25-02-2020, 08:54 PM
(Update No. 53 date. 26.7.2018)
দুপুরে খেয়ে দেয়ে সীমন্তিনী বড়মার ঘরে পাঁজি নিয়ে বসল। তারপর রচনার ফোনে ফোন করে বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সাথে কথা বলল। সরলাদেবীকে জিজ্ঞেস করে তাদের বিয়ের দিন জেনে নিল। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ির বড় ঘরে বড়রা সবাই এসে জড়ো হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা সবাই যার যার ঘরে পড়াশোনা শুরু করেছে। রতীশ নিজের ঘরে শুয়ে তার আগামী জীবনের কথা ভেবে যাচ্ছে। সতুকে সঙ্গে নিয়ে সীমন্তিনী বড় ঘরে এসে বলল, “জেঠু, তোমরা কি দাদাভাই আর রচুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ? কবে নাগাদ দিতে চাও তোমরা বিয়েটা”?
রতিকান্তবাবু বললেন, “নারে মা। সেভাবে তো কিছু এখনও ভাবিনি আমরা। বিয়েটা তো হবেই, এটা জেনেই আমরা খুশী রয়েছি। আসলে আমরা তো তোর আর রচুর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার অপেক্ষা করছিলাম। তোর পরীক্ষার ফল বেরোবার পর তোর বড়মা বলছিল যে তুই এসে যা করার করবি। তাই তো আমরা সবাই তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম। এখন তুই যা বলবি, আমরা সেভাবেই সব কিছু করব। তুই বল, কবে কী করতে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তবে শোনো। মার্চ মাসে একটা ভাল দিন আছে। ন’ তারিখ। বাংলায় ২৫শে ফাল্গুন। মঙ্গলবার। গোধূলি লগ্ন। ভাই পাঁজিটা বাবার হাতে দে। তোমরা দেখে নাও। যদি কারুর কোন আপত্তি থাকে সেটা আমাকে বল। বাকি কথা পরে বলছি”।
রতিকান্তবাবু দু’ভাইকে সাথে নিয়ে পাঁজি খুলে বসলেন। তিথি, নক্ষত্র, রাশি, লগ্ন, সবদিক দিয়ে বিচার বিবেচনা করে দেখলেন দিনটা ভালই। সব দেখে শুনে রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে, দিনটা সত্যি ভাল। তবে দিন স্থির করার আগে রচুর বাবা মার বিয়ের দিন, মাস আর রচুর জন্মের দিন মাসটাও জেনে নিতে হবে রে মা”।
সীমন্তিনী বলল, “সে’সব কিছু আমি জেনে নিয়েছি জেঠু। আর সবদিক বিচার করেই আমার মনে হয়েছে এ দিনটা সবদিক থেকেই খুব ভাল। রচুর মা বাবাও এ দিনটার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এবার তোমরাও
যদি এ দিনটার পক্ষে মত দাও, তাহলে এই ডেটটাকেই ফাইনাল হিসেবে ধরে পরের কথায় আসি আমি”।
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে মা। দিনটা ভাল। আর কালচিনির তরফ থেকে যখন কোন বাঁধা নেই তাহলে ওই তারিখটাই ফাইনাল হল। তা বিয়েটা হচ্ছে কোথায় রে মা? বিধুবাবুর যা আর্থিক দুরবস্থা, তাতে করে কালচিনিতে বিয়ের আয়োজন করা কি তার পক্ষে সম্ভব হবে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “সে’ কথায় একটু পরে আসছি কাকু। তার আগে শোনো, ওই তারিখেই যদি বিয়েটা হয়, তাহলে হাতে দেড় মাসের মত সময় থাকছে। আর দিনগুলো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। তাই সময় থাকতে থাকতে সব কিছু গোছগাছ করে নিতে হবে। জেঠুর সাথে তোমরা যে যে যেতে চাও, তারা আগামী পরশুই কালচিনি যাবে। সেখানে বিয়ের দিন স্থির করার সাথে সাথে একবারে রচুকে তোমরা ভাবী পুত্রবধূ হিসেবে আশীর্বাদ করে আসবে। সকাল সকাল রওনা না হলে তোমরা একদিনে কাজ সেরে ফিরতে পারবেনা হয়ত। তাই আমার মনে হয় একটা গাড়ি ভাড়া করে গেলেই সবচেয়ে ভাল হবে। আর সঙ্গে আপাততঃ লাখ খানেক টাকা আলাদা করে নিয়ে যেও। রচুর বাবার হাতে টাকাটা দিয়ে বোল, তারা যেন বিয়ের আয়োজন শুরু করে দেন। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেই যাব। তাদের ওখানে কি কি করতে হবে না হবে তা আমি মেসোকে বলে দেব। আর হ্যা, টাকাটা যে তোমরা দিচ্ছ এ’ কথাটা তাদের কাছে প্রকাশ কোর না। তাতে মেসো হয়ত অপমানিত বোধ করতে পারেন। তোমরা বলবে যে টাকাটা আমি পাঠিয়েছি তোমাদের হাত দিয়ে। তারা আমাকে তাদের আরেকটা মেয়ে বলেই ভাবেন। তাই তারা ভাববেন যে তাদের এক মেয়ের বিয়ের জন্য আরেক মেয়ে আর্থিক ব্যয়ভার বহন করছে। এতে খানিকটা মনঃকষ্ট হলেও তারা অপমানিত বোধ করবেন না”।
একটু থেমে সীমন্তিনী সকলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, “এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু বলার আছে”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “দেখ মা, বিধুবাবুর আর্থিক অবস্থা তো আমরা সকলেই জানি। তাই নিজেদের তরফের খরচ খরচা ছাড়াও মেয়ের বাড়ির সব খরচও যে আমাদেরই বহন করতে হবে এ’কথা তো আগে থেকেই আমাদের জানা। কিন্তু এক লাখেই তারা সবটা কুলিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় তোর? আর তাছাড়া যতদুর শুনেছি, তাদের হাতে লোকবল বলতেও প্রায় কিছুই নেই। ছেলেটা তো ছোট। বিধুবাবু একা হাতে সব কিছু সামলাতে পারবেন বলে তোর মনে হয়”?
সীমন্তিনী বলল, “আগে টাকার ব্যাপারটা বলি কাকু। এক লাখেই হয়ত কুলোবে না, সেটা সত্যি। তবে আপাততঃ সেটাই তাদের হাতে দিয়ে এস। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আর সেখানে বিয়ের আয়োজন কী হবে, কে করবে, এসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তবু তোমাদের জানিয়ে রাখছি। তোমরা রচুকে আশীর্বাদ করে ফিরে এলেই আমি কালচিনি চলে যাব। সেখানকার সব কাজের ভার আমি নিজে হাতে তুলে নেব। আশাকরি সব কিছু সামলে নিতে পারব। আমি কালচিনি যাবার পরের দিনই মাসি আর মেসো এসে দাদাভাইকে আশীর্বাদ করে যাবেন। এখন যে তোমাদের একলাখ টাকার কথা বললুম, এটা আসলে সে জন্যেই। তারা কি খালি হাতে পাত্রকে আশীর্বাদ করতে আসবেন নাকি? এদিকের সব আয়োজনে আমি না থাকলেও কোন অসুবিধে হবে না। তোমরা সবাই আছ, সতুও থাকছে। অবশ্য তেমন প্রয়োজন হলে সতুকে দু’একদিনের জন্যে আমি ডেকে নিতেও পারি। তাতেও তোমাদের এদিকের কাজে খুব একটা ব্যাঘাত হবে না। তবে রচুকে আশীর্বাদ করার পর থেকেই আমি মেয়েপক্ষের লোক হয়ে যাব। ও’দিকের সমস্ত আয়োজনের ভার আমার হাতেই থাকবে”।
সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে? তোর দাদাভাইয়ের বিয়ের সময় তুই বাড়ি থাকবি না”?
সীমন্তিনী সোজা জবাব দিল, “না-ই বা রইলাম বাড়িতে বড়মা। তাতে কারুর তো কোন অসুবিধে হবার নয়। আমি তো আট বছর থেকেই বাড়ি ছাড়া। তাতে কার কোন কাজটা আঁটকে আছে বল? কিন্তু সেই কন্যাদায়গ্রস্ত লোকটার পাশে না দাঁড়ালে যে রচু আর দাদাভাইয়ের বিয়েটাই আঁটকে যাবে। হ্যা তোমরা হয়ত বলতে পার, যে রচুকে এখানে তুলে এনে তোমরা দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দেবে। সেটা অসম্ভবও কিছু নয়। কিন্তু বড়মা সেক্ষেত্রেও তো সমস্ত ব্যয়ভার আমাদেরই বহন করতে হবে তাই না? আর কালচিনিতে আয়োজন করতে হলে হয়ত আর কিছুটা বেশী খরচ পড়তে পারে। কিন্তু তুমি তো মা বড়মা। মাসির, মানে রচুর মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখ তো। শুধু গরীব বলেই তিনি নিজের বাড়ি থেকে কনে বিদেয় করতে পারবেন না? এটা কি তুমিই মেনে নিতে পারবে? আর যে মেয়েটা সারা জীবনের জন্যে নিজের মা বাবা ভাই বোনদের ছেড়ে তোমার সংসারে আসতে চলেছে, সে মেয়েটার মনেও কতটা দুঃখ হতে পারে একটু ভাবো তো”।
একটু থেমে একবার সীমাদেবীর মুখের দিকে দেখে সীমন্তিনী আবার বলল, “সবাই তো আর তোমার এ মেয়েটার মত অলক্ষ্মী নয় বড়মা। নিজের বড় মেয়েটাকে কূপাত্রে দান করে মাসি মেসো দু’জনেই যেন অকালেই কেমন বুড়িয়ে গেছে, তা তো তোমরা স্বচক্ষে দেখেছ বড়মা। মেয়েটার দুর্ভোগের কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু তাদের বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি গিয়েও তারা তাদের মেয়েটাকে বিয়ের পর একটা দিনও দেখতে পারেন নি। তার বেয়াই বেয়ানরা দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বার বার। এটা যে ওই বাড়ির লোকগুলোর পক্ষে কতটা দুঃখের ব্যাপার সেটা আশা করি তুমিও বুঝতে পারছ। ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে তাদের বাড়ি ছাড়া হয়ে এখানে বা জলপাইগুড়ি আসতে হোক এটা আমি চাই না। তবে তোমরা যদি মনে কর যে এ বাড়তি খরচাটুকু তোমরা করতে পারবে না, তাহলে তার সমাধানও আমার কাছে আছে। কোনও একটা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তোমরা ছেলের বিয়ে দিতে পারো। খরচ খুব কম হবে। তবে সেক্ষেত্রেও কালচিনির কোন মন্দিরেই সেটা সমাধা করতে হবে। মাসি নিজের ওই ভাঙা বাড়িটা থেকেই তার ছোটমেয়েকে বিদেয় করতে পারবেন”।
সরলাদেবী নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “তুই এমন করে বলছিস কেন রে মা? আমি কি তাই বলেছি নাকি? তোর দাদাভাইয়ের বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব তো আমি তোর কাঁধেই দিয়েছি রে মা। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি যদি কিছু ভুল বলে থাকি আমায় ক্ষমা করিস মা তুই”।
সীমন্তিনী সরলাদেবীকে শান্ত করতে করতে বলল, “না বড়মা, তুমি কিছুই ভুল বল নি। কিন্তু আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম যে দাদাভাইকে সংসারী করে তোমার ঘরে পূত্রবধূ এনে দেবই আমি। আমি তো সেটাই করতে চাইছি। রচুকে যে ভাবেই হোক তোমার ছেলের বৌ করে এ বাড়িতে এনে দেবই আমি। তাই সম্ভাব্য সব রকম পথের কথাই তোমাদের বলছি। তোমরা কোন পথে যেতে চাও সেটা তোমরা বিচার করে দেখ। তুমি বসো এখানে। আর কেঁদো না। ছেলের বিয়ে নিয়ে আলোচনায় বসেছ, এটা কত সুখের কথা। এমন মূহুর্তে ছেলের মা হয়ে চোখের জল ফেলতে আছে”?
রতিকান্তবাবু এবার বললেন, “ঠিক আছে রে মা। ভগবানের আশীর্বাদে এ’টুকু বাড়তি খরচ বহন করবার মত সামর্থ্য তো আমাদের আছেই। তাই তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস না। কিন্তু এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। তুই যে রচুকে আশীর্বাদ করবার দিনই ওর বাবার হাতে এক লাখ টাকা দিয়ে আসতে বলছিস, সে ব্যাপারে বলি। তুই তো বলছিস যে আমরা রচুকে আশীর্বাদ করে আসবার পরের দিনই তুই তাদের ওখানে যাবি। ওই একটা দিনেই তো আর টাকার অত প্রয়োজন হবে না। তাই বলছিলাম কি, রাস্তা ঘাটে এতগুলো ক্যাশ টাকা নিয়ে যাতায়াত করাটা তো খুব নিরাপদ নয়। আমি না হয় কালই তোর ব্যাঙ্ক একাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করে দেব। তুই কালচিনি গিয়ে সেখানে এটিএম থেকে যখন যেমন প্রয়োজন হবে তুলে নিবি। এটা করলে তোর কোন আপত্তি আছে”?
সীমন্তিনী একটু ভেবে নিয়ে বলল, “কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ জেঠু। ঠিক আছে তাহলে তা-ই কোর। তাহলে আশীর্বাদ আর বিয়ের দিন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। বিয়ের পরের ব্যাপারগুলো, মানে বৌভাত, পার্টি বা ওদের মধুচন্দ্রিমা এ’সব ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তোমরা যা ভাল বুঝবে তাই করবে। প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। না জানালেও কোন ব্যাপার নেই। তবে আর দুটো ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। বিয়ের দিন বরযাত্রী সংখ্যা যেন পঞ্চাশ ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রেখ। কারন বরযাত্রীদের সকলের জন্যেই তো সেখানে রাতে থাকবার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেটা হোটেল বা লজ ভাড়া নিয়েই করতে হবে। তাই এর বেশী বরযাত্রী হলে সামলান মুস্কিল হবে হয়ত। তবে এটাও আমি সেখানে না গেলে বুঝতে পারব না। তবে আপাতাতঃ এমনটাই ধরে রাখ তোমরা। ওখানে গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে পরে আমি তোমাদের জানাব। আর অন্য কথাটা হচ্ছে, আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সুকোমল স্যারকে নিয়ে। তাকে আমি আজই আগাম নিমন্ত্রন জানিয়ে এসেছি। সতু জানে। অবশ্য তাকে আমি বৌভাতের দিনের জন্যেই বলেছি। কিন্তু দাদাভাইয়ের তরফ থেকে তাকে বিয়ের দিন বরযাত্রী যাবার জন্যেও তোমরা অনুরোধ কোর। উনি নিজে যেতে না পারলে না যাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রনটা তাকে জানানো উচিৎ”।
রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যা হ্যা, সুকোমল স্যারকে অবশ্যই বলব আমরা। ভদ্রলোক সব সময় আমাদের কাছে তোর ব্যাপারে খবরাখবর নেন। তোকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন। তাকে নিশ্চয়ই বলব। আর বরযাত্রীর ব্যাপারেও তুই যা বললি, তা-ই হবে। বাড়ির বড়ছেলের বিয়ে। সম্ভব হলে তো আরও অনেককেই নিয়ে যেতাম। তবে বৌভাতের দিন চেনা পরিচিত সকলকে ডেকেই না হয় সে সাধ মেটাব। ও’খানে তোর যদি আরও টাকার প্রয়োজন পড়ে তাহলে সময় থাকতেই আমাকে জানিয়ে দিস। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব”।
এবার শশিকান্ত বাবু প্রথমবার মুখ খুললেন। বললেন, “আচ্ছা বৌদি, বিয়ের দিন পড়ছে তাহলে পঁচিশে
ফাল্গুন। ছেলে-বৌ বাড়ি আসছে ২৬ তারিখে। তারপর এদিকে ওইসব কালরাত্রি, বৌভাত, পার্টি আর ওদের হানিমুনের ব্যাপারটা বাকি রইল। সে’সব ব্যাপারেও না হয় আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক একবারেই”।
সরলাদেবী কিছু বলবার আগে রতিকান্তবাবু বললেন, “কথাটা ঠিকই বলেছিস শশী। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে আমরা সকলেই এত ব্যস্ত থাকি যে তিন ভাই মিলে একত্রে বসে ওঠা প্রায় হয়ই না। আজ মন্তির ডাকেই আমরা যখন একত্রিত হয়ে বসেছি, আর হাতেও যখন সময় আছে, তাহলে সে’সব নিয়েও আলোচনা করা যাক”।
সীমন্তিনী সে সভা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, “বেশ তোমরা আর যা যা আলোচনা করতে চাও কর। কিন্তু বড়মা এখন আমার সাথে যাবেন। তার সাথে আমার আলাদা করে কিছু কথা আছে। আমার হাতে সময় কম। আমিও পরশুই চলে যাব। কাল আবার আমাকে দু’বেলা একটু বাইরে বেরোতে হবে। কয়েকজনের সাথে দেখা করবার আছে। তাই বড়মার সাথে ব্যক্তিগত কথাটুকু আমি আজই সেরে নিতে চাই”।
সরলাদেবীও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যা হ্যা চল মা। ওনারা আলোচনা করুন। আমি পরে সে’সব জেনে নেব। চল” বলে সীমন্তিনীর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে যেতে যেতে সীমন্তিনী একবার তার মায়ের মুখের দিকে চাইল। সীমাদেবী একদৃষ্টে তার মেয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।
বড় ঘর থেকে বেরিয়ে রতীশের ঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রাত প্রায় দশটা। বাড়ির খাওয়া দাওয়া হয় রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। তাই সে ভাবল, বড়মার সাথে আলোচনা করবার মত যথেষ্ট সময় এখন হাতে নেই। তাই সে থেমে সরলাদেবীকে বলল, “না গো বড়মা। তোমার সাথে এখন আর কথা বলা যাবে না। দশটা বাজতে চলল। আর আধঘন্টা বাদেই তো সবাইকে খেতে দিতে হবে। শোন না, তুমি না হয় আবার বড় ঘরেই ফিরে গিয়ে তাদের সাথে আলোচনায় বস গিয়ে। আমি ততক্ষণে আমার ভাইবোন গুলোর সাথে একটু কথা বলে নিই। রাতে সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তুমি আমার সাথে একটু বসতে পারবে না”?
সরলাদেবী বললেন, “তা পারব না কেন? অবশ্যই পারব”।
সীমন্তিনী বলল, “তাহলে তা-ই কর। তুমি ওঘরেই যাও” বলে কাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘরে চন্দ্রিকা আর চঞ্চলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সীমন্তিনী নিজের মায়ের ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকল। সামনের রুমেই শশীকান্তবাবু আর সীমাদেবীর বিয়ের সময়কার একটা ছবি আছে, সেটা সে আগে থেকেই জানে। পাশের রুমেই সূর্য্যর পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমন্তিনী ফটোটার কাছে গিয়ে ফটোটাকে হাতে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে চোখ বুঝল। তারপর কপালে ছুঁইয়ে ফটোটাকে আবার ঠিক জায়গায় রেখে
দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিল। তারপর সূর্য্যর ঘরে ঢুকে দরজার কাছ থেকেই ডাকল, “ভাই”।
সূর্য্য চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দিদিকে দেখেই লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “দিদি তুমি”?
সীমন্তিনী দু’হাত বাড়িয়ে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যারে ভাই আমি। কেমন আছিস ভাই তুই? ভাল আছিস তো? টিউশন থেকে কখন ফিরেছিস আমি তো বুঝতেই পারিনি। ইশ কী ভাল লাগছে রে তোকে দেখতে ভাই”।
সূর্য্য অনেকক্ষন দিদির হাতের আদর খেয়ে নিচু হয়ে দিদিকে প্রণাম করে বলল, “কত বছর বাদে আজ তোমাকে দেখতে পাচ্ছি দিদি। মেজদা তো তবু মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। তাকে তো তবু দেখতে পাই। তুমি কেন বাড়ি আস না গো দিদি? আমার মনটা যে মাঝেমধ্যে তোমাকে খুব দেখতে চায় গো। একবার মেজদার সাথে যাবার জন্য কত কান্নাকাটি করেছিলাম। মা যেতে দেন নি। তুমি ভাল আছ তো দিদি”?
সীমন্তিনী ভাইয়ের কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “হ্যারে ভাই, আমি ভাল আছি। তুই মন দিয়ে লেখাপড়া করছিস তো? এবার হায়ার সেকেণ্ডারি দিবি। ভাল রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু। বড়মা বলছিলেন তুই নাকি সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাস, আর ফিরিস রাত ন’টা নাগাদ। খুব কষ্ট হয় না রে ভাই”?
সূর্য্য ম্লান হেসে জবাব দিল, “তা তো একটু হয়ই দিদি। তবে বড়মা আমার জন্য সব সময় বেশী করে টিফিন গিয়ে দেন। দুপুরে কিছুটা খাই। আর বিকেলে একটা টিউশানি শেষ হলে বাকিটুকু খাই। তাই ক্ষিদেয় কোন কষ্ট পেতে হয় না। কিন্তু সকালে একটা আর বিকেলে দুটো টিউশান ক্লাস করে ফিরতে ফিরতে রোজই ন’টা বেজে যায়। তুমি কখন বাড়ি এসেছ দিদি”?
সীমন্তিনী সূর্য্যর হাতটা হাতে ধরে রেখেই জবাব দিল, “আমি তো সাড়ে দশটা নাগাদ এখানে এসেছি। তবে বাড়ি আসবার আগে তোদের কলেজে গিয়েছিলাম। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করে তারপর বাড়ি এসেছি”।
সূর্য্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাদের কলেজে গিয়েছিলে দিদি? তবু আমার সাথে একটু দেখা করনি তখন”?
সীমন্তিনী ভাইকে আদর করে বলল, “রাগ করিস না ভাই। তখন তোদের ক্লাস চলছিল তো। তাই ও সময়ে তোকে ক্লাস থেকে ডেকে পাঠালে তোর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটত না? তবে তখন যদি আমি জানতুম যে তুই রাত ন’টার আগে বাড়ি ফিরবি না, তাহলে তোর ওই ক্লাসটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই অপেক্ষা করতুম রে। কিন্তু আমি তো সেটা জানতুম না। বিকেলে চন্দু চঞ্চু ওরা যখন কলেজ থেকে ফিরল তখন তোকে না দেখে ওদের জিজ্ঞেস করেই জানলুম যে তুই রাত ন’টায় ফিরবি। আর এখন বাবা কাকু জেঠুদের সাথে কথা বলেই তো তোর ঘরে ছুটে এলাম তোকে দেখব বলে”।
সূর্য্য একটু অবাক হয়ে বলল, “বাবা তোমার সাথে বলেছে? সত্যি বলছ তুমি দিদি”?
সীমন্তিনী মিথ্যে বলল, “বা রে, কেন বলবেন না? বাবা, মা কাকু, কাকিমা সবার সাথেই তো আমি কথা বললুম এতক্ষণ”।
সূর্য্য একটু আমতা আমতা করে বলল, “ও, কিন্তু তাহলে তোমার কথা তুলে কিছু বলতে গেলেই বাবা মা আমাকে ধমক দেন কেন, সেটা তো বুঝতে পারছি না”।
সীমন্তিনী ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ও কিছু নয় রে ভাই। আসলে আমি অনেক দিন আগে কী যেন একটা সাংঘাতিক অন্যায় কাজ করে ফেলেছিলুম। আমার ঠিক মনেও নেই। কিন্তু মা বাবা বুঝি সে কথাটা ভুলতে পারেননি এখনও। তাই তোকে অমন করে বলেন। ও নিয়ে তুই ভাবিস না ভাই। তুই ভাল করে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। আর মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করবি। কখনো মা বাবাকে কোন কষ্ট দিস না যেন। আচ্ছা শোন ভাই, আজ রাতে আমি তুই আর চন্দু চঞ্চু একসাথে বসে খাব, হ্যা”?
সূর্য্য বলল, “কতদিন তোমার সাথে একসাথে বসে খাইনি দিদি। আজ নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু মা যদি আবার বকেন”?
সীমন্তিনী বলল, “না বকবেন না। কিচ্ছু বলবেন না। চল আমরা খাবার ঘরে যাই। চন্দু আর চঞ্চুকেও সাথে নিয়ে যাব চল। তুই ওদের ডেকে নিয়ে আয়, আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি, কেমন”?
সীমন্তিনী বড় ঘরের সামনে এসে দেখল, আলোচনা তখনও চলছে। দরজার বাইরে থেকেই সে বড়মাকে ডেকে বলল, “বড়মা, একটু আসতে পারবে তুমি”?
সরলাদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, “কি হয়েছে রে মা? কিছু বলবি”?
সীমন্তিনী সরলাদেবীর হাত ধরে বলল, “সূর্য্যর খুব ক্ষিদে পেয়েছে গো। আর চন্দু চঞ্চু ওরাও বায়না ধরেছে আমার সাথে খাবে বলে। ওদের পড়াও শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটু দেখিয়ে দেবে, কি কি রান্না হয়েছে, আর কোথায় কিভাবে রাখা হয়েছে। তাহলে আমি ওদের খেতে দিয়ে ওদের সাথে নিজেও বসে পড়তাম”।
সরলাদেবী বলল, “মমতা তো রান্নাঘরেই আছে। তুই বাচ্চাদের নিয়ে খাবার ঘরে আয়। আমি বেড়ে দিচ্ছি”।
ছোট তিন ভাই বোনের সাথে নানা রকম খুনসুটি করতে করতে সীমন্তিনী তাদের সাথেই খাবার খেল। তবে রতীশকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে বসেছিল।
______________________________
দুপুরে খেয়ে দেয়ে সীমন্তিনী বড়মার ঘরে পাঁজি নিয়ে বসল। তারপর রচনার ফোনে ফোন করে বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সাথে কথা বলল। সরলাদেবীকে জিজ্ঞেস করে তাদের বিয়ের দিন জেনে নিল। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ির বড় ঘরে বড়রা সবাই এসে জড়ো হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা সবাই যার যার ঘরে পড়াশোনা শুরু করেছে। রতীশ নিজের ঘরে শুয়ে তার আগামী জীবনের কথা ভেবে যাচ্ছে। সতুকে সঙ্গে নিয়ে সীমন্তিনী বড় ঘরে এসে বলল, “জেঠু, তোমরা কি দাদাভাই আর রচুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ? কবে নাগাদ দিতে চাও তোমরা বিয়েটা”?
রতিকান্তবাবু বললেন, “নারে মা। সেভাবে তো কিছু এখনও ভাবিনি আমরা। বিয়েটা তো হবেই, এটা জেনেই আমরা খুশী রয়েছি। আসলে আমরা তো তোর আর রচুর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার অপেক্ষা করছিলাম। তোর পরীক্ষার ফল বেরোবার পর তোর বড়মা বলছিল যে তুই এসে যা করার করবি। তাই তো আমরা সবাই তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম। এখন তুই যা বলবি, আমরা সেভাবেই সব কিছু করব। তুই বল, কবে কী করতে হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তবে শোনো। মার্চ মাসে একটা ভাল দিন আছে। ন’ তারিখ। বাংলায় ২৫শে ফাল্গুন। মঙ্গলবার। গোধূলি লগ্ন। ভাই পাঁজিটা বাবার হাতে দে। তোমরা দেখে নাও। যদি কারুর কোন আপত্তি থাকে সেটা আমাকে বল। বাকি কথা পরে বলছি”।
রতিকান্তবাবু দু’ভাইকে সাথে নিয়ে পাঁজি খুলে বসলেন। তিথি, নক্ষত্র, রাশি, লগ্ন, সবদিক দিয়ে বিচার বিবেচনা করে দেখলেন দিনটা ভালই। সব দেখে শুনে রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে, দিনটা সত্যি ভাল। তবে দিন স্থির করার আগে রচুর বাবা মার বিয়ের দিন, মাস আর রচুর জন্মের দিন মাসটাও জেনে নিতে হবে রে মা”।
সীমন্তিনী বলল, “সে’সব কিছু আমি জেনে নিয়েছি জেঠু। আর সবদিক বিচার করেই আমার মনে হয়েছে এ দিনটা সবদিক থেকেই খুব ভাল। রচুর মা বাবাও এ দিনটার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এবার তোমরাও
যদি এ দিনটার পক্ষে মত দাও, তাহলে এই ডেটটাকেই ফাইনাল হিসেবে ধরে পরের কথায় আসি আমি”।
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে মা। দিনটা ভাল। আর কালচিনির তরফ থেকে যখন কোন বাঁধা নেই তাহলে ওই তারিখটাই ফাইনাল হল। তা বিয়েটা হচ্ছে কোথায় রে মা? বিধুবাবুর যা আর্থিক দুরবস্থা, তাতে করে কালচিনিতে বিয়ের আয়োজন করা কি তার পক্ষে সম্ভব হবে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “সে’ কথায় একটু পরে আসছি কাকু। তার আগে শোনো, ওই তারিখেই যদি বিয়েটা হয়, তাহলে হাতে দেড় মাসের মত সময় থাকছে। আর দিনগুলো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। তাই সময় থাকতে থাকতে সব কিছু গোছগাছ করে নিতে হবে। জেঠুর সাথে তোমরা যে যে যেতে চাও, তারা আগামী পরশুই কালচিনি যাবে। সেখানে বিয়ের দিন স্থির করার সাথে সাথে একবারে রচুকে তোমরা ভাবী পুত্রবধূ হিসেবে আশীর্বাদ করে আসবে। সকাল সকাল রওনা না হলে তোমরা একদিনে কাজ সেরে ফিরতে পারবেনা হয়ত। তাই আমার মনে হয় একটা গাড়ি ভাড়া করে গেলেই সবচেয়ে ভাল হবে। আর সঙ্গে আপাততঃ লাখ খানেক টাকা আলাদা করে নিয়ে যেও। রচুর বাবার হাতে টাকাটা দিয়ে বোল, তারা যেন বিয়ের আয়োজন শুরু করে দেন। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেই যাব। তাদের ওখানে কি কি করতে হবে না হবে তা আমি মেসোকে বলে দেব। আর হ্যা, টাকাটা যে তোমরা দিচ্ছ এ’ কথাটা তাদের কাছে প্রকাশ কোর না। তাতে মেসো হয়ত অপমানিত বোধ করতে পারেন। তোমরা বলবে যে টাকাটা আমি পাঠিয়েছি তোমাদের হাত দিয়ে। তারা আমাকে তাদের আরেকটা মেয়ে বলেই ভাবেন। তাই তারা ভাববেন যে তাদের এক মেয়ের বিয়ের জন্য আরেক মেয়ে আর্থিক ব্যয়ভার বহন করছে। এতে খানিকটা মনঃকষ্ট হলেও তারা অপমানিত বোধ করবেন না”।
একটু থেমে সীমন্তিনী সকলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, “এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু বলার আছে”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “দেখ মা, বিধুবাবুর আর্থিক অবস্থা তো আমরা সকলেই জানি। তাই নিজেদের তরফের খরচ খরচা ছাড়াও মেয়ের বাড়ির সব খরচও যে আমাদেরই বহন করতে হবে এ’কথা তো আগে থেকেই আমাদের জানা। কিন্তু এক লাখেই তারা সবটা কুলিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় তোর? আর তাছাড়া যতদুর শুনেছি, তাদের হাতে লোকবল বলতেও প্রায় কিছুই নেই। ছেলেটা তো ছোট। বিধুবাবু একা হাতে সব কিছু সামলাতে পারবেন বলে তোর মনে হয়”?
সীমন্তিনী বলল, “আগে টাকার ব্যাপারটা বলি কাকু। এক লাখেই হয়ত কুলোবে না, সেটা সত্যি। তবে আপাততঃ সেটাই তাদের হাতে দিয়ে এস। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আর সেখানে বিয়ের আয়োজন কী হবে, কে করবে, এসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তবু তোমাদের জানিয়ে রাখছি। তোমরা রচুকে আশীর্বাদ করে ফিরে এলেই আমি কালচিনি চলে যাব। সেখানকার সব কাজের ভার আমি নিজে হাতে তুলে নেব। আশাকরি সব কিছু সামলে নিতে পারব। আমি কালচিনি যাবার পরের দিনই মাসি আর মেসো এসে দাদাভাইকে আশীর্বাদ করে যাবেন। এখন যে তোমাদের একলাখ টাকার কথা বললুম, এটা আসলে সে জন্যেই। তারা কি খালি হাতে পাত্রকে আশীর্বাদ করতে আসবেন নাকি? এদিকের সব আয়োজনে আমি না থাকলেও কোন অসুবিধে হবে না। তোমরা সবাই আছ, সতুও থাকছে। অবশ্য তেমন প্রয়োজন হলে সতুকে দু’একদিনের জন্যে আমি ডেকে নিতেও পারি। তাতেও তোমাদের এদিকের কাজে খুব একটা ব্যাঘাত হবে না। তবে রচুকে আশীর্বাদ করার পর থেকেই আমি মেয়েপক্ষের লোক হয়ে যাব। ও’দিকের সমস্ত আয়োজনের ভার আমার হাতেই থাকবে”।
সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে? তোর দাদাভাইয়ের বিয়ের সময় তুই বাড়ি থাকবি না”?
সীমন্তিনী সোজা জবাব দিল, “না-ই বা রইলাম বাড়িতে বড়মা। তাতে কারুর তো কোন অসুবিধে হবার নয়। আমি তো আট বছর থেকেই বাড়ি ছাড়া। তাতে কার কোন কাজটা আঁটকে আছে বল? কিন্তু সেই কন্যাদায়গ্রস্ত লোকটার পাশে না দাঁড়ালে যে রচু আর দাদাভাইয়ের বিয়েটাই আঁটকে যাবে। হ্যা তোমরা হয়ত বলতে পার, যে রচুকে এখানে তুলে এনে তোমরা দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দেবে। সেটা অসম্ভবও কিছু নয়। কিন্তু বড়মা সেক্ষেত্রেও তো সমস্ত ব্যয়ভার আমাদেরই বহন করতে হবে তাই না? আর কালচিনিতে আয়োজন করতে হলে হয়ত আর কিছুটা বেশী খরচ পড়তে পারে। কিন্তু তুমি তো মা বড়মা। মাসির, মানে রচুর মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখ তো। শুধু গরীব বলেই তিনি নিজের বাড়ি থেকে কনে বিদেয় করতে পারবেন না? এটা কি তুমিই মেনে নিতে পারবে? আর যে মেয়েটা সারা জীবনের জন্যে নিজের মা বাবা ভাই বোনদের ছেড়ে তোমার সংসারে আসতে চলেছে, সে মেয়েটার মনেও কতটা দুঃখ হতে পারে একটু ভাবো তো”।
একটু থেমে একবার সীমাদেবীর মুখের দিকে দেখে সীমন্তিনী আবার বলল, “সবাই তো আর তোমার এ মেয়েটার মত অলক্ষ্মী নয় বড়মা। নিজের বড় মেয়েটাকে কূপাত্রে দান করে মাসি মেসো দু’জনেই যেন অকালেই কেমন বুড়িয়ে গেছে, তা তো তোমরা স্বচক্ষে দেখেছ বড়মা। মেয়েটার দুর্ভোগের কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু তাদের বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি গিয়েও তারা তাদের মেয়েটাকে বিয়ের পর একটা দিনও দেখতে পারেন নি। তার বেয়াই বেয়ানরা দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বার বার। এটা যে ওই বাড়ির লোকগুলোর পক্ষে কতটা দুঃখের ব্যাপার সেটা আশা করি তুমিও বুঝতে পারছ। ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে তাদের বাড়ি ছাড়া হয়ে এখানে বা জলপাইগুড়ি আসতে হোক এটা আমি চাই না। তবে তোমরা যদি মনে কর যে এ বাড়তি খরচাটুকু তোমরা করতে পারবে না, তাহলে তার সমাধানও আমার কাছে আছে। কোনও একটা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তোমরা ছেলের বিয়ে দিতে পারো। খরচ খুব কম হবে। তবে সেক্ষেত্রেও কালচিনির কোন মন্দিরেই সেটা সমাধা করতে হবে। মাসি নিজের ওই ভাঙা বাড়িটা থেকেই তার ছোটমেয়েকে বিদেয় করতে পারবেন”।
সরলাদেবী নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “তুই এমন করে বলছিস কেন রে মা? আমি কি তাই বলেছি নাকি? তোর দাদাভাইয়ের বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব তো আমি তোর কাঁধেই দিয়েছি রে মা। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি যদি কিছু ভুল বলে থাকি আমায় ক্ষমা করিস মা তুই”।
সীমন্তিনী সরলাদেবীকে শান্ত করতে করতে বলল, “না বড়মা, তুমি কিছুই ভুল বল নি। কিন্তু আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম যে দাদাভাইকে সংসারী করে তোমার ঘরে পূত্রবধূ এনে দেবই আমি। আমি তো সেটাই করতে চাইছি। রচুকে যে ভাবেই হোক তোমার ছেলের বৌ করে এ বাড়িতে এনে দেবই আমি। তাই সম্ভাব্য সব রকম পথের কথাই তোমাদের বলছি। তোমরা কোন পথে যেতে চাও সেটা তোমরা বিচার করে দেখ। তুমি বসো এখানে। আর কেঁদো না। ছেলের বিয়ে নিয়ে আলোচনায় বসেছ, এটা কত সুখের কথা। এমন মূহুর্তে ছেলের মা হয়ে চোখের জল ফেলতে আছে”?
রতিকান্তবাবু এবার বললেন, “ঠিক আছে রে মা। ভগবানের আশীর্বাদে এ’টুকু বাড়তি খরচ বহন করবার মত সামর্থ্য তো আমাদের আছেই। তাই তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস না। কিন্তু এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। তুই যে রচুকে আশীর্বাদ করবার দিনই ওর বাবার হাতে এক লাখ টাকা দিয়ে আসতে বলছিস, সে ব্যাপারে বলি। তুই তো বলছিস যে আমরা রচুকে আশীর্বাদ করে আসবার পরের দিনই তুই তাদের ওখানে যাবি। ওই একটা দিনেই তো আর টাকার অত প্রয়োজন হবে না। তাই বলছিলাম কি, রাস্তা ঘাটে এতগুলো ক্যাশ টাকা নিয়ে যাতায়াত করাটা তো খুব নিরাপদ নয়। আমি না হয় কালই তোর ব্যাঙ্ক একাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করে দেব। তুই কালচিনি গিয়ে সেখানে এটিএম থেকে যখন যেমন প্রয়োজন হবে তুলে নিবি। এটা করলে তোর কোন আপত্তি আছে”?
সীমন্তিনী একটু ভেবে নিয়ে বলল, “কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ জেঠু। ঠিক আছে তাহলে তা-ই কোর। তাহলে আশীর্বাদ আর বিয়ের দিন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। বিয়ের পরের ব্যাপারগুলো, মানে বৌভাত, পার্টি বা ওদের মধুচন্দ্রিমা এ’সব ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তোমরা যা ভাল বুঝবে তাই করবে। প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। না জানালেও কোন ব্যাপার নেই। তবে আর দুটো ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। বিয়ের দিন বরযাত্রী সংখ্যা যেন পঞ্চাশ ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রেখ। কারন বরযাত্রীদের সকলের জন্যেই তো সেখানে রাতে থাকবার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেটা হোটেল বা লজ ভাড়া নিয়েই করতে হবে। তাই এর বেশী বরযাত্রী হলে সামলান মুস্কিল হবে হয়ত। তবে এটাও আমি সেখানে না গেলে বুঝতে পারব না। তবে আপাতাতঃ এমনটাই ধরে রাখ তোমরা। ওখানে গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে পরে আমি তোমাদের জানাব। আর অন্য কথাটা হচ্ছে, আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সুকোমল স্যারকে নিয়ে। তাকে আমি আজই আগাম নিমন্ত্রন জানিয়ে এসেছি। সতু জানে। অবশ্য তাকে আমি বৌভাতের দিনের জন্যেই বলেছি। কিন্তু দাদাভাইয়ের তরফ থেকে তাকে বিয়ের দিন বরযাত্রী যাবার জন্যেও তোমরা অনুরোধ কোর। উনি নিজে যেতে না পারলে না যাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রনটা তাকে জানানো উচিৎ”।
রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যা হ্যা, সুকোমল স্যারকে অবশ্যই বলব আমরা। ভদ্রলোক সব সময় আমাদের কাছে তোর ব্যাপারে খবরাখবর নেন। তোকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন। তাকে নিশ্চয়ই বলব। আর বরযাত্রীর ব্যাপারেও তুই যা বললি, তা-ই হবে। বাড়ির বড়ছেলের বিয়ে। সম্ভব হলে তো আরও অনেককেই নিয়ে যেতাম। তবে বৌভাতের দিন চেনা পরিচিত সকলকে ডেকেই না হয় সে সাধ মেটাব। ও’খানে তোর যদি আরও টাকার প্রয়োজন পড়ে তাহলে সময় থাকতেই আমাকে জানিয়ে দিস। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব”।
এবার শশিকান্ত বাবু প্রথমবার মুখ খুললেন। বললেন, “আচ্ছা বৌদি, বিয়ের দিন পড়ছে তাহলে পঁচিশে
ফাল্গুন। ছেলে-বৌ বাড়ি আসছে ২৬ তারিখে। তারপর এদিকে ওইসব কালরাত্রি, বৌভাত, পার্টি আর ওদের হানিমুনের ব্যাপারটা বাকি রইল। সে’সব ব্যাপারেও না হয় আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক একবারেই”।
সরলাদেবী কিছু বলবার আগে রতিকান্তবাবু বললেন, “কথাটা ঠিকই বলেছিস শশী। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে আমরা সকলেই এত ব্যস্ত থাকি যে তিন ভাই মিলে একত্রে বসে ওঠা প্রায় হয়ই না। আজ মন্তির ডাকেই আমরা যখন একত্রিত হয়ে বসেছি, আর হাতেও যখন সময় আছে, তাহলে সে’সব নিয়েও আলোচনা করা যাক”।
সীমন্তিনী সে সভা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, “বেশ তোমরা আর যা যা আলোচনা করতে চাও কর। কিন্তু বড়মা এখন আমার সাথে যাবেন। তার সাথে আমার আলাদা করে কিছু কথা আছে। আমার হাতে সময় কম। আমিও পরশুই চলে যাব। কাল আবার আমাকে দু’বেলা একটু বাইরে বেরোতে হবে। কয়েকজনের সাথে দেখা করবার আছে। তাই বড়মার সাথে ব্যক্তিগত কথাটুকু আমি আজই সেরে নিতে চাই”।
সরলাদেবীও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যা হ্যা চল মা। ওনারা আলোচনা করুন। আমি পরে সে’সব জেনে নেব। চল” বলে সীমন্তিনীর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে যেতে যেতে সীমন্তিনী একবার তার মায়ের মুখের দিকে চাইল। সীমাদেবী একদৃষ্টে তার মেয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।
বড় ঘর থেকে বেরিয়ে রতীশের ঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রাত প্রায় দশটা। বাড়ির খাওয়া দাওয়া হয় রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। তাই সে ভাবল, বড়মার সাথে আলোচনা করবার মত যথেষ্ট সময় এখন হাতে নেই। তাই সে থেমে সরলাদেবীকে বলল, “না গো বড়মা। তোমার সাথে এখন আর কথা বলা যাবে না। দশটা বাজতে চলল। আর আধঘন্টা বাদেই তো সবাইকে খেতে দিতে হবে। শোন না, তুমি না হয় আবার বড় ঘরেই ফিরে গিয়ে তাদের সাথে আলোচনায় বস গিয়ে। আমি ততক্ষণে আমার ভাইবোন গুলোর সাথে একটু কথা বলে নিই। রাতে সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তুমি আমার সাথে একটু বসতে পারবে না”?
সরলাদেবী বললেন, “তা পারব না কেন? অবশ্যই পারব”।
সীমন্তিনী বলল, “তাহলে তা-ই কর। তুমি ওঘরেই যাও” বলে কাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘরে চন্দ্রিকা আর চঞ্চলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সীমন্তিনী নিজের মায়ের ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকল। সামনের রুমেই শশীকান্তবাবু আর সীমাদেবীর বিয়ের সময়কার একটা ছবি আছে, সেটা সে আগে থেকেই জানে। পাশের রুমেই সূর্য্যর পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমন্তিনী ফটোটার কাছে গিয়ে ফটোটাকে হাতে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে চোখ বুঝল। তারপর কপালে ছুঁইয়ে ফটোটাকে আবার ঠিক জায়গায় রেখে
দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিল। তারপর সূর্য্যর ঘরে ঢুকে দরজার কাছ থেকেই ডাকল, “ভাই”।
সূর্য্য চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দিদিকে দেখেই লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “দিদি তুমি”?
সীমন্তিনী দু’হাত বাড়িয়ে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যারে ভাই আমি। কেমন আছিস ভাই তুই? ভাল আছিস তো? টিউশন থেকে কখন ফিরেছিস আমি তো বুঝতেই পারিনি। ইশ কী ভাল লাগছে রে তোকে দেখতে ভাই”।
সূর্য্য অনেকক্ষন দিদির হাতের আদর খেয়ে নিচু হয়ে দিদিকে প্রণাম করে বলল, “কত বছর বাদে আজ তোমাকে দেখতে পাচ্ছি দিদি। মেজদা তো তবু মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। তাকে তো তবু দেখতে পাই। তুমি কেন বাড়ি আস না গো দিদি? আমার মনটা যে মাঝেমধ্যে তোমাকে খুব দেখতে চায় গো। একবার মেজদার সাথে যাবার জন্য কত কান্নাকাটি করেছিলাম। মা যেতে দেন নি। তুমি ভাল আছ তো দিদি”?
সীমন্তিনী ভাইয়ের কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “হ্যারে ভাই, আমি ভাল আছি। তুই মন দিয়ে লেখাপড়া করছিস তো? এবার হায়ার সেকেণ্ডারি দিবি। ভাল রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু। বড়মা বলছিলেন তুই নাকি সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাস, আর ফিরিস রাত ন’টা নাগাদ। খুব কষ্ট হয় না রে ভাই”?
সূর্য্য ম্লান হেসে জবাব দিল, “তা তো একটু হয়ই দিদি। তবে বড়মা আমার জন্য সব সময় বেশী করে টিফিন গিয়ে দেন। দুপুরে কিছুটা খাই। আর বিকেলে একটা টিউশানি শেষ হলে বাকিটুকু খাই। তাই ক্ষিদেয় কোন কষ্ট পেতে হয় না। কিন্তু সকালে একটা আর বিকেলে দুটো টিউশান ক্লাস করে ফিরতে ফিরতে রোজই ন’টা বেজে যায়। তুমি কখন বাড়ি এসেছ দিদি”?
সীমন্তিনী সূর্য্যর হাতটা হাতে ধরে রেখেই জবাব দিল, “আমি তো সাড়ে দশটা নাগাদ এখানে এসেছি। তবে বাড়ি আসবার আগে তোদের কলেজে গিয়েছিলাম। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করে তারপর বাড়ি এসেছি”।
সূর্য্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাদের কলেজে গিয়েছিলে দিদি? তবু আমার সাথে একটু দেখা করনি তখন”?
সীমন্তিনী ভাইকে আদর করে বলল, “রাগ করিস না ভাই। তখন তোদের ক্লাস চলছিল তো। তাই ও সময়ে তোকে ক্লাস থেকে ডেকে পাঠালে তোর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটত না? তবে তখন যদি আমি জানতুম যে তুই রাত ন’টার আগে বাড়ি ফিরবি না, তাহলে তোর ওই ক্লাসটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই অপেক্ষা করতুম রে। কিন্তু আমি তো সেটা জানতুম না। বিকেলে চন্দু চঞ্চু ওরা যখন কলেজ থেকে ফিরল তখন তোকে না দেখে ওদের জিজ্ঞেস করেই জানলুম যে তুই রাত ন’টায় ফিরবি। আর এখন বাবা কাকু জেঠুদের সাথে কথা বলেই তো তোর ঘরে ছুটে এলাম তোকে দেখব বলে”।
সূর্য্য একটু অবাক হয়ে বলল, “বাবা তোমার সাথে বলেছে? সত্যি বলছ তুমি দিদি”?
সীমন্তিনী মিথ্যে বলল, “বা রে, কেন বলবেন না? বাবা, মা কাকু, কাকিমা সবার সাথেই তো আমি কথা বললুম এতক্ষণ”।
সূর্য্য একটু আমতা আমতা করে বলল, “ও, কিন্তু তাহলে তোমার কথা তুলে কিছু বলতে গেলেই বাবা মা আমাকে ধমক দেন কেন, সেটা তো বুঝতে পারছি না”।
সীমন্তিনী ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ও কিছু নয় রে ভাই। আসলে আমি অনেক দিন আগে কী যেন একটা সাংঘাতিক অন্যায় কাজ করে ফেলেছিলুম। আমার ঠিক মনেও নেই। কিন্তু মা বাবা বুঝি সে কথাটা ভুলতে পারেননি এখনও। তাই তোকে অমন করে বলেন। ও নিয়ে তুই ভাবিস না ভাই। তুই ভাল করে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। আর মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করবি। কখনো মা বাবাকে কোন কষ্ট দিস না যেন। আচ্ছা শোন ভাই, আজ রাতে আমি তুই আর চন্দু চঞ্চু একসাথে বসে খাব, হ্যা”?
সূর্য্য বলল, “কতদিন তোমার সাথে একসাথে বসে খাইনি দিদি। আজ নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু মা যদি আবার বকেন”?
সীমন্তিনী বলল, “না বকবেন না। কিচ্ছু বলবেন না। চল আমরা খাবার ঘরে যাই। চন্দু আর চঞ্চুকেও সাথে নিয়ে যাব চল। তুই ওদের ডেকে নিয়ে আয়, আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি, কেমন”?
সীমন্তিনী বড় ঘরের সামনে এসে দেখল, আলোচনা তখনও চলছে। দরজার বাইরে থেকেই সে বড়মাকে ডেকে বলল, “বড়মা, একটু আসতে পারবে তুমি”?
সরলাদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, “কি হয়েছে রে মা? কিছু বলবি”?
সীমন্তিনী সরলাদেবীর হাত ধরে বলল, “সূর্য্যর খুব ক্ষিদে পেয়েছে গো। আর চন্দু চঞ্চু ওরাও বায়না ধরেছে আমার সাথে খাবে বলে। ওদের পড়াও শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটু দেখিয়ে দেবে, কি কি রান্না হয়েছে, আর কোথায় কিভাবে রাখা হয়েছে। তাহলে আমি ওদের খেতে দিয়ে ওদের সাথে নিজেও বসে পড়তাম”।
সরলাদেবী বলল, “মমতা তো রান্নাঘরেই আছে। তুই বাচ্চাদের নিয়ে খাবার ঘরে আয়। আমি বেড়ে দিচ্ছি”।
ছোট তিন ভাই বোনের সাথে নানা রকম খুনসুটি করতে করতে সীমন্তিনী তাদের সাথেই খাবার খেল। তবে রতীশকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে বসেছিল।
______________________________