25-02-2020, 08:48 PM
(Update No. 51)
সতীশ চোখ বড় বড় করে রচনার কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ হতেই সে লাফ মেরে নিচে নেমে রচনার পায়ের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বলল, “তুমি তো দেখছি একটা ঝানু গোয়েন্দা গো বৌদিভাই। একটু তোমার পায়ের ধুলো নিতে দাও”।
রচনা ছুটে বিছানার উল্টোদিকে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ও মাগো, ও দিদিভাই তোমার ভাইকে থামাও। মেজদাভাই প্লীজ”।
সীমন্তিনী সতীশকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল। “ভাই, থাক। মেয়েটাকে আর বিরক্ত করিস না”।
বিভাদেবীও এসব দেখে হাসতে শুরু করেছিলেন। তিনিও সতীশকে বললেন, “হ্যা বাবা, তুমি ওকে আর লজ্জা দিও না। সম্পর্কে ওর দেওর হলেও তুমি তো ওর চেয়ে বয়সে বড়। তাই ও তোমার প্রণাম নিতে কখনই রাজি হবে না। তুমিও ওকে বৌদির চেয়ে নিজের বোনের মত ভালবাসলেই আমরা সবাই খুশী হব”।
সতীশ আবার বিছানায় বসে বলল, “মাসিমা, সে’কথা আর আপনাকে বলে দিতে হবে? ওকে তো নিজের বোন বলে ভাবতেই আমার বেশী ভাল লাগবে। তাই তো বৌদি শব্দটার সাথে বোন কথাটাও জুড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু বৌদিবোন বা বোনবৌদি ডাকটা শুনতে তো ভাল লাগে না, তাই তো আমি ওকে বৌদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছি। এ ডাকটা তো শুনতে ভাল লাগবে, তাই না মাসিমা”?
বিভাদেবী বললেন, “খুব ভাল বাবা। আমি তো মনে মনে সেটাই কামনা করি। আমার রচু তোমাদের বাড়ির বৌ না হয়ে মেয়ে হয়ে থাকুক। তোমরা সব ভাইবোনেরা সবাই ওকে নিজের দিদি নিজের বোনের মত ভালবেসো, আর তোমার মা বাবা কাকা কাকিমারাও সবাই যেন ওকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল।
সীমন্তিনী রচনাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “মাসি আমি তো তোমায় আগেই বলেছি। রচুকে তো আমি অনেক আগে থেকেই আমার বোন বানিয়ে নিয়েছি। আর তুমি দেখে নিও। আমাদের আলাদা করে কোন চেষ্টাই করতে হবে না। তোমার এ মেয়েটা যা মিষ্টি, আমাদের বাড়ির সকলে ওকে মাথায় তুলে রাখবে। তোমার মেয়ের কখনও কোন অযত্ন হবে না ও বাড়িতে। সে’কথা আমি তোমায় দিচ্ছি। আমি ওকে সারা জীবন আমার বুক দিয়ে আগলে রাখব। যদি কখনো তোমাদের মনে হয় তোমার মেয়ে ও বাড়িতে কষ্টে আছে, তাহলে সবার আগে তুমি আমাকে শূলে চড়িও”।
বিভাদেবী নিজের চোখের কোল মুছতে মুছতে বললেন, “আজ থেকে নয় রে মা। তোর কথা শুনে প্রথম থেকেই তোর ওপর আমার ভরসা করতে ইচ্ছে করেছে। আর তোদের বাড়িতে গিয়ে মনে হয়েছে, রচু সেখানে সত্যিই খুব ভাল থাকবে। কিন্তু জানিস তো? আমি যে ওর মা। সন্তানকে নিয়ে মায়ের মনে যে কত দুশ্চিন্তা হয়, তা তো তোরা হয়ত কল্পনাও করতে পারবি না। তোর মা কাকিমারাই সেটা উপলব্ধি করবেন। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো দেখছিসই। সাধ ষোল আনা থাকলেও সাধ্য যে একেবারেই নেই রে। এ জন্যেই বড় মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রোজ হেনস্থার শিকার হচ্ছে। ওর কথা মনে হলেই বুকটা ভেঙে যায় আমার। তাই রচুকে নিয়েও মনে বড় আশঙ্কা ছিল আমার। কিন্তু তোদের সকলের সাথে পরিচিত হবার পর আমার মন অনেকটাই শান্ত হয়েছে। তাই বলছি মা, এই যে এ মূহুর্তে তুই যেভাবে রচুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছিস, এভাবেই সারাজীবন ওকে তোর বুকে করে রাখিস মা”। বলতে বলতে বিভাদেবীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।
সীমন্তিনী রচনাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে বিভাদেবীর মাথাটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি রচুকে নিয়ে একেবারে দুশ্চিন্তা কোর না মাসি। আমাদের বাড়িতে রচুর কোনরকম অমর্যাদা হবে না। তুমি নিজেকে সামলাও। আমি বলছি, রচুর জীবনে নেমে আসা সব দুর্যোগের মোকাবিলা আমি করব। আমি প্রায় সাত আট বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে আছি। আর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেভাবে ভেবেছি, তাতে সে বাড়িতে বোধহয় পাকাপাকিভাবে আর কখনও থাকতেও পারব না। কিন্তু তা সত্বেও আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, ওর প্রতিটা প্রয়োজনে আমি দুরে থেকেও সব সময় ওর পাশে পাশে থাকব। এটা তোমার কাছে তোমার এ মেয়েটার আরেকটা প্রতিশ্রুতি বলে ভেব তুমি”।
বিভাদেবীও সীমন্তিনীকে আদর করে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “তোর কথায় ভরসা করেই তো এতদুর এগিয়েছিরে আমরা মা। তোর কথা শুনে আমার মন ভরে গেছে”।
সীমন্তিনী এবার কথা ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা মাসি, তোমরা কেমন গো? আমাদের বাড়ি থেকে দাদাভাইয়ের একটা ছবি চেয়ে আনতে পারনি? তোমার মেয়েটা তো অন্ধের মত আমার তোমার কথার ওপর ভরসা করেই বিয়ে করতে চলছে। আমার দাদাভাই তো ওকে দেখেছে। ওরও তো মনে মনে একটু ইচ্ছে করতেই পারে, যার সাথে ওর বিয়ে হবে তার চেহারাটা একটু দেখতে। একটা ছবি চেয়ে এনেও তো ওকে দেখাতে পারতে তোমরা”।
বিভাদেবী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কথাটা যে আমার মনে হয়নি তা নয় রে মা। কিন্তু মুখ ফুটে কারো কাছে সে’কথাটা বলতে পারিনি। তবে এখন আমি জানি, তুই যা মেয়ে, তুই নিজেই সে ব্যবস্থা করবি। তাই আমাকে আর সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুমিও কম চালাক নও মাসি। দিলে তো আমার কাঁধে বন্দুকটা তুলে? আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ছবির ব্যবস্থা করে দিলে তোমরা আবার কিছু মনে করবে না তো”?
বিভাদেবী হেসে জবাব দিলেন, “নারে মা। এখন আর সঙ্কোচের কোন কথা নেই। তুই নিজে যদি রচুকে তোদের বাড়িতেও নিয়ে যেতে চাস, আমি তাতেও বাঁধা দেব না। তুই চাইলে তোর দাদাভাইকেও এখানে নিয়ে আসতে পারিস”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “বাব্বা মাসি! তুমি তো দেখছি অনেক ছাড় দিয়ে দিচ্ছ আমাকে। কিন্তু কথায় বলে না শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখাতে নেই। তোমার মেয়েকে আমি যদি বাড়ি নিয়ে যাই, তাহলে ও আর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। এটা ভেবেছ”?
বিভাদেবী আগের মতই হেসে বললেন, “যা না নিয়ে। আমি বারণ করব না”।
সীমন্তিনী বিভাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার মত মা পাওয়া সত্যি খুব ভাগ্যের ব্যাপার গো মাসি”।
বিভাদেবী বললেন, “ঠিক আছে, তোরা কথা বল। আমি দেখি তোর মেসোর ঘুম ভাঙল কি না। তাকে আবার চা করে দিতে হবে” বলে ট্রেতে খালি চায়ের কাপগুলো তুলে চলে গেলেন।
সীমন্তিনী খাটে বসে রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “তা হ্যারে রচু, মোবাইলের সব কিছু ঠিকমত বুঝতে পেরেছিস তো? অপারেট করতে কোন অসুবিধে কিছু হচ্ছে না তো”?
রচনা জবাব দিল, “আমি তো শুধু কল করা আর কল রিসিভ করা ছাড়া আর কিছু করিনা দিদিভাই। আর তেমন প্রয়োজনও পড়েনি”।
সীমন্তিনী বলল, “ওমা সেকি রে? আজকাল ছেলে মেয়েরা মোবাইল হাতে পেলেই তো এটা ওটা টেপাটিপি করে কোথায় কি আছে সব দেখতে চায়। আর তুই কিছুই দেখিস নি? তোকে তো আগের বার সবকিছু বলে গিয়েছিলাম আমি। কিছুই দেখিস নি? আচ্ছা দে তো দেখি তোর ফোনটা। আমাদের আবার যাবার সময় হয়ে এল”।
রচনা তার ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “যাবার সময় নিয়ে ভেবে ব্যাকুল হয়ে লাভ নেই। যত কষ্টই হোক, আজ তোমরা এখানেই থাকছ সবাই”।
সীমন্তিনী সতীশের দিকে চেয়ে বলল, “কিরে ভাই? কী বলছে তোর বৌদিভাই”?
সতীশ হেসে বলল, “আমার কিন্তু আপত্তি নেই রে। কাল তো রবিবার। তোর তো ক্লাস টিউশন কিছু নেই। তাই থেকে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। বরং লাভই হবে। আরো কিছু সময় আমার মিষ্টি বৌদিভাইয়ের কাছাকাছি থাকতে পারব আমরা। চল না যাবার প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে বিকেলে সবাই মিলে একটু এদিক ওদিক বেরিয়ে জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে আসি”।
সীমন্তিনী মোবাইলে খুটখাট করতে করতে বলল, “তুই কিন্তু ভাই দিনে দিনে বেশী হ্যাংলা হয়ে উঠছিস রে। লক্ষণটা কিন্তু ভাল নয়। তবে আজ তোকে কনসিডার করছি” বলে একহাতে রচনাকে কাছে ডেকে বলল, “এই দেখ রচু। ফটোস বলে এখানে যে ফোল্ডারটা আছে সেটা মাঝের এই বোতামটায় চাপ দিয়ে সিলেক্ট কর”।
রচনা মোবাইলটা হাতে নিয়ে সেটা করতেই পুরোটা স্ক্রিন জুড়ে খুব ছোট ছোট অনেকগুলো ছবি দেখে বলল, “এতে তো দেখি খুব ছোট ছোট কতগুলো ছবি। এগুলো কিসের ছবি গো দিদিভাই? ঠিক মত বোঝা যাচ্ছে না”।
সীমন্তিনী রচনার মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে বলল, “হ্যারে, প্রথমে অমন ছোট ছোটই দেখা যায়। এবার এই মাঝের বোতামটার এদিক ওদিক চাপ দিলেই দেখবি একেকটা ব্লক আলাদা আলাদা ভাবে সিলেক্ট হচ্ছে। দেখেছিস? এবার ধর এ ছোট্ট ছবিটাকে তুই বড় করে দেখতে চাইছিস। তখন এ ব্লকটাকে বক্সের ভেতরে রেখে সিলেক্ট বোতামটা চাপ দিলেই দেখবি ছবিটা বড় করে দেখা যাবে। এই দেখ”।
রচনা অবাক হয়ে বলল, “ওমা, এ যে তোমার ছবি গো দিদিভাই। ইশ কী সুন্দর লাগছে গো তোমাকে দেখতে”?
সীমন্তিনী সতীশের কাছে এসে বলল, “ভাই একটু গিয়ে দেখ না, কিংশুক ঘুম থেকে উঠেছে কি না। আর মাসি মেসোকে জিজ্ঞেস করে দেখ তারা আমাদের রচু আর ভাইকে নিয়ে একটু বেরোতে দেবেন কি না”।
সতীশ বেরিয়ে যেতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, এখানে কি আরও ছবি আছে? না এই একটাই”?
সীমন্তিনী রচনাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “মুখ ফুটে বলছিস না কেন তুই কার ছবি দেখতে চাইছিস? এই দেখ এবার এই এরো কী-টায় চাপ দিলেই আরেকটা ছবি বেরোবে। দে চাপ দে। হ্যা এই তো। দেখ”।
মোবাইলের পর্দায় তখন রতীশের একটা ছবি বেড়িয়েছে। রচনা তাকিয়ে দেখে যে খুব সুন্দর একটা ছেলের ছবি। হাঁসি হাঁসি মুখে ছেলেটা যেন তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। সীমন্তিনী আড় চোখে রচনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখের ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করতে লাগল। রচনা কিছুক্ষন ছবিটা ভাল করে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “এটা কার ছবি গো দিদিভাই? তোমার কোন বন্ধু”?
সীমন্তিনী মজা করে বলল, “হ্যা সেটা বলতে পারিস। আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুও, আর আমার দাদাও। এটা তোর হবু বর, আমার দাদাভাই রে বোকা মেয়ে”।
রচনার চোখ দুটো এক সেকেণ্ডের জন্যে চকচক করে উঠল। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে সীমন্তিনীর কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলে বলল, “ইশ দিদিভাই, তুমি কী গো”?
সীমন্তিনী রচনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রচনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কিরে? কেমন লাগছে আমার দাদাভাইকে? পছন্দ হয়েছে তো”?
রচনার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ধড়ফড় করছে। সীমন্তিনীর কোলে আরো জোরে নিজের মুখটা চেপে ধরে সে হাঁপাতে লাগল। সীমন্তিনী আর কিছু না বলে রচনার পিঠে আর মাথায় হাত বোলাতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর সীমন্তিনী ঝুঁকে রচনার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, “ওঠ পাগলী। লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আগে থেকেই এ ছবিগুলো তোর মোবাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম তুই দেখবি বলে। কিন্তু তুই এ’সব দেখিস নি শুনেই আমাকে এটা করতে হল। ওঠ ওঠ। আরো আছে দেখ। আমাদের বাড়ির সকলের ছবিই আছে। দেখ”।
রচনা তবুও লজ্জায় মাথা ওঠাতে পারছে না। সীমন্তিনী এবার জোর করে রচনাকে ঠেলে তুলে হাঁসি হাঁসি মুখে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “বল না বোন। তোর পছন্দ হয়নি আমার দাদাভাইকে? আরো কয়েকটা আছে। তবে আগে তুই বল তোর কেমন লেগেছে। তারপর তোকে বাকি ছবিগুলো দেখাচ্ছি। বল না লক্ষ্মী বোন আমার। আমি না তোর বান্ধবী! তাহলে আমার কাছে আর লজ্জা করছিস কেন? সেজন্যেই তো সতুকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। তোর মুখ থেকে কথাটা না শুনলে আমি যে শান্তি পাব না রে”।
রচনা এবার সীমন্তিনীকে হঠাৎ করে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সীমন্তিনী কিছু না বলে রচনার পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অনেকক্ষণ পর রচনা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “আমার কপালে কি এত সুখ সইবে দিদিভাই? আমি তো স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি যে এমন কেউ আমার জীবনে আসতে পারে”।
সীমন্তিনী রচনাকে আদর করে বলল, “স্বপ্ন নয় রে পাগলী। এটাই সত্যি। তুই এর স্ত্রী হয়েই আমাদের সংসারে যাচ্ছিস। আচ্ছা, তুই না হয় পরে দাদাভাইয়ের বাকি ছবিগুলো দেখিস। আমি তোকে অন্যদের ছবি দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি” বলে রচনাকে কোলের ওপর রেখেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরপর রতীশের অনেকগুলো ছবি বাদ দিয়ে নিজের জেঠুর ছবি বের করে বলল, “এটা দেখ, দেখ তো চিনতে পারিস কি না”।
রচনা তবুও সীমন্তিনীর কোল থেকে মুখ ওঠাচ্ছে না দেখে সীমন্তিনী জোর করে তাকে উল্টে দিয়ে দেখে রচনার চোখে জল। সীমন্তিনী অবাক হয়ে রচনার চোখের জল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল, “কি হল রে তোর? দাদাভাইকে দেখে পছন্দ হয়নি তোর”?
রচনা নিজেকে সামলাতে সামলাতে ভারী গলায় বলল, “না দিদিভাই, তা নয়। আসলে দিদির কথা মনে পড়ছে আমার। তাই ...”
সীমন্তিনী আদর করে রচনাকে শান্ত করে বলল, “দেখ, ইনি আমার জেঠু মানে তোর শ্বশুর মশাই শ্রীযুক্ত রতিকান্ত ভট্টাচার্যি। ইনি আমার বড়মা, তোর শাশুড়ি শ্রীমতী সরলা ভট্টাচার্যি। এটা সতু বুঝতেই পারছিস। আর ইনি হচ্ছেন আমার বাবা, মানে তোর বড় খুড়শ্বশুর শ্রীযুক্ত শশীকান্ত ভট্টাচার্যি। ইনি আমার মা আর তোর বড় খুড়শাশুড়ি শ্রীমতি সীমা ভট্টাচার্যি। এটা আমার ছোট ভাই, তোর মেজ দেওর সূর্য্য। আমাদের বাড়ির ভেতর সবচেয়ে গম্ভীর। ইনি আমার ছোটকাকু শ্রীযুক্ত চন্দ্রকান্ত ভট্টাচার্যি। আর ইনি হচ্ছেন আমার ছোটকাকিমা শ্রীমতী চন্দ্রা ভট্টাচার্যি তোর ছোট খুড়শাশুড়ি। এটা তোর ছোট দেওর চঞ্চল, আমাদের ছোট কাকুর ছেলে। আর এটা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য, আমার ছোটকাকুর মেয়ে, আর তোর ছোট্ট ননদ চন্দ্রিকা”।
রচনা খুব আগ্রহ সহকারে ছবিগুলো দেখে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী সব শেষে বলল, “এই ফোল্ডারটার মধ্যেই দাদাভাইয়ের আরো ন’টা ছবি আছে। তুই যখন একা একা থাকবি, তখন প্রাণ ভরে দেখিস। আর এই পোড়ামুখী মেয়েটাকে যদি বান্ধবী ভেবে কিছু বলতে চাস, তাহলে বলিস”।
রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে বলল, “তোমাকে একবারটি আমায় প্রণাম করতে দেবে দিদিভাই? তুমি তো শুধু আমার ননদ আর আমার বান্ধবীই নয়। তুমি যে আমার বড় দিদিও। ছোট বোন ভেবে আমাকে একবার তোমাকে প্রণাম করতে দাও না প্লীজ”।
সীমন্তিনী রচনাকে আবার বুকে চেপে ধরে বলল, “আমি কারুর প্রণাম নেবার যোগ্যই নই রে বোন। আমি বড় বাজে একটা মেয়ে। আর সেটা আজ থেকে নয়। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি প্রচণ্ড রকম জেদী, গোঁয়ার আর অবাধ্য। তাই আমার নিজের মা বাবাও আমায় ভালবাসেন না। ও বাড়ির বড়দের মধ্যে কেবল শুধু বড়মা আর ছোটকাকুই আমার সাথে কথা বলেন। আর কেউ আমার সাথে কথাও বলেন না। তবে আমি খুব জেদী বলেই বোধহয় সবাই আমাকে ভাল না বাসলেও বেশ সমীহ করে চলেন। ভাল না বাসলেও বাড়ির সকলেই এটা জানেন যে সেই ছোটবেলায় একটা অন্যায় করা ছাড়া আমি আর কখনও কোন অন্যায় করিনি। আর আমার জেদী স্বভাবের সাথেও তারা খুব ভালভাবে পরিচিত। তাই হয়ত আমার কথার বিপক্ষে গিয়ে তারা কখনও কিছু করেন না। আমার যখন যা কিছুর প্রয়োজন হয়েছে তারা সবাই সে প্রয়োজন মিটিয়েছেন। এজন্য তাদের সকলের প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। তাই বুঝতেই পারছিস, পরিবারের লোকদের সমর্থন সহযোগিতা পেলেও তাদের ভালবাসা আমি খুব বেশী পাই নি। তাই তুই আমাকে শুধু একটু ভালবাসিস বোন। আর তুই তো আমার বুকের মধ্যে বসে গেছিস রে। তাই তুই কখনো আমাকে প্রণাম করবি না। তুই শুধু আমাকে আদর করবি। আমাকে ভালবাসবি”।
রচনাও সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মন খারাপ কোর না দিদিভাই। ঠাকুর তোমার সব অভাব একদিন ঠিক মিটিয়ে দেবে দেখো”।
***************
সতীশ চোখ বড় বড় করে রচনার কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ হতেই সে লাফ মেরে নিচে নেমে রচনার পায়ের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বলল, “তুমি তো দেখছি একটা ঝানু গোয়েন্দা গো বৌদিভাই। একটু তোমার পায়ের ধুলো নিতে দাও”।
রচনা ছুটে বিছানার উল্টোদিকে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ও মাগো, ও দিদিভাই তোমার ভাইকে থামাও। মেজদাভাই প্লীজ”।
সীমন্তিনী সতীশকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল। “ভাই, থাক। মেয়েটাকে আর বিরক্ত করিস না”।
বিভাদেবীও এসব দেখে হাসতে শুরু করেছিলেন। তিনিও সতীশকে বললেন, “হ্যা বাবা, তুমি ওকে আর লজ্জা দিও না। সম্পর্কে ওর দেওর হলেও তুমি তো ওর চেয়ে বয়সে বড়। তাই ও তোমার প্রণাম নিতে কখনই রাজি হবে না। তুমিও ওকে বৌদির চেয়ে নিজের বোনের মত ভালবাসলেই আমরা সবাই খুশী হব”।
সতীশ আবার বিছানায় বসে বলল, “মাসিমা, সে’কথা আর আপনাকে বলে দিতে হবে? ওকে তো নিজের বোন বলে ভাবতেই আমার বেশী ভাল লাগবে। তাই তো বৌদি শব্দটার সাথে বোন কথাটাও জুড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু বৌদিবোন বা বোনবৌদি ডাকটা শুনতে তো ভাল লাগে না, তাই তো আমি ওকে বৌদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছি। এ ডাকটা তো শুনতে ভাল লাগবে, তাই না মাসিমা”?
বিভাদেবী বললেন, “খুব ভাল বাবা। আমি তো মনে মনে সেটাই কামনা করি। আমার রচু তোমাদের বাড়ির বৌ না হয়ে মেয়ে হয়ে থাকুক। তোমরা সব ভাইবোনেরা সবাই ওকে নিজের দিদি নিজের বোনের মত ভালবেসো, আর তোমার মা বাবা কাকা কাকিমারাও সবাই যেন ওকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল।
সীমন্তিনী রচনাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “মাসি আমি তো তোমায় আগেই বলেছি। রচুকে তো আমি অনেক আগে থেকেই আমার বোন বানিয়ে নিয়েছি। আর তুমি দেখে নিও। আমাদের আলাদা করে কোন চেষ্টাই করতে হবে না। তোমার এ মেয়েটা যা মিষ্টি, আমাদের বাড়ির সকলে ওকে মাথায় তুলে রাখবে। তোমার মেয়ের কখনও কোন অযত্ন হবে না ও বাড়িতে। সে’কথা আমি তোমায় দিচ্ছি। আমি ওকে সারা জীবন আমার বুক দিয়ে আগলে রাখব। যদি কখনো তোমাদের মনে হয় তোমার মেয়ে ও বাড়িতে কষ্টে আছে, তাহলে সবার আগে তুমি আমাকে শূলে চড়িও”।
বিভাদেবী নিজের চোখের কোল মুছতে মুছতে বললেন, “আজ থেকে নয় রে মা। তোর কথা শুনে প্রথম থেকেই তোর ওপর আমার ভরসা করতে ইচ্ছে করেছে। আর তোদের বাড়িতে গিয়ে মনে হয়েছে, রচু সেখানে সত্যিই খুব ভাল থাকবে। কিন্তু জানিস তো? আমি যে ওর মা। সন্তানকে নিয়ে মায়ের মনে যে কত দুশ্চিন্তা হয়, তা তো তোরা হয়ত কল্পনাও করতে পারবি না। তোর মা কাকিমারাই সেটা উপলব্ধি করবেন। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো দেখছিসই। সাধ ষোল আনা থাকলেও সাধ্য যে একেবারেই নেই রে। এ জন্যেই বড় মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রোজ হেনস্থার শিকার হচ্ছে। ওর কথা মনে হলেই বুকটা ভেঙে যায় আমার। তাই রচুকে নিয়েও মনে বড় আশঙ্কা ছিল আমার। কিন্তু তোদের সকলের সাথে পরিচিত হবার পর আমার মন অনেকটাই শান্ত হয়েছে। তাই বলছি মা, এই যে এ মূহুর্তে তুই যেভাবে রচুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছিস, এভাবেই সারাজীবন ওকে তোর বুকে করে রাখিস মা”। বলতে বলতে বিভাদেবীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।
সীমন্তিনী রচনাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে বিভাদেবীর মাথাটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি রচুকে নিয়ে একেবারে দুশ্চিন্তা কোর না মাসি। আমাদের বাড়িতে রচুর কোনরকম অমর্যাদা হবে না। তুমি নিজেকে সামলাও। আমি বলছি, রচুর জীবনে নেমে আসা সব দুর্যোগের মোকাবিলা আমি করব। আমি প্রায় সাত আট বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে আছি। আর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেভাবে ভেবেছি, তাতে সে বাড়িতে বোধহয় পাকাপাকিভাবে আর কখনও থাকতেও পারব না। কিন্তু তা সত্বেও আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, ওর প্রতিটা প্রয়োজনে আমি দুরে থেকেও সব সময় ওর পাশে পাশে থাকব। এটা তোমার কাছে তোমার এ মেয়েটার আরেকটা প্রতিশ্রুতি বলে ভেব তুমি”।
বিভাদেবীও সীমন্তিনীকে আদর করে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “তোর কথায় ভরসা করেই তো এতদুর এগিয়েছিরে আমরা মা। তোর কথা শুনে আমার মন ভরে গেছে”।
সীমন্তিনী এবার কথা ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা মাসি, তোমরা কেমন গো? আমাদের বাড়ি থেকে দাদাভাইয়ের একটা ছবি চেয়ে আনতে পারনি? তোমার মেয়েটা তো অন্ধের মত আমার তোমার কথার ওপর ভরসা করেই বিয়ে করতে চলছে। আমার দাদাভাই তো ওকে দেখেছে। ওরও তো মনে মনে একটু ইচ্ছে করতেই পারে, যার সাথে ওর বিয়ে হবে তার চেহারাটা একটু দেখতে। একটা ছবি চেয়ে এনেও তো ওকে দেখাতে পারতে তোমরা”।
বিভাদেবী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কথাটা যে আমার মনে হয়নি তা নয় রে মা। কিন্তু মুখ ফুটে কারো কাছে সে’কথাটা বলতে পারিনি। তবে এখন আমি জানি, তুই যা মেয়ে, তুই নিজেই সে ব্যবস্থা করবি। তাই আমাকে আর সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুমিও কম চালাক নও মাসি। দিলে তো আমার কাঁধে বন্দুকটা তুলে? আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ছবির ব্যবস্থা করে দিলে তোমরা আবার কিছু মনে করবে না তো”?
বিভাদেবী হেসে জবাব দিলেন, “নারে মা। এখন আর সঙ্কোচের কোন কথা নেই। তুই নিজে যদি রচুকে তোদের বাড়িতেও নিয়ে যেতে চাস, আমি তাতেও বাঁধা দেব না। তুই চাইলে তোর দাদাভাইকেও এখানে নিয়ে আসতে পারিস”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “বাব্বা মাসি! তুমি তো দেখছি অনেক ছাড় দিয়ে দিচ্ছ আমাকে। কিন্তু কথায় বলে না শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখাতে নেই। তোমার মেয়েকে আমি যদি বাড়ি নিয়ে যাই, তাহলে ও আর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। এটা ভেবেছ”?
বিভাদেবী আগের মতই হেসে বললেন, “যা না নিয়ে। আমি বারণ করব না”।
সীমন্তিনী বিভাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার মত মা পাওয়া সত্যি খুব ভাগ্যের ব্যাপার গো মাসি”।
বিভাদেবী বললেন, “ঠিক আছে, তোরা কথা বল। আমি দেখি তোর মেসোর ঘুম ভাঙল কি না। তাকে আবার চা করে দিতে হবে” বলে ট্রেতে খালি চায়ের কাপগুলো তুলে চলে গেলেন।
সীমন্তিনী খাটে বসে রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “তা হ্যারে রচু, মোবাইলের সব কিছু ঠিকমত বুঝতে পেরেছিস তো? অপারেট করতে কোন অসুবিধে কিছু হচ্ছে না তো”?
রচনা জবাব দিল, “আমি তো শুধু কল করা আর কল রিসিভ করা ছাড়া আর কিছু করিনা দিদিভাই। আর তেমন প্রয়োজনও পড়েনি”।
সীমন্তিনী বলল, “ওমা সেকি রে? আজকাল ছেলে মেয়েরা মোবাইল হাতে পেলেই তো এটা ওটা টেপাটিপি করে কোথায় কি আছে সব দেখতে চায়। আর তুই কিছুই দেখিস নি? তোকে তো আগের বার সবকিছু বলে গিয়েছিলাম আমি। কিছুই দেখিস নি? আচ্ছা দে তো দেখি তোর ফোনটা। আমাদের আবার যাবার সময় হয়ে এল”।
রচনা তার ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “যাবার সময় নিয়ে ভেবে ব্যাকুল হয়ে লাভ নেই। যত কষ্টই হোক, আজ তোমরা এখানেই থাকছ সবাই”।
সীমন্তিনী সতীশের দিকে চেয়ে বলল, “কিরে ভাই? কী বলছে তোর বৌদিভাই”?
সতীশ হেসে বলল, “আমার কিন্তু আপত্তি নেই রে। কাল তো রবিবার। তোর তো ক্লাস টিউশন কিছু নেই। তাই থেকে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। বরং লাভই হবে। আরো কিছু সময় আমার মিষ্টি বৌদিভাইয়ের কাছাকাছি থাকতে পারব আমরা। চল না যাবার প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে বিকেলে সবাই মিলে একটু এদিক ওদিক বেরিয়ে জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে আসি”।
সীমন্তিনী মোবাইলে খুটখাট করতে করতে বলল, “তুই কিন্তু ভাই দিনে দিনে বেশী হ্যাংলা হয়ে উঠছিস রে। লক্ষণটা কিন্তু ভাল নয়। তবে আজ তোকে কনসিডার করছি” বলে একহাতে রচনাকে কাছে ডেকে বলল, “এই দেখ রচু। ফটোস বলে এখানে যে ফোল্ডারটা আছে সেটা মাঝের এই বোতামটায় চাপ দিয়ে সিলেক্ট কর”।
রচনা মোবাইলটা হাতে নিয়ে সেটা করতেই পুরোটা স্ক্রিন জুড়ে খুব ছোট ছোট অনেকগুলো ছবি দেখে বলল, “এতে তো দেখি খুব ছোট ছোট কতগুলো ছবি। এগুলো কিসের ছবি গো দিদিভাই? ঠিক মত বোঝা যাচ্ছে না”।
সীমন্তিনী রচনার মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে বলল, “হ্যারে, প্রথমে অমন ছোট ছোটই দেখা যায়। এবার এই মাঝের বোতামটার এদিক ওদিক চাপ দিলেই দেখবি একেকটা ব্লক আলাদা আলাদা ভাবে সিলেক্ট হচ্ছে। দেখেছিস? এবার ধর এ ছোট্ট ছবিটাকে তুই বড় করে দেখতে চাইছিস। তখন এ ব্লকটাকে বক্সের ভেতরে রেখে সিলেক্ট বোতামটা চাপ দিলেই দেখবি ছবিটা বড় করে দেখা যাবে। এই দেখ”।
রচনা অবাক হয়ে বলল, “ওমা, এ যে তোমার ছবি গো দিদিভাই। ইশ কী সুন্দর লাগছে গো তোমাকে দেখতে”?
সীমন্তিনী সতীশের কাছে এসে বলল, “ভাই একটু গিয়ে দেখ না, কিংশুক ঘুম থেকে উঠেছে কি না। আর মাসি মেসোকে জিজ্ঞেস করে দেখ তারা আমাদের রচু আর ভাইকে নিয়ে একটু বেরোতে দেবেন কি না”।
সতীশ বেরিয়ে যেতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, এখানে কি আরও ছবি আছে? না এই একটাই”?
সীমন্তিনী রচনাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “মুখ ফুটে বলছিস না কেন তুই কার ছবি দেখতে চাইছিস? এই দেখ এবার এই এরো কী-টায় চাপ দিলেই আরেকটা ছবি বেরোবে। দে চাপ দে। হ্যা এই তো। দেখ”।
মোবাইলের পর্দায় তখন রতীশের একটা ছবি বেড়িয়েছে। রচনা তাকিয়ে দেখে যে খুব সুন্দর একটা ছেলের ছবি। হাঁসি হাঁসি মুখে ছেলেটা যেন তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। সীমন্তিনী আড় চোখে রচনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখের ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করতে লাগল। রচনা কিছুক্ষন ছবিটা ভাল করে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “এটা কার ছবি গো দিদিভাই? তোমার কোন বন্ধু”?
সীমন্তিনী মজা করে বলল, “হ্যা সেটা বলতে পারিস। আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুও, আর আমার দাদাও। এটা তোর হবু বর, আমার দাদাভাই রে বোকা মেয়ে”।
রচনার চোখ দুটো এক সেকেণ্ডের জন্যে চকচক করে উঠল। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে সীমন্তিনীর কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলে বলল, “ইশ দিদিভাই, তুমি কী গো”?
সীমন্তিনী রচনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রচনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কিরে? কেমন লাগছে আমার দাদাভাইকে? পছন্দ হয়েছে তো”?
রচনার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ধড়ফড় করছে। সীমন্তিনীর কোলে আরো জোরে নিজের মুখটা চেপে ধরে সে হাঁপাতে লাগল। সীমন্তিনী আর কিছু না বলে রচনার পিঠে আর মাথায় হাত বোলাতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর সীমন্তিনী ঝুঁকে রচনার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, “ওঠ পাগলী। লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আগে থেকেই এ ছবিগুলো তোর মোবাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম তুই দেখবি বলে। কিন্তু তুই এ’সব দেখিস নি শুনেই আমাকে এটা করতে হল। ওঠ ওঠ। আরো আছে দেখ। আমাদের বাড়ির সকলের ছবিই আছে। দেখ”।
রচনা তবুও লজ্জায় মাথা ওঠাতে পারছে না। সীমন্তিনী এবার জোর করে রচনাকে ঠেলে তুলে হাঁসি হাঁসি মুখে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “বল না বোন। তোর পছন্দ হয়নি আমার দাদাভাইকে? আরো কয়েকটা আছে। তবে আগে তুই বল তোর কেমন লেগেছে। তারপর তোকে বাকি ছবিগুলো দেখাচ্ছি। বল না লক্ষ্মী বোন আমার। আমি না তোর বান্ধবী! তাহলে আমার কাছে আর লজ্জা করছিস কেন? সেজন্যেই তো সতুকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। তোর মুখ থেকে কথাটা না শুনলে আমি যে শান্তি পাব না রে”।
রচনা এবার সীমন্তিনীকে হঠাৎ করে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সীমন্তিনী কিছু না বলে রচনার পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অনেকক্ষণ পর রচনা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “আমার কপালে কি এত সুখ সইবে দিদিভাই? আমি তো স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি যে এমন কেউ আমার জীবনে আসতে পারে”।
সীমন্তিনী রচনাকে আদর করে বলল, “স্বপ্ন নয় রে পাগলী। এটাই সত্যি। তুই এর স্ত্রী হয়েই আমাদের সংসারে যাচ্ছিস। আচ্ছা, তুই না হয় পরে দাদাভাইয়ের বাকি ছবিগুলো দেখিস। আমি তোকে অন্যদের ছবি দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি” বলে রচনাকে কোলের ওপর রেখেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরপর রতীশের অনেকগুলো ছবি বাদ দিয়ে নিজের জেঠুর ছবি বের করে বলল, “এটা দেখ, দেখ তো চিনতে পারিস কি না”।
রচনা তবুও সীমন্তিনীর কোল থেকে মুখ ওঠাচ্ছে না দেখে সীমন্তিনী জোর করে তাকে উল্টে দিয়ে দেখে রচনার চোখে জল। সীমন্তিনী অবাক হয়ে রচনার চোখের জল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল, “কি হল রে তোর? দাদাভাইকে দেখে পছন্দ হয়নি তোর”?
রচনা নিজেকে সামলাতে সামলাতে ভারী গলায় বলল, “না দিদিভাই, তা নয়। আসলে দিদির কথা মনে পড়ছে আমার। তাই ...”
সীমন্তিনী আদর করে রচনাকে শান্ত করে বলল, “দেখ, ইনি আমার জেঠু মানে তোর শ্বশুর মশাই শ্রীযুক্ত রতিকান্ত ভট্টাচার্যি। ইনি আমার বড়মা, তোর শাশুড়ি শ্রীমতী সরলা ভট্টাচার্যি। এটা সতু বুঝতেই পারছিস। আর ইনি হচ্ছেন আমার বাবা, মানে তোর বড় খুড়শ্বশুর শ্রীযুক্ত শশীকান্ত ভট্টাচার্যি। ইনি আমার মা আর তোর বড় খুড়শাশুড়ি শ্রীমতি সীমা ভট্টাচার্যি। এটা আমার ছোট ভাই, তোর মেজ দেওর সূর্য্য। আমাদের বাড়ির ভেতর সবচেয়ে গম্ভীর। ইনি আমার ছোটকাকু শ্রীযুক্ত চন্দ্রকান্ত ভট্টাচার্যি। আর ইনি হচ্ছেন আমার ছোটকাকিমা শ্রীমতী চন্দ্রা ভট্টাচার্যি তোর ছোট খুড়শাশুড়ি। এটা তোর ছোট দেওর চঞ্চল, আমাদের ছোট কাকুর ছেলে। আর এটা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য, আমার ছোটকাকুর মেয়ে, আর তোর ছোট্ট ননদ চন্দ্রিকা”।
রচনা খুব আগ্রহ সহকারে ছবিগুলো দেখে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী সব শেষে বলল, “এই ফোল্ডারটার মধ্যেই দাদাভাইয়ের আরো ন’টা ছবি আছে। তুই যখন একা একা থাকবি, তখন প্রাণ ভরে দেখিস। আর এই পোড়ামুখী মেয়েটাকে যদি বান্ধবী ভেবে কিছু বলতে চাস, তাহলে বলিস”।
রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে বলল, “তোমাকে একবারটি আমায় প্রণাম করতে দেবে দিদিভাই? তুমি তো শুধু আমার ননদ আর আমার বান্ধবীই নয়। তুমি যে আমার বড় দিদিও। ছোট বোন ভেবে আমাকে একবার তোমাকে প্রণাম করতে দাও না প্লীজ”।
সীমন্তিনী রচনাকে আবার বুকে চেপে ধরে বলল, “আমি কারুর প্রণাম নেবার যোগ্যই নই রে বোন। আমি বড় বাজে একটা মেয়ে। আর সেটা আজ থেকে নয়। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি প্রচণ্ড রকম জেদী, গোঁয়ার আর অবাধ্য। তাই আমার নিজের মা বাবাও আমায় ভালবাসেন না। ও বাড়ির বড়দের মধ্যে কেবল শুধু বড়মা আর ছোটকাকুই আমার সাথে কথা বলেন। আর কেউ আমার সাথে কথাও বলেন না। তবে আমি খুব জেদী বলেই বোধহয় সবাই আমাকে ভাল না বাসলেও বেশ সমীহ করে চলেন। ভাল না বাসলেও বাড়ির সকলেই এটা জানেন যে সেই ছোটবেলায় একটা অন্যায় করা ছাড়া আমি আর কখনও কোন অন্যায় করিনি। আর আমার জেদী স্বভাবের সাথেও তারা খুব ভালভাবে পরিচিত। তাই হয়ত আমার কথার বিপক্ষে গিয়ে তারা কখনও কিছু করেন না। আমার যখন যা কিছুর প্রয়োজন হয়েছে তারা সবাই সে প্রয়োজন মিটিয়েছেন। এজন্য তাদের সকলের প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। তাই বুঝতেই পারছিস, পরিবারের লোকদের সমর্থন সহযোগিতা পেলেও তাদের ভালবাসা আমি খুব বেশী পাই নি। তাই তুই আমাকে শুধু একটু ভালবাসিস বোন। আর তুই তো আমার বুকের মধ্যে বসে গেছিস রে। তাই তুই কখনো আমাকে প্রণাম করবি না। তুই শুধু আমাকে আদর করবি। আমাকে ভালবাসবি”।
রচনাও সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মন খারাপ কোর না দিদিভাই। ঠাকুর তোমার সব অভাব একদিন ঠিক মিটিয়ে দেবে দেখো”।
***************