26-02-2020, 08:27 PM
(Update No. 65 dt. 29.7.2018)
থানা থেকে বেরিয়ে অটোয় চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রচনা সীমন্তিনীকে এসএমএস পাঠাল “অনেক কথা আছে। সময় হাতে নিয়ে ফোন কোর”। বাড়ি এসে রচনা পোশাক বদলে কিচেনে ঢুকে পড়ল। রান্না শেষ হল বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। দু’জনে একসাথে খেয়েদেয়ে বসবার ঘরে এসে বসল। দুপুরে ঘুমনোর অভ্যাস তাদের কারোরই নেই। রচনা সোফায় বসে রতীশকে টেনে নিজের কোলের ওপর শোয়াতে শোয়াতে বলল, “আচ্ছা সোনা, রবিশঙ্কর তো প্রতি মাসেই দু’বার করে ছোটকাকুর দোকানে যেত। তোমার কি মনে হয় ওর কোন ছবি সেখানে থাকতে পারে”?
রতীশ রচনার কোলে মাথাটা ভাল করে পেতে নিয়ে বলল, “জানিনে রচু। কিন্তু আমি তো কখনও এমন কোন ছবি দেখিনি”।
রচনা মনে মনে ভাবতে ভাবতে বলল, “ছোটকাকুর সাথে কথা বলতে হবে। তিনি হয়ত ভাল বলতে পারবেন। আর তাছাড়া রবিশঙ্কর যে ছোটকাকুর দোকানে মালপত্র সাপ্লাই করত, তাতে কলকাতার যে’সব কোম্পানীর সাথে রবিশঙ্কর ব্যবসা করে, সেসব কোম্পানীর কিছু ক্যাশমেমো, ভাউচার বা আরো কিছু ডকুমেন্ট ছোটকাকুর কাছে থাকতে পারে। সে’সব যদি আমরা পুলিশকে দিতে পারি, তাহলে তারা সে’সব জায়গায় রবিশঙ্করের খোঁজ করতে পারবে। তবে সবার আগে দিদিভাইয়ের সাথে কথা বলে নিই। দেখি দিদিভাই কী বলেন। আর দিদিভাইকেই বলব বাড়িতে ঘটণাটা যেন তিনিই জানিয়ে দেন”।
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে থাকবার পর রতীশ বলল, “তোমাকে আরেকটা কথা বলছি সোনা। দেখ, যে আশা নিয়ে এখানে এসেছি সে আশা তো শুধু স্বপ্ন হয়েই রইল। কিন্তু এখন আমাদের কী করা উচিৎ বল তো? আমরা কি বাড়ি ফিরে যাব? আর ফিরে গিয়ে করবই বা কি? কলেজের চাকরিটা তো আর আমি ফিরে পাব না। সেখানে ফিরে গেলে তো বাবা কাকুদের দোকানেই বসতে হবে। নিজে কোন দোকান খুলে বসতে চাইলেও তো আবার বাবা কাকুদের কাছেই হাত পাততে হবে। কিন্তু সেটা কি উচিৎ হবে বল? নিজের কাছে যা আছে তাতে কয়েক মাস সংসার চালানোর খরচটাই কুলোতে পারব। বাবা আর কাকুরা মিলে যে চার লাখ টাকা আমাকে দিয়েছিলেন তার দু’লাখ টাকা তো লুটই হয়ে গেল। ঘরের ফার্নিচারগুলো কিনতে একলাখ খরচ হয়ে গেছে। তাই সেখান থেকে একলাখ টাকাই শুধু হাতে আছে। আর নিজের একাউন্ট থেকে তুলে আনা হাজার পঞ্চাশেক আছে। এই দেড়লাখ দিয়ে কিছু একটা করতে চাইলে সংসার খরচ সামলানো মুস্কিল হয়ে পড়বে। কি করব তাহলে”?
রচনা বলল, “আমি তো গরীবের ঘরের মেয়ে সোনা। আলুসেদ্ধ ডাল ভাত খেয়েও আমি দিনের পর দিন থাকতে পারব। প্রয়োজন হলে মাঝে সাঝে উপোষ করেও থাকতে পারব। কিন্তু তোমাকে তো আমি উপোষী রাখতে পারব না গো। তাই আমার মনে হয়, এ দেড়লাখ টাকা দিয়ে তুমি যদি রাজগঞ্জে কোন ব্যবসা খুলে বসতে পার, তাহলে না হয় সেটাই কর। বাড়িতে আপনজনদের সাথে থেকে আমরা সব কিছু মানিয়ে নিতে পারব”।
রতীশ বলল, “রাজগঞ্জের মত জায়গায় দেড় লাখ টাকায় ছোটখাট একটা ব্যবসা খুলে বসাই যায়। কিন্তু সোনা, সেখানে গেলে তো আবার আমাদের সংসার খরচ আমাদের যৌথপরিবারের ওপরই বর্তাবে। বিয়ের পর এই তিনটে বছরে ওভাবে থাকতে আমার খুব খারাপ লাগছিল বলেই না এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আবার আগের পরিস্থিতিতেই ফিরে যেতে হবে! আর তাছাড়া যোগা ইনস্টিটিউট খোলার স্বপ্ন আমার কখনোই সফল হবে না। আবার দেখ, আসবার সময় আমাদের এত আসবাব পত্র ছিল না। এসব জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হলে তো তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা এমনিতেই খরচ হয়ে যাবে। যখন বাড়ি গিয়ে পৌঁছব তখন হাতে হয়ত মাত্র একলাখ টাকাই থাকবে। সেটুকু হয়ত নতুন ব্যবসা খোলার পক্ষে যথেষ্ট হবে না। আবার বাবা কাকুদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা চাইতে হবে। আমার যে খুব লজ্জা করবে”।
রচনা জিজ্ঞেস করল, “এছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে মনে হয় তোমার”?
রতীশ বলল, “একটা উপায় আছে হয়ত। তবে সেটাও এখনই নিশ্চিত করে বলতে যাচ্ছে না। তবে শোনো। কাল রাতে বিমল আগরওয়ালার সাথে কথা বলে চলে আসবার আগে তিনি আমাকে একটা কথা বলেছেন। তার কোন এক বন্ধুর নাকি দক্ষিন কলকাতায় একটা যোগা ইনস্টিটিউট আছে। সেখানে কয়েকজন টিচার থাকলেও তিনি নাকি একজন ভাল যোগা টিচারের খোঁজ করছেন। বিমলজী বললেন যে আমি চাইলে তিনি আমাকে সেখানে যোগা টিচার হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। মাসে হয়ত কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের মত বেতন পাব। অবশ্য ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে কুড়ি হাজার টাকায় সংসার চালাতে টানাটানিই হবে। তবু আমি আমার লাইনেই থাকতে পারব। আর কিছুদিন সেখানে কাজ করলে আমি কলকাতার এ লাইনের লোকজনের সংস্পর্শে আসতে পারব। তাতে ভবিষ্যতে একটা যোগা সেন্টার খুলতে সুবিধে হবে আমার”।
রচনা শুনে বলল, “বিমল আগরওয়ালা? মানে যে তোমার ওই কমপ্লেক্সটার আসল মালিক”?
রতীশ সায় দিয়ে বলল, “হ্যা রচু সে-ই”।
রচনা একটু ভেবে বলল, “এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাদের ভাল করে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে সোনা। এই বিমল আগরওয়ালা লোকটাকে আমার একেবারেই ধোয়া তুলসীপাতা বলে মনে হচ্ছে না। সে কিছু করুক আর না করুক, আমাদের এ সর্বনাশের পেছনে তার নামটা কিন্তু জড়িয়ে আছে। আচ্ছা সোনা একটা কথা ভেবে দেখ তো। রবিশঙ্কর বা ওই লোকটার সাথে বিমল আগরওয়ালার যদি কোন পরিচয়ই না থেকে থাকে, তাহলে লোকটা ওই কমপ্লেক্স খুলে তার ভেতর তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল কী করে? বিমল আগরওয়ালা তোমার কাছে স্বীকার না করলেও, যে তালার চাবি তার লকারে লুকনো থাকে, সে চাবিটা ওই ঠকবাজ লোকটা পায় কি করে? অবশ্য তাকে যদি পুলিশ জেরা করে তাহলে সে হয়ত বলতে পারে যে কেউ হয়ত একটা নকল চাবি বানিয়ে কাজটা করেছে। কিন্তু আমি কিন্তু তার কথাগুলো পুরো বিশ্বাস করতে পারছি না”।
রতীশ বলল, “যে প্রশ্নটা তুমি তুলছ তা হবার সম্ভাবনা যে থাকতে পারে, এমন কথা তো আমার মনেও এসেছিল। তাই আমি দ্বিতীয়বার তার সাথে দেখা করতে তার অফিসে গিয়েছিলুম মূলতঃ এ প্রশ্নের জবাব নিতেই। কিন্তু লোকটার সাথে কথা বলে শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে তিনি এ ঘটণার সাথে জড়িত নন। তিনি তো নিজে মুখেই কথাটা স্বীকার করেছেন যে এ ঘটণায় তার নামটা জড়িয়ে গেছে বলেই তিনি আমার জন্য দুঃখ পাচ্ছেন। তাই তিনি আমাকে তার বন্ধুর ওখানে কাজ পাইয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। আর তিনি নিজেই বললেন যে তার ব্যাপারেও যেন আমি পুলিশকে সব কিছু খুলে বলি। তিনি নিজে যদি এ ঘটানার সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে কি আর এমন কথা বলতেন”?
রচনা বলল, “হ্যা সে কথা ঠিক। তবে তার বন্ধুর ওখানে কাজ নেবার ব্যাপারে আমরা আগে দিদিভাইয়ের সাথে একটু কথা বলে নিই। নিজেরাও একটু ভেবে দেখি দু’চার দিন। তারপর না হয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব আমরা। আর শুধু দিদিভাইই নয়, বাবা কাকুদের সাথেও আমাদের এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। তারা তো আজ রাতে সব ঘটণা শুনেই আমাদের মতই হাঁ হুতোশ করতে শুরু করবেন। তাদের না জানিয়ে তাদের কাছে লুকিয়ে আলাদা করে কোন সিদ্ধান্ত নিলে যে তাদের অসম্মান করা হবে সোনা। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি বলে আমরা কি তাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছি? তারাই তো আমাদের আপনজন। তারাও যেমন সব সময় আমাদের কথা ভাবেন, তেমনই সারাটা দিন ধরে আমিও যে শুধু তাদের কথাই ভাবি গো। তুমি তো এখানে আসবার পর থেকে এখানে ওখানে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছ। আমি একা একা ঘরে বসে কি করব? সারাক্ষণ বাড়ির সকলের কথা ভাবি। বাবা কাকুরা সময় মত খাওয়া দাওয়া করছেন কিনা। মায়েরা, ভাই বোনেরা আমাদের কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছে কিনা, চন্দু চঞ্চু ওরা কে কি করছে, এ’সবই তো ভাবতে থাকি আমি” বলতে বলতে রচনার গলা ধরে এল। চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
রতীশ বলল, “জানি সোনা। তিনবছর আগে আমার বৌ হয়ে আমাদের বাড়ি এসেই তুমি বাড়ির সবাইকে এমনভাবে ভালবেসে ফেলেছ যে আমি অবাক না হয়ে পারিনি। নিজের বাবা মাকে ছেড়ে এসে একটা দিনও তোমাকে বাড়ির কেউ মুখ ভার করে থাকতে দেখেনি। আর কোন নতুন বৌ শ্বশুর বাড়ির সকলকে এত তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পেরেছে বলে আমি শুনিনি কখনও”।
রচনা নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, “সবটাই হয়েছে শুধু আমার দিদিভাইয়ের জন্যে। বিয়ের এক বছর আগে থেকেই দিদিভাই আমাকে মোবাইল দেবার পর থেকেই তো বাড়ির সকলের সাথে আমার রোজ কথা হত। আর আমাদের বাড়ির সকলেই এত ভাল যে বিয়ের আগেই তারা ফোনে ফোনেই আমার আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। আমি তো অপরিচিতদের মাঝে এসে পড়িনি। তাই বিয়ের পর আমার কোন সমস্যাও হয়নি। আজ তাদের কাছ থেকে অনেক দুরে চলে এলেও আমি জানি বাবা, কাকুরা, মায়েরা আর ভাইবোনেরা সকলেই আগের মতই আমাদের ভালবাসছে। আমাদের কথা ভাবছে। আমিও দু’বেলা ঠাকুরের কাছে তাদের সকলের জন্য প্রার্থনা করি। তাদের বাদ দিয়ে আমাদের কী আলাদা কোন অস্তিত্ব আছে”?
দুপুর দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট আগেই সীমন্তিনীর ফোন এল। সে জিজ্ঞেস করল, “হ্যারে রচু? অমন একটা এসএমএস পাঠিয়েছিস কেন রে? কোন রকমে একটা অপারেশন শেষ করেই ক্যান্টিনে চলে এসেছি। বল তো শুনি, কি খবর”?
রচনা জিজ্ঞেস করল, “তুমি দুপুরের খাবারটা আগে খেয়ে নাও দিদিভাই। আমি দশ মনিট বাদে তোমাকে ফোন করছি”।
সীমন্তিনী বলল, “না না রচু, ফোন কাটিস নে। আমি খাওয়া শুরু করছি। তুই বলতে শুরু কর। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারব না রে বোন। প্লীজ লক্ষ্মী বোন আমার। তুই বল না। আমি তোর দিব্যি খেয়ে বলছি, আমি খেতে খেতেই তোর কথা শুনতে থাকব”।
রচনা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। শোনো দিদিভাই” বলে রচনা আদ্যোপান্ত সব খুলে বলল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে প্রথম থেকে শুরু করে থানায় গিয়ে রিপোর্ট করা পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলল। সীমন্তিনী খেতে খেতে মাঝে মধ্যে হু হা করে সাড়া দিয়ে সবটা শুনে বলল, “ইশ এ শয়তান রবিশঙ্করটা এত বছর ধরে কাকুর সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছিল, আর কাকুরা কেউ তাকে চিনতে পারেনি! আমি তো ভেবেই অবাক হচ্ছি রে। তবে শোন রচু, তোর কথা শুনতে শুনতে আমার খাওয়াও শেষ হয়ে গেছে, আর আমাকে আরও কিছু দরকারী কাজ সারতে হবে সন্ধ্যের মধ্যে। তাই এখন আমি কথা শেষ করে আমার কেবিনে যাচ্ছি। আমি পাঁচটার পর ফ্রি হয়েই তোকে আবার ফোন করব। তখন বাকি সব কথা হবে। আর শোন, আপাততঃ তোরা বাড়িতে কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস না। আমি সন্ধ্যের পর কাকুর সাথে আগে কথা বলব। কাকুকে বুঝিয়ে বলব যাতে ধীরে সুস্থে সবাইকে ব্যাপারটা বলে। নইলে সবাই মিলে হুলুস্থুল শুরু করে দেবে”।
রচনা বলল, “কিন্তু দিদিভাই মামনি তো বারবার করে জানতে চাইছেন। তিনিও তো কাল থেকে খুব উতলা হয়ে রয়েছেন। সকালেও ফোন করেছিলেন। তখন আমিও ঘটণাটা শুনিনি বলে তাকে বলেছি যে আমি জানতে পারলেই তাকে সব কিছু জানাব। আমরা ফোন না করলেও তিনি তো নিজেই হয়ত আরেকটু বাদেই ফোন করবেন। তাকে মিথ্যে কথা কী করে বলব আমি”?
সীমন্তিনী বলল, “শোন, তোর আর দাদাভাইয়ের ফোন সুইচ অফ করে রাখ এখনই। তারপর দাদাভাইকে একটু ঘুমিয়ে নিতে বল। সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটার পর তোরা ফোন অন করবি। তার আগেই আমি বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেব। তারপর তারা ফোন করলে তখন কথা বলিস। বা নিজেরাও ফোন করতে পারিস”।
রচনা বলল, “কাল তোমার দাদাভাইয়ের ফোন সুইচ অফ পেয়েই মামনি যা চিন্তা করছিলেন। আজ দু’জনের ফোন সুইচ অফ থাকলে তো তার আরও চিন্তা হবে দিদিভাই”।
সীমন্তিনী বলল, “সেটা নিয়ে তুই ভাবিস না। আমি বাড়িতে এখনই ফোন করে তাদের বলে দিচ্ছি যে তোরা দু’জন ম্যাটিনি শোর সিনেমা দেখতে গিয়েছিস। তাই তোদের দু’জনের ফোনই বন্ধ থাকবে সন্ধ্যে ছ’টা অব্দি। তাহলে তারা কেউ আর চিন্তা করবেন না”।
রচনা আবার বলল, “তাহলে কথা তো সেই একই দাঁড়াচ্ছে। সন্ধ্যের পর মামনিকে আমাদের মিথ্যে কথাই বলতে হচ্ছে। না দিদিভাই, আমি সেটা পারব না গো। অন্য কোন বুদ্ধি বের কর তুমি”।
সীমন্তিনী অধৈর্য ভাবে বলল, “আরে পাগলী মেয়ে, তোকে মিথ্যে কথা বলতে হবে না রে। আমি সন্ধ্যের আগেই বড়মাকে জানিয়ে দেব যে আমার কথাতেই তোরা ফোন বন্ধ করে রেখেছিলিস। তোরা কেউ সিনেমা টিনেমা দেখতে যাস নি। তোরা সত্যি কথাই বলিস। বলিস যে আমার কথাতেই তোরা ফোন বন্ধ রেখেছিলিস। এবার হল তো? আচ্ছা রাখছি আমি। কাজগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করবার চেষ্টা করি গিয়ে। আর সন্ধ্যের পর তোদের সাথে আবার কথা বলব। তুই ছ’টা নাগাদ ফোন অন করে সবার আগে আমাকে ফোন করবি” বলে ফোন কেটে দিল।
****************
নিজের কেবিনে এসেই সীমন্তিনী তার নিজস্ব ফোন থেকে একজনকে ফোন করল। দু’বার রিং হতেই ও’পাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল, “কী সৌভাগ্য আমার! অধরা রূপসী মুন ডার্লিং আমায় ফোন করেছে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পাচ্ছি না”!
সীমন্তিনী গম্ভীর গলায় জবাব দিল, “প্লীজ পরি, ঠাট্টা রাখো। একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমাকে অফিস থেকেই ফোন করছি। তাই আজেবাজে কথা ছেড়ে মন দিয়ে আমার কথাটা শোনো প্লীজ”।
ও’পাশ থেকে সেই পুরুষ কণ্ঠটি এবার সতর্ক গলায় বলল, “তুমি ঠিক আছ তো মন্তি? কোন বিপদ হয়নি তো তোমার”?
সীমন্তিনী বলল, “আমি ঠিক আছি পরি। আর কোন প্রশ্ন না করে চুপ করে আমার কথাটা শোনো প্লীজ। আমার হাতে সময় খুব কম। আমার দাদাভাই তিন চারদিন আগে কলকাতা গেছে। সাথে তার স্ত্রীকেও নিয়ে গেছে। সেখানে সে একটা যোগা কোচিং সেন্টার খুলবে বলে গেছে। বরানগরে তারা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে খানিকটা দুরেই একটা কমপ্লেক্স দু’লাখ টাকায় এক বছরের জন্য লিজ নেবার কথা ছিল। রবিশঙ্কর প্রসাদ নামের আমার কাকুর পরিচিত একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ তাকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করছিল। গত পরশু রবিশঙ্কর আর অন্য আরেকজন মিলে আমার দাদাভাইয়ের কাছ থেকে দু’লাখ টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। অন্য লোকটাকে কমপ্লেক্সের মালিক সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। গতকাল দুপুরে দাদাভাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। ততক্ষণে পাখি ফুড়ুৎ হয়ে গেছে। আজ লোকাল থানায় ডাইরী করা হয়েছে একটা। তবে রবিশঙ্কর যেখানে ভাড়া থাকত সে ঠিকানা থেকে সরে গেছে। আর কমপ্লেক্সের মালিক সেজে যে লোকটা এসেছিল তার আসল নাম ঠিকানা দাদাভাই জানতেই পারেনি। তাই বুঝতেই পারছ কেসটা অফিসিয়ালি ডিল করা কতটা অসম্ভব। তাই তোমার কাছে আমি কি চাইছি সেটা আশা করি তুমি বুঝতে পারছ”।
ও’পাশের পুরুষ কন্ঠ বলল, “তুমি ভেবো না মুন ডার্লিং। ওরা দু’জন পৃথিবীর যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন আমার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তবে কলকাতার বাইরে চলে গেলে সময়টা একটু বেশী লাগবে সেটা তো বুঝতেই পারছ। তুমি শুধু রবিশঙ্করের পুরনো বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে জানিয়ে দাও। আর তার চেহারার ডেসক্রিপশানটা এসএমএস করে দাও আমাকে। বাই দি বাই, একটা প্রশ্ন করতে পারি”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “ওকে, তবে আপাতত শুধু একটাই প্রশ্ন নেব আমি। কাজের খুব চাপ আছে। বলো”।
ও’পাশ থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, “ইনিই কি তোমার সেই দাদাভাই”?
সীমন্তিনী খুব শান্তভাবে জবাব দিল, “কিপ ইট ফুললি কনফিডেন্সিয়াল। হ্যা”।
ও’পাশ থেকে পুরুষ কন্ঠটি এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, “শালারা ভীমরুলের চাকে ঘা মেরেছে! ওদের পরমায়ু বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে”।
সীমন্তিনী বলল, “না পরি, নো এনকাউন্টার প্লীজ। আমি শুধু চাই ওদের কাছ থেকে টাকাটা ফিরে পেতে। তবে ছোটখাটো শাস্তি তুমি দিতেই পার, যাতে এমন ঘটণার পুনরাবৃত্তি করতে তাদের বেশ কয়েকবার ভাবতে হয়”।
ও’পাশের পুরুষ কন্ঠ এবার কিছুটা সংযত গলায় বলল, “তোমার আদেশ শিরোধার্য দেবী। কিন্তু দয়া করে তোমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা একটু জানাবে”?
সীমন্তিনী বলল, “দিতে পারি। কিন্তু অন ওয়ান কণ্ডিশন। তাদের সাথে ডাইরেক্ট ইনট্রোডাকশন করতে পারবে না”।
পুরুষ কন্ঠ বলল, “কথায় কথায় তুমি এত কণ্ডিশন রাখছ কেন বল তো ডার্লিং? তাকে আমার শ্যালক বানাবার স্বপ্নটা তো তুমি শুরুতেই ভেঙে দিয়েছ। এখন আমার বান্ধবীর দাদার সাথেও পরিচয় করতে পারব না? ওকে বাবা। তোমার এ কণ্ডিশনও মেনে চলব আমি”।
সীমন্তিনী বলল, “ওকে, আমি তোমাকে এসএমএস করে পাঠাচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যেই। রাতে বাকি কথা হবে, এখন রাখছি” বলে ফোন কেটে দিল। পরপর তিন খানা এসএমএস পাঠিয়ে সে টেবিলের ওপরে রাখা কলিং বেলের সুইচ টিপতেই একজন কনস্টেবল তার কেবিনে ঢুকে স্যালিউট ঠুকে বলল, “ইয়েস ম্যাম”।
সীমন্তিনী তাকে বলল, “রমেনবাবুকে একটু আমার কেবিনে আসতে বল তো। ইটস আর্জেন্ট”।
কনস্টেবলটা সেলাম ঠুকে বেরিয়ে যেতেই সীমন্তিনী ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা ফাইল বের করে দেখতে লাগল। একটু পরেই একজন তার কেবিনের দরজায় এসে স্যালিউট ঠুকতেই সীমন্তিনী তাকে ভেতরে ডেকে বলল, “রমেন বাবু। আপনার কেবিনে কি এখন আর অন্য কেউ আছে”?
রমেনবাবু জবাব দিল, “না ম্যাম, আমি একাই আছি”।
সীমন্তিনী ফাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিন। আমি মোটামুটি ফাইনাল শেপ দিয়ে দিয়েছি। আপনি শেষ বারের মত গোটা রিপোর্টটায় একটু চোখ বুলিয়ে দেখুন, কোথাও কোন মিস্টেক আছে কিনা। আর আপনি তো জানেনই, কেসটা কতটা কনফিডেন্সিয়াল। তাই সতর্ক থাকবেন। অন্য কেউ যেন এটা দেখার সুযোগ না পায়। কাজটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কমপ্লিট করুন। আর কোথাও কোন অসংগতি চোখে পড়লে সে পয়েন্টগুলো আলাদা নোট করে আমাকে দেখাবেন। আর বিকেল পাঁচটার আগেই এটা নিয়ে আপনাকে এসপি অফিসে যেতে হবে। খোদ এসপি স্যারের হাতে ডেলিভারি দিয়ে আসবেন। বুঝেছেন”?
রমেনবাবু ফাইলটা হাতে নিয়ে স্যালিউট ঠুকে বলল, “ওকে ম্যাম” বলে চলে গেল।
সীমন্তিনী এবার তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাড়ির নম্বর ডায়াল করতেই ও’পাশ থেকে সতীশের গলা পেল। সীমন্তিনী ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল বিকেল তিনটে। একটু অবাক হয়ে বলল, “ভাই তুই এ’সময় বাড়িতে”?
সতীশ সীমন্তিনীর গলা শুনে খুশী হয়ে বলল, “বড়দি তুই? তুই কেমন আছিস দিদি”?
সীমন্তিনী বলল, “আমি তো ঠিকই আছি ভাই। কিন্তু তুই এ’সময় বাড়িতে কেন রে? তোর তো এখন জলপাইগুড়ি থাকবার কথা! তুই ভাল আছিস তো ভাই”?
সতীশ জবাব দিল, “কাল আমাদের কলেজ ছুটি। আজও শুধু একটাই ক্লাস হয়েছে। তাই মা বাড়ি আসতে বলেছিলেন। আধঘন্টা আগেই আমি বাড়ি এসেছি। আর তুই ভাবিস না, আমি ভাল আছি বড়দি”।
সীমন্তিনী বলল, “ভাই শোন না, আমি এখন অফিসে আছি। তোর সাথে পরে কথা বলব। এখন একটু বড়মাকে ডেকে দে না ভাই। খুব দরকারী একটা কথা বলার আছে রে”।
সতীশ বলল, “হ্যা দিচ্ছি বড়দি, তুই একটু লাইনে থাক। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি”।
প্রায় মিনিট খানেক বাদে সরলাদেবী ফোন ধরে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে মন্তি? তুই তো কখনও এমন সময় ফোন করিসনা রে! সব ঠিক আছে তো? তুই ভাল আছিস তো মা”?
সীমন্তিনী বলল, “বড়মা তুমি শান্ত হও। আমি ঠিক আছি গো। এখন অফিসে আছি। একটা কথা তোমাকে এখনই জানানো দরকার বলেই এ’সময় ফোন করছি। শোনো বড়মা। দাদাভাই আর রচুর সাথে আমার একটু আগে কথা হয়েছে। ওরা ভাল আছে। তবে দাদাভাইয়ের কাজটা হয়নি। আমি মোটামুটি শুনেছি। কিন্তু এখন তোমাকে সবটা খুলে বলতে পারছি না। রাতে তোমাকে সব বলব। তোমাকে শুধু এটা জানাবার জন্যেই ফোন করেছি যে, রচু দাদাভাইকে নিয়ে ম্যাটিনী শোর সিনেমা দেখতে গেছে। তাই সন্ধ্যে পর্যন্ত ওদের দু’জনের ফোন বন্ধ থাকবে। সন্ধ্যের পর তুমি ওদের ফোন কোরো”।
সরলাদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “ওরা দু’জন সিনেমা দেখতে গেছে! কাল রতুটার শরীর ভাল ছিল না, আর আজ ওরা সিনেমায় গেল”?
সীমন্তিনী বলল, “বড়মা সব কথা আমি অফিস থেকে বেরোবার পর তোমাকে বলব। এখন অফিসে বসে সে সব বলতে পাচ্ছি না। কিন্তু তুমি চিন্তা কোর না। দাদাভাইয়ের শরীর ঠিক আছে। কাল কাজটা হয়নি বলেই ওর মনটা একটু খারাপ ছিল। আর ওর মনটা ভাল করবার জন্যে আমিই ওদেরকে বলেছি সিনেমা দেখতে যেতে। তুমি ফোন করলে ওদের দু’জনের ফোন বন্ধ দেখে দুশ্চিন্তা করবে বলেই কথাটা তোমায় জানিয়ে দিচ্ছি আমি। এবার বুঝেছ তো? আচ্ছা ছাড়ছি এখন। রাতে কথা হবে”।
থানা থেকে বেরিয়ে অটোয় চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রচনা সীমন্তিনীকে এসএমএস পাঠাল “অনেক কথা আছে। সময় হাতে নিয়ে ফোন কোর”। বাড়ি এসে রচনা পোশাক বদলে কিচেনে ঢুকে পড়ল। রান্না শেষ হল বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। দু’জনে একসাথে খেয়েদেয়ে বসবার ঘরে এসে বসল। দুপুরে ঘুমনোর অভ্যাস তাদের কারোরই নেই। রচনা সোফায় বসে রতীশকে টেনে নিজের কোলের ওপর শোয়াতে শোয়াতে বলল, “আচ্ছা সোনা, রবিশঙ্কর তো প্রতি মাসেই দু’বার করে ছোটকাকুর দোকানে যেত। তোমার কি মনে হয় ওর কোন ছবি সেখানে থাকতে পারে”?
রতীশ রচনার কোলে মাথাটা ভাল করে পেতে নিয়ে বলল, “জানিনে রচু। কিন্তু আমি তো কখনও এমন কোন ছবি দেখিনি”।
রচনা মনে মনে ভাবতে ভাবতে বলল, “ছোটকাকুর সাথে কথা বলতে হবে। তিনি হয়ত ভাল বলতে পারবেন। আর তাছাড়া রবিশঙ্কর যে ছোটকাকুর দোকানে মালপত্র সাপ্লাই করত, তাতে কলকাতার যে’সব কোম্পানীর সাথে রবিশঙ্কর ব্যবসা করে, সেসব কোম্পানীর কিছু ক্যাশমেমো, ভাউচার বা আরো কিছু ডকুমেন্ট ছোটকাকুর কাছে থাকতে পারে। সে’সব যদি আমরা পুলিশকে দিতে পারি, তাহলে তারা সে’সব জায়গায় রবিশঙ্করের খোঁজ করতে পারবে। তবে সবার আগে দিদিভাইয়ের সাথে কথা বলে নিই। দেখি দিদিভাই কী বলেন। আর দিদিভাইকেই বলব বাড়িতে ঘটণাটা যেন তিনিই জানিয়ে দেন”।
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে থাকবার পর রতীশ বলল, “তোমাকে আরেকটা কথা বলছি সোনা। দেখ, যে আশা নিয়ে এখানে এসেছি সে আশা তো শুধু স্বপ্ন হয়েই রইল। কিন্তু এখন আমাদের কী করা উচিৎ বল তো? আমরা কি বাড়ি ফিরে যাব? আর ফিরে গিয়ে করবই বা কি? কলেজের চাকরিটা তো আর আমি ফিরে পাব না। সেখানে ফিরে গেলে তো বাবা কাকুদের দোকানেই বসতে হবে। নিজে কোন দোকান খুলে বসতে চাইলেও তো আবার বাবা কাকুদের কাছেই হাত পাততে হবে। কিন্তু সেটা কি উচিৎ হবে বল? নিজের কাছে যা আছে তাতে কয়েক মাস সংসার চালানোর খরচটাই কুলোতে পারব। বাবা আর কাকুরা মিলে যে চার লাখ টাকা আমাকে দিয়েছিলেন তার দু’লাখ টাকা তো লুটই হয়ে গেল। ঘরের ফার্নিচারগুলো কিনতে একলাখ খরচ হয়ে গেছে। তাই সেখান থেকে একলাখ টাকাই শুধু হাতে আছে। আর নিজের একাউন্ট থেকে তুলে আনা হাজার পঞ্চাশেক আছে। এই দেড়লাখ দিয়ে কিছু একটা করতে চাইলে সংসার খরচ সামলানো মুস্কিল হয়ে পড়বে। কি করব তাহলে”?
রচনা বলল, “আমি তো গরীবের ঘরের মেয়ে সোনা। আলুসেদ্ধ ডাল ভাত খেয়েও আমি দিনের পর দিন থাকতে পারব। প্রয়োজন হলে মাঝে সাঝে উপোষ করেও থাকতে পারব। কিন্তু তোমাকে তো আমি উপোষী রাখতে পারব না গো। তাই আমার মনে হয়, এ দেড়লাখ টাকা দিয়ে তুমি যদি রাজগঞ্জে কোন ব্যবসা খুলে বসতে পার, তাহলে না হয় সেটাই কর। বাড়িতে আপনজনদের সাথে থেকে আমরা সব কিছু মানিয়ে নিতে পারব”।
রতীশ বলল, “রাজগঞ্জের মত জায়গায় দেড় লাখ টাকায় ছোটখাট একটা ব্যবসা খুলে বসাই যায়। কিন্তু সোনা, সেখানে গেলে তো আবার আমাদের সংসার খরচ আমাদের যৌথপরিবারের ওপরই বর্তাবে। বিয়ের পর এই তিনটে বছরে ওভাবে থাকতে আমার খুব খারাপ লাগছিল বলেই না এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আবার আগের পরিস্থিতিতেই ফিরে যেতে হবে! আর তাছাড়া যোগা ইনস্টিটিউট খোলার স্বপ্ন আমার কখনোই সফল হবে না। আবার দেখ, আসবার সময় আমাদের এত আসবাব পত্র ছিল না। এসব জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হলে তো তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা এমনিতেই খরচ হয়ে যাবে। যখন বাড়ি গিয়ে পৌঁছব তখন হাতে হয়ত মাত্র একলাখ টাকাই থাকবে। সেটুকু হয়ত নতুন ব্যবসা খোলার পক্ষে যথেষ্ট হবে না। আবার বাবা কাকুদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা চাইতে হবে। আমার যে খুব লজ্জা করবে”।
রচনা জিজ্ঞেস করল, “এছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে মনে হয় তোমার”?
রতীশ বলল, “একটা উপায় আছে হয়ত। তবে সেটাও এখনই নিশ্চিত করে বলতে যাচ্ছে না। তবে শোনো। কাল রাতে বিমল আগরওয়ালার সাথে কথা বলে চলে আসবার আগে তিনি আমাকে একটা কথা বলেছেন। তার কোন এক বন্ধুর নাকি দক্ষিন কলকাতায় একটা যোগা ইনস্টিটিউট আছে। সেখানে কয়েকজন টিচার থাকলেও তিনি নাকি একজন ভাল যোগা টিচারের খোঁজ করছেন। বিমলজী বললেন যে আমি চাইলে তিনি আমাকে সেখানে যোগা টিচার হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। মাসে হয়ত কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের মত বেতন পাব। অবশ্য ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে কুড়ি হাজার টাকায় সংসার চালাতে টানাটানিই হবে। তবু আমি আমার লাইনেই থাকতে পারব। আর কিছুদিন সেখানে কাজ করলে আমি কলকাতার এ লাইনের লোকজনের সংস্পর্শে আসতে পারব। তাতে ভবিষ্যতে একটা যোগা সেন্টার খুলতে সুবিধে হবে আমার”।
রচনা শুনে বলল, “বিমল আগরওয়ালা? মানে যে তোমার ওই কমপ্লেক্সটার আসল মালিক”?
রতীশ সায় দিয়ে বলল, “হ্যা রচু সে-ই”।
রচনা একটু ভেবে বলল, “এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাদের ভাল করে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে সোনা। এই বিমল আগরওয়ালা লোকটাকে আমার একেবারেই ধোয়া তুলসীপাতা বলে মনে হচ্ছে না। সে কিছু করুক আর না করুক, আমাদের এ সর্বনাশের পেছনে তার নামটা কিন্তু জড়িয়ে আছে। আচ্ছা সোনা একটা কথা ভেবে দেখ তো। রবিশঙ্কর বা ওই লোকটার সাথে বিমল আগরওয়ালার যদি কোন পরিচয়ই না থেকে থাকে, তাহলে লোকটা ওই কমপ্লেক্স খুলে তার ভেতর তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল কী করে? বিমল আগরওয়ালা তোমার কাছে স্বীকার না করলেও, যে তালার চাবি তার লকারে লুকনো থাকে, সে চাবিটা ওই ঠকবাজ লোকটা পায় কি করে? অবশ্য তাকে যদি পুলিশ জেরা করে তাহলে সে হয়ত বলতে পারে যে কেউ হয়ত একটা নকল চাবি বানিয়ে কাজটা করেছে। কিন্তু আমি কিন্তু তার কথাগুলো পুরো বিশ্বাস করতে পারছি না”।
রতীশ বলল, “যে প্রশ্নটা তুমি তুলছ তা হবার সম্ভাবনা যে থাকতে পারে, এমন কথা তো আমার মনেও এসেছিল। তাই আমি দ্বিতীয়বার তার সাথে দেখা করতে তার অফিসে গিয়েছিলুম মূলতঃ এ প্রশ্নের জবাব নিতেই। কিন্তু লোকটার সাথে কথা বলে শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে তিনি এ ঘটণার সাথে জড়িত নন। তিনি তো নিজে মুখেই কথাটা স্বীকার করেছেন যে এ ঘটণায় তার নামটা জড়িয়ে গেছে বলেই তিনি আমার জন্য দুঃখ পাচ্ছেন। তাই তিনি আমাকে তার বন্ধুর ওখানে কাজ পাইয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। আর তিনি নিজেই বললেন যে তার ব্যাপারেও যেন আমি পুলিশকে সব কিছু খুলে বলি। তিনি নিজে যদি এ ঘটানার সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে কি আর এমন কথা বলতেন”?
রচনা বলল, “হ্যা সে কথা ঠিক। তবে তার বন্ধুর ওখানে কাজ নেবার ব্যাপারে আমরা আগে দিদিভাইয়ের সাথে একটু কথা বলে নিই। নিজেরাও একটু ভেবে দেখি দু’চার দিন। তারপর না হয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব আমরা। আর শুধু দিদিভাইই নয়, বাবা কাকুদের সাথেও আমাদের এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। তারা তো আজ রাতে সব ঘটণা শুনেই আমাদের মতই হাঁ হুতোশ করতে শুরু করবেন। তাদের না জানিয়ে তাদের কাছে লুকিয়ে আলাদা করে কোন সিদ্ধান্ত নিলে যে তাদের অসম্মান করা হবে সোনা। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি বলে আমরা কি তাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছি? তারাই তো আমাদের আপনজন। তারাও যেমন সব সময় আমাদের কথা ভাবেন, তেমনই সারাটা দিন ধরে আমিও যে শুধু তাদের কথাই ভাবি গো। তুমি তো এখানে আসবার পর থেকে এখানে ওখানে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছ। আমি একা একা ঘরে বসে কি করব? সারাক্ষণ বাড়ির সকলের কথা ভাবি। বাবা কাকুরা সময় মত খাওয়া দাওয়া করছেন কিনা। মায়েরা, ভাই বোনেরা আমাদের কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছে কিনা, চন্দু চঞ্চু ওরা কে কি করছে, এ’সবই তো ভাবতে থাকি আমি” বলতে বলতে রচনার গলা ধরে এল। চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
রতীশ বলল, “জানি সোনা। তিনবছর আগে আমার বৌ হয়ে আমাদের বাড়ি এসেই তুমি বাড়ির সবাইকে এমনভাবে ভালবেসে ফেলেছ যে আমি অবাক না হয়ে পারিনি। নিজের বাবা মাকে ছেড়ে এসে একটা দিনও তোমাকে বাড়ির কেউ মুখ ভার করে থাকতে দেখেনি। আর কোন নতুন বৌ শ্বশুর বাড়ির সকলকে এত তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পেরেছে বলে আমি শুনিনি কখনও”।
রচনা নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, “সবটাই হয়েছে শুধু আমার দিদিভাইয়ের জন্যে। বিয়ের এক বছর আগে থেকেই দিদিভাই আমাকে মোবাইল দেবার পর থেকেই তো বাড়ির সকলের সাথে আমার রোজ কথা হত। আর আমাদের বাড়ির সকলেই এত ভাল যে বিয়ের আগেই তারা ফোনে ফোনেই আমার আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। আমি তো অপরিচিতদের মাঝে এসে পড়িনি। তাই বিয়ের পর আমার কোন সমস্যাও হয়নি। আজ তাদের কাছ থেকে অনেক দুরে চলে এলেও আমি জানি বাবা, কাকুরা, মায়েরা আর ভাইবোনেরা সকলেই আগের মতই আমাদের ভালবাসছে। আমাদের কথা ভাবছে। আমিও দু’বেলা ঠাকুরের কাছে তাদের সকলের জন্য প্রার্থনা করি। তাদের বাদ দিয়ে আমাদের কী আলাদা কোন অস্তিত্ব আছে”?
দুপুর দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট আগেই সীমন্তিনীর ফোন এল। সে জিজ্ঞেস করল, “হ্যারে রচু? অমন একটা এসএমএস পাঠিয়েছিস কেন রে? কোন রকমে একটা অপারেশন শেষ করেই ক্যান্টিনে চলে এসেছি। বল তো শুনি, কি খবর”?
রচনা জিজ্ঞেস করল, “তুমি দুপুরের খাবারটা আগে খেয়ে নাও দিদিভাই। আমি দশ মনিট বাদে তোমাকে ফোন করছি”।
সীমন্তিনী বলল, “না না রচু, ফোন কাটিস নে। আমি খাওয়া শুরু করছি। তুই বলতে শুরু কর। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারব না রে বোন। প্লীজ লক্ষ্মী বোন আমার। তুই বল না। আমি তোর দিব্যি খেয়ে বলছি, আমি খেতে খেতেই তোর কথা শুনতে থাকব”।
রচনা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। শোনো দিদিভাই” বলে রচনা আদ্যোপান্ত সব খুলে বলল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে প্রথম থেকে শুরু করে থানায় গিয়ে রিপোর্ট করা পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলল। সীমন্তিনী খেতে খেতে মাঝে মধ্যে হু হা করে সাড়া দিয়ে সবটা শুনে বলল, “ইশ এ শয়তান রবিশঙ্করটা এত বছর ধরে কাকুর সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছিল, আর কাকুরা কেউ তাকে চিনতে পারেনি! আমি তো ভেবেই অবাক হচ্ছি রে। তবে শোন রচু, তোর কথা শুনতে শুনতে আমার খাওয়াও শেষ হয়ে গেছে, আর আমাকে আরও কিছু দরকারী কাজ সারতে হবে সন্ধ্যের মধ্যে। তাই এখন আমি কথা শেষ করে আমার কেবিনে যাচ্ছি। আমি পাঁচটার পর ফ্রি হয়েই তোকে আবার ফোন করব। তখন বাকি সব কথা হবে। আর শোন, আপাততঃ তোরা বাড়িতে কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস না। আমি সন্ধ্যের পর কাকুর সাথে আগে কথা বলব। কাকুকে বুঝিয়ে বলব যাতে ধীরে সুস্থে সবাইকে ব্যাপারটা বলে। নইলে সবাই মিলে হুলুস্থুল শুরু করে দেবে”।
রচনা বলল, “কিন্তু দিদিভাই মামনি তো বারবার করে জানতে চাইছেন। তিনিও তো কাল থেকে খুব উতলা হয়ে রয়েছেন। সকালেও ফোন করেছিলেন। তখন আমিও ঘটণাটা শুনিনি বলে তাকে বলেছি যে আমি জানতে পারলেই তাকে সব কিছু জানাব। আমরা ফোন না করলেও তিনি তো নিজেই হয়ত আরেকটু বাদেই ফোন করবেন। তাকে মিথ্যে কথা কী করে বলব আমি”?
সীমন্তিনী বলল, “শোন, তোর আর দাদাভাইয়ের ফোন সুইচ অফ করে রাখ এখনই। তারপর দাদাভাইকে একটু ঘুমিয়ে নিতে বল। সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটার পর তোরা ফোন অন করবি। তার আগেই আমি বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেব। তারপর তারা ফোন করলে তখন কথা বলিস। বা নিজেরাও ফোন করতে পারিস”।
রচনা বলল, “কাল তোমার দাদাভাইয়ের ফোন সুইচ অফ পেয়েই মামনি যা চিন্তা করছিলেন। আজ দু’জনের ফোন সুইচ অফ থাকলে তো তার আরও চিন্তা হবে দিদিভাই”।
সীমন্তিনী বলল, “সেটা নিয়ে তুই ভাবিস না। আমি বাড়িতে এখনই ফোন করে তাদের বলে দিচ্ছি যে তোরা দু’জন ম্যাটিনি শোর সিনেমা দেখতে গিয়েছিস। তাই তোদের দু’জনের ফোনই বন্ধ থাকবে সন্ধ্যে ছ’টা অব্দি। তাহলে তারা কেউ আর চিন্তা করবেন না”।
রচনা আবার বলল, “তাহলে কথা তো সেই একই দাঁড়াচ্ছে। সন্ধ্যের পর মামনিকে আমাদের মিথ্যে কথাই বলতে হচ্ছে। না দিদিভাই, আমি সেটা পারব না গো। অন্য কোন বুদ্ধি বের কর তুমি”।
সীমন্তিনী অধৈর্য ভাবে বলল, “আরে পাগলী মেয়ে, তোকে মিথ্যে কথা বলতে হবে না রে। আমি সন্ধ্যের আগেই বড়মাকে জানিয়ে দেব যে আমার কথাতেই তোরা ফোন বন্ধ করে রেখেছিলিস। তোরা কেউ সিনেমা টিনেমা দেখতে যাস নি। তোরা সত্যি কথাই বলিস। বলিস যে আমার কথাতেই তোরা ফোন বন্ধ রেখেছিলিস। এবার হল তো? আচ্ছা রাখছি আমি। কাজগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করবার চেষ্টা করি গিয়ে। আর সন্ধ্যের পর তোদের সাথে আবার কথা বলব। তুই ছ’টা নাগাদ ফোন অন করে সবার আগে আমাকে ফোন করবি” বলে ফোন কেটে দিল।
****************
নিজের কেবিনে এসেই সীমন্তিনী তার নিজস্ব ফোন থেকে একজনকে ফোন করল। দু’বার রিং হতেই ও’পাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল, “কী সৌভাগ্য আমার! অধরা রূপসী মুন ডার্লিং আমায় ফোন করেছে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পাচ্ছি না”!
সীমন্তিনী গম্ভীর গলায় জবাব দিল, “প্লীজ পরি, ঠাট্টা রাখো। একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমাকে অফিস থেকেই ফোন করছি। তাই আজেবাজে কথা ছেড়ে মন দিয়ে আমার কথাটা শোনো প্লীজ”।
ও’পাশ থেকে সেই পুরুষ কণ্ঠটি এবার সতর্ক গলায় বলল, “তুমি ঠিক আছ তো মন্তি? কোন বিপদ হয়নি তো তোমার”?
সীমন্তিনী বলল, “আমি ঠিক আছি পরি। আর কোন প্রশ্ন না করে চুপ করে আমার কথাটা শোনো প্লীজ। আমার হাতে সময় খুব কম। আমার দাদাভাই তিন চারদিন আগে কলকাতা গেছে। সাথে তার স্ত্রীকেও নিয়ে গেছে। সেখানে সে একটা যোগা কোচিং সেন্টার খুলবে বলে গেছে। বরানগরে তারা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে খানিকটা দুরেই একটা কমপ্লেক্স দু’লাখ টাকায় এক বছরের জন্য লিজ নেবার কথা ছিল। রবিশঙ্কর প্রসাদ নামের আমার কাকুর পরিচিত একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ তাকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করছিল। গত পরশু রবিশঙ্কর আর অন্য আরেকজন মিলে আমার দাদাভাইয়ের কাছ থেকে দু’লাখ টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। অন্য লোকটাকে কমপ্লেক্সের মালিক সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। গতকাল দুপুরে দাদাভাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। ততক্ষণে পাখি ফুড়ুৎ হয়ে গেছে। আজ লোকাল থানায় ডাইরী করা হয়েছে একটা। তবে রবিশঙ্কর যেখানে ভাড়া থাকত সে ঠিকানা থেকে সরে গেছে। আর কমপ্লেক্সের মালিক সেজে যে লোকটা এসেছিল তার আসল নাম ঠিকানা দাদাভাই জানতেই পারেনি। তাই বুঝতেই পারছ কেসটা অফিসিয়ালি ডিল করা কতটা অসম্ভব। তাই তোমার কাছে আমি কি চাইছি সেটা আশা করি তুমি বুঝতে পারছ”।
ও’পাশের পুরুষ কন্ঠ বলল, “তুমি ভেবো না মুন ডার্লিং। ওরা দু’জন পৃথিবীর যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন আমার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তবে কলকাতার বাইরে চলে গেলে সময়টা একটু বেশী লাগবে সেটা তো বুঝতেই পারছ। তুমি শুধু রবিশঙ্করের পুরনো বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে জানিয়ে দাও। আর তার চেহারার ডেসক্রিপশানটা এসএমএস করে দাও আমাকে। বাই দি বাই, একটা প্রশ্ন করতে পারি”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “ওকে, তবে আপাতত শুধু একটাই প্রশ্ন নেব আমি। কাজের খুব চাপ আছে। বলো”।
ও’পাশ থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, “ইনিই কি তোমার সেই দাদাভাই”?
সীমন্তিনী খুব শান্তভাবে জবাব দিল, “কিপ ইট ফুললি কনফিডেন্সিয়াল। হ্যা”।
ও’পাশ থেকে পুরুষ কন্ঠটি এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, “শালারা ভীমরুলের চাকে ঘা মেরেছে! ওদের পরমায়ু বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে”।
সীমন্তিনী বলল, “না পরি, নো এনকাউন্টার প্লীজ। আমি শুধু চাই ওদের কাছ থেকে টাকাটা ফিরে পেতে। তবে ছোটখাটো শাস্তি তুমি দিতেই পার, যাতে এমন ঘটণার পুনরাবৃত্তি করতে তাদের বেশ কয়েকবার ভাবতে হয়”।
ও’পাশের পুরুষ কন্ঠ এবার কিছুটা সংযত গলায় বলল, “তোমার আদেশ শিরোধার্য দেবী। কিন্তু দয়া করে তোমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা একটু জানাবে”?
সীমন্তিনী বলল, “দিতে পারি। কিন্তু অন ওয়ান কণ্ডিশন। তাদের সাথে ডাইরেক্ট ইনট্রোডাকশন করতে পারবে না”।
পুরুষ কন্ঠ বলল, “কথায় কথায় তুমি এত কণ্ডিশন রাখছ কেন বল তো ডার্লিং? তাকে আমার শ্যালক বানাবার স্বপ্নটা তো তুমি শুরুতেই ভেঙে দিয়েছ। এখন আমার বান্ধবীর দাদার সাথেও পরিচয় করতে পারব না? ওকে বাবা। তোমার এ কণ্ডিশনও মেনে চলব আমি”।
সীমন্তিনী বলল, “ওকে, আমি তোমাকে এসএমএস করে পাঠাচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যেই। রাতে বাকি কথা হবে, এখন রাখছি” বলে ফোন কেটে দিল। পরপর তিন খানা এসএমএস পাঠিয়ে সে টেবিলের ওপরে রাখা কলিং বেলের সুইচ টিপতেই একজন কনস্টেবল তার কেবিনে ঢুকে স্যালিউট ঠুকে বলল, “ইয়েস ম্যাম”।
সীমন্তিনী তাকে বলল, “রমেনবাবুকে একটু আমার কেবিনে আসতে বল তো। ইটস আর্জেন্ট”।
কনস্টেবলটা সেলাম ঠুকে বেরিয়ে যেতেই সীমন্তিনী ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা ফাইল বের করে দেখতে লাগল। একটু পরেই একজন তার কেবিনের দরজায় এসে স্যালিউট ঠুকতেই সীমন্তিনী তাকে ভেতরে ডেকে বলল, “রমেন বাবু। আপনার কেবিনে কি এখন আর অন্য কেউ আছে”?
রমেনবাবু জবাব দিল, “না ম্যাম, আমি একাই আছি”।
সীমন্তিনী ফাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিন। আমি মোটামুটি ফাইনাল শেপ দিয়ে দিয়েছি। আপনি শেষ বারের মত গোটা রিপোর্টটায় একটু চোখ বুলিয়ে দেখুন, কোথাও কোন মিস্টেক আছে কিনা। আর আপনি তো জানেনই, কেসটা কতটা কনফিডেন্সিয়াল। তাই সতর্ক থাকবেন। অন্য কেউ যেন এটা দেখার সুযোগ না পায়। কাজটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কমপ্লিট করুন। আর কোথাও কোন অসংগতি চোখে পড়লে সে পয়েন্টগুলো আলাদা নোট করে আমাকে দেখাবেন। আর বিকেল পাঁচটার আগেই এটা নিয়ে আপনাকে এসপি অফিসে যেতে হবে। খোদ এসপি স্যারের হাতে ডেলিভারি দিয়ে আসবেন। বুঝেছেন”?
রমেনবাবু ফাইলটা হাতে নিয়ে স্যালিউট ঠুকে বলল, “ওকে ম্যাম” বলে চলে গেল।
সীমন্তিনী এবার তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাড়ির নম্বর ডায়াল করতেই ও’পাশ থেকে সতীশের গলা পেল। সীমন্তিনী ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল বিকেল তিনটে। একটু অবাক হয়ে বলল, “ভাই তুই এ’সময় বাড়িতে”?
সতীশ সীমন্তিনীর গলা শুনে খুশী হয়ে বলল, “বড়দি তুই? তুই কেমন আছিস দিদি”?
সীমন্তিনী বলল, “আমি তো ঠিকই আছি ভাই। কিন্তু তুই এ’সময় বাড়িতে কেন রে? তোর তো এখন জলপাইগুড়ি থাকবার কথা! তুই ভাল আছিস তো ভাই”?
সতীশ জবাব দিল, “কাল আমাদের কলেজ ছুটি। আজও শুধু একটাই ক্লাস হয়েছে। তাই মা বাড়ি আসতে বলেছিলেন। আধঘন্টা আগেই আমি বাড়ি এসেছি। আর তুই ভাবিস না, আমি ভাল আছি বড়দি”।
সীমন্তিনী বলল, “ভাই শোন না, আমি এখন অফিসে আছি। তোর সাথে পরে কথা বলব। এখন একটু বড়মাকে ডেকে দে না ভাই। খুব দরকারী একটা কথা বলার আছে রে”।
সতীশ বলল, “হ্যা দিচ্ছি বড়দি, তুই একটু লাইনে থাক। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি”।
প্রায় মিনিট খানেক বাদে সরলাদেবী ফোন ধরে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে মন্তি? তুই তো কখনও এমন সময় ফোন করিসনা রে! সব ঠিক আছে তো? তুই ভাল আছিস তো মা”?
সীমন্তিনী বলল, “বড়মা তুমি শান্ত হও। আমি ঠিক আছি গো। এখন অফিসে আছি। একটা কথা তোমাকে এখনই জানানো দরকার বলেই এ’সময় ফোন করছি। শোনো বড়মা। দাদাভাই আর রচুর সাথে আমার একটু আগে কথা হয়েছে। ওরা ভাল আছে। তবে দাদাভাইয়ের কাজটা হয়নি। আমি মোটামুটি শুনেছি। কিন্তু এখন তোমাকে সবটা খুলে বলতে পারছি না। রাতে তোমাকে সব বলব। তোমাকে শুধু এটা জানাবার জন্যেই ফোন করেছি যে, রচু দাদাভাইকে নিয়ে ম্যাটিনী শোর সিনেমা দেখতে গেছে। তাই সন্ধ্যে পর্যন্ত ওদের দু’জনের ফোন বন্ধ থাকবে। সন্ধ্যের পর তুমি ওদের ফোন কোরো”।
সরলাদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “ওরা দু’জন সিনেমা দেখতে গেছে! কাল রতুটার শরীর ভাল ছিল না, আর আজ ওরা সিনেমায় গেল”?
সীমন্তিনী বলল, “বড়মা সব কথা আমি অফিস থেকে বেরোবার পর তোমাকে বলব। এখন অফিসে বসে সে সব বলতে পাচ্ছি না। কিন্তু তুমি চিন্তা কোর না। দাদাভাইয়ের শরীর ঠিক আছে। কাল কাজটা হয়নি বলেই ওর মনটা একটু খারাপ ছিল। আর ওর মনটা ভাল করবার জন্যে আমিই ওদেরকে বলেছি সিনেমা দেখতে যেতে। তুমি ফোন করলে ওদের দু’জনের ফোন বন্ধ দেখে দুশ্চিন্তা করবে বলেই কথাটা তোমায় জানিয়ে দিচ্ছি আমি। এবার বুঝেছ তো? আচ্ছা ছাড়ছি এখন। রাতে কথা হবে”।
(To be cont'd .....)
______________________________