28-02-2020, 09:00 PM
(Update No. 79)
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ পরিতোষের গাড়িটা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। এ রেস্টুরেন্টের বয় বেয়ারা সিকিউরিটি গার্ড থেকে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আর মালিক পর্যন্ত সবাই পরিতোষকে খুব ভাল ভাবে চেনে। প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শনি, পরিতোষ এখানে রোজ দুপুরে লাঞ্চ করতে আসে। আর সপ্তাহে তিন চার দিন সে এ রেস্টুরেন্টে ডিনারও করে। একা মানুষ সে। সকাল ন’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে। তাই দুপুরের রান্না করবার মত সময় হাতে পায় না সে। আর সারাদিন থানায় এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় অন ডিউটি ঘুরে ঘুরে রাতে ফাঁকা ঘরে ফিরে এসে বেশীর ভাগ দিনই তার আর হাত পুড়িয়ে রান্না বান্না করতে ইচ্ছে করে না। রেস্টুরেন্টটা তার বাড়ি আর থানা দু’জায়গা থেকেই প্রায় সমান দুরত্বে। তাই সে এ রেস্টুরেন্টের নিয়মিত কাস্টমার। আর এভাবে রেগুলার যাতায়াতের ফলেই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আর মালিকের সাথে তার প্রায় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আর এখানে সে সবদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। কোন কোন সময় নিজের অবস্থান গোপন করতে সে এ রেস্টুরেন্টে নিজের গাড়িটাকে রেখে রেস্টুরেন্টের পেছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রেস্টুরেন্টের পার্কিং-এ গাড়িটাকে রেখে সে একজন সিকিউরিটি গার্ডের কাছে গিয়ে তাকে গাড়ির চাবিটা দিয়ে বলল, “আমি ডিনার সেরে রাত ন’টা নাগাদ বেরোবো এখান থেকে। গাড়িটাকে এখানে না রেখে সেফ জায়গায় রেখে দিও ভাই। আর চাবিটাকে তোমাদের ম্যানেজারের কাছে রেখে দিও”।
পরিতোষ সিভিল ড্রেসে থাকলেও সিকিউরিটি গার্ডটা চাবিটা হাতে নিয়ে তাকে একটা স্যালিউট ঠুকে বলল, “ঠিক আছে স্যার”।
পরিতোষ রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে একটা ফাঁকা টেবিলে বসতেই একজন ওয়েটার প্রায় ছুটে এল তার কাছে। ওয়েটারটাকে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে সে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে হাতের ঈশারা করতেই চল্লিশ বছর বয়সী ম্যানেজার তার পাশের মেয়েটিকে কিছু একটা বলেই পরিতোষের কাছে চলে এল। পরিতোষ তাকে চেয়ারে বসতে বলে বলল, “দীপুদা, আমার গাড়িটা তোমাদের ভেতরের গ্যারেজে রাখতে বলেছি। চাবিটা তোমার কাউন্টারে রেখ। কফি খেয়ে আমি একটু বেরোবো ব্যাকডোর দিয়ে। রাত ন’টা নাগাদ ফিরব। তারপর ডিনার সেরে গাড়ি নিয়ে যাব। তোমাদের কোন অসুবিধে হবে না তো”?
ম্যানেজার বলল, “না, অসুবিধে কিসের? তোমাকে কি আমরা চিনি না? নিশ্চয়ই কোন সিক্রেট মিশনে যাচ্ছ। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার”।
ওয়েটারটা কফি নিয়ে আসতেই পরিতোষ ম্যানেজারকে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দীপুদা। তবে, এ সময়ের মধ্যে কেউ যদি আমার খোঁজ করতে আসে, তাহলে বোল যে আমি এখানে আসিনি”।
ম্যানেজার পরিতোষকে আশ্বস্ত করে বলল, “ঠিক আছে। আর কিছু”?
পরিতোষ বলল, “আপাততঃ এটুকুই দীপু-দা। ধন্যবাদ”।
কফি শেষ করেই পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে ভেতরের দিকে যেতে যেতে ম্যানেজারকে ঈশারা করল। রেস্টুরেন্টের পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে আসতেই একটা ওয়েটার দৌড়ে এসে কম্পাউণ্ডের পেছন দিকের গেটের তালা খুলে দিল। পরিতোষ পেছনের রাস্তায় এসে এদিক ওদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে একদিকে হেঁটে চলল। প্রায় দশ মিনিট এ গলি ও গলি দিয়ে হেঁটে এসে সে একটা ভাঙাচোরা লোহার গেটে ঠকঠক করল। একটু বাদেই একটা কম বয়সী ছেলে এসে গেটটা খুলে দিতেই পরিতোষ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “প্রবাল এসে গেছে”?
ছেলেটা আবার গেটে তালা লাগাতে লাগাতে জবাব দিল, “হ্যা দাদা, একটু আগেই এসেছে। ভেতরের ঘরে আছে”।
পরিতোষ একটা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। প্রথম ঘরটা পেরিয়ে দ্বিতীয় রুমে ঢুকতেই প্রবাল লাহিড়ী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “গুড ইভিনিং স্যার”।
পরিতোষও তাকে ‘গুড ইভিনিং’ বলে একটা চেয়ারে বসে প্রবালকে জিজ্ঞেস করল, “দিবাকরদের ওখানে কাউকে নিজের আসল নাম ঠিকানা বলিস নি তো”?
প্রবাল বলল, “না না স্যার। ওরা জানে যে ওরা প্রভুদাস লাহিড়ি বলে একজনের কাছ থেকে গাড়িটা কিনেছিল। আপনার ব্লু প্রিন্ট অক্ষরে অক্ষরে ফলো করা হয়েছে। গাড়িটাকে সীজ করতেও কোন অসুবিধে হয়নি। দিবাকর আর বিন্দিয়া কেউই স্বীকার করেনি যে গাড়িটা তারা আমার কাছ থেকে কিনেছিল। আমার ভুয়ো নামটাও তারা মুখে উচ্চারণ করেনি। নকল পুলিশের টিম দিবাকর, বিন্দিয়া আর ওই মহল্লার আরও একজনের সই নিয়ে তাদেরকে সাক্ষী বানিয়ে বেওয়ারিশ চোরাই গাড়ি হিসেবে সেটাকে সীজ করে নিয়েছে। তাই ও গাড়ি নিয়ে দিবাকর আর কিছুই করতে পারবে না। শুধু সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা জলে ভেসে গেছে বলে দুঃখ করা ছাড়া আর কিছুই আর তাদের করার নেই এখন”।
পরিতোষ পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “হু, পরের আপডেটগুলোও আমি পেয়েছি। ভাবনার কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে। তা কাকে কততে কন্ট্রাক্ট করেছিলিস”?
প্রবাল বলল, “স্যার, আপনি তো বলেছিলেন, সব খরচ খরচা মিটিয়ে দিয়ে নেট দু’লাখ আসল জায়গায় দিতে হবে। দিবাকরের কাছ থেকে উসুল করেছিলাম সাড়ে পাঁচ লাখ। এর ভেতর থেকে মঙ্গুর দালালীর কমিশন পঞ্চান্ন হাজার সেখানেই দিয়ে এসেছিলাম ওর হাতে। বাকি সবটাই এখানে জমা দিয়ে গিয়েছি। এখন যার গাড়িটা এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল তাকে পঞ্চাশ দিতে হবে। যে পাঁচ জন রেইড করতে গিয়েছিল তাদের প্রত্যেককে পঁচিশ পঁচিশ করে কন্ট্রাক্ট করেছিলাম। তাই ওদের পাঁচজনকে দিতে হবে এক লাখ পঁচিশ”।
পরিতোষ বলল, “তার মানে পাঁচ লাখ পঞ্চাশের মধ্যে পঞ্চান্ন হাজার তুই দালালটাকে দিয়েছিস। আর এখানে ওই ব্যাগে তুই চার লাখ পচানব্বই হাজার রেখে গেছিস, এই তো? বিট্টু পেছনের ঘরে বসে আছে। ওর কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে আয়, যা”।
প্রবাল সাথে সাথে উঠে চলে গেল। আর একটু বাদেই সেই পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আবার ঘরে এসে দু’জনের মাঝখানের ছোট টেবিলটার ওপর ব্যাগটা রাখতেই পরিতোষ বলল, “বের কর টাকাগুলো”।
প্রবাল বিনা বাক্যব্যয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে টাকাগুলো বের করে টেবিলে রাখতেই পরিতোষ বলল, “এখান থেকে গাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ হাজার আর পাঁচ জনের জন্য এক লাখ পঁচিশ হাজার আলাদা করে রাখ। তাহলে এখানে পড়ে থাকবে তিন লাখ কুড়ি। তুই কত নিবি”?
প্রবাল অবাক গলায় বলল, “এ কী বলছেন স্যার। আপনার নিজের জন্যে একটা কাজ করে দিয়েছি। তার বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে আমি পয়সা নেব? এমনটা আপনি ভাবতে পারলেন? আজ যে কিছু করে কামিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি, এ তো আপনারই দয়ায়। নইলে এতদিনে হয়ত জেলের কয়েদী হয়ে থাকতে হত, নয়ত আপনার মতই কোন এক পুলিশ অফিসারের গুলি খেয়ে মরতে হত আমাকে। আপনি সাহায্য করেছিলেন বলেই না আজ বিয়ে থা করে সংসারী হয়ে ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারছি। আর আপনার আদেশে মাঝে মধ্যেই তো এটা সেটা করে থাকি। কিন্তু তার জন্যেও তো আপনি ভরপুর পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন আমাকে। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে আপনি নিজের প্রমোশন বা অন্য কোনও স্বার্থের খাতিরে এ’সব কাজ করেন না স্যার। আগে যতবার আপনার কাজ করেছি, সে কাজগুলো করে আপনি অন্য কাউকে সাহায্য করতেন জেনেই আমি আমার পারিশ্রমিক নিয়েছি। কিন্তু এটা আপনার নিজের লোকের জন্য করেছেন। তাই এ কাজে আমি কোন পারিশ্রমিক নিতে পারব না স্যার। আপনি আমাকে অমন অনুরোধ করবেন না প্লীজ”।
পরিতোষ বেশ কিছু সময় চুপ করে প্রবালের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “এবারেও আমি ঠিক একই উদ্দেশ্যে এ অপারেশনটা তোদের দিয়ে করালাম রে প্রবাল। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে, এর আগের অপারেশন গুলো যার বা যাদের জন্যে আমি করেছি তাদের সবাইকেই আমি সরাসরি সাহায্য করেছি। হ্যা, অবশ্যই আমাদের দেশের বস্তা পচা আইনের ধারার বাইরে গিয়ে। এবারেও তাই করেছি। কিন্তু এবারের সাহায্যটা আমি সরাসরি করছি না। অন্যান্যবার ভিক্টিমেরা আমার সংস্পর্শে থাকে। কিন্তু এবারে ভিক্টিমের সাথে আমার কখনও মুখোমুখি দেখা হচ্ছে না। আমার খুব বিশ্বাসভাজন আরেকজনের কথায় এটা করতে হয়েছে। বলতে পারিস আমার এক বিশেষ বন্ধুর অনুরোধেই এটা করেছি। কিন্তু তোদের কাছে তো ব্যাপারটা একই। আর নিজের কাজ ছেড়ে আমার মুখের কথায় তোরা এসব করিস বলে আমি তো তোদের ভালবাসা আর শ্রদ্ধার দোহাই দিয়ে তোদের এক্সপ্লয়েট করতে পারব না। তোদের যাতে কোন রকম ক্ষতি না হয়, সেটা তো আমাকেই দেখতে হবে। আর ভাবছিস কেন। আমি কি আর নিজের পকেট থেকে তোদের পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি নাকি? এটাও তো বদমাশগুলোর কাছ থেকেই আদায় করেছিস। আমি তো শুধু মাছের তেলে মাছ ভাঁজছি। নে, এখান থেকে এক লাখ তুই নিয়ে নে। সামনে তোর পয়সার প্রয়োজন পড়বে। তা হ্যারে, প্রণিতা কেমন আছে রে? সময়মত চেকআপ করাচ্ছিস তো? আর ডাক্তার কী বলছে? কবে নাগাদ ডেট এক্সপেক্ট করছে”?
প্রবাল বলল, “হ্যা স্যার, ও ভালই আছে। আর ডাক্তারের কথা মত রেগুলার চেকআপ আর ওষুধ চলছে। ডাক্তার তো বলছে নভেম্বরের ন’ দশ তারিখ নাগাদ”।
পরিতোষ বলল, “ওর প্রতি সব সময় নজর রাখবি। যদি কখনও শুনি যে ওর কোন ব্যাপারে তুই কোন অবহেলা করেছিস, তাহলে জেনে রাখিস, আমার হাতে অবধারিত শাস্তি পাবি। আচ্ছা শোন, এখানে তাহলে আর কত রইল? দু’লাখ কুড়ি হাজার, তাই না? এ টাকাটা এ পলিথিনের ব্যাগটায় ভরে আমাকে দিয়ে দে। আর বাকি গুলো তুই নিয়ে যা। যাকে যা দেবার দিয়ে ওখান থেকে এক লাখ তুই রেখে দিস। আর একটা ছোট্ট কাজ করিস। দিবাকরের গাড়িটা সীজ করবার সময় যে সীজার লিস্টটা বানানো হয়েছিল, সে কাগজটা ওদের কাছ থেকে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে যাবি একসময়। ওটার দরকার পড়তে পারে আবার”।
প্রবাল পলিথিনের ব্যাগে দু’লাখ কুড়ি হাজার টাকা ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “ঠিক আছে স্যার। আমি সেটা কাল বিকেলের মধ্যেই আপনার হাতে দিয়ে যাব। কিন্তু স্যার, আরও কোন ঝামেলা হতে পারে বলে ভাবছেন নাকি আপনি”?
পরিতোষ বলল, “দু’লাখ টাকা দিবাকর আর তার এক পার্টনার মিলে ভিক্টিমের কাছ থেকে লুটে নিয়েছিল। বেআইনি ভাবে টাকাটা আদায় করলাম। এবার আইনি ভাবে দিবাকরকে শাস্তি দেব। বছর খানেকের জন্য জেলের ভাত খেয়ে নিজেকে সংশোধন করবার সুযোগটা তো দেওয়া দরকার। তাই ওর নাম ঠিকানাটা আমার রেকর্ডে রাখা উচিৎ। তবে আমরা ওকে এখনই এরেস্ট করব না। ক’টা দিনের মধ্যে আরেকটা অপারেশন সাকসেসফুলি শেষ করতে পারলে দুই আসামীকে একসাথে এরেস্ট করব। আচ্ছা তুই এবার যা। পরে তোর সাথে যোগাযোগ করব আমি”।
প্রবাল চলে যাবার পর পরিতোষ কম বয়সী ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “মাকে দেখতে গিয়েছিলিস আজ বিট্টু? কেমন আছেন তিনি”?
বিট্টু বলল, “হ্যা দাদা, দু’বেলাই গিয়েছিলাম। ডাক্তারের সাথেও কথা বলেছি। ডাক্তার বলল কাল হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেবে। কিন্তু হসপিটালের বিল হয়েছে প্রায় পনের হাজার টাকা। বিলটা পেমেন্ট করতে না পারলে মাকে রিলিজ করিয়ে আনব কি করে, সেটাই তো বুঝতে পাচ্ছি না”।
পরিতোষ পলিথিনের ব্যাগটা খুলে কুড়ি হাজার টাকার প্যাকেটটা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, “এটা নে। এখানে কুড়ি হাজার আছে। হসপিটালের বিল দিয়ে বাকিটা তোর কাছে রেখে দিস। আর যদি আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে, তাহলে আমাকে ফোন করিস”।
বিট্টু টাকাটা হাতে নিয়ে বলল, “আপনার কাছ থেকে আর কত নেব দাদা? কিন্তু হাত পেতে না নিয়ে তো আর কোন উপায়ও নেই। একটা কাজ টাজ না পেলে এভাবে আর কতদিন চলতে পারব জানিনা”।
পরিতোষ বলল, “শোন বিট্টু, তোকে তো আমি আগেও বলেছি। সরকারি চাকরি চাইলেই কি আর পাওয়া যায়রে ভাই? আমি তো খোঁজ খবর রাখছি। তুইও তো চেষ্টা করে যাচ্ছিস। তবু বলছি, আপাততঃ একটা প্রাইভেট ফার্মে ঢুকে পড়। সরকারী চাকরি পেলে না হয় ছেড়ে দিস তখন। আমার জানাশোনা কোন একটা জায়গায় আমি তোকে ঠিক ঢুকিয়ে দিতে পারব। মাসের শেষে দশ পনের হাজার মাইনে তো অন্ততঃ পাবি। সেটাই কি একেবারে ফ্যালনা কিছু? একেবারে কিছু না করে বসে থাকার চাইতে তো ভাল। আর বেকার বসে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে ফ্রাস্টেশনে ভুগতে শুরু করবি। মাথায় উল্টোপাল্টা চিন্তা আসতে শুরু করবে। তার চেয়ে কিছু একটা করতে থাকা অনেক ভাল”।
বিট্টু বলল, “ঠিক আছে দাদা। আর ক’টা দিন অপেক্ষা করে দেখি। আর মাস দেড়েকের মধ্যে দুটো পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। তাতে যদি আমার নাম না থাকে, তাহলে তোমার কথা মতই কিছু একটা করতে শুরু করব”।
পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পলিথিনের প্যাকেটটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “চল। আমার সাথে আজ ডিনার করবি”।
বিট্টু বলল, “কোথায়? তোমার বাড়ি? না দাদা, এখন আর অতদুর যেতে ইচ্ছে করছে না গো। ঘরেই কিছু একটা বানিয়ে নেব’খন”।
পরিতোষ বলল, “আমার বাড়িতে কে খেতে দেবে তোকে? আমি রেস্টুরেন্টে খাব আজ। তুইও চল। সে জায়গাটা তো তোর বাড়ি থেকে আর বেশী দুর নয়। চল চল, আর কথা বলে সময় নষ্ট করিস না”।
***************
রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বিট্টুকে বিদেয় দিয়ে পরিতোষ নিজের গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ড্রেস পাল্টে হাত মুখ ধুয়েই সে সীমন্তিনীকে ফোন করল, “কি মুন ডার্লিং, ভাল আছ তো”?
ও’পাশ থেকে সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যা পরিতোষ, ভালই আছি। তুমি কেমন আছ”?
পরিতোষ বলল, “আমি তো অ্যাজ ইউজুয়াল আছি। কিন্তু আই এম সরি টু সে ডার্লিং। তোমাকে একটা খুব রিস্কি অ্যাসাইনমেন্ট অ্যালট করা হচ্ছে। এটা ভেতরের খবর। অবশ্য কফিডেনশিয়াল চিঠিটা আজ লাস্ট আওয়ার অব্দি পাঠানো হয়নি। বাট আই নো। ইউ উইল ডেফিনিটলি কমপ্লিট দা অ্যাসাইনমেন্ট কোয়াইট এফিসিয়েন্টলি। কিন্তু তবু বলছি, সব সময় এলার্ট থেক”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তা অ্যাসাইনমেন্টটা কী, সেটা বলবে তো”।
পরিতোষ জবাব দিল, “সেটা আমি না বললেও তুমি কাল দুপুরের আগেই জেনে যাবে। ডিপার্টমেন্টাল অর্ডার ডিপার্টমেন্ট থেকে জানাই ভাল। আমি শুধু একটু প্রয়োজনীয় অ্যাডভাইস দিচ্ছি তোমাকে। ডুয়ার্সের একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে তোমাকে একটা ইনভেস্টিগেটিভ অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হচ্ছে। কোন অপারেশন করবার অর্ডার না থাকলেও তুমি জানই, যে কোন মোমেন্টে তোমার ওপর হামলা হতে পারে। অবশ্য ফুল ফোর্স নিয়ে যাবার সুযোগ তুমি পাচ্ছ। কাজটা তুমি খুব ভাল ভাবেই করতে পারবে, তাতে আমার কোনও সন্দেহই নেই। হায়দ্রাবাদ ট্রেনিং-এ তার নমুনা তুমি দেখিয়েছিলে। আই রিমেম্বার দ্যাট। কিন্তু তা সত্বেও তোমাকে সতর্ক করে দেওয়াটা উচিৎ বলে মনে হল আমার”।
সীমন্তিনী বলল, “পরিতোষ আমি তো গত চার মাস ধরে নর্থ ডুয়ার্সেই তো আছি। এতদিনে এ জায়গা সম্বন্ধে মোটামুটি জেনেই গেছি। তুমি ও নিয়ে ভেব না”।
পরিতোষ বলল, “সে তো জানি মুন ডার্লিং। কিন্তু তুমি এখন আছ ভূটান বর্ডারে। কিন্তু এ নুতন অর্ডারে তোমাকে আরো খানিকটা পশ্চিম দিকে দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্টের বর্ডারে যেতে হবে। আসাম আর উত্তরবঙ্গের অনেকগুলো জঙ্গী গোষ্ঠী ও’সব এলাকায় গোপন ঘাঁটি গেঁড়ে কী ধরণের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে আশা করি তোমার ধারণা আছে। তবে আগে থেকেই আইবির লোকেরা সেখানে আছে। তারা তোমায় রিপোর্টটা বানাতে যথেষ্ট সাহায্য করবে। আপাততঃ তোমাকে একটা অ্যাকশন প্ল্যান ফর্মুলেট করে হেড কোয়ার্টারে পাঠাতে হবে। আর শোন, ওখানে মিস্টার দেবাশীষ বক্সী বলে আইবির এক সিনিয়র অফিসারকে পাবে তুমি। আমার বিশেষ পরিচিত। তার হেল্প নেবে। আমি অলরেডি তার সাথে কথা বলেছি। আর তুমি সেখানে কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছ, তাও বলে দিয়েছি। আর উনিও তোমাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাতে তোমার পরিশ্রম অর্ধেকটা কমে যাবে”।
সীমন্তিনী সব শুনে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ পরিতোষ। এতদুরে থেকেও তুমি যে আমার জন্যে এতটা ভাবছ, তাতে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে”।
পরিতোষের মুখে ম্লান একটা হাঁসি ফুটে উঠল। সে বলল, “ভাবার মত আমার জীবনে আর যে কিছু নেই মুন ডার্লিং” বলেই নিজেকে সামলে নিয়ে সীমন্তিনী কিছু বলে ওঠার আগেই বলল, “আর শোন, একটা সুখবর আছে। আমাদের টার্গেট টুর অপারেশন শেষ হয়েছে। ওই দিবাকর হারামজাদা তোমার দাদাভাইয়ের এক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছিল। তার কাছ থেকে আমি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে নিয়েছি। তবে যাদের মাধ্যমে অপারেশনটা করিয়েছি, তাদের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে তোমার দাদাভাইয়ের জন্য দু’লাখ টাকা আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। এবার তুমি বল, টাকাটা কি তোমার দাদাভাইয়ের হাতে দেব, না তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব”?
সীমন্তিনী উল্লসিত কন্ঠে বলল, “কী বলছ পরিতোষ তুমি! এরই মধ্যে তোমার অপারেশন শেষ করে ফেললে? দিবাকর কি তাহলে এখন লকআপে আছে”?
পরিতোষ বলল, “না মুন ডার্লিং। তুমি তো জানোই, এটা ধরাবাঁধা আইনি পদ্ধতিতে হয়নি। আর কাজটায় পুলিশের কেউই ছিল না। তবে হ্যা, পুলিশের লক আপেও তাকে যেতে হবেই। সে আটঘাটও বাঁধছি আমি। টার্গেট ওয়ানের গ্রাউণ্ড প্রিপারেশন কমপ্লিট হয়ে গেছে। টার্গেট ওয়ানের অপারেশনটা দুটো ফেজে কমপ্লিট হবে। ফার্স্ট ফেজের কাজও শুরু হয়ে গেছে। সেকেণ্ড ফেজটা কমপ্লিট হবার পর দিবাকর আর রবিশঙ্করকে একসঙ্গে অ্যারেস্ট করা হবে। কলকাতার অন্ততঃ চারটে থানায় জালিয়াতী আর জোচ্চুরির অনেকগুলো মামলায় ওদের দু’জনকে ফাঁসানো হবে, যাতে সব গুলো মিলে অন্ততঃ চার পাঁচ বছরের জন্য শয়তান দুটোকে জেলে পাঠানো যায়। তবে সে’সব নিয়ে তোমাকে টেনশন নিতে হবে না। তুমি শুধু আপাততঃ আমাকে এটুকু বল, আমি ওই টাকাটা কাকে কিভাবে দেব”।
সীমন্তিনী এবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “পরিতোষ, ওটা আপাততঃ তুমি তোমার কাছেই রেখে দাও। মানে, তুমি এমন আচমকা খবরটা দিলে যে আমি এ মূহুর্তে ঠিক কী করা উচিৎ, সেটা ভাবতেই পাচ্ছি না। তুমি আমাকে দুটো দিন ভাবতে দাও প্লীজ। আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভেবে দেখতে দাও। তারপর তোমাকে জানাচ্ছি”।
পরিতোষ বলল, “ওকে, ফাইন ডার্লিং। তবে তুমি তো জানোই ডার্লিং, একজন পুলিশ অফিসারের ঘরে দু’লাখ টাকা আছে, ব্যাপারটা যদি কোনভাবে এসিবিতে গিয়ে পৌঁছয় তবে কী হতে পারে। তবে নিজেকে বাঁচিয়ে এসব করার রেকর্ড আমার আগেও আছে। আমি সামলে নেব। তাহলে আর নতুন কিছু খবর আছে আমাকে জানাবার? তোমার দাদাভাই এ টাকাটা পেলেই তো তার কাজ শুরু করতে পারবেন। এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছ কি? আর তোমার দাদাভাইই বা কি ভাবছেন”?
সীমন্তিনী বলল, “একটা খবরই আছে শুধু তোমাকে দেবার মত। বিল্ডার বিমল আগরওয়ালার এক বন্ধুর নাকি দক্ষিণ কলকাতায় কোথাও একটা যোগা ট্রেনিং সেন্টার আছে। বিমল আগরওয়ালা দাদাভাইকে বলেছে সে ওই ট্রেনিং সেন্টারে দাদাভাইকে ট্রেনার হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে পারবে। মাসে মাসে নাকি কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের মত স্যালারি পাবে সেখানে। দাদাভাই আমার পরামর্শ চাইছিল। আমি ওকে বলেছি একদিন নিজে গিয়ে ওই সেন্টারটা দেখে আসুক আর তার মালিকের সাথে কথাবার্তা বলে দেখুক। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আমি তো ভাবছিলাম, তোমাকে ওই সেন্টারটার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিতে বলব। কিন্তু তোমার কাজের বোঝা কি আর কম কিছু? আর আগে থেকেই তুমি আমার কথায় চারটে টার্গেট নিয়ে ডিল করছ। এর ওপর আরেকটা ঝামেলা তোমাকে দিতে কিছুটা সঙ্কোচ হচ্ছিল। তাই দাদাভাইকেই বলেছি সে নিজে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি যাচাই করে দেখুক”।
পরিতোষ হঠাৎ প্রশ্ন করল, “আচ্ছা ডার্লিং, বিমল আগরওয়ালা তোমার দাদাভাইকে কাজ পাইয়ে দেবার ব্যাপারে এতটা অগ্রণী ভূমিকা নিতে চাইছে কেন, সে ব্যাপারে কি কোনও ধারণা আছে তোমার”?
সীমন্তিনী বলল, “সে প্রশ্নটা তো আমার মনেও উঠেছিল পরিতোষ। আর দাদাভাই নিজেও বিমলকে একই প্রশ্ন করেছিল। বিমল তাকে বলেছে যে রবিশঙ্কর অন্য একটা লোককে তার পরিচয় দিয়ে দাদাভাইয়ের সর্বনাশ করেছে বলেই সে নাকি আন্তরিক ভাবে খুব অনুতপ্ত। তাই সে দাদাভাইকে সাহায্য করতে চাইছে। কথাটা আমার কাছে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। লোকটা নিজে কলকাতার বেশ নামকরা একজন বিল্ডার এবং প্রোমোটার। তার উদ্দেশ্য যদি এতটাই সৎ হবে তাহলে সে চাইলে তো অন্যভাবেও দাদাভাইকে সাহায্য করতে পারত। তার আরেকবন্ধুর ওখানে সে দাদাভাইকে নিয়ে যেতে চাইছে কেন”?
______________________________
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ পরিতোষের গাড়িটা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। এ রেস্টুরেন্টের বয় বেয়ারা সিকিউরিটি গার্ড থেকে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আর মালিক পর্যন্ত সবাই পরিতোষকে খুব ভাল ভাবে চেনে। প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শনি, পরিতোষ এখানে রোজ দুপুরে লাঞ্চ করতে আসে। আর সপ্তাহে তিন চার দিন সে এ রেস্টুরেন্টে ডিনারও করে। একা মানুষ সে। সকাল ন’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে। তাই দুপুরের রান্না করবার মত সময় হাতে পায় না সে। আর সারাদিন থানায় এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় অন ডিউটি ঘুরে ঘুরে রাতে ফাঁকা ঘরে ফিরে এসে বেশীর ভাগ দিনই তার আর হাত পুড়িয়ে রান্না বান্না করতে ইচ্ছে করে না। রেস্টুরেন্টটা তার বাড়ি আর থানা দু’জায়গা থেকেই প্রায় সমান দুরত্বে। তাই সে এ রেস্টুরেন্টের নিয়মিত কাস্টমার। আর এভাবে রেগুলার যাতায়াতের ফলেই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আর মালিকের সাথে তার প্রায় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আর এখানে সে সবদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। কোন কোন সময় নিজের অবস্থান গোপন করতে সে এ রেস্টুরেন্টে নিজের গাড়িটাকে রেখে রেস্টুরেন্টের পেছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রেস্টুরেন্টের পার্কিং-এ গাড়িটাকে রেখে সে একজন সিকিউরিটি গার্ডের কাছে গিয়ে তাকে গাড়ির চাবিটা দিয়ে বলল, “আমি ডিনার সেরে রাত ন’টা নাগাদ বেরোবো এখান থেকে। গাড়িটাকে এখানে না রেখে সেফ জায়গায় রেখে দিও ভাই। আর চাবিটাকে তোমাদের ম্যানেজারের কাছে রেখে দিও”।
পরিতোষ সিভিল ড্রেসে থাকলেও সিকিউরিটি গার্ডটা চাবিটা হাতে নিয়ে তাকে একটা স্যালিউট ঠুকে বলল, “ঠিক আছে স্যার”।
পরিতোষ রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে একটা ফাঁকা টেবিলে বসতেই একজন ওয়েটার প্রায় ছুটে এল তার কাছে। ওয়েটারটাকে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে সে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে হাতের ঈশারা করতেই চল্লিশ বছর বয়সী ম্যানেজার তার পাশের মেয়েটিকে কিছু একটা বলেই পরিতোষের কাছে চলে এল। পরিতোষ তাকে চেয়ারে বসতে বলে বলল, “দীপুদা, আমার গাড়িটা তোমাদের ভেতরের গ্যারেজে রাখতে বলেছি। চাবিটা তোমার কাউন্টারে রেখ। কফি খেয়ে আমি একটু বেরোবো ব্যাকডোর দিয়ে। রাত ন’টা নাগাদ ফিরব। তারপর ডিনার সেরে গাড়ি নিয়ে যাব। তোমাদের কোন অসুবিধে হবে না তো”?
ম্যানেজার বলল, “না, অসুবিধে কিসের? তোমাকে কি আমরা চিনি না? নিশ্চয়ই কোন সিক্রেট মিশনে যাচ্ছ। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার”।
ওয়েটারটা কফি নিয়ে আসতেই পরিতোষ ম্যানেজারকে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দীপুদা। তবে, এ সময়ের মধ্যে কেউ যদি আমার খোঁজ করতে আসে, তাহলে বোল যে আমি এখানে আসিনি”।
ম্যানেজার পরিতোষকে আশ্বস্ত করে বলল, “ঠিক আছে। আর কিছু”?
পরিতোষ বলল, “আপাততঃ এটুকুই দীপু-দা। ধন্যবাদ”।
কফি শেষ করেই পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে ভেতরের দিকে যেতে যেতে ম্যানেজারকে ঈশারা করল। রেস্টুরেন্টের পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে আসতেই একটা ওয়েটার দৌড়ে এসে কম্পাউণ্ডের পেছন দিকের গেটের তালা খুলে দিল। পরিতোষ পেছনের রাস্তায় এসে এদিক ওদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে একদিকে হেঁটে চলল। প্রায় দশ মিনিট এ গলি ও গলি দিয়ে হেঁটে এসে সে একটা ভাঙাচোরা লোহার গেটে ঠকঠক করল। একটু বাদেই একটা কম বয়সী ছেলে এসে গেটটা খুলে দিতেই পরিতোষ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “প্রবাল এসে গেছে”?
ছেলেটা আবার গেটে তালা লাগাতে লাগাতে জবাব দিল, “হ্যা দাদা, একটু আগেই এসেছে। ভেতরের ঘরে আছে”।
পরিতোষ একটা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। প্রথম ঘরটা পেরিয়ে দ্বিতীয় রুমে ঢুকতেই প্রবাল লাহিড়ী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “গুড ইভিনিং স্যার”।
পরিতোষও তাকে ‘গুড ইভিনিং’ বলে একটা চেয়ারে বসে প্রবালকে জিজ্ঞেস করল, “দিবাকরদের ওখানে কাউকে নিজের আসল নাম ঠিকানা বলিস নি তো”?
প্রবাল বলল, “না না স্যার। ওরা জানে যে ওরা প্রভুদাস লাহিড়ি বলে একজনের কাছ থেকে গাড়িটা কিনেছিল। আপনার ব্লু প্রিন্ট অক্ষরে অক্ষরে ফলো করা হয়েছে। গাড়িটাকে সীজ করতেও কোন অসুবিধে হয়নি। দিবাকর আর বিন্দিয়া কেউই স্বীকার করেনি যে গাড়িটা তারা আমার কাছ থেকে কিনেছিল। আমার ভুয়ো নামটাও তারা মুখে উচ্চারণ করেনি। নকল পুলিশের টিম দিবাকর, বিন্দিয়া আর ওই মহল্লার আরও একজনের সই নিয়ে তাদেরকে সাক্ষী বানিয়ে বেওয়ারিশ চোরাই গাড়ি হিসেবে সেটাকে সীজ করে নিয়েছে। তাই ও গাড়ি নিয়ে দিবাকর আর কিছুই করতে পারবে না। শুধু সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা জলে ভেসে গেছে বলে দুঃখ করা ছাড়া আর কিছুই আর তাদের করার নেই এখন”।
পরিতোষ পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “হু, পরের আপডেটগুলোও আমি পেয়েছি। ভাবনার কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে। তা কাকে কততে কন্ট্রাক্ট করেছিলিস”?
প্রবাল বলল, “স্যার, আপনি তো বলেছিলেন, সব খরচ খরচা মিটিয়ে দিয়ে নেট দু’লাখ আসল জায়গায় দিতে হবে। দিবাকরের কাছ থেকে উসুল করেছিলাম সাড়ে পাঁচ লাখ। এর ভেতর থেকে মঙ্গুর দালালীর কমিশন পঞ্চান্ন হাজার সেখানেই দিয়ে এসেছিলাম ওর হাতে। বাকি সবটাই এখানে জমা দিয়ে গিয়েছি। এখন যার গাড়িটা এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল তাকে পঞ্চাশ দিতে হবে। যে পাঁচ জন রেইড করতে গিয়েছিল তাদের প্রত্যেককে পঁচিশ পঁচিশ করে কন্ট্রাক্ট করেছিলাম। তাই ওদের পাঁচজনকে দিতে হবে এক লাখ পঁচিশ”।
পরিতোষ বলল, “তার মানে পাঁচ লাখ পঞ্চাশের মধ্যে পঞ্চান্ন হাজার তুই দালালটাকে দিয়েছিস। আর এখানে ওই ব্যাগে তুই চার লাখ পচানব্বই হাজার রেখে গেছিস, এই তো? বিট্টু পেছনের ঘরে বসে আছে। ওর কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে আয়, যা”।
প্রবাল সাথে সাথে উঠে চলে গেল। আর একটু বাদেই সেই পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আবার ঘরে এসে দু’জনের মাঝখানের ছোট টেবিলটার ওপর ব্যাগটা রাখতেই পরিতোষ বলল, “বের কর টাকাগুলো”।
প্রবাল বিনা বাক্যব্যয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে টাকাগুলো বের করে টেবিলে রাখতেই পরিতোষ বলল, “এখান থেকে গাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ হাজার আর পাঁচ জনের জন্য এক লাখ পঁচিশ হাজার আলাদা করে রাখ। তাহলে এখানে পড়ে থাকবে তিন লাখ কুড়ি। তুই কত নিবি”?
প্রবাল অবাক গলায় বলল, “এ কী বলছেন স্যার। আপনার নিজের জন্যে একটা কাজ করে দিয়েছি। তার বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে আমি পয়সা নেব? এমনটা আপনি ভাবতে পারলেন? আজ যে কিছু করে কামিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি, এ তো আপনারই দয়ায়। নইলে এতদিনে হয়ত জেলের কয়েদী হয়ে থাকতে হত, নয়ত আপনার মতই কোন এক পুলিশ অফিসারের গুলি খেয়ে মরতে হত আমাকে। আপনি সাহায্য করেছিলেন বলেই না আজ বিয়ে থা করে সংসারী হয়ে ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারছি। আর আপনার আদেশে মাঝে মধ্যেই তো এটা সেটা করে থাকি। কিন্তু তার জন্যেও তো আপনি ভরপুর পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন আমাকে। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে আপনি নিজের প্রমোশন বা অন্য কোনও স্বার্থের খাতিরে এ’সব কাজ করেন না স্যার। আগে যতবার আপনার কাজ করেছি, সে কাজগুলো করে আপনি অন্য কাউকে সাহায্য করতেন জেনেই আমি আমার পারিশ্রমিক নিয়েছি। কিন্তু এটা আপনার নিজের লোকের জন্য করেছেন। তাই এ কাজে আমি কোন পারিশ্রমিক নিতে পারব না স্যার। আপনি আমাকে অমন অনুরোধ করবেন না প্লীজ”।
পরিতোষ বেশ কিছু সময় চুপ করে প্রবালের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “এবারেও আমি ঠিক একই উদ্দেশ্যে এ অপারেশনটা তোদের দিয়ে করালাম রে প্রবাল। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে, এর আগের অপারেশন গুলো যার বা যাদের জন্যে আমি করেছি তাদের সবাইকেই আমি সরাসরি সাহায্য করেছি। হ্যা, অবশ্যই আমাদের দেশের বস্তা পচা আইনের ধারার বাইরে গিয়ে। এবারেও তাই করেছি। কিন্তু এবারের সাহায্যটা আমি সরাসরি করছি না। অন্যান্যবার ভিক্টিমেরা আমার সংস্পর্শে থাকে। কিন্তু এবারে ভিক্টিমের সাথে আমার কখনও মুখোমুখি দেখা হচ্ছে না। আমার খুব বিশ্বাসভাজন আরেকজনের কথায় এটা করতে হয়েছে। বলতে পারিস আমার এক বিশেষ বন্ধুর অনুরোধেই এটা করেছি। কিন্তু তোদের কাছে তো ব্যাপারটা একই। আর নিজের কাজ ছেড়ে আমার মুখের কথায় তোরা এসব করিস বলে আমি তো তোদের ভালবাসা আর শ্রদ্ধার দোহাই দিয়ে তোদের এক্সপ্লয়েট করতে পারব না। তোদের যাতে কোন রকম ক্ষতি না হয়, সেটা তো আমাকেই দেখতে হবে। আর ভাবছিস কেন। আমি কি আর নিজের পকেট থেকে তোদের পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি নাকি? এটাও তো বদমাশগুলোর কাছ থেকেই আদায় করেছিস। আমি তো শুধু মাছের তেলে মাছ ভাঁজছি। নে, এখান থেকে এক লাখ তুই নিয়ে নে। সামনে তোর পয়সার প্রয়োজন পড়বে। তা হ্যারে, প্রণিতা কেমন আছে রে? সময়মত চেকআপ করাচ্ছিস তো? আর ডাক্তার কী বলছে? কবে নাগাদ ডেট এক্সপেক্ট করছে”?
প্রবাল বলল, “হ্যা স্যার, ও ভালই আছে। আর ডাক্তারের কথা মত রেগুলার চেকআপ আর ওষুধ চলছে। ডাক্তার তো বলছে নভেম্বরের ন’ দশ তারিখ নাগাদ”।
পরিতোষ বলল, “ওর প্রতি সব সময় নজর রাখবি। যদি কখনও শুনি যে ওর কোন ব্যাপারে তুই কোন অবহেলা করেছিস, তাহলে জেনে রাখিস, আমার হাতে অবধারিত শাস্তি পাবি। আচ্ছা শোন, এখানে তাহলে আর কত রইল? দু’লাখ কুড়ি হাজার, তাই না? এ টাকাটা এ পলিথিনের ব্যাগটায় ভরে আমাকে দিয়ে দে। আর বাকি গুলো তুই নিয়ে যা। যাকে যা দেবার দিয়ে ওখান থেকে এক লাখ তুই রেখে দিস। আর একটা ছোট্ট কাজ করিস। দিবাকরের গাড়িটা সীজ করবার সময় যে সীজার লিস্টটা বানানো হয়েছিল, সে কাগজটা ওদের কাছ থেকে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে যাবি একসময়। ওটার দরকার পড়তে পারে আবার”।
প্রবাল পলিথিনের ব্যাগে দু’লাখ কুড়ি হাজার টাকা ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “ঠিক আছে স্যার। আমি সেটা কাল বিকেলের মধ্যেই আপনার হাতে দিয়ে যাব। কিন্তু স্যার, আরও কোন ঝামেলা হতে পারে বলে ভাবছেন নাকি আপনি”?
পরিতোষ বলল, “দু’লাখ টাকা দিবাকর আর তার এক পার্টনার মিলে ভিক্টিমের কাছ থেকে লুটে নিয়েছিল। বেআইনি ভাবে টাকাটা আদায় করলাম। এবার আইনি ভাবে দিবাকরকে শাস্তি দেব। বছর খানেকের জন্য জেলের ভাত খেয়ে নিজেকে সংশোধন করবার সুযোগটা তো দেওয়া দরকার। তাই ওর নাম ঠিকানাটা আমার রেকর্ডে রাখা উচিৎ। তবে আমরা ওকে এখনই এরেস্ট করব না। ক’টা দিনের মধ্যে আরেকটা অপারেশন সাকসেসফুলি শেষ করতে পারলে দুই আসামীকে একসাথে এরেস্ট করব। আচ্ছা তুই এবার যা। পরে তোর সাথে যোগাযোগ করব আমি”।
প্রবাল চলে যাবার পর পরিতোষ কম বয়সী ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “মাকে দেখতে গিয়েছিলিস আজ বিট্টু? কেমন আছেন তিনি”?
বিট্টু বলল, “হ্যা দাদা, দু’বেলাই গিয়েছিলাম। ডাক্তারের সাথেও কথা বলেছি। ডাক্তার বলল কাল হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেবে। কিন্তু হসপিটালের বিল হয়েছে প্রায় পনের হাজার টাকা। বিলটা পেমেন্ট করতে না পারলে মাকে রিলিজ করিয়ে আনব কি করে, সেটাই তো বুঝতে পাচ্ছি না”।
পরিতোষ পলিথিনের ব্যাগটা খুলে কুড়ি হাজার টাকার প্যাকেটটা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, “এটা নে। এখানে কুড়ি হাজার আছে। হসপিটালের বিল দিয়ে বাকিটা তোর কাছে রেখে দিস। আর যদি আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে, তাহলে আমাকে ফোন করিস”।
বিট্টু টাকাটা হাতে নিয়ে বলল, “আপনার কাছ থেকে আর কত নেব দাদা? কিন্তু হাত পেতে না নিয়ে তো আর কোন উপায়ও নেই। একটা কাজ টাজ না পেলে এভাবে আর কতদিন চলতে পারব জানিনা”।
পরিতোষ বলল, “শোন বিট্টু, তোকে তো আমি আগেও বলেছি। সরকারি চাকরি চাইলেই কি আর পাওয়া যায়রে ভাই? আমি তো খোঁজ খবর রাখছি। তুইও তো চেষ্টা করে যাচ্ছিস। তবু বলছি, আপাততঃ একটা প্রাইভেট ফার্মে ঢুকে পড়। সরকারী চাকরি পেলে না হয় ছেড়ে দিস তখন। আমার জানাশোনা কোন একটা জায়গায় আমি তোকে ঠিক ঢুকিয়ে দিতে পারব। মাসের শেষে দশ পনের হাজার মাইনে তো অন্ততঃ পাবি। সেটাই কি একেবারে ফ্যালনা কিছু? একেবারে কিছু না করে বসে থাকার চাইতে তো ভাল। আর বেকার বসে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে ফ্রাস্টেশনে ভুগতে শুরু করবি। মাথায় উল্টোপাল্টা চিন্তা আসতে শুরু করবে। তার চেয়ে কিছু একটা করতে থাকা অনেক ভাল”।
বিট্টু বলল, “ঠিক আছে দাদা। আর ক’টা দিন অপেক্ষা করে দেখি। আর মাস দেড়েকের মধ্যে দুটো পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। তাতে যদি আমার নাম না থাকে, তাহলে তোমার কথা মতই কিছু একটা করতে শুরু করব”।
পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পলিথিনের প্যাকেটটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “চল। আমার সাথে আজ ডিনার করবি”।
বিট্টু বলল, “কোথায়? তোমার বাড়ি? না দাদা, এখন আর অতদুর যেতে ইচ্ছে করছে না গো। ঘরেই কিছু একটা বানিয়ে নেব’খন”।
পরিতোষ বলল, “আমার বাড়িতে কে খেতে দেবে তোকে? আমি রেস্টুরেন্টে খাব আজ। তুইও চল। সে জায়গাটা তো তোর বাড়ি থেকে আর বেশী দুর নয়। চল চল, আর কথা বলে সময় নষ্ট করিস না”।
***************
রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বিট্টুকে বিদেয় দিয়ে পরিতোষ নিজের গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ড্রেস পাল্টে হাত মুখ ধুয়েই সে সীমন্তিনীকে ফোন করল, “কি মুন ডার্লিং, ভাল আছ তো”?
ও’পাশ থেকে সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যা পরিতোষ, ভালই আছি। তুমি কেমন আছ”?
পরিতোষ বলল, “আমি তো অ্যাজ ইউজুয়াল আছি। কিন্তু আই এম সরি টু সে ডার্লিং। তোমাকে একটা খুব রিস্কি অ্যাসাইনমেন্ট অ্যালট করা হচ্ছে। এটা ভেতরের খবর। অবশ্য কফিডেনশিয়াল চিঠিটা আজ লাস্ট আওয়ার অব্দি পাঠানো হয়নি। বাট আই নো। ইউ উইল ডেফিনিটলি কমপ্লিট দা অ্যাসাইনমেন্ট কোয়াইট এফিসিয়েন্টলি। কিন্তু তবু বলছি, সব সময় এলার্ট থেক”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তা অ্যাসাইনমেন্টটা কী, সেটা বলবে তো”।
পরিতোষ জবাব দিল, “সেটা আমি না বললেও তুমি কাল দুপুরের আগেই জেনে যাবে। ডিপার্টমেন্টাল অর্ডার ডিপার্টমেন্ট থেকে জানাই ভাল। আমি শুধু একটু প্রয়োজনীয় অ্যাডভাইস দিচ্ছি তোমাকে। ডুয়ার্সের একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে তোমাকে একটা ইনভেস্টিগেটিভ অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হচ্ছে। কোন অপারেশন করবার অর্ডার না থাকলেও তুমি জানই, যে কোন মোমেন্টে তোমার ওপর হামলা হতে পারে। অবশ্য ফুল ফোর্স নিয়ে যাবার সুযোগ তুমি পাচ্ছ। কাজটা তুমি খুব ভাল ভাবেই করতে পারবে, তাতে আমার কোনও সন্দেহই নেই। হায়দ্রাবাদ ট্রেনিং-এ তার নমুনা তুমি দেখিয়েছিলে। আই রিমেম্বার দ্যাট। কিন্তু তা সত্বেও তোমাকে সতর্ক করে দেওয়াটা উচিৎ বলে মনে হল আমার”।
সীমন্তিনী বলল, “পরিতোষ আমি তো গত চার মাস ধরে নর্থ ডুয়ার্সেই তো আছি। এতদিনে এ জায়গা সম্বন্ধে মোটামুটি জেনেই গেছি। তুমি ও নিয়ে ভেব না”।
পরিতোষ বলল, “সে তো জানি মুন ডার্লিং। কিন্তু তুমি এখন আছ ভূটান বর্ডারে। কিন্তু এ নুতন অর্ডারে তোমাকে আরো খানিকটা পশ্চিম দিকে দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্টের বর্ডারে যেতে হবে। আসাম আর উত্তরবঙ্গের অনেকগুলো জঙ্গী গোষ্ঠী ও’সব এলাকায় গোপন ঘাঁটি গেঁড়ে কী ধরণের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে আশা করি তোমার ধারণা আছে। তবে আগে থেকেই আইবির লোকেরা সেখানে আছে। তারা তোমায় রিপোর্টটা বানাতে যথেষ্ট সাহায্য করবে। আপাততঃ তোমাকে একটা অ্যাকশন প্ল্যান ফর্মুলেট করে হেড কোয়ার্টারে পাঠাতে হবে। আর শোন, ওখানে মিস্টার দেবাশীষ বক্সী বলে আইবির এক সিনিয়র অফিসারকে পাবে তুমি। আমার বিশেষ পরিচিত। তার হেল্প নেবে। আমি অলরেডি তার সাথে কথা বলেছি। আর তুমি সেখানে কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছ, তাও বলে দিয়েছি। আর উনিও তোমাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাতে তোমার পরিশ্রম অর্ধেকটা কমে যাবে”।
সীমন্তিনী সব শুনে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ পরিতোষ। এতদুরে থেকেও তুমি যে আমার জন্যে এতটা ভাবছ, তাতে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে”।
পরিতোষের মুখে ম্লান একটা হাঁসি ফুটে উঠল। সে বলল, “ভাবার মত আমার জীবনে আর যে কিছু নেই মুন ডার্লিং” বলেই নিজেকে সামলে নিয়ে সীমন্তিনী কিছু বলে ওঠার আগেই বলল, “আর শোন, একটা সুখবর আছে। আমাদের টার্গেট টুর অপারেশন শেষ হয়েছে। ওই দিবাকর হারামজাদা তোমার দাদাভাইয়ের এক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছিল। তার কাছ থেকে আমি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে নিয়েছি। তবে যাদের মাধ্যমে অপারেশনটা করিয়েছি, তাদের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে তোমার দাদাভাইয়ের জন্য দু’লাখ টাকা আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। এবার তুমি বল, টাকাটা কি তোমার দাদাভাইয়ের হাতে দেব, না তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব”?
সীমন্তিনী উল্লসিত কন্ঠে বলল, “কী বলছ পরিতোষ তুমি! এরই মধ্যে তোমার অপারেশন শেষ করে ফেললে? দিবাকর কি তাহলে এখন লকআপে আছে”?
পরিতোষ বলল, “না মুন ডার্লিং। তুমি তো জানোই, এটা ধরাবাঁধা আইনি পদ্ধতিতে হয়নি। আর কাজটায় পুলিশের কেউই ছিল না। তবে হ্যা, পুলিশের লক আপেও তাকে যেতে হবেই। সে আটঘাটও বাঁধছি আমি। টার্গেট ওয়ানের গ্রাউণ্ড প্রিপারেশন কমপ্লিট হয়ে গেছে। টার্গেট ওয়ানের অপারেশনটা দুটো ফেজে কমপ্লিট হবে। ফার্স্ট ফেজের কাজও শুরু হয়ে গেছে। সেকেণ্ড ফেজটা কমপ্লিট হবার পর দিবাকর আর রবিশঙ্করকে একসঙ্গে অ্যারেস্ট করা হবে। কলকাতার অন্ততঃ চারটে থানায় জালিয়াতী আর জোচ্চুরির অনেকগুলো মামলায় ওদের দু’জনকে ফাঁসানো হবে, যাতে সব গুলো মিলে অন্ততঃ চার পাঁচ বছরের জন্য শয়তান দুটোকে জেলে পাঠানো যায়। তবে সে’সব নিয়ে তোমাকে টেনশন নিতে হবে না। তুমি শুধু আপাততঃ আমাকে এটুকু বল, আমি ওই টাকাটা কাকে কিভাবে দেব”।
সীমন্তিনী এবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “পরিতোষ, ওটা আপাততঃ তুমি তোমার কাছেই রেখে দাও। মানে, তুমি এমন আচমকা খবরটা দিলে যে আমি এ মূহুর্তে ঠিক কী করা উচিৎ, সেটা ভাবতেই পাচ্ছি না। তুমি আমাকে দুটো দিন ভাবতে দাও প্লীজ। আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভেবে দেখতে দাও। তারপর তোমাকে জানাচ্ছি”।
পরিতোষ বলল, “ওকে, ফাইন ডার্লিং। তবে তুমি তো জানোই ডার্লিং, একজন পুলিশ অফিসারের ঘরে দু’লাখ টাকা আছে, ব্যাপারটা যদি কোনভাবে এসিবিতে গিয়ে পৌঁছয় তবে কী হতে পারে। তবে নিজেকে বাঁচিয়ে এসব করার রেকর্ড আমার আগেও আছে। আমি সামলে নেব। তাহলে আর নতুন কিছু খবর আছে আমাকে জানাবার? তোমার দাদাভাই এ টাকাটা পেলেই তো তার কাজ শুরু করতে পারবেন। এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছ কি? আর তোমার দাদাভাইই বা কি ভাবছেন”?
সীমন্তিনী বলল, “একটা খবরই আছে শুধু তোমাকে দেবার মত। বিল্ডার বিমল আগরওয়ালার এক বন্ধুর নাকি দক্ষিণ কলকাতায় কোথাও একটা যোগা ট্রেনিং সেন্টার আছে। বিমল আগরওয়ালা দাদাভাইকে বলেছে সে ওই ট্রেনিং সেন্টারে দাদাভাইকে ট্রেনার হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে পারবে। মাসে মাসে নাকি কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের মত স্যালারি পাবে সেখানে। দাদাভাই আমার পরামর্শ চাইছিল। আমি ওকে বলেছি একদিন নিজে গিয়ে ওই সেন্টারটা দেখে আসুক আর তার মালিকের সাথে কথাবার্তা বলে দেখুক। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আমি তো ভাবছিলাম, তোমাকে ওই সেন্টারটার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিতে বলব। কিন্তু তোমার কাজের বোঝা কি আর কম কিছু? আর আগে থেকেই তুমি আমার কথায় চারটে টার্গেট নিয়ে ডিল করছ। এর ওপর আরেকটা ঝামেলা তোমাকে দিতে কিছুটা সঙ্কোচ হচ্ছিল। তাই দাদাভাইকেই বলেছি সে নিজে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি যাচাই করে দেখুক”।
পরিতোষ হঠাৎ প্রশ্ন করল, “আচ্ছা ডার্লিং, বিমল আগরওয়ালা তোমার দাদাভাইকে কাজ পাইয়ে দেবার ব্যাপারে এতটা অগ্রণী ভূমিকা নিতে চাইছে কেন, সে ব্যাপারে কি কোনও ধারণা আছে তোমার”?
সীমন্তিনী বলল, “সে প্রশ্নটা তো আমার মনেও উঠেছিল পরিতোষ। আর দাদাভাই নিজেও বিমলকে একই প্রশ্ন করেছিল। বিমল তাকে বলেছে যে রবিশঙ্কর অন্য একটা লোককে তার পরিচয় দিয়ে দাদাভাইয়ের সর্বনাশ করেছে বলেই সে নাকি আন্তরিক ভাবে খুব অনুতপ্ত। তাই সে দাদাভাইকে সাহায্য করতে চাইছে। কথাটা আমার কাছে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। লোকটা নিজে কলকাতার বেশ নামকরা একজন বিল্ডার এবং প্রোমোটার। তার উদ্দেশ্য যদি এতটাই সৎ হবে তাহলে সে চাইলে তো অন্যভাবেও দাদাভাইকে সাহায্য করতে পারত। তার আরেকবন্ধুর ওখানে সে দাদাভাইকে নিয়ে যেতে চাইছে কেন”?
______________________________