27-02-2020, 07:29 PM
(Update No. 72)
বেলঘরিয়া অঞ্চলের খুব কাছাকাছি একটা ছোট খাটো বাজার এলাকা। এ বাজারটায় সকাল থেকে সারাটা দিন ভিড় ভাট্টা কম থাকলেও বিকেল চারটের পর থেকে লোক সমাগম বেশী হতে শুরু করে। বাজারের বাইরে পুব দিকের বড় রাস্তার ধারে একে একে প্রাইভেট গাড়ি এসে জমা হতে থাকে। বাজারের ভেতর কোন গাড়ি ঢুকতে পারে না। যেসব গাড়িতে শুধু ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ থাকে না, সে গাড়ি গুলো রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যেই ফিরে চলে যায়। কিন্তু ফিরে যাবার সময় গাড়ির পেছনের বা সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে নতুন আরেকজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। এই নতুন ব্যক্তিটি পুরুষ বা মহিলা দু’ধরণেরই হয়ে থাকে। বাকি গাড়ি গুলো পেছনের সীটের লোক বাজারের গলি থেকে বেরিয়ে না আসা অব্দি সেখানেই পার্ক করা থাকে। তবে এ গাড়িগুলো যখন ফিরে যায় তখন নতুন কোন সওয়ারী আর তাতে থাকে না। কিন্তু পেছনের সীটের পুরুষ তখন আর মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসতে পারে না। তারা সকলেই নিজের শরীরটাকে পেছনে হেলিয়ে না দিয়ে বসতে পারে না।
রাত আটটায় এ বাজারের কোন গলিতেই আশে পাশের লোকের ধাক্কা না খেয়ে কেউ এক পা-ও এগোতে পারে না। রাত আটটা থেকে ন’টা এ বাজারে সবচেয়ে বেশী ভিড় থাকে। রাত ন’টা থেকে আবার লোক চলাচল কমতে শুরু করে। আর রাত এগারটার পর থেকে একে একে দোকান গুলো বন্ধ হতে শুরু করে। আর রাত বারোটা নাগাদ সব দোকান পাটই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন মাঝে মাঝে দু’একজন পুরুষ মানুষকে দেখা যায় বাজারের পশ্চিম দিকের একটা বড় বস্তি থেকে বেরিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে পুব দিকের বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে। তাদের অনেকেই আবার জ্যান্ত দু’পেয়ে কোন অবলম্বন ছাড়া এক পা-ও এগোতে পারে না। আর এরা সকলেই বাজারের শেষ প্রান্তে এসে রাস্তার ধারে অপেক্ষমান কোন গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির ড্রাইভারেরা কেউ কেউ হয়ত অবলম্বন হিসেবেই তার মালিককে বস্তি থেকে বাজারের ভেতর দিয়ে টেনে এনেছে। আবার কেউ কেউ হয়ত গাড়িতেই শুয়ে শুয়ে ঘুমিয়েছে। মালিক গাড়িতে উঠতেই গাড়িগুলো চলে যায়। রাত সাড়ে বারোটা একটার পর থেকে রাস্তায় পার্ক করা গাড়িগুলোর ফিরে যাবার পালা শুরু হয়। আর ভোর পাঁচটা নাগাদ একটিও গাড়ি আর থাকে না। তবে ভোর পাঁচটা থেকে ছ’টার ভেতর শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কিছু কিছু গাড়ি এখানে এসে থামে। তবে সে’সব গাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ না করেই তার পেটের ভেতর থেকে একজন ছেলে বা মেয়ে বা মহিলা যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইউ টার্ন মেরে চলে যায়। আবার বিভিন্ন বয়সের দু’চারজন পদযাত্রী পুরুষকেও ভোরের দিকে বস্তির দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। সকাল আটটা নাগাদ আবার বাজারের কিছু কিছু দোকান খুলতে শুরু করে। তবে দুপুর দুটো পর্যন্ত কিছু কিছু দোকান বন্ধই থেকে যায়। তারপর আবার বাজারটা পূর্ণ রূপে ফুটে ওঠে।
সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ মাঝারী উচ্চতার কিন্তু সুগঠিত স্বাস্থ্যের অধিকারী ত্রিশ বছর বয়সী প্রভু লাহিড়িকে দেখা গেল বাজারের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে। একটা জায়গায় এসে সে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকের একটা চায়ের দোকানের দিকে দেখতে দেখতে পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে একটা বিড়ি ধরাল। দেখতে সুন্দর স্বাস্থ্যবান হলেও তার বেশভূষা দেখে তাকে একজন নিম্ন স্তরের ব্যবসায়ী বলেই মনে হচ্ছে।
চায়ের দোকানের একটা বেঞ্চে বসা সাইত্রিশ আটত্রিশ বছরের একজন মজবুত চেহারার লোকের ওপর প্রভুর চোখ বার বার পড়ছিল। ওই লোকটার পাশে একটা আঠার ঊণিশ বছরের ছেলে বসে লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে কিছু একটা খেয়ে যাচ্ছিল। প্রায় মিনিট দশেক বাদে কমবয়সী ছেলেটি উঠে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতেই প্রভু তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে ছেলেটির পরিত্যক্ত জায়গায় বসে পড়ল।
খানিক বাদেই দোকানের একটা ছেলে এসে প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “বলুন স্যার, কি দেব আপনাকে”?
প্রভু ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো এই প্রথম এখানে এসেছি রে। তাই, তোদের দোকানে ভাল জিনিস কি পাওয়া যায় তা তো জানিনা। তা কি কি পাওয়া যাবে বল তো”?
ছেলেটি কিছু বলবার আগে প্রভুর পাশে বসা লোকটি অযাচিত ভাবে বলে উঠল, “আপনি পকৌড়া খেতে পারেন ভাইসাব। এ দোকানে ওটাই সব চেয়ে বেশী ভাল লাগে খেতে”।
প্রভু সাথে সাথে দোকানের ছেলেটাকে বলল, “ঠিক হ্যায় বেটা। এক প্লেট পকৌড়াই দে তাহলে”।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “ফুল প্লেট দেব? না হাফ প্লেট”?
প্রভু বলল, “ফুল প্লেটই দিস, যা”।
ছেলেটা চলে যেতেই প্রভু পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “শুক্রিয়া ভাইসাব”।
পাশে বসা লোকটি চা খেতে খেতে বলল, “ঠিক আছে ভাইসাব। এতে শুক্রিয়া জানাবার আর কি আছে। তবে আপনাকে তো এ বাজারে আর আগে কখনও দেখিনি ভাইসাব”?
প্রভু আবার হেসে বলল, “কি করে দেখবেন ভাইসাব। আমি তো এর আগে কখনও এ বাজারে আসিই নি। আজ এক বন্ধুর কথায় এখানে এলাম। এখানে নাকি সব জিনিসের কাস্টমার পাওয়া যায়। তাই ভাবলাম একবার দেখি গিয়ে। আমার মতলবের কোন কাস্টমার পাওয়া যায় কি না”।
পাশের লোকটা বলল, “আপনি কিন্তু ঠিকই শুনেছেন ভাইসাব। কিন্তু কেমন কাস্টমার খুঁজছেন বলুন। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি”।
প্রভু লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও, তাহলে আপনি দালালী করেন? তা কত পার্সেন্ট নেবেন শুনি”।
পাশের লোকটা বলল, “সেটা তো আর জিনিসের ধরণ কোয়ালিটি না জেনে সোজাসুজি বলা যায় না ভাইসাব” বলে প্রভুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “আনমেরেড মেয়ে চাইলে আট শ। মেরেড মহিলা চাইলে পাঁচ শ। আর পুরুষ চাইলে তিন শ টাকা নেব। তবে কম বয়সী ছেলে ছোকরা চাইলে পাঁচ শ দিতে হবে”।
দোকানের ছেলেটা একটা বড় প্লেট ভর্তি পকৌড়া এনে দিতে সেটা দেখেই প্রভু বলে উঠল, “আরে বাপরে! এতগুলো কেন এনেছিস রে”?
দোকানের ছেলেটা বলল, “আপনি তো ফুল প্লেট আনতে বলেছেন স্যার। এটা ফুলপ্লেটই দিয়েছি আপনাকে আমি”।
পাশের লোকটা ছেলেটাকে বলল, “ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। তু ভাগ। জা অপনা কাম কর”।
ছেলেটা চলে যেতে প্রভু পাশের লোকটাকে বলল, “আপনি তো ছেলেটাকে ভাগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি তো এর অর্ধেকও খেতে পারব না। জিনিসগুলো বেকার নষ্ট হয়ে যাবে”।
পাশের লোকটা বলল, “সেটা নিয়ে ভাবছেন কেন ভাইসাব। কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে খেতে থাকুন। ঠিক শেষ হয়ে যাবে। তা বলুন, কী চান আপনি”?
প্রভু বলল, “না ভাইসাব, আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি কিছু চাইতে বা নিতে আসিনি এখানে। আমি পুরানা গাড়ি কেনা বেচা করি। গাড়ি কেনার কাস্টমার খুঁজতেই আমি এসেছি। ছেলে মেয়ে এসব কিছু চাই না আমার। কিন্তু প্রায় একঘন্টা ধরে এ মার্কেটে ঘুরেও কোন কাস্টমার পেলাম না। মনে হচ্ছে আমার বন্ধুর কথা শুনে এখানে এসে কোন লাভ হল না। কাল অন্য জায়গায় যেতে হবে”।
পাশের লোকটা বলল, “ও, তাহলে এই কথা। আপনি গাড়ি বেচবেন। সে জন্যেই জিজ্ঞেস করেছিলেন কত পার্সেন্ট, তাই না? তা কি গাড়ি? দেশী না বিদেশী”?
প্রভু একখানা পকৌড়া মুখে দিয়ে জবাব দিল, “দেশী বিদেশী সবই আছে। তবে এখন হাতে বিদেশী গাড়িই বেশী আছে। তা, আপনার হাতে কোন কাস্টমার আছে নাকি ভাইসাব”? বলে পকৌড়ার প্লেটটা লোকটার দিকে একটু ঠেলে দিয়ে বলল, “আপনিও নিন না”।
লোকটা একটা পকৌড়া হাতে নিয়ে বলল, “হাঁ ভাইসাব। একটা কাস্টমারের খোঁজ আমি আপনাকে দিতে পারি। কিন্তু তার সাথে বাজারে দেখা করতে পারবেন না। একটু হেঁটে যেতে হবে। দশ পনের মিনিট লাগবে যেতে। কিন্তু আমাকে পন্দ্রহ পার্সেন্ট কমিশন দিতে হবে”।
প্রভু পকৌড়া চিবোতে চিবোতে একটু ভেবে বলল, “টয়োটা বা মার্সিডিসের কাস্টমার পেলে পনের পার্সেন্ট কমিশন দেব ঠিক আছে। কিন্তু অন্য কোম্পানীর মাল নিলে পনের পার্সেন্ট দিতে পারব না ভাইসাব। দশ পার্সেন্টের বেশী দিতে পারব না। তাহলে আমার পোষাবে না”।
লোকটা এবার একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে চলুন কাস্টমারের কাছে যাওয়া যাক”।
প্রভু পকৌড়া খেতে খেতেই বলল, “ঠিক হ্যায়। কিন্তু পকৌড়া গুলোর কী হবে? পকৌড়াগুলো খেতে খেতে আমাদের পরিচয়টা সেরে নিলে ভাল হবে না? নিন। আমার নাম প্রভুদাস লাহিড়ি। বড়বাজারে থাকি। সেখানে সবাই আমাকে প্রভু বলেই ডাকে”।
পাশের লোকটাও পকৌড়া খেতে খেতে বলল, “আমার নাম মাঙ্গিলাল যাদব। কিন্তু এ মহল্লায় সবাই আমাকে মঙ্গু বলে ডাকে। দালালীর ব্যবসা করি। সবরকম জিনিসের দালালী। যখন যেটা পাই আর কি। আচ্ছা প্রভুজী, আমি আগে একটু খবর নিয়ে নিই” বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “হাঁ ভইয়া, আপ কাঁহা হো ইস বক্ত”?
প্রভু কান খাঁড়া করে পকৌড়া খেতে খেতে মঙ্গুর কথা শুনে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মঙ্গু আবার ফোনে বলল, “বাত ইয়ে হ্যায় ভইয়া। এক পার্টি মিলা হ্যায়। পুরানা গাড়ি বেচনেওয়ালা। ভাবী উস দিন বোল রহি থি না? ইসিলিয়ে কহ রহা হু ভইয়া কি অগর আপ চাহে তো ইনসে মিল সকতে হ্যায়। বো মেরে সাথ হি হ্যায়। ভাবীজী কাম মে বিজি হ্যায় ক্যা অভি”?
আবার কিছুক্ষণ ও’পাশের কথা শুনে মঙ্গু বলল, “ঠিক হ্যায় ভইয়া তব। পর আপ দের মত করনা। বাত নহী বনেগী তো পার্টি তো বেকার সময় খরাব নহী করেগা না? সমঝে ন আপ”?
আরেকবার থেমে অন্যদিকের কথা শুনে বলল, “অচ্ছা ভাইয়া। ম্যায় দস মিনট তক উনকে সাথ হু বজার পর। আপ ইসি বিচ মুঝে ফোন কীজিয়েগা”।
ফোন পকেটে রেখে মঙ্গু প্রভুকে বলল, “একটু পরে খবর পাব। নিন। ততক্ষণে দু’জন মিলে খাওয়া শেষ করি”।
প্রভু খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “আপনি যার সাথে কথা বললেন, সে নিজে কিনবেন না”?
মঙ্গুও খেতে খেতেই জবাব দিল, “নিজে কিনবেন না তা ঠিক নয় প্রভুজী। কিন্তু ওর বৌ ওর থেকে অনেক বেশী রোজগার করে বলে বৌয়ের কথা ছাড়া সে কোন কাজই করে না। কেমন গাড়ি নেবে, কি গাড়ি নেবে এ সব কিছুই তার বৌ ঠিক করবে। আর তার সাথেই আপনাকে কথা বলতে হবে। কিন্তু ভাবীজী তো দুপুর দুটোর পর থেকে রাত এগারটা বারোটা পর্যন্ত হেভি ডিউটি করে। তাই সে এখন আপনার সাথে কথা বলতে পারবে কি না, সেটা তো তাকে জিজ্ঞেস না করলে বোঝা যাবে না”।
প্রভু খেতে খেতে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল, “আপনার এই ভাবী এমন কি কাজ করে যে তাকে দুপুর দুটো থেকে রাত বারোটা অব্দি ব্যস্ত থাকতে হয়? হাসপাতালের নার্স বা ডাক্তার নাকি উনি”?
মঙ্গু জবাব দিল, “আরে না প্রভুজী। নার্স উর্স কিছু না” বলেই প্রভুর কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে বলল, “ঘরে কাস্টমার নেয়। বুঝেছেন তো? ঘরে এই সময় কাস্টমার থাকলে তো তার সাথে কথা বলা যাবে না”।
প্রভুও গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা আপনার ভাইয়া কী বলল? তার বৌয়ের ঘরে এখন কোন কাস্টমার আছে”?
মঙ্গু নিচু গলায় জবাব দিল, “দিবাকর ভাইয়া তো বলল যে এখন একজন কাস্টমার আছে। তবে সাতটা থেকে একঘন্টা ভাবী ফ্রি আছে। এখন তো প্রায় পৌনে সাতটা বেজেই গেল। তাই ভাবীর সাথে কথা বলে জানাতে বললাম”।
প্রভু বলল, “ঠিক আছে। দশ পনের মিনিট আমি আপনার সাথে বসতে পারব। কিন্তু এর চেয়ে বেশী দেরী কিন্তু আমি করব না। এক জায়গায় বেশীক্ষণ বসে থাকা আমার পক্ষে ঠিক নয়”।
মঙ্গু বলল, “আরে প্রভুজী সে কথা আপনাকে বলতে হবে না। এ’সব ধান্দার ভেতরের খবর আমিও তো জানি। আর ভাইয়া ভাবীও জানে। তাই খবর আসতে খুব দেরী হবে না”।
আরও কিছু টুকটাক কথা বলে প্রভু শেষ পকৌড়াটা মুখে নিতেই মঙ্গুর পকেটের ভেতর ফোন বেজে উঠল। মঙ্গু ফোন নিয়ে কানে লাগিয়েই বলল, “হ্যা ভইয়া, কহিয়ে”।
তারপর কিছু সময় চুপ করে থাকবার পর আবার বলল, “ঠিক হ্যায় ভইয়া। হম অভি নিকল রহে হ্যায়। আপ বোহি পর হমারা ইন্তজার করনা”।
ফোন পকেটে রেখেই মঙ্গু প্রভুর হাত ধরে বলল, “চলিয়ে প্রভুজী, গ্রীন সিগন্যাল মিল গয়া হ্যায়”।
প্রভু দোকানের বিল মিটিয়ে দিয়ে মঙ্গুর সাথে ভিড় ঠেলে একদিকে এগিয়ে যেতে থাকল। অনেকটা হেঁটে বাজারের প্রায় শেষ মাথায় এসে মঙ্গু হাতের ঈশারায় একটা দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে থাকা একজন রোগা লম্বা লোকের দিকে ঈশারা করে বলল, “ওই যে দিবাকর ভইয়া। রাস্তার ওদিকে চলুন”।
ধুতি পাঞ্জাবী পড়া ঢ্যাঙা রোগা হাড়গিলে টাইপের লোকটার কাছে এসে মঙ্গু তাকে বলল, “ভইয়া ইয়ে হ্যায় প্রভুজী। ইনহি কে বারে মে আপকো বোলা থা”।
দিবাকর প্রভুর সাথে হ্যাণ্ডশেক করে জিজ্ঞেস করল, “তো প্রভুজী আপনি তৈরী হয়েই এসেছেন তো? মানে ক্যাটালগ টগ সব নিয়ে এসেছেন তো”?
প্রভু কিছু জবাব দেবার আগেই মঙ্গু বলল, “আপ ক্যায়সি বাত কর রহে হ্যায় ভইয়া। ভলা ইয়ে সব সামান কা ক্যাটালগ আপকো কাঁহা মিলেগা? চোরি কে সামান কে লিয়ে কোই এয়সা সবাল করতা হ্যায় ক্যা”?
প্রভু একটু হেসে বলল, “মঙ্গু ভাই ঠিক বলেছে। ক্যাটালগ নেই। কিন্তু মোবাইলে ছবি আছে। আর গাড়ির ডিটেইলস সব কিছু আমি মুখেই বলব। সেভাবেই ডিল করতে হবে দিবাকরজী”।
দিবাকর বলল, “আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন, আর দেরী না করে যাওয়া যাক” বলে মঙ্গুর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল একদিকে। প্রভুও তাদের পাশে পাশে চলতে লাগল।
প্রায় মিনিট দশেক হেঁটে একটা বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে এসে দরজায় টোকা দিল দিবাকর। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই চৌদ্দ পনের বছর বয়সী একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। দিবাকর সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “গুড্ডি, তেরী মাম্মি কে ঘর কা মেহমান চলা গয়া কি অভিভি হ্যায়”?
মেয়েটা মঙ্গু আর প্রভুর দিকে এক একবার দেখে জবাব দিল, “অভি থোড়ি দের পহলে চলা গয়া হ্যায় পাপা। মাম্মি ফ্রেশ হো রহি হ্যায়”।
দিবাকর বলল, “তো ঠিক হ্যায়। হমলোগ বাহর ওয়ালে কমরে মে বৈঠতে হ্যায়। তেরি মা কো বোল তৈয়ার হোকে ইয়াহা আনে কে লিয়ে। হাঁ বেটি”?
“ঠিক হ্যায় পাপা” বলে মেয়েটা ভেতরের দিকে একটা প্রায়ান্ধকার রুমের ভেতর ঢুকে গেল। সামনের দিকের ঘরে ঢুকে দিবাকর সবাইকে বসতে দিয়ে প্রভুকে জিজ্ঞেস করল, “তো বলুন প্রভুজী। ভাল জিনিস দেবেন তো? আর দাম টাম কেমন নেবেন”?
প্রভু নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, “আগে আমার মোবাইলের ছবি গুলো দেখে গাড়ি পছন্দ করুন। তারপর আমি সব বলব। তবে আমি আপনাদের কোন ভাবেই ঠকাব না। এটা তো জানেনই দিবাকরজী, দু নম্বরী ব্যবসা যারা করে তারা কেউ কাউকে ঠকায় না। আর একে অপরের ওপর বিশ্বাস না করলে এ’সব ব্যবসা করাই যায় না”।
দিবাকর খুশী হয়ে বলল, “হাঁ হাঁ, এটা তো একদম সত্যি কথাই বলেছেন আপনি। কিন্তু ছবি দেখা, সামান পছন্দ করা ও’সব আমার কাজ নয়। ও’সব যার কাজ সে এখনই আসবে”।
প্রভু বলল, “সে ঠিক আছে দিবাকরজী। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন। যদি ডিল ফাইনাল হয়ে যায় তাহলে গাড়ি ডেলিভারি দেবার সাথে সাথে আমাকে ফুল পেমেন্ট করে দিতে হবে। ধার বাকির ব্যবসা কিন্তু আমি করিনা। আর একটা কথা আগেই বলে দিচ্ছি আপনাকে। এ’সব কারবারে কিন্তু সব কিছু গোপনে করতে হয়। তাই যে কেনে তাকেও যেমন সাবধান থাকতে হয়, তেমনি যে বেচে, তাকেও একই রকম সাবধান থাকতে হয়। তাই বলছি গাড়ি ডেলিভারি দেবার সময় তাতে যে নাম্বার প্লেট থাকবে সেটা কিন্তু ফলস হবে। তাই আপনি চেষ্টা করবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের নামে নতুন রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেবেন। আর নতুন নাম্বার প্লেটটা গাড়িতে লাগিয়ে নেবেন। সেটা না করলে কিন্তু যে কোন সময় পুলিশের খপ্পরে পড়তে পারেন”।
প্রভু থামতে দিবাকর একটু হেসে বলল, “আরে ও’সব নিয়ে আমার চিন্তা নেই। সব জায়গায় আমার চ্যানেল ফিট করা আছে। আমি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই সব ঠিক করে নেব”।
প্রভু আবার বলল, “কিন্তু ওই চব্বিশ ঘন্টা সময়টাই কিন্তু সবচেয়ে বেশী রিস্কি দিবাকরজী, সেটা মনে রাখবেন”।
দিবাকর প্রভুকে আশ্বস্ত করল, “প্রভুজী আমি এখন অন্যরকম দালালীর ব্যবসা করলেও, এক সময় চোরাই মালের দালালীও করেছি। তাই এ সব কিছুই আমার জানা আছে। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। আপনার কোন ভয় নেই। আমি সব কিছু সামলে নেব”।
এমন সময়ে ভেতরের দরজা দিয়ে টুংটাং শব্দে নুপুর বাজিয়ে টকটকে ফর্সা রঙের অপরূপা সুন্দরী এক মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। সারাটা ঘর যেন তার রূপের ছটায় ঝলমল করে উঠল। একটা মন মাতানো মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল ঘরটা। প্রভুজী সেই রূপসীকে দেখে প্রায় হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। একটু ভারিক্কি চেহারা হলেও সে রূপসীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে যেন সৌন্দর্য্য আর যৌনতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
______________________________
বেলঘরিয়া অঞ্চলের খুব কাছাকাছি একটা ছোট খাটো বাজার এলাকা। এ বাজারটায় সকাল থেকে সারাটা দিন ভিড় ভাট্টা কম থাকলেও বিকেল চারটের পর থেকে লোক সমাগম বেশী হতে শুরু করে। বাজারের বাইরে পুব দিকের বড় রাস্তার ধারে একে একে প্রাইভেট গাড়ি এসে জমা হতে থাকে। বাজারের ভেতর কোন গাড়ি ঢুকতে পারে না। যেসব গাড়িতে শুধু ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ থাকে না, সে গাড়ি গুলো রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যেই ফিরে চলে যায়। কিন্তু ফিরে যাবার সময় গাড়ির পেছনের বা সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে নতুন আরেকজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। এই নতুন ব্যক্তিটি পুরুষ বা মহিলা দু’ধরণেরই হয়ে থাকে। বাকি গাড়ি গুলো পেছনের সীটের লোক বাজারের গলি থেকে বেরিয়ে না আসা অব্দি সেখানেই পার্ক করা থাকে। তবে এ গাড়িগুলো যখন ফিরে যায় তখন নতুন কোন সওয়ারী আর তাতে থাকে না। কিন্তু পেছনের সীটের পুরুষ তখন আর মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসতে পারে না। তারা সকলেই নিজের শরীরটাকে পেছনে হেলিয়ে না দিয়ে বসতে পারে না।
রাত আটটায় এ বাজারের কোন গলিতেই আশে পাশের লোকের ধাক্কা না খেয়ে কেউ এক পা-ও এগোতে পারে না। রাত আটটা থেকে ন’টা এ বাজারে সবচেয়ে বেশী ভিড় থাকে। রাত ন’টা থেকে আবার লোক চলাচল কমতে শুরু করে। আর রাত এগারটার পর থেকে একে একে দোকান গুলো বন্ধ হতে শুরু করে। আর রাত বারোটা নাগাদ সব দোকান পাটই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন মাঝে মাঝে দু’একজন পুরুষ মানুষকে দেখা যায় বাজারের পশ্চিম দিকের একটা বড় বস্তি থেকে বেরিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে পুব দিকের বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে। তাদের অনেকেই আবার জ্যান্ত দু’পেয়ে কোন অবলম্বন ছাড়া এক পা-ও এগোতে পারে না। আর এরা সকলেই বাজারের শেষ প্রান্তে এসে রাস্তার ধারে অপেক্ষমান কোন গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির ড্রাইভারেরা কেউ কেউ হয়ত অবলম্বন হিসেবেই তার মালিককে বস্তি থেকে বাজারের ভেতর দিয়ে টেনে এনেছে। আবার কেউ কেউ হয়ত গাড়িতেই শুয়ে শুয়ে ঘুমিয়েছে। মালিক গাড়িতে উঠতেই গাড়িগুলো চলে যায়। রাত সাড়ে বারোটা একটার পর থেকে রাস্তায় পার্ক করা গাড়িগুলোর ফিরে যাবার পালা শুরু হয়। আর ভোর পাঁচটা নাগাদ একটিও গাড়ি আর থাকে না। তবে ভোর পাঁচটা থেকে ছ’টার ভেতর শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কিছু কিছু গাড়ি এখানে এসে থামে। তবে সে’সব গাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ না করেই তার পেটের ভেতর থেকে একজন ছেলে বা মেয়ে বা মহিলা যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইউ টার্ন মেরে চলে যায়। আবার বিভিন্ন বয়সের দু’চারজন পদযাত্রী পুরুষকেও ভোরের দিকে বস্তির দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। সকাল আটটা নাগাদ আবার বাজারের কিছু কিছু দোকান খুলতে শুরু করে। তবে দুপুর দুটো পর্যন্ত কিছু কিছু দোকান বন্ধই থেকে যায়। তারপর আবার বাজারটা পূর্ণ রূপে ফুটে ওঠে।
সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ মাঝারী উচ্চতার কিন্তু সুগঠিত স্বাস্থ্যের অধিকারী ত্রিশ বছর বয়সী প্রভু লাহিড়িকে দেখা গেল বাজারের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে। একটা জায়গায় এসে সে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকের একটা চায়ের দোকানের দিকে দেখতে দেখতে পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে একটা বিড়ি ধরাল। দেখতে সুন্দর স্বাস্থ্যবান হলেও তার বেশভূষা দেখে তাকে একজন নিম্ন স্তরের ব্যবসায়ী বলেই মনে হচ্ছে।
চায়ের দোকানের একটা বেঞ্চে বসা সাইত্রিশ আটত্রিশ বছরের একজন মজবুত চেহারার লোকের ওপর প্রভুর চোখ বার বার পড়ছিল। ওই লোকটার পাশে একটা আঠার ঊণিশ বছরের ছেলে বসে লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে কিছু একটা খেয়ে যাচ্ছিল। প্রায় মিনিট দশেক বাদে কমবয়সী ছেলেটি উঠে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতেই প্রভু তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে ছেলেটির পরিত্যক্ত জায়গায় বসে পড়ল।
খানিক বাদেই দোকানের একটা ছেলে এসে প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “বলুন স্যার, কি দেব আপনাকে”?
প্রভু ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো এই প্রথম এখানে এসেছি রে। তাই, তোদের দোকানে ভাল জিনিস কি পাওয়া যায় তা তো জানিনা। তা কি কি পাওয়া যাবে বল তো”?
ছেলেটি কিছু বলবার আগে প্রভুর পাশে বসা লোকটি অযাচিত ভাবে বলে উঠল, “আপনি পকৌড়া খেতে পারেন ভাইসাব। এ দোকানে ওটাই সব চেয়ে বেশী ভাল লাগে খেতে”।
প্রভু সাথে সাথে দোকানের ছেলেটাকে বলল, “ঠিক হ্যায় বেটা। এক প্লেট পকৌড়াই দে তাহলে”।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “ফুল প্লেট দেব? না হাফ প্লেট”?
প্রভু বলল, “ফুল প্লেটই দিস, যা”।
ছেলেটা চলে যেতেই প্রভু পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “শুক্রিয়া ভাইসাব”।
পাশে বসা লোকটি চা খেতে খেতে বলল, “ঠিক আছে ভাইসাব। এতে শুক্রিয়া জানাবার আর কি আছে। তবে আপনাকে তো এ বাজারে আর আগে কখনও দেখিনি ভাইসাব”?
প্রভু আবার হেসে বলল, “কি করে দেখবেন ভাইসাব। আমি তো এর আগে কখনও এ বাজারে আসিই নি। আজ এক বন্ধুর কথায় এখানে এলাম। এখানে নাকি সব জিনিসের কাস্টমার পাওয়া যায়। তাই ভাবলাম একবার দেখি গিয়ে। আমার মতলবের কোন কাস্টমার পাওয়া যায় কি না”।
পাশের লোকটা বলল, “আপনি কিন্তু ঠিকই শুনেছেন ভাইসাব। কিন্তু কেমন কাস্টমার খুঁজছেন বলুন। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি”।
প্রভু লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও, তাহলে আপনি দালালী করেন? তা কত পার্সেন্ট নেবেন শুনি”।
পাশের লোকটা বলল, “সেটা তো আর জিনিসের ধরণ কোয়ালিটি না জেনে সোজাসুজি বলা যায় না ভাইসাব” বলে প্রভুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “আনমেরেড মেয়ে চাইলে আট শ। মেরেড মহিলা চাইলে পাঁচ শ। আর পুরুষ চাইলে তিন শ টাকা নেব। তবে কম বয়সী ছেলে ছোকরা চাইলে পাঁচ শ দিতে হবে”।
দোকানের ছেলেটা একটা বড় প্লেট ভর্তি পকৌড়া এনে দিতে সেটা দেখেই প্রভু বলে উঠল, “আরে বাপরে! এতগুলো কেন এনেছিস রে”?
দোকানের ছেলেটা বলল, “আপনি তো ফুল প্লেট আনতে বলেছেন স্যার। এটা ফুলপ্লেটই দিয়েছি আপনাকে আমি”।
পাশের লোকটা ছেলেটাকে বলল, “ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। তু ভাগ। জা অপনা কাম কর”।
ছেলেটা চলে যেতে প্রভু পাশের লোকটাকে বলল, “আপনি তো ছেলেটাকে ভাগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি তো এর অর্ধেকও খেতে পারব না। জিনিসগুলো বেকার নষ্ট হয়ে যাবে”।
পাশের লোকটা বলল, “সেটা নিয়ে ভাবছেন কেন ভাইসাব। কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে খেতে থাকুন। ঠিক শেষ হয়ে যাবে। তা বলুন, কী চান আপনি”?
প্রভু বলল, “না ভাইসাব, আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি কিছু চাইতে বা নিতে আসিনি এখানে। আমি পুরানা গাড়ি কেনা বেচা করি। গাড়ি কেনার কাস্টমার খুঁজতেই আমি এসেছি। ছেলে মেয়ে এসব কিছু চাই না আমার। কিন্তু প্রায় একঘন্টা ধরে এ মার্কেটে ঘুরেও কোন কাস্টমার পেলাম না। মনে হচ্ছে আমার বন্ধুর কথা শুনে এখানে এসে কোন লাভ হল না। কাল অন্য জায়গায় যেতে হবে”।
পাশের লোকটা বলল, “ও, তাহলে এই কথা। আপনি গাড়ি বেচবেন। সে জন্যেই জিজ্ঞেস করেছিলেন কত পার্সেন্ট, তাই না? তা কি গাড়ি? দেশী না বিদেশী”?
প্রভু একখানা পকৌড়া মুখে দিয়ে জবাব দিল, “দেশী বিদেশী সবই আছে। তবে এখন হাতে বিদেশী গাড়িই বেশী আছে। তা, আপনার হাতে কোন কাস্টমার আছে নাকি ভাইসাব”? বলে পকৌড়ার প্লেটটা লোকটার দিকে একটু ঠেলে দিয়ে বলল, “আপনিও নিন না”।
লোকটা একটা পকৌড়া হাতে নিয়ে বলল, “হাঁ ভাইসাব। একটা কাস্টমারের খোঁজ আমি আপনাকে দিতে পারি। কিন্তু তার সাথে বাজারে দেখা করতে পারবেন না। একটু হেঁটে যেতে হবে। দশ পনের মিনিট লাগবে যেতে। কিন্তু আমাকে পন্দ্রহ পার্সেন্ট কমিশন দিতে হবে”।
প্রভু পকৌড়া চিবোতে চিবোতে একটু ভেবে বলল, “টয়োটা বা মার্সিডিসের কাস্টমার পেলে পনের পার্সেন্ট কমিশন দেব ঠিক আছে। কিন্তু অন্য কোম্পানীর মাল নিলে পনের পার্সেন্ট দিতে পারব না ভাইসাব। দশ পার্সেন্টের বেশী দিতে পারব না। তাহলে আমার পোষাবে না”।
লোকটা এবার একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে চলুন কাস্টমারের কাছে যাওয়া যাক”।
প্রভু পকৌড়া খেতে খেতেই বলল, “ঠিক হ্যায়। কিন্তু পকৌড়া গুলোর কী হবে? পকৌড়াগুলো খেতে খেতে আমাদের পরিচয়টা সেরে নিলে ভাল হবে না? নিন। আমার নাম প্রভুদাস লাহিড়ি। বড়বাজারে থাকি। সেখানে সবাই আমাকে প্রভু বলেই ডাকে”।
পাশের লোকটাও পকৌড়া খেতে খেতে বলল, “আমার নাম মাঙ্গিলাল যাদব। কিন্তু এ মহল্লায় সবাই আমাকে মঙ্গু বলে ডাকে। দালালীর ব্যবসা করি। সবরকম জিনিসের দালালী। যখন যেটা পাই আর কি। আচ্ছা প্রভুজী, আমি আগে একটু খবর নিয়ে নিই” বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “হাঁ ভইয়া, আপ কাঁহা হো ইস বক্ত”?
প্রভু কান খাঁড়া করে পকৌড়া খেতে খেতে মঙ্গুর কথা শুনে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মঙ্গু আবার ফোনে বলল, “বাত ইয়ে হ্যায় ভইয়া। এক পার্টি মিলা হ্যায়। পুরানা গাড়ি বেচনেওয়ালা। ভাবী উস দিন বোল রহি থি না? ইসিলিয়ে কহ রহা হু ভইয়া কি অগর আপ চাহে তো ইনসে মিল সকতে হ্যায়। বো মেরে সাথ হি হ্যায়। ভাবীজী কাম মে বিজি হ্যায় ক্যা অভি”?
আবার কিছুক্ষণ ও’পাশের কথা শুনে মঙ্গু বলল, “ঠিক হ্যায় ভইয়া তব। পর আপ দের মত করনা। বাত নহী বনেগী তো পার্টি তো বেকার সময় খরাব নহী করেগা না? সমঝে ন আপ”?
আরেকবার থেমে অন্যদিকের কথা শুনে বলল, “অচ্ছা ভাইয়া। ম্যায় দস মিনট তক উনকে সাথ হু বজার পর। আপ ইসি বিচ মুঝে ফোন কীজিয়েগা”।
ফোন পকেটে রেখে মঙ্গু প্রভুকে বলল, “একটু পরে খবর পাব। নিন। ততক্ষণে দু’জন মিলে খাওয়া শেষ করি”।
প্রভু খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “আপনি যার সাথে কথা বললেন, সে নিজে কিনবেন না”?
মঙ্গুও খেতে খেতেই জবাব দিল, “নিজে কিনবেন না তা ঠিক নয় প্রভুজী। কিন্তু ওর বৌ ওর থেকে অনেক বেশী রোজগার করে বলে বৌয়ের কথা ছাড়া সে কোন কাজই করে না। কেমন গাড়ি নেবে, কি গাড়ি নেবে এ সব কিছুই তার বৌ ঠিক করবে। আর তার সাথেই আপনাকে কথা বলতে হবে। কিন্তু ভাবীজী তো দুপুর দুটোর পর থেকে রাত এগারটা বারোটা পর্যন্ত হেভি ডিউটি করে। তাই সে এখন আপনার সাথে কথা বলতে পারবে কি না, সেটা তো তাকে জিজ্ঞেস না করলে বোঝা যাবে না”।
প্রভু খেতে খেতে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল, “আপনার এই ভাবী এমন কি কাজ করে যে তাকে দুপুর দুটো থেকে রাত বারোটা অব্দি ব্যস্ত থাকতে হয়? হাসপাতালের নার্স বা ডাক্তার নাকি উনি”?
মঙ্গু জবাব দিল, “আরে না প্রভুজী। নার্স উর্স কিছু না” বলেই প্রভুর কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে বলল, “ঘরে কাস্টমার নেয়। বুঝেছেন তো? ঘরে এই সময় কাস্টমার থাকলে তো তার সাথে কথা বলা যাবে না”।
প্রভুও গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা আপনার ভাইয়া কী বলল? তার বৌয়ের ঘরে এখন কোন কাস্টমার আছে”?
মঙ্গু নিচু গলায় জবাব দিল, “দিবাকর ভাইয়া তো বলল যে এখন একজন কাস্টমার আছে। তবে সাতটা থেকে একঘন্টা ভাবী ফ্রি আছে। এখন তো প্রায় পৌনে সাতটা বেজেই গেল। তাই ভাবীর সাথে কথা বলে জানাতে বললাম”।
প্রভু বলল, “ঠিক আছে। দশ পনের মিনিট আমি আপনার সাথে বসতে পারব। কিন্তু এর চেয়ে বেশী দেরী কিন্তু আমি করব না। এক জায়গায় বেশীক্ষণ বসে থাকা আমার পক্ষে ঠিক নয়”।
মঙ্গু বলল, “আরে প্রভুজী সে কথা আপনাকে বলতে হবে না। এ’সব ধান্দার ভেতরের খবর আমিও তো জানি। আর ভাইয়া ভাবীও জানে। তাই খবর আসতে খুব দেরী হবে না”।
আরও কিছু টুকটাক কথা বলে প্রভু শেষ পকৌড়াটা মুখে নিতেই মঙ্গুর পকেটের ভেতর ফোন বেজে উঠল। মঙ্গু ফোন নিয়ে কানে লাগিয়েই বলল, “হ্যা ভইয়া, কহিয়ে”।
তারপর কিছু সময় চুপ করে থাকবার পর আবার বলল, “ঠিক হ্যায় ভইয়া। হম অভি নিকল রহে হ্যায়। আপ বোহি পর হমারা ইন্তজার করনা”।
ফোন পকেটে রেখেই মঙ্গু প্রভুর হাত ধরে বলল, “চলিয়ে প্রভুজী, গ্রীন সিগন্যাল মিল গয়া হ্যায়”।
প্রভু দোকানের বিল মিটিয়ে দিয়ে মঙ্গুর সাথে ভিড় ঠেলে একদিকে এগিয়ে যেতে থাকল। অনেকটা হেঁটে বাজারের প্রায় শেষ মাথায় এসে মঙ্গু হাতের ঈশারায় একটা দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে থাকা একজন রোগা লম্বা লোকের দিকে ঈশারা করে বলল, “ওই যে দিবাকর ভইয়া। রাস্তার ওদিকে চলুন”।
ধুতি পাঞ্জাবী পড়া ঢ্যাঙা রোগা হাড়গিলে টাইপের লোকটার কাছে এসে মঙ্গু তাকে বলল, “ভইয়া ইয়ে হ্যায় প্রভুজী। ইনহি কে বারে মে আপকো বোলা থা”।
দিবাকর প্রভুর সাথে হ্যাণ্ডশেক করে জিজ্ঞেস করল, “তো প্রভুজী আপনি তৈরী হয়েই এসেছেন তো? মানে ক্যাটালগ টগ সব নিয়ে এসেছেন তো”?
প্রভু কিছু জবাব দেবার আগেই মঙ্গু বলল, “আপ ক্যায়সি বাত কর রহে হ্যায় ভইয়া। ভলা ইয়ে সব সামান কা ক্যাটালগ আপকো কাঁহা মিলেগা? চোরি কে সামান কে লিয়ে কোই এয়সা সবাল করতা হ্যায় ক্যা”?
প্রভু একটু হেসে বলল, “মঙ্গু ভাই ঠিক বলেছে। ক্যাটালগ নেই। কিন্তু মোবাইলে ছবি আছে। আর গাড়ির ডিটেইলস সব কিছু আমি মুখেই বলব। সেভাবেই ডিল করতে হবে দিবাকরজী”।
দিবাকর বলল, “আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন, আর দেরী না করে যাওয়া যাক” বলে মঙ্গুর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল একদিকে। প্রভুও তাদের পাশে পাশে চলতে লাগল।
প্রায় মিনিট দশেক হেঁটে একটা বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে এসে দরজায় টোকা দিল দিবাকর। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই চৌদ্দ পনের বছর বয়সী একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। দিবাকর সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “গুড্ডি, তেরী মাম্মি কে ঘর কা মেহমান চলা গয়া কি অভিভি হ্যায়”?
মেয়েটা মঙ্গু আর প্রভুর দিকে এক একবার দেখে জবাব দিল, “অভি থোড়ি দের পহলে চলা গয়া হ্যায় পাপা। মাম্মি ফ্রেশ হো রহি হ্যায়”।
দিবাকর বলল, “তো ঠিক হ্যায়। হমলোগ বাহর ওয়ালে কমরে মে বৈঠতে হ্যায়। তেরি মা কো বোল তৈয়ার হোকে ইয়াহা আনে কে লিয়ে। হাঁ বেটি”?
“ঠিক হ্যায় পাপা” বলে মেয়েটা ভেতরের দিকে একটা প্রায়ান্ধকার রুমের ভেতর ঢুকে গেল। সামনের দিকের ঘরে ঢুকে দিবাকর সবাইকে বসতে দিয়ে প্রভুকে জিজ্ঞেস করল, “তো বলুন প্রভুজী। ভাল জিনিস দেবেন তো? আর দাম টাম কেমন নেবেন”?
প্রভু নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, “আগে আমার মোবাইলের ছবি গুলো দেখে গাড়ি পছন্দ করুন। তারপর আমি সব বলব। তবে আমি আপনাদের কোন ভাবেই ঠকাব না। এটা তো জানেনই দিবাকরজী, দু নম্বরী ব্যবসা যারা করে তারা কেউ কাউকে ঠকায় না। আর একে অপরের ওপর বিশ্বাস না করলে এ’সব ব্যবসা করাই যায় না”।
দিবাকর খুশী হয়ে বলল, “হাঁ হাঁ, এটা তো একদম সত্যি কথাই বলেছেন আপনি। কিন্তু ছবি দেখা, সামান পছন্দ করা ও’সব আমার কাজ নয়। ও’সব যার কাজ সে এখনই আসবে”।
প্রভু বলল, “সে ঠিক আছে দিবাকরজী। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন। যদি ডিল ফাইনাল হয়ে যায় তাহলে গাড়ি ডেলিভারি দেবার সাথে সাথে আমাকে ফুল পেমেন্ট করে দিতে হবে। ধার বাকির ব্যবসা কিন্তু আমি করিনা। আর একটা কথা আগেই বলে দিচ্ছি আপনাকে। এ’সব কারবারে কিন্তু সব কিছু গোপনে করতে হয়। তাই যে কেনে তাকেও যেমন সাবধান থাকতে হয়, তেমনি যে বেচে, তাকেও একই রকম সাবধান থাকতে হয়। তাই বলছি গাড়ি ডেলিভারি দেবার সময় তাতে যে নাম্বার প্লেট থাকবে সেটা কিন্তু ফলস হবে। তাই আপনি চেষ্টা করবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের নামে নতুন রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেবেন। আর নতুন নাম্বার প্লেটটা গাড়িতে লাগিয়ে নেবেন। সেটা না করলে কিন্তু যে কোন সময় পুলিশের খপ্পরে পড়তে পারেন”।
প্রভু থামতে দিবাকর একটু হেসে বলল, “আরে ও’সব নিয়ে আমার চিন্তা নেই। সব জায়গায় আমার চ্যানেল ফিট করা আছে। আমি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই সব ঠিক করে নেব”।
প্রভু আবার বলল, “কিন্তু ওই চব্বিশ ঘন্টা সময়টাই কিন্তু সবচেয়ে বেশী রিস্কি দিবাকরজী, সেটা মনে রাখবেন”।
দিবাকর প্রভুকে আশ্বস্ত করল, “প্রভুজী আমি এখন অন্যরকম দালালীর ব্যবসা করলেও, এক সময় চোরাই মালের দালালীও করেছি। তাই এ সব কিছুই আমার জানা আছে। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। আপনার কোন ভয় নেই। আমি সব কিছু সামলে নেব”।
এমন সময়ে ভেতরের দরজা দিয়ে টুংটাং শব্দে নুপুর বাজিয়ে টকটকে ফর্সা রঙের অপরূপা সুন্দরী এক মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। সারাটা ঘর যেন তার রূপের ছটায় ঝলমল করে উঠল। একটা মন মাতানো মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল ঘরটা। প্রভুজী সেই রূপসীকে দেখে প্রায় হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। একটু ভারিক্কি চেহারা হলেও সে রূপসীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে যেন সৌন্দর্য্য আর যৌনতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
______________________________