Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
#39
(Update No. 61 date. 28.7.2018)

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন রচনা আর রতীশ চা খাচ্ছিল, তখনই রবিশঙ্করের ফোন এল। রবিশঙ্কর রতীশকে বলল যে সে বিমল আগরওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে কমপ্লেক্সে পৌঁছে যাবে সকাল ন’টার ভেতর। রতীশ যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেখানে চলে আসে। রচনা সে’কথা শুনেই বলল, “ইশ, আমি ভেবেছিলুম সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করে ঠাকুর ঘরে ঠাকুরের আসনটা পেতে দেব। তুমি ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরোতে পারতে। কিন্তু আজই দেরী করে ঘুম ভাঙল। তুমি কখন বেরোবে গো”?
 

রতীশ বলল, “আধঘন্টার মধ্যেই বেরোতে হবে আমাকে। কিন্তু তোমাকে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে হবে না। কালও তো তুমি বারোটার আগে ঘুমোওনি। তাড়াতাড়ি না উঠে ভালই হয়েছে। তুমি বরং এক কাজ কর সোনা। আমাকে কিছু একটা খাবার বানিয়ে দাও। সে’টুকু খেয়েই বেরিয়ে যাব। আজ যদি কমপ্লেক্সে ঢুকতে পারি তাহলে সেন্টারের জন্য যে জিনিসগুলো কিনতে হবে সে’সব বিকেলেই কিনে এনে সেখানে রেখে দেব”।

রচনা খালি কাপ প্লেটগুলো উঠিয়ে নিতে নিতে বলল, “না সোনা, আজই সেখানে কোন জিনিস ঢুকিও না। আজ যদি তারা কমপ্লেক্সের চাবিটা তোমার হাতে দিয়ে দেয়, তাহলে শুধু চাবিটাই নিয়ে এস। ভেতরে যদি সাফ সাফাই কিছু করতে হয় সেটা বিকেলে গিয়ে দু’জনে মিলে করে নেব। কাল সকালে সেখানেও আমি ঠাকুর বসিয়ে দেব। তারপর তোমার যা কিছু করার প্রয়োজন সে’সব কোর”।
 

রুটি সব্জী খেয়ে রতীশ ফ্ল্যাট থেকে বেরোল বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ। একটা হাতব্যাগে দু’লাখ টাকা ভরে নিতে দেখে রচনা বলল, “সোনা শোন। এগ্রিমেন্ট সাইন না হওয়া অব্দি কিন্তু তুমি তাদের কোন টাকা পয়সা দিও না। দিদিভাইও কিন্তু বারবার করে এ’কথা বলে দিয়েছেন”।

রতীশ সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পায়ে হেঁটে গেলে পনের মিনিটেই পৌঁছে যাবে। রচনা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রতীশকে সামনের মোড়ের দিকে যেতে দেখে দু’হাত জোড় করে মনে মনে ঠাকুরকে প্রণাম করল।
 

রতীশ কমপ্লেক্সের সামনে এসে যখন দাঁড়াল তখনও ন’টা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই রবিশঙ্করের সাথে বিমল আগরওয়ালা এসে পৌঁছল। বিমলজী চাবি দিয়ে বিল্ডিঙের দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। রতীশ ভেতরের সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখল। পরিস্কারই আছে সবগুলো রুম। কমপ্লেক্সটা একটা পার্টিশান দিয়ে দু’ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগটা খুব বড় নয়। কিন্তু ভেতরের অংশটা বেশ বড়। ছত্রিশ ফুট বাই চল্লিশ ফুট বেশ বড় একটা হলঘরের একদিকে দুটো ছোট ছোট রুমের সাথে একটা মাঝারি সাইজের বাথরুম। সামনের অংশটাতেও একটা ছোট বাথরুম আছে। এ’সব রতীশ আগেই দেখে গিয়েছিল। সামনের ছোট অংশটা সে তার অফিসঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। আর ভেতরের অংশে মূল ট্রেনিং দেওয়া যাবে। তবে আগে ভেতরটা এত পরিস্কার ছিল না। এখন সবকিছুই বলতে গেলে ঝকঝকে তকতকে। বিমলজী সব কিছু দেখিয়ে রতীশকে বলল, “আমি দু’দিন আগে লোক লাগিয়ে সব পরিস্কার করে রেখেছি রতীশবাবু। ইলেকট্রিক লাইন গুলো, আর বাথরুমের জলের পাইপ গুলো সব চেক করে ঠিকঠাক করে রেখেছি। আর কোন সমস্যাই নেই”।
 

রতীশ খুশী হয়ে বলল, “হ্যা, সে তো দেখতেই পাচ্ছি বিমলজী। কিন্তু বলছিলাম কি আজ তো এক তারিখ। আমাকে এটার পজেশান আজই দেবেন তো? আর এগ্রিমেন্টটা বানানো হয়েছে”?
 

বিমলজী রতীশ আর রবিশঙ্করকে দুটো চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ারে বসে বলল, “পজেশান আপনি কাল পাবেন রতীশবাবু। আসলে উকিলবাবু এগ্রিমেন্টটা ফাইনাল করতে পারে নি। ভুলটা আমারই হয়েছে। আপনার নাম ঠিকানা আমি যে কাগজটায় লিখে রেখেছিলাম, সে কাগজটা কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছি তা আর খুঁজেই পেলাম না। আর এগ্রিমেন্টে তো সে’সব লিখতে হবে। তবে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি আবার আমাকে ওই জিনিসগুলো লিখে দিন। আমি আজ বিকেলের মধ্যেই দু’কপি এগ্রিমেন্ট বানিয়ে রেডি করে রাখব। কাল সকালেই এগ্রিমেন্টে সই করে আপনি চাবি নিয়ে নেবেন”।

নিরূপায় হয়ে রতীশ নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজ কলম বের করে আবার নিজের নাম ধাম লিখে কাগজটা বিমলজীর হাতে দিয়ে বলল, “এই নিন। কিন্তু আজ তো তাহলে আর আমি কোন কাজ শুরু করতে পাচ্ছি না। ভেবেছিলুম আজই এখানে অফিসটা সাজিয়ে ফেলব”।
 

রবিশঙ্কর বলল, “একটা দিনের জন্যে আর এমন কী প্রব্লেম হবে রতীশবাবু। সব কথা তো আগেই হয়ে গেছে। কাল থেকেই আপনি কাজ শুরু করতে পারবেন। আপনি বরং বিমলজীর পেমেন্টটা করে দিন আজ”।
 

রতীশ বলল, “হ্যা সে তো করতেই হবে। কিন্তু বলছিলাম কি, এগ্রিমেন্টটা তো আজ আর সাইন করা হচ্ছে না। ওটা করেই না হয় পেমেন্টটা দিতুম”।
 

বিমলজী বলল, “আপনি ঠিক কথাই বলছেন রতীশবাবু। কিন্তু আমার ছেলেটার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করতে আমাকে আজই সেখানে চার লাখ টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু আমার হাতে আজ অতগুলো টাকা নেই। তাই ভাবছিলাম, আপনার কাছে থেকে দু’লাখ টাকা পেলে আমাকে আর অন্য কোথাও খোঁজ করতে হবে না। আর আমার একটু অসাবধানতার জন্যেই আপনার কাগজটা হারিয়ে ফেলেছি বলেই মুস্কিলটা হল। তবে কাল তো আপনি এ বিল্ডিঙের পজেশান পেয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু কলেজে টাকাটা যে আমাকে আজই পেমেন্ট করতে হবে। আজই শেষ দিন”।
 

রবিশঙ্কর মিষ্টি করে হেসে বলল, “সে নিয়ে ভাবছেন কেন রতীশবাবু। আমি তো সব কিছুর সাক্ষী থাকছি। আর আপনাদের এগ্রিমেন্টে সাক্ষী হিসেবে আমিও তো সই করব। তাই ও নিয়ে ভাববেন না। চাচাজীর আজ টাকাটা দরকার। দিয়ে দিন। কাল সকাল ন’টায় আপনার সব কাজ হয়ে যাবে। আমি তো আছিই”।
 

রতীশ মনে মনে একটু দোনামনা করলেও আর কিছু না বলে ব্যাগ থেকে দু’লাখ টাকা বের করে বিমলজীর হাতে দিল। বিমলজী টাকাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “খুব উপকার করলেন আমার রতীশবাবু। নইলে আমার ছেলের অ্যাডমিশনের টাকাটা যোগার করতে আমাকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হত। থ্যাঙ্কিউ। কাল সকাল এ’রকম সময়েই চলে আসবেন। আমরাও আসব”।

রতীশ একটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু বিমলজী, টাকাটা নিয়ে আমাকে একটা রসিদ দেবেন না”?

রবিশঙ্কর জবাব দিল, “হ্যা সে তো অবশ্যই পাবেন। চাচাজীর রসিদ বই ছাপানোই আছে। কাল সকালে এগ্রিমেন্টের কপি আর বিল্ডিঙের চাবির সাথে সাথে সেটাও পেয়ে যাবেন। তাহলে এখন এখান থেকে বেরোন যাক চলুন। চাচাজী আপনি এখনই উকিলবাবুকে কাগজটা দিয়ে এগ্রিমেন্টটা ফাইনাল করতে বলে দিন। আজ বিকেলেই যেন দু’কপি এগ্রিমেন্ট সে বানিয়ে দেয়। তবে এগ্রিমেন্টে একটা কথা একটু বদলে দেবেন চাচাজী। রতীশবাবু দু’তারিখে বিল্ডিঙের পজেশান পাচ্ছে। তাই লিজ পেরিয়ড শুরু হবে দু’তারিখ থেকেই। আর শেষও হবে দু’তারিখে”।

বিমলজী চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, “হ্যা হ্যা, সেটাই তো হবে। একটা দিন লিজ কম পাবেন কেন রতীশবাবু। ও আমি উকিলবাবুকে বলে দেব। উনি সব ঠিক করে দেবেন”।

রতীশ কিছুটা দোনামনা করলেও আর কিছু বলে উঠতে পারল মা। ভাবল, রবিশঙ্কর তো সব কিছুর সাক্ষী থাকছেই। কী আর হবে।

হাতে আর কোন কাজ না থাকাতে রতীশ বাড়ির পথ ধরল। ভাবল, রচনা একা একা ঘর সংসারের সমস্ত কাজ সামলে ঘরের জিনিসপত্র গুলো গোছগাছ করতে ব্যস্ত। অন্য কোথাও না গিয়ে এখন ঘরে গিয়ে বাকি ঘরগুলো একটু ঠিকঠাক করে দিলে রচনার পরিশ্রম খানিকটা কম হবে।
 

দশটার আগেই রতীশকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখে রচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি গো? এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? কাজ হলনা আজ”?
 

রতীশ নিজের গায়ের জামা খুলতে খুলতে বলল, “হ্যা গো এগ্রিমেন্টটা রেডি হয়নি এখনও। বিমলজীকে আমি আগে একটা কাগজে আমার নাম ঠিকানা সব কিছু লিখে দিয়েছিলুম। সে কাগজটা সে কোথাও হারিয়ে ফেলেছে বলে উকিল না কি এগ্রিমেন্টটা বানাতে পারেন নি। আজ আবার সে’সব লিখে দিলুম। আজ বিকেলের মধ্যেই না কি এগ্রিমেন্টটা রেডি হয়ে যাবে। কাল সকালেই আমাকে ঘরের চাবি দিয়ে দেবে বলেছে। রবিশঙ্করও এসেছিল। আর ভেতরের সবকিছুই পরিস্কারই আছে। তাই নতুন করে আর কিছু করতে হবে না। কাল সকালে কমপ্লেক্সের চাবিটা পেলেই আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমিও জায়গাটা দেখে নিও। বেশী দুর নয় এখান থেকে। হেঁটে গেলেও পনের কুড়ি মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। আর অটোতে গেলে তো পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব। তাই আজ আর কিছু হচ্ছে না বলে চলে এলুম। ভাবলুম ঘরে তো গোছগাছ তুমি একা একাই সবটা করছ। হাতে যখন সময় আছে আমিও কিছু একটা করে তোমাকে সাহায্য করি”।

রচনা বলল, “তাহলে তুমি এক কাজ কর। জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে একটা ধোয়া পাজামা পড়ে নাও। তারপর ডাইনিং রুমের পরের ছোট ঘরটাতে ঠাকুরের আসনটা বসিয়ে দাও। রান্নাঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘর আর বসার ঘর তো মোটামুটি গোছান হয়েই গেছে। ঠাকুর ঘরটা ঠিক করতে পারলেই এখন আপাততঃ হয়ে যাবে। এ কার্টনটায় ঠাকুর ঘরের সব কিছু আছে। এটা খালি করে জিনিসগুলো সাজিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। আর শোনো, কয়েকটা পর্দা বানাতে দিতে হবে গো। পেছনের স্টোর রুমে পর্দা না লাগালেও অন্য ঘর গুলোর দরজায় তো পর্দা লাগাতেই হবে। আর বসার ঘর, শোবার ঘর, আর ডাইনিং রুমের জানালা গুলোতেও পর্দা লাগাতে হবে”।

রতীশ বলল, “ঠিক আছে, তাই করছি। জানালা দরজার মাপ গুলো কাগজে টুকে নিয়ে বিকেলে গিয়ে না হয় পর্দার কাপড় পছন্দ করে পর্দা বানাতে দিয়ে আসব। তুমিও যাবে কিন্তু আমার সাথে। তোমার পছন্দসই কাপড় কিনব”।
 

সীমন্তিনী আর বাড়ির সকলকে জানিয়ে দেওয়া হল যে কমপ্লেক্সের এগ্রিমেন্টটা আজ সাইন হয় নি। কাল এগ্রিমেন্টে সই করবার সাথে সাথে বিল্ডিঙের চাবিও রতীশ পেয়ে যাবে।


**************

পরদিন সকাল ন’টার একটু আগেই রতীশ কমপ্লেক্সের সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু বিমল আগরওয়ালা বা রবিশঙ্কর কাউকেই দেখতে পেল না। মনে মনে ভাবল, হয়ত কোন জরুরী কাজে ব্যস্ত আছে, তাই আসতে দেরী হচ্ছে। কাছাকাছি একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল সে। দশটা বেজে যাবার পরেও কাউকে আসতে না দেখে রতীশের চিন্তা হতে লাগল। বিমলজী বা রবিশঙ্কর কারুরই দেখা নেই। তাদের আসতে দেরী হচ্ছে বলে কেউ কোন ফোনও করেনি তাকে। আরো আধঘন্টা পেড়িয়ে যাবার পর রতীশ আর থাকতে না পেরে নিজের মোবাইল থেকে রবিশঙ্করের নাম্বার ডায়াল করল। কিন্তু শোনা গেল তার ফোন সুইচড অফ। আরও কয়েকবার চেষ্টা করেও কোন ফল হল না। প্রত্যেক বারেই একই জবাব, ফোন সুইচড অফ।
 

গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েও রতীশ এবার ঘামতে শুরু করল। তার মনটা যেন কূ গেয়ে উঠল। টাকাগুলো হাতে পেয়েই ওরা গা ঢাকা দিল না তো? হে ভগবান, এমনটা হলে সে কী করবে? কোথায় যাবে? বাবা কাকাদের কাছ থেকে আনা টাকাগুলো সে এভাবে খোয়াল? সীমন্তিনী আর রচনা দু’জনেই তাকে বারবার করে বলে দিয়েছিল যে এগ্রিমেন্ট সাইন না হওয়া অব্দি রতীশ যেন কোন টাকা পয়সা তাদের হাতে না দেয়। কিন্তু মালিকের ছেলের কলেজে অ্যাডমিশনের শেষ দিন ছিল বলেই কাল বিমলজী তার কাছ থেকে দু’লাখ টাকা চেয়ে নিয়েছিল। রতীশ যে সীমন্তিনী আর রচনার কথা ভুলে গিয়েছিল, তা নয়। সে কাল টাকাটা না দিলে বিমলজীকে হয়ত অন্যান্য জায়গায় ছুটোছুটি করতে হত। তার ছেলের অ্যাডমিশনটাও হয়ত হত না। কিন্তু বন্ধুর মত রবিশঙ্করের মিষ্টি কথায় রতীশ আর এমন সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখে নি। কিন্তু এখন এ মূহুর্তে সে বুঝতে পারছে, কত বড় ভুলটা সে আগের দিন করেছে। সময়ের সাথে সাথে তার মনের ধারণা আরও যেন পুষ্ট হতে লাগল।

প্রায় বারোটা নাগাদ সুন্দর পোশাক পড়া বছর পঞ্চাশের একজন মারোয়ারী ভদ্রলোককে দেখা গেল সেই কমপ্লেক্সের দরজার তালা খুলতে। তার সঙ্গে আরও একজন লোক। রতীশ অবাক চোখে দেখতে দেখতে প্রায় ছুটে লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি বিমল আগরওয়ালার লোক”?

ভদ্রলোক রতীশের দিকে অচেনা দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বলল, “বিমল আগরওয়ালার লোক মানে? না না আপনি ভুল করছেন। আমি বিমল আগরওয়ালার লোক নই। আসলে আমি নিজেই বিমল আগরওয়ালা। এই বিল্ডিঙের মালিক। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো”?
 

তার কথা শুনে রতীশের পায়ের তলার মাটি যেন কেঁপে উঠল। কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ-আপনিই বি-বিমল আগরওয়ালা? কিন্তু তাহলে কাল যে এসেছিল সে .....”
 

রতীশ আর নিজের কথা শেষ করতে পারল না। তার পা দুটো উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায় কাঁপতে শুরু করল। মাথাটাও কেমন যেন একটু ঘুরে উঠল। ভদ্রলোক রতীশের অবস্থা দেখে খপ করে তার হাতটা ধরে বললেন, “আরে আরে কী হল আপনার। আপনি আসুন তো। ভেতরে গিয়ে একটু বসুন। তারপর আপনার যা বলার আছে বলবেন। আসুন” বলে রতীশের হাত ধরে তাকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। রতীশকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে তার সঙ্গের লোকটাকে এক গ্লাস জল আনতে বলল। লোকটা সামনের একটা টেবিলের ওপর থেকে একটা খালি জলের জগ নিয়ে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল।
 

রতীশের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। চেয়ারের হাতল দুটো শক্ত করে ধরে সে চোখ বুজে রইল। খানিকক্ষণ বাদে লোকটা জগে জল ভরে এনে টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখা একটা কাচের গ্লাস ধুয়ে তাতে জল ভরে রতীশের কাছে এসে বলল, “এ জলটুকু খেয়ে নিন তো দেখি। একটু ভাল বোধ করবেন। নিন”।

রতীশ অবসাদে আচ্ছন্ন অবস্থায় তার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসের জলটুকু খেয়ে ফেলল। কিন্তু তার হাত পা তখনও ঠরঠর করে কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা হাতেই নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে আগে ঠোঁট মুছে নিয়ে তারপর কপালে ঘাড়ে গলায় লেগে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে শূণ্য দৃষ্টিতে ভদ্রলোকটার দিকে চাইল। ভদ্রলোক সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে রতীশের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন লাগছে বলুন তো? শরীর খারাপ লাগছে খুব”?
 

রতীশ দুর্বল গলায় কোন রকমে জবাব দিল, “না ঠিক আছে”।
 

ভদ্রলোক আরেকটা চেয়ার টেনে রতীশের কাছাকাছি এনে বসে বলল, “এবার বলুন তো? আপনি আমাকে খুঁজছেন কেন? আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পাচ্ছি না”।
 

রতীশ এবার ভাল করে চেয়ে দেখে ঘরের ভেতরে এক কোনায় একটা টেবিলের ওপর তিন চারটে কাঁচের গ্লাস আর একটা জলের জগ রাখা। কাল এ ঘরে শুধু চারখানা চেয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না। টেবিলের অভাবে নিজের ব্যাগের ওপরেই কাগজ রেখে নিজের নাম ঠিকানা লিখে ওই বিমল আগরওয়ালাকে সে দিয়েছিল। আর এখন এ লোকটা বলছে যে ইনিই বিমল আগরওয়ালা! গতকালের বা তারও আগে দেখা ওই লোকটা তাহলে কে ছিল?
 

রতীশ ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি সত্যি বলছেন? আপনিই বিমল আগরওয়ালা? এ বিল্ডিঙের মালিক বিমল আগরওয়ালা”?
 

ভদ্রলোক জবাব দিল, “হ্যা হ্যা, আমিই তো বিমল আগরওয়ালা। আপনি কি আমাকেই খুঁজছেন? আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি কে? আমি তো আপনাকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না”।
 

রতীশ ততক্ষণে বুঝে গেছে যে তার চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে। দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে সে বলল, “আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে। আসলে অন্য আরেকজন লোক নিজেকে এ বিল্ডিঙের মালিক বিমল আগরওয়ালা বলে পরিচয় দিয়ে আমাকে এ বিল্ডিংটা এক বছরের জন্যে লিজে দেবে বলে রাজি হয়েছিল। মাস দুয়েক আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আমার এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে। গতকাল লোকটা আমার সাথে এখানে বসে কিছুক্ষণ কথাও বলে গেছে। আমার সে বন্ধুও ছিল। কাল আমার কাছ থেকে দু’লাখ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। আজ লিজ এগ্রিমেন্ট সই করে আমাকে পজেশান দেবে বলে কথা ছিল। আমি সকাল ন’টা থেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছি। তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ ধরে ফোন করে যাচ্ছি। ফোন সুইচড অফ পাচ্ছি বারবার। আর এখন আপনি বলছেন, বিমল আগরওয়ালা আপনি”।

ভদ্রলোক সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বলল, “হে ভগবান। কী জমানা এসে গেছে? মানুষ মানুষকে এভাবে ঠকায়”?
 

রতীশ তার কথার অর্থ না বুঝে জিজ্ঞেস করল, “কি বলছেন আপনি”?
 

ভদ্রলোক তার দামী শার্টের বুক পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রতীশের হাতে দিয়ে বলল, “এই দেখুন, এই আমার ভিজিটিং কার্ড। এতে আমার ছবি নাম, বাড়ির আর অফিসের ঠিকানা সবকিছু লেখা আছে। দেখুন”।
 

রতীশ কার্ডখানা হাতে নিয়ে দেখল। তাতে লেখা- বিমল আগরওয়ালা। প্রোপাইটর আগরওয়ালা রিয়েল্টরস। সেখানে ভদ্রলোকের বাড়ি এবং অফিসের ঠিকানার সাথে তার একটা ছবিও ছাপান আছে। তার অফিসের আর রেসিডেন্সের ঠিকানা আর ফোন নাম্বারও লেখা আছে। কার্ডটা দেখার পর রতীশের মুখে আর কথা যোগাচ্ছিল না।

ভদ্রলোক বলল, “এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি আপনাকে মিথ্যে কথা বলছি না। আমি একজন
 
বিল্ডার। এ বিল্ডিংটা আমার নিজস্ব। কয়েক মাস ধরে ফাঁকা পড়েছিল। এখন একটা ব্যাঙ্ক এটাকে পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়ে এখানে তাদের একটা ব্রাঞ্চ খুলবে। আজ বিকেলেই ব্যাঙ্কের অফিসাররা এখানে আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। আমি দু’দিন আগে লোক লাগিয়ে কমপ্লেক্সটা পরিস্কার করিয়ে রেখেছি। তবু আজ ব্যাঙ্কের লোকেরা আসছে বলে আমি একটু দেখতে এসেছি সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না” একটু থেমেই ভদ্রলোক আবার বললেন। “কিন্তু আপনি বলছেন যে কাল আপনি এ কমপ্লেক্সে ঢুকেছিলেন। এখানে বসে তাদের সাথে কথা বলেছেন”?
 

রতীশ জবাব দিল, “হ্যা, আমি সত্যি বলছি। আর কালই শুধু নয়। মাস দুয়েক আগেও একবার এখানে এসেছিলুম। তখন কমপ্লেক্সের ভেতরটা দেখে আমার মনে হয়েছিল যে এটা একটা যোগা সেন্টার বানাবার উপযুক্ত। তারপর থেকে আমার সে বন্ধুর মাধ্যমেই তার সাথে যোগাযোগ হয়েছে আমার। কাল আমার বন্ধুর সাথে এসে সে নিজে চাবি দিয়ে এ ঘরের তালা খুলেছিল। এখানে বসেই আমরা প্রায় আধঘন্টা ধরে কথা বলেছি। অবশ্য এ ঘরে তখন এই টেবিল, জলের জগ গ্লাস এসব কিছু দেখিনি। শুধু চারখানা চেয়ারই ছিল। তবে এ চেয়ারগুলো নয়। কাল যে চেয়ারগুলোতে আমরা বসেছিলাম তার সবকটাই হাতল ছাড়া ছিল”।
 

ভদ্রলোক চুড়ান্ত অবাক হয়ে বলল, “এটা কী করে সম্ভব হয় বলুন তো? এ দরজার চাবি তো একমাত্র আমার কাছেই থাকে। হ্যা গত পরশু দিন আমি তিন চারটে লেবার লাগিয়ে রুম গুলো পরিস্কার করিয়ে ছিলাম। আমার অফিসের একটা ছেলেকে চাবি দিয়ে পাঠিয়েছিলাম তখন। কিন্তু কাল তো আমি কাউকে চাবি দিই নি। তাহলে এ’ঘরটা কে কীভাবে খুলে দিল আপনাকে? সেটা শুনে তো আমিই অবাক হয়ে যাচ্ছি”।
 

রতীশ অসহায় ভাবে বলে উঠল, “হে ভগবান, এ তুমি আমায় কোন বিপদের মুখে ফেললে”?

ভদ্রলোক রতীশের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “কেউ যে মিথ্যে কথা বলে, মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আপনার কাছ থেকে দু’লাখ টাকা লুঠ করে নিয়ে গেছে, সেটা তো আশাকরি এতক্ষণে আপনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আপনি আমাকে বলুন তো, আপনার বাড়ি কোথায়? আর কী নাম আপনার”?
 

রতীশ বিদ্ধস্ত গলায় জবাব দিল, “আমার নাম রতীশ ভট্টাচার্যি। আমি রাজগঞ্জ থেকে এসেছি। আমি একজন যোগা টিচার। কলকাতায় একটা যোগা সেন্টার খুলব বলেই কলকাতা এসেছি। আজ এ বিল্ডিঙের পজেশানটা পেলে কাল থেকে সেন্টারটা খুলবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সব আশা সব স্বপ্নই আমার হারিয়ে গেল। বাবা কাকাদের কাছে থেকে আনা টাকা গুলোও খুইয়ে বসলাম। এখন আমি কি করব বলুন তো”?
 

বিমল বলল, “দেখুন রতীশবাবু, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় লোকাল থানায় গিয়ে আপনার একটা ডাইরী করা উচিৎ। আপনার কথা শুনে তো বোঝাই যাচ্ছে যে আপনার সেই বন্ধু আর ওই ভুয়ো লোকটা প্ল্যান করেই এ’সব করেছে। যদিও দেরী হয়ে গেছে। এখন আর তাদেরকে ধরতে পেলেও আপনার টাকা যে আপনি ফেরত পাবেন, সে সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু যেহেতু ক্রাইমটা হয়েছে, তাই পুলিশের কাছে রিপোর্ট করাটা দরকার। থানায় গিয়ে সবটা খুলে বলুন। তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার যা কিছু আপনি জানতেন সে’সব কিছু পুলিশের কাছে বলুন। তাদের দেখতে কেমন, তাদের চেহারার বিবরণ সব পুলিশকে বলুন। কপাল ভাল থাকলে কিছু হলেও হতে পারে। আর থানায় গিয়ে আপনি আমার কথাও নিশ্চয়ই বলবেন। আমার নাম ভাড়িয়েই তো ব্যাপারটা ঘটানো হয়েছে। তাই পুলিশ তৎপর হলে হয়ত আমাকেও জেরা করবে। আর আমার সাথে দেখা হল বলেই না জোচ্চুরির ব্যাপারটা এখন আপনি বুঝতে পেলেন। তাই আমার নামটাও অবশ্যই বলবেন। আমার কার্ড আপনার কাছে রইলই। সেটা পুলিশকে দেখাতে পারেন। আর আপনিও যদি আমার কাছ থেকে আর কিছু জানতে চান। তাহলে আমাকে ফোন করতে পারেন বা আমার অফিসে এসেও দেখা করতে পারেন। তবে অফিসে আমাকে সন্ধ্যের পরেই শুধু পাবেন। সারাদিন তো আমি এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করতেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু আপনি কি এখন একা যেতে পারবেন? না মানে, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ধাক্কাটা খানিকটা সামলে নিয়েছেন”।
 

রতীশ বলল, “না না, আমি ঠিক আছি বিমলজী। আমি যেতে পারব। আচ্ছা আসছি আমি তাহলে” বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
 

কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাথের একটা দোকান থেকে এক গ্লাস জল চেয়ে খেল। দোকানের লোকটা রতীশকে দেখে বলল, “দাদা আপনাকে কালও এখানে আসতে দেখেছি। আপনার সঙ্গে আরও দু’জনকে দেখেছিলাম। লোকগুলো কিন্তু ভাল নয় দাদা। ও’সব লোকের সাথে মেলামেশা করলে কিন্তু বিপদ হতে পারে। একটু সাবধান থাকবেন”।
 

রতীশ কিছুক্ষণ লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে “ধন্যবাদ ভাই” বলে সরে পড়ল।

রতীশ যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, তার এখন কী করণীয়। বড় রাস্তায় এসে ফুটপাথে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে সে আবার মোবাইল থেকে রবিশঙ্করের নাম্বারে ফোন করল। এবারেও সুইচড অফ ফোন। তার কাছে এতক্ষনে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে রবিশঙ্করই ওই ভুয়ো লোকটার সাথে মিলে আগে থেকেই তার টাকা লুটে নেবার প্ল্যান করেছিল। তাই এখন হাজার বার ফোন করেও তাকে আর পাওয়া যাবে না। মোবাইলটা পকেটে রাখবার পর তার হাতটা নিজের অজান্তেই যেন তার শার্টের বুক পকেটে উঠে এল। হঠাৎ তার মনে হল, একটা কাগজে রবিশঙ্করের বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল। সে কাগজটা তো পকেটেই থাকবার কথা। পকেটের ভেতরের জিনিসগুলো বের করে সে দেখতে দেখতে একটা ছোট কাগজে রবিশঙ্করের বাড়ির ঠিকানাটা দেখতে পেল।
 

(To be cont'd .......)
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 26-02-2020, 08:21 PM



Users browsing this thread: 2 Guest(s)