাথে”।
রচনা ‘ঠিক আছে বৌদি, গুডনাইট’ বলে ফোন নামিয়ে রাখল।
***************
বেলা এগারোটা নাগাদ সীমন্তিনীর গাড়ি নাগরাকাটা অভিমুখে রওনা হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে সে দার্জিলিং বর্ডারে এসেছিল, সে কাজটা খুব ভালভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আইবির একটা দল তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তবে সবচেয়ে বেশী উপকার করেছেন দেবাশীষ বক্সী। পরিতোষের রেফারেন্স নিয়ে তার সাথে দেখা করতেই তিনি সীমন্তিনীকে উপদেশ দিয়েছিলেন কোত্থেকে কিভাবে কাজটা শুরু করলে ভাল হবে। পুরো অ্যাকশন প্ল্যানটা কিভাবে ডিজাইন করলে সবচেয়ে ভাল হবে তিনি সেটা প্রথমেই সীমন্তিনীকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে সীমন্তিনীর সব কাজ শেষ হয়ে যাবার পর সীমন্তিনী যেন তিন চার ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে তার সাথে দেখা করে। সীমন্তিনীর কাজ আগের দিন রাতেই মোটামুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে সে দেবাশীষ বক্সীর সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে তার বাড়িতে গিয়েছিল। ভদ্রলোক প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে যে সব তথ্য আর যুক্তি সীমন্তিনীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাতে সীমন্তিনীর মনে হল, সে একখানা অসাধারণ অ্যাকশন রিপোর্ট বানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে পারবে। আর এ রিপোর্ট পেলে ডিপার্টমেন্টে হয়তো একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। আর এ সবের পেছনে সবচেয়ে বড় হাত দেবাশীষ বক্সীর। তার সাহায্য না পেলে রিপোর্টটা খুবই সাধারণ মানের হত।
তিনখানা পুলিশ জীপের কনভয় মাল বাজারের কাছাকাছি আসতেই মোবাইলে সিগ্ন্যাল পাওয়া গেল। বেলা তখন প্রায় বারোটা। রচনার নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে লাগাতেই রচনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিভাই ও দিদিভাই। ইশ কতদিন বাদে তোমার ফোন এল গো। পরশুদিন থেকে কতবার তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি। বারবার শুধু আনরিচেবল পাচ্ছিলাম। তুমি কোথায় আছ গো দিদিভাই? তুমি ঠিক আছ তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? খাওয়া দাওয়া সময় মত করেছ তো? না কাজ করতে করতে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে বসে আছ? তোমার কোন খবর না পেয়ে আমার মনে ভেতর যে কী হচ্ছিল, কী বলব তোমাকে। ঠাকুরের কাছে বারবার মিনতি করছি, ঠাকুর যেন তোমার ওপর নজর রাখেন। আচ্ছা তুমি কিছু বলছ না কেন বল তো দিদিভাই? ও দিদিভাই, কি হল? চুপ করে আছ কেন তুমি”? বলতে বলতে রচনা কেঁদে ফেলল।
সীমন্তিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “রচু রচু, সোনা বোন আমার। কাঁদছিস কেন তুই”?
রচনা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “তুমি কথা বলছ না কেন তাহলে”?
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা পাগলী মেয়ে তো তুই। আমাকে কথা বলার সুযোগ তুই দিচ্ছিস কোথায় যে কথা বলবো? শোন, কান্না থামা। চোখ মোছ। শান্ত হ। তবে আমি কথা বলব। মুছেছিস চোখ”?
রচনা চোখ মুছে নাক টানতে টানতে বলল, “হ্যা মুছেছি। বল”।
সীমন্তিনী বলল, “তোকে তো আগেই বলেছিলাম, যে জায়গাটা ঘণ জঙ্গলে ভরা। যেখানে আমি ছিলাম সেখানে সিগন্যাল একেবারেই ছিল না। তাই তো কাউকে ফোন করতে পারিনি”।
রচনা অভিমানী গলায় প্রশ্ন করল, “যেখানে সিগন্যাল পাওয়া যায় সেখান থেকে তো অন্ততঃ একটা ফোন করতে পারতে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “সরি রে সোনা। সেটা হয়ত চেষ্টা করলে পারতুম ঠিকই। কিন্তু সেটাও সম্ভব ছিল না। আর কেন সম্ভব ছিল না, সেটা তোকে পরে বুঝিয়ে বলব। বাড়ি গিয়ে। তা তোরা কেমন আছিস বল তো? তুই আর দাদাভাই ঠিক আছিস তো”?
রচনা বলল, “তুমি যদি ভেবে থাক যে তোমার সাথে তিনদিন ধরে কথা না বলেও আমরা ভাল আছি, তাহলে সেটাই ধরে নাও। কিন্তু দয়া করে বলবে কি? তুমি এখন কোথায় আছ”?
সীমন্তিনী আদরের সুরে বলল, “রচু, সোনা বোন আমার। রাগ করিসনে ভাই। আমি এখন রাস্তায় আছি। মালবাজারের কাছাকাছি। গাড়িতে আছি। বেলা দেড়টা দুটো নাগাদ পৌঁছে যাব। আগে অফিসে যাব, তারপর বাড়ি যাব। বাড়ি গিয়ে তোকে সব খুলে বলব। তখন বুঝতে পারবি, কেন ফোন করিনি। আচ্ছা এবারে বল, তোদের দু’জনের শরীর ঠিক আছে তো? ভালো আছিস তো তোরা? দাদাভাই কোথায়? ওই যোগা ইনস্টিটিউটে জয়েন করেছে”?
রচনা জবাব দিল, “আমরা ঠিক আছি। তোমার দাদাভাই এখন ঘরে নেই। একটু বাজারে গেছেন। আর ওই যোগা ইনস্টিটিউটে এখনও জয়েন করেননি। বলছিলেন যে তোমার সাথে আরেকটু কথা বলবেন ওই ব্যাপারে। আমারও তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। তুমি ঘরে গিয়ে স্নান খাওয়া দাওয়া করেই আমাকে ফোন করো। তখন সব কথা শুনতে পারবে”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে। ভাল থাকিস। রাখছি”।
মালবাজার পেরিয়ে আসবার পর সীমন্তিনী পরিতোষ আর লক্ষ্মীকে ফোন করল। তারপর বাড়ির নাম্বারে ফোন করে বড়মার সাথে কথা বলল। তার কিছুক্ষণ বাদেই তার মোবাইলে একটা ফোন এল। কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়ের ফোন। সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে কলটা রিসিভ করে বলল, “হ্যা মিঃ রায়, বলুন কি খবর”?
মিঃ রায় বললেন, “ম্যাম, আপনি কি একবার কালচিনি আসতে পারবেন আজ”?
সীমন্তিনী এবার আরও অবাক হয়ে বলল, “আজ আসতে বলছেন? কিন্তু কেন স্যার? কোন জরুরী কিছু ব্যাপার”?
মিঃ রায় বললেন, “ম্যাম, একটা খারাপ খবর আছে। গতকাল রাত প্রায় এগারটা নাগাদ অর্চনা আচার্য্যিকে অচেতন অবস্থায় ট্রেন লাইনের ধারে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আমরা ইনফর্মেশন পেয়ে সাথে সাথেই মুভ করেছিলাম। তাকে অচেতন অবস্থায় সেখান থেকে উদ্ধার করে আমরা কালচিনি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছি। আজ সকালে তার জ্ঞান ফিরলেও, তিনি অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। এখনও যথেষ্ট দুর্বল এবং অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। ডাক্তাররা বলছেন গত দু’তিন দিনের ভেতর তার স্টমাকে নাকি কিছুই ঢোকেনি। সাংঘাতিক ডিহাইড্রেশন হয়েছে। আমি জানি, উনি আপনার রিলেটিভ। আর তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তার প্রতি সহৃদয় ছিল না। আমরা তাই আপনার সাথে কন্টাক্ট করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম কাল রাত থেকেই। কিন্তু আপনার ফোন নট রিচেবল বলছিল বার বার। পরে ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার থেকে আপনার লোকেশান জানতে পেরেছি। আমি ইচ্ছে করেই তার শ্বশুর বাড়িতে ব্যাপারটা জানাইনি। আপনার সাথে কথা বলবার অপেক্ষায় ছিলাম। তা আপনি কি আসতে পারবেন ম্যাম? নইলে ব্যাপারটাকে আমার মত করেই হ্যান্ডেল করব আমি। আর সবার আগে ওই বদমাশ ত্রিলোচন আচার্য্যিকে এটেম্পট টু মার্ডারের চার্জ লাগিয়ে লকআপে পুড়ব”।
সীমন্তিনী মিঃ রায়ের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠল। তাই সে সাথে সাথে বলল, “স্যার আমি অন ডিউটি এখন কালচিনি থেকে প্রায় একশ’ কিলো মিটার দুরে আছি। তবে আপনি যে আমাকে খবরটা দিয়েছেন সে জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি এখন সোজা আপনার ওখানেই যাচ্ছি। আশা করি ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। কিন্তু স্যার ততক্ষন ব্যাপারটাকে অফিসিয়াল বা পাব্লিক কোনটাই করবেন না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি মীন করছি”?
মিঃ রায় বললেন, “হ্যা ম্যাম বুঝেছি। আর সে জন্যেই তো আপনার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় ছিলাম। ঠিক আছে ম্যাম, আপনি কালচিনিতে ঢুকেই আমাকে একটা ফোন করে দেবেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যাব। আপনিও সোজা হাসপাতালেই চলে আসুন। বাকিটা সাক্ষাতে আলোচনা করব। কিন্তু ম্যাম, ইন দা মীন টাইম, আমি কি ত্রিলোচন আচার্য্যির বাড়িতে বা মেয়েটির বাপের বাড়িতে কোন খবর পাঠাব”?
সীমন্তিনী বলল, “না মিঃ রায়। আমি না পৌঁছনো অব্দি একটু অপেক্ষা করুন না প্লীজ। তবে এখন অর্চনার অবস্থা কেমন? সেখানকার ডাক্তাররা কী বলছে? ওকে কি বড় কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হবে”?
মিঃ রায় জবাবে বললেন, “ম্যাম, ওনাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম তখন তো আমরা সকলেই ভেবেছিলাম, ওনাকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারব না। এখানে হাসপাতালও ছোট। কিন্তু অমন অবস্থায় তাকে আলিপুরদুয়ারেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তবে এখানকার ইনচার্য ডঃ সোম খুবই দক্ষ একজন ডাক্তার। গতকাল রাত বারোটা থেকে অর্চনাকে নিয়ে ওটিতে ঢুকে আজ ভোর সাড়ে পাঁচটা অব্দি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওটি থেকে বেরিয়ে জানালেন যে পেশেন্ট মোটামুটি বিপদমুক্ত। তবে আরও কয়েক ঘন্টা কনস্ট্যান্ট ওয়াচে না রাখলে পুরোপুরিভাবে বিপদ কেটে গেছে বলা যাবে না। তবে অর্চনার জ্ঞান এখনও ফেরে নি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন যে আলিপুরদুয়ার নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু অর্চনার কন্ডিশান দেখে ডাক্তার তাতেও বিপদের ঝুঁকি আছে বলছেন”।
সীমন্তিনী শ্বাসরূদ্ধ অবস্থায় মিঃ রায়ের কথাগুলো শুনে বলল, “ওকে মিঃ রায়। আমি এখন সোজা কালচিনি যাচ্ছি”।
মিঃ রায় সংক্ষেপে বললেন, “ওকে ম্যাম। সি ইউ সুন” বলে ফোন কেটে দিল। সীমন্তিনী তার গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, “আমরা এখন সোজা কালচিনি হাসপাতালে যাব। সেখানে একটা আর্জেন্ট কাজ শেষ করে তারপর অফিসে ফিরব” বলে জীপের পেছনে বসে থাকা একজন এসআই কে বলল, “আপনি সামনের আর পেছনের গাড়িতে খবরটা পাঠিয়ে দিন মিঃ বড়াল। আমরা সোজা কালচিনি হাসপাতালে যাচ্ছি”।
গভীরভাবে মনে মনে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনী কালচিনি টাউনে ঢুকেই মিঃ রায়কে ফোন করে বলল, “মিঃ রায়, আমরা কালচিনিতে ঢুকে গেছি। সোজা হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনিও প্লীজ চলে আসুন”।
বেলা আড়াইটে নাগাদ কালচিনি হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই একদিক থেকে মিঃ রায়কে ছুটে আসতে দেখল সীমন্তিনী। ছ’সাতজন বন্দুকধারী সতর্ক ভঙ্গীতে সীমন্তিনীর চারপাশে এসে দাঁড়াল। মিঃ রায় সীমন্তিনীর সাথে এত ফোর্স দেখে একটু অবাকই হলেন। সীমন্তিনীর কাছে এসে তিনি বললেন, “গুড আফটারনুন ম্যাম। আসুন”।
সীমন্তিনী মিঃ রায়কে অনুসরন করে হাসপাতালের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দু’জন গার্ড সীমন্তিনীর সাথে ভেতরে ঢুকল। আর বাকিরা হাসপাতালের মূল দরজার পাশে দাঁড়াল। মিঃ রায় সীমন্তিনীকে নিয়ে একটা কেবিনে ঢুকতেই ডাক্তারের পোশাক পড়া একজন হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে বললেন, “সরি স্যার। আমি একটা অন্য পেশেন্টকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। তাই আপনাদের রিসিভ করতে যেতে পারিনি”।
সীমন্তিনী সে লোকটার দিকে চাইতেই মিঃ রায় বললেন, “ম্যাম, ইনি ডক্টর শিবরঞ্জন সোম। ইনিই পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করছেন। আর ডোক্টর সোম, ইনি হচ্ছেন আইপিএস অফিসার সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি। পেশেন্টের রিলেটিভ”।
সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে ডক্টর সোমের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “হ্যালো ডক্টর সোম। তা পেশেন্টের কণ্ডিশন কেমন বুঝছেন? প্রাণে বাঁচবে তো”?
ডক্টর সোম বললেন, “কাল যখন পেশেন্টকে আনা হয়েছিল, তখন আমরা নিজেরাও সিওর ছিলাম না ম্যাম। তবে আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছি। আর ইতিমধ্যে প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা যখন সারভাইভ করে গেছে, তাহলে বড়সর বিপদের সম্ভাবনাটা কেটেই গেছে ধরা যায়। সকাল আটটার দিকে একবার সেন্স ফিরে এসেছিল। কিন্তু সাংঘাতিক ট্রমাটাইজড ছিল। প্রচণ্ড রকম চিৎকার করছিল। বারবার বলছিল ‘আমাকে মেরোনা, আমাকে মেরোনা। আমাকে আমার বাবার কাছে যেতে দাও। আমাকে আমার মার কাছে যেতে দাও’। অনেক চেষ্টা করেও তাকে শান্ত করতে না পেরে আমরা সেডেটিভ দিতে বাধ্য হয়েছি। এখন ঘুমোচ্ছে। পালস রেট ইম্প্রুভ করলেও এখনও বেশ স্লো চলছে। বিপি অস্বাভাবিক রকম লো। ডিহাইড্রেশন খুব সাংঘাতিক মাত্রায় হয়েছিল। তখন হাসপাতালে না আনলে আর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চরম বিপদটা ঘটে যেত। তবে শুরু থেকেই স্যালাইন চলছে। ডিহাইড্রেশনের প্রকোপ কমে এসেছে অনেকটাই। কিন্তু শরীর এখনও খুবই দুর্বল। আরেকবার সেন্স ফিরলে তবে আরেকটু এক্সামিন করে ভাল ভাবে বলতে পারব। আসলে ম্যাম, এই ছোট হাসপাতালে তো সবকিছু উপলব্ধ নয়”।
সীমন্তিনী ডাক্তারের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি একটু বেডের কাছে গিয়ে দেখতে পারি ডক্টর”?
ডক্টর সোম বললেন, “হ্যা ম্যাম, সেটা করতে পারেন। তবে জাগাবার চেষ্টা আপাততঃ না করলেই ভাল হবে। মনে হয় আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই উনি সেন্সে ফিরবেন। তবে আপনারা যদি পেশেন্টের কোন কাছের মানুষ বা কোন প্রিয়জনকে তার সামনে আনতে পারেন, তাহলে খুব ভাল হত”।
সীমন্তিনী বেডের কাছে গিয়ে দেখল খুবই শীর্ণকায় একটা কমবয়সী মেয়ে চোখ বুজে বিছানায় মরার মত পড়ে আছে। শ্বাস চলছে কি না তা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। শরীরটা যেন বিছানার সাথে একেবারে মিশে আছে। থুতনীর নিচ দিয়ে দু’কান ঢেকে মাথার ওপর দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করা। মুখের আদলের সাথে রচনার মুখের বেশ মিল আছে। না চাইতেও সীমন্তিনীর চোখ দুটো জলে ভরে এল। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে ডাক্তারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “শরীরে ইনজুরিও আছে নাকি ডক্টর”?
ডক্টর সোম বললেন, “হ্যা ম্যাম, তার গালে কাঁধে আর কানের নিচে বেশ কয়েকটা জায়গায় মারধরের চিহ্ন আছে। তবে সেগুলো তেমন ফ্যাটাল নয়। তার ট্রমাটা কেটে গেলেই সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে বলে মনে হয়। আর সেটা তাড়াতাড়ি দুর করবার জন্য মেয়েটার কোন প্রিয়জনের এখানে থাকাটা খুবই আবশ্যক”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি সে চেষ্টা করছি ডক্টর। কিন্তু মোটামুটি রিকভারি হতে কতটা সময় লাগতে পারে বলে মনে হয় আপনার? মানে ওকে কতদিন এখানে থাকতে হবে”?
ডক্টর সোম বললেন, “যদি মেয়েটা জ্ঞান ফিরে তার মা বাবাকে দেখতে পায়, তাহলে আমার মনে হয় ট্রমাটা খুব তাড়াতাড়িই কেটে যাবে। কিন্তু তবু দুটো দিন তো এখানে পুরো থাকতেই হবে। কিছুটা স্ট্রেন্থ রিগেইন না করা পর্যন্ত তো ডিসচার্জ করা যাবে না”।
সীমন্তিনী বলল, “ওকে ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমি ওর মা বাবাকে এখানে আনবার ব্যবস্থা করছি”।
সীমন্তিনীর পেছন পেছন মিঃ রায়ও কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। সীমন্তিনী হাসপাতালের দরজার বাইরে এসে মিঃ রায়কে বলল, “আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মিঃ রায়। আমি ওর মা বাবাকে নিয়ে আসছি। আর শুনুন, এটা তো এটেম্পট টু মার্ডারই। আর কালপ্রিট কে, সেটা আমরা জানলেও, আমাদের হাতে তো কোনও প্রুফ নেই। ভিক্টিমের বয়ান না পাওয়া পর্যন্ত তো আমরা কোন অ্যাকশন নিতে পারব না। তাই আমার মনে হয় একটু অপেক্ষা করাই ভাল। আপনি আপাততঃ ব্যাপারটাকে একটু সিক্রেট রাখবার চেষ্টা করুন। ত্রিলোচন আচার্য্যির বাড়ির লোকেরা যাতে জানতে না পারে, সেদিকে একটু খেয়াল রাখুন। আর একটু অপেক্ষা করুন আমার জন্যে প্লীজ। আমি আধঘন্টার ভেতরেই ফিরে আসব”।
মিঃ রায় বললেন, “হ্যা হ্যা, ম্যাম। আপনি আসুন। আমি এখানেই থাকছি আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত”।
সীমন্তিনী তার গাড়ির কাছে এসে তার সঙ্গের এক ইনস্পেক্টরকে বলল, “মিঃ বর্মন, আমাদের বাজার পেরিয়ে ওদিকে একটা জায়গায় যেতে হবে। দু’তিন জনকে এসকর্ট করে আনতে হবে এখানে। তাই আমার গাড়িতে শুধু পেছনে দু’জনকে বসতে বলুন। আপনি একটা গাড়িতে আর চার পাঁচ জনকে নিয়ে আমাদের ফলো করুন”।
মিঃ বর্মন ফোর্সের বাকিদের সাথে কথা বলে একটা গাড়িতে উঠে বসল। সীমন্তিনী কিংশুকের নাম্বারে ফোন করল। কিংশুক ফোন ধরেই বলল, “হ্যা দিদিভাই, বল”?
সীমন্তিনী বলল, “ভাই তুমি এখন কোথায় আছ, বাড়িতে”?
কিংশুক জবাব দিল, “না দিদিভাই, ঠিক বাড়িতে নয়। তবে বাড়ির কাছাকাছিই আছি। একটা জিনিস নিতে এসেছি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আর মা বাবা কি বাড়িতেই আছেন”?
কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই, তারা বাড়িতেই আছেন। কেন বল তো”?
সীমন্তিনী নিজের গলাকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করে বলল, “ভাই শোন, তুমি এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাও। বাবা আর মাকে পোশাক পড়ে তৈরী হতে বল। তুমিও তৈরী হয়ে নিও। তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি এক্ষুনি একটা জায়গায় যাব। আমি দশ মিনিটের ভেতর বাড়ি আসছি। এসে সব কথা বলছি” বলেই কিংশুককে আর কোন প্রশ্ন করবার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল।
______________________________
রচনা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “সেটা হতে আরও কিছুদিন লাগবে গো বৌদি। তোমার দেবর পাকাপাকি ভাবে কিছু একটা করে থিতু হয়ে বসলেই সেটা সম্ভব। ওর তেমনই ইচ্ছে”।
মহিমা অবাক হয়ে বলল, “এ আবার কী কথা রে? তা আমার দেবরটা কী করতে চায় বল তো? আমি সব কিছুর বন্দোবস্ত করে দেব। বল তো শুনি ও কি করতে চায়”?
রচনা বলল, “তোমার দেবর যা করতে চায় সেটা তিনি নিজেই করবেন। তোমাকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না বৌদি। তোমার মত একটা বৌদি আমাদের পাশে থাকলেই আমরা আর কিছু চাইনে গো”।
মহিমা বলল, “কিছু ভেবো না রচনা। আজ থেকে আমি সব সময় তোমাদের পাশে আছি”।
রচনা বলল, “শুনে খুশী হলাম বৌদি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ”।
মহিমা বলল, “ধন্যবাদ তো তোমাদের আমি দেব রচনা। তুমি আমাকে আজ কত দামী একটা উপহার দিলে, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। তাই তোমাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর শোন, রতীশকে বোল, ও যদি আমার ইনস্টিটিউটে কাজ না করতে চায়, তাহলেও কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু আমার সাথে সম্পর্কটা যেন রাখে। ঠিক আছে”?
রচনা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বৌদি। তোমার দেবর তোমার কথা শুনেছেন”।
মহিমা বলল, “ঠিক আছে তাহলে। আর তোমার চালতার ডালের স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে গো। রাতে কমলার হাতের রান্না খেয়ে আজ কেমন লাগবে কে জানে। আচ্ছা রচনা, এখন রাখছি তাহলে। কাল আবার কথা বলব তোমাদের সাথে”।
রচনা ‘ঠিক আছে বৌদি, গুডনাইট’ বলে ফোন নামিয়ে রাখল।
***************
বেলা এগারোটা নাগাদ সীমন্তিনীর গাড়ি নাগরাকাটা অভিমুখে রওনা হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে সে দার্জিলিং বর্ডারে এসেছিল, সে কাজটা খুব ভালভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আইবির একটা দল তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তবে সবচেয়ে বেশী উপকার করেছেন দেবাশীষ বক্সী। পরিতোষের রেফারেন্স নিয়ে তার সাথে দেখা করতেই তিনি সীমন্তিনীকে উপদেশ দিয়েছিলেন কোত্থেকে কিভাবে কাজটা শুরু করলে ভাল হবে। পুরো অ্যাকশন প্ল্যানটা কিভাবে ডিজাইন করলে সবচেয়ে ভাল হবে তিনি সেটা প্রথমেই সীমন্তিনীকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে সীমন্তিনীর সব কাজ শেষ হয়ে যাবার পর সীমন্তিনী যেন তিন চার ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে তার সাথে দেখা করে। সীমন্তিনীর কাজ আগের দিন রাতেই মোটামুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে সে দেবাশীষ বক্সীর সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে তার বাড়িতে গিয়েছিল। ভদ্রলোক প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে যে সব তথ্য আর যুক্তি সীমন্তিনীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাতে সীমন্তিনীর মনে হল, সে একখানা অসাধারণ অ্যাকশন রিপোর্ট বানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে পারবে। আর এ রিপোর্ট পেলে ডিপার্টমেন্টে হয়তো একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। আর এ সবের পেছনে সবচেয়ে বড় হাত দেবাশীষ বক্সীর। তার সাহায্য না পেলে রিপোর্টটা খুবই সাধারণ মানের হত।
তিনখানা পুলিশ জীপের কনভয় মাল বাজারের কাছাকাছি আসতেই মোবাইলে সিগ্ন্যাল পাওয়া গেল। বেলা তখন প্রায় বারোটা। রচনার নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে লাগাতেই রচনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিভাই ও দিদিভাই। ইশ কতদিন বাদে তোমার ফোন এল গো। পরশুদিন থেকে কতবার তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি। বারবার শুধু আনরিচেবল পাচ্ছিলাম। তুমি কোথায় আছ গো দিদিভাই? তুমি ঠিক আছ তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? খাওয়া দাওয়া সময় মত করেছ তো? না কাজ করতে করতে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে বসে আছ? তোমার কোন খবর না পেয়ে আমার মনে ভেতর যে কী হচ্ছিল, কী বলব তোমাকে। ঠাকুরের কাছে বারবার মিনতি করছি, ঠাকুর যেন তোমার ওপর নজর রাখেন। আচ্ছা তুমি কিছু বলছ না কেন বল তো দিদিভাই? ও দিদিভাই, কি হল? চুপ করে আছ কেন তুমি”? বলতে বলতে রচনা কেঁদে ফেলল।
সীমন্তিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “রচু রচু, সোনা বোন আমার। কাঁদছিস কেন তুই”?
রচনা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “তুমি কথা বলছ না কেন তাহলে”?
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা পাগলী মেয়ে তো তুই। আমাকে কথা বলার সুযোগ তুই দিচ্ছিস কোথায় যে কথা বলবো? শোন, কান্না থামা। চোখ মোছ। শান্ত হ। তবে আমি কথা বলব। মুছেছিস চোখ”?
রচনা চোখ মুছে নাক টানতে টানতে বলল, “হ্যা মুছেছি। বল”।
সীমন্তিনী বলল, “তোকে তো আগেই বলেছিলাম, যে জায়গাটা ঘণ জঙ্গলে ভরা। যেখানে আমি ছিলাম সেখানে সিগন্যাল একেবারেই ছিল না। তাই তো কাউকে ফোন করতে পারিনি”।
রচনা অভিমানী গলায় প্রশ্ন করল, “যেখানে সিগন্যাল পাওয়া যায় সেখান থেকে তো অন্ততঃ একটা ফোন করতে পারতে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “সরি রে সোনা। সেটা হয়ত চেষ্টা করলে পারতুম ঠিকই। কিন্তু সেটাও সম্ভব ছিল না। আর কেন সম্ভব ছিল না, সেটা তোকে পরে বুঝিয়ে বলব। বাড়ি গিয়ে। তা তোরা কেমন আছিস বল তো? তুই আর দাদাভাই ঠিক আছিস তো”?
রচনা বলল, “তুমি যদি ভেবে থাক যে তোমার সাথে তিনদিন ধরে কথা না বলেও আমরা ভাল আছি, তাহলে সেটাই ধরে নাও। কিন্তু দয়া করে বলবে কি? তুমি এখন কোথায় আছ”?
সীমন্তিনী আদরের সুরে বলল, “রচু, সোনা বোন আমার। রাগ করিসনে ভাই। আমি এখন রাস্তায় আছি। মালবাজারের কাছাকাছি। গাড়িতে আছি। বেলা দেড়টা দুটো নাগাদ পৌঁছে যাব। আগে অফিসে যাব, তারপর বাড়ি যাব। বাড়ি গিয়ে তোকে সব খুলে বলব। তখন বুঝতে পারবি, কেন ফোন করিনি। আচ্ছা এবারে বল, তোদের দু’জনের শরীর ঠিক আছে তো? ভালো আছিস তো তোরা? দাদাভাই কোথায়? ওই যোগা ইনস্টিটিউটে জয়েন করেছে”?
রচনা জবাব দিল, “আমরা ঠিক আছি। তোমার দাদাভাই এখন ঘরে নেই। একটু বাজারে গেছেন। আর ওই যোগা ইনস্টিটিউটে এখনও জয়েন করেননি। বলছিলেন যে তোমার সাথে আরেকটু কথা বলবেন ওই ব্যাপারে। আমারও তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। তুমি ঘরে গিয়ে স্নান খাওয়া দাওয়া করেই আমাকে ফোন করো। তখন সব কথা শুনতে পারবে”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে। ভাল থাকিস। রাখছি”।
মালবাজার পেরিয়ে আসবার পর সীমন্তিনী পরিতোষ আর লক্ষ্মীকে ফোন করল। তারপর বাড়ির নাম্বারে ফোন করে বড়মার সাথে কথা বলল। তার কিছুক্ষণ বাদেই তার মোবাইলে একটা ফোন এল। কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়ের ফোন। সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে কলটা রিসিভ করে বলল, “হ্যা মিঃ রায়, বলুন কি খবর”?
মিঃ রায় বললেন, “ম্যাম, আপনি কি একবার কালচিনি আসতে পারবেন আজ”?
সীমন্তিনী এবার আরও অবাক হয়ে বলল, “আজ আসতে বলছেন? কিন্তু কেন স্যার? কোন জরুরী কিছু ব্যাপার”?
মিঃ রায় বললেন, “ম্যাম, একটা খারাপ খবর আছে। গতকাল রাত প্রায় এগারটা নাগাদ অর্চনা আচার্য্যিকে অচেতন অবস্থায় ট্রেন লাইনের ধারে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আমরা ইনফর্মেশন পেয়ে সাথে সাথেই মুভ করেছিলাম। তাকে অচেতন অবস্থায় সেখান থেকে উদ্ধার করে আমরা কালচিনি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছি। আজ সকালে তার জ্ঞান ফিরলেও, তিনি অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। এখনও যথেষ্ট দুর্বল এবং অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। ডাক্তাররা বলছেন গত দু’তিন দিনের ভেতর তার স্টমাকে নাকি কিছুই ঢোকেনি। সাংঘাতিক ডিহাইড্রেশন হয়েছে। আমি জানি, উনি আপনার রিলেটিভ। আর তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তার প্রতি সহৃদয় ছিল না। আমরা তাই আপনার সাথে কন্টাক্ট করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম কাল রাত থেকেই। কিন্তু আপনার ফোন নট রিচেবল বলছিল বার বার। পরে ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার থেকে আপনার লোকেশান জানতে পেরেছি। আমি ইচ্ছে করেই তার শ্বশুর বাড়িতে ব্যাপারটা জানাইনি। আপনার সাথে কথা বলবার অপেক্ষায় ছিলাম। তা আপনি কি আসতে পারবেন ম্যাম? নইলে ব্যাপারটাকে আমার মত করেই হ্যান্ডেল করব আমি। আর সবার আগে ওই বদমাশ ত্রিলোচন আচার্য্যিকে এটেম্পট টু মার্ডারের চার্জ লাগিয়ে লকআপে পুড়ব”।
সীমন্তিনী মিঃ রায়ের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠল। তাই সে সাথে সাথে বলল, “স্যার আমি অন ডিউটি এখন কালচিনি থেকে প্রায় একশ’ কিলো মিটার দুরে আছি। তবে আপনি যে আমাকে খবরটা দিয়েছেন সে জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি এখন সোজা আপনার ওখানেই যাচ্ছি। আশা করি ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। কিন্তু স্যার ততক্ষন ব্যাপারটাকে অফিসিয়াল বা পাব্লিক কোনটাই করবেন না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি মীন করছি”?
মিঃ রায় বললেন, “হ্যা ম্যাম বুঝেছি। আর সে জন্যেই তো আপনার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় ছিলাম। ঠিক আছে ম্যাম, আপনি কালচিনিতে ঢুকেই আমাকে একটা ফোন করে দেবেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যাব। আপনিও সোজা হাসপাতালেই চলে আসুন। বাকিটা সাক্ষাতে আলোচনা করব। কিন্তু ম্যাম, ইন দা মীন টাইম, আমি কি ত্রিলোচন আচার্য্যির বাড়িতে বা মেয়েটির বাপের বাড়িতে কোন খবর পাঠাব”?
সীমন্তিনী বলল, “না মিঃ রায়। আমি না পৌঁছনো অব্দি একটু অপেক্ষা করুন না প্লীজ। তবে এখন অর্চনার অবস্থা কেমন? সেখানকার ডাক্তাররা কী বলছে? ওকে কি বড় কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হবে”?
মিঃ রায় জবাবে বললেন, “ম্যাম, ওনাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম তখন তো আমরা সকলেই ভেবেছিলাম, ওনাকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারব না। এখানে হাসপাতালও ছোট। কিন্তু অমন অবস্থায় তাকে আলিপুরদুয়ারেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তবে এখানকার ইনচার্য ডঃ সোম খুবই দক্ষ একজন ডাক্তার। গতকাল রাত বারোটা থেকে অর্চনাকে নিয়ে ওটিতে ঢুকে আজ ভোর সাড়ে পাঁচটা অব্দি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওটি থেকে বেরিয়ে জানালেন যে পেশেন্ট মোটামুটি বিপদমুক্ত। তবে আরও কয়েক ঘন্টা কনস্ট্যান্ট ওয়াচে না রাখলে পুরোপুরিভাবে বিপদ কেটে গেছে বলা যাবে না। তবে অর্চনার জ্ঞান এখনও ফেরে নি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন যে আলিপুরদুয়ার নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু অর্চনার কন্ডিশান দেখে ডাক্তার তাতেও বিপদের ঝুঁকি আছে বলছেন”।
সীমন্তিনী শ্বাসরূদ্ধ অবস্থায় মিঃ রায়ের কথাগুলো শুনে বলল, “ওকে মিঃ রায়। আমি এখন সোজা কালচিনি যাচ্ছি”।
মিঃ রায় সংক্ষেপে বললেন, “ওকে ম্যাম। সি ইউ সুন” বলে ফোন কেটে দিল। সীমন্তিনী তার গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, “আমরা এখন সোজা কালচিনি হাসপাতালে যাব। সেখানে একটা আর্জেন্ট কাজ শেষ করে তারপর অফিসে ফিরব” বলে জীপের পেছনে বসে থাকা একজন এসআই কে বলল, “আপনি সামনের আর পেছনের গাড়িতে খবরটা পাঠিয়ে দিন মিঃ বড়াল। আমরা সোজা কালচিনি হাসপাতালে যাচ্ছি”।
গভীরভাবে মনে মনে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনী কালচিনি টাউনে ঢুকেই মিঃ রায়কে ফোন করে বলল, “মিঃ রায়, আমরা কালচিনিতে ঢুকে গেছি। সোজা হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনিও প্লীজ চলে আসুন”।
বেলা আড়াইটে নাগাদ কালচিনি হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই একদিক থেকে মিঃ রায়কে ছুটে আসতে দেখল সীমন্তিনী। ছ’সাতজন বন্দুকধারী সতর্ক ভঙ্গীতে সীমন্তিনীর চারপাশে এসে দাঁড়াল। মিঃ রায় সীমন্তিনীর সাথে এত ফোর্স দেখে একটু অবাকই হলেন। সীমন্তিনীর কাছে এসে তিনি বললেন, “গুড আফটারনুন ম্যাম। আসুন”।
সীমন্তিনী মিঃ রায়কে অনুসরন করে হাসপাতালের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দু’জন গার্ড সীমন্তিনীর সাথে ভেতরে ঢুকল। আর বাকিরা হাসপাতালের মূল দরজার পাশে দাঁড়াল। মিঃ রায় সীমন্তিনীকে নিয়ে একটা কেবিনে ঢুকতেই ডাক্তারের পোশাক পড়া একজন হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে বললেন, “সরি স্যার। আমি একটা অন্য পেশেন্টকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। তাই আপনাদের রিসিভ করতে যেতে পারিনি”।
সীমন্তিনী সে লোকটার দিকে চাইতেই মিঃ রায় বললেন, “ম্যাম, ইনি ডক্টর শিবরঞ্জন সোম। ইনিই পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করছেন। আর ডোক্টর সোম, ইনি হচ্ছেন আইপিএস অফিসার সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি। পেশেন্টের রিলেটিভ”।
সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে ডক্টর সোমের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “হ্যালো ডক্টর সোম। তা পেশেন্টের কণ্ডিশন কেমন বুঝছেন? প্রাণে বাঁচবে তো”?
ডক্টর সোম বললেন, “কাল যখন পেশেন্টকে আনা হয়েছিল, তখন আমরা নিজেরাও সিওর ছিলাম না ম্যাম। তবে আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছি। আর ইতিমধ্যে প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা যখন সারভাইভ করে গেছে, তাহলে বড়সর বিপদের সম্ভাবনাটা কেটেই গেছে ধরা যায়। সকাল আটটার দিকে একবার সেন্স ফিরে এসেছিল। কিন্তু সাংঘাতিক ট্রমাটাইজড ছিল। প্রচণ্ড রকম চিৎকার করছিল। বারবার বলছিল ‘আমাকে মেরোনা, আমাকে মেরোনা। আমাকে আমার বাবার কাছে যেতে দাও। আমাকে আমার মার কাছে যেতে দাও’। অনেক চেষ্টা করেও তাকে শান্ত করতে না পেরে আমরা সেডেটিভ দিতে বাধ্য হয়েছি। এখন ঘুমোচ্ছে। পালস রেট ইম্প্রুভ করলেও এখনও বেশ স্লো চলছে। বিপি অস্বাভাবিক রকম লো। ডিহাইড্রেশন খুব সাংঘাতিক মাত্রায় হয়েছিল। তখন হাসপাতালে না আনলে আর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চরম বিপদটা ঘটে যেত। তবে শুরু থেকেই স্যালাইন চলছে। ডিহাইড্রেশনের প্রকোপ কমে এসেছে অনেকটাই। কিন্তু শরীর এখনও খুবই দুর্বল। আরেকবার সেন্স ফিরলে তবে আরেকটু এক্সামিন করে ভাল ভাবে বলতে পারব। আসলে ম্যাম, এই ছোট হাসপাতালে তো সবকিছু উপলব্ধ নয়”।
সীমন্তিনী ডাক্তারের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “আমি কি একটু বেডের কাছে গিয়ে দেখতে পারি ডক্টর”?
ডক্টর সোম বললেন, “হ্যা ম্যাম, সেটা করতে পারেন। তবে জাগাবার চেষ্টা আপাততঃ না করলেই ভাল হবে। মনে হয় আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই উনি সেন্সে ফিরবেন। তবে আপনারা যদি পেশেন্টের কোন কাছের মানুষ বা কোন প্রিয়জনকে তার সামনে আনতে পারেন, তাহলে খুব ভাল হত”।
সীমন্তিনী বেডের কাছে গিয়ে দেখল খুবই শীর্ণকায় একটা কমবয়সী মেয়ে চোখ বুজে বিছানায় মরার মত পড়ে আছে। শ্বাস চলছে কি না তা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। শরীরটা যেন বিছানার সাথে একেবারে মিশে আছে। থুতনীর নিচ দিয়ে দু’কান ঢেকে মাথার ওপর দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করা। মুখের আদলের সাথে রচনার মুখের বেশ মিল আছে। না চাইতেও সীমন্তিনীর চোখ দুটো জলে ভরে এল। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে ডাক্তারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “শরীরে ইনজুরিও আছে নাকি ডক্টর”?
ডক্টর সোম বললেন, “হ্যা ম্যাম, তার গালে কাঁধে আর কানের নিচে বেশ কয়েকটা জায়গায় মারধরের চিহ্ন আছে। তবে সেগুলো তেমন ফ্যাটাল নয়। তার ট্রমাটা কেটে গেলেই সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে বলে মনে হয়। আর সেটা তাড়াতাড়ি দুর করবার জন্য মেয়েটার কোন প্রিয়জনের এখানে থাকাটা খুবই আবশ্যক”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি সে চেষ্টা করছি ডক্টর। কিন্তু মোটামুটি রিকভারি হতে কতটা সময় লাগতে পারে বলে মনে হয় আপনার? মানে ওকে কতদিন এখানে থাকতে হবে”?
ডক্টর সোম বললেন, “যদি মেয়েটা জ্ঞান ফিরে তার মা বাবাকে দেখতে পায়, তাহলে আমার মনে হয় ট্রমাটা খুব তাড়াতাড়িই কেটে যাবে। কিন্তু তবু দুটো দিন তো এখানে পুরো থাকতেই হবে। কিছুটা স্ট্রেন্থ রিগেইন না করা পর্যন্ত তো ডিসচার্জ করা যাবে না”।
সীমন্তিনী বলল, “ওকে ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমি ওর মা বাবাকে এখানে আনবার ব্যবস্থা করছি”।
সীমন্তিনীর পেছন পেছন মিঃ রায়ও কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। সীমন্তিনী হাসপাতালের দরজার বাইরে এসে মিঃ রায়কে বলল, “আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মিঃ রায়। আমি ওর মা বাবাকে নিয়ে আসছি। আর শুনুন, এটা তো এটেম্পট টু মার্ডারই। আর কালপ্রিট কে, সেটা আমরা জানলেও, আমাদের হাতে তো কোনও প্রুফ নেই। ভিক্টিমের বয়ান না পাওয়া পর্যন্ত তো আমরা কোন অ্যাকশন নিতে পারব না। তাই আমার মনে হয় একটু অপেক্ষা করাই ভাল। আপনি আপাততঃ ব্যাপারটাকে একটু সিক্রেট রাখবার চেষ্টা করুন। ত্রিলোচন আচার্য্যির বাড়ির লোকেরা যাতে জানতে না পারে, সেদিকে একটু খেয়াল রাখুন। আর একটু অপেক্ষা করুন আমার জন্যে প্লীজ। আমি আধঘন্টার ভেতরেই ফিরে আসব”।
মিঃ রায় বললেন, “হ্যা হ্যা, ম্যাম। আপনি আসুন। আমি এখানেই থাকছি আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত”।
সীমন্তিনী তার গাড়ির কাছে এসে তার সঙ্গের এক ইনস্পেক্টরকে বলল, “মিঃ বর্মন, আমাদের বাজার পেরিয়ে ওদিকে একটা জায়গায় যেতে হবে। দু’তিন জনকে এসকর্ট করে আনতে হবে এখানে। তাই আমার গাড়িতে শুধু পেছনে দু’জনকে বসতে বলুন। আপনি একটা গাড়িতে আর চার পাঁচ জনকে নিয়ে আমাদের ফলো করুন”।
মিঃ বর্মন ফোর্সের বাকিদের সাথে কথা বলে একটা গাড়িতে উঠে বসল। সীমন্তিনী কিংশুকের নাম্বারে ফোন করল। কিংশুক ফোন ধরেই বলল, “হ্যা দিদিভাই, বল”?
সীমন্তিনী বলল, “ভাই তুমি এখন কোথায় আছ, বাড়িতে”?
কিংশুক জবাব দিল, “না দিদিভাই, ঠিক বাড়িতে নয়। তবে বাড়ির কাছাকাছিই আছি। একটা জিনিস নিতে এসেছি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আর মা বাবা কি বাড়িতেই আছেন”?
কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই, তারা বাড়িতেই আছেন। কেন বল তো”?
সীমন্তিনী নিজের গলাকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করে বলল, “ভাই শোন, তুমি এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাও। বাবা আর মাকে পোশাক পড়ে তৈরী হতে বল। তুমিও তৈরী হয়ে নিও। তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি এক্ষুনি একটা জায়গায় যাব। আমি দশ মিনিটের ভেতর বাড়ি আসছি। এসে সব কথা বলছি” বলেই কিংশুককে আর কোন প্রশ্ন করবার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল।
______________________________