25-02-2020, 09:05 PM
(Update No. 60 date. 28.7.2018)
সীমন্তিনী নিজের গাড়িতে বিধুবাবুকে নিয়ে উঠে বসল। ড্রাইভারের পাশে বিধুবাবুকে বসিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী জীপের পেছনের সীটে গিয়ে বসল। সিকিউরিটির লোকেরাও পেছনের গাড়িতে বসতেই কমাণ্ডিং অফিসার হুইসেল বাজাল। বিভাদেবী সীমন্তিনীর চিবুকে হাত বুলিয়ে বললেন, “ওখানে পৌঁছে খবর দিস মা”।
দুটো গাড়ি বাজারের দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু কিছুটা যেতেই সীমন্তিনী ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে। গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই পেছনের গাড়ি থেকে কমাণ্ডিং অফিসার নেমে ছুটে সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হল ম্যাডাম? এনি প্রব্লেম”?
সীমন্তিনী বলল, “না কোন প্রব্লেম নেই। কিন্তু আপনি একটু ওই ছেলেটাকে ডেকে আনুন তো প্লীজ। ওই যে কলেজ ইউনিফর্ম পড়া ছেলেটা ওই গলি দিয়ে যাচ্ছে। প্লীজ একটু তাড়াতাড়ি করুন”।
কমাণ্ডিং অফিসার সেদিকে ছুটে গেল। খানিক বাদেই দেখা গেল কিংশুককে সাথে নিয়ে সে সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে হাজির হল। বিধুবাবু ছেলেকে দেখেই বলে উঠলেন, “খোকা এসেছিস”?
কিংশুক পুলিশের গাড়িতে বাবাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা তুমি? পুলিশের গাড়িতে? কী হয়েছে”?
বিধুবাবু কিছু বলবার আগেই পেছনের সীট থেকে সীমন্তিনী নেমে চুপি চুপি কিংশুকের পেছনে গিয়ে বলল, “শুধু বাবা নয়, তোমাকেও ধরে নিয়ে যাব”।
কিংশুক মাথা ঘুরিয়ে পুলিশের পোশাকে সীমন্তিনীকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “দিদিভাই তুমি”?
সীমন্তিনী কিংশুককে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তোমার সাথে দেখা করবার জন্যে এতক্ষন বাড়িতে বসেছিলুম ভাই। কিন্তু সন্ধ্যের আগেই আমাকে গিয়ে পৌঁছতে হবে বলে আর দেরী করতে পারছিলুম না। ভাগ্যিস এখানে দেখা হল। নইলে তোমাকে না দেখেই ফিরে যেতে হত”।
কিংশুক হঠাৎ করে ঝুঁকে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী বলল, “একি ভাই? তোমাকে না আমি বলেছি যে কখনও আমাকে প্রণাম করবে না। সে’কথা ভুলে গেছ তুমি”?
কিংশুক বলল, “ভুলিনি দিদিভাই। কিন্তু এ পোশাকে তোমাকে প্রথমবার দেখে একটা প্রণাম না করে থাকতে পারলুম না গো। তোমাকে যে কী সুন্দর দেখাচ্ছে গো”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ভাই, এভাবে রাস্তায় আর বেশী দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তুমি বাড়ি যাও। বাবাকে আমি বাজারে নামিয়ে দিয়ে যাব। মাকে কিছু কথা বলে এসেছি। সে’সব মার কাছ থেকে শুনে নিও। আর যা যা করতে বলেছি সে সব কোর। পরে তোমার সাথে কথা বলব কেমন”?
কিংশুক বলল, “ইশ আর একটু আগে এলে তোমার সাথে অন্ততঃ একটু কথা বলতে পারতুম। কিন্তু আমি কি আর জানতুম যে তুমি কোন খবর না দিয়ে এভাবে চলে আসবে? জানলে আমি আগেই চলে আসতুম কলেজ থেকে”।
সীমন্তিনী আরেকবার কিংশুকের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “পরে কখনও সুযোগ পেলে আবার আসব
ভাই। সেদিন আগে থেকে জানিয়েই আসব। আজ চলি ভাই। আর দেরী করা ঠিক হবে না। তুমি মন খারাপ কোর না। বাড়িতে যা যা বলে এসেছি সে’সব মার কাছ থেকে শুনে নিও, কেমন? লক্ষ্মী ভাই আমার। আজ আসছি কেমন”?
******************
একদিন রাতে রতিকান্তবাবু নিজের দু’ভাই আর রতীশকে নিয়ে চন্দ্রকান্তবাবুর দোকানে আলোচনায় বসলেন। কলকাতা গিয়ে নতুন একটা যোগ শিক্ষাকেন্দ্র খুলে সঙ্গে সঙ্গেই সেটার আয় থেকে রতীশ নিজের সংসার চালাতে পারবে না। অন্ততঃ ছ’টা মাস তো নিজের জমানো পুঁজি থেকেই নিজেদের সব খরচ খরচা মেটাতে হবে। তারপর ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হবে মাসে মাসে। ফ্ল্যাটে কিছু আসবাব পত্র আর গ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন যোগা সেন্টার খুলতে গেলে একটা বড়সড় ক্যাম্পাসের দরকার। আর সেটা কারো কাছ থেকে লিজে নিতে হবে। একটা ছোটখাট অফিস সাজিয়ে বসতে হবে। সেখানেও কিছু চেয়ার টেবিল আলমারি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে। অফিস ঝাড়পোঁছ করবার জন্য একজন কর্মচারী রাখতে হবে। হয়ত অফিসের জন্য একজন এসিস্ট্যান্টও রাখতে হবে। তাদের বেতন ছাড়াও বিদ্যুতের বিল, জলের বিল এসব দিতে হবে। কিছু বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনতে হবে। রবিশঙ্কর জানিয়েছে যে কমপ্লেক্সটা রতীশের পছন্দ হয়েছে সেটা লিজ নিতে হলে বছরে দু’লাখ টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে এক বছরের লিজ নিতে হবে। সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে দেখা গেল মোট লাখ চারেক টাকার প্রয়োজন শুরুতেই। রতীশ জানাল তার হাতে যা আছে তাতে আগামী আট দশ মাসের সংসার খরচ চালিয়ে নিতে পারবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে শশীকান্তবাবু আর চন্দ্রকান্তবাবু এক এক লাখ করে দেবেন, বাকি দু’লাখ দেবেন রতিকান্তবাবু নিজে। রতীশকে বলা হল সে রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়ে থাকবার ফ্ল্যাট আর কমপ্লেক্স লিজ নেবার ব্যাপারটা যেন সেরে আসে।
সকলের পরামর্শ মত মে ২০১২র মে মাসে রতীশ রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়ে বরানগরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিল। মাসিক আট হাজার টাকা ভাড়া। আর বিদ্যুতের বিল আলাদা। পরের মাস থেকে ভাড়া দিতে হবে। বাড়ি ভাড়ার এগ্রিমেন্টও সাইন করা হল। যে কমপ্লেক্সে রতীশ যোগা সেন্টার খুলবে বলে ভেবেছিল সেখান থেকে তার ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটা খুব একটা দুর নয়। পায়ে হেঁটে গেলেও দশ বারো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালাকে দেখে রতীশের মনে হল রোগা লম্বা লোকটাকে দেখে মারোয়ারী বলে মনেই হয় না। বরং তার চেহারা ছবি আর কথা বার্তার স্টাইল দেখে তাকে বিহারী বলেই সকলে ভুল ভাববে। বিমল আগরওয়ালা বছরে দু’লাখ চল্লিশ হাজারে কমপ্লেক্সটা লিজ দিতে চাইল এক বছরের জন্য। রতীশ আর রবিশঙ্করের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত দু’লাখ টাকায় রাজি হল। কিন্তু রতীশ পরের মাস থেকে কমপ্লেক্সের পজেশন নেবে বলে সে আগেই এগ্রিমেন্ট বানাতে চাইল না। বলল যে পরের মাসে রতীশ পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে এলেই সে একদিনের মধ্যে লিজ এগ্রিমেন্ট রেডি করে তাকে কমপ্লেক্সের পজেশন দিয়ে দেবে।
অবশেষ একদিন বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে রচনা রতীশের সাথে কলকাতার পথে পাড়ি দিয়েছিল জুন মাসের ঊনত্রিশ তারিখে। রতীশ ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে তাকে বলে দিয়েছিল যে তারা পরের দিন সকাল এগারটার আগে ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকবে। রবিশঙ্করও তাদের সাথে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে একই কামরায় উঠেছিল। নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকেই তাদের তিনজনের রিজার্ভেশন করা হয়েছিল।
পরদিন সকাল প্রায় আটটায় তারা হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছল। রচনা সারা রাতে ট্রেণে একটা মূহুর্তের জন্যেও ঘুমোতে পারেনি। নিজের বার্থে শুয়ে শুয়ে সে নিঃশব্দে কেঁদেছে সারাটা রাত ধরে। বাড়ির সকলের কথা ঘুরে ফিরে তার মনে আসছিল বারবার। সন্ধ্যে থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত আধঘন্টা বাদে বাদেই বাড়ির ফোনে ফোন করে সকলের খবরাখবর নিয়েছে। সে জানে, সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসাতে সবচেয়ে বেশী দুঃখ পেয়েছে চন্দ্রিকা। একটা মূহুর্তও সে রচনাকে ছেড়ে থাকতে চাইত না। আগের দিন তার বৌমণি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে চন্দু কলেজে যায়নি। সারাদিন রচনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করেছে আর বারবার রচনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছে, “তুমি যেও না বৌমণি। তুমি কি জান না আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা”?
আগের তিন চার মাস ধরে তাকে সবরকম ভাবে বুঝিয়েও কেউ শান্ত করতে পারেনি। রচনাও একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। হাওড়া ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসবার সময় রতীশ লক্ষ্য করল রচনার মুখ চোখ বেশ ফুলে উঠেছে। চোখদুটো বেশ লাল হয়ে আছে। রচনা যে সারা রাত জেগেই কাটিয়েছে এটা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।
রবিশঙ্কর আর রতীশ কুলির ট্রলিতে সবগুলো লাগেজ তুলে দিয়ে তাদের পেছন পেছন ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। এমন সময়ে রচনার মোবাইলটা বেজে উঠল। সীমন্তিনীর ফোন। কিন্তু রচনার ওই মূহুর্তে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না বলে সে ফোনটা রতীশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দিদিভাইয়ের ফোন। তুমি কথা বল। আমার ভাল লাগছে না এখন কারো সাথে কথা বলতে। জিজ্ঞেস করলে বলে দিও আমি ঠিক আছি”।
রতীশ ফোনটা রিসিভ করে বলল, “হ্যা মন্তি বল ......হ্যারে পৌঁছে গেছি। এই তো ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলুম ....... হ্যা, সেও আমাদের সাথেই আছে...... ওর কথা আর কি বলব তোকে, সারা রাতে বোধহয় এক মূহুর্তের জন্যেও ঘুমোয় নি... কেঁদে কেঁদে মুখ চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে .... মা তো অনেক কিছুই সঙ্গে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রায় কিছুই খায়নি ও..... এখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হবে...... হ্যা হ্যা ঠিক আছে, আমি দুপুর দুটো নাগাদ তোকে ফোন করব... হ্যা ঠিক আছে” বলে কথা শেষ করে ফোনটা রচনার হাতে ফিরিয়ে দিল।
সব গুলো লাগেজ একটা ট্যাক্সিতে চাপান সম্ভব হল না। ঘর সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসতে হয়েছে তাদের সাথে করে। দু’খানা ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হল। একটায় রবিশঙ্কর বসল, অন্যটায় রচনাকে নিয়ে রতীশ উঠে বসল। সাড়ে ন’টা নাগাদ ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল তারা। রবিশঙ্কর আর রতীশ মালপত্র গুলো ট্যাক্সি থেকে নামাতে নামাতেই ফ্ল্যাটের মালিক এসে গেল। রচনা দেখল প্রায় রতীশেরই বয়সী একটা ছেলে। রতীশ রচনার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিতে রচনা হাতজোড় করে তাকে নমস্কার করল। তার সাথে একটা কম বয়সী ছেলেও এসেছিল। চারজনে মিলে ধরাধরি করে লাগেজগুলো টেনে লিফটে নিয়ে ঢোকাল। ফ্ল্যাটের মালিক তার সঙ্গের ছেলেটিকে নিয়ে লিফটে ঢুকতে ঢুকতে রতীশকে বলল, “আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। লিফটে তো বেশী জায়গা নেই আর। আমি আগে এগুলো নিয়ে যাই। তারপর আপনারা লিফটে উঠে আসুন”।
ফ্ল্যাটটা সেই চারতলা বিল্ডিঙের তিন তলায়। রবিশঙ্কর ফ্ল্যাটে না ঢুকে নিচে থেকেই বিদেয় নিয়ে বলল, “আমি তাহলে এখন আর ওপরে যাচ্ছি না রতীশবাবু। ম্যাডামকে দেখে বেশ টায়ার্ড মনে হচ্ছে। আপনারা বরং আজকের দিনটা রেস্ট নিন। সম্ভব হলে একটু গোছগাছ করে নিন। আমি কাল সকালে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। তখন বিমলজীর সাথে দেখা করে কমপ্লেক্সের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করব”।
রতীশও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদেয় করে রচনাকে নিয়ে লিফটে চেপে তিনতলায় উঠে এল। ফ্ল্যাটের মালিক দীপকবাবু তখন ছেলেটাকে দিয়ে জিনিসপত্র গুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। রতীশ আর রচনা ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সে বলল, “রতীশবাবু, আপনার কথামত আমি এক ফার্নিচারের দোকানে কথা বলে সব কিছু ঠিকঠাক করে এসেছি। ওদের ফোন করে বলে দিলেই ওরা সে’সব পাঠিয়ে দেবে। সঙ্গে ওদের লোক এসে সব কিছু ফিটিং করে দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে হয় বৌদিকে সাথে করে সেখানে নিয়ে গিয়ে আপনাদের একটু জিনিসগুলো দেখে নেওয়া উচিৎ। আমার পছন্দের সাথে আপনাদের পছন্দ তো না-ও মিলতে পারে”।
রতীশ দীপকবাবুর হাত ধরে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি আমরা দীপকবাবু। সে জন্যে নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব। কিন্তু রাতে শোবার বন্দোবস্ত তো কিছু একটা করতেই হবে। তাই ভাবছি খাওয়া দাওয়া করেই সেখানে যাব। আপনি দোকানের নাম্বারটা আমায় দিয়ে যান। আর রান্নার গ্যাসের বন্দোবস্ত কিছু করতে পেরেছেন কি? নইলে তো ঘরে রান্না বান্না করা যাবে না”।
দীপকবাবু বলল, “দু’ তিন দিনের মধ্যেই আপনাদের নিজস্ব গ্যাস কানেকশন পেয়ে যাবেন। তবে বিকেলে আমি একটা সিলিণ্ডার পাঠিয়ে দেব। একটা এক্সট্রা আছে আমার কাছে। আপাততঃ সেটা ব্যবহার করুন। আপনাদের নতুন কানেকশন এসে গেলে আমি না হয় এটা নিয়ে যাব। আর এ জন্যে আপনাকে আলাদা করে কোন পয়সাও দিতে হবে না”।
দীপকবাবুর কাছ থেকে ফার্নিচারের দোকানের নাম্বারটা চেয়ে নিয়ে রতীশ বলল, “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দীপকবাবু। কিন্তু সে এক্সট্রা সিলিণ্ডারটা যদি এখন পাওয়া যেত, তাহলে আমরা এখনই গিয়ে গ্যাস স্টোভটা কিনে আনতুম। যদিও দুপুরের খাবার আজ বাইরেই খেতে হবে। কিন্তু বিকেলের রান্নাটা ঘরে করতে পারলে ভাল হত”।
দীপকবাবু বলল, “আমি যদি কাছাকাছি কোথাও থাকতুম তাহলে আপনাদের এসময়ে একটু সাহায্য করতে পারতুম। কিন্তু জানেনই তো এখান থেকে আমার ওখানে যেতে প্রায় আধঘন্টা লেগে যাবে। তবে আপনি এক কাজ করুন। এ ছেলেটাকে একশোটা টাকা দিয়ে দিন। ও একটা অটো ভাড়া করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সিলিন্ডারটা এনে দিয়ে যাবে। আপনারা ততক্ষণ স্নানটান সেরে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসুন”।
দীপকবাবু বেরিয়ে যাবার পর রতীশ রচনাকে কাছে টেনে বলল, “তোমাকে সত্যি খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে সোনা। একটু চা খাবে? তাহলে সামনের দোকানটা থেকে নিয়ে আসছি”।
রচনা স্বামীর বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলল, “বাড়ির সকলের জন্য খুব মন কেমন করছে গো। চন্দুটা আজ কী করছে কে জানে। কলেজে গেছে কি না। বাবা কাকুরা সকালের খাবার খেয়ে গেছেন কি না”।
রতীশ রচনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কিচ্ছু ভেব না সোনা। জানি, তোমাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি বলে বাড়ির সকলেরই মন খারাপ হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। কিন্তু আমি তোমাকে বাড়িতে ফেলে এখানে একা এসে কি থাকতে পারতুম বল? ছোটবেলা থেকে আমার সব কিছু মন্তি দেখাশোনা করত। তারপর অনেক বছর আমি ছন্নছাড়ার মত জীবন কাটিয়েছি। তুমি এসে আবার আমার জীবনের হাল ধরেছ। তোমাকে ছেড়ে যে আমি এখন একটা দিনও কাটাতে পারব না। তাই তো তোমাকে নিয়ে এসেছি। প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন আমাদেরও খারাপ লাগবে। বাড়ির সকলেরও খারাপ লাগবে। তারপর দেখো, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে শোন না লক্ষ্মীটি। সারাটা রাত তুমি যে এক মূহুর্তও ঘুমোওনি, তা তো আমি জানিই। বলছি কি, এখন একটু চা খেলে তোমার ভাল লাগবে। তাই ফ্লাস্কটা বের করে দাও। আমি দু’কাপ চা নিয়ে আসছি। তারপর চা খেয়ে, স্নান সেরে চল বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি। তারপর একটু ঘুমিয়ে নিও। বিকেলে বেরিয়ে একটা খাট আর রান্নার স্টোভ কিনে আনব। আর রাতে যতটুকু পারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করব”।
রচনা আর কোন কথা না বলে একটা ব্যাগ খুলে তার ভেতর থেকে ফ্লাস্ক বের করে রতীশের হাতে দিল। রতীশ বেরিয়ে যাবার পর রচনা ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখতে লাগল। সামনের করিডোর থেকে ভেতরে ঢুকেই মাঝারি সাইজের একটা বসবার ঘর। তার বাঁ পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখল ছোট খাট একটা ব্যালকনি যেখান থেকে সামনের রাস্তার বেশ কিছুটা জায়গা দেখা যায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখতে পেল একটা ঘরের আড়াল থেকে রতীশ বেরিয়ে এসে রাস্তা দিয়ে সামনের মোড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উল্টোদিকে চেয়ে দেখল কয়েকটা ঘরের ব্যালকনির পরে রাস্তাটা সোজা অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ব্যালকনি থেকে আবার বসবার ঘরে এসে ডানদিকের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল। দেখল সেটা রান্না ঘর। কুকিং স্ল্যাব বসান আছে। একপাশে দেয়ালের সঙ্গে সেট করা কয়েকটা কেবিনেট আছে। একটা জানালা আছে, যেটা সামনের করিডোরের দিকে খোলে। কুকিং টেবিলের সাথেই একটা সিঙ্ক বসান আছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার বসবার ঘরে এসে ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে দেখল ভেতরে একটা মাঝারি সাইজের করিডোরের মত। করিডোরের ডান পাশে পরপর তিনখানা দরজা। প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকে একটা রুম দেখে মনে হল, এটা নিশ্চয়ই ডাইনিং রুম হবে। এ রুমটার ভেতর দিকে আরেকটা দরজা দেখা গেল। রচনা দরজাটা খুলে দেখল ওদিকে রান্নাঘরটা। ডানদিকের দু’নম্বর আর তিন নম্বর দরজাগুলো খুলে দেখল ছোট ছোট দুটো রুম। রচনা মনে মনে ভাবল এর একটাকে ঠাকুর ঘর করে অন্য ঘরটাকে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করবে। বসবার ঘর থেকে ভেতরের করিডোরে এসে বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দেখল বেডরুম। সে রুমটা চওড়ায় মাঝামাঝি হলেও বেশ লম্বা। বেডরুমের একদিকে একটা ছোট দরজা খুলে দেখল সেটা বাথরুম। ভেতরে শাওয়ার ছাড়াও অন্যান্য ফিটিংস আছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল একটা ভেন্টিলেটর আছে। বাথরুমটার দু’দিকে দুটো দরজা। একটা বেডরুম থেকে ঢোকার আর অন্যটা ভেতরের করিডোর থেকে ঢোকার জন্য। তার মানে বাথরুম ব্যবহার করতে গেলে দু’দিকের দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। বেডরুমের লাগোয়া দরজার ওপর একটা গিজারও বসান আছে দেখা গেল। ঘর দেখে মোটামুটি পছন্দই হল রচনার। সাফ সুতরোও আছে। বাড়ির মালিক নিজেই হয়ত লোক লাগিয়ে সব পরিস্কার করিয়ে রেখেছেন। ঘরগুলো সব নতুন করে রং করা হয়েছে। কিছুটা রঙের গন্ধও যেন নাকে ঢুকছে।
নিজের ব্যাগ থেকে একটা টাওয়েল বের করে বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখ ভাল করে ধুয়ে বেডরুমের ভেতর আসতেই ডিংডং শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল। মুখ মুছতে মুছতেই রচনা সামনের দরজা খুলে দিতেই রতীশ ফ্লাস্ক হাতে ঘরে ঢুকল। এক হাতে কয়েকটা প্লাস্টিকের চায়ের কাপ। দু’জনে মিলে চা খেতে খেতেই রতীশের মোবাইল বেজে উঠল। বাড়ি থেকে রতীশের মা ফোন করেছেন। তারা ফ্ল্যাটে এসে ঢুকেছে শুনে সরলাদেবী আশ্বস্ত হলেন। রচনাও একটু কথা বলল। শুনল, চন্দ্রিকা আজও সকালে ঘুম থেকে উঠেই কান্নাকাটি করেছে। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে কলেজে পাঠিয়েছে। বাড়ির আর সবাই ভাল আছে।
চা খেয়ে রতীশ রচনাকে স্নান সেরে নিতে বলল। রচনা দুটো লাগেজ টেনে ভেতরের বেডরুমে নিয়ে গেল। তারপর একটা ব্যাগ থেকে শাড়ি সায়া ব্লাউজ বের করে টাওয়েল নিয়ে স্নান করতে ঢুকে গেল। রচনা স্নান করতে করতেই শুনতে পেল তার মোবাইল বাজছে।
স্নান সেরে বের হতেই রতীশ বলল, “বাবা আর মেজকাকু ফোন করেছিলেন। আমাদের খবর নিলেন”।
রচনা নিজের ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল, “স্নান করে বেশ ক্ষিদে লাগছে গো। তুমিও আগে স্নান করে নাও। তারপর খেয়ে দেয়ে দেখা যাবে কি করা যায়”।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের মোড়টা পেড়িয়েই একটা ছোটখাট খাবার হোটেল দেখা গেল। সেখানেই খাওয়া দাওয়া সেরে ফ্ল্যাটে ফিরে আসতে না আসতেই আবার কেউ এসে কলিং বেল বাজাল। রতীশ দরজা খুলে দেখল ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে যে ছেলেটা আগে এসেছিল সে একটা গ্যাস সিলিণ্ডার নিয়ে এসেছে। ছেলেটা সেটা দিয়ে চলে যেতেই আবার ফোন বেজে উঠল। এবারে ছোটকাকুর সাথে কথা বলা শেষ করে রতীশ বলল, “বসবার মতও তো কিছু ঘরে নেই সোনা। একটু গড়িয়ে নিলে ভাল হত না। তুমি তো কাল সারাটা রাত একেবারে ঘুমোও নি। এক কাজ কর, আমি বেডিংটা খুলে ম্যাট্রেসটা ফ্লোরে পেতে দিচ্ছি। তুমি একটু শুয়ে নাও। তারপর তিনটে নাগাদ বেরিয়ে যাব। আগে ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে একটা খাট, একটা সেন্টার টেবিল, সোফা সেট আর দু’ তিনটে চেয়ার আপাততঃ কিনে নিই। তারপর বাজার থেকে রান্নার জিনিসগুলো কিনে বাড়ি ফিরব। তারপর বাদ বাকি যা কিছু দরকার তা ধীরে সুস্থে পরে কেনা যাবে”।
মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে রচনা শুয়ে পড়ল। রতীশও মোবাইলে এলার্ম সেট করে রচনার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। বেলা দুটোর সময় মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠতে তাদের ঘুম ভাঙল। রতীশ প্রথমে সীমন্তিনীকে ফোন করল। রচনাও তার সাথে কথা বলল। তারপর পোশাক আশাক বদলে তারা তিনটে নাগাদ ফ্ল্যাট থেকে বেরোল। একটা অটো ভাড়া করে ফার্নিচারের দোকানে গেল। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফাসেট, সেন্টার টেবিল, ফোর সিটার ডাইনিং টেবিল আর চারখানা চেয়ার পছন্দ করল তারা। সব মিলে দাম হল মোট আটশট্টি হাজার টাকা। পঁচিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ মালগুলো ফ্ল্যাটে ডেলিভারি দিতে বলে দিয়ে তারা বাজারে গিয়ে রান্না ঘরের জন্য কিছু শাক সব্জী মশলা আর মুদি দোকানের জিনিস আর একটা গ্যাস স্টোভ কিনে নিয়ে একটা অটো ভাড়া করে সন্ধ্যে ছ’টার আগেই ফ্ল্যাটে ফিরে এল।
ঠিক ছ’টায় ফার্নিচার গুলো সব এসে গেল। লোকগুলো সবকিছু জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে ঠিকমত ফিটিং করে দিয়ে রাত ন’টা নাগাদ বাকি টাকা নিয়ে চলে গেল। রচনা ততক্ষণে রান্নাঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। রচনার রাতের রান্না শেষ হতে হতে রতীশ বেডরুমের বিছানা আর বসবার ঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে ফেলল। রাতে সীমন্তিনী, ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু আর রতীশের মা সরলাদেবীর সাথে আবার ফোনে কথা বলল। রচনা শাশুড়ি মাকে আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না, “মামনি, চন্দু কেমন আছে গো”?
সরলাদেবী জবাব দিলেন, “ওর কথা তোকে আজ আর কিছু বলছি না রে মা। মন্তি বারবার করে বারণ করে দিয়েছে। তাই তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস না। আমি খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দিয়েছি ওকে। ও এখন ওদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তুই মন খারাপ করিসনে মা। কাল সারা রাত তুই ট্রেনে একটুও ঘুমোস নি শুনেছি। আজও তো বেশ পরিশ্রম গেছে তোর। তাই এবার সব ভাবনা ছেড়ে একটু ভাল করে ঘুমোবার চেষ্টা কর সোনা মা আমার। আমরা বাড়ির সকলেই ভাল আছি। তুই আমাদের নিয়ে ভাবিস না”।
ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে রচনা বলল, “জানি মামনি, ওখানে তোমরা সবাই সবাইকে প্রবোধ দেবে সান্ত্বনা দেবে। আমি থাকা না থাকাতে তোমাদের আর বেশী কষ্ট কী হবে”?
সরলাদেবী একটু অভিমানী সুরে বললেন, “আমি যত নিজেকে সামলে রাখবার চেষ্টা করছি, তুই ততই আমাকে কাঁদাবার চেষ্টা করছিস না? আমি ছাড়ছি এবার। কাল কথা বলব আবার” বলেই ফোন কেটে দিলেন। রচনাও সাথে উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল।
ss_sexy
সীমন্তিনী নিজের গাড়িতে বিধুবাবুকে নিয়ে উঠে বসল। ড্রাইভারের পাশে বিধুবাবুকে বসিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী জীপের পেছনের সীটে গিয়ে বসল। সিকিউরিটির লোকেরাও পেছনের গাড়িতে বসতেই কমাণ্ডিং অফিসার হুইসেল বাজাল। বিভাদেবী সীমন্তিনীর চিবুকে হাত বুলিয়ে বললেন, “ওখানে পৌঁছে খবর দিস মা”।
দুটো গাড়ি বাজারের দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু কিছুটা যেতেই সীমন্তিনী ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে। গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই পেছনের গাড়ি থেকে কমাণ্ডিং অফিসার নেমে ছুটে সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হল ম্যাডাম? এনি প্রব্লেম”?
সীমন্তিনী বলল, “না কোন প্রব্লেম নেই। কিন্তু আপনি একটু ওই ছেলেটাকে ডেকে আনুন তো প্লীজ। ওই যে কলেজ ইউনিফর্ম পড়া ছেলেটা ওই গলি দিয়ে যাচ্ছে। প্লীজ একটু তাড়াতাড়ি করুন”।
কমাণ্ডিং অফিসার সেদিকে ছুটে গেল। খানিক বাদেই দেখা গেল কিংশুককে সাথে নিয়ে সে সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে হাজির হল। বিধুবাবু ছেলেকে দেখেই বলে উঠলেন, “খোকা এসেছিস”?
কিংশুক পুলিশের গাড়িতে বাবাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা তুমি? পুলিশের গাড়িতে? কী হয়েছে”?
বিধুবাবু কিছু বলবার আগেই পেছনের সীট থেকে সীমন্তিনী নেমে চুপি চুপি কিংশুকের পেছনে গিয়ে বলল, “শুধু বাবা নয়, তোমাকেও ধরে নিয়ে যাব”।
কিংশুক মাথা ঘুরিয়ে পুলিশের পোশাকে সীমন্তিনীকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “দিদিভাই তুমি”?
সীমন্তিনী কিংশুককে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তোমার সাথে দেখা করবার জন্যে এতক্ষন বাড়িতে বসেছিলুম ভাই। কিন্তু সন্ধ্যের আগেই আমাকে গিয়ে পৌঁছতে হবে বলে আর দেরী করতে পারছিলুম না। ভাগ্যিস এখানে দেখা হল। নইলে তোমাকে না দেখেই ফিরে যেতে হত”।
কিংশুক হঠাৎ করে ঝুঁকে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী বলল, “একি ভাই? তোমাকে না আমি বলেছি যে কখনও আমাকে প্রণাম করবে না। সে’কথা ভুলে গেছ তুমি”?
কিংশুক বলল, “ভুলিনি দিদিভাই। কিন্তু এ পোশাকে তোমাকে প্রথমবার দেখে একটা প্রণাম না করে থাকতে পারলুম না গো। তোমাকে যে কী সুন্দর দেখাচ্ছে গো”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ভাই, এভাবে রাস্তায় আর বেশী দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তুমি বাড়ি যাও। বাবাকে আমি বাজারে নামিয়ে দিয়ে যাব। মাকে কিছু কথা বলে এসেছি। সে’সব মার কাছ থেকে শুনে নিও। আর যা যা করতে বলেছি সে সব কোর। পরে তোমার সাথে কথা বলব কেমন”?
কিংশুক বলল, “ইশ আর একটু আগে এলে তোমার সাথে অন্ততঃ একটু কথা বলতে পারতুম। কিন্তু আমি কি আর জানতুম যে তুমি কোন খবর না দিয়ে এভাবে চলে আসবে? জানলে আমি আগেই চলে আসতুম কলেজ থেকে”।
সীমন্তিনী আরেকবার কিংশুকের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “পরে কখনও সুযোগ পেলে আবার আসব
ভাই। সেদিন আগে থেকে জানিয়েই আসব। আজ চলি ভাই। আর দেরী করা ঠিক হবে না। তুমি মন খারাপ কোর না। বাড়িতে যা যা বলে এসেছি সে’সব মার কাছ থেকে শুনে নিও, কেমন? লক্ষ্মী ভাই আমার। আজ আসছি কেমন”?
******************
একদিন রাতে রতিকান্তবাবু নিজের দু’ভাই আর রতীশকে নিয়ে চন্দ্রকান্তবাবুর দোকানে আলোচনায় বসলেন। কলকাতা গিয়ে নতুন একটা যোগ শিক্ষাকেন্দ্র খুলে সঙ্গে সঙ্গেই সেটার আয় থেকে রতীশ নিজের সংসার চালাতে পারবে না। অন্ততঃ ছ’টা মাস তো নিজের জমানো পুঁজি থেকেই নিজেদের সব খরচ খরচা মেটাতে হবে। তারপর ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হবে মাসে মাসে। ফ্ল্যাটে কিছু আসবাব পত্র আর গ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন যোগা সেন্টার খুলতে গেলে একটা বড়সড় ক্যাম্পাসের দরকার। আর সেটা কারো কাছ থেকে লিজে নিতে হবে। একটা ছোটখাট অফিস সাজিয়ে বসতে হবে। সেখানেও কিছু চেয়ার টেবিল আলমারি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে। অফিস ঝাড়পোঁছ করবার জন্য একজন কর্মচারী রাখতে হবে। হয়ত অফিসের জন্য একজন এসিস্ট্যান্টও রাখতে হবে। তাদের বেতন ছাড়াও বিদ্যুতের বিল, জলের বিল এসব দিতে হবে। কিছু বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনতে হবে। রবিশঙ্কর জানিয়েছে যে কমপ্লেক্সটা রতীশের পছন্দ হয়েছে সেটা লিজ নিতে হলে বছরে দু’লাখ টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে এক বছরের লিজ নিতে হবে। সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে দেখা গেল মোট লাখ চারেক টাকার প্রয়োজন শুরুতেই। রতীশ জানাল তার হাতে যা আছে তাতে আগামী আট দশ মাসের সংসার খরচ চালিয়ে নিতে পারবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে শশীকান্তবাবু আর চন্দ্রকান্তবাবু এক এক লাখ করে দেবেন, বাকি দু’লাখ দেবেন রতিকান্তবাবু নিজে। রতীশকে বলা হল সে রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়ে থাকবার ফ্ল্যাট আর কমপ্লেক্স লিজ নেবার ব্যাপারটা যেন সেরে আসে।
সকলের পরামর্শ মত মে ২০১২র মে মাসে রতীশ রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়ে বরানগরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিল। মাসিক আট হাজার টাকা ভাড়া। আর বিদ্যুতের বিল আলাদা। পরের মাস থেকে ভাড়া দিতে হবে। বাড়ি ভাড়ার এগ্রিমেন্টও সাইন করা হল। যে কমপ্লেক্সে রতীশ যোগা সেন্টার খুলবে বলে ভেবেছিল সেখান থেকে তার ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটা খুব একটা দুর নয়। পায়ে হেঁটে গেলেও দশ বারো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালাকে দেখে রতীশের মনে হল রোগা লম্বা লোকটাকে দেখে মারোয়ারী বলে মনেই হয় না। বরং তার চেহারা ছবি আর কথা বার্তার স্টাইল দেখে তাকে বিহারী বলেই সকলে ভুল ভাববে। বিমল আগরওয়ালা বছরে দু’লাখ চল্লিশ হাজারে কমপ্লেক্সটা লিজ দিতে চাইল এক বছরের জন্য। রতীশ আর রবিশঙ্করের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত দু’লাখ টাকায় রাজি হল। কিন্তু রতীশ পরের মাস থেকে কমপ্লেক্সের পজেশন নেবে বলে সে আগেই এগ্রিমেন্ট বানাতে চাইল না। বলল যে পরের মাসে রতীশ পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে এলেই সে একদিনের মধ্যে লিজ এগ্রিমেন্ট রেডি করে তাকে কমপ্লেক্সের পজেশন দিয়ে দেবে।
অবশেষ একদিন বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে রচনা রতীশের সাথে কলকাতার পথে পাড়ি দিয়েছিল জুন মাসের ঊনত্রিশ তারিখে। রতীশ ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে তাকে বলে দিয়েছিল যে তারা পরের দিন সকাল এগারটার আগে ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকবে। রবিশঙ্করও তাদের সাথে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে একই কামরায় উঠেছিল। নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকেই তাদের তিনজনের রিজার্ভেশন করা হয়েছিল।
পরদিন সকাল প্রায় আটটায় তারা হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছল। রচনা সারা রাতে ট্রেণে একটা মূহুর্তের জন্যেও ঘুমোতে পারেনি। নিজের বার্থে শুয়ে শুয়ে সে নিঃশব্দে কেঁদেছে সারাটা রাত ধরে। বাড়ির সকলের কথা ঘুরে ফিরে তার মনে আসছিল বারবার। সন্ধ্যে থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত আধঘন্টা বাদে বাদেই বাড়ির ফোনে ফোন করে সকলের খবরাখবর নিয়েছে। সে জানে, সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসাতে সবচেয়ে বেশী দুঃখ পেয়েছে চন্দ্রিকা। একটা মূহুর্তও সে রচনাকে ছেড়ে থাকতে চাইত না। আগের দিন তার বৌমণি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে চন্দু কলেজে যায়নি। সারাদিন রচনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করেছে আর বারবার রচনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছে, “তুমি যেও না বৌমণি। তুমি কি জান না আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা”?
আগের তিন চার মাস ধরে তাকে সবরকম ভাবে বুঝিয়েও কেউ শান্ত করতে পারেনি। রচনাও একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। হাওড়া ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসবার সময় রতীশ লক্ষ্য করল রচনার মুখ চোখ বেশ ফুলে উঠেছে। চোখদুটো বেশ লাল হয়ে আছে। রচনা যে সারা রাত জেগেই কাটিয়েছে এটা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।
রবিশঙ্কর আর রতীশ কুলির ট্রলিতে সবগুলো লাগেজ তুলে দিয়ে তাদের পেছন পেছন ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। এমন সময়ে রচনার মোবাইলটা বেজে উঠল। সীমন্তিনীর ফোন। কিন্তু রচনার ওই মূহুর্তে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না বলে সে ফোনটা রতীশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দিদিভাইয়ের ফোন। তুমি কথা বল। আমার ভাল লাগছে না এখন কারো সাথে কথা বলতে। জিজ্ঞেস করলে বলে দিও আমি ঠিক আছি”।
রতীশ ফোনটা রিসিভ করে বলল, “হ্যা মন্তি বল ......হ্যারে পৌঁছে গেছি। এই তো ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলুম ....... হ্যা, সেও আমাদের সাথেই আছে...... ওর কথা আর কি বলব তোকে, সারা রাতে বোধহয় এক মূহুর্তের জন্যেও ঘুমোয় নি... কেঁদে কেঁদে মুখ চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে .... মা তো অনেক কিছুই সঙ্গে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রায় কিছুই খায়নি ও..... এখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হবে...... হ্যা হ্যা ঠিক আছে, আমি দুপুর দুটো নাগাদ তোকে ফোন করব... হ্যা ঠিক আছে” বলে কথা শেষ করে ফোনটা রচনার হাতে ফিরিয়ে দিল।
সব গুলো লাগেজ একটা ট্যাক্সিতে চাপান সম্ভব হল না। ঘর সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসতে হয়েছে তাদের সাথে করে। দু’খানা ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হল। একটায় রবিশঙ্কর বসল, অন্যটায় রচনাকে নিয়ে রতীশ উঠে বসল। সাড়ে ন’টা নাগাদ ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল তারা। রবিশঙ্কর আর রতীশ মালপত্র গুলো ট্যাক্সি থেকে নামাতে নামাতেই ফ্ল্যাটের মালিক এসে গেল। রচনা দেখল প্রায় রতীশেরই বয়সী একটা ছেলে। রতীশ রচনার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিতে রচনা হাতজোড় করে তাকে নমস্কার করল। তার সাথে একটা কম বয়সী ছেলেও এসেছিল। চারজনে মিলে ধরাধরি করে লাগেজগুলো টেনে লিফটে নিয়ে ঢোকাল। ফ্ল্যাটের মালিক তার সঙ্গের ছেলেটিকে নিয়ে লিফটে ঢুকতে ঢুকতে রতীশকে বলল, “আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। লিফটে তো বেশী জায়গা নেই আর। আমি আগে এগুলো নিয়ে যাই। তারপর আপনারা লিফটে উঠে আসুন”।
ফ্ল্যাটটা সেই চারতলা বিল্ডিঙের তিন তলায়। রবিশঙ্কর ফ্ল্যাটে না ঢুকে নিচে থেকেই বিদেয় নিয়ে বলল, “আমি তাহলে এখন আর ওপরে যাচ্ছি না রতীশবাবু। ম্যাডামকে দেখে বেশ টায়ার্ড মনে হচ্ছে। আপনারা বরং আজকের দিনটা রেস্ট নিন। সম্ভব হলে একটু গোছগাছ করে নিন। আমি কাল সকালে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। তখন বিমলজীর সাথে দেখা করে কমপ্লেক্সের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করব”।
রতীশও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদেয় করে রচনাকে নিয়ে লিফটে চেপে তিনতলায় উঠে এল। ফ্ল্যাটের মালিক দীপকবাবু তখন ছেলেটাকে দিয়ে জিনিসপত্র গুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। রতীশ আর রচনা ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সে বলল, “রতীশবাবু, আপনার কথামত আমি এক ফার্নিচারের দোকানে কথা বলে সব কিছু ঠিকঠাক করে এসেছি। ওদের ফোন করে বলে দিলেই ওরা সে’সব পাঠিয়ে দেবে। সঙ্গে ওদের লোক এসে সব কিছু ফিটিং করে দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে হয় বৌদিকে সাথে করে সেখানে নিয়ে গিয়ে আপনাদের একটু জিনিসগুলো দেখে নেওয়া উচিৎ। আমার পছন্দের সাথে আপনাদের পছন্দ তো না-ও মিলতে পারে”।
রতীশ দীপকবাবুর হাত ধরে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি আমরা দীপকবাবু। সে জন্যে নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব। কিন্তু রাতে শোবার বন্দোবস্ত তো কিছু একটা করতেই হবে। তাই ভাবছি খাওয়া দাওয়া করেই সেখানে যাব। আপনি দোকানের নাম্বারটা আমায় দিয়ে যান। আর রান্নার গ্যাসের বন্দোবস্ত কিছু করতে পেরেছেন কি? নইলে তো ঘরে রান্না বান্না করা যাবে না”।
দীপকবাবু বলল, “দু’ তিন দিনের মধ্যেই আপনাদের নিজস্ব গ্যাস কানেকশন পেয়ে যাবেন। তবে বিকেলে আমি একটা সিলিণ্ডার পাঠিয়ে দেব। একটা এক্সট্রা আছে আমার কাছে। আপাততঃ সেটা ব্যবহার করুন। আপনাদের নতুন কানেকশন এসে গেলে আমি না হয় এটা নিয়ে যাব। আর এ জন্যে আপনাকে আলাদা করে কোন পয়সাও দিতে হবে না”।
দীপকবাবুর কাছ থেকে ফার্নিচারের দোকানের নাম্বারটা চেয়ে নিয়ে রতীশ বলল, “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দীপকবাবু। কিন্তু সে এক্সট্রা সিলিণ্ডারটা যদি এখন পাওয়া যেত, তাহলে আমরা এখনই গিয়ে গ্যাস স্টোভটা কিনে আনতুম। যদিও দুপুরের খাবার আজ বাইরেই খেতে হবে। কিন্তু বিকেলের রান্নাটা ঘরে করতে পারলে ভাল হত”।
দীপকবাবু বলল, “আমি যদি কাছাকাছি কোথাও থাকতুম তাহলে আপনাদের এসময়ে একটু সাহায্য করতে পারতুম। কিন্তু জানেনই তো এখান থেকে আমার ওখানে যেতে প্রায় আধঘন্টা লেগে যাবে। তবে আপনি এক কাজ করুন। এ ছেলেটাকে একশোটা টাকা দিয়ে দিন। ও একটা অটো ভাড়া করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সিলিন্ডারটা এনে দিয়ে যাবে। আপনারা ততক্ষণ স্নানটান সেরে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসুন”।
দীপকবাবু বেরিয়ে যাবার পর রতীশ রচনাকে কাছে টেনে বলল, “তোমাকে সত্যি খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে সোনা। একটু চা খাবে? তাহলে সামনের দোকানটা থেকে নিয়ে আসছি”।
রচনা স্বামীর বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলল, “বাড়ির সকলের জন্য খুব মন কেমন করছে গো। চন্দুটা আজ কী করছে কে জানে। কলেজে গেছে কি না। বাবা কাকুরা সকালের খাবার খেয়ে গেছেন কি না”।
রতীশ রচনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কিচ্ছু ভেব না সোনা। জানি, তোমাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি বলে বাড়ির সকলেরই মন খারাপ হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। কিন্তু আমি তোমাকে বাড়িতে ফেলে এখানে একা এসে কি থাকতে পারতুম বল? ছোটবেলা থেকে আমার সব কিছু মন্তি দেখাশোনা করত। তারপর অনেক বছর আমি ছন্নছাড়ার মত জীবন কাটিয়েছি। তুমি এসে আবার আমার জীবনের হাল ধরেছ। তোমাকে ছেড়ে যে আমি এখন একটা দিনও কাটাতে পারব না। তাই তো তোমাকে নিয়ে এসেছি। প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন আমাদেরও খারাপ লাগবে। বাড়ির সকলেরও খারাপ লাগবে। তারপর দেখো, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে শোন না লক্ষ্মীটি। সারাটা রাত তুমি যে এক মূহুর্তও ঘুমোওনি, তা তো আমি জানিই। বলছি কি, এখন একটু চা খেলে তোমার ভাল লাগবে। তাই ফ্লাস্কটা বের করে দাও। আমি দু’কাপ চা নিয়ে আসছি। তারপর চা খেয়ে, স্নান সেরে চল বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি। তারপর একটু ঘুমিয়ে নিও। বিকেলে বেরিয়ে একটা খাট আর রান্নার স্টোভ কিনে আনব। আর রাতে যতটুকু পারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করব”।
রচনা আর কোন কথা না বলে একটা ব্যাগ খুলে তার ভেতর থেকে ফ্লাস্ক বের করে রতীশের হাতে দিল। রতীশ বেরিয়ে যাবার পর রচনা ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখতে লাগল। সামনের করিডোর থেকে ভেতরে ঢুকেই মাঝারি সাইজের একটা বসবার ঘর। তার বাঁ পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখল ছোট খাট একটা ব্যালকনি যেখান থেকে সামনের রাস্তার বেশ কিছুটা জায়গা দেখা যায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখতে পেল একটা ঘরের আড়াল থেকে রতীশ বেরিয়ে এসে রাস্তা দিয়ে সামনের মোড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উল্টোদিকে চেয়ে দেখল কয়েকটা ঘরের ব্যালকনির পরে রাস্তাটা সোজা অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ব্যালকনি থেকে আবার বসবার ঘরে এসে ডানদিকের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল। দেখল সেটা রান্না ঘর। কুকিং স্ল্যাব বসান আছে। একপাশে দেয়ালের সঙ্গে সেট করা কয়েকটা কেবিনেট আছে। একটা জানালা আছে, যেটা সামনের করিডোরের দিকে খোলে। কুকিং টেবিলের সাথেই একটা সিঙ্ক বসান আছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার বসবার ঘরে এসে ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে দেখল ভেতরে একটা মাঝারি সাইজের করিডোরের মত। করিডোরের ডান পাশে পরপর তিনখানা দরজা। প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকে একটা রুম দেখে মনে হল, এটা নিশ্চয়ই ডাইনিং রুম হবে। এ রুমটার ভেতর দিকে আরেকটা দরজা দেখা গেল। রচনা দরজাটা খুলে দেখল ওদিকে রান্নাঘরটা। ডানদিকের দু’নম্বর আর তিন নম্বর দরজাগুলো খুলে দেখল ছোট ছোট দুটো রুম। রচনা মনে মনে ভাবল এর একটাকে ঠাকুর ঘর করে অন্য ঘরটাকে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করবে। বসবার ঘর থেকে ভেতরের করিডোরে এসে বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দেখল বেডরুম। সে রুমটা চওড়ায় মাঝামাঝি হলেও বেশ লম্বা। বেডরুমের একদিকে একটা ছোট দরজা খুলে দেখল সেটা বাথরুম। ভেতরে শাওয়ার ছাড়াও অন্যান্য ফিটিংস আছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল একটা ভেন্টিলেটর আছে। বাথরুমটার দু’দিকে দুটো দরজা। একটা বেডরুম থেকে ঢোকার আর অন্যটা ভেতরের করিডোর থেকে ঢোকার জন্য। তার মানে বাথরুম ব্যবহার করতে গেলে দু’দিকের দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। বেডরুমের লাগোয়া দরজার ওপর একটা গিজারও বসান আছে দেখা গেল। ঘর দেখে মোটামুটি পছন্দই হল রচনার। সাফ সুতরোও আছে। বাড়ির মালিক নিজেই হয়ত লোক লাগিয়ে সব পরিস্কার করিয়ে রেখেছেন। ঘরগুলো সব নতুন করে রং করা হয়েছে। কিছুটা রঙের গন্ধও যেন নাকে ঢুকছে।
নিজের ব্যাগ থেকে একটা টাওয়েল বের করে বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখ ভাল করে ধুয়ে বেডরুমের ভেতর আসতেই ডিংডং শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল। মুখ মুছতে মুছতেই রচনা সামনের দরজা খুলে দিতেই রতীশ ফ্লাস্ক হাতে ঘরে ঢুকল। এক হাতে কয়েকটা প্লাস্টিকের চায়ের কাপ। দু’জনে মিলে চা খেতে খেতেই রতীশের মোবাইল বেজে উঠল। বাড়ি থেকে রতীশের মা ফোন করেছেন। তারা ফ্ল্যাটে এসে ঢুকেছে শুনে সরলাদেবী আশ্বস্ত হলেন। রচনাও একটু কথা বলল। শুনল, চন্দ্রিকা আজও সকালে ঘুম থেকে উঠেই কান্নাকাটি করেছে। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে কলেজে পাঠিয়েছে। বাড়ির আর সবাই ভাল আছে।
চা খেয়ে রতীশ রচনাকে স্নান সেরে নিতে বলল। রচনা দুটো লাগেজ টেনে ভেতরের বেডরুমে নিয়ে গেল। তারপর একটা ব্যাগ থেকে শাড়ি সায়া ব্লাউজ বের করে টাওয়েল নিয়ে স্নান করতে ঢুকে গেল। রচনা স্নান করতে করতেই শুনতে পেল তার মোবাইল বাজছে।
স্নান সেরে বের হতেই রতীশ বলল, “বাবা আর মেজকাকু ফোন করেছিলেন। আমাদের খবর নিলেন”।
রচনা নিজের ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল, “স্নান করে বেশ ক্ষিদে লাগছে গো। তুমিও আগে স্নান করে নাও। তারপর খেয়ে দেয়ে দেখা যাবে কি করা যায়”।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের মোড়টা পেড়িয়েই একটা ছোটখাট খাবার হোটেল দেখা গেল। সেখানেই খাওয়া দাওয়া সেরে ফ্ল্যাটে ফিরে আসতে না আসতেই আবার কেউ এসে কলিং বেল বাজাল। রতীশ দরজা খুলে দেখল ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে যে ছেলেটা আগে এসেছিল সে একটা গ্যাস সিলিণ্ডার নিয়ে এসেছে। ছেলেটা সেটা দিয়ে চলে যেতেই আবার ফোন বেজে উঠল। এবারে ছোটকাকুর সাথে কথা বলা শেষ করে রতীশ বলল, “বসবার মতও তো কিছু ঘরে নেই সোনা। একটু গড়িয়ে নিলে ভাল হত না। তুমি তো কাল সারাটা রাত একেবারে ঘুমোও নি। এক কাজ কর, আমি বেডিংটা খুলে ম্যাট্রেসটা ফ্লোরে পেতে দিচ্ছি। তুমি একটু শুয়ে নাও। তারপর তিনটে নাগাদ বেরিয়ে যাব। আগে ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে একটা খাট, একটা সেন্টার টেবিল, সোফা সেট আর দু’ তিনটে চেয়ার আপাততঃ কিনে নিই। তারপর বাজার থেকে রান্নার জিনিসগুলো কিনে বাড়ি ফিরব। তারপর বাদ বাকি যা কিছু দরকার তা ধীরে সুস্থে পরে কেনা যাবে”।
মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে রচনা শুয়ে পড়ল। রতীশও মোবাইলে এলার্ম সেট করে রচনার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। বেলা দুটোর সময় মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠতে তাদের ঘুম ভাঙল। রতীশ প্রথমে সীমন্তিনীকে ফোন করল। রচনাও তার সাথে কথা বলল। তারপর পোশাক আশাক বদলে তারা তিনটে নাগাদ ফ্ল্যাট থেকে বেরোল। একটা অটো ভাড়া করে ফার্নিচারের দোকানে গেল। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফাসেট, সেন্টার টেবিল, ফোর সিটার ডাইনিং টেবিল আর চারখানা চেয়ার পছন্দ করল তারা। সব মিলে দাম হল মোট আটশট্টি হাজার টাকা। পঁচিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ মালগুলো ফ্ল্যাটে ডেলিভারি দিতে বলে দিয়ে তারা বাজারে গিয়ে রান্না ঘরের জন্য কিছু শাক সব্জী মশলা আর মুদি দোকানের জিনিস আর একটা গ্যাস স্টোভ কিনে নিয়ে একটা অটো ভাড়া করে সন্ধ্যে ছ’টার আগেই ফ্ল্যাটে ফিরে এল।
ঠিক ছ’টায় ফার্নিচার গুলো সব এসে গেল। লোকগুলো সবকিছু জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে ঠিকমত ফিটিং করে দিয়ে রাত ন’টা নাগাদ বাকি টাকা নিয়ে চলে গেল। রচনা ততক্ষণে রান্নাঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। রচনার রাতের রান্না শেষ হতে হতে রতীশ বেডরুমের বিছানা আর বসবার ঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে ফেলল। রাতে সীমন্তিনী, ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু আর রতীশের মা সরলাদেবীর সাথে আবার ফোনে কথা বলল। রচনা শাশুড়ি মাকে আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না, “মামনি, চন্দু কেমন আছে গো”?
সরলাদেবী জবাব দিলেন, “ওর কথা তোকে আজ আর কিছু বলছি না রে মা। মন্তি বারবার করে বারণ করে দিয়েছে। তাই তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস না। আমি খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দিয়েছি ওকে। ও এখন ওদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তুই মন খারাপ করিসনে মা। কাল সারা রাত তুই ট্রেনে একটুও ঘুমোস নি শুনেছি। আজও তো বেশ পরিশ্রম গেছে তোর। তাই এবার সব ভাবনা ছেড়ে একটু ভাল করে ঘুমোবার চেষ্টা কর সোনা মা আমার। আমরা বাড়ির সকলেই ভাল আছি। তুই আমাদের নিয়ে ভাবিস না”।
ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে রচনা বলল, “জানি মামনি, ওখানে তোমরা সবাই সবাইকে প্রবোধ দেবে সান্ত্বনা দেবে। আমি থাকা না থাকাতে তোমাদের আর বেশী কষ্ট কী হবে”?
সরলাদেবী একটু অভিমানী সুরে বললেন, “আমি যত নিজেকে সামলে রাখবার চেষ্টা করছি, তুই ততই আমাকে কাঁদাবার চেষ্টা করছিস না? আমি ছাড়ছি এবার। কাল কথা বলব আবার” বলেই ফোন কেটে দিলেন। রচনাও সাথে উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল।
**************
___________________________________ss_sexy