Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
#40
(Update No. 62 dt. 29.7.2018)

রবিশঙ্করের বাড়ি সে আগে কখনও যায় নি। কাগজে লেখা ঠিকানায় যেতে হলে কোন রুটে কোন দিকে যেতে হবে তা তার জানা ছিল না। ফুটপাথের একটা ফলের দোকানে গিয়ে দোকানের লোকটাকে কাগজে লেখা ঠিকানাটা বলে সে রাস্তার হদিশ জেনে নিল। তারপর দোকানিটার কথা মত একটা বাসে উঠে পড়ল। বেলা দেড়টা নাগাদ সে বাসের কন্ডাক্টরের কথায় একটা জায়গায় নেমে পড়ল। বাস থেকে নেমে আরেকটা দোকানে ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করতেই দোকানের লোকটা একদিকে হাতের ঈশারা করে বলল, “আপনি এখান থেকে ওই গলিটা দিয়ে এগিয়ে যান। কিছু দুর গেলে রাস্তার ডানপাশে একটা লন্ড্রী দেখতে পাবেন। সেখানে রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা মোটর পার্টসের দোকান আর একটা ওষুধের দোকান দেখতে পাবেন। সেখানে বাড়ির নম্বরটা বললেই তারা দেখিয়ে দেবে আপনাকে”।

রতীশ লোকটার নির্দেশ মত আট ন’ মিনিট হাঁটবার পর রাস্তার বাঁদিকে মোটর পার্টসের আর ওষুধের দোকান দুটো দেখতে পেল। কিন্তু উল্টোদিকে অন্যান্য অনেক গুলো ছোট খাটো দোকান থাকলেও কোন লন্ড্রী সে দেখতে পেল না। অবশ্য দু’তিনটে বন্ধ দোকান ঘর দেখা গেল। রতীশ পায়ে পায়ে ওষুধের দোকানটায় গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই দোকানের লোকটা রতীশের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উল্টোদিকের একটা বাড়ির দিকে ঈশারা করে বলল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ ওই বাড়িটাতেই থাকত। কিন্তু তারা বোধ হয় এখন আর নেই এখানে”।
 

রতীশ জিজ্ঞেস করল, “নেই মানে? তারা কি বাইরে কোথাও চলে গেছে”?
 

দোকানের লোকটা জবাব দিল, “কোথায় গেছে সে’সব কথা জানিনে দাদা। কিন্তু কাল দুপুর দুটো নাগাদ তাকে বৌ বাচ্চা নিয়ে সঙ্গে বেশ কিছু মালপত্র নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে দেখেছি। এর বেশী কিছু আমি আর বলতে পারছি না”।
 

রতীশ বোবা চোখে বাড়িটার দিকে দেখতে লাগল। ছোট্ট একতলা বাড়িটার দরজা জানালা একটাও খোলা নেই। সামনে একটা তালাও ঝুলছে। রতীশ মনে মনে ভাবল, রবিশঙ্কর তার কাছ থেকে টাকা গুলো লুটে নিয়েই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। সুতরাং তার দেখা পাবার সম্ভাবনা আর নেই। রতীশের মনে হচ্ছিল তার শরীরে বুঝি আর শক্তি নেই। পা দুটো যেন আর এগোতে চাইছে না। ক্লান্ত অবসন্ন মনে শরীরের বোঝা টানতে টানতে সে আবার বাস স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। সে এখন কোথায় যাবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। কিন্তু ফ্ল্যাটে তো তাকে ফিরতেই হবে। রচনা না জানি মনে মনে কত কিছু ভেবে বসে আছে। সবার আগে সে অফিস ঘরে ঠাকুরের আসন বসাবে। তার আগে কোন জিনিস কিনে সেখানে নিয়ে যেতে মানা করেছিল। সে নিশ্চয়ই সব কিছু যোগার যন্ত্র করে তৈরী হয়ে আছে, বিকেলে তার সাথে তাদের কমপ্লেক্সে আসবে বলে। এখন বাড়ি ফিরে গিয়ে সে রচনাকে কী বলবে? রবিশঙ্করের মিষ্টি কথায় ভুলে কাল সে বোকার মত দু’লাখ টাকা খুইয়ে বসেছে। এ’কথা রচনাকে সে কোন মুখে বলবে। নিজের মুর্খামীর কথা ভেবে তার নিজেরই লজ্জা লাগছে সে কথা ভাবতে।

রুটের বাস আসতেই সে বাসে উঠে পড়ল। বাড়ির সামনের স্টপেজে এসে নেমেও তার পা দুটো যেন আর বাড়ির দিকে এগোতে চাইছিল না। বাস স্টপের একটা শেডের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল সে। এমন সময় তার পকেটের ভেতরের মোবাইলটা বেজে উঠল। সে জানে বাড়ি থেকে কেউ কিংবা রচনা ফোন করে থাকবে হয়ত। কিন্তু ইচ্ছে করেই কলটা আর রিসিভ করল না সে। বসে বসে ভাবতে লাগল, সে ঘরে ফিরে রচনার মুখোমুখি দাঁড়াবে কী করে। একটু বাদেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। এবার আর থাকতে না পেরে সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রচনার ফোন। ইশ স্বামী এখনও ঘরে ফিরে আসেনি বলে বেচারী মেয়েটা হয়ত কত দুশ্চিন্তা করছে। কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগাতেই রচনার গলা শুনতে পেল, “কী গো, কী হয়েছে তোমার? খেতে আসবে না নাকি? আমি কখন থেকে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। কাজ শেষ হয়নি এখনও না কি”?
 

রতীশ ঘড়ঘড়ে গলায় কোনরকমে বলল, “এই তো রাস্তাতেই আছি, ফিরছি। কিন্তু আমাকে এখন খেয়েই আবার বেরিয়ে আসতে হবে। কাজটা শেষ হয়নি এখনও। ঠিক আছে আসছি”।
 

রতীশ যখন ফ্ল্যাটে ফিরে এল তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে। ঘরে ঢুকেই সে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে রচনার দিকে না তাকিয়েই বলল, “চটপট খাবার বেড়ে ফেল সোনা। আমাকে এখনই বেরোতে হবে আবার”।

রচনা রতীশের কথা বলার ভঙ্গী দেখে একটু অবাক হল। রতীশের মুখটাও খুব শুকনো দেখাচ্ছে। রান্নাঘরে গিয়ে থালায় খাবার সাজাতে সাজাতে ভাবল, এই চড়া রোদের মধ্যে এতোটা পথ বুঝি হেঁটেই এসেছে তার স্বামী। তাই হয়ত এমন লাগছে। কিন্তু বিয়ের তিন বছরের মধ্যে এমনটা কখনও হয়নি যে রতীশ ঘরে এসে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেছে। মনে মনে ভাবল কাজটা শেষ হয়নি বলেই বোধ হয় একটু টেনশনে আছে।

কিন্তু খাবার টেবিলে রতীশকে মাথা নিচু করে গোগ্রাসে খেতে দেখে সে আবার অবাক না হয়ে পারল না। রতীশ বরাবর ধীরে সুস্থে খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ সে এমন তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছে যেন একটু দেরী হলেই তার গাড়ি ছুটে যাবে। মনে মনে অবাক হলেও রচনা কিছু বলল না। কিন্তু সামান্য একটু খেয়েই রতীশ উঠে পড়ল। বেসিনে হাত ধুয়েই সে আবার বেরোতে বেরোতে বলল, “আমি আসছি সোনা। কাজ শেষ হলেই ফিরে আসব”।
 

রচনা তখনও তার এঁটো হাত ধুয়ে উঠতে পারেনি। সে ছুটে সামনের ঘরে এসে রতীশের পেছন থেকেই বলে উঠল, “শোনো, বাকি সব জিনিস আমি গুছিয়ে নিয়েছি। তুমি আসবার সময় সম্ভব হলে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে এস। আর আমাকে কখন নিয়ে যাবে”?

রতীশ লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব” বলেই লিফটের ভেতর ঢুকে পড়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। রচনার চোখের সামনে সে আর থাকতে পারছিল না।
 

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনির্দিষ্ট ভাবে ফুটপাথ ধরে একদিকে হেঁটে চলল। মনের ভেতর তার হাজারটা প্রশ্ন। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই কোন জবাব সে খুঁজে পাচ্ছিল না। উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে এ’পথ ও’পথ ধরে হাঁটতে লাগল। পকেটের ফোনটা এর ভেতর অনেক বার বেজে উঠেছে। কিন্তু সে একটা কলও রিসিভ করে নি। সে জানত রচনা আর সীমন্তিনী বাদেও বাড়ি থেকে অনেকেই কমপ্লেক্সের লিজ নেবার কাজটা সম্পন্ন হয়েছে কিনা, সেটা জানতেই তাকে ফোন করছে। কিন্তু কাউকে তো কিচ্ছুটি বলবার নেই তার। নিজের বোকামির কথাটা বুক ফুলিয়ে সে কী করে বলবে সবাইকে?

এ রাস্তা সে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সে ভাবল, থানায় গিয়ে একটা ডাইরী করা বোধহয় তার উচিৎ। যদিও টাকা ফিরে পাবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে, তবু ব্যাপারটা থানায় জানিয়ে রাখা উচিৎ। তবে তার আগে মন্তির সাথে কি একটু কথা বলে নেবে? কিন্তু সব শুনে মন্তি তো তাকে ছিঃ ছিঃ করবে। মন্তি হয়ত তাকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। রবিশঙ্কর যে লোকটাকে বিমল আগরওয়ালা বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে আসলে কে? ওই কমপ্লেক্সের চাবি সে পেল কোথায়? রবিশঙ্কর আর ওই লোকটার সাথে আসল বিমল আগরওয়ালার সম্পর্ক কী? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হবে, বার বার করে বলে দেওয়া সত্বেও রতীশ এগ্রিমেন্ট সই করবার আগেই তাকে টাকাগুলো দিয়ে দিল কেন?
 

এসব প্রশ্নের একটারও উত্তর তার জানা নেই। তার মনে হল, দুপুরে আসল বিমল আগরওয়ালার সাথে দেখা হবার পর সে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে অনেক কথাই সে জানতে চায়নি। তাকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশও তো তাকে এ’সব প্রশ্ন করবে। তার মনে হল বিমল আগরওয়ালার কাছ থেকে এসব তথ্য তার জেনে নেওয়া উচিৎ।
 

কথাটা মনে হতেই সে পকেটের ভেতর থেকে বিমল আগরওয়ালার ভিজিটিং কার্ডটা বের করল। সে বলেছিল সন্ধ্যের পরই তাকে অফিসে পাওয়া যাবে। এখন তো সন্ধ্যে হতেই চলল। তার অফিসের ঠিকানায় পৌঁছতে পৌঁছতে তো আরও চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট কেটে যাবে। তাই এখন রওনা হলেই ভাল হবে। এই ভেবে সে একটা সিটিবাসে উঠে পড়ল।
 

নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থেকে নেমে সে একটা দোকানের একজনকে জিজ্ঞেস করে একদিকে এগিয়ে চলল। মিনিট পাঁচেক বাদেই রাস্তার ডানদিকে একটা সাত তলা বিল্ডিঙের তিনতলায় আগরওয়ালা রিয়েল্টর্স লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেল। গ্রাউণ্ড ফ্লোরের দোকানটায় জিজ্ঞেস করে সে লিফটে চড়ে তিনতলায় উঠে এল। করিডোর ধরে একটু এগিয়ে যেতেই অফিসটা চোখে পড়ল। ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে বসা একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পেয়ে তার কাছে গিয়ে বিমল আগরওয়ালার নাম বলতেই সে একদিকে একটা রুমের দিকে ঈশারা করে দেখিয়ে দিল। রতীশ সে ঘরটার দরজার সামনে যেতেই ভেতর থেকে বিমল আগরওয়ালার গলার স্বর ভেসে এল, “আরে রতীশবাবু যে! আসুন আসুন”।
 

রতীশ ঘরে ঢুকে দেখল মাঝারি সাইজের একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ও’পাশে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে বিমল একটা ফাইল খুলে দেখছে। রতীশ ভেতরে ঢুকতেই বিমল তাকে চেয়ারে বসতে বলে বলল, “হ্যা বলুন দেখি। থানায় গিয়েছিলেন? ডাইরীটা করেছেন”?
 

রতীশ চেয়ারে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের চোখ মুখ মুছতে মুছতে জবাব দিল, “না বিমলজী। তখন থেকেই মনের ভেতরটা এতটাই অস্থির হয়ে আছে যে কোন কিছুই ঠিক মত ভেবে উঠতে পারছি না। আর আমার নিজের মনেই কয়েকটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু সে’সব প্রশ্নের জবাব যারা দিতে পারে তারা দু’জনেই তো আমার সর্বস্ব লুট করে গা ঢাকা দিয়েছে। তাই ভাবলুম দু’ একটা কথা আপনার কাছ থেকেও জেনে নিতে পারলে একটু সুবিধে হবে। তাই আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি খুব ব্যস্ত আছেন”?

বিমল তার হাতের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে বলল, “কাজ তো সারা জীবন ধরেই থাকবে রতীশবাবু। কিন্তু এ’সময়ে আমি মোটামুটি ফ্রিই থাকি। আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন। তবে এক মিনিট দাঁড়ান। কি খাবেন বলুন তো? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছুই খাননি। অবশ্য এ অবস্থায় খাবার মত মনের অবস্থাও যে আপনার নেই, সেটাও তো আন্দাজ করতেই পারছি। তবু চা কফি বা আর কিছু খেতে চাইলে বলুন। তারপর আপনার কথা শুনছি”।

রতীশ হাত তুলে বলল, “না না বিমলজী, কিছু লাগবে না। আমি শুধু....”

তাকে মাঝপথে বাঁধা দিয়ে বিমল বলল, “বেশ ঠিক আছে। তাহলে একটু কফিই খান শুধু” বলেই তার চেম্বার সংলগ্ন কাঁচে ঘেরা একটা কেবিনের দিকে চেয়ে ঈশারা করতেই এক সুন্দরী যুবতী বেরিয়ে আসতেই তাকে কফি আনবার আদেশ দিয়ে রতীশের দিকে চেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, “হ্যা এবার বলুন, কী জানতে চাইছেন আমার কাছে”।

রতীশ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বিমলজী, আপনি কি রবিশঙ্কর প্রসাদ বলে কাউকে চেনেন? আসলে তার মাধ্যমেই ওই কমপ্লেক্সটা ভাড়া নেবার কথা হয়েছিল”।

বিমল মনে মনে ভাবতে ভাবতে জবাব দিল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ? বিহারী লোক হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ নামে কাউকে তো আমি জানি না। লোকটা থাকে কোথায়? কী কাজ করে”?

রতীশ বলল, “লোকটা আসলে একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ। ফটোস্ট্যাট আর পিসিওর জিনিসপত্র সাপ্লাই করে। রাজগঞ্জে আমার কাকুর দোকানে সে অনেক বছর ধরে এসব জিনিস যোগান দিত”।

বিমল বলল, “দেখুন রতীশবাবু, আমার কাজ হচ্ছে বাড়ি ঘর বানানো। পুরোন বাড়ি ঘর বা জায়গা জমি কিনে সেখানে বড় বড় রেসিডেন্সিয়াল আর কমার্সিয়াল কমপ্লেক্স বানিয়ে বিক্রী করি। তাই ফটোস্ট্যাটের লাইনের কারুর সাথে আমার খুব বেশী জানা শোনা নেই। আমার নিজের অফিসে ফটোস্ট্যাট মেশিন দুটো আছে ঠিকই। কিন্তু এ কমপ্লেক্সেরই দু’তলায় একজন সাপ্লায়ার আছে। তাদের কাছ থেকেই নেওয়া। আর কখনো সখনো সার্ভিসিংএর প্রয়োজন হলে ওরাই এসে করে দিয়ে যায়। কিন্তু রবিশঙ্কর বলে কাউকে তো আমি চিনি না”।

এমন সময়ে রতীশের পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। রতীশ ফোন বের করে দেখে সীমন্তিনীর ফোন।
 

ইচ্ছে করেই কলটা রিজেক্ট করে দিয়ে সে আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বিমলজী, আপনি তো বলেছেন যে ওই কমপ্লেক্সের চাবি আপনার কাছেই থাকে। তাহলে কাল এবং দু’মাস আগেও ওই লোকটা কী করে কমপ্লেক্সটার দরজায় লাগানো তালা খুলে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারল”?

বিমল বলল, “আরে সে’কথাটা আমিও তো অনেকবার ভেবেছি। অফিসে এসে পরশু যে ছেলেটাকে আমি চাবি দিয়ে সেখানে সাফ সাফাই করতে বলেছিলাম, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। সে অন্য কাউকে চাবিটা দিয়েছিল কি না। কিন্তু সে বলল সে কাউকে চাবি দেয়নি। আর সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কাজ দেখাশুনো করেছে। কাজ শেষে সে নিজে হাতে দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে এসেছে। অফিসে এসে আমাকেও সন্ধ্যের সময় সে চাবিটা দিয়ে গেছে, আর আমিও রোজকার মত সেটা লকারে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আপনার মুখে এসব কথা শুনে তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না, এটা কী করে সম্ভব হয়? চাবিটা তো সব সময় আমার এ লকারটার ভেতরে রেখে থাকি আমি। আর এ লকার কেবল আমি ছাড়া আমার অফিসের আর কেউ খোলে না। আর এটার চাবিও সব সময় আমার সাথেই থাকে” বলে একদিকে রাখা একটা আলমারির দিকে ঈশারা করল।

এমন সময়ে মহিলা কফি নিয়ে এল। রতীশকে একটা কাপ দিয়ে বিমল অন্য কাপটা নিজের হাতে নেবার পর রতীশ জিজ্ঞেস করল, “সেটার কোন ডুপ্লিকেট চাবি......”

আবার পকেটের ভেতর মোবাইল বেজে উঠতেই রতীশ কথা থামিয়ে ফোন বের করে দেখে সীমন্তিনীর কল। রিজেক্ট করে জিজ্ঞেস করল, “ওই কমপ্লেক্সের তালার কোন ডুপ্লিকেট চাবি কি অন্য কারো কাছে আছে”?

বিমল জবাব দিল, “হ্যা রতীশবাবু। ডুপ্লিকেট চাবিও একটা আছে। কিন্তু সেটা তো সবার নাগালের বাইরে আমার ব্যাঙ্কের লকারে রাখা আছে”।

রতীশ এবার হতাশ গলায় বলল, “ওহ, তাহলে তো সেটা নিয়ে আর কোন কথাই ওঠানো উচিৎ নয়। কিন্তু ওই লোকটা কী করে তাহলে কমপ্লেক্সটা খুলল, সেটা তো কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। ইশ, কী যে করি এখন আমি। আমার সব স্বপ্ন সব আশা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, এ তো আমি ভাবতেই পাচ্ছি না। রাজগঞ্জে কলেজের চাকরিতেও রিজাইন করে এসেছি। ফিরে গেলেও সে চাকরি আর আমি ফিরে পাব না। এখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। কোন কাজকর্ম ছাড়া কী করে থাকব এখানে? নতুন করে কোন একটা কমপ্লেক্স ভাড়া নেবার মত পয়সাও হাতে নেই। ফ্ল্যাটের ভাড়াও বা যোগাব কোত্থেকে”?
 

বিমল বলল, “রতীশবাবু, আপনার আজই থানায় গিয়ে ডাইরীটা করা খুব দরকারি ছিল। যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, আপনার টাকা ফিরে পাবার সম্ভাবনা কিন্তু ততই কমে যাচ্ছে। আপনি আর দেরী না করে কাল সকালেই লোকাল থানায় গিয়ে ব্যাপারটা জানান। আপনার যা কিছু জানা আছে, সেসব কথা পুলিশকে খুলে বলুন”।

রতীশ আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “সে না হয় করব বিমলজী। কিন্তু তারপর? তারপর আমি কী করব? পুলিশ কি আমার ডাইরি নেবার সাথে সাথেই আমার টাকাটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারবে? আমি খাব কী? সংসার চালাব কী দিয়ে? ফ্ল্যাটের ভাড়া কী করে যোগাবো”?
 

রতীশের পকেটের মোবাইলটা আবার বেজে উঠতে বিমল বলল, “বার বার কলটা কেটে দিয়ে ঠিক করছেন না রতীশবাবু। আপনি বরং কলটা রিসিভ করে বলে দিন যে আলোচনায় ব্যস্ত আছেন। আপনি পরে তাকে কল ব্যাক করবেন”।

রতীশ সীমন্তিনীর কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগাতেই সীমন্তিনী ওদিকে থেকে কী বলে যাচ্ছিল, সেসব না শুনেই সে বলল, “মন্তি আমি কমপ্লেক্সের মালিকের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত আছি। তোকে একটু বাদে আমি ফোন করছি” বলেই ফোন কেটে দিল।
 

বিমল আগরওয়ালা কিছু সময় চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল, “রতীশবাবু। আমার একটা কথা শুনুন। দক্ষিণ কোলকাতায় আমার এক বন্ধুর একটা যোগা সেন্টার আছে। তার ওখানে তিন চারজন টিচার থাকলেও তারা কেউই তেমন এক্সপার্ট নয়। তাই সে একজন ভাল যোগা টিচার খুঁজছে। আপনি যদি সেখানে যোগা টিচারের কাজ করতে রাজি থাকেন, তাহলে আমি তার সাথে কথা বলে দেখতে পারি। ভাল টিচার পেলে সে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার পর্যন্ত স্যালারি দিতে রাজি আছে। আপনি করতে চান সে কাজ”?

রতীশ জবাব দিল, “কিছু না কিছু তো আমাকে করতেই হবে বিমলজী। কিন্তু এখন এই মূহুর্তে আমার মনটা এতটাই অস্থির হয়ে আছে যে ভাল মত কিছু ভাবতেও পাচ্ছি না। তবে আমাকে না জেনে না চিনে আপনি যে আমার এতটা উপকার করতে চাইছেন সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাববার সুযোগ দিন”।
 

বিমল বলল, “হ্যা হ্যা, আমি আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি রতীশবাবু। এমন অবস্থায় আর মাথার ঠিক থাকে বলুন। তবে ভিজিটিং কার্ডে আমার মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে। আপনি আপনার সুবিধে মত যে কোন সময় আমাকে ফোন করতে পারেন”।

রতীশ বলল, “যাকে দশ বছর ধরে আমরা সবাই জানতুম চিনতুম সে লোকটাই এমন অবলীলায় আমার সর্বস্ব লুট করে পালিয়ে গেল। আর আমাকে না জেনে না চিনেই আমার জন্য এতটা ভাবছেন বিমলজী”।

বিমল জবাব দিল, “দেখুন রতীশবাবু, মানুষ যেমন মানুষের শত্রু, তেমনি মানুষই মানুষের বন্ধুও হয়ে থাকে। আমরাও তো সারাদিন লোক চড়িয়ে খাই। তাই মানুষ চিনতেও পারি। আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আপনি খুবই ভদ্র পরিবারের একজন সজ্জন মানুষ। আর তাছাড়া আপনার এই ঘটণাটার সাথে আমার নামটাও জড়িয়ে পড়েছে। তাই মনে হচ্ছে আপনার এমন বিপদের সময় আমি যদি একটু আপনার পাশে থাকতে পারি, তাহলে ক্ষতি কি? আর আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারলে আমার তো কোন লোকশান হবে না। আমার বন্ধু আপনার মতই একজনকে খুঁজছে। তাই আমি শুধু তার কাছে আপনাকে নিয়ে যাব। আর তো কিছু আমাকে করতে হবে না। তারপর কি হবে সেটা আমার বন্ধু বুঝবে আর আপনি বুঝবেন। তবে আপনি যদি চান, তাহলে আমি আমার এই কনস্ট্রাকশন ফার্মেও আপনাকে কোনও একটা কাজ দিতে পারি। কিন্তু আমাদের সমস্ত কাজই হচ্ছে লেবার মিস্ত্রীদের নিয়ে। আপনার মত ভদ্রলোকের পক্ষে এ’সব কাজ করা হয়ত সম্ভব হবে না। তাই আমার বন্ধুর যোগা সেন্টারের কথাটা বললাম আপনাকে। আপনি তো ওই লাইনেরই লোক”।

রতীশ কফি শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে বিমলজী। আজ তাহলে আমি উঠছি। আর অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি দু’একটা দিন ভেবে দেখি। যদি কোথাও কাজে ঢুকতেই হয় তাহলে আপনাকে ফোন করে জানাব। চলি নমস্কার” বলে বিমলের অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
 

*************
 
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 26-02-2020, 08:21 PM



Users browsing this thread: 8 Guest(s)