26-02-2020, 08:23 PM
(Update No. 64 dt. 29.7.2018)
খাওয়া শেষে রচনা বলল, “সোনা, একটু সামনের ঘরে গিয়ে বস। আমি হাতটা ধুয়েই বিছানাটা পেতে দিচ্ছি” বলে হাত ধুয়েই বেডরুমে এসে বিছানা ঝেড়ে ভাল করে পেতে দিয়ে বসবার ঘরে গিয়ে রতীশের হাত ধরে বলল, “চল, বিছানা হয়ে গেছে। তুমি শুয়ে পড়। আমি রান্নাঘরের কাজটুকু সেরে পরে আসছি”।
রতীশ বিছানায় এসে বসে রচনার একটা হাত আঁকড়ে ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল, “আই এম সরি সোনা, তোমাকে আজ অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি”।
রচনা স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল, “কিচ্ছু হয়নি সোনা। আর এখন কিছু বলতেও হবে না। চুপ করে শুয়ে পড়। ভাল করে ঘুমোও। কাল সকালে যা বলার বলো”।
রতীশ আর কথা না বলে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। আধঘন্টা বাদে রচনা একটা নাইটি পড়ে বিছানায় এসে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়ল। অন্য দিন রতীশ বিছানায় শুয়েই রচনার নাইটির সামনের বোতামগুলো খুলে ফেলে। রচনা শোবার সময় ভেতরে কোন অন্তর্বাস রাখে না। রচনার খোলা বুকে কিছুক্ষণ মুখ গুঁজে রেখেই সে যৌবনের খেলা খেলতে শুরু করে দেয়। রচনাও মনে প্রাণে স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু আজ ক্লান্ত দেহ আর মন নিয়ে রতীশ যে কিছু করবে সেটা রচনা আশা করছে না। তাই সে নিজেই নিজের নাইটির বোতামগুলো খুলে ফেলে তার উন্মুক্ত বুকে স্বামীর মুখটা চেপে ধরে তার গলা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজল। কিন্তু ঘুম যে তার এত তাড়াতাড়ি আসবে না, এটা তার জানাই ছিল। স্বামীর ওপর দিয়ে আজ সকাল থেকে নাজানি কত ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেছে, এসব কথাই সে ভাবতে লাগল।
এক সময় হঠাৎ রচনার মনে হল তার বুকের ত্বক যেন ভেজা ভেজা। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চিন্তার জাল ছিন্ন করে ভাল করে খেয়াল করে বুঝল হ্যা ঠিক তাই। এক কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে সে রতীশের মুখটাকে বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখে তার দুটো স্তনের মাঝের বিভাজিকাটা জলে ভেজা। চমকে উঠে বেডল্যাম্পটা জ্বালাতেই দেখে রতীশের দু’গাল বেয়ে অঝোর ধারায় চোখের জল পড়ছে। রচনা দু’হাতে স্বামীর মুখটা অঞ্জলি করে ধরে জিজ্ঞেস করল, “এ কী সোনা? তুমি কাঁদছ কেন গো? কী হয়েছে সোনা? আমি কি নিজের অজান্তেই তোমাকে কোন দুঃখ দিয়ে ফেলেছি? বল না গো। লক্ষ্মীটি প্লীজ বল, কী হয়েছে তোমার”।
রতীশ ছোট শিশুর মত রচনাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার এ অপদার্থ স্বামীটাকে ক্ষমা করে দিও তুমি রচু। আমি তোমার আর আমার মন্তির বিশ্বাসভঙ্গ করে ফেলেছি”।
রচনা পরম ভালবাসায় স্বামীর মুখটাকে আবার নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “চুপ, চুপ কর সোনা। এখন কিচ্ছু বলতে হবে না। অনেক রাত হয়ে গেছে। আর তুমি এখন সত্যি খুব ক্লান্ত। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর। কাল সকালে উঠে সব কিছু শুনব’খন। লক্ষ্মী সোনা আমার। এখন আর একটাও কথা বলো না” বলতে বলতে রতীশের মুখটাকে নিজের নরম বুকে চেপে ধরল। রতীশও অসহায়ের মত রচনাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ চেপে রইল।
রচনা অনেকক্ষণ ধরে রতীশের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল নিজের মনে মনে। অনেকক্ষন বাদে তার মনে হলে রতীশের শরীরটা আর কান্নার আবেগে ফুলে ফুলে উঠছে না। সে তার হাতের আলিঙ্গন খানিকটা শিথিল করলেও দু’হাতে রতীশের গলা জড়িয়ে ধরে রইল। জেগে থাকতে থাকতে আর রতীশের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কখন যেন সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে সকাল ছ’টা নাগাদ রচনার ঘুম ভাঙল। নিজের বুকের দিকে চেয়ে দেখে রতীশ হাঁ করে তার একটা স্তনের ওপর মুখ রেখে ঘুমোচ্ছে। ভাল করে খেয়াল করে দেখল রতীশের ঘুম ভাঙে নি। সে আলতো করে রতীশের মাথার নিচ থেকে তার হাতটা বের করে তার মাথাটাকে বালিশের ওপর ভাল করে রেখে বিছানায় উঠে বসল। তারপর নিজের খোলা বুকটাকে ঢাকতে ঢাকতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। প্রাতঃকৃত্য সেরে দাঁত ব্রাশ করে স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে আলমারি খুলে ধোয়া শাড়ি ব্রা ব্লাউজ পড়ে ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঠাকুরকে প্রণাম করে মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করল, “হে ঠাকুর, আমার স্বামীর মনে শক্তি দাও। উনি যেন ভেঙে না পড়েন। যে বিপদই ঘটে থাকুক না কেন, উনি যেন সব ঝড় ঝাপটা সয়ে নিয়ে সোজা হয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে পারেন”।
ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে বিছানার কাছে এসে স্বামীর মাথায় আলতো করে হাত বোলাল রচনা। রতীশ গভীর ঘুমে। রচনা ইচ্ছে করেই তাকে জাগাল না। বাড়িতে থাকতে রতীশ রোজ ভোর পাঁচটা থেকে একঘন্টা যোগ চর্চা করত। কলকাতায় আসবার পর থেকে এ দু’তিন দিনে সে আর যোগচর্চা করবার সুযোগ পায়নি। নানান ব্যস্ততায় আর সেটা করতে পারেনি। কাল রাতেও বারোটা পর্যন্ত সে তার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছে। তারপর কিছুটা ঘুমিয়েছিল। সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু অনেক রাতে আবার তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন রতীশ আবার কাঁদছিল। কিন্তু সে বুঝতে পেয়েও রতীশকে বুঝতে দেয় নি যে সে জেগে গেছে। চোখ বুজে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রচনা ইচ্ছে করেই রতীশকে জাগাল না। না জানি রাতে কতক্ষণ অব্দি সে গুমরে গুমরে কেঁদেছে। বিছানার পাশে সাইড টেবিলের ওপর থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে সে ব্যালকনিতে এসে একটা চেয়ারে বসল। বাড়ি থেকে কেউ ফোন করতে পারে। রতীশের ফোন তো সুইচ অফই আছে। তাই তার ফোনেই কল আসবে। মোবাইলের শব্দে রতীশের ঘুম ভেঙে যাক এটা সে চাইছিল না। ব্যালকনিতে বসে আবার রবিশঙ্কর আর কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালাকে নিয়ে সে ভাবতে শুরু করল। এখন সে মোটামুটি নিশ্চিত যে রতীশের হাত থেকে টাকাটা তারা নিয়েও কমপ্লেক্স লিজ দেয় নি। তাই রতীশ অমনভাবে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু একটা কথা রচনার মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। সে আর সীমন্তিনী বারবার করে বোঝানো সত্বেও রতীশ কী করে লিজ এগ্রিমেন্ট সাইন করবার আগেই টাকাটা তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। না কি তারা জোর করে টাকাটা রতীশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, না এমনটা হলে রতীশের হাবভাবে সে আগের দিনই সেটা আঁচ করতে পারত। কিন্তু আগের দিন রতীশ ব্যস্ত থাকলেও মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। টাকাটা যে তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, সেটা সে আগের দিন নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি। সেটা সে বুঝেছে গতকাল। হয়ত সকালেই সে সেটা বুঝতে পেরেছে। আর তারপর থেকেই বুঝি পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়েছে। তাই সময় মত খেতেও আসতে চায় নি।
কিন্তু টাকাটা হাতে থাকলে রতীশ এতোটা নিশ্চয়ই ভেঙে পড়ত না। টাকাটা যে খোয়া গেছে, এ ব্যাপারে তো সে এখন প্রায় নিশ্চিত। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে রতীশ কলকাতায় এসেছে, তার সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তবে রচনা ভাবল যেটা হবার ছিল তা তো হয়েই গেছে। বুঝে বা না বুঝে রতীশ যা-ই করে থাকুক না কেন, তার কৃতকর্মের জন্য সে নিজেই অনুতপ্ত। নইলে কাল রাতে তার বুকে মুখ গুঁজে সে ও’সব কথা বলত না। তাই এখন তাকে দোষারোপ করে, তার নিন্দা করে, ছিঃ ছিঃ করে তাকে আর দুঃখ দেওয়া ঠিক হবে না। নিজের ভালবাসার লোকটাকে এভাবে নিন্দা করলে সে আরও ভেঙে পড়বে। স্ত্রী হয়ে সেটা করা তার পক্ষে অনুচিত হবে। ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিয়ে দু’জনে পরামর্শ করে ঠিক করতে হবে, এরপর তাদের কি করা উচিৎ। তবে সে যা ভাবছে, তেমনটাই হয়ে থাকলে, রতীশ যদি কাল সেটা না করে থাকে, তাহলে সবার আগে থানায় গিয়ে একটা ডাইরী করতে হবে।
হাতের মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠতে রচনা চমকে উঠল। বাড়ি থেকে মামনির ফোন। কল রিসিভ করে সে বলল, “হ্যা মামনি, বল”।
সরলাদেবী উদ্বিঘ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “রতু কেমন আছে রে মা? এখনও ওর ফোন বন্ধ দেখছি! ও ঠিক আছে তো”?
রচনা বলল, “হ্যা মামনি, তোমার ছেলে ঠিক আছে। তবে রাতে অনেক দেরীতে ঘুমিয়েছেন বলে এখনও ঘুম থেকে ওঠেন নি। আর ঘুমোচ্ছেন বলেই তার ফোনটা আমি অফ করে রেখেছি। নইলে ফোনের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যেত। তুমি ভেব না। উনি ঠিক আছেন”।
সরলাদেবী বললেন, “তুই ঘুমিয়েছিলিস তো? তুই তাহলে এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস কেন”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাগো, আমিও ঘুমিয়েছি রাতে। আর আমি তো রোজ পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদই উঠি। অবশ্য আজ আমারও ছটায় ঘুম ভেঙেছে। একটু দেরী হয়েছে আমারও”।
সরলাদেবী বললেন, “কাল রাতের কথা শুনে রতুর বাবা কাকারা খুব চিন্তা করছেন। হ্যারে মা, কালও যে ওর কাজটা হয়নি, এ ব্যাপারে তোকে কিছু বলেছে”?
রচনা একটু সতর্কভাবে বলল, “না মামনি। আমাকে কিছু বলেন নি। রাতে খাবার সময় তোমার ছেলে হয়তো বলতে চাইছিলেন কিছু একটা। কিন্তু আমিই তাকে বাঁধা দিয়েছি। আসলে মামনি, তার অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল গো। তাকে এমন বিধ্বস্ত হতে কখনও দেখিনি আগে। তাই ভেবেছিলুম রাতটা ভাল করে ঘুমিয়ে নিক। তাহলে তার শরীরটা একটু ভাল লাগবে, তাই”।
সরলাদেবী বললেন, “খুব ভাল করেছিস মা। ঠিক কাজই করেছিস তুই। ভাগ্যিস এ সময়ে তুই ওর পাশে আছিস। জানিস মা, মুখ ফুটে না বললেও, তোরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর তোদের দু’জনের ওপরেই আমার একটু অভিমান হয়েছিল। কাল রাত থেকে ভাবতে ভাবতে বুঝেছি, তুই রতুর সাথে গিয়ে সত্যি খুব ভাল করেছিস। নইলে কাল রাতে আমার ছেলেটার কী গতি হত, বল তো”?
রচনা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, “আমি তো কখনই চাই না কেউ আমার ওপর অভিমান করুক বা রাগ করে থাকুক। কিন্তু আমার আর কী করার ছিল বল তো মামনি? আমি কার কথা অমান্য করব আর কার কথা রাখব”।
সরলাদেবী বললেন, “নারে মা, তুই আমার ওপর রাগ করিসনে লক্ষ্মী মা আমার। আমার ছেলেটাকে যদি একা ছেড়ে দিতুম তাহলে আজ কী হত বল তো? তুই আছিস বলেই না ওকে সামলে নিতে পারছিস। তা হ্যারে, সকালের চা খেয়েছিস”?
রচনা বলল, “না মামনি। এখনও খাই নি। তোমার ছেলে উঠলে একসঙ্গে খাব ভাবছি”।
সরলাদেবী বললেন, “ঠিক আছে মা। তাই করিস। তবে রতু সব কথা খুলে বললে আমাদের জানাস কিন্তু”।
রচনা বলল, “হ্যা মামনি, জানাব”।
সরলাদেবী বললেন, “ঠিক আছে রে মা। এখন তাহলে রাখছি। পরে আবার কথা হবে কেমন”?
রচনা ফোন ডিসকানেক্ট করে বসবার ঘরের ভেতর দিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখে রতীশ বিছানায় নেই। বাথরুমের দরজার দিকে চেয়ে দেখল, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। রতীশ ঘুম থেকে উঠে গেছে বুঝেই সে ফোন রেখে বিছানা গোছাতে আরম্ভ করল। বিছানা গুছিয়ে সে কিচেনে গিয়ে ঢুকল। তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে একটা প্লেটে কয়েকটা বিস্কুট আর ট্রেতে করে দু’কাপ চা নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখল রতীশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। ডাইনিং রুমে চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “সোনা, এ’ঘরে চলে এস”।
রতীশ খাবার টেবিলে এসে একটা চেয়ারে বসতেই রচনা তার পাশে বসে বলল, “নাও, চা খাও”।
রতীশ চুপচাপ চা খেতে শুরু করল। রচনা চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “এখন শরীরটা কেমন লাগছে সোনা”?
রতীশ রচনার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলল, “হু, ভাল আছি”।
তারপর আবার দু’জনেই চুপচাপ। রচনা আশা করছে তার স্বামী যা বলবার নিজেই বলবে। আর রতীশ ভাবছে কথাটা কি করে, কোত্থেকে শুরু করবে। কয়েকবার শুরু করবার উদ্যোগ নিয়েও সে আবার থেমে গেল। কিন্তু রচনা ভাবল কথাগুলো রতীশ যতক্ষণ পর্যন্ত না বলতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কিছুতেই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু সে যে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা সেটা রচনাও খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছিল। সে ভাবল তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে না দিতেই বেডরুমে তার ফোন বেজে উঠল। রচনা মনে মনে ভাবল এটা নিশ্চয়ই সীমন্তিনীর ফোন হবে। বেডরুমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে সে এবার আর বসবার ঘরে বা ব্যালকনিতে না গিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকতে ঢুকতেই বলল, “হ্যা দিদিভাই, তুমি কি বেরোচ্ছ”? বলে ফোনের স্পীকার অন অন করে দিল।
সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যারে, তৈরী হয়েছি। তা তোদের খবর কি? বল তো”?
রচনা আড়চোখে রতীশের দিকে দেখতে দেখতে আর টেবিলের ওপর থেকে নিজের প্লেট কাপ তুলতে তুলতে বলল, “সে খবর তো আমিও এখনো জানিনা দিদিভাই। তোমাকে কী করে বলব”?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “সে কি রে? এখনও দাদাভাই কিছু বলেনি তোকে”?
রচনা জবাব দিল, “নাগো দিদিভাই, কিছুই শুনিনি এখনও। আসলে আমাদের আজ উঠতে একটু দেরী হয়ে গেছে গো। তোমার দাদাভাই তো বলতে গেলে সারাটা রাত প্রায় জেগেই ছিলেন। ভোরের দিকেই একটু ঘুমোতে পেরেছেন সে। আমিও ছ’টার সময় উঠেছি। এখন চা খাচ্ছি”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি যে খুব উৎকণ্ঠায় আছি রে রচু। রাতে আমিও ঠিক মত ঘুমোতে পারিনি রে। আচ্ছা তুই কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিস”?
রচনা আবার আড়চোখে রতীশের দিকে চেয়ে দেখল সে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে চা খেয়ে চলেছে। সে সীমন্তিনীর প্রশ্নের জবাবে বলল, “সেটা যে একেবারেই করতে পারিনি তা নয় দিদিভাই। তবে সে ধারণা আমার ভুলও হতে পারে। তাই সে’সব কথা বলে সকাল সকাল তোমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তুমি শান্ত মনে অফিসে যাও। আমি টিফিন টাইমে তোমাকে ফোন করব’খন”।
সীমন্তিনী বলল, “বিপজ্জনক কিছু একটা যে ঘটেছে সেটা তো আমিও আন্দাজ করতে পারছি রে। কিন্তু ব্যাপারটা সঠিক ভাবে জানাটা তো দরকার। আর দাদাভাইয়ের ফোন তো এখনও সুইচড অফ পাচ্ছি”।
রচনা এবার রতীশের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যা দিদিভাই, ওটা সুইচ অফই আছে এখনও। আসলে তোমার দাদাভাই ভোরের দিকেই একটু ঘুমিয়েছিলেন বলে আমিও আর সেটা চালু করিনি। বাড়ি থেকে মামনি আর তুমি যে ফোন করবেই সেটা তো জানাই ছিল। ফোনের শব্দে ওনার ঘুম ভেঙে যাবে বলেই করিনি”।
সীমন্তিনী বলল, “বেশ করেছিস। কিন্তু ব্যাপারটা না শোনা অব্দি আমি যে কোন কাজেই মন বসাতে পারব না রে বোন। ঠিক আছে, টিফিন টাইমেই না হয় শুনব। কিন্তু দাদাভাই এখন কেমন আছে রে? ওর শরীর ঠিক আছে তো? ও সুস্থ আছে তো”?
রচনা পেছন থেকে রতীশের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যা দিদিভাই, সে শারীরিক ভাবে সুস্থই আছে। তুমি ও নিয়ে ভেব না। আমি আছি তো তোমার দাদাভাইয়ের পাশে”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে রে রচু। আমি তাহলে এখন বেরোচ্ছি। তুই ফোন করে আমাকে জানাস সব কিছু। তবে টিফিন টাইমের আগে ফোন করিস না। আজ অফিসে খুব জরুরী একটা কাজে ব্যস্ত থাকব আমি। ঠিক আছে? ছাড়ছি”।
সীমন্তিনী ফোন কেটে দিতে রচনা ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে রতীশের মুখটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার চুলে মুখ ঘসতে ঘসতে বলল, “দেখেছ সোনা? দিদিভাই কত দুশ্চিন্তায় আছেন? মামনিও সকালে ফোন করেছিলেন। কিন্তু আমি তো কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এবার সব কিছু আমাকে খুলে বল না লক্ষ্মীটি। আমার বুঝি কষ্ট হয় না? আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় লোকটা আমার কাছে তার মনের কথা খুলে বলছে না। এতে আমার মনে কতটা দুঃখ হতে পারে, সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ না? কাল রাতে আমার বুকে মুখ চেপে রেখে ওভাবে কাঁদছিলে কেন? বলনা সোনা আমার”।
রতীশ রচনার হাতের ওপর নিজের হাত চেপে ধরে বলল, “আমি যে ভুল করেছি, তার জন্য কান্না ছাড়া আমার যে আর কিছুই করবার নেই রচু” বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠল।
রচনা এবার রতীশের পাশে দাঁড়িয়ে তার মুখটাকে দু’হাতে ধরে উঁচু করে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “না সোনা। আর কেঁদো না। কাল তো সারাটা দিন সারাটা রাতই কেঁদেছ তুমি। এবার নিজেকে একটু সামলাও। আমাকে সবটা খুলে বল। তুমি না তোমার মন্তিকে কথা দিয়েছ যে আমার কাছে কখনও কিছু লুকোবে না। তুমি সে কথা ভুলে গেছ”?
রতীশ এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, “হ্যা হ্যা আমি সব ভুলে গেছি। তোমাকে দেওয়া কথা, মন্তিকে দেওয়া সব কথা আমি ভুলে গেছি। তোমাদের কথার অমান্য করেই তো নিজের সবথেকে বড় সর্বনাশটা আমি করে বসেছি। তাই তো বলছি, আমার মত অপদার্থ এ পৃথিবীতে আর দুটি নেই। আমাকে তোমরা সবাই ক্ষমা করে দিও সোনা। কিন্তু এটাও জানি, সব জানলে হয়ত তোমরা কেউ আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না”।
রচনা রতীশের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “না সোনা, অমন কথা বলো না গো। রবিশঙ্করকে চিনতে যে ভুল হয়েছে, সে ভুল শুধু তোমার একার নয়। ছোটকাকু দশ বছর যাবৎ তার সাথে ব্যবসা করেও তাকে চিনতে ভুল করেছেন। বাবা আর মেজকাকুও তো রবিশঙ্করের সাথে কথা বলেছেন। তারাও তো কেউ বুঝতে পারেননি যে সে আমাদের এভাবে ঠকাতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় বিমল আগরওয়ালার হাতে টাকাটা তুমি পরশু দিনই দিয়ে দিয়েছিলে, তাই না”?
রতীশ একটু অবাক হয়ে রচনার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করে বুঝলে সেটা”?
রচনা একইভাবে রতীশের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কাল রাতে তোমার অবস্থা দেখে মনে মনে হিসেব করে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। কিন্তু সেটাই কি ঠিক”?
রতীশ রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যা রচু। তোমার ধারণা ঠিক। টাকাটা আমি পরশু সকালেই বিমল আগরওয়ালাকে দিয়েছি। কিন্তু সে লোকটা আসলে বিমল আগরওয়ালা নয়ই। রবিশঙ্কর একটা অন্য লোককে বিমল আগরওয়ালা বলে আমার সাথে পরিচয় করিয়েছিল। আসল বিমল আগরওয়ালার সাথে আমার তো কাল পরিচয় হল। আর তখনই বুঝতে পারলুম রবিশঙ্কর আর ওই ভুয়ো বিমল আগরওয়ালা মিলে আমার দু’লাখ টাকা লুটে নিয়েছে” বলে আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
রচনা রতীশকে শান্ত করতে করতে বলল, “না সোনা, লক্ষ্মী সোনা আমার। আর কেঁদো না গো। আমাকে পুরো ব্যাপারটা গুছিয়ে ভাল করে বল দেখি। চল, বসবার ঘরে বসে আমাকে সবটা খুলে বল”।
বসবার ঘরে রতীশ রচনাকে আদ্যোপান্ত সব কথা খুলে বলল। পরশুদিন সকালে কমপ্লেক্সে যাবার পর থেকে গতকাল রাতে বিমল আগরওয়ালার অফিসে গিয়ে কথাবার্তা বলা পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলল। রবিশঙ্করের বাড়ি যাবার কথাও বলল। রতীশের মুখে পুরো ঘটণাটা মন দিয়ে শুনে রচনা বলল, “রবিশঙ্কর এভাবে আমাদের ঠকালো শেষ পর্যন্ত! কাল রাতে আমি এমনটাই আশঙ্কা করেছিলুম। কিন্তু সোনা, তোমার কালই থানায় গিয়ে ডাইরীটা করানো উচিৎ ছিল। যদি ওই দু’লাখ টাকা তারা দু’জনে ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকে তাহলে সে টাকা তারা এতক্ষণে খরচ করে ফেলেছে হয়ত। তাই টাকা ফিরে পাবার সম্ভাবনা তো প্রায় নেইই ধরে নেওয়া যায়। তবু থানায় গিয়ে রিপোর্টটা লেখাতেই হবে। ওই ভুয়ো লোকটার নাম ঠিকানা না জানলেও রবিশঙ্করের ঠিকানাটা তো পুলিশকে বলতেই পারব আমরা। রবিশঙ্কর বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়ে উঠেছে সেটা হয়ত পুলিশ খুঁজে বের করতে পারবে। যদি পুলিশ তাকে ধরতে পারে তাহলে অন্য আরেকজনকেও ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে। টাকাটা ফেরত না পেলেও ওই লোকগুলোর সাজা পাওয়া উচিৎ। তাই চল, আমরা দু’জনে মিলেই লোকাল থানায় গিয়ে ডাইরীটা করে আসি। তবে দাঁড়াও। আগে চট করে কিছু একটা বানিয়ে নিই। সকালের খাবারটা খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ব”।
রচনা রান্নাঘরে এসে কাজে লেগে গেল। খানিক বাদে রতীশও রান্নাঘরে এসে একটা চেয়ার নিয়ে বসতে বসতে বলল, “রচু, আমার মনে হয়, টাকাটা যে আমি স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলুম এ’কথাটা মন্তিকে বা বাড়ির কাউকে না জানালেই বোধ হয় ঠিক হবে। আমরা যদি কথাটা একটু অন্যভাবে বলি, ধর যদি বলি টাকাটা আমি হারিয়ে ফেলেছি, তাহলে কেমন হয় বল তো”?
রচনা নিজের কাজ করতে করতে জবাব দিল, “না সোনা। দিদিভাই আর বাড়ির সকলেই আমাদের আপনজন। আমাদের প্রিয়জন। আমাদের খুব কাছের মানুষ। এমন কারো কাছে মিথ্যে কথা বলা একেবারেই উচিৎ নয়। আর জানো তো? সত্যকে সাময়িক ভাবে লুকোতে পারলেও, সেটা একদিন না একদিন ঠিক প্রকাশ পাবেই। আর যখন তারা বুঝতে পারবে যে আমরা তাদের মিথ্যে কথা বলেছি, তখন তারা কতটা আঘাত পাবে, একবার ভাব তো? আমি বুঝতে পারছি, কথাটা বলতে তোমার সঙ্কোচ হচ্ছে। তুমি সেটা নিয়ে ভেব না। আমি সবাইকে বুঝিয়ে দেব যে তুমি রবিশঙ্করদের ছলনাটা না বুঝে সরল মনে লোকটার ছেলের কলেজের অ্যাডমিশনের কথা শুনেই টাকাটা দিয়েছিলে। তুমি টাকাটা তাদের হাতে দিয়েছ বলেই তো তোমার লজ্জা হচ্ছে সে’কথাটা বলতে? কিন্তু একটু ভেবে দেখ তো? এ লজ্জা তো শুধু তোমার একার নয়। আমাদের সকলের। আমরা কেউই তো রবিশঙ্করের বদ মতলবটা বুঝতে পারিনি। আর বিপদের দিনে নিজের লোকেরা পাশে থাকলে সব বিপদই কাটিয়ে ওঠা যায়। বাড়ির সকলে আমাদের পাশে আছেন, দিদিভাই আমাদের পাশে আছেন। তাই বাড়ির লোকদের কাছে আমরা কোন কথাই গোপন করব না। টাকাটা তো আমরা হারিয়েই ফেলেছি সোনা। এখন তাদের কাছে মিথ্যে কথা বললে তাদের সকলের ভালবাসাও হাঁরিয়ে ফেলব আমরা। সেটা কি হতে দেওয়া যায় বলো”?
***************
লোকাল থানায় যেতে যেতে রচনা রতীশকে বলল, “সোনা, আমাদের দিদিভাইও যে পুলিশে চাকরি করে এটা কিন্তু আমরা এখন থানায় গিয়ে বলব না। আগে দিদিভাইয়ের মতামত নিতে হবে এ ব্যাপারে। তারপর প্রয়োজন হলে আমরা সে’কথা পুলিশকে বলব”।
থানায় গিয়ে তাদের যা কিছু জানা ছিল তার সবটাই পুলিশকে খুলে বলল রতীশ আর রচনা। পুলিশ অফিসার লোকটা আরও অনেক কিছু জানতে চাইছিল। কিন্তু রতীশ সে সব কথার জবাব দিতে পারেনি। পুলিশ অফিসার রতীশের আর রবিশঙ্করের নাম ঠিকানা নোট করে নিয়ে আর বিমল আগরওয়ালার ভিজিটিং কার্ডের একটা ফটোকপি জমা নিয়ে জানতে চাইল যে রতীশের কাছে রবিশঙ্করের কোন ছবি আছে কিনা। রতীশ জানাল, নেই।
______________________________
খাওয়া শেষে রচনা বলল, “সোনা, একটু সামনের ঘরে গিয়ে বস। আমি হাতটা ধুয়েই বিছানাটা পেতে দিচ্ছি” বলে হাত ধুয়েই বেডরুমে এসে বিছানা ঝেড়ে ভাল করে পেতে দিয়ে বসবার ঘরে গিয়ে রতীশের হাত ধরে বলল, “চল, বিছানা হয়ে গেছে। তুমি শুয়ে পড়। আমি রান্নাঘরের কাজটুকু সেরে পরে আসছি”।
রতীশ বিছানায় এসে বসে রচনার একটা হাত আঁকড়ে ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল, “আই এম সরি সোনা, তোমাকে আজ অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি”।
রচনা স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল, “কিচ্ছু হয়নি সোনা। আর এখন কিছু বলতেও হবে না। চুপ করে শুয়ে পড়। ভাল করে ঘুমোও। কাল সকালে যা বলার বলো”।
রতীশ আর কথা না বলে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। আধঘন্টা বাদে রচনা একটা নাইটি পড়ে বিছানায় এসে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়ল। অন্য দিন রতীশ বিছানায় শুয়েই রচনার নাইটির সামনের বোতামগুলো খুলে ফেলে। রচনা শোবার সময় ভেতরে কোন অন্তর্বাস রাখে না। রচনার খোলা বুকে কিছুক্ষণ মুখ গুঁজে রেখেই সে যৌবনের খেলা খেলতে শুরু করে দেয়। রচনাও মনে প্রাণে স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু আজ ক্লান্ত দেহ আর মন নিয়ে রতীশ যে কিছু করবে সেটা রচনা আশা করছে না। তাই সে নিজেই নিজের নাইটির বোতামগুলো খুলে ফেলে তার উন্মুক্ত বুকে স্বামীর মুখটা চেপে ধরে তার গলা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজল। কিন্তু ঘুম যে তার এত তাড়াতাড়ি আসবে না, এটা তার জানাই ছিল। স্বামীর ওপর দিয়ে আজ সকাল থেকে নাজানি কত ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেছে, এসব কথাই সে ভাবতে লাগল।
এক সময় হঠাৎ রচনার মনে হল তার বুকের ত্বক যেন ভেজা ভেজা। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চিন্তার জাল ছিন্ন করে ভাল করে খেয়াল করে বুঝল হ্যা ঠিক তাই। এক কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে সে রতীশের মুখটাকে বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখে তার দুটো স্তনের মাঝের বিভাজিকাটা জলে ভেজা। চমকে উঠে বেডল্যাম্পটা জ্বালাতেই দেখে রতীশের দু’গাল বেয়ে অঝোর ধারায় চোখের জল পড়ছে। রচনা দু’হাতে স্বামীর মুখটা অঞ্জলি করে ধরে জিজ্ঞেস করল, “এ কী সোনা? তুমি কাঁদছ কেন গো? কী হয়েছে সোনা? আমি কি নিজের অজান্তেই তোমাকে কোন দুঃখ দিয়ে ফেলেছি? বল না গো। লক্ষ্মীটি প্লীজ বল, কী হয়েছে তোমার”।
রতীশ ছোট শিশুর মত রচনাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার এ অপদার্থ স্বামীটাকে ক্ষমা করে দিও তুমি রচু। আমি তোমার আর আমার মন্তির বিশ্বাসভঙ্গ করে ফেলেছি”।
রচনা পরম ভালবাসায় স্বামীর মুখটাকে আবার নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “চুপ, চুপ কর সোনা। এখন কিচ্ছু বলতে হবে না। অনেক রাত হয়ে গেছে। আর তুমি এখন সত্যি খুব ক্লান্ত। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর। কাল সকালে উঠে সব কিছু শুনব’খন। লক্ষ্মী সোনা আমার। এখন আর একটাও কথা বলো না” বলতে বলতে রতীশের মুখটাকে নিজের নরম বুকে চেপে ধরল। রতীশও অসহায়ের মত রচনাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ চেপে রইল।
রচনা অনেকক্ষণ ধরে রতীশের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল নিজের মনে মনে। অনেকক্ষন বাদে তার মনে হলে রতীশের শরীরটা আর কান্নার আবেগে ফুলে ফুলে উঠছে না। সে তার হাতের আলিঙ্গন খানিকটা শিথিল করলেও দু’হাতে রতীশের গলা জড়িয়ে ধরে রইল। জেগে থাকতে থাকতে আর রতীশের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কখন যেন সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে সকাল ছ’টা নাগাদ রচনার ঘুম ভাঙল। নিজের বুকের দিকে চেয়ে দেখে রতীশ হাঁ করে তার একটা স্তনের ওপর মুখ রেখে ঘুমোচ্ছে। ভাল করে খেয়াল করে দেখল রতীশের ঘুম ভাঙে নি। সে আলতো করে রতীশের মাথার নিচ থেকে তার হাতটা বের করে তার মাথাটাকে বালিশের ওপর ভাল করে রেখে বিছানায় উঠে বসল। তারপর নিজের খোলা বুকটাকে ঢাকতে ঢাকতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। প্রাতঃকৃত্য সেরে দাঁত ব্রাশ করে স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে আলমারি খুলে ধোয়া শাড়ি ব্রা ব্লাউজ পড়ে ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঠাকুরকে প্রণাম করে মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করল, “হে ঠাকুর, আমার স্বামীর মনে শক্তি দাও। উনি যেন ভেঙে না পড়েন। যে বিপদই ঘটে থাকুক না কেন, উনি যেন সব ঝড় ঝাপটা সয়ে নিয়ে সোজা হয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে পারেন”।
ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে বিছানার কাছে এসে স্বামীর মাথায় আলতো করে হাত বোলাল রচনা। রতীশ গভীর ঘুমে। রচনা ইচ্ছে করেই তাকে জাগাল না। বাড়িতে থাকতে রতীশ রোজ ভোর পাঁচটা থেকে একঘন্টা যোগ চর্চা করত। কলকাতায় আসবার পর থেকে এ দু’তিন দিনে সে আর যোগচর্চা করবার সুযোগ পায়নি। নানান ব্যস্ততায় আর সেটা করতে পারেনি। কাল রাতেও বারোটা পর্যন্ত সে তার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছে। তারপর কিছুটা ঘুমিয়েছিল। সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু অনেক রাতে আবার তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন রতীশ আবার কাঁদছিল। কিন্তু সে বুঝতে পেয়েও রতীশকে বুঝতে দেয় নি যে সে জেগে গেছে। চোখ বুজে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রচনা ইচ্ছে করেই রতীশকে জাগাল না। না জানি রাতে কতক্ষণ অব্দি সে গুমরে গুমরে কেঁদেছে। বিছানার পাশে সাইড টেবিলের ওপর থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে সে ব্যালকনিতে এসে একটা চেয়ারে বসল। বাড়ি থেকে কেউ ফোন করতে পারে। রতীশের ফোন তো সুইচ অফই আছে। তাই তার ফোনেই কল আসবে। মোবাইলের শব্দে রতীশের ঘুম ভেঙে যাক এটা সে চাইছিল না। ব্যালকনিতে বসে আবার রবিশঙ্কর আর কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালাকে নিয়ে সে ভাবতে শুরু করল। এখন সে মোটামুটি নিশ্চিত যে রতীশের হাত থেকে টাকাটা তারা নিয়েও কমপ্লেক্স লিজ দেয় নি। তাই রতীশ অমনভাবে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু একটা কথা রচনার মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। সে আর সীমন্তিনী বারবার করে বোঝানো সত্বেও রতীশ কী করে লিজ এগ্রিমেন্ট সাইন করবার আগেই টাকাটা তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। না কি তারা জোর করে টাকাটা রতীশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, না এমনটা হলে রতীশের হাবভাবে সে আগের দিনই সেটা আঁচ করতে পারত। কিন্তু আগের দিন রতীশ ব্যস্ত থাকলেও মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। টাকাটা যে তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, সেটা সে আগের দিন নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি। সেটা সে বুঝেছে গতকাল। হয়ত সকালেই সে সেটা বুঝতে পেরেছে। আর তারপর থেকেই বুঝি পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়েছে। তাই সময় মত খেতেও আসতে চায় নি।
কিন্তু টাকাটা হাতে থাকলে রতীশ এতোটা নিশ্চয়ই ভেঙে পড়ত না। টাকাটা যে খোয়া গেছে, এ ব্যাপারে তো সে এখন প্রায় নিশ্চিত। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে রতীশ কলকাতায় এসেছে, তার সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তবে রচনা ভাবল যেটা হবার ছিল তা তো হয়েই গেছে। বুঝে বা না বুঝে রতীশ যা-ই করে থাকুক না কেন, তার কৃতকর্মের জন্য সে নিজেই অনুতপ্ত। নইলে কাল রাতে তার বুকে মুখ গুঁজে সে ও’সব কথা বলত না। তাই এখন তাকে দোষারোপ করে, তার নিন্দা করে, ছিঃ ছিঃ করে তাকে আর দুঃখ দেওয়া ঠিক হবে না। নিজের ভালবাসার লোকটাকে এভাবে নিন্দা করলে সে আরও ভেঙে পড়বে। স্ত্রী হয়ে সেটা করা তার পক্ষে অনুচিত হবে। ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিয়ে দু’জনে পরামর্শ করে ঠিক করতে হবে, এরপর তাদের কি করা উচিৎ। তবে সে যা ভাবছে, তেমনটাই হয়ে থাকলে, রতীশ যদি কাল সেটা না করে থাকে, তাহলে সবার আগে থানায় গিয়ে একটা ডাইরী করতে হবে।
হাতের মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠতে রচনা চমকে উঠল। বাড়ি থেকে মামনির ফোন। কল রিসিভ করে সে বলল, “হ্যা মামনি, বল”।
সরলাদেবী উদ্বিঘ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “রতু কেমন আছে রে মা? এখনও ওর ফোন বন্ধ দেখছি! ও ঠিক আছে তো”?
রচনা বলল, “হ্যা মামনি, তোমার ছেলে ঠিক আছে। তবে রাতে অনেক দেরীতে ঘুমিয়েছেন বলে এখনও ঘুম থেকে ওঠেন নি। আর ঘুমোচ্ছেন বলেই তার ফোনটা আমি অফ করে রেখেছি। নইলে ফোনের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যেত। তুমি ভেব না। উনি ঠিক আছেন”।
সরলাদেবী বললেন, “তুই ঘুমিয়েছিলিস তো? তুই তাহলে এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস কেন”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাগো, আমিও ঘুমিয়েছি রাতে। আর আমি তো রোজ পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদই উঠি। অবশ্য আজ আমারও ছটায় ঘুম ভেঙেছে। একটু দেরী হয়েছে আমারও”।
সরলাদেবী বললেন, “কাল রাতের কথা শুনে রতুর বাবা কাকারা খুব চিন্তা করছেন। হ্যারে মা, কালও যে ওর কাজটা হয়নি, এ ব্যাপারে তোকে কিছু বলেছে”?
রচনা একটু সতর্কভাবে বলল, “না মামনি। আমাকে কিছু বলেন নি। রাতে খাবার সময় তোমার ছেলে হয়তো বলতে চাইছিলেন কিছু একটা। কিন্তু আমিই তাকে বাঁধা দিয়েছি। আসলে মামনি, তার অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল গো। তাকে এমন বিধ্বস্ত হতে কখনও দেখিনি আগে। তাই ভেবেছিলুম রাতটা ভাল করে ঘুমিয়ে নিক। তাহলে তার শরীরটা একটু ভাল লাগবে, তাই”।
সরলাদেবী বললেন, “খুব ভাল করেছিস মা। ঠিক কাজই করেছিস তুই। ভাগ্যিস এ সময়ে তুই ওর পাশে আছিস। জানিস মা, মুখ ফুটে না বললেও, তোরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর তোদের দু’জনের ওপরেই আমার একটু অভিমান হয়েছিল। কাল রাত থেকে ভাবতে ভাবতে বুঝেছি, তুই রতুর সাথে গিয়ে সত্যি খুব ভাল করেছিস। নইলে কাল রাতে আমার ছেলেটার কী গতি হত, বল তো”?
রচনা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, “আমি তো কখনই চাই না কেউ আমার ওপর অভিমান করুক বা রাগ করে থাকুক। কিন্তু আমার আর কী করার ছিল বল তো মামনি? আমি কার কথা অমান্য করব আর কার কথা রাখব”।
সরলাদেবী বললেন, “নারে মা, তুই আমার ওপর রাগ করিসনে লক্ষ্মী মা আমার। আমার ছেলেটাকে যদি একা ছেড়ে দিতুম তাহলে আজ কী হত বল তো? তুই আছিস বলেই না ওকে সামলে নিতে পারছিস। তা হ্যারে, সকালের চা খেয়েছিস”?
রচনা বলল, “না মামনি। এখনও খাই নি। তোমার ছেলে উঠলে একসঙ্গে খাব ভাবছি”।
সরলাদেবী বললেন, “ঠিক আছে মা। তাই করিস। তবে রতু সব কথা খুলে বললে আমাদের জানাস কিন্তু”।
রচনা বলল, “হ্যা মামনি, জানাব”।
সরলাদেবী বললেন, “ঠিক আছে রে মা। এখন তাহলে রাখছি। পরে আবার কথা হবে কেমন”?
রচনা ফোন ডিসকানেক্ট করে বসবার ঘরের ভেতর দিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখে রতীশ বিছানায় নেই। বাথরুমের দরজার দিকে চেয়ে দেখল, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। রতীশ ঘুম থেকে উঠে গেছে বুঝেই সে ফোন রেখে বিছানা গোছাতে আরম্ভ করল। বিছানা গুছিয়ে সে কিচেনে গিয়ে ঢুকল। তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে একটা প্লেটে কয়েকটা বিস্কুট আর ট্রেতে করে দু’কাপ চা নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখল রতীশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। ডাইনিং রুমে চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “সোনা, এ’ঘরে চলে এস”।
রতীশ খাবার টেবিলে এসে একটা চেয়ারে বসতেই রচনা তার পাশে বসে বলল, “নাও, চা খাও”।
রতীশ চুপচাপ চা খেতে শুরু করল। রচনা চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “এখন শরীরটা কেমন লাগছে সোনা”?
রতীশ রচনার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলল, “হু, ভাল আছি”।
তারপর আবার দু’জনেই চুপচাপ। রচনা আশা করছে তার স্বামী যা বলবার নিজেই বলবে। আর রতীশ ভাবছে কথাটা কি করে, কোত্থেকে শুরু করবে। কয়েকবার শুরু করবার উদ্যোগ নিয়েও সে আবার থেমে গেল। কিন্তু রচনা ভাবল কথাগুলো রতীশ যতক্ষণ পর্যন্ত না বলতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কিছুতেই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু সে যে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা সেটা রচনাও খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছিল। সে ভাবল তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে না দিতেই বেডরুমে তার ফোন বেজে উঠল। রচনা মনে মনে ভাবল এটা নিশ্চয়ই সীমন্তিনীর ফোন হবে। বেডরুমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে সে এবার আর বসবার ঘরে বা ব্যালকনিতে না গিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকতে ঢুকতেই বলল, “হ্যা দিদিভাই, তুমি কি বেরোচ্ছ”? বলে ফোনের স্পীকার অন অন করে দিল।
সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যারে, তৈরী হয়েছি। তা তোদের খবর কি? বল তো”?
রচনা আড়চোখে রতীশের দিকে দেখতে দেখতে আর টেবিলের ওপর থেকে নিজের প্লেট কাপ তুলতে তুলতে বলল, “সে খবর তো আমিও এখনো জানিনা দিদিভাই। তোমাকে কী করে বলব”?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “সে কি রে? এখনও দাদাভাই কিছু বলেনি তোকে”?
রচনা জবাব দিল, “নাগো দিদিভাই, কিছুই শুনিনি এখনও। আসলে আমাদের আজ উঠতে একটু দেরী হয়ে গেছে গো। তোমার দাদাভাই তো বলতে গেলে সারাটা রাত প্রায় জেগেই ছিলেন। ভোরের দিকেই একটু ঘুমোতে পেরেছেন সে। আমিও ছ’টার সময় উঠেছি। এখন চা খাচ্ছি”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি যে খুব উৎকণ্ঠায় আছি রে রচু। রাতে আমিও ঠিক মত ঘুমোতে পারিনি রে। আচ্ছা তুই কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিস”?
রচনা আবার আড়চোখে রতীশের দিকে চেয়ে দেখল সে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে চা খেয়ে চলেছে। সে সীমন্তিনীর প্রশ্নের জবাবে বলল, “সেটা যে একেবারেই করতে পারিনি তা নয় দিদিভাই। তবে সে ধারণা আমার ভুলও হতে পারে। তাই সে’সব কথা বলে সকাল সকাল তোমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তুমি শান্ত মনে অফিসে যাও। আমি টিফিন টাইমে তোমাকে ফোন করব’খন”।
সীমন্তিনী বলল, “বিপজ্জনক কিছু একটা যে ঘটেছে সেটা তো আমিও আন্দাজ করতে পারছি রে। কিন্তু ব্যাপারটা সঠিক ভাবে জানাটা তো দরকার। আর দাদাভাইয়ের ফোন তো এখনও সুইচড অফ পাচ্ছি”।
রচনা এবার রতীশের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যা দিদিভাই, ওটা সুইচ অফই আছে এখনও। আসলে তোমার দাদাভাই ভোরের দিকেই একটু ঘুমিয়েছিলেন বলে আমিও আর সেটা চালু করিনি। বাড়ি থেকে মামনি আর তুমি যে ফোন করবেই সেটা তো জানাই ছিল। ফোনের শব্দে ওনার ঘুম ভেঙে যাবে বলেই করিনি”।
সীমন্তিনী বলল, “বেশ করেছিস। কিন্তু ব্যাপারটা না শোনা অব্দি আমি যে কোন কাজেই মন বসাতে পারব না রে বোন। ঠিক আছে, টিফিন টাইমেই না হয় শুনব। কিন্তু দাদাভাই এখন কেমন আছে রে? ওর শরীর ঠিক আছে তো? ও সুস্থ আছে তো”?
রচনা পেছন থেকে রতীশের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যা দিদিভাই, সে শারীরিক ভাবে সুস্থই আছে। তুমি ও নিয়ে ভেব না। আমি আছি তো তোমার দাদাভাইয়ের পাশে”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে রে রচু। আমি তাহলে এখন বেরোচ্ছি। তুই ফোন করে আমাকে জানাস সব কিছু। তবে টিফিন টাইমের আগে ফোন করিস না। আজ অফিসে খুব জরুরী একটা কাজে ব্যস্ত থাকব আমি। ঠিক আছে? ছাড়ছি”।
সীমন্তিনী ফোন কেটে দিতে রচনা ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে রতীশের মুখটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার চুলে মুখ ঘসতে ঘসতে বলল, “দেখেছ সোনা? দিদিভাই কত দুশ্চিন্তায় আছেন? মামনিও সকালে ফোন করেছিলেন। কিন্তু আমি তো কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এবার সব কিছু আমাকে খুলে বল না লক্ষ্মীটি। আমার বুঝি কষ্ট হয় না? আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় লোকটা আমার কাছে তার মনের কথা খুলে বলছে না। এতে আমার মনে কতটা দুঃখ হতে পারে, সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ না? কাল রাতে আমার বুকে মুখ চেপে রেখে ওভাবে কাঁদছিলে কেন? বলনা সোনা আমার”।
রতীশ রচনার হাতের ওপর নিজের হাত চেপে ধরে বলল, “আমি যে ভুল করেছি, তার জন্য কান্না ছাড়া আমার যে আর কিছুই করবার নেই রচু” বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠল।
রচনা এবার রতীশের পাশে দাঁড়িয়ে তার মুখটাকে দু’হাতে ধরে উঁচু করে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “না সোনা। আর কেঁদো না। কাল তো সারাটা দিন সারাটা রাতই কেঁদেছ তুমি। এবার নিজেকে একটু সামলাও। আমাকে সবটা খুলে বল। তুমি না তোমার মন্তিকে কথা দিয়েছ যে আমার কাছে কখনও কিছু লুকোবে না। তুমি সে কথা ভুলে গেছ”?
রতীশ এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, “হ্যা হ্যা আমি সব ভুলে গেছি। তোমাকে দেওয়া কথা, মন্তিকে দেওয়া সব কথা আমি ভুলে গেছি। তোমাদের কথার অমান্য করেই তো নিজের সবথেকে বড় সর্বনাশটা আমি করে বসেছি। তাই তো বলছি, আমার মত অপদার্থ এ পৃথিবীতে আর দুটি নেই। আমাকে তোমরা সবাই ক্ষমা করে দিও সোনা। কিন্তু এটাও জানি, সব জানলে হয়ত তোমরা কেউ আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না”।
রচনা রতীশের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “না সোনা, অমন কথা বলো না গো। রবিশঙ্করকে চিনতে যে ভুল হয়েছে, সে ভুল শুধু তোমার একার নয়। ছোটকাকু দশ বছর যাবৎ তার সাথে ব্যবসা করেও তাকে চিনতে ভুল করেছেন। বাবা আর মেজকাকুও তো রবিশঙ্করের সাথে কথা বলেছেন। তারাও তো কেউ বুঝতে পারেননি যে সে আমাদের এভাবে ঠকাতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় বিমল আগরওয়ালার হাতে টাকাটা তুমি পরশু দিনই দিয়ে দিয়েছিলে, তাই না”?
রতীশ একটু অবাক হয়ে রচনার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করে বুঝলে সেটা”?
রচনা একইভাবে রতীশের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কাল রাতে তোমার অবস্থা দেখে মনে মনে হিসেব করে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। কিন্তু সেটাই কি ঠিক”?
রতীশ রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যা রচু। তোমার ধারণা ঠিক। টাকাটা আমি পরশু সকালেই বিমল আগরওয়ালাকে দিয়েছি। কিন্তু সে লোকটা আসলে বিমল আগরওয়ালা নয়ই। রবিশঙ্কর একটা অন্য লোককে বিমল আগরওয়ালা বলে আমার সাথে পরিচয় করিয়েছিল। আসল বিমল আগরওয়ালার সাথে আমার তো কাল পরিচয় হল। আর তখনই বুঝতে পারলুম রবিশঙ্কর আর ওই ভুয়ো বিমল আগরওয়ালা মিলে আমার দু’লাখ টাকা লুটে নিয়েছে” বলে আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
রচনা রতীশকে শান্ত করতে করতে বলল, “না সোনা, লক্ষ্মী সোনা আমার। আর কেঁদো না গো। আমাকে পুরো ব্যাপারটা গুছিয়ে ভাল করে বল দেখি। চল, বসবার ঘরে বসে আমাকে সবটা খুলে বল”।
বসবার ঘরে রতীশ রচনাকে আদ্যোপান্ত সব কথা খুলে বলল। পরশুদিন সকালে কমপ্লেক্সে যাবার পর থেকে গতকাল রাতে বিমল আগরওয়ালার অফিসে গিয়ে কথাবার্তা বলা পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলল। রবিশঙ্করের বাড়ি যাবার কথাও বলল। রতীশের মুখে পুরো ঘটণাটা মন দিয়ে শুনে রচনা বলল, “রবিশঙ্কর এভাবে আমাদের ঠকালো শেষ পর্যন্ত! কাল রাতে আমি এমনটাই আশঙ্কা করেছিলুম। কিন্তু সোনা, তোমার কালই থানায় গিয়ে ডাইরীটা করানো উচিৎ ছিল। যদি ওই দু’লাখ টাকা তারা দু’জনে ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকে তাহলে সে টাকা তারা এতক্ষণে খরচ করে ফেলেছে হয়ত। তাই টাকা ফিরে পাবার সম্ভাবনা তো প্রায় নেইই ধরে নেওয়া যায়। তবু থানায় গিয়ে রিপোর্টটা লেখাতেই হবে। ওই ভুয়ো লোকটার নাম ঠিকানা না জানলেও রবিশঙ্করের ঠিকানাটা তো পুলিশকে বলতেই পারব আমরা। রবিশঙ্কর বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়ে উঠেছে সেটা হয়ত পুলিশ খুঁজে বের করতে পারবে। যদি পুলিশ তাকে ধরতে পারে তাহলে অন্য আরেকজনকেও ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে। টাকাটা ফেরত না পেলেও ওই লোকগুলোর সাজা পাওয়া উচিৎ। তাই চল, আমরা দু’জনে মিলেই লোকাল থানায় গিয়ে ডাইরীটা করে আসি। তবে দাঁড়াও। আগে চট করে কিছু একটা বানিয়ে নিই। সকালের খাবারটা খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ব”।
রচনা রান্নাঘরে এসে কাজে লেগে গেল। খানিক বাদে রতীশও রান্নাঘরে এসে একটা চেয়ার নিয়ে বসতে বসতে বলল, “রচু, আমার মনে হয়, টাকাটা যে আমি স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলুম এ’কথাটা মন্তিকে বা বাড়ির কাউকে না জানালেই বোধ হয় ঠিক হবে। আমরা যদি কথাটা একটু অন্যভাবে বলি, ধর যদি বলি টাকাটা আমি হারিয়ে ফেলেছি, তাহলে কেমন হয় বল তো”?
রচনা নিজের কাজ করতে করতে জবাব দিল, “না সোনা। দিদিভাই আর বাড়ির সকলেই আমাদের আপনজন। আমাদের প্রিয়জন। আমাদের খুব কাছের মানুষ। এমন কারো কাছে মিথ্যে কথা বলা একেবারেই উচিৎ নয়। আর জানো তো? সত্যকে সাময়িক ভাবে লুকোতে পারলেও, সেটা একদিন না একদিন ঠিক প্রকাশ পাবেই। আর যখন তারা বুঝতে পারবে যে আমরা তাদের মিথ্যে কথা বলেছি, তখন তারা কতটা আঘাত পাবে, একবার ভাব তো? আমি বুঝতে পারছি, কথাটা বলতে তোমার সঙ্কোচ হচ্ছে। তুমি সেটা নিয়ে ভেব না। আমি সবাইকে বুঝিয়ে দেব যে তুমি রবিশঙ্করদের ছলনাটা না বুঝে সরল মনে লোকটার ছেলের কলেজের অ্যাডমিশনের কথা শুনেই টাকাটা দিয়েছিলে। তুমি টাকাটা তাদের হাতে দিয়েছ বলেই তো তোমার লজ্জা হচ্ছে সে’কথাটা বলতে? কিন্তু একটু ভেবে দেখ তো? এ লজ্জা তো শুধু তোমার একার নয়। আমাদের সকলের। আমরা কেউই তো রবিশঙ্করের বদ মতলবটা বুঝতে পারিনি। আর বিপদের দিনে নিজের লোকেরা পাশে থাকলে সব বিপদই কাটিয়ে ওঠা যায়। বাড়ির সকলে আমাদের পাশে আছেন, দিদিভাই আমাদের পাশে আছেন। তাই বাড়ির লোকদের কাছে আমরা কোন কথাই গোপন করব না। টাকাটা তো আমরা হারিয়েই ফেলেছি সোনা। এখন তাদের কাছে মিথ্যে কথা বললে তাদের সকলের ভালবাসাও হাঁরিয়ে ফেলব আমরা। সেটা কি হতে দেওয়া যায় বলো”?
***************
লোকাল থানায় যেতে যেতে রচনা রতীশকে বলল, “সোনা, আমাদের দিদিভাইও যে পুলিশে চাকরি করে এটা কিন্তু আমরা এখন থানায় গিয়ে বলব না। আগে দিদিভাইয়ের মতামত নিতে হবে এ ব্যাপারে। তারপর প্রয়োজন হলে আমরা সে’কথা পুলিশকে বলব”।
থানায় গিয়ে তাদের যা কিছু জানা ছিল তার সবটাই পুলিশকে খুলে বলল রতীশ আর রচনা। পুলিশ অফিসার লোকটা আরও অনেক কিছু জানতে চাইছিল। কিন্তু রতীশ সে সব কথার জবাব দিতে পারেনি। পুলিশ অফিসার রতীশের আর রবিশঙ্করের নাম ঠিকানা নোট করে নিয়ে আর বিমল আগরওয়ালার ভিজিটিং কার্ডের একটা ফটোকপি জমা নিয়ে জানতে চাইল যে রতীশের কাছে রবিশঙ্করের কোন ছবি আছে কিনা। রতীশ জানাল, নেই।
______________________________