25-02-2020, 08:59 PM
(Update No. 56 date. 27.7.2018)
বিয়েটা খুব ভালভাবেই সম্পন্ন হল। সীমন্তিনীর ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি ছিল না। রচনার আর রতীশের বিয়ের গাটছড়া সীমন্তিনী নিজের হাতে বেঁধে দিয়েছিল। ১০ই মার্চ সকাল সাড়ে এগারটা নাগাদ বর কনেকে নিয়ে বরযাত্রীরা সবাই রাজগঞ্জ অভিমুখে রওনা হল। রতিকান্তবাবু আর চন্দ্রকান্তবাবু বার বার সীমন্তিনীকে তাদের সাথে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সীমন্তিনী তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছিল। সকলকে বুঝিয়েছিল যে তার দু’একটা দিন কালচিনিতে থেকে বিয়ে বাবদ এর ওর কাছে যা কিছু বাকি বকেয়া আছে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল অবসাদে ভেঙে পড়া রচনার মা বাবাকে সঙ্গ দেওয়া। দুর্গাপূজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের পর খালি পূজো প্যাণ্ডেলের মত নিস্তব্ধ বাড়িতে বিধুবাবু ও বিভাদেবীকে একা ছেড়ে যেতে তার মন সায় দেয়নি।
কিংশুককে রচনার সাথে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাড়িতে শুধু রচনার মা আর বাবা। বড় মেয়ে অর্চনার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বিয়ের নিমন্ত্রন করে, অনেক অনুরোধ আব্দার করেও মেয়ের সাথে দেখা করতে পারেননি বিধুবাবু। অর্চনাকে ছোটবোনের বিয়েতে আসতেও দেয়নি তারা। মায়ের আঁচলে দু’মুঠো চাল ছিটিয়ে দিয়ে রচনা মা বাবার সমস্ত ভরণ পোষণের ঋণ শোধ করবার সাথে সাথে বিভাদেবী মেয়েকে বিদেয় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সীমন্তিনী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছিল। পরের দিনই রচনার বৌভাত। সকলের অনুরোধ রাখতে বিভাদেবী আর বিধুবাবু বৌভাতে যেতে রাজি হয়েছিলেন। তাই সময় নষ্ট না করে সীমন্তিনী ডেকারেটর, ক্যাটারার, আর হোটেলের বকেয়া পেমেন্ট গুলো মিটিয়ে দিয়ে জীবনে প্রথমবার উনোনে রান্না করে রচনার মা বাবাকে খাওয়াল।
পরের দিন বৌভাত খেয়ে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে কালচিনি ফিরে আসতে হবে বলে একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে সীমন্তিনী তাদেরকে সঙ্গে করে নিজেদের বাড়ি এসে পৌঁছলো সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। বিভাদেবী মেয়েকে হাসিখুশী দেখে খুব খুশী হলেন। বিকেলে ফিরে আসবার সময় বিভাদেবী নিজের মেয়েকে আশীর্বাদ করে যতটা আদর করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী আদর করেছিলেন সীমন্তিনীকে। সীমন্তিনী রচনার মোবাইলটা তার কাছ থেকে নিয়ে বিধুবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিল, “মেসো এটা নিয়ে যাও তোমরা। মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলে যে কোন সময় কথা বলতে পারবে”।
বিধুবাবু সীমন্তিনীকে আদর করে বললেন, “আমাদের জন্যে, আমার মেয়েটার জন্যে তুমি যা করলে, তাতে
তোমার কাছে আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব মা গো। প্রতিদান দেবার সামর্থ্য তো নেই আমার। আর হবে বলেও মনে হয় না। তবু কথা দিচ্ছি, তোমার সব কথা রাখবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। তুমি শুধু আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো মা। আমার লক্ষ্মীকে আমি আমার মা দুর্গার হাতে সঁপে গেলাম”।
১১ই মার্চ খুব ধুমধামের সাথে বৌভাত আর রাতের পার্টি সম্পন্ন হল। সকলেই বৌ দেখে খুব খুশী। সকলের মুখে এক কথা, একেবারে রতীশের উপযুক্ত বৌ। বৌভাতের দিন রাতেই রতীশ আর রচনার ফুলশয্যার বিছানা সীমন্তিনী নিজের হাতে সাজিয়ে দিল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে রতীশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বিছানার ওপর বসে থাকা রতীশের দিকে ঈশারা করে রচনাকে বলল, “রচু, ওই যে ঘরে যে ছেলেটা বসে আছে, ওই ছেলেটা দু’দিন আগে পর্যন্ত আমার জীবনের সর্বস্য ছিল। তোদের বিয়ের দিন গাঁটছড়া বেঁধে আমার জীবনের এই অমূল্য সম্পদটাকে আমি তোর হাতে তুলে দিয়েছি। আমার আদরের দাদাভাইকে সারা জীবন পরম যত্নে রাখবি সোনা বোন আমার। যা, ভেতরে যা। ঈশ্বর তোদের মঙ্গল করুন। আমি দুর থেকে এই হরপার্বতীর পাশে থাকব সারা জীবন” বলে রচনার কপালে ভালবাসা ভরা চুমু দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
বাড়ি নিঝুম হয়ে যাবার পরেও সীমন্তিনী ঘুমোতে এল না দেখে সরলাদেবী খুঁজতে খুঁজতে উঠোনে এসে দেখলেন, আবছা অন্ধকারে একটা চেয়ারে সীমন্তিনী আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। কাছে এসে দেখলেন ঘুমিয়ে আছে। তার দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা শুকিয়ে আছে। নিজের সর্বস্য বিলিয়ে দিয়ে কেমন ভিখিরির মত পড়ে রয়েছে মেয়েটা। নিজের হাতে এমন হাসিমুখে নিজের কলজেটা উপড়ে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে তিনি আর আগে কখনো দেখেননি। সরলাদেবী একবার সীমন্তিনীকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মত বদলে আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। এক মিনিট বাদেই একটা মোটা চাদর এনে সীমন্তিনীকে ভাল করে ঢেকে দিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে ঠাকুর, আমার এ মেয়েটাকে তুমি দেখো ঠাকুর। ওর যে নিজের বলতে আর কেউ রইল না। কিচ্ছু রইল না। সব থেকেও মেয়েটা আজ থেকে সর্বহারা হয়ে গেল। তুমি ওকে বিপদে আপদে সব সময় রক্ষা করো ঠাকুর”।
বৌভাতের পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ রচনা ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। রতীশের ঘরের এটাচ বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে ঘর থেকে বেড়িয়েই দেখে উঠোনের প্যাণ্ডেলে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সীমন্তিনী আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। রচনা পায়ে পায়ে তার কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে তার নাম ধরে ডাকতেই সীমন্তিনী চোখ মেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কিরে রচু? এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস কেন রে? রাতে তো অনেক দেরী করে শুতে হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ওঠবার কি দরকার ছিল”?
রচনা তীক্ষ্ণ চোখে সীমন্তিনীর মুখটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই, তোমাদের ঠাকুর ঘরটা কোথায় গো”?
সীমন্তিনী হাত দিয়ে একদিকে ঈশারা করে বলল, “ওই তো, চল আমি খুলে দিচ্ছি” বলে রচনার হাত ধরতে গিয়েই হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “ওহ, তুই তো স্নানও সেরে ফেলেছিস রে! না তোকে এখন ছোঁয়া ঠিক হবে না। আগে ঠাকুর প্রণাম সেরে আয়। আয় আমার সাথে”।
ঠাকুর প্রণাম সেরে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েই রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার দিদিভাই! সারা রাত উঠোনে ওই চেয়ারটায় বসে বসে তুমি কেঁদেছ? কেন গো, বল না দিদিভাই। কী হয়েছে তোমার”?
সীমন্তিনী নিজের চোখ মুছতে মুছতে বিব্রত হয়ে জবাব দিল, “কোথায় না তো? আমার এমন সুখের দিনে আমি কাঁদতে পারি রে বোকা মেয়ে। তুই এক কাজ কর তো বোন। তোদের ঘরের বাথরুম থেকে আমাকে একটু পেস্ট এনে দে না ভাই। হাত মুখটা ধুয়ে নিই” বলে রচনাকে ঠেলতে ঠেলতে রতীশের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রচনাকে ভেতরে ঠেলে দিল।
রচনা ভেতরে ঢুকে যেতেই সে আবার নিজের চোখের কোল দুটো হাতের চেটোয় খানিকটা ঘসে নিল। খানিকক্ষণ বাদেই রচনা পেস্ট নিয়ে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্রাশ কোথায় দিদিভাই”?
সীমন্তিনী মুখে হাঁসি টেনে বলল, “বড়মার বাথরুমে রেখেছি রে ওটা। বড়মার ঘরের দরজা তো এখনও খোলেনি। তাই আপাততঃ আঙুলে মেজে নিচ্ছি”।
রচনা বলল, “দাঁড়াও। আমার কাছে নতুন ব্রাশ আছে। এনে দিচ্ছি তোমাকে” বলে আবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। একটু বাদেই একটা নতুন ব্রাশ এনে নিজেই তাতে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বলতে লাগল, “আমার ফুলশয্যার রাতের শেষে আমার দিদিভাইয়ের চোখে জল দেখব, এমনটা আমি কখনও কল্পনাও করিনি”।
সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে আবার উঠোনে এসে বলল, “তুই এমন আবোল তাবোল ভাবতে শুরু করেছিস কেন বল তো রচু? কিচ্ছু হয়নি রে আমার। রাতে হঠাৎ একটা পোকা চোখে এসে পড়েছিল। চোখটা বেশ জ্বালা করছিল। কিন্তু এত টায়ার্ড ছিলুম যে কখন ঘুম এসে গেছে, টেরই পাই নি। আর তুই যখন বলছিস চোখের জলের দাগ লেগে আছে, তাহলে হয়ত সত্যি সত্যি চোখ দিয়ে জল বেরিয়েছিল। কিন্তু আমি সত্যি কিছু টের পাইনি। আচ্ছা, তুই একটু দাঁড়া। আমি মুখটা ধুয়ে আসি। তারপর চা বানাচ্ছি” বলে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
সীমন্তিনীর বলা কথাগুলো রচনার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু তার দিদিভাই তাকে মিথ্যে কথা বলবে? না না, এটা হতে পারে না। কিছুক্ষন সীমন্তিনীর চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে থেকে সে আবার রতীশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রতীশ বিছানায় নেই। হয়ত বাথরুমে ঢুকেছে। সে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখল বাড়ির রাঁধুনি মমতাদি রান্না ঘরের দরজার তালা খুলছে।
রচনাকে দেখে সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। “ওমা! বৌমণি! তুমি এত সকাল সকাল উঠে পড়েছ”?
রচনা তার কাছে গিয়ে বলল, “বাড়ির লোকেরা কে কখন ওঠে, তা তো আমি জানিনা মমতাদি। মনে মনে ভেবেছিলুম আজ সকালে আমি চা করে সবাইকে দেব”।
মমতা বলল, “ওমা, এ কী কথা বলছ তুমি বৌমণি? ক্ষেপেছ তুমি? এ বাড়ি এসে প্রথম দিনেই বড়মার হাতে আমাকে হেনস্থা করতে চাইছ না কি? না না, তুমি ঘরে গিয়ে বোস, আমি চা বানিয়ে আনছি। বড় দাদাবাবুর হাত মুখ ধোওয়া হয়ে গেছে”?
রচনা জবাব দিল, “উঠেছেন, তবে উনি বুঝি বাথরুম সেরে বেরোননি এখনও”।
মমতা হেসে বলল, “বাথরুম? না না, বড়দাদাবাবু এখন ব্যায়াম করছে নিশ্চয়ই” এমন সময় সীমন্তিনীকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে মমতা বলল, “ও বড়দি, দেখ তোমার বোন কী বলছে? উনি বাড়ির সকলের জন্য চা বানাতে চাইছেন এখন”।
সীমন্তিনী রচনার কাছে এসে বলল, “এখন তোকে চা করতে হবে না রচু। বাড়ির সকলে আজ কে কখন উঠবে বলা মুস্কিল। কাল তো সকলেই রাত করে শুয়েছে। তাই তুই সবাইকে চা বানিয়ে দিতে চাইলে তোকে হয়ত অনেকক্ষণ চা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে। আজ বাবা, কাকু জেঠুরাও তো দোকানে যেতে দেরী করবেন। তাই আজ নয়, ওটা পরে কখনো করিস। মমতাদি তুমি আমাদের চা বানিয়ে দাও। রচু আমার সাথে আয়। আমরা বাইরে গিয়েই কথা বলি”।
রচনা মমতাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মমতাদি, আজ সকালের খাবার কী বানানো হবে গো”?
মমতা জবাব দিল, “সে বড়মা যা বলবেন, তা-ই হবে”।
রচনা বলল, “আচ্ছা মমতাদি ঘরে কি ছোট ছোট আলু আছে”?
মমতা জবাব দিল, “গুড়ো আলু? হ্যা সে তো আছেই। কিন্তু গুড়ো আলু দিয়ে তুমি কি করবে গো”?
রচনা বলল, “আলুর দম বানাব। মামনিকে আমি সামলে নেব। তুমি চা করতে করতে পরিমান মত কিছু আলু সেদ্ধ করতে বসিয়ে দিতে পারবে? না হলে আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি বসিয়ে দিচ্ছি”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা তুই আজই রান্না করবার জন্যে এত উতলা হচ্ছিস কেন বল তো? এখন তো এ বাড়িতেই থাকছিস তুই। যথেষ্ট সুযোগ পাবি রান্না করবার”।
রচনা বলল, “কাল রাতে তোমার দাদাভাই বলছিলেন, আজই নাকি আমাদের কালচিনি যেতে হবে দ্বিরাগমন সারতে। দুপুরের পর পরই যাবেন বলেছেন। আর সেখান থেকে দু’দিন বাদে ফিরে এসে তোমাকে এ বাড়িতে পাব না জানি। মামনি তো বললেন যে তুমি নাকি কালই এখান থেকে চলে যাবে। তাই কিছু একটা বানিয়ে তোমাকে খাওয়াবার সুযোগ দেবে না একটু”?
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, মমতাদি তুমি আলু সেদ্ধ বসিয়ে দাও। তুমি লুচিটা বানিও। আর আলুর দমটা এ পাগলীটাকে বানাতে দিও। নইলে ওর মুখ গোমড়া হয়ে যাবে। আমি বড়মাকে বলে দেব’খন। আর চা বানিয়ে দাও আমাদের”।
রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে বাইরে এল। দু’জনে দু’টো চেয়ারে বসে রচনা হঠাৎ সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি রাতে কোন ঘরে না গিয়ে বাইরে এই চেয়ারটার ওপর বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে কেন গো”?
সীমন্তিনী মনে মনে একটু চমকে উঠে বলল, “আরে আমি কি এখানে ঘুমোব বলে বসেছিলুম না কি? আমি তো শুধু একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে বসেছিলাম। বড়মার ঘরে আমার বিছানা তো রেডিই ছিল। কিন্তু হয়ত টায়ার্ড ছিলুম বলেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। তুই ওটা নিয়ে এত ভাবিসনে তো? ওই তো দাদাভাই এসে গেছে” বলেই একটু গলা তুলে বলল, “মমতাদি, তিনকাপ চা এনো। দাদাভাইও খাবে আমাদের সাথে”।
রতীশ একটা চেয়ারে বসে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যারে মন্তি, আমরা যদি এখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে যাই, তাহলে কালচিনি পৌঁছতে কতক্ষন লাগবে বলে মনে হয় রে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “গাড়ি নিয়ে গেলে তো তিন ঘন্টাও লাগবে না। তোরা এখান থেকে তিনটে নাগাদ রওনা হয়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে না গিয়ে মাদারিহাট হয়ে গেলে রাস্তা আরও শর্ট হবে। আমি তো কাল ওই রাস্তা দিয়েই এসেছি। আলিপুরদুয়ার হয়ে ঘুরে গেলে সময় বেশী লাগে”।
মমতা সকলের হাতে চা দিয়ে যাবার পর রতীশ আবার জিজ্ঞেস করল, “তুই কি আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি? না তার আগেই চলে যাবি”?
সীমন্তিনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “না রে দাদাভাই। আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব হবে না রে। আমাকে কালই চলে যেতে হবে। আইপিএস পরীক্ষার এপ্লিকেশনটা জমা দিতে হবে। মঙ্গলবার জমা দেবার শেষ দিন। আজ শুক্রবার। মাঝের শনিবার আর রবিবার অফিস বন্ধ থাকবে। তাই বুঝতে পারছিস, আমার যাওয়াটা কতটা জরুরী। সোমবারেই এপ্লিকেশনটা জমা করবার চেষ্টা করব। শুনেছি দু’মাস বাদেই নাকি রিটেন টেস্ট। তাই পড়াশোনাও তো শুরু করতে হবে”।
রচনা এ’কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তার মানে তুমি আর এ দু’মাসের মধ্যে বাড়ি আসছ না দিদিভাই”?
সীমন্তিনী ম্লান হেসে বলল, “আমি তো প্রায় ন’ বছর থেকেই বাড়ি ছাড়া হয়ে গেছি রে। তবে তুই ভাবছিস কেন? আমি তো রোজ তোর সাথে ফোনে কথা বলব। ও হ্যা, ভাল কথা দাদাভাই। আমি তো রচুর আগের মোবাইলটা মেসোকে দিয়ে দিয়েছি। নইলে তারা তো ওর সাথে কথা বলতে পারবেন না। তাই আজ না হলেও, কালচিনি থেকে ফিরে এসেই ওকে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিস। আর সে নাম্বারটা আমায় জানিয়ে দিস। আর মনে রাখিস। এখন রচুর সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু তোর। ওকে কখনও কষ্ট দিবি না। মনে রাখিস, রচু কষ্ট পেলে সে ব্যথা কিন্তু ও একা পাবে না। আমিও একই সমান কষ্ট পাব। আর রচু, তুইও একটা কথা মনে রাখিস। এখন থেকে তুই আর দাদাভাইই আমার সব কিছু। তাই সব পরিস্থিতিতে তোরা একে অপরের খেয়াল রাখবি। দাদাভাইকে যত্নে রাখবি। আমার দাদাভাইটা খুব সরল রে। একেবারে প্রায় একটা শিশুর মত। ও খুব সহজেই সকলের কথা মেনে নেয়। নিজের ভালমন্দ বুঝতে চেষ্টা করে না। কিন্তু তুই বেশ বুদ্ধিমতী। তুই ওকে সব সময় উচিৎ পরমর্শ দিবি। আর দাদাভাই, তুইও রচুকে না জানিয়ে কখনও কিছু করবিনা কিন্তু”।
রচনার হাতের আলুর দম খেয়ে সকলেই খুব প্রশংসা করল। বিকেল তিনটের দিকে কিংশুককে সাথে নিয়ে রতীশ আর রচনা কালচিনি রওনা হয়ে গেল। পরদিন সরলাদেবীর অনেক অনুরোধ সত্বেও সীমন্তিনী বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে গেল।
***************
সীমন্তিনীর ভবিষ্যত বানীকে সত্য প্রতিপন্ন করে রচনা ভট্টাচার্যি বাড়ির সকলের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে। বাড়ির বড় ছোট সকলেই যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ রচনাকে ডাকাডাকি করতে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠবার পর সকলকে প্রথম চা করে খাওয়ানো দিয়ে রচনার দিন শুরু হয়। তারপর সুর্য্য, চন্দ্রিকা আর চঞ্চলকে কলেজে পাঠাবার জন্যে তাদের তৈরী করে দেয়।
এরই মধ্যে শ্বশুর রতিকান্ত বাবু বলে ওঠেন “বড়বৌমা, আমাকে বাজারের ব্যাগটা এনে দাও। আর বাজার থেকে কি কি আনতে হবে সে’সব লিস্ট করে দাও”।
বড় খুড়শ্বশুর ডেকে হয়ত বলেন, “বৌমা, আমাকে সকালের খাবারটা খেতে দাও দেখি। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আজ”।
ঠিক তখনই হয়ত সূর্য্য তার ঘরের ভেতরে চেঁচিয়ে উঠবে, “ও বৌমণি, আমার ফিজিক্স কপিটা একটু খুঁজে দাও না গো, পাচ্ছি না”।
আরেকঘর থেকে চিরুনি হাতে চন্দ্রিকা ছুটে এসে বড়বৌদির কাছে এসে বলে ওঠে, “আমার চুলটা একটু
আঁচড়ে দাও না বৌমণি। দেরী হয়ে যাচ্ছে গো আমার”।
একই সময়ে ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু হয়ত বলে ওঠেন, “বড়বৌমা আজ আমি কি পড়ে বেরোব একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও না”।
আর তার ছেলে চঞ্চল কলেজের জুতো হাতে নিয়ে এসে বলবে, “ও বৌমণি, আমার জুতোর ফিতেটা লাগিয়ে দাও না গো। কিছুতেই পারছি না”।
আর তার সর্বভোলা পতিদেবটি তো আছেনই। রোজ কলেজে যাবার আগে সে তার প্রয়োজনীয় কোন কিছুই যেন খুঁজে পায় না। রচনা প্রায় একটা চড়কির মত ছুটোছুটি করে সকলের সব চাহিদা পুরন করে। সূর্য্য, চঞ্চল, চন্দ্রিকা আর রতীশের জন্য দুপুরের খাবার প্যাক করে দিতে হয় এসব ব্যস্ততার মধ্যেই। সকাল সাড়ে ন’টার আগে সে নিজের চায়ের কাপ হাতে তুলে নেবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না।
সরলাদেবী আর সীমাদেবী একা একাই নিজেদের মনে গজগজ করতে থাকেন, “বাড়ির সকলেই যেন ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে গেছে। আরে বাবা এতদিন কি এ সংসার চলেনি? বিয়ের পর থেকে মেয়েটাকে একটা দিনের জন্যেও কেউ সকালের চা টুকু খাবার সময় দেয় না। যতক্ষণ বাড়ি থাকবে ততক্ষন সকলেই যেন বড়বৌমা বৌমণি ছাড়া আর কিচ্ছুটি বোঝে না। বড়বৌমা আমাদের নেহাত নিপাট ভালমানুষ। তাই কারুর কথার কোন প্রতিবাদ করে না। অন্য কোন মেয়ে হলে দেখতে কি করত। ছোটদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। তোমরা বুড়ো ধাড়িরাও একটুও সুস্থ হয়ে বসতে দাও মেয়েটাকে? বলি তোমাদের সংসারে এসে মেয়েটা এমন কী অপরাধ করে বসেছে যে নিত্য তাকে এমনভাবে নাকানি চোবানি খেতে হবে”?
রতিকান্তবাবু স্ত্রীর এ’সব কথা শুনে বেশীর ভাগই কোন জবাব দেন না। কিন্তু একদিন আশেপাশে রচনা না থাকাতে বলে ফেলেছিলেন, “কত ভাগ্য করলে এমন একটা মা লক্ষ্মী কারো সংসারে আসে, তা কি তোমরা বোঝ না? তাই তো যে কোন ছলছুতোয় আমরা শুধু তাকে একটু দেখতে চাই গো। তোমরা তো জানো না গিন্নী। বড়বৌমা যেদিন থেকে আমাদের সংসারে পা রেখেছে সেদিন থেকে আমাদের সবগুলো দোকানেই বিক্রীবাট্টা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে গো। শশী আর চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ওরাও একই কথা বলবে। আগের থেকে রোজ দেড়গুণ দু’গুণ বেশী টাকা আমদানি হচ্ছে আমাদের সকলের দোকানে। দুটো কর্মচারীর সাথে নিজেরা হাত মিলিয়েও আমরা ভিড় সামলাতে পারিনা জানো? এটা যে কী করে সম্ভব হল তা বোঝ? সব হয়েছে একমাত্র আমাদের মালক্ষ্মী বৌমার জন্যে। আমাদের সংসারে যে মা লক্ষ্মী এসেছেন গো। বয়সে ছোট, সম্পর্কে আমাদের পূত্রবধূ। তাই হাত বাড়িয়ে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিতে তো পারিনা। কিন্তু সকাল সন্ধ্যে দু’বেলা যখন দোকানে মা লক্ষ্মীর আসনে প্রণাম করি তখন মনের ভেতর বড়বৌমার ছবিটাই ভেসে ওঠে গো। তাই তো বাড়ি ফিরেই সে জীবন্ত মা লক্ষ্মীকে দেখার জন্যে প্রাণটা ছটফট করে ওঠে”।
______________________________
ss_sexy
বিয়েটা খুব ভালভাবেই সম্পন্ন হল। সীমন্তিনীর ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি ছিল না। রচনার আর রতীশের বিয়ের গাটছড়া সীমন্তিনী নিজের হাতে বেঁধে দিয়েছিল। ১০ই মার্চ সকাল সাড়ে এগারটা নাগাদ বর কনেকে নিয়ে বরযাত্রীরা সবাই রাজগঞ্জ অভিমুখে রওনা হল। রতিকান্তবাবু আর চন্দ্রকান্তবাবু বার বার সীমন্তিনীকে তাদের সাথে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সীমন্তিনী তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছিল। সকলকে বুঝিয়েছিল যে তার দু’একটা দিন কালচিনিতে থেকে বিয়ে বাবদ এর ওর কাছে যা কিছু বাকি বকেয়া আছে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল অবসাদে ভেঙে পড়া রচনার মা বাবাকে সঙ্গ দেওয়া। দুর্গাপূজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের পর খালি পূজো প্যাণ্ডেলের মত নিস্তব্ধ বাড়িতে বিধুবাবু ও বিভাদেবীকে একা ছেড়ে যেতে তার মন সায় দেয়নি।
কিংশুককে রচনার সাথে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাড়িতে শুধু রচনার মা আর বাবা। বড় মেয়ে অর্চনার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বিয়ের নিমন্ত্রন করে, অনেক অনুরোধ আব্দার করেও মেয়ের সাথে দেখা করতে পারেননি বিধুবাবু। অর্চনাকে ছোটবোনের বিয়েতে আসতেও দেয়নি তারা। মায়ের আঁচলে দু’মুঠো চাল ছিটিয়ে দিয়ে রচনা মা বাবার সমস্ত ভরণ পোষণের ঋণ শোধ করবার সাথে সাথে বিভাদেবী মেয়েকে বিদেয় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সীমন্তিনী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছিল। পরের দিনই রচনার বৌভাত। সকলের অনুরোধ রাখতে বিভাদেবী আর বিধুবাবু বৌভাতে যেতে রাজি হয়েছিলেন। তাই সময় নষ্ট না করে সীমন্তিনী ডেকারেটর, ক্যাটারার, আর হোটেলের বকেয়া পেমেন্ট গুলো মিটিয়ে দিয়ে জীবনে প্রথমবার উনোনে রান্না করে রচনার মা বাবাকে খাওয়াল।
পরের দিন বৌভাত খেয়ে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে কালচিনি ফিরে আসতে হবে বলে একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে সীমন্তিনী তাদেরকে সঙ্গে করে নিজেদের বাড়ি এসে পৌঁছলো সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। বিভাদেবী মেয়েকে হাসিখুশী দেখে খুব খুশী হলেন। বিকেলে ফিরে আসবার সময় বিভাদেবী নিজের মেয়েকে আশীর্বাদ করে যতটা আদর করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী আদর করেছিলেন সীমন্তিনীকে। সীমন্তিনী রচনার মোবাইলটা তার কাছ থেকে নিয়ে বিধুবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিল, “মেসো এটা নিয়ে যাও তোমরা। মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলে যে কোন সময় কথা বলতে পারবে”।
বিধুবাবু সীমন্তিনীকে আদর করে বললেন, “আমাদের জন্যে, আমার মেয়েটার জন্যে তুমি যা করলে, তাতে
তোমার কাছে আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব মা গো। প্রতিদান দেবার সামর্থ্য তো নেই আমার। আর হবে বলেও মনে হয় না। তবু কথা দিচ্ছি, তোমার সব কথা রাখবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। তুমি শুধু আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো মা। আমার লক্ষ্মীকে আমি আমার মা দুর্গার হাতে সঁপে গেলাম”।
১১ই মার্চ খুব ধুমধামের সাথে বৌভাত আর রাতের পার্টি সম্পন্ন হল। সকলেই বৌ দেখে খুব খুশী। সকলের মুখে এক কথা, একেবারে রতীশের উপযুক্ত বৌ। বৌভাতের দিন রাতেই রতীশ আর রচনার ফুলশয্যার বিছানা সীমন্তিনী নিজের হাতে সাজিয়ে দিল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে রতীশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বিছানার ওপর বসে থাকা রতীশের দিকে ঈশারা করে রচনাকে বলল, “রচু, ওই যে ঘরে যে ছেলেটা বসে আছে, ওই ছেলেটা দু’দিন আগে পর্যন্ত আমার জীবনের সর্বস্য ছিল। তোদের বিয়ের দিন গাঁটছড়া বেঁধে আমার জীবনের এই অমূল্য সম্পদটাকে আমি তোর হাতে তুলে দিয়েছি। আমার আদরের দাদাভাইকে সারা জীবন পরম যত্নে রাখবি সোনা বোন আমার। যা, ভেতরে যা। ঈশ্বর তোদের মঙ্গল করুন। আমি দুর থেকে এই হরপার্বতীর পাশে থাকব সারা জীবন” বলে রচনার কপালে ভালবাসা ভরা চুমু দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
বাড়ি নিঝুম হয়ে যাবার পরেও সীমন্তিনী ঘুমোতে এল না দেখে সরলাদেবী খুঁজতে খুঁজতে উঠোনে এসে দেখলেন, আবছা অন্ধকারে একটা চেয়ারে সীমন্তিনী আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। কাছে এসে দেখলেন ঘুমিয়ে আছে। তার দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা শুকিয়ে আছে। নিজের সর্বস্য বিলিয়ে দিয়ে কেমন ভিখিরির মত পড়ে রয়েছে মেয়েটা। নিজের হাতে এমন হাসিমুখে নিজের কলজেটা উপড়ে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে তিনি আর আগে কখনো দেখেননি। সরলাদেবী একবার সীমন্তিনীকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মত বদলে আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। এক মিনিট বাদেই একটা মোটা চাদর এনে সীমন্তিনীকে ভাল করে ঢেকে দিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে ঠাকুর, আমার এ মেয়েটাকে তুমি দেখো ঠাকুর। ওর যে নিজের বলতে আর কেউ রইল না। কিচ্ছু রইল না। সব থেকেও মেয়েটা আজ থেকে সর্বহারা হয়ে গেল। তুমি ওকে বিপদে আপদে সব সময় রক্ষা করো ঠাকুর”।
বৌভাতের পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ রচনা ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। রতীশের ঘরের এটাচ বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে ঘর থেকে বেড়িয়েই দেখে উঠোনের প্যাণ্ডেলে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সীমন্তিনী আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। রচনা পায়ে পায়ে তার কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে তার নাম ধরে ডাকতেই সীমন্তিনী চোখ মেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কিরে রচু? এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস কেন রে? রাতে তো অনেক দেরী করে শুতে হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ওঠবার কি দরকার ছিল”?
রচনা তীক্ষ্ণ চোখে সীমন্তিনীর মুখটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই, তোমাদের ঠাকুর ঘরটা কোথায় গো”?
সীমন্তিনী হাত দিয়ে একদিকে ঈশারা করে বলল, “ওই তো, চল আমি খুলে দিচ্ছি” বলে রচনার হাত ধরতে গিয়েই হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “ওহ, তুই তো স্নানও সেরে ফেলেছিস রে! না তোকে এখন ছোঁয়া ঠিক হবে না। আগে ঠাকুর প্রণাম সেরে আয়। আয় আমার সাথে”।
ঠাকুর প্রণাম সেরে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েই রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার দিদিভাই! সারা রাত উঠোনে ওই চেয়ারটায় বসে বসে তুমি কেঁদেছ? কেন গো, বল না দিদিভাই। কী হয়েছে তোমার”?
সীমন্তিনী নিজের চোখ মুছতে মুছতে বিব্রত হয়ে জবাব দিল, “কোথায় না তো? আমার এমন সুখের দিনে আমি কাঁদতে পারি রে বোকা মেয়ে। তুই এক কাজ কর তো বোন। তোদের ঘরের বাথরুম থেকে আমাকে একটু পেস্ট এনে দে না ভাই। হাত মুখটা ধুয়ে নিই” বলে রচনাকে ঠেলতে ঠেলতে রতীশের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রচনাকে ভেতরে ঠেলে দিল।
রচনা ভেতরে ঢুকে যেতেই সে আবার নিজের চোখের কোল দুটো হাতের চেটোয় খানিকটা ঘসে নিল। খানিকক্ষণ বাদেই রচনা পেস্ট নিয়ে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্রাশ কোথায় দিদিভাই”?
সীমন্তিনী মুখে হাঁসি টেনে বলল, “বড়মার বাথরুমে রেখেছি রে ওটা। বড়মার ঘরের দরজা তো এখনও খোলেনি। তাই আপাততঃ আঙুলে মেজে নিচ্ছি”।
রচনা বলল, “দাঁড়াও। আমার কাছে নতুন ব্রাশ আছে। এনে দিচ্ছি তোমাকে” বলে আবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। একটু বাদেই একটা নতুন ব্রাশ এনে নিজেই তাতে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বলতে লাগল, “আমার ফুলশয্যার রাতের শেষে আমার দিদিভাইয়ের চোখে জল দেখব, এমনটা আমি কখনও কল্পনাও করিনি”।
সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে আবার উঠোনে এসে বলল, “তুই এমন আবোল তাবোল ভাবতে শুরু করেছিস কেন বল তো রচু? কিচ্ছু হয়নি রে আমার। রাতে হঠাৎ একটা পোকা চোখে এসে পড়েছিল। চোখটা বেশ জ্বালা করছিল। কিন্তু এত টায়ার্ড ছিলুম যে কখন ঘুম এসে গেছে, টেরই পাই নি। আর তুই যখন বলছিস চোখের জলের দাগ লেগে আছে, তাহলে হয়ত সত্যি সত্যি চোখ দিয়ে জল বেরিয়েছিল। কিন্তু আমি সত্যি কিছু টের পাইনি। আচ্ছা, তুই একটু দাঁড়া। আমি মুখটা ধুয়ে আসি। তারপর চা বানাচ্ছি” বলে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
সীমন্তিনীর বলা কথাগুলো রচনার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু তার দিদিভাই তাকে মিথ্যে কথা বলবে? না না, এটা হতে পারে না। কিছুক্ষন সীমন্তিনীর চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে থেকে সে আবার রতীশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রতীশ বিছানায় নেই। হয়ত বাথরুমে ঢুকেছে। সে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখল বাড়ির রাঁধুনি মমতাদি রান্না ঘরের দরজার তালা খুলছে।
রচনাকে দেখে সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। “ওমা! বৌমণি! তুমি এত সকাল সকাল উঠে পড়েছ”?
রচনা তার কাছে গিয়ে বলল, “বাড়ির লোকেরা কে কখন ওঠে, তা তো আমি জানিনা মমতাদি। মনে মনে ভেবেছিলুম আজ সকালে আমি চা করে সবাইকে দেব”।
মমতা বলল, “ওমা, এ কী কথা বলছ তুমি বৌমণি? ক্ষেপেছ তুমি? এ বাড়ি এসে প্রথম দিনেই বড়মার হাতে আমাকে হেনস্থা করতে চাইছ না কি? না না, তুমি ঘরে গিয়ে বোস, আমি চা বানিয়ে আনছি। বড় দাদাবাবুর হাত মুখ ধোওয়া হয়ে গেছে”?
রচনা জবাব দিল, “উঠেছেন, তবে উনি বুঝি বাথরুম সেরে বেরোননি এখনও”।
মমতা হেসে বলল, “বাথরুম? না না, বড়দাদাবাবু এখন ব্যায়াম করছে নিশ্চয়ই” এমন সময় সীমন্তিনীকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে মমতা বলল, “ও বড়দি, দেখ তোমার বোন কী বলছে? উনি বাড়ির সকলের জন্য চা বানাতে চাইছেন এখন”।
সীমন্তিনী রচনার কাছে এসে বলল, “এখন তোকে চা করতে হবে না রচু। বাড়ির সকলে আজ কে কখন উঠবে বলা মুস্কিল। কাল তো সকলেই রাত করে শুয়েছে। তাই তুই সবাইকে চা বানিয়ে দিতে চাইলে তোকে হয়ত অনেকক্ষণ চা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে। আজ বাবা, কাকু জেঠুরাও তো দোকানে যেতে দেরী করবেন। তাই আজ নয়, ওটা পরে কখনো করিস। মমতাদি তুমি আমাদের চা বানিয়ে দাও। রচু আমার সাথে আয়। আমরা বাইরে গিয়েই কথা বলি”।
রচনা মমতাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মমতাদি, আজ সকালের খাবার কী বানানো হবে গো”?
মমতা জবাব দিল, “সে বড়মা যা বলবেন, তা-ই হবে”।
রচনা বলল, “আচ্ছা মমতাদি ঘরে কি ছোট ছোট আলু আছে”?
মমতা জবাব দিল, “গুড়ো আলু? হ্যা সে তো আছেই। কিন্তু গুড়ো আলু দিয়ে তুমি কি করবে গো”?
রচনা বলল, “আলুর দম বানাব। মামনিকে আমি সামলে নেব। তুমি চা করতে করতে পরিমান মত কিছু আলু সেদ্ধ করতে বসিয়ে দিতে পারবে? না হলে আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি বসিয়ে দিচ্ছি”।
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা তুই আজই রান্না করবার জন্যে এত উতলা হচ্ছিস কেন বল তো? এখন তো এ বাড়িতেই থাকছিস তুই। যথেষ্ট সুযোগ পাবি রান্না করবার”।
রচনা বলল, “কাল রাতে তোমার দাদাভাই বলছিলেন, আজই নাকি আমাদের কালচিনি যেতে হবে দ্বিরাগমন সারতে। দুপুরের পর পরই যাবেন বলেছেন। আর সেখান থেকে দু’দিন বাদে ফিরে এসে তোমাকে এ বাড়িতে পাব না জানি। মামনি তো বললেন যে তুমি নাকি কালই এখান থেকে চলে যাবে। তাই কিছু একটা বানিয়ে তোমাকে খাওয়াবার সুযোগ দেবে না একটু”?
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, মমতাদি তুমি আলু সেদ্ধ বসিয়ে দাও। তুমি লুচিটা বানিও। আর আলুর দমটা এ পাগলীটাকে বানাতে দিও। নইলে ওর মুখ গোমড়া হয়ে যাবে। আমি বড়মাকে বলে দেব’খন। আর চা বানিয়ে দাও আমাদের”।
রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে বাইরে এল। দু’জনে দু’টো চেয়ারে বসে রচনা হঠাৎ সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি রাতে কোন ঘরে না গিয়ে বাইরে এই চেয়ারটার ওপর বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে কেন গো”?
সীমন্তিনী মনে মনে একটু চমকে উঠে বলল, “আরে আমি কি এখানে ঘুমোব বলে বসেছিলুম না কি? আমি তো শুধু একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে বসেছিলাম। বড়মার ঘরে আমার বিছানা তো রেডিই ছিল। কিন্তু হয়ত টায়ার্ড ছিলুম বলেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। তুই ওটা নিয়ে এত ভাবিসনে তো? ওই তো দাদাভাই এসে গেছে” বলেই একটু গলা তুলে বলল, “মমতাদি, তিনকাপ চা এনো। দাদাভাইও খাবে আমাদের সাথে”।
রতীশ একটা চেয়ারে বসে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যারে মন্তি, আমরা যদি এখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে যাই, তাহলে কালচিনি পৌঁছতে কতক্ষন লাগবে বলে মনে হয় রে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “গাড়ি নিয়ে গেলে তো তিন ঘন্টাও লাগবে না। তোরা এখান থেকে তিনটে নাগাদ রওনা হয়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে না গিয়ে মাদারিহাট হয়ে গেলে রাস্তা আরও শর্ট হবে। আমি তো কাল ওই রাস্তা দিয়েই এসেছি। আলিপুরদুয়ার হয়ে ঘুরে গেলে সময় বেশী লাগে”।
মমতা সকলের হাতে চা দিয়ে যাবার পর রতীশ আবার জিজ্ঞেস করল, “তুই কি আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি? না তার আগেই চলে যাবি”?
সীমন্তিনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “না রে দাদাভাই। আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব হবে না রে। আমাকে কালই চলে যেতে হবে। আইপিএস পরীক্ষার এপ্লিকেশনটা জমা দিতে হবে। মঙ্গলবার জমা দেবার শেষ দিন। আজ শুক্রবার। মাঝের শনিবার আর রবিবার অফিস বন্ধ থাকবে। তাই বুঝতে পারছিস, আমার যাওয়াটা কতটা জরুরী। সোমবারেই এপ্লিকেশনটা জমা করবার চেষ্টা করব। শুনেছি দু’মাস বাদেই নাকি রিটেন টেস্ট। তাই পড়াশোনাও তো শুরু করতে হবে”।
রচনা এ’কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তার মানে তুমি আর এ দু’মাসের মধ্যে বাড়ি আসছ না দিদিভাই”?
সীমন্তিনী ম্লান হেসে বলল, “আমি তো প্রায় ন’ বছর থেকেই বাড়ি ছাড়া হয়ে গেছি রে। তবে তুই ভাবছিস কেন? আমি তো রোজ তোর সাথে ফোনে কথা বলব। ও হ্যা, ভাল কথা দাদাভাই। আমি তো রচুর আগের মোবাইলটা মেসোকে দিয়ে দিয়েছি। নইলে তারা তো ওর সাথে কথা বলতে পারবেন না। তাই আজ না হলেও, কালচিনি থেকে ফিরে এসেই ওকে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিস। আর সে নাম্বারটা আমায় জানিয়ে দিস। আর মনে রাখিস। এখন রচুর সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু তোর। ওকে কখনও কষ্ট দিবি না। মনে রাখিস, রচু কষ্ট পেলে সে ব্যথা কিন্তু ও একা পাবে না। আমিও একই সমান কষ্ট পাব। আর রচু, তুইও একটা কথা মনে রাখিস। এখন থেকে তুই আর দাদাভাইই আমার সব কিছু। তাই সব পরিস্থিতিতে তোরা একে অপরের খেয়াল রাখবি। দাদাভাইকে যত্নে রাখবি। আমার দাদাভাইটা খুব সরল রে। একেবারে প্রায় একটা শিশুর মত। ও খুব সহজেই সকলের কথা মেনে নেয়। নিজের ভালমন্দ বুঝতে চেষ্টা করে না। কিন্তু তুই বেশ বুদ্ধিমতী। তুই ওকে সব সময় উচিৎ পরমর্শ দিবি। আর দাদাভাই, তুইও রচুকে না জানিয়ে কখনও কিছু করবিনা কিন্তু”।
রচনার হাতের আলুর দম খেয়ে সকলেই খুব প্রশংসা করল। বিকেল তিনটের দিকে কিংশুককে সাথে নিয়ে রতীশ আর রচনা কালচিনি রওনা হয়ে গেল। পরদিন সরলাদেবীর অনেক অনুরোধ সত্বেও সীমন্তিনী বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে গেল।
***************
সীমন্তিনীর ভবিষ্যত বানীকে সত্য প্রতিপন্ন করে রচনা ভট্টাচার্যি বাড়ির সকলের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে। বাড়ির বড় ছোট সকলেই যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ রচনাকে ডাকাডাকি করতে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠবার পর সকলকে প্রথম চা করে খাওয়ানো দিয়ে রচনার দিন শুরু হয়। তারপর সুর্য্য, চন্দ্রিকা আর চঞ্চলকে কলেজে পাঠাবার জন্যে তাদের তৈরী করে দেয়।
এরই মধ্যে শ্বশুর রতিকান্ত বাবু বলে ওঠেন “বড়বৌমা, আমাকে বাজারের ব্যাগটা এনে দাও। আর বাজার থেকে কি কি আনতে হবে সে’সব লিস্ট করে দাও”।
বড় খুড়শ্বশুর ডেকে হয়ত বলেন, “বৌমা, আমাকে সকালের খাবারটা খেতে দাও দেখি। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আজ”।
ঠিক তখনই হয়ত সূর্য্য তার ঘরের ভেতরে চেঁচিয়ে উঠবে, “ও বৌমণি, আমার ফিজিক্স কপিটা একটু খুঁজে দাও না গো, পাচ্ছি না”।
আরেকঘর থেকে চিরুনি হাতে চন্দ্রিকা ছুটে এসে বড়বৌদির কাছে এসে বলে ওঠে, “আমার চুলটা একটু
আঁচড়ে দাও না বৌমণি। দেরী হয়ে যাচ্ছে গো আমার”।
একই সময়ে ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু হয়ত বলে ওঠেন, “বড়বৌমা আজ আমি কি পড়ে বেরোব একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও না”।
আর তার ছেলে চঞ্চল কলেজের জুতো হাতে নিয়ে এসে বলবে, “ও বৌমণি, আমার জুতোর ফিতেটা লাগিয়ে দাও না গো। কিছুতেই পারছি না”।
আর তার সর্বভোলা পতিদেবটি তো আছেনই। রোজ কলেজে যাবার আগে সে তার প্রয়োজনীয় কোন কিছুই যেন খুঁজে পায় না। রচনা প্রায় একটা চড়কির মত ছুটোছুটি করে সকলের সব চাহিদা পুরন করে। সূর্য্য, চঞ্চল, চন্দ্রিকা আর রতীশের জন্য দুপুরের খাবার প্যাক করে দিতে হয় এসব ব্যস্ততার মধ্যেই। সকাল সাড়ে ন’টার আগে সে নিজের চায়ের কাপ হাতে তুলে নেবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না।
সরলাদেবী আর সীমাদেবী একা একাই নিজেদের মনে গজগজ করতে থাকেন, “বাড়ির সকলেই যেন ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে গেছে। আরে বাবা এতদিন কি এ সংসার চলেনি? বিয়ের পর থেকে মেয়েটাকে একটা দিনের জন্যেও কেউ সকালের চা টুকু খাবার সময় দেয় না। যতক্ষণ বাড়ি থাকবে ততক্ষন সকলেই যেন বড়বৌমা বৌমণি ছাড়া আর কিচ্ছুটি বোঝে না। বড়বৌমা আমাদের নেহাত নিপাট ভালমানুষ। তাই কারুর কথার কোন প্রতিবাদ করে না। অন্য কোন মেয়ে হলে দেখতে কি করত। ছোটদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। তোমরা বুড়ো ধাড়িরাও একটুও সুস্থ হয়ে বসতে দাও মেয়েটাকে? বলি তোমাদের সংসারে এসে মেয়েটা এমন কী অপরাধ করে বসেছে যে নিত্য তাকে এমনভাবে নাকানি চোবানি খেতে হবে”?
রতিকান্তবাবু স্ত্রীর এ’সব কথা শুনে বেশীর ভাগই কোন জবাব দেন না। কিন্তু একদিন আশেপাশে রচনা না থাকাতে বলে ফেলেছিলেন, “কত ভাগ্য করলে এমন একটা মা লক্ষ্মী কারো সংসারে আসে, তা কি তোমরা বোঝ না? তাই তো যে কোন ছলছুতোয় আমরা শুধু তাকে একটু দেখতে চাই গো। তোমরা তো জানো না গিন্নী। বড়বৌমা যেদিন থেকে আমাদের সংসারে পা রেখেছে সেদিন থেকে আমাদের সবগুলো দোকানেই বিক্রীবাট্টা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে গো। শশী আর চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ওরাও একই কথা বলবে। আগের থেকে রোজ দেড়গুণ দু’গুণ বেশী টাকা আমদানি হচ্ছে আমাদের সকলের দোকানে। দুটো কর্মচারীর সাথে নিজেরা হাত মিলিয়েও আমরা ভিড় সামলাতে পারিনা জানো? এটা যে কী করে সম্ভব হল তা বোঝ? সব হয়েছে একমাত্র আমাদের মালক্ষ্মী বৌমার জন্যে। আমাদের সংসারে যে মা লক্ষ্মী এসেছেন গো। বয়সে ছোট, সম্পর্কে আমাদের পূত্রবধূ। তাই হাত বাড়িয়ে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিতে তো পারিনা। কিন্তু সকাল সন্ধ্যে দু’বেলা যখন দোকানে মা লক্ষ্মীর আসনে প্রণাম করি তখন মনের ভেতর বড়বৌমার ছবিটাই ভেসে ওঠে গো। তাই তো বাড়ি ফিরেই সে জীবন্ত মা লক্ষ্মীকে দেখার জন্যে প্রাণটা ছটফট করে ওঠে”।
______________________________
ss_sexy