25-02-2020, 09:02 PM
(Update No. 58 date. 27.7.2018)
চন্দ্রকান্তবাবু নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে সীমন্তিনীর নাম্বার ডায়াল করলেন। দু’বার রিং হতেই সীমন্তিনী কল রিসিভ করে বলল, “হ্যা কাকু, তুমি তো এখনও বড় ঘরেই আছ, তাই না”?
চন্দ্রকান্তবাবু মজা করে জবাব দিলেন, “কই না তো। আমি তো এখন আমাদের ঘরে বসে আছি রে”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “তোমার ঘরের পূবের জানালাটা কি খোলা আছে কাকু? তাহলে সে জানালা দিয়ে একটু তাকিয়ে দেখ তো, চাঁপা গাছ থেকে কি ফুল ঝরে পড়ছে? রচু বলছিল সব ফুলগুলো নাকি গাছ থেকে ঝরে ঝরে যাচ্ছে”।
চন্দ্রকান্তবাবু হেসে ফেলে বললেন, “মোক্ষম চাল চেলেছিস মা। আইপিএস হয়ে তোর বুদ্ধি দেখি বেশ খুলে গেছে রে। আমি এ মূহুর্তে কোথায় আছি, তা তুই ঠিক বুঝে গেছিস”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আমার উপহার আর প্রণামটা স্বীকার করেছ তোমরা”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “সে তো করেছিই রে মা। কিন্তু বিকেলে তুই আমাকে মিথ্যে কথা বললি কেন? বৌমাকে তো আগে থেকেই সব কিছু জানিয়ে দিয়ে তাকে বলে দিয়েছিলিস যে তোর উপহার গুলো সে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে যেন তোর হয়ে আমাদের সবাইকে প্রণাম করে। আর আমাকে বললি, তুই ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস নি”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি যে অলক্ষ্মী, মুখপুড়ি, হতচ্ছাড়ি, এ তো ছোটবেলা থেকেই শুনতে শুনতে বড় হয়েছি কাকু। কিন্তু আমি যে মিথ্যেবাদী এ ক’থাটা আজ তুমি আমায় প্রথমবার বললে”।
চন্দ্রকান্তবাবু এবার হকচকিয়ে উঠে বললেন, “মন্তি। মন্তি মা আমার। আমায় ভুল বুঝিসনে তুই। আমি তো সেটা সিরিয়াসলি বলিনি রে। আমি তো তোর সাথে একটু ঠাট্টা করছিলুম রে। কিন্তু সত্যি তুই বৌমাকে কিছু বলিস নি”?
সীমন্তিনী বলল, “না কাকু, রচুকে আমি কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আমি জানতুম, ও সেটাই করবে। তাই তোমাকে বলেছিলুম যে প্যাকেটটা যেন রচু নিজে হাতে খোলে। আচ্ছা কাকু, তোমার মেজদা মেজবৌদি ও’গুলো ফিরিয়ে দেননি তো? আর রচুর প্রণামটাও নিয়েছেন”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁরে মা, নিয়েছে। সবাই খুব খুশী মনে তোর উপহারগুলো স্বীকার করে নিয়েছে রে। সবাই খুব খুব খুশী হয়েছে”।
সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “কাকু, শোন না। কালচিনির মাসি মেসো আর ভাইয়ের জন্যেও একটা প্যাকেট পাঠিয়েছি। ওটা কাউকে দিয়ে পুজোর আগেই পাঠিয়ে দিতে পারবে না”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তুই ভাবিসনে মা। বড়দা তো এখনই বললেন, যে কালই সতুকে পাঠিয়ে দেবেন। সতুই গিয়ে দিয়ে আসবে’খন”।
সীমন্তিনী বলল, “ফোনটা একটু রচুকে দেবে কাকু”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে মা দিচ্ছি। ওকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে দে। তোর উপহারের প্যাকেটটা বুকে চেপে ধরে মেয়েটা একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। একটু বুঝিয়ে দে ওকে” বলে ফোনটা রচনার দিকে বাড়িয়ে দিল।
রচনা ফোনটা হাতে নিয়েও কোন কথা বলতে পারছিল না যেন। তার গলা দিয়ে যেন আবার কান্না ঠেলে উঠছিল। কোনরকমে “হ্যালো” বলতেই সীমন্তিনী বলল, “রচু সোনা। সোনা বোন আমার। তুই কেঁদে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেনরে পাগলী? তুই জানিসনা? তুই কাঁদছিস শুনলে আমার কী অবস্থা হবে? শোন লক্ষ্মীটি। আমি ভাল আছিরে। তোর ভালবাসা যে সর্বক্ষণ আমাকে ঘিরে রেখেছে রে। কাঁদিস নে বোন। তুই আমার মনের ইচ্ছেটা বুঝতে পারবি, এ বিশ্বাস আমার ছিল। তবু তোকে ধন্যবাদ জানিয়ে কষ্ট দেব না। আমার অনেক অনেক আদর আর ভালবাসা নিস বোন, ভাল থাকিস” বলেই ফোন কেটে দিল।
রচনা আর কিছু না বলে আবার হু হু করে কেঁদে উঠল। সরলাদেবী এবার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আবার রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রচনা শাশুড়ি মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও মামনি, দিদিভাইও যে কাঁদছেন গো। তুমি তো আমাকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছ। ওই মেয়েটাকে কে সান্ত্বনা দেবে এখন গো। তার পাশে যে কেউ নেই এখন। সে যে একা”।
এ প্রশ্নের জবাব কারুর কাছেই ছিল না। সরলাদেবী শুধু নিজের বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
**************
কিন্তু মানুষের জীবনের কোন সুখই তো আর নিরবচ্ছিন্ন নয়। রচনা আর রতীশের বিয়ের প্রায় ন’মাস বাদেই দুঃসংবাদ এল, রচনার দিদি অর্চনার স্বামী গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছেন। সে দুঃসংবাদ পেয়ে রতীশ রচনাকে সাথে নিয়ে কালচিনি গিয়েছিল। সেখানে দুঃখে ভেঙে পড়া শ্বশুর শাশুড়িকে প্রবোধ দিতে দিতে তারা জানতে পারল যে অর্চনার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এমন সময়েও বিধুবাবুকে মেয়ের সাথে দেখা করতে দেয় নি। আগের মতই দুর দুর করে তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুব ইচ্ছে থাকলেও রচনা তখনও তার দিদিকে দেখতে পায় নি।
বিয়ের বছর দুয়েক বাদেই এক রাতে রতীশের মুখের একটা কথা শুনে রচনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। রতীশ নিজের ভবিষ্যতটাকে আরও সুন্দর করবার জন্য কলেজের চাকরি ছেড়ে কলকাতা গিয়ে একটা যোগা কলেজ খুলতে চায়। রতীশ কলেজ থেকে ফিরে রোজ জলখাবার খেয়ে ছোটকাকুর পিসিওতে গিয়ে বসে। রবিশঙ্কর প্রসাদ বলে একটা লোক কলকাতা থেকে এসে ছোটকাকুর দোকানে নানা জিনিস সাপ্লাই দেয়। বেশীর ভাগই ফটোস্ট্যাটের সামগ্রী। প্রতি মাসেই সে নিয়ম করে দু’বার রাজগঞ্জে আসে। আর রাজগঞ্জে তার সবচেয়ে বড় খদ্দের হচ্ছেন রতীশের ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু। তাই সে যখন রাজগঞ্জ আসে তখন যে’কদিন থাকে সে ক’দিন রোজই চন্দ্রকান্ত বাবুর দোকানে অনেকটা সময় কাটায়। অবসর সময়ে সে চন্দ্রকান্ত বাবুর পিসিওতে এসে সকলের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটায়। রতীশের সাথেও তার ভাল পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়েছে। সেই রবিশঙ্কর প্রসাদই প্রথম রতীশকে পরামর্শ দিয়েছিল, কলকাতা গিয়ে একটা যোগা কলেজ খুলতে। সে বলতো রতীশ যোগাতে খুবই এক্সপার্ট। আর রতীশের মত যোগার এত বড় বড় ডিগ্রীধারী আর কোন প্রশিক্ষকই নেই কলকাতায়। তাই রতীশ যদি কিছু চেষ্টা চরিত্র করে কলকাতায় একটা যোগা কলেজ খুলতে পারে, তবে তার আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তাই করতে হবে না।
রতীশ ভেবে দেখেছে, কলেজের চাকরি করে সে যা বেতন পাচ্ছে তাতে খুব ভালভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয়। তবে বাড়িতে আছে বলেই তাদের খাবার খরচ আলাদা করে দিতে হয়না। কিন্তু সারা জীবন এভাবে চললে, তার তো আর উন্নতি বেশী কিছু হবে না। বিয়ের পর দুটো বছর তো কেটেই গেছে। আর কিছুদিন পর তো তাদের সন্তান হবে। তখন সাংসারিক খরচ তো আরও বাড়বে। এখন কলেজের কুড়ি হাজার বেতনের বেশীর ভাগটাই তার ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা হচ্ছে। তার কাছ থেকে সংসার খরচও তার বাবা কাকারা নিতে চায়নি। শুধু রচনার কথায় ছোট ছোট ভাই বোন গুলোকেই মাঝে মধ্যে দু’একটা পোশাক কিনে দিতে হয়েছে তাকে। রচনা নিজের জন্যেও কখনো কোন বায়না করেনি। বিয়ের সময়কার উপহার সামগ্রী গুলোর বেশীর ভাগই অধরা রয়ে গেছে। আজ অব্দি সামান্য একটা নেল পালিশও সে নিজের স্ত্রীকে কিনে দিতে পারেনি, বা বলা ভাল দেবার প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু চিরটা কাল তো এভাবে চলতে পারে না। বিয়ে করে স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে সে বাবার পয়সাতেই নিজের সংসারের খরচ মিটিয়ে যাবে, এটা তো হতেই পারে না। তাই তার ভবিষ্যতে উন্নতির পথ বেছে নিতেই হবে তাকে। এই ভেবে একদিন রাতে সে রচনাকে বলল, “রচু, তোমার কাছ থেকে একটা ব্যাপারে আমার পরামর্শ চাই”।
রচনা স্বামীকে আদর করতে করতে সহজ ভাবেই উত্তর দিয়েছিল, “হ্যা বল না, কী পরামর্শ চাও তুমি”?
রতীশ নিজের মনের ভাবনার কথা গুলো খুলে বলে বলেছিল, “তাই আমি ভাবছি, কলেজের চাকরী ছেড়ে দিয়ে কলকাতা গিয়ে একটা যোগা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুলব। প্রথম প্রথম কিছুদিন হয়ত একটু স্ট্রাগল করতে হবে ঠিকই। কিন্তু একবার ইন্সটিটিউটটা দাঁড়িয়ে গেলে আর ভাবনার কিছু থাকবে না। তুমি কি বলছ”?
রচনা রতীশের কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনেছিল। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “বেশ তোমার যুক্তি সবটাই না হয় মেনে নিলুম আমি। কিন্তু তুমি আমাকে এখানে বাড়িতে ফেলে একা কলকাতা চলে যাবে? আমি যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না সোনা। আর ওখানে তুমি একা নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাবে নাকি”?
রতীশ বলেছিল, “আমিও কি তোমাকে ছেড়ে সেখানে একা গিয়ে বেশীদিন থাকতে পারব সোনা? তোমাকেও যে আমার সাথে যেতে হবে”।
রচনা স্থির চোখে অনেকক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “দেখ সোনা, এ বাড়ির লোক গুলোকে ছেড়ে কোথাও পাকাপাকিভাবে চলে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে থাকবার কথাও আমি কল্পনাও করতে পারি না। একদিকে তোমার মনের সাধ পূর্ণ করতে আমাকে তোমার পাশে থাকতে হবে। আবার অন্যদিকে বাড়ির সকলের মনে দুঃখ দিয়ে তাদের সবাইকে ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। এ দুটোর মধ্যে কোন একটাকে বেছে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমার মনে হয় বাড়ির সকলের সাথে বসে তুমি এ ব্যাপারে পরামর্শ করে যা সিদ্ধান্ত নেবার নিও। আর আমার মনে হয় দিদিভাইয়ের সাথেও কথা বলাটা প্রয়োজন। কার ওপর ভরসা করে তুমি কলকাতা যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছ সেটাও সবাইকে খুলে বলো। আর এটা নিয়েও সকলের সাথে আলোচনা করো। তবে তাদের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমি তোমার সাথে থাকতে চাইনা। কারন সিদ্ধান্ত যাই নেওয়া হোক না কেন, আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারব না। আমি শুধু একটা কথাই জানি। বিয়ের আগেই দিদিভাই আমাকে বহুবার বলেছেন যে আমি যেন কোন অবস্থাতেই তোমাকে একা ছেড়ে না দিই। শুধু দিদিভাইকে দেওয়া কথা রাখবার জন্যেই নয়, আমি নিজেও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তাই তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে আমাকে সেটাই মানতে হবে। তবে আমি পরিস্কার করে তোমায় একটা কথা বলতে পারি। যদি সবাই তোমাকে কলকাতা যাবার অনুমতি দেন, তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার যতই কষ্ট হোক না কেন, আমিও তোমার সাথে যাব। সে কলকাতাই হোক বা পৃথিবীর যে কোনও জায়গাই হোক”।
পরের কয়েকটা দিন বাড়ির সকলকেই খুব চুপচাপ দেখা গেল। রচনা নিজে যেমন দোটানায় পড়েছিল তেমনি বাড়ির আর সকলেও। কেউই মন খুলে রতীশের কথায় সায় দিতে বা তার কথার বিরোধিতা করতে পারছিলেন না। অবশেষে অপারগ হয়ে সবাই সীমন্তিনীর ওপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ভার দিলেন। তখনও সীমন্তিনী হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ। তার সাথে একমাত্র রাতের বেলা ছাড়া আর কখনও কথা বলা সম্ভব হত না। সীমন্তিনী সব শুনে রতীশকে বলেছিল, “দাদাভাই, কলকাতা গিয়ে তুই একা একা তোর যোগা কোচিং সেন্টার খুলতে পারবি? না সেখানে তোকে সাহায্য করবার মত আর কেউ আছে”?
রতীশ জবাবে বলেছিল, “না ওখানে আর তেমন কে থাকবে। তবে ছোটকাকুর দোকানে ফটোস্ট্যাটের জিনিসপত্র সাপ্লাই দেয় যে রবিশঙ্কর প্রসাদ। সে ফ্যামিলী নিয়ে কলকাতাতেই থাকে। সে বলেছে আমাকে কোচিং সেন্টার খুলবার জন্য একটা ভাল জায়গা সে খুঁজে দিতে পারবে। আর আমাদের থাকবার জন্যে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার ব্যবস্থাও সে করে দেবে। সাহায্য বলতে এটুকুই। বাকিটা তো নিজেকেই দেখে শুনে নিতে হবে”।
সীমন্তিনী বলেছিল, “হ্যা লোকটাকে মনে হয় আমিও দেখেছি। কিন্তু লোকটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। তুই শোন দাদাভাই। রবিশঙ্কর প্রসাদ কলকাতায় কোথায় থাকে, সে ঠিকানাটা আমাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দিস তো। লোকটার ব্যাপারে একট খোঁজ খবর নিয়ে দেখি। তারপর তোকে জানাব”।
রবিশঙ্কর প্রসাদ তখন রাজগঞ্জেই ছিল। তাই তার কাছ থেকে তার বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিতে রতীশের দেরী হল না। সেটা সে সীমন্তিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল। তার তিনদিন বাদেই সীমন্তিনী ফোন করে জানিয়েছিল যে লোকটার ঠিকানা ঠিকই আছে। ভুয়ো ঠিকানা সে দেয়নি। সীমন্তিনী বলেছিল, “দাদাভাই লোকটার ঠিকানা তো ঠিকই আছে। কিন্তু হায়দ্রাবাদে বসে লোকটা সম্বন্ধে আমি আর বেশী কিছু খোঁজ খবর করতে পারছি না। আমি কাকুর সাথে কথা বলব। তুইও একটু ভাল করে ভেবে দ্যাখ লোকটা সত্যি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য কি না। আর তোর যদি মনে হয় সব ঠিকঠাক আছে, তাহলে তুই একবার একা তার সাথে কলকাতা গিয়ে দেখে আয় কোথায় জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। তোদের থাকার জায়গাও দেখে আয়। বাকিটা তারপর দেখা যাবে”।
তার পরের মাসেই রতীশ রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়েছিল। রবিশঙ্করের ছোট ঘরে থাকবার জায়গা নেই বলে সে একটা হোটেলে উঠেছিল। রবিশঙ্করের সাথে উত্তর কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার ব্যাপারে কথা হল। আর যোগা কোচিং সেন্টার খুলবার জন্যেও একটা কমপ্লেক্স দেখল। কমপ্লেক্সটা তার থাকবার ওই ফ্ল্যাট থেকে খুব বেশী দুরে নয়। কমপ্লেক্সটা দেখে রতীশের বেশ ভাল লেগেছিল। তবে কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালার সাথে কোন কথাবার্তা বলা সম্ভব হয়নি। সে দিন পনেরোর জন্য দিল্লী গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরে এসে সবাইকে সব কথা খুলে বলে রতীশ সকলের কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করল যে সে কলকাতা গিয়ে ওই কমপ্লেক্সেই নিজের যোগা কোচিং সেন্টার খুলতে চায়। তাদের ঘরের লক্ষ্মী রচনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভেবে সকলেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রতীশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেউ আর অমত করেন নি।
তখন থেকেই বাড়ির সকলের সাথে সাথে রচনাও যেন মুষড়ে পড়েছিল। এ বাড়ি ছেড়ে, বাড়ির এই লোকগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে সেও মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করত। কোন কাজ করতে করতে হঠাতই তার মনটা উদাস হয়ে উঠত। বড়রা সকলেই নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারলেও তার ছোট্ট ননদ চন্দ্রিকা কিছুতেই বাড়ির লোকদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিল না। যখন তখন রচনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠত, “ও বৌমণি তুমি বড়দাকে বলে দাও সে একা চলে যাক কলকাতা। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না। তোমাকে না দেখে আমি যে একটা দিনও থাকতে পারব না। পড়শোনাতেও মন বসবে না আমার। আমি পরীক্ষায় ফেল করব। কে আমায় খাইয়ে দেবে? কলেজে যাবার সময় কে আমায় তৈরী করে দেবে। আমি কারো কোন কথা শুনতে চাই না। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না ব্যস”।
রচনা হাজার বুঝিয়েও তাকে শান্ত করতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরে সে নিজেও কেঁদে ফেলত। তখন তার তিন শাশুড়ি মায়ের কেউ একজন জোর করে চন্দ্রিকাকে রচনার হাত থেকে ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। সীমন্তিনী প্রায় রোজই তার সাথে ফোনে কথা বলত। সেও নানাভাবে রচনাকে বোঝাত।
সীমন্তিনী একদিন তার ট্রেনিংএর শেষে চন্দ্রকান্তবাবুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, “ছোটকাকু, দাদাভাই তো কলকাতা যাচ্ছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে নতুন করে একটা যোগা সেন্টার খুলতে গেলে কতটা পয়সাকড়ি লাগতে পারে, সে’সব তোমরা ভেবে দেখেছ? দাদাভাইয়ের হাতে কি অত পয়সা আছে? তাহলে সে কী করে কি শুরু করবে? কলেজের চাকরিতে রিজাইন দেবার আগে এ সব ব্যাপার নিয়ে তোমরা সবাই আলোচনা করে দেখ। আমি তো সবে চাকরিতে ঢুকলাম। আমার হাতে যদি কিছু থাকত আমি তো সেটা দাদাভাইকে দিতে দু’বার ভাবতুম না। আর দাদাভাই কলেজ থেকে যা বেতন পেত তা থেকে আর কতটুকু সেভিংস করতে পেরেছে। তোমরা দাদাভাইকে নিয়ে বসে একটু শলা পরামর্শ করে কতটা কি লাগে, আর তা কোত্থেকে কিভাবে পাবে, সেসব নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা কোর। আর বাড়ির সবাই কে কি বলছে এ ব্যাপারে”।
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “বাড়ির কথা আর বলিসনে মা। সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। কারুর মুখে হাঁসি নেই। শুধু চন্দুটাই যা একটু চেঁচামেচি করছে। আর তারও মুখে একটাই কথা। তার বৌমণি তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। আসলে রচু এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবার পর থেকে ও তো আর তার বৌমণি ছাড়া কিছুটি বোঝে না। আমরা বড়রা তো রতুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারি। দশ এগার বছরের একটা মেয়ে কি আর সেসব বুঝতে পারবে? কিন্তু সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে তো আমাদের বৌমাই। সে না পারছে এ বাড়ির লোকগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে, না পারছে রতীশকে একা চলে যাবার কথা বলতে। বাড়ির সব কটা মানুষকে ও যে কতটা ভালবাসে সে’কথা আমাদের চেয়ে বেশী আর কে জানবে বল? রোজ দুপুরে মেয়েটা তার তিন শাশুড়ির সাথে বসে তাদের সেবা যত্ন করে। কাল তোর ছোটমা বলছিল, কাল বিকেলে তোর মায়ের চুল আঁচড়ে দিতে দিতে ও নাকি হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল। আমরা সবাই তো নিজেদের মনের অনেক প্রশ্ন অনেক কথাই একে ওকে বলে থাকি। কিন্তু ও মেয়েটা যে কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না রে। কার দাবী ও সমর্থন করবে, আর কার বিপক্ষে যাবে”?
সীমন্তিনী বলল, “জানি গো কাকু। ও মেয়েটাই সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে মনে মনে। কিন্তু দেখ কাকু, দাদাভাই যেটা ভাবছে, সেটাকেও তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওদের বিয়ের প্রায় তিন বছর হতে চলল। ঠাকুরের আশীর্বাদে এখন তো ওদের সংসারে যে কোন সময় নতুন অতিথি আসতে পারে। এ কলেজের চাকরি করে বাড়িতে থাকতে কোন বাঁধা না থাকলেও, দাদাভাই চিরদিন বাবা কাকাদের আয়ে নিজের পরিবারের ভরণ পোষন করে যাবে, এটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তাই সে চাইছে নিজের আয় বাড়াতে। আর রাজগঞ্জে কোন যোগা সেন্টার খুলে তো লাভ হবে না। তাই ও চাইছে কোলকাতা গিয়ে কিছু একটা করতে। আমার মনে হয় তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করা আমাদের সকলেরই উচিৎ”।
২০১২ সালের মার্চ মাসে সীমন্তিনীকে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ডুয়ার্সের একটি মহকুমা শহরে পোস্টিং দেওয়া হল এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। নাগরাকাটায় তাকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি করে পাঠানো হল। রাজগঞ্জ থেকে সে জায়গাটা যতটা দুরে, কালচিনি থেকে সে জায়গাটা প্রায় অতটাই দুর। রাজগঞ্জের দুরত্ব সেখান থেকে প্রায় ৭৬ কিমি। আর কালচিনিও সেখান থেকে প্রায় ৭৮ কিমি। তবে ট্রেনে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগে কালচিনি থেকে। এ লাইনে ট্রেন খুব বেশী চলাচল করে না। তবে ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার জলপাইগুড়ি থেকে তার জায়গায় যেতে হলে যে সড়কপথে তাকে যাতায়াত করতে হবে সে রাস্তায় কালচিনি পড়ে না। তার ওখান থেকে ট্রেনে আলিপুরদুয়ার যাবার পথে কালচিনি পড়ে। অফিস থেকে তাকে থাকবার কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে। একটা টিলার ওপর একতলা বাংলো প্যাটার্নের একটা কোয়ার্টার। কোয়ার্টারটাতে সব মিলে মোট ছ’খানা ঘর। দুটো বেডরুম আর গেস্ট রুমের সাথে এটাচড বাথরুম আছে। লিভিং রুম, কিচেন আর একটা স্টোর রুম। পেছনে একটা ছোট্ট ফুলের বাগান, আর একটা ছোট ফাঁকা জায়গা। তার পেছনদিকে ছোটখাটো একটা পার্ক আর পার্কের পেছনে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। কোয়ার্টারের সামনের দিকে এক পাশে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। আর ওয়াচম্যান এবং সিকিরিটির লোকদের থাকবার দুটো আলাদা ঘর। তিনদিকে সবুজ পাহাড় আর একদিকে চা বাগান ঘেরা জায়গাটা সত্যি খুব মনোরম। সীমন্তিনী ভেবেছিল সেখানে কাজে যোগ দেবার আগে সে একবার কালচিনি গিয়ে রচনার মা বাবাকে প্রণাম করে যাবে। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট থেকে তাকে সে পথে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় নি। তাকে বলা হয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টারে আসা যাওয়া করতে হলে তাকে সবচেয়ে কম দুরত্বের রাস্তায় আসা যাওয়া করতে হবে। গত কয়েক বছরে আসাম এবং উত্তরবঙ্গের অনেকগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠণের উগ্রপন্থীরা বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স এলাকা এবং ভূটানের কিছু অঞ্চল জুড়ে তাদের গোপন ঘাঁটি বানিয়ে এসব অঞ্চলে ঘোরা ফেরা করছে। তাই সীমন্তিনীর সাথে সব সময়ই কয়েকজন সিকিউরিটি থাকবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সীমন্তিনী তার উচ্চপদস্থ অফিসারদের কথা অমান্য করে কালচিনি যেতে পারেনি।
হায়দ্রাবাদ ট্রেনিংএ যাবার পর সীমন্তিনী আর কখনও কালচিনি যেতে পারেনি। রচনার ছোটভাই কিংশুক এবার হায়ার সেকেণ্ডারি দেবে। সীমন্তিনী মনে মনে ভেবে রেখেছে কিংশুকের লেখাপড়ার খরচ সে নিজে বহন করবে। এখন তার সামর্থ্য আছে। কিংশুক দু’বছর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে চতুর্থ স্থান পেয়েছিল। তার মত অমন ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে পয়সার অভাবে লেখা পড়া ছেড়ে দেবে, এটা সীমন্তিনী কিছুতেই হতে দেবে না।
অফিসে জয়েন করার দিন সন্ধ্যে বেলায় কোয়ার্টারে ফিরে এসে কালচিনির নাম্বারে ফোন করল। কয়েকবার রিং হতেই কিংশুকের গলা শুনতে পেল, “হ্যা দিদিভাই বল। তুমি কোথায় আছ? জলপাইগুড়িতে”?
সীমন্তিনী বলল, “আজ সকালে নাগরাকাটা এসে পৌঁছেছি রে ভাই। ভেবেছিলুম ওদিক দিয়ে এলে তোমাদের সাথে দেখা করে আসব। কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমাকে অন্য রাস্তায় আসতে হয়েছে। আচ্ছা ভাই, বাড়ির সবাই কেমন আছে রে? সবাই ভাল আছে তো”?
কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই, সবাই ভাল আছে। তবে কেউই আর আগের মত হাসিখুশি নেই। তুমি তো সব খবরই জান দিদিভাই। বড়জামাইবাবুর দুর্ঘটণার পর থেকে মা বাবা দু’জনেই যেন কেমন হয়ে গেছেন। বড়দির শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বাবা অনেকবার চেষ্টা করেছেন তার সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু দেখা করা তো দুর, বাবাকে তারা বসতে পর্যন্ত দেয়নি। জামাইবাবু মারা গেছেন তিন বছর হল। এতটা সময়ের মধ্যে আমার বড়দির কোন খবর পাইনি। এই নিয়ে কিছুদিন পরপরই মা কান্নাকাটি করেন। বাবার শরীরটা আগের থেকে অনেক ভেঙে গেছে। এসব আর কত বলব তোমাকে দিদিভাই। তোমার তো আর কিছু অজানা নেই”।
সীমন্তিনী বলল, “ভাই, মা বাবা আছেন বাড়িতে”?
কিংশুক বলল, “দিদিভাই, বাবা তো একটু বাজারে গেছে, আমি মাকে দিচ্ছি”।
খানিক বাদে বিভাদেবীর গলা শোনা গেল, “হ্যারে মন্তিমা বল। ভাল আছিস তো”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যা মাসি, আমি তো ঠিক আছি। কিন্তু ভাই এ সব কী বলছে? তুমি নাকি রোজ কান্নাকাটি করছ বাড়িতে”?
বিভাদেবী বললেন, “তোকে আমি কী করে বোঝাব রে মা। আমি যে মা। পেটে ধরা মেয়েটাকে কত বছর থেকে চোখের দেখাটুকুও দেখতে পাচ্ছি না। জামাই চলে যাবার পর তোর মেসো কতবার মেয়েটাকে শুধু একটু চোখের দেখা দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওদের বাড়ির লোকেরা মেয়েটাকে দেখতে তো দেয়ই নি, তোর মেসোকে বসতে পর্যন্ত দেয় নি। মেয়েটা কেমন আছে সে খবর টুকুও আমরা জানতে পাচ্ছি না। তুই তো মা আমার ছোট মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস। নইলে ওর কপালেও যে কী হত কে জানে। প্রায় সাত বছর হয়ে গেল। অর্চুকে একটুখানি চোখের দেখাও দেখিনি। একজন মায়ের পক্ষে এটা যে কতটা কষ্টের, সেটা তো আমি তোকে বোঝাতে পারব না রে মা। আমাদের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়েই তো আমাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “মাসি, তুমি এসব ভেবে ভেবে নিজের শরীর খারাপ কোর না গো। ভাইয়ের কথাটা একটু ভাবো। তোমাকে মেসোকে সর্বক্ষণ মন ভারী করে বসে থাকতে দেখলে ওর কি ভাল লাগবে বল? এবার ও বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেবে। ভাল রেজাল্ট করতে হবে ওকে। তোমাদের ও’ভাবে দেখলে ও যে মন দিয়ে পড়াশোনাটাও করতে পারবে না গো, সেটা বোঝ না তোমরা”?
বিভাদেবী সীমন্তিনীর কথা শুনে বললেন, “সবই তো বুঝিরে মা। কিন্তু আমরা যে এতই অপদার্থ বাবা-মা যে ছেলেমেয়ে গুলোর ভবিষ্যৎ গড়ে দেবার মত সাধ্যও আমাদের নেই। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যার রচুর মত খোকাকেও স্কলারশিপ জুটিয়ে দিয়েছেন বলেই বার ক্লাসটা পড়তে পারছে। এরপর কি হবে কে জানে। হয়ত কারো একটা দোকান টোকানে কাজে ঢুকিয়ে দিতে....”।
সীমন্তিনী বিভাদেবীকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “মাসি, এমন আজে বাজে কথা বোলনা তো। রচুর বিয়ের পর আমাকে দুরে চলে যেতে হয়েছিল বলে ওকে আমি গ্র্যাজুয়েট করতে পারিনি। আর সেও আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হয়নি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমি ওকে পড়াতে পারিনি। তখন আমার নিজের কোন আয়ও ছিল না। কিন্তু তোমাদের আশীর্বাদে আজ আমার সে ক্ষমতা আছে। তাই ভাই যা পড়তে চাইবে আমি তাকে সেটা পড়ার সুযোগ দেব। ওর পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমার। আমি তো ওর দিদি। ভাইয়ের জীবনটা ভাল করে গড়ে তোলার এটুকু দায়িত্ব তো আমিও নিতে পারি। তুমি ও’সব নিয়ে ভেব না। ভাইকে আমি সব বুঝিয়ে বলব। আর ওকে সেভাবেই তৈরী করব। আর শোন মাসি। ভাই বলছিল মেসোর শরীরটা নাকি ভাল যাচ্ছে না। আমি কয়েকদিন বাদে একবার কালচিনি যাবার চেষ্টা করব। তখন মেসোর সাথেও কথা বলব”।
বিভাদেবী সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। অনেক কষ্টে বললেন, “তুই আমাদের জন্যে আর কত করবি মা? আমাদের ওপর তোর ঋণের বোঝা যে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে রে। আমি তো তোকে পেটে ধরিনি রে মা। তুই কোন জন্মের ঋণ শোধ করতে চাইছিস, জানি না”।
সীমন্তিনী বলল, “আবার আজেবাজে কথা বলছ তুমি মাসি? শোন, তোমার ছোটমেয়ে আর জামাই তো এবার কলকাতা চলে যাবে শুনছি। মেয়ে দুরে চলে যাচ্ছে বলে তোমরা মন খারাপ কোর না। ওদের ওপর আমি সব সময় নজর রাখব। তোমাকে আমি ওদের বিয়ের আগে যে কথা দিয়েছি, সেটা আমি ভুলিনি। তাই তুমি আর মেসো এ’কথাটা সব সময় মাথায় রেখ। আমি সারা জীবন তোমার ছোটমেয়ে আর জামাইয়ের পাশে থাকব। আর শোন মাসি। আমি পরের সপ্তাহে মেসোর নামে কিছু টাকা পাঠাব। তোমরা সেটা ফিরিয়ে দিও না যেন। তোমার এ মেয়েটা তার নিজের আয় থেকে জীবনে প্রথমবার তার মা বাবাকে কিছু দিতে যাচ্ছে। তোমরা সেটা অস্বীকার করে আমাকে দুঃখ দিও না দয়া করে। আচ্ছা, আজ ছাড়ছি মাসি। পরে আবার কথা বলব। তবে একটা কথা মনে রেখ, তোমাদের যে কোন সমস্যা হোক, সবার আগে আমাকে সেটা জানাবে। নইলে কিন্তু আমি খুব দুঃখ পাব। রাখছি”।
ss_sexy
চন্দ্রকান্তবাবু নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে সীমন্তিনীর নাম্বার ডায়াল করলেন। দু’বার রিং হতেই সীমন্তিনী কল রিসিভ করে বলল, “হ্যা কাকু, তুমি তো এখনও বড় ঘরেই আছ, তাই না”?
চন্দ্রকান্তবাবু মজা করে জবাব দিলেন, “কই না তো। আমি তো এখন আমাদের ঘরে বসে আছি রে”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “তোমার ঘরের পূবের জানালাটা কি খোলা আছে কাকু? তাহলে সে জানালা দিয়ে একটু তাকিয়ে দেখ তো, চাঁপা গাছ থেকে কি ফুল ঝরে পড়ছে? রচু বলছিল সব ফুলগুলো নাকি গাছ থেকে ঝরে ঝরে যাচ্ছে”।
চন্দ্রকান্তবাবু হেসে ফেলে বললেন, “মোক্ষম চাল চেলেছিস মা। আইপিএস হয়ে তোর বুদ্ধি দেখি বেশ খুলে গেছে রে। আমি এ মূহুর্তে কোথায় আছি, তা তুই ঠিক বুঝে গেছিস”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আমার উপহার আর প্রণামটা স্বীকার করেছ তোমরা”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “সে তো করেছিই রে মা। কিন্তু বিকেলে তুই আমাকে মিথ্যে কথা বললি কেন? বৌমাকে তো আগে থেকেই সব কিছু জানিয়ে দিয়ে তাকে বলে দিয়েছিলিস যে তোর উপহার গুলো সে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে যেন তোর হয়ে আমাদের সবাইকে প্রণাম করে। আর আমাকে বললি, তুই ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস নি”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি যে অলক্ষ্মী, মুখপুড়ি, হতচ্ছাড়ি, এ তো ছোটবেলা থেকেই শুনতে শুনতে বড় হয়েছি কাকু। কিন্তু আমি যে মিথ্যেবাদী এ ক’থাটা আজ তুমি আমায় প্রথমবার বললে”।
চন্দ্রকান্তবাবু এবার হকচকিয়ে উঠে বললেন, “মন্তি। মন্তি মা আমার। আমায় ভুল বুঝিসনে তুই। আমি তো সেটা সিরিয়াসলি বলিনি রে। আমি তো তোর সাথে একটু ঠাট্টা করছিলুম রে। কিন্তু সত্যি তুই বৌমাকে কিছু বলিস নি”?
সীমন্তিনী বলল, “না কাকু, রচুকে আমি কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আমি জানতুম, ও সেটাই করবে। তাই তোমাকে বলেছিলুম যে প্যাকেটটা যেন রচু নিজে হাতে খোলে। আচ্ছা কাকু, তোমার মেজদা মেজবৌদি ও’গুলো ফিরিয়ে দেননি তো? আর রচুর প্রণামটাও নিয়েছেন”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁরে মা, নিয়েছে। সবাই খুব খুশী মনে তোর উপহারগুলো স্বীকার করে নিয়েছে রে। সবাই খুব খুব খুশী হয়েছে”।
সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “কাকু, শোন না। কালচিনির মাসি মেসো আর ভাইয়ের জন্যেও একটা প্যাকেট পাঠিয়েছি। ওটা কাউকে দিয়ে পুজোর আগেই পাঠিয়ে দিতে পারবে না”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তুই ভাবিসনে মা। বড়দা তো এখনই বললেন, যে কালই সতুকে পাঠিয়ে দেবেন। সতুই গিয়ে দিয়ে আসবে’খন”।
সীমন্তিনী বলল, “ফোনটা একটু রচুকে দেবে কাকু”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে মা দিচ্ছি। ওকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে দে। তোর উপহারের প্যাকেটটা বুকে চেপে ধরে মেয়েটা একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। একটু বুঝিয়ে দে ওকে” বলে ফোনটা রচনার দিকে বাড়িয়ে দিল।
রচনা ফোনটা হাতে নিয়েও কোন কথা বলতে পারছিল না যেন। তার গলা দিয়ে যেন আবার কান্না ঠেলে উঠছিল। কোনরকমে “হ্যালো” বলতেই সীমন্তিনী বলল, “রচু সোনা। সোনা বোন আমার। তুই কেঁদে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেনরে পাগলী? তুই জানিসনা? তুই কাঁদছিস শুনলে আমার কী অবস্থা হবে? শোন লক্ষ্মীটি। আমি ভাল আছিরে। তোর ভালবাসা যে সর্বক্ষণ আমাকে ঘিরে রেখেছে রে। কাঁদিস নে বোন। তুই আমার মনের ইচ্ছেটা বুঝতে পারবি, এ বিশ্বাস আমার ছিল। তবু তোকে ধন্যবাদ জানিয়ে কষ্ট দেব না। আমার অনেক অনেক আদর আর ভালবাসা নিস বোন, ভাল থাকিস” বলেই ফোন কেটে দিল।
রচনা আর কিছু না বলে আবার হু হু করে কেঁদে উঠল। সরলাদেবী এবার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আবার রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রচনা শাশুড়ি মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও মামনি, দিদিভাইও যে কাঁদছেন গো। তুমি তো আমাকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছ। ওই মেয়েটাকে কে সান্ত্বনা দেবে এখন গো। তার পাশে যে কেউ নেই এখন। সে যে একা”।
এ প্রশ্নের জবাব কারুর কাছেই ছিল না। সরলাদেবী শুধু নিজের বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
**************
কিন্তু মানুষের জীবনের কোন সুখই তো আর নিরবচ্ছিন্ন নয়। রচনা আর রতীশের বিয়ের প্রায় ন’মাস বাদেই দুঃসংবাদ এল, রচনার দিদি অর্চনার স্বামী গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছেন। সে দুঃসংবাদ পেয়ে রতীশ রচনাকে সাথে নিয়ে কালচিনি গিয়েছিল। সেখানে দুঃখে ভেঙে পড়া শ্বশুর শাশুড়িকে প্রবোধ দিতে দিতে তারা জানতে পারল যে অর্চনার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এমন সময়েও বিধুবাবুকে মেয়ের সাথে দেখা করতে দেয় নি। আগের মতই দুর দুর করে তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুব ইচ্ছে থাকলেও রচনা তখনও তার দিদিকে দেখতে পায় নি।
বিয়ের বছর দুয়েক বাদেই এক রাতে রতীশের মুখের একটা কথা শুনে রচনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। রতীশ নিজের ভবিষ্যতটাকে আরও সুন্দর করবার জন্য কলেজের চাকরি ছেড়ে কলকাতা গিয়ে একটা যোগা কলেজ খুলতে চায়। রতীশ কলেজ থেকে ফিরে রোজ জলখাবার খেয়ে ছোটকাকুর পিসিওতে গিয়ে বসে। রবিশঙ্কর প্রসাদ বলে একটা লোক কলকাতা থেকে এসে ছোটকাকুর দোকানে নানা জিনিস সাপ্লাই দেয়। বেশীর ভাগই ফটোস্ট্যাটের সামগ্রী। প্রতি মাসেই সে নিয়ম করে দু’বার রাজগঞ্জে আসে। আর রাজগঞ্জে তার সবচেয়ে বড় খদ্দের হচ্ছেন রতীশের ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু। তাই সে যখন রাজগঞ্জ আসে তখন যে’কদিন থাকে সে ক’দিন রোজই চন্দ্রকান্ত বাবুর দোকানে অনেকটা সময় কাটায়। অবসর সময়ে সে চন্দ্রকান্ত বাবুর পিসিওতে এসে সকলের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটায়। রতীশের সাথেও তার ভাল পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়েছে। সেই রবিশঙ্কর প্রসাদই প্রথম রতীশকে পরামর্শ দিয়েছিল, কলকাতা গিয়ে একটা যোগা কলেজ খুলতে। সে বলতো রতীশ যোগাতে খুবই এক্সপার্ট। আর রতীশের মত যোগার এত বড় বড় ডিগ্রীধারী আর কোন প্রশিক্ষকই নেই কলকাতায়। তাই রতীশ যদি কিছু চেষ্টা চরিত্র করে কলকাতায় একটা যোগা কলেজ খুলতে পারে, তবে তার আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তাই করতে হবে না।
রতীশ ভেবে দেখেছে, কলেজের চাকরি করে সে যা বেতন পাচ্ছে তাতে খুব ভালভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয়। তবে বাড়িতে আছে বলেই তাদের খাবার খরচ আলাদা করে দিতে হয়না। কিন্তু সারা জীবন এভাবে চললে, তার তো আর উন্নতি বেশী কিছু হবে না। বিয়ের পর দুটো বছর তো কেটেই গেছে। আর কিছুদিন পর তো তাদের সন্তান হবে। তখন সাংসারিক খরচ তো আরও বাড়বে। এখন কলেজের কুড়ি হাজার বেতনের বেশীর ভাগটাই তার ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা হচ্ছে। তার কাছ থেকে সংসার খরচও তার বাবা কাকারা নিতে চায়নি। শুধু রচনার কথায় ছোট ছোট ভাই বোন গুলোকেই মাঝে মধ্যে দু’একটা পোশাক কিনে দিতে হয়েছে তাকে। রচনা নিজের জন্যেও কখনো কোন বায়না করেনি। বিয়ের সময়কার উপহার সামগ্রী গুলোর বেশীর ভাগই অধরা রয়ে গেছে। আজ অব্দি সামান্য একটা নেল পালিশও সে নিজের স্ত্রীকে কিনে দিতে পারেনি, বা বলা ভাল দেবার প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু চিরটা কাল তো এভাবে চলতে পারে না। বিয়ে করে স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে সে বাবার পয়সাতেই নিজের সংসারের খরচ মিটিয়ে যাবে, এটা তো হতেই পারে না। তাই তার ভবিষ্যতে উন্নতির পথ বেছে নিতেই হবে তাকে। এই ভেবে একদিন রাতে সে রচনাকে বলল, “রচু, তোমার কাছ থেকে একটা ব্যাপারে আমার পরামর্শ চাই”।
রচনা স্বামীকে আদর করতে করতে সহজ ভাবেই উত্তর দিয়েছিল, “হ্যা বল না, কী পরামর্শ চাও তুমি”?
রতীশ নিজের মনের ভাবনার কথা গুলো খুলে বলে বলেছিল, “তাই আমি ভাবছি, কলেজের চাকরী ছেড়ে দিয়ে কলকাতা গিয়ে একটা যোগা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুলব। প্রথম প্রথম কিছুদিন হয়ত একটু স্ট্রাগল করতে হবে ঠিকই। কিন্তু একবার ইন্সটিটিউটটা দাঁড়িয়ে গেলে আর ভাবনার কিছু থাকবে না। তুমি কি বলছ”?
রচনা রতীশের কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনেছিল। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “বেশ তোমার যুক্তি সবটাই না হয় মেনে নিলুম আমি। কিন্তু তুমি আমাকে এখানে বাড়িতে ফেলে একা কলকাতা চলে যাবে? আমি যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না সোনা। আর ওখানে তুমি একা নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাবে নাকি”?
রতীশ বলেছিল, “আমিও কি তোমাকে ছেড়ে সেখানে একা গিয়ে বেশীদিন থাকতে পারব সোনা? তোমাকেও যে আমার সাথে যেতে হবে”।
রচনা স্থির চোখে অনেকক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “দেখ সোনা, এ বাড়ির লোক গুলোকে ছেড়ে কোথাও পাকাপাকিভাবে চলে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে থাকবার কথাও আমি কল্পনাও করতে পারি না। একদিকে তোমার মনের সাধ পূর্ণ করতে আমাকে তোমার পাশে থাকতে হবে। আবার অন্যদিকে বাড়ির সকলের মনে দুঃখ দিয়ে তাদের সবাইকে ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। এ দুটোর মধ্যে কোন একটাকে বেছে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমার মনে হয় বাড়ির সকলের সাথে বসে তুমি এ ব্যাপারে পরামর্শ করে যা সিদ্ধান্ত নেবার নিও। আর আমার মনে হয় দিদিভাইয়ের সাথেও কথা বলাটা প্রয়োজন। কার ওপর ভরসা করে তুমি কলকাতা যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছ সেটাও সবাইকে খুলে বলো। আর এটা নিয়েও সকলের সাথে আলোচনা করো। তবে তাদের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমি তোমার সাথে থাকতে চাইনা। কারন সিদ্ধান্ত যাই নেওয়া হোক না কেন, আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারব না। আমি শুধু একটা কথাই জানি। বিয়ের আগেই দিদিভাই আমাকে বহুবার বলেছেন যে আমি যেন কোন অবস্থাতেই তোমাকে একা ছেড়ে না দিই। শুধু দিদিভাইকে দেওয়া কথা রাখবার জন্যেই নয়, আমি নিজেও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তাই তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে আমাকে সেটাই মানতে হবে। তবে আমি পরিস্কার করে তোমায় একটা কথা বলতে পারি। যদি সবাই তোমাকে কলকাতা যাবার অনুমতি দেন, তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার যতই কষ্ট হোক না কেন, আমিও তোমার সাথে যাব। সে কলকাতাই হোক বা পৃথিবীর যে কোনও জায়গাই হোক”।
পরের কয়েকটা দিন বাড়ির সকলকেই খুব চুপচাপ দেখা গেল। রচনা নিজে যেমন দোটানায় পড়েছিল তেমনি বাড়ির আর সকলেও। কেউই মন খুলে রতীশের কথায় সায় দিতে বা তার কথার বিরোধিতা করতে পারছিলেন না। অবশেষে অপারগ হয়ে সবাই সীমন্তিনীর ওপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ভার দিলেন। তখনও সীমন্তিনী হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ। তার সাথে একমাত্র রাতের বেলা ছাড়া আর কখনও কথা বলা সম্ভব হত না। সীমন্তিনী সব শুনে রতীশকে বলেছিল, “দাদাভাই, কলকাতা গিয়ে তুই একা একা তোর যোগা কোচিং সেন্টার খুলতে পারবি? না সেখানে তোকে সাহায্য করবার মত আর কেউ আছে”?
রতীশ জবাবে বলেছিল, “না ওখানে আর তেমন কে থাকবে। তবে ছোটকাকুর দোকানে ফটোস্ট্যাটের জিনিসপত্র সাপ্লাই দেয় যে রবিশঙ্কর প্রসাদ। সে ফ্যামিলী নিয়ে কলকাতাতেই থাকে। সে বলেছে আমাকে কোচিং সেন্টার খুলবার জন্য একটা ভাল জায়গা সে খুঁজে দিতে পারবে। আর আমাদের থাকবার জন্যে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার ব্যবস্থাও সে করে দেবে। সাহায্য বলতে এটুকুই। বাকিটা তো নিজেকেই দেখে শুনে নিতে হবে”।
সীমন্তিনী বলেছিল, “হ্যা লোকটাকে মনে হয় আমিও দেখেছি। কিন্তু লোকটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। তুই শোন দাদাভাই। রবিশঙ্কর প্রসাদ কলকাতায় কোথায় থাকে, সে ঠিকানাটা আমাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দিস তো। লোকটার ব্যাপারে একট খোঁজ খবর নিয়ে দেখি। তারপর তোকে জানাব”।
রবিশঙ্কর প্রসাদ তখন রাজগঞ্জেই ছিল। তাই তার কাছ থেকে তার বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিতে রতীশের দেরী হল না। সেটা সে সীমন্তিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল। তার তিনদিন বাদেই সীমন্তিনী ফোন করে জানিয়েছিল যে লোকটার ঠিকানা ঠিকই আছে। ভুয়ো ঠিকানা সে দেয়নি। সীমন্তিনী বলেছিল, “দাদাভাই লোকটার ঠিকানা তো ঠিকই আছে। কিন্তু হায়দ্রাবাদে বসে লোকটা সম্বন্ধে আমি আর বেশী কিছু খোঁজ খবর করতে পারছি না। আমি কাকুর সাথে কথা বলব। তুইও একটু ভাল করে ভেবে দ্যাখ লোকটা সত্যি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য কি না। আর তোর যদি মনে হয় সব ঠিকঠাক আছে, তাহলে তুই একবার একা তার সাথে কলকাতা গিয়ে দেখে আয় কোথায় জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। তোদের থাকার জায়গাও দেখে আয়। বাকিটা তারপর দেখা যাবে”।
তার পরের মাসেই রতীশ রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়েছিল। রবিশঙ্করের ছোট ঘরে থাকবার জায়গা নেই বলে সে একটা হোটেলে উঠেছিল। রবিশঙ্করের সাথে উত্তর কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার ব্যাপারে কথা হল। আর যোগা কোচিং সেন্টার খুলবার জন্যেও একটা কমপ্লেক্স দেখল। কমপ্লেক্সটা তার থাকবার ওই ফ্ল্যাট থেকে খুব বেশী দুরে নয়। কমপ্লেক্সটা দেখে রতীশের বেশ ভাল লেগেছিল। তবে কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালার সাথে কোন কথাবার্তা বলা সম্ভব হয়নি। সে দিন পনেরোর জন্য দিল্লী গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরে এসে সবাইকে সব কথা খুলে বলে রতীশ সকলের কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করল যে সে কলকাতা গিয়ে ওই কমপ্লেক্সেই নিজের যোগা কোচিং সেন্টার খুলতে চায়। তাদের ঘরের লক্ষ্মী রচনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভেবে সকলেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রতীশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেউ আর অমত করেন নি।
তখন থেকেই বাড়ির সকলের সাথে সাথে রচনাও যেন মুষড়ে পড়েছিল। এ বাড়ি ছেড়ে, বাড়ির এই লোকগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে সেও মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করত। কোন কাজ করতে করতে হঠাতই তার মনটা উদাস হয়ে উঠত। বড়রা সকলেই নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারলেও তার ছোট্ট ননদ চন্দ্রিকা কিছুতেই বাড়ির লোকদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিল না। যখন তখন রচনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠত, “ও বৌমণি তুমি বড়দাকে বলে দাও সে একা চলে যাক কলকাতা। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না। তোমাকে না দেখে আমি যে একটা দিনও থাকতে পারব না। পড়শোনাতেও মন বসবে না আমার। আমি পরীক্ষায় ফেল করব। কে আমায় খাইয়ে দেবে? কলেজে যাবার সময় কে আমায় তৈরী করে দেবে। আমি কারো কোন কথা শুনতে চাই না। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না ব্যস”।
রচনা হাজার বুঝিয়েও তাকে শান্ত করতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরে সে নিজেও কেঁদে ফেলত। তখন তার তিন শাশুড়ি মায়ের কেউ একজন জোর করে চন্দ্রিকাকে রচনার হাত থেকে ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। সীমন্তিনী প্রায় রোজই তার সাথে ফোনে কথা বলত। সেও নানাভাবে রচনাকে বোঝাত।
সীমন্তিনী একদিন তার ট্রেনিংএর শেষে চন্দ্রকান্তবাবুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, “ছোটকাকু, দাদাভাই তো কলকাতা যাচ্ছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে নতুন করে একটা যোগা সেন্টার খুলতে গেলে কতটা পয়সাকড়ি লাগতে পারে, সে’সব তোমরা ভেবে দেখেছ? দাদাভাইয়ের হাতে কি অত পয়সা আছে? তাহলে সে কী করে কি শুরু করবে? কলেজের চাকরিতে রিজাইন দেবার আগে এ সব ব্যাপার নিয়ে তোমরা সবাই আলোচনা করে দেখ। আমি তো সবে চাকরিতে ঢুকলাম। আমার হাতে যদি কিছু থাকত আমি তো সেটা দাদাভাইকে দিতে দু’বার ভাবতুম না। আর দাদাভাই কলেজ থেকে যা বেতন পেত তা থেকে আর কতটুকু সেভিংস করতে পেরেছে। তোমরা দাদাভাইকে নিয়ে বসে একটু শলা পরামর্শ করে কতটা কি লাগে, আর তা কোত্থেকে কিভাবে পাবে, সেসব নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা কোর। আর বাড়ির সবাই কে কি বলছে এ ব্যাপারে”।
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “বাড়ির কথা আর বলিসনে মা। সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। কারুর মুখে হাঁসি নেই। শুধু চন্দুটাই যা একটু চেঁচামেচি করছে। আর তারও মুখে একটাই কথা। তার বৌমণি তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। আসলে রচু এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবার পর থেকে ও তো আর তার বৌমণি ছাড়া কিছুটি বোঝে না। আমরা বড়রা তো রতুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারি। দশ এগার বছরের একটা মেয়ে কি আর সেসব বুঝতে পারবে? কিন্তু সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে তো আমাদের বৌমাই। সে না পারছে এ বাড়ির লোকগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে, না পারছে রতীশকে একা চলে যাবার কথা বলতে। বাড়ির সব কটা মানুষকে ও যে কতটা ভালবাসে সে’কথা আমাদের চেয়ে বেশী আর কে জানবে বল? রোজ দুপুরে মেয়েটা তার তিন শাশুড়ির সাথে বসে তাদের সেবা যত্ন করে। কাল তোর ছোটমা বলছিল, কাল বিকেলে তোর মায়ের চুল আঁচড়ে দিতে দিতে ও নাকি হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল। আমরা সবাই তো নিজেদের মনের অনেক প্রশ্ন অনেক কথাই একে ওকে বলে থাকি। কিন্তু ও মেয়েটা যে কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না রে। কার দাবী ও সমর্থন করবে, আর কার বিপক্ষে যাবে”?
সীমন্তিনী বলল, “জানি গো কাকু। ও মেয়েটাই সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে মনে মনে। কিন্তু দেখ কাকু, দাদাভাই যেটা ভাবছে, সেটাকেও তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওদের বিয়ের প্রায় তিন বছর হতে চলল। ঠাকুরের আশীর্বাদে এখন তো ওদের সংসারে যে কোন সময় নতুন অতিথি আসতে পারে। এ কলেজের চাকরি করে বাড়িতে থাকতে কোন বাঁধা না থাকলেও, দাদাভাই চিরদিন বাবা কাকাদের আয়ে নিজের পরিবারের ভরণ পোষন করে যাবে, এটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তাই সে চাইছে নিজের আয় বাড়াতে। আর রাজগঞ্জে কোন যোগা সেন্টার খুলে তো লাভ হবে না। তাই ও চাইছে কোলকাতা গিয়ে কিছু একটা করতে। আমার মনে হয় তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করা আমাদের সকলেরই উচিৎ”।
**************
২০১২ সালের মার্চ মাসে সীমন্তিনীকে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ডুয়ার্সের একটি মহকুমা শহরে পোস্টিং দেওয়া হল এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। নাগরাকাটায় তাকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি করে পাঠানো হল। রাজগঞ্জ থেকে সে জায়গাটা যতটা দুরে, কালচিনি থেকে সে জায়গাটা প্রায় অতটাই দুর। রাজগঞ্জের দুরত্ব সেখান থেকে প্রায় ৭৬ কিমি। আর কালচিনিও সেখান থেকে প্রায় ৭৮ কিমি। তবে ট্রেনে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগে কালচিনি থেকে। এ লাইনে ট্রেন খুব বেশী চলাচল করে না। তবে ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার জলপাইগুড়ি থেকে তার জায়গায় যেতে হলে যে সড়কপথে তাকে যাতায়াত করতে হবে সে রাস্তায় কালচিনি পড়ে না। তার ওখান থেকে ট্রেনে আলিপুরদুয়ার যাবার পথে কালচিনি পড়ে। অফিস থেকে তাকে থাকবার কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে। একটা টিলার ওপর একতলা বাংলো প্যাটার্নের একটা কোয়ার্টার। কোয়ার্টারটাতে সব মিলে মোট ছ’খানা ঘর। দুটো বেডরুম আর গেস্ট রুমের সাথে এটাচড বাথরুম আছে। লিভিং রুম, কিচেন আর একটা স্টোর রুম। পেছনে একটা ছোট্ট ফুলের বাগান, আর একটা ছোট ফাঁকা জায়গা। তার পেছনদিকে ছোটখাটো একটা পার্ক আর পার্কের পেছনে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। কোয়ার্টারের সামনের দিকে এক পাশে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। আর ওয়াচম্যান এবং সিকিরিটির লোকদের থাকবার দুটো আলাদা ঘর। তিনদিকে সবুজ পাহাড় আর একদিকে চা বাগান ঘেরা জায়গাটা সত্যি খুব মনোরম। সীমন্তিনী ভেবেছিল সেখানে কাজে যোগ দেবার আগে সে একবার কালচিনি গিয়ে রচনার মা বাবাকে প্রণাম করে যাবে। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট থেকে তাকে সে পথে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় নি। তাকে বলা হয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টারে আসা যাওয়া করতে হলে তাকে সবচেয়ে কম দুরত্বের রাস্তায় আসা যাওয়া করতে হবে। গত কয়েক বছরে আসাম এবং উত্তরবঙ্গের অনেকগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠণের উগ্রপন্থীরা বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স এলাকা এবং ভূটানের কিছু অঞ্চল জুড়ে তাদের গোপন ঘাঁটি বানিয়ে এসব অঞ্চলে ঘোরা ফেরা করছে। তাই সীমন্তিনীর সাথে সব সময়ই কয়েকজন সিকিউরিটি থাকবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সীমন্তিনী তার উচ্চপদস্থ অফিসারদের কথা অমান্য করে কালচিনি যেতে পারেনি।
হায়দ্রাবাদ ট্রেনিংএ যাবার পর সীমন্তিনী আর কখনও কালচিনি যেতে পারেনি। রচনার ছোটভাই কিংশুক এবার হায়ার সেকেণ্ডারি দেবে। সীমন্তিনী মনে মনে ভেবে রেখেছে কিংশুকের লেখাপড়ার খরচ সে নিজে বহন করবে। এখন তার সামর্থ্য আছে। কিংশুক দু’বছর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে চতুর্থ স্থান পেয়েছিল। তার মত অমন ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে পয়সার অভাবে লেখা পড়া ছেড়ে দেবে, এটা সীমন্তিনী কিছুতেই হতে দেবে না।
অফিসে জয়েন করার দিন সন্ধ্যে বেলায় কোয়ার্টারে ফিরে এসে কালচিনির নাম্বারে ফোন করল। কয়েকবার রিং হতেই কিংশুকের গলা শুনতে পেল, “হ্যা দিদিভাই বল। তুমি কোথায় আছ? জলপাইগুড়িতে”?
সীমন্তিনী বলল, “আজ সকালে নাগরাকাটা এসে পৌঁছেছি রে ভাই। ভেবেছিলুম ওদিক দিয়ে এলে তোমাদের সাথে দেখা করে আসব। কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমাকে অন্য রাস্তায় আসতে হয়েছে। আচ্ছা ভাই, বাড়ির সবাই কেমন আছে রে? সবাই ভাল আছে তো”?
কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই, সবাই ভাল আছে। তবে কেউই আর আগের মত হাসিখুশি নেই। তুমি তো সব খবরই জান দিদিভাই। বড়জামাইবাবুর দুর্ঘটণার পর থেকে মা বাবা দু’জনেই যেন কেমন হয়ে গেছেন। বড়দির শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বাবা অনেকবার চেষ্টা করেছেন তার সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু দেখা করা তো দুর, বাবাকে তারা বসতে পর্যন্ত দেয়নি। জামাইবাবু মারা গেছেন তিন বছর হল। এতটা সময়ের মধ্যে আমার বড়দির কোন খবর পাইনি। এই নিয়ে কিছুদিন পরপরই মা কান্নাকাটি করেন। বাবার শরীরটা আগের থেকে অনেক ভেঙে গেছে। এসব আর কত বলব তোমাকে দিদিভাই। তোমার তো আর কিছু অজানা নেই”।
সীমন্তিনী বলল, “ভাই, মা বাবা আছেন বাড়িতে”?
কিংশুক বলল, “দিদিভাই, বাবা তো একটু বাজারে গেছে, আমি মাকে দিচ্ছি”।
খানিক বাদে বিভাদেবীর গলা শোনা গেল, “হ্যারে মন্তিমা বল। ভাল আছিস তো”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যা মাসি, আমি তো ঠিক আছি। কিন্তু ভাই এ সব কী বলছে? তুমি নাকি রোজ কান্নাকাটি করছ বাড়িতে”?
বিভাদেবী বললেন, “তোকে আমি কী করে বোঝাব রে মা। আমি যে মা। পেটে ধরা মেয়েটাকে কত বছর থেকে চোখের দেখাটুকুও দেখতে পাচ্ছি না। জামাই চলে যাবার পর তোর মেসো কতবার মেয়েটাকে শুধু একটু চোখের দেখা দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওদের বাড়ির লোকেরা মেয়েটাকে দেখতে তো দেয়ই নি, তোর মেসোকে বসতে পর্যন্ত দেয় নি। মেয়েটা কেমন আছে সে খবর টুকুও আমরা জানতে পাচ্ছি না। তুই তো মা আমার ছোট মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস। নইলে ওর কপালেও যে কী হত কে জানে। প্রায় সাত বছর হয়ে গেল। অর্চুকে একটুখানি চোখের দেখাও দেখিনি। একজন মায়ের পক্ষে এটা যে কতটা কষ্টের, সেটা তো আমি তোকে বোঝাতে পারব না রে মা। আমাদের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়েই তো আমাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “মাসি, তুমি এসব ভেবে ভেবে নিজের শরীর খারাপ কোর না গো। ভাইয়ের কথাটা একটু ভাবো। তোমাকে মেসোকে সর্বক্ষণ মন ভারী করে বসে থাকতে দেখলে ওর কি ভাল লাগবে বল? এবার ও বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেবে। ভাল রেজাল্ট করতে হবে ওকে। তোমাদের ও’ভাবে দেখলে ও যে মন দিয়ে পড়াশোনাটাও করতে পারবে না গো, সেটা বোঝ না তোমরা”?
বিভাদেবী সীমন্তিনীর কথা শুনে বললেন, “সবই তো বুঝিরে মা। কিন্তু আমরা যে এতই অপদার্থ বাবা-মা যে ছেলেমেয়ে গুলোর ভবিষ্যৎ গড়ে দেবার মত সাধ্যও আমাদের নেই। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যার রচুর মত খোকাকেও স্কলারশিপ জুটিয়ে দিয়েছেন বলেই বার ক্লাসটা পড়তে পারছে। এরপর কি হবে কে জানে। হয়ত কারো একটা দোকান টোকানে কাজে ঢুকিয়ে দিতে....”।
সীমন্তিনী বিভাদেবীকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “মাসি, এমন আজে বাজে কথা বোলনা তো। রচুর বিয়ের পর আমাকে দুরে চলে যেতে হয়েছিল বলে ওকে আমি গ্র্যাজুয়েট করতে পারিনি। আর সেও আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হয়নি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমি ওকে পড়াতে পারিনি। তখন আমার নিজের কোন আয়ও ছিল না। কিন্তু তোমাদের আশীর্বাদে আজ আমার সে ক্ষমতা আছে। তাই ভাই যা পড়তে চাইবে আমি তাকে সেটা পড়ার সুযোগ দেব। ওর পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমার। আমি তো ওর দিদি। ভাইয়ের জীবনটা ভাল করে গড়ে তোলার এটুকু দায়িত্ব তো আমিও নিতে পারি। তুমি ও’সব নিয়ে ভেব না। ভাইকে আমি সব বুঝিয়ে বলব। আর ওকে সেভাবেই তৈরী করব। আর শোন মাসি। ভাই বলছিল মেসোর শরীরটা নাকি ভাল যাচ্ছে না। আমি কয়েকদিন বাদে একবার কালচিনি যাবার চেষ্টা করব। তখন মেসোর সাথেও কথা বলব”।
বিভাদেবী সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। অনেক কষ্টে বললেন, “তুই আমাদের জন্যে আর কত করবি মা? আমাদের ওপর তোর ঋণের বোঝা যে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে রে। আমি তো তোকে পেটে ধরিনি রে মা। তুই কোন জন্মের ঋণ শোধ করতে চাইছিস, জানি না”।
সীমন্তিনী বলল, “আবার আজেবাজে কথা বলছ তুমি মাসি? শোন, তোমার ছোটমেয়ে আর জামাই তো এবার কলকাতা চলে যাবে শুনছি। মেয়ে দুরে চলে যাচ্ছে বলে তোমরা মন খারাপ কোর না। ওদের ওপর আমি সব সময় নজর রাখব। তোমাকে আমি ওদের বিয়ের আগে যে কথা দিয়েছি, সেটা আমি ভুলিনি। তাই তুমি আর মেসো এ’কথাটা সব সময় মাথায় রেখ। আমি সারা জীবন তোমার ছোটমেয়ে আর জামাইয়ের পাশে থাকব। আর শোন মাসি। আমি পরের সপ্তাহে মেসোর নামে কিছু টাকা পাঠাব। তোমরা সেটা ফিরিয়ে দিও না যেন। তোমার এ মেয়েটা তার নিজের আয় থেকে জীবনে প্রথমবার তার মা বাবাকে কিছু দিতে যাচ্ছে। তোমরা সেটা অস্বীকার করে আমাকে দুঃখ দিও না দয়া করে। আচ্ছা, আজ ছাড়ছি মাসি। পরে আবার কথা বলব। তবে একটা কথা মনে রেখ, তোমাদের যে কোন সমস্যা হোক, সবার আগে আমাকে সেটা জানাবে। নইলে কিন্তু আমি খুব দুঃখ পাব। রাখছি”।
******************
________________________________________________________________________ss_sexy