Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
#32
(Update No. 54 date. 26.7.2018)

খাওয়া শেষ হলে সীমন্তিনী সরলাদেবীকে বলল, “বড়মা আমি দাদাভাইয়ের ঘরে থাকবো। তোমার খাওয়া হলে তুমি সেখানে এস”।

ততক্ষণে বড় ঘরের আলোচনা শেষ হয়ে গেছে। খাবার ঘর থেকে বেরোতেই চন্দ্রাদেবী সীমন্তিনীর কাছে
 
এসে চঞ্চলকে জিজ্ঞেস করলেন। “কিরে তোরা খেয়েছিস”?

চন্দ্রিকা উৎফুল্ল গলায় জবাব দিল, “হ্যা মা। আমরা খেয়ে নিয়েছি। জানো মা? বড়দি আজ আমাকে সেজদাকে আর ছোড়দাকে সব্বাইকে নিজে হাতে করে খাইয়ে দিয়েছে। খুব মজা হয়েছে। এখন বড়দি আমাকে গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দেবে বলেছে”।

চন্দ্রাদেবী চন্দ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “বাহ, এ তো দারুণ খবর। তা পেট ভরে খেয়েছ তো তোমরা সবাই? তাহলে যাও। বড়দির আদর খেতে খেতে আর তার মুখে গল্প শুনতে শুনতে লক্ষী মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড় গিয়ে” বলে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে মা। এই পুচকো গুলো তোকে খুব জ্বালাচ্ছে, তাই না রে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “একটুও জ্বালায়নি ছোটমা। ওরা সবাই লক্ষী ছেলেমেয়ের মত খেয়ে নিয়েছে। তুমি ভেব না। তুমি যাও ওদিকের খাবার ঘরের ঝামেলা সামলাও গিয়ে। আমি ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি”।

সূর্য্য আগেই নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। সীমন্তিনী চঞ্চল আর চন্দ্রিকাকে নিয়ে ছোটমার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দু’জনকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তাদের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রূপকথার গল্প শোনাতে লাগল। অনেকক্ষণ গল্প শুনবার পর একটা সময় তারা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লে সীমন্তিনী দু’জনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে তাদের গায়ের ওপর ভাল করে চাদর বিছিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতেই চন্দ্রকান্তবাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। সীমন্তিনীকে দেখে বললেন, “কিরে মা? বিচ্ছু দুটো ঘুমোল? তুই পারলি ওদের ঘুম পাড়াতে? তোর ছোটমা তো রোজ এ কাজ করতে একেবারে গলদঘর্ম হয়ে ওঠে। আর এ দুটোও সত্যি খুব জ্বালায়
 
রে তোর ছোটমাকে”।
 

সীমন্তিনী চন্দ্রকান্তবাবুর কাছে এসে হেসে বলল, “কই আমার সাথে তো ওরা তেমন কিছু করেনি। খেতেও কোন ঝামেলা করেনি, আর ঘুমোতেও না। তবে দু’দুটো গল্প শুনে তবে ঘুমিয়েছে” বলে একটু হাসল।

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তুই কি এখনই শুতে যাবি মা? নইলে একটু বোস না। এতদিন পর তুই বাড়ি এসেছিস। আমি তো সকাল হতে না হতেই আবার বেরিয়ে যাব। বোস না একটু। দুটো কথা বলি তোর সাথে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “বসতে নয় কাকু, কিছু সময় থাকতে পারি। তবে একটা শর্তে”।

চন্দ্রকান্তবাবু নিজের বিছানায় বসতে বসতে বললেন, “তোর সাথে দুটো কথা বলব, তাতেও শর্তের কথা বলছিস মা? বেশ শুনি, কী শর্ত তোর? সেই ছোট্টবেলার মতো আমার কোলে মাথা পেতে শুবি নাকি”?
 

সীমন্তিনী বিছানায় চন্দ্রকান্তবাবুর পাশে বসে বলল, “হ্যা কাকু, সেটাই চাইছি। একটু সরে বোস তুমি। ইশ কত বছর বাদে তোমার কোলে একটু শোবার সুযোগ পেয়েছি! এ সুযোগ ছাড়া যায়”? বলতে বলতে চন্দ্রকান্তবাবুর কোলে মাথা পেতে শুয়ে পড়ল।
 

চন্দ্রকান্তবাবু সীমন্তিনীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “শুনেছিস মা? বৌভাত আর পার্টি, দুটোই হবে এগার তারিখে। বৌভাতটা ঘরোয়া ভাবে দিনের বেলাতেই সারা হবে। আর পার্টিটা হবে সন্ধ্যের পর থেকে। ভাল হবে না”?
 

সীমন্তিনী চোখ বুজে কাকুর আদর খেতে খেতে বলল, “হু ভালই হবে”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তবে ওদের মধুচন্দ্রিমা নিয়ে কোন মীমাংসা হলনা রে। আসলে সবাই বলল যে রতীশ কবে ছুটি পাবে সেটা না জানতে পারলে তো সে ব্যাপারটা ফাইনাল করা যাবে না। আর এটা তো ওদের দু’জনের পছন্দ অপছন্দের ওপর নির্ভর করে। সতু অবশ্য বলছিল যে ওদের সুইজারল্যাণ্ড পাঠাতে চায়। কিন্তু সেখানে যেতে হলে তো পাসপোর্ট ভিসা, এ’সবের প্রয়োজন হবে। ওদের তো কারুরই পাসপোর্ট নেই। মাসখানেকের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া গেলেও ভিসার বন্দোবস্ত করে ফেলা যাবে বলে ভরসা কম। তুই কি বলিস”?
 

সীমন্তিনী চোখ বুজেই বলল, “এ ব্যাপারে আর আমি কী বলব বল? তবে আমার মনে হয় রচু আর দাদাভাই মিলে ডিসিশনটা নিলেই সবচেয়ে ভাল হবে। কিন্তু কাকু আমি একটা অন্য কথা বলতে চাই তোমাকে। ছোটবেলা থেকে তুমি আমার অনেক ন্যায় অন্যায় আব্দার রেখেছ। আজ আরেকটা আব্দার করব তোমার কাছে, তুমি রাখবে না সেটা”?

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “নিশ্চয়ই রাখব মা। বল কী চাস তুই”?
 

সীমন্তিনী চন্দ্রকান্তবাবুর অন্য হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আমি তো আর এ বাড়িতে থাকছি না। আমার ভবিষ্যৎ জীবনটা নিয়ে অন্যভাবে প্ল্যান করেছি। আমাদের পরিবারটা ভাল। রাজগঞ্জের সকলেই আমাদের পরিবারকে সম্মানের চোখে দেখে। এ বাড়ির সকলেই খুব ভাল। একমাত্র খারাপ শুধু আমিই। আর নতুন করে যে এ পরিবারে আসতে চলেছে, সে-ও সত্যি খুব ভাল। রচু সত্যি খুব ভাল মেয়ে। আমি তো প্রায় বছর খানেক ধরে ওর সাথে, ওর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রেখে আসছি। তাই তোমাদের সকলের চেয়েও আমি ওকে বেশী ভাল করে জেনেছি, চিনেছি। তাই বলছি, রচুকে আমি আমার বৌদি কম বান্ধবী আর ছোট বোন বলে ভেবেই বেশী সুখ পাই। ওর মত একটা মেয়ে যে এ পরিবারে আসছে, এটা আমাদের সকলের পরম সৌভাগ্য কাকু। তাই আমি চাই, এ বাড়ির কেউ যেন গরীব ঘরের মেয়ে বলে ওকে কোন কষ্ট না দেয়। তুমি তো জানই কাকু, দাদাভাইকে আমি কতটা ভালবাসি। রচুকে দেখবার পর থেকে, ওর সাথে মেশবার পর থেকে রচুকেও আমি একই সমান ভালবেসে ফেলেছি। এখন থেকে ওরা দু’জনই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের লোক। আর আমি জানি, রচনার যা মিষ্টি স্বভাব, তাতে ও দু’দিনেই তোমাদের সকলের মন জয় করে নেবে। এ বাড়ির অনেকেই আমাকে ঘৃণা করে, আমার ছায়াও মাড়াতে চায় না তারা। কিন্তু তারাও রচনাকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসতে বাধ্য হবে, এ’কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। আমার মনের কথা শোনবার লোক এ বাড়িতে খুব বেশী নেই। শুধু তুমি আর বড়মা ছাড়া। তাই তোমাদের দু’জনের কাছেই আমি মিনতি করছি কাকু, রচুকে তোমরা কখনও কোন কষ্ট দিও না। ওকে তোমরা ভালবেসে কাছে টেনে নিও। ওকে তোমরা চার আনা ভালবাসলে ও তার চার গুণ ভালবাসা তোমাদের ফিরিয়ে দেবে দেখো”।

চন্দ্রকান্তবাবু সীমন্তিনীর মাথায় আদর করে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “তুই কিচ্ছু ভাবিস না মা। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, এ বাড়িতে কেউ কখনও রচুর অমর্যাদা করবে না। আমিও তো মেয়েটাকে দেখেছি। কি মিষ্টিই না দেখতে মেয়েটা। আর যতটুকু সময় ওকে দেখেছি, তাতে ওকে খুব নম্র আর খুব ভদ্র বলেই মনে হয়েছে আমাদের সবার। তবে এটাও ঠিক, তুই যেভাবে ওর সাথে মেলামেশা করেছিস আমরা তো সেভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পাইনি। তুই নিশ্চয়ই আমাদের চেয়েও ওকে বেশী ভাল চিনতে পেরেছিস। আর রতুও যে তোর কাছে কী, কতখানি সেটাও আমরা বুঝিরে মা। রতুর অমঙ্গল তুই কখনও বরদাস্ত করতে পারবি না জানি। এটাও জানি কেউ রতুর কোন অমঙ্গল করতে চাইলে তুই তার সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবি। রতুকে আমরা যেমন ভালবাসি, রচুকেও ঠিক ততটাই ভালবাসব দেখিস। আর অমন মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ ভাল না বেসে থাকতে পারব আমরা”?
 

এমন সময় চন্দ্রাদেবী ঘরে ঢুকে বললেন, “এক বছর ধরে শুধু মেয়েটার কথাই শুনে যাচ্ছি। চোখের দেখা তো দুর। একটা ছবিও কেউ এনে দেখাল না আমাকে”।
 

সীমন্তিনী চোখ মেলে ছোটমার দিকে চেয়ে বলল, “ওমা সেকি ছোটমা? তুমি এখনও রচুর কোন ছবি দেখ নি? দাঁড়াও, এখনই দেখাচ্ছি তোমাকে” বলে চন্দ্রকান্তবাবুর কোল থেকে মাথা তুলে উঠে রতীশের ঘরের দিকে চলল। রতীশ বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইলটা নিতে নিতে বলল, “দাদাভাই, আর একটু অপেক্ষা কর লক্ষীটি। আমি ছোটমার সাথে একটু কথা বলে আসছি”।

ছোটমার ঘরের দিকে যেতে যেতে রান্নাঘরের বারান্দায় সরলাদেবীকে দেখে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তুমি খেয়েছ বড়মা”?

সরলাদেবী বললেন, “হ্যারে খেয়েছি। তুই কোথায় যাচ্ছিস”?

সীমন্তিনী বলল, “তুমিও এস। একটু ছোটমার ঘরে যাচ্ছি”।
 

সরলাদেবীকে সাথে নিয়ে সীমন্তিনী চন্দ্রকান্তবাবুর ঘরে ঢুকে বলল, “কই ছোটমা এস”।

বিছানায় একপাশে বড়মা আর একপাশে ছোটমাকে নিয়ে বসে সীমন্তিনী মোবাইলে রচনার ছবি বের করে
 
বলল, “এই দেখো ছোটমা। এই হচ্ছে রচু। তোমাদের বাড়ির হবু বড়বৌ”।
 

রচনার পাঁচ ছ’টা ছবি দেখার পর চন্দ্রাদেবী বললেন, “ইশ কি সুন্দর দেখতে রে! ও বড়দি, এ যে সাক্ষাৎ মা লক্ষী গো”!
 

সীমন্তিনী বলল, “না ছোটমা, শুধু মা লক্ষ্মী নয় গো। এ মেয়ে একেবারে যাকে বলে রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী, ঠিক তাই। লেখাপড়ায় দারুন ভাল। মাধ্যমিকে উচ্চ মাধ্যমিকে জেলার ভেতরে ফার্স্ট হয়েছে। ক্লাসে ছোটবেলা থেকে বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছে”।
 

চন্দ্রাদেবীর পেছন থেকে চন্দ্রকান্তবাবু ছবি গুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে মন্তি, মেয়েটা তো দেখতে সত্যিই চমৎকার রে। আর চলাফেরা কথা বলা দেখে শুনে বেশ নম্র আর ভদ্র বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু ঘরকন্নার কাজে বা রান্না বান্নায় কেমন রে”?

সীমন্তিনী বলল, “ঘর গোছানোতে যে খুব ওস্তাদ সে তো প্রথম দিন থেকেই দেখছি। আর মাসি বলেছেন রচু সব রকম ঘরোয়া রান্নাবান্না জানে। অবশ্য তুমি যদি ইটালিয়ান খাবার চাইনীজ খাবার বা কন্টিনেন্টাল ফুডের কথা বল, তাহলে সে’সব কিছু ও জানে না। আর অমন গ্রামাঞ্চলের অমন গরীব ঘরের মেয়ে এসব জানবেই বা কেমন করে? কিন্তু কাকু। তোমাকে কী বলব? যেদিন সতুকে নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম সেদিন রচু ছোলার ডালের রসা বানিয়ে খাইয়েছিল আমাদের। কী দারুণ যে বানিয়েছিল না! কী বলব তোমাকে! সে স্বাদ মনে হয় এখনও আমার মুখে লেগে আছে। সতুকে জিজ্ঞেস করে দেখ”।

চন্দ্রাদেবী বলল, “তাহলেই হল। আমাদের বাড়িতে তো আর ওকে কন্টিনেন্টাল ফুড রান্না করবার প্রয়োজন হবে না। আমরা ডাল ভাত মাছ যা খাই সেটুকু করতে পারলেই হল। তাই না গো বড়দি”?
 

সরলাদেবী বললেন, “একদম ঠিক বলেছিস। এর বেশী আমাদের আর কি চাই”।
 

সীমন্তিনী বলল, “এ ছবিটা দেখ ছোটমা। এটা রচুর ছোট ভাই কিংশুক। আমাদের চঞ্চুর থেকে বছর খানেকের মত বড়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোর। ও-ও রচুর মত ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আর এটুকু বয়সেই কি বুদ্ধি তার! বয়সের তুলনায় অনেক বেশী বোঝদার। আর মাঝে মাঝে এমন এমন সব কথা বলে না! আমি শুনে অবাক হয়ে যাই। ও-ও আমাকে খুব ভালবাসে”।

চন্দ্রাদেবী বললেন, “বাঃ ছেলেটাও তো বেশ দেখতে”।
 

সীমন্তিনী মোবাইল বন্ধ করে বলল, “চলো বড়মা, এবার আমরা যাই। তোমার সাথে কিছু দরকারি কথা সেরে নিই এবার” বলে চন্দ্রকান্তবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কাকু, তুমি আমার মোবাইলটা নিয়ে গিয়ে তোমার মেজদা আর মেজোবৌদিকে রচুর ছবিগুলো দেখাও গিয়ে। তারাও তো রচুর ছবি দেখেননি এখনও”।
 

সরলাদেবীকে নিয়ে রতীশের ঘরে এসে সীমন্তিনী দেখে রতীশ আগের মতই বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে দিতে সামান্য শব্দ হল। সে শব্দে রতীশ চোখ মেলে চেয়ে বলল, “এসেছিস মন্তি? হয়েছে সকলের সাথে কথা বলা”?
 

সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে দাদাভাই। মোটামুটিভাবে হয়েছে কথা। এখন শুধু তোর আর বড়মার সাথে কথা বলা বাকি। উঠে বোস। বড়মাকে বসতে দে”।
 

রতীশ উঠে খাটের একপাশে হেলান দিয়ে বসতে সীমন্তিনী সরলাদেবীকে ধরে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছ বড়মা যে তোমার সাথে কথা বলব বলে তোমাকে এ’ ঘরে টেনে আনলুম কেন। শোনো বড়মা। ছোটবেলা থেকে আমাকে নিয়ে তো এ বাড়িতে কম অশান্তি হয়নি। কিন্তু যা কিছু হয়েছে তাতে বাড়ির সবাই আমাকে ও দাদাভাইকে সমানভাবে দোষী বানিয়েছে। না তোমরা সবাই যা করেছ তা নিয়ে আমি কোন সমালোচনা করছি না। তোমরা যা করেছ, অভিভাবক বা গুরুজন হিসেবে তা একেবারেই অনুচিত কিছু ছিল না। তবে তোমরা যে কথাটা এতদিন জানতে পারনি, আজ আমি সে’ কথাটাই তোমাকে বলব বলে এখানে ডেকে এনেছি তোমাকে। ছোটবেলা থেকে আমার আর দাদাভাইয়ের মধ্যে যা কিছু হয়েছে, তাতে দাদাভাইয়ের কোন দোষই ছিল না। সব কিছুতেই অগ্রণী ভূমিকা ছিল শুধু আমার। দাদাভাই আমাকে কষ্ট দিতে চায়নি বলেই আমার সব কথা চুপচাপ মেনে নিত। কিন্তু তোমরা জানতে যে দাদাভাইও আমার মতই দোষী ছিল। তাই আমাকে ও দাদাভাইকে তোমরা একই ভাবে শাসন করতে চেয়েছিলে। সে’সব দিনের কথাগুলো একটু মনে করে দেখো বড়মা। মা বাবা তোমরা আমাকে অনেক বুঝিয়েও যখন আমাকে সোজা পথে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলে, তখন মা আর বাবা আমাকে মারধোর করতে শুরু করেছিলেন। তাদেরও কোন দোষ ছিল না। অবাধ্য মেয়েকে বাবা মায়েদের তেমনি করেই শাসন করা উচিৎ। আমাকেও তারা তেমনি করেই শাসন করেছেন। নিজের দোষ মুখ বুজে স্বীকার করে নিয়ে তাদের সব অত্যাচার আমি হাসিমুখে সহ্য করে গেছি। হ্যা, মাঝে মাঝে প্রতিবাদও করেছি। চরম অবাধ্য হয়ে তোমাদের সকলের মুখের ওপর অনেক কথা বলেছি। কিন্তু সেটা করেছি শুধু তখনই যখন তোমরা আমার দাদাভাইয়ের নিন্দা করতে, তাকে গালিগালাজ করতে কিংবা তাকে মারতে আসতে। দাদাভাইয়ের তো সত্যি তেমন কোন দোষ ছিল না। ও তো কেবল ওর এই ছোটবোনের চাওয়াগুলো পূরন করেছিল। দোষ যা করার সে তো আমি করেছিলাম। আর আমার দোষের শাস্তি দাদাভাই কেন পাবে? তাই তোমরা সবাই যখন দাদার দোষ আছে ভেবে তাকে শাস্তি দিতে চাইতে, তখন নির্দোষ দাদাভাইকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতেই আমি তোমাদের বিরোধিতা করতুম। তোমরা যা করেছ সেটাও অভিভাবক হিসেবে যেমন ঠিক ছিল, তেমনি আমি মনে করি একজন নির্দোষকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে আমি যা কিছু করেছি, সেটাও সম্পূর্ণ ঠিক ছিল। আমাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে তোমরা যেভাবে আমাদের বুঝিয়েছ, সে’সব বুঝতে পারলেও আমি নিজেকে কিছুতেই দাদাভাইয়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু তোমাদের প্রত্যেকটা কথাই যে অমোঘ সত্য ছিল, সেটাও বুঝেছিলাম আরেকটু বড় হয়ে। কিন্তু ততদিনে আমি এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌছেছিলাম যে ফিরে আসা আর সম্ভব ছিল না। দাদাভাইকে ছেড়ে থাকবার কথা আমি ভাবতেও পারতুম না। কিন্তু একটা সময় বোধ বুদ্ধি আরেকটু বাড়তেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমাদের কথা না মেনে আমি কত বড় ভুল করেছিলাম। তাই তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমার যত কষ্টই হোক না কেন, দাদাভাইয়ের জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আমাকে বন্ধ করতেই হবে। সেই সাথে আমাদের এ বাড়ির সম্মানটাও অক্ষুন্ন রাখতে হবে। শুধু মাত্র নিজের জেদ আর নিজের সুখের জন্য তোমার, জেঠুর, মা বাবার, কাকু ছোটমার সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার আমার নেই। তাই যে পথে ধরে এগিয়েছিলাম সে পথে ফিরে আসতে না পারলেও পথের অন্য একটা বাঁকে এসে গন্তব্যটাকে বদলে ফেলেছিলাম। দাদাভাইয়ের কাছ থেকে দুরে সরে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম তখনই। দাদাভাইকে বাড়ি থেকে হাজার মাইল দুরে পাঠিয়ে দিয়ে আমি নিজেও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে দাদাভাইয়ের সাথে আমার যেন আর কখনও মুখোমুখি দেখা না হয়। সফলও হয়েছি। ছোটবেলা থেকে যাকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসতুম, সেই দাদাভাইকে না দেখে আটটা বছর দিব্যি কাটিয়ে দিতে পেরেছি। দাদাভাইও পেরেছে। কিন্তু দাদাভাইয়ের সাথে আমার নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হত। আজ ন’ বছর বাদে তাকে দেখে আমার মন আর আগের মত চঞ্চল হয়ে উঠছে না। তাই বুঝতে পারছি সেই ছোটবেলার মানসিকতাকে আমি বদলে দিতে পেরেছি”।

একটু থেমে লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে সীমন্তিনী আবার বলল, “বাড়ির আর সবার চেয়ে তুমি আমাকে বেশী চেনো বড়মা। ছোটবেলা থেকেই আমি যে সত্যি কথা বলতে ভয় পাই না, তা তুমি জানো। অপরাধ করে স্বীকার করবার মত সৎ সাহসটুকু আমার যে আছে, তাও তুমি জানো। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলুম, তোমার বড়ছেলেকে সংসারী করে তুলব। আজ সেই সুন্দর মূহুর্তটা আমাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। রচু এ বাড়িতে তোমার ছেলের বৌ হয়ে আসছে। রচুকে প্রথম দিন দেখবার পর থেকে ওকে এতদিনে আমি এতটাই ভালবেসে ফেলেছি যে ওর মনে দুঃখ দেবার কথা আমি ভাবতেও পারব না। আর শুধু রচুকেই নয়, ওর মা, বাবা আর ভাইটাকেও আমি খুব ভাল বেসে ফেলেছি। ওনারাও আমাকে ওনাদের ঘরের মেয়ের মতই ভালবাসেন। তাই আমি চাই না রচু এ বাড়িতে এসে কোনভাবে কষ্ট পাক। তাই তোমার কাছে প্রার্থনা করছি বড়মা, তুমি এ ব্যাপারে একটু নজর রেখ। আমার আর দাদাভাইয়ের ভেতরে ছোটবেলা থেকে যা কিছু হয়েছে, সে সব তোমরা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলে দিও। রচনা যেন ঘুণাক্ষরেও সেসব ঘটণার বিন্দু বিসর্গও জানতে বা বুঝতে না পারে। তাহলে ওর জীবনটা একটা নরক হয়ে উঠবে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, ওদের দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে আমার ছায়া পর্যন্ত পড়বে না। কিন্তু আমি যে কতটা জেদী সে প্রমাণ তোমরা বহুবার পেয়েছ। তাই একটা কথা মনে রেখ। কোনদিন যদি জানতে পারি দাদাভাই আর আমার সম্পর্ক নিয়ে এ বাড়ির কেউ কোন কথা রচুকে বলেছে, তবে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ দিন। কারন রচুর সামনে এসে দাঁড়াবার মত মুখ আর থাকবে না আমার। আমি তোমায় গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি বড়মা, সেদিন আমি আত্মহত্যা করব”।

রতীশ আর সরলাদেবী দু’জনেই সীমন্তিনীর কথা শুনে চমকে উঠল। সরলাদেবী সীমন্তিনীর মুখে হাত চেপে বললেন, “না মা, অমন কথা মুখেও আনিস না তুই। আমি আমি তোকে কথা দিচ্ছি মা, রচু এসব কথা কোনদিন জানতে পারবে না। আমি মেজো আর ছোটোকে সব বুঝিয়ে বলব। তুই কিচ্ছু ভাবিস না”।
 

সীমন্তিনী নিজের মুখের ওপর থেকে বড়মার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আমার এ’ কথাটাই বলে বোঝাবার ছিল বড়মা। আর তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবার আছে আমার। আমি জানি আমার জন্যে তোমরা কিছু গয়নাগাটি বানিয়ে রেখেছ। সে’গুলো তুমি আজ আমাকে দেবে বড়মা”?

সরলাদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “সেগুলো এখন নিয়ে তুই কি করবি মা? ও’গুলো তো তোর বিয়েতে দেব বলে গড়িয়ে রেখেছি আমরা”।
 

সীমন্তিনী শান্ত কন্ঠেই বলল, “জানি গো বড়মা। আর সে’জন্যেই তো সে’গুলো চাইছি আমি আজ। ওই গয়নাগুলো পড়ে যেখানে আমি বসবো বলে ভেবেছিলুম ছোটবেলা থেকে, আজ সেই পিড়িতে আমি আমার রচুসোনাকে বসাতে যাচ্ছি। আমার অর্ধেকটা সত্ত্বাই এখন রচুর ভেতরে ঢুকে গেছে এতদিনে। তাই আমি চাই রচু ওই গয়নাগুলো পড়েই বিয়ের পিড়িতে বসুক। তাতে আমি খুব খুশী হব। তোমরা দু’জনেও আজ থেকে অমনটাই ভেবো। রচুকে যখন তোমরা দেখবে তখন ভেবো, ওর ভেতরে তোমাদের এই অলক্ষ্মী মেয়েটাও আছে। তুমি আর দাদাভাই আমাকে যতটা ভালবেসেছো, রচুকেও ঠিক তেমনি করে ভালবেসো”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে সরলাদেবী আর রতীশ দু’জনেই বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। সীমন্তিনী প্রথমে রতীশের দিকে দেখে তার বড়মাকে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ও’গুলো দেবে বড়মা”?

সরলাদেবী জল ভরা চোখে আরও কিছুক্ষণ সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “তোরা বোস একটু। আমি আসছি” বলে বেরিয়ে গেলেন”।


______________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 25-02-2020, 08:55 PM



Users browsing this thread: 13 Guest(s)