24-02-2020, 09:12 PM
(Update No. 48)
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “তোর ভাল লেগেছে? ভাল করে কথা বলেছিস তো তার সাথে? না সেদিনের মত ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা ছিল তোর”?
রচনা বলল, “তোমাকে তো মিথ্যে বলতে পারব না দিদিভাই। একটু অস্বস্তি তো হচ্ছিলই। তবে সেদিনের মত অতটা নার্ভাস হইনি আজ”।
সীমন্তিনীর পরের প্রশ্ন, “তাহলে হবু শাশুড়ি মার সাথে আমার বোনটা আজ ভাল করেই কথা বলেছে। তা এত কথার মধ্যে তার কোন কথাটা তোর সবচাইতে ভাল লেগেছে বল তো শুনি”।
রচনা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, “তার কোন কথাই তো খারাপ লাগেনি দিদিভাই। তবে সেদিন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে, সেটার সাথে তার একটা কথা একেবারে মিলে গিয়েছে। উনি আমাকে বলেছেন যে ‘তুমি আমাকে কী বলে ডাকবে জানিনা রচনা, আমিও তোমাকে কি বলে ডাকব সেটা এখনও ভেবে ঠিক করতে পারিনি আমি। কিন্তু তোমাকে আমি আমার ছেলের বৌ না ভেবে আমার মেয়ে বলে ভাবব, আমার নিজের কোন মেয়ে নেই। ভগবান আমাকে দুটো ছেলেই দিয়েছেন, তাই তুমি আমার মেয়ে হয়েই থাকবে চিরদিন’। ওই কথাটাই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে গো দিদিভাই”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “বাঃ, আমিও তো মনে মনে তাই চাইছিলুম রে রচু। তোর শাশুড়ি মা তোকে যেন তার নিজের মেয়ের মত করে ভালবাসেন। তা তুই কি বলেছিস তাকে? তুইও তাকে নিজের মায়ের মতই ভাববি সেটা বলিস নি”?
রচনা বলল, “না দিদিভাই। সেটা বলতে পারিনি গো। আসলে কি জান দিদিভাই, ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসা এসব জিনিস তো বলে কয়ে বা ঢাক ঢোল পিটিয়ে হয় না। নিজের মনের ভেতর থেকে একটা তাগিদ জেগে না উঠলে বুঝি কাউকেই ভালবাসা যায় না, শ্রদ্ধা করা যায় না। তুমি প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলে সেদিন মনের ভেতর থেকে কে যেন বলেছিল, এ তোর পরম আপনজন। তাই তো সহজেই তোমাকে আমার দিদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। আর ওনাকে বিয়ের পর প্রথা মেনেই মা বলেই তো ডাকব। তবে প্রাণের ভেতর থেকে তাগিদটা না পেলে তাকে সত্যি সত্যি মায়ের জায়গায় বসাতে পারব কি না কে জানে। যদিও মনে মনে সে তাগিদ পাব বলেই আশা করছি আমি”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে সতীশের মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইল। দেখে সতীশের চোখে মুখেও বিস্ময়ের ছাপ। ফোনে বলল, “আমি জানিরে রচু। তুই তোর প্রাণের ভেতর থেকেই সে তাগিদটা অনুভব করবি। তোর শাশুড়ি সত্যিই খুব খুব ভাল রে। আমি জানি। তবে তুই তো আজ আমাকে অবাক করে দিলি রে! এমন সুন্দর করে কথাটা বললি যে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেলুম রে। ভাল থাকিস বোন। খুব খুব ভাল থাকিস তুই, আর তোরা সবাই”।
ফোন কেটে দিয়ে সীমন্তিনী সতীশের মুখের দিকে চাইতেই সতীশ অবাক গলায় বলে উঠল, “এ কি মেয়ে রে বড়দি? ভালবাসা ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে এখনকার যুগের একটা মেয়ে এমন কথা বলতে পারে! সেটা নিজে কানে না শুনলে কখনই বিশ্বাস করতুম না আমি”।
সীমন্তিনীও রচনার মুখে এমন কথা শুনবে বলে আশাই করে নি। কত গভীর মর্মাথের একটা কথা রচু কি সহজেই না বলে বুঝিয়ে দিল! মাত্র সতের বছরের একটা মেয়ের ভেতর এ উপলব্ধি কী করে এল? সে সতীশের কথার জবাবে বলল, “এখন বুঝতে পাচ্ছিস ভাই? কেন আমি রচুকে আমাদের ঘরের বৌ করে তুলবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছি? এমন ভাবনা ক’টা মেয়ের মনে আসতে পারে বল। আমি জানি রচু আমাদের সংসারটাকে সবদিক দিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ করে তুলবে। বাড়ির প্রত্যেকে ওকে ভালবাসতে বাধ্য হবে দেখিস। ও আমাদের সকলের চোখের মণি হয়ে উঠবে”।
সতীশ বলল, “হ্যারে বড়দি। এতদিন শুধু তোর আর মার মুখে ওর প্রশংসাই শুনেছি। আজ নিজের কানে ওর মুখের যে কথা শুনতে পেলুম, তাতে আমিও তোর কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হয়ে থাকতে পারছি না রে। আমার তো আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে এখনই ছুটে চলে যাই কালচিনি”।
সীমন্তিনী বলল, “তুই বড়মাকে ফোন করে বলে দে। রচুদের বাড়িতে ফোন করে বলে দিক যে ছেলের ভাই আর বোন তাদের বাড়ি যাচ্ছে শনিবার। আর এটা বলতে ভুলিস না, আমাদের নাম যেন না বলেন। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে আনছি ভাই”।
ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে সতীশের রুমে এসে দেখে সে তখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। সীমন্তিনীকে ঢুকতে দেখে সতীশ বলল, “এই যে বড়দি এসে গেছে মা। নাও দিদির সাথে কথা বল” বলে সীমন্তিনীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল।
সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বলল, “কিগো বড়মা? হবু বৌমার সাথে খুব কথা বললে আজ শুনলুম। তা কেমন লাগল তোমার বৌমাকে? তোমার মনের মত হয়েছে তো”?
সরলাদেবী বললেন, “আমি এখন বৌমার কথা ভাবছি না রে মা। আমি তো এখন তোর কথাই ভাবছি। তুই মাঠে না নামলে রচুকে কি আমরা পেতাম? তুই আমার জন্যে, তোর দাদাভাইয়ের জন্যে যা করলি তাতে তো আমরা সারা জীবনের জন্য তোর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব রে মা। আমাকে ক্ষমা করিস মা। কিন্তু এবার নিজের জীবনটা নিয়েও একটু ভাবিস। এটা তোর কাছে আমার মিনতি রে মা। বল, তুই আমার এ মিনতিটা রাখবি তো”?
সীমন্তিনী সরলাদেবীর কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বড়মা, তুমি তো জান মিথ্যে কথা বলা আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমি আর যাকে যা-ই বলি না কেন। তোমাকে কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারব না। তাই ও’কথা থাক না বড়মা। তোমার এ মেয়েটাকে তার তপস্যা নিয়ে থাকতে দাও না তুমি”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে সরলাদেবীও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন “জানিরে মা। কারুর কথায় তুই কিছু করবি নে। তুই তো শুধু তোর মনের কথা শুনিস। তবে তোর এই মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখিস। আর ঠিক আছে শোন, সতুকে নিয়ে তুই যখন পরের শনিবার কালচিনি যাচ্ছিস তাহলে ওকে কাল বাড়ি পাঠিয়ে দিস। শুক্রবার ওর সাথে আমি কিছু জিনিস পাঠিয়ে দেব। ওগুলো কালচিনিতে নিয়ে যাস তোরা সাথে করে। আর রচুকে বলিস, যেন আমায় ফোন করে”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে বড়মা। তবে শোন, আমি যে সতুকে নিয়ে কালচিনি যাব, সে কথাটা এত আগেই তাদের জানিও না। শুক্রবারে সতু বাড়ি থেকে রওনা দেবার পর তাদের ফোন করে কথাটা বোল।
তবে মনে রেখো বড়মা, তখনও কিন্তু তোমরা আমার আর সতুর নামটা তাদের জানাবে না। শুধু বলবে যে বাড়ি থেকে ছেলের ভাই আর বোন কালচিনি যাচ্ছে। আর তোমাকে আরেকটা কথা বলছি বড়মা। ছেলের হবু বৌয়ের সাথে তুমি একাই শুধু কথা বললে হবে না। তোমার দুই জা, তোমার স্বামী আর দেওররাও যেন মাঝে মাঝে রচুর সাথে কথা বলে। আমি চাই ফোনে ফোনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতে রচু তোমাদের সকলের সাথে খোলামেলা হয়ে উঠুক, তোমাদের সবাইকে নিজের কাছের লোক বলে ভাবতে শুরু করুক। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসে সব মেয়েই একটু দ্বিধান্বিত একটু শঙ্কান্বিত থাকে। স্বামীর বাড়ির লোকেরা কে কেমন, তার কথা বার্তাকে কে তারা কিভাবে নেবে, এসব নিয়ে সব নতুন বৌরাই বেশ টেনশনে থাকে। আমি চাইনে রচু যখন আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে আসবে, তখন ওর মনে কোন টেনশন থাকুক। সকলের সাথে ফোনে কথা বললে সকলের ব্যাপারেই ওর মনে একটা ধারণা জন্মে যাবে। আর আমি তো জানি, আমি সকলের চক্ষুশূল হলেও আমাদের বাড়ির লোকেরা সবাই সবাইকে ভালবাসতে পারে। ওদের বিয়েটা তো বছরখানেক বাদেই হবে। তাই আমি চাই এ বছর খানেকের মধ্যে জেঠু থেকে শুরু করে চন্দু পর্যন্ত সকলকেই যেন ও ফোনের মাধ্যমে চিনে উঠতে পারে। তাহলে বৌ হয়ে আমাদের বাড়িতে পা রাখবার সময় ওর মনে আর কোন দ্বিধা কোন সঙ্কোচ থাকবে না। ও জানবে যে বাপের বাড়ি ছেড়ে ও এমন একটা বাড়িতে আসছে যে সেখানে সবাই ওর পরিচিত। কেউই তার অচেনা নয়। আর এটা সম্ভব হবে ফোনে ফোনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতেই। তাই বাড়ির কেউ যদি নিজে ইচ্ছে প্রকাশ না-ও করে তুমি রচুর সাথে তাদের কথা বলাবে”।
সরলাদেবী বললেন, “তুই যে কত ভাল একটা মেয়ে সেটা তো আর আমার জানতে বাকি নেই রে মা। কিন্তু আজ তোকে যেন একটু অন্যভাবে চিনলাম আমি। ভালো থাকিস মা। সুখে থাকিস। রাখছি”।
সীমন্তিনী জানে, তার বড়মা এবার নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ কাঁদবেন। তার কথা ভেবে চোখের জল বাড়ির আর কেউ যে ফেলে না, সেটা সে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে। বড়মা আর কাকু চন্দ্রকান্তই শুধু এখনও সীমন্তিনীকে ভালবেসে যাচ্ছেন। কিন্তু এ’কথা ভেবে তার চোখেও কখনও জল আসে না। সে জানে এতে বাড়ির লোকদের কোন দোষ নেই। সব দোষ শুধু তার একারই। প্রাণের চেয়ে প্রিয় তার দাদাভাইয়েরও এতে কোন দোষ নেই।
**************
বিধুবাবু সকাল সকালই বাজারে চলে গেছেন। রাজগঞ্জ থেকে তার হবু বেয়ান জানিয়েছেন যে রতীশের এক বোন আর এক ভাই আজ তাদের বাড়ি আসছে। তারা দু’জনেই নাকি বাইরে পড়াশোনা করছে। দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে তারা নাকি তাদের হবু বৌদিকে দেখবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। তাই তারা আজ কালচিনি আসছে।
বিধুবাবু এবং তার স্ত্রী বিভাদেবী রতীশের সাথে রচনার সম্মন্ধ পাকা করে ফেলে খুব খুশী হয়েছেন। পাত্রের বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই বড় অমায়িক। তারা বুঝতে পেরেছেন যে তাদের ছোট মেয়ে রতীশদের বাড়িতে খুব স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে। কোন কিছুর অভাব নেই সে বাড়িতে। বড় মেয়ের মত দুর্ভোগ তাদের ছোট মেয়ের কপালে হবে না, এটা ভেবেই তারা খুশী। তারা স্বামী স্ত্রী রোজ রাতে রতীশদের বাড়ির লোকজনদের ভাল আন্তরিক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন।
রাজগঞ্জ যাবার আগে সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতে জোর করেই পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল। আসা যাওয়ার বাস, ট্রেন, রিক্সাভাড়া আর মিষ্টি কিনতে শ’ পাঁচেক টাকাও খরচ হয় নি। বাকি টাকাটা তার হাতেই রয়ে গেছে। তাই বিভাদেবীর কথাতেই তিনি সকাল সকাল বাজারে ছুটেছেন। আজ ভাল দেখে মাছ নিয়ে যাবেন রতীশের ভাই আর বোনকে খাওয়াবার জন্যে। বাজারের পথে যেতে যেতে তার সীমন্তিনীর কথা মনে পড়ল। মেয়েটা তাদের জন্য রচুর জন্য কত কী করছে। তিন তিনবার তাদের বাড়িতে এসে নানারকম ভাবে তাদের সাহায্য করেছে। রচুকে একটা দামী মোবাইল দিয়েছে। ছেলের বাড়ির সমস্ত খবরাখবর জানিয়েছে। তার বুদ্ধিমত চলেই বিনা পণে মেয়েকে অমন একটা সুন্দর পরিবারে বিয়ে দিতে পারছেন তারা। নইলে তো তার সাহসই হত না এগিয়ে যাবার। কিন্তু মেয়েটাকে শুধু ডাল ভাত ছাড়া আর কিছু খাওয়াবার সামর্থ্যই হয়নি তাদের। আজ যদি সেও আসত তাহলে কি ভালই না হত। ইশ মেয়েটাকে ফোন করে একবার আসতে অনুরোধ করা যেত। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আগের রাতেও তো মেয়েটা তাদের সাথে কথা বলেছে। বিভাদেবীই তো তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে রতীশের ভাই আর বোন আসছে। ইশ তখনও যদি কথাটা মাথায় আসত! কিন্তু রাতে রচনা বলছিল যে সীমন্তিনীকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন নাকি বেজে যাচ্ছে, কিন্তু সীমন্তিনীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বাজার থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ওকে ফোন করেও তো আর কোন লাভ হবে না।
বিভাদেবীও সকালের চা খেয়েই দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে শুরু দিয়েছেন। রাতে ছোলার ডাল ভিজিয়ে রেখেছিলেন। ডাল, কুমড়ো ভাজা, চালকুমড়োর ঘন্ট, আর সরসে বাটা দিয়ে ইলিশ ভাপার সাথে ছোলার ডালের রসা বানাবেন বলে ভেবেছেন। ছোলার ডালের রসাটা করতেই সবচেয়ে বেশী সময়ের প্রয়োজন। ডাল বেটে চপের মত আকৃতিতে ডেলা বানাতে হয়। তারপর সেটাকে গরম জলে রেখে শক্ত করে তুলতে হয়। তারপর ডেলা গুলোকে ছুড়ি দিয়ে চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে একটু ঘিয়ে ভেজে নিতে হয়। তারপর সেগুলো নিয়ে রসা বানাতে হয়। অনেকটাই সময় লেগে যায়। তবে রসাটা রচুই বানাবে বলে অত চিন্তা হচ্ছে না। শুধু ডালটা তিনি নিজে শিলনোড়ায় বেটে দেবেন। মেয়েকে আগে থেকেই রান্নাবান্না শিখিয়ে দিয়েছেন। বেশ ভালই রাঁধে রচু। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তার মেয়ের হাতের রান্না খেয়ে নিশ্চয়ই খুশী হবে। ডাল বাটতে বাটতে সীমন্তিনীর কথা মনে পড়ল তার। মেয়েটা তিন দিন এসেছে তাদের বাড়ি। কিন্তু ডাল ভাত ছাড়া আর কিছুই খাওয়াতে পারেননি তিনি। আজ তার স্বামীর হাতে কিছু পয়সা আছে ভাল করে বাজার করবার মত। আর সেটাও তো সীমন্তিনীর দৌলতেই। আজ যদি মন্তিও আসত তাহলে কী ভালই না হত। এমন ভাল মন্দ রান্না করার সুযোগ তো অনেক বছরের মধ্যে আসেনি। মেয়েটাকে খাওয়াতে পারলে তার মনটাও বেশ শান্তি পেত। রোজই তো মেয়েটা ফোন করে। কালও করেছিল। সকলের সাথে কথা বলেছে। তবে বলছিল এ সপ্তাহটা নাকি ক্লাস আর পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে। কিন্তু মেয়েটাকে তো আসবার কথা বলা হয়নি। আর শেষ যখন কথা হয়েছে তখন তো রতীশের ভাই বোনের আসার খবরটা জানাতে গিয়ে অন্য কিছু বলাই হয়ে ওঠেনি। পরে বাড়ির কেউই কথাটা মনে করেনি। মনে মনে তিনি নিজেই নিজেকে গালমন্দ করে রাতে রচুকে বলেছিলেন সীমন্তিনীকে ফোন করতে। কিন্তু রচু আর কথা বলতে পারেনি। সীমন্তিনী নাকি ফোন ধরেই নি। বিভাদেবী ভেবে অবাক হয়েছিলেন, এমনটা তো এতদিনে কখনও হয় নি। যখনই সীমন্তিনীকে ফোন করা হয়েছে তখনই তার সাথে কথা হয়েছে।
রচনার কলেজ নেই এখন। দিন কয়েক আগে এগারো ক্লাসের পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। বরাবরের মত রচনা এবারেও প্রথম হয়েছে। কলেজে গিয়ে রেজাল্ট পেয়ে সবার আগে সে সীমন্তিনীকে ফোন করেছিল। তার দিদিভাই ফোনে কথাটা শুনেই আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল। রচনা তার দিদিভাইকে বলেছে একদিন কালচিনি আসতে। এ’কথাও বলেছিল যে আজ রাজগঞ্জ থেকে রতীশের এক ভাই আর এক বোন আজ তাদের বাড়ি আসছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে ও বাড়ির প্রায় সকলের সাথেই কথা হয়েছে তার। শুধু রতীশের নিজের ভাই আর বড়কাকা শশীকান্তবাবুর মেয়ের সাথেই তার কথা হয়নি। তারা দু’জনেই বাইরে পড়াশোনা করছে। আজ নাকি তারাই আসবে রচনাদের বাড়ি। এখন আর রচনা আগের মত অতটা ঘাবড়াচ্ছে না। কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছিল, এ সময় তার দিদিভাই যদি তার পাশে থাকত তাহলে খুব ভাল হত। বাবা আর তার দিদিভাই যে রাজগঞ্জের ওই ছেলের সাথেই তার বিয়ে দেবে, এতে আর রচনার মনে কোন সন্দেহই নেই। আর প্রথমে দিদিভাইয়ের মুখে আর পরে মা বাবার মুখে ছেলের ও ছেলের বাড়ির সুখ্যাতি শুনে রচনাও মনে মনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছে। তার নিজের শ্বশুর বাড়ি দিদির শ্বশুর বাড়ির মত হবে না, এটা সে বুঝতে পেরেছে। আর দিদিভাই যা বলেছে তাতে তো মনে হয় ছেলেও দেখতে শুনতে ভালই হবে। তার মা বিভাদেবীও তো ছেলের অনেক প্রশংসা করেছেন। শুধু ছেলের ব্যাপারেই নয়, তার বাবা মা তো ছেলের বাড়ির সকলেরই প্রশংসা করেছেন। তবু রচনার মনের ভেতর আর একটা আশা ছিল, যে ব্যাপারে তার মা বাবা বা তার দিদিভাই প্রায় কিছুই বলেনি। সে ভেবেছিল কেউ না কেউ পাত্রের একটা ছবি নিশ্চয়ই তাকে দেখাবে। কিন্তু কেউই সেটা করেননি বলে মনে মনে একটু হতাশ হয়েছে সে। আর একটা চিন্তা তার মনে রয়ে গেছে। মা বলেছেন ছেলের বড় কাকার মেয়ে নাকি প্রায় ছেলের বয়সীই। মাত্র ছ’মাসের ছোট। বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে সে হবে রচনার বড় ননদ। ননদদের সাথে বৌদিদের নাকি প্রায় অহি নকুলের মত সম্পর্ক হয়ে থাকে। তাই বাবা মা রাজগঞ্জ থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই রচনা মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে, তার বড় ননদের সাথে যেন তার মনের মিল হয়। তার মনটা খুব চাইছে যে তার বড় ননদ যেন দিদিভাইয়ের মতই তাকে ভালবাসে। দিদিভাইয়ের মত একটা বড় ননদ তার কপালে জুটলে তার আর চিন্তার কিছু থাকবে না। তার সব স্বপ্নই তাহলে পূর্ণ হবে।
কুইজ কনটেস্টে যাবার দিন থেকে এই ক’টা দিনের মধ্যে তার জীবনে এমন সব ঘটণা ঘটে গেছে, যে সে একের পর এক চমৎকৃত হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে সীমন্তিনীর সাথে তার দেখা হওয়া। না, তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার ব্যাপারটাও কম চমকপ্রদ মোটেও নয় তার কাছে। কিন্তু তার পেছনেও তো সীমন্তিনীর হাত অনেকটাই আছে। তার দিদিভাই না থাকলে এমন একজন শিক্ষিত, সুন্দর দেখতে পাত্র, আর সেই সাথে এমন সুন্দর একটা শ্বশুর বাড়ির স্বপ্নও বুঝি সে দেখতে পেত না। অবশ্য রতীশকে সে এখনও দেখেনি। তার কোন ছবিও এখনও দেখেনি। তার খুব আশা ছিল যে মা বাবা নিশ্চয়ই ছেলের একটা ছবি চেয়ে আনবেন। কিন্তু তারা তা আনেননি। তবে তার দিদিভাইয়ের মুখে যতটা শুনেছে, তা থেকেই নিজের মনে রতীশের একটা অবয়ব তৈরী করে নিয়েছে সে। মাঝে মাঝে সে অবয়বটা তার চোখে সামনে ভেসে উঠে তাকেই যেন লজ্জিত করে ফেলে।
তার দিদিভাই নাকি ক্লাস আর টিউশন নিয়ে এ সপ্তাহটা খুব ব্যস্ত আছে। সামনেই নাকি একটা পরীক্ষা আছে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও রচনা তাকে আসতে বলতে পারেনি। কিন্তু রাতে মা বিভাদেবীর কথায় সে আবার সীমন্তিনীকে ফোন করেছিল। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সীমন্তিনীর সাথে আর কথা হয়নি। ফোনটা বেজে বেজেই থেমে যাচ্ছিল বারবার।
সকালে বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর রচনা ফোন করল সীমন্তিনীকে। এবারেও একই দশা। ফোনটা বেজে বেজে একসময় লাইন কেটে গেল। মনে মনে বেশ চিন্তা হচ্ছিল তার। এতদিনের মধ্যে একদিনও এমন হয়নি যে সীমন্তিনীকে ফোন করে সে তার সাথে কথা বলতে পারেনি। কাল রাত থেকে বারবার এমন হচ্ছে কেন, সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। সীমন্তিনী তার ফোন রিসিভ করবে না, এমনটা তো হতেই পারে না। তাহলে কি নেটওয়ার্কের কোন সমস্যা হচ্ছে কে জানে?
এমন সময় রান্নাঘর থেকে মা ডাকতেই সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বিভাদেবী মেয়েকে রান্নার কাজে একটু সাহায্য করতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে। মন্তিকে কি সকালে ফোন করেছিলিস”?
রচনা ছোলার ডালের ডেলা বানাতে বানাতে জবাব দিল, “একটু আগেই একবার করেছিলাম মা। কিন্তু এবারেও রাতের মতই দিদিভাইয়ের সাড়া পেলাম না। কেন যে এমনটা হচ্ছে কিছু বুঝতেই পাচ্ছি না”।
বিভাদেবী বললেন, “আমাদের কপালটাই বুঝি খারাপ রে মা। মেয়েটা এতবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। কোনদিন একটুখানি ভালমন্দ রেঁধে ওকে খাওয়াতে পারিনি। আজ ওরই দয়াতেই তোর বাবার হাতে দুটো পয়সা ছিল বলে রতীশের ভাইবোনের আসার উপলক্ষ্যে দুটো পদ রান্না করতে পারছি। মনটা খুব চাইছিল, ওর মুখেও আজ একটু খাবার তুলে দিতে। কিন্তু দেখ, ফোনটাই কাজ করছে না। ভাগ্যের দোষ ছাড়া আর কি বলব একে? আচ্ছা খোকা কি করছে রে? বেরিয়ে গেছে নাকি”?
রচনা জবাব দিল, “না মা, ভাই পড়ছে গো। আর বাইরে গেলে কি ও তোমাকে না বলে বেরোয় কখনও? আচ্ছা মা, একটা কথা বলবে? তুমি দিদিভাইকে মনে মনে খুব ভালবেসে ফেলেছ, তাই না মা”?
বিভাদেবী বললেন, “সে তো ওকে দেখার পর থেকেই ভালবেসে ফেলেছি রে। সত্যি অমন মেয়ে ক’টা হয়
বল তো? তবে ও আমাদের জন্য যা কিছু করছে তার জন্যে ওকে আরও বেশী ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু সেসব বলতে গেলে নিজেকেই স্বার্থপর বলে মনে হবে। কিন্তু এমন মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়েকে ভাল না বেসে থাকা যায়, বল? আর কী সুন্দর দেখতে! মনে হয় সাক্ষাৎ মা দুর্গা। ওর মার কথা ভেবে আমার সত্যিই হিংসে হয় রে। একেবারে রত্নগর্ভা মেয়ে। কিন্তু মন্তির কপালটা দেখ। সেদিন আমার কোলে মাথা পেতে শুয়ে কি বলেছিল, তোর মনে আছে? ওর মা নাকি কখনও ওভাবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নি! এমন একটা মেয়ে পেয়েও কোন মা তাকে আদর না করে থাকতে পারে”?
রচনা বলল, “দেখ মা, দিদিভাইকে দেখে আমারও মনে হয় সে আমার খুব আপন। তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের জন্যে দিদিভাই যা কিছু করেছেন সে’সবের জন্যই যদি আমরা তাকে ভালবেসে থাকি, তাহলে সকলেই আমাদের স্বার্থপর বলে ভাববে। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম, তখনই আমার তাকে খুব ভাল লেগেছিল। আর তার দু’দিন বাদেই কাবেরীর সাথে যখন আমাদের বাড়ি এসে হাজির হয়েছিলেন তখন তো খুশীতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমার অনেক অনেক কাছের একজন অনেকদিন বাদে আমার কাছে ফিরে এসেছেন। কিন্তু মা, দিদিভাইয়ের জীবনের কতটুকু কথা আর আমরা জানি বল? সে নিজে আমাকে অনেকবার বলেছে যে সে খুব খারাপ মেয়ে। সেদিন তোমার কোলে শোবার সময়েও তো বলছিল যে তার মা নাকি তাকে সবচেয়ে বড় অলক্ষ্মী বলে ভাবেন। তার মা যে কেন কোনদিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি, কেন তাকে অলক্ষ্মী বলে ভাবেন, সে’সব কথা তো আমাদের খুলে বলেনি। নিশ্চয়ই কোন কারন থেকে থাকবে এসবের পেছনে। কিন্তু সেসব নিয়ে ভেবে আমরা তো কোন কুল কিনারা বের করতে পারব না। তবে দিদিভাইয়ের মত মেয়ে লাখেও একটা খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। ভগবান যদি আমায় সুযোগ দেন, দিদিভাইয়ের সুখের জন্য আমি সব কিছু করার চেষ্টা করব”।
বিভাদেবী বললেন, “আমি তো সারা জীবনেও ওকে ভুলতে পারব না। কিন্তু ওর উজ্জ্বল মুখটার পেছনে একটা ব্যথাও যেন কোথাও জমা হয়ে রয়েছে, আমার এমনটাই মনে হয়। নইলে এমন অপরূপা বিদুষী একটা মেয়ের ছাব্বিশ বছর বয়স হতে চলল, অথচ তার বাবা মায়েরা তার বিয়ে দেন নি! এটা ভেবে কেন যেন ভাল লাগছে না রে”।
রচনা বলল, “আজকাল তো অনেক মেয়েই লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় মা। আর দিদিভাই লেখাপড়াতেও খুব ভাল। এখন এমএ পড়ছেন। এরপর তিনি আইপিএসে বসে পুলিশ অফিসার হবার স্বপ্ন দেখছেন। এতে দোষের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না মা। তবে বিয়ে সাদির ব্যাপারে মনে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। আমি অনেকবার ভাবলেও তার বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে পারিনি”।
এমন সময় বিধুবাবু বাড়িতে ঢুকে খুব খুশী হয়ে হাক ছাড়লেন, “রচু মা, কোথায় গেলি রে? দেখ আজ কি ভাল ইলিশ মাছ পেয়েছি রে! একেবারে পদ্মার ইলিশ। শিলিগুড়ি থেকে এনেছে এখানে” বলতে বলতে রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে এলেন। বিভাদেবী আর রচনাও ঘর থেকে বেরিয়ে মাছ দেখে খুব খুশী।
বিভাদেবী মাছটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের ভেতর ঢুকতেই বিধুবাবু রচনাকে বললেন, “ও তুইও বুঝি কাজে ব্যস্ত আছিস? তা হ্যারে মা। মন্তিমাকে কি আর ফোন করেছিলিস”?
রচনা জবাব দিল, “করেছিলাম বাবা। কিন্তু এবারেও কথা হয় নি”।
বিধুবাবু কলপাড়ের দিকে যেতে যেতে নিজে নিজেই বললেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার! এমনটা তো কখনও হয়নি”।
রচনা রান্নাঘরে ঢুকে আবার নিজের কাজে হাত দিল। খানিকক্ষণ বাদে কিংশুক রান্নাঘরে ঢুকতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “কিরে ভাই? পড়া শেষ হয়েছে তোর? এখন কি বেরোবি”?
কিংশুক বলল, “নারে ছোড়দি, আজ এ বেলা আর বেরোব না। তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। আমাকে না দেখলে তারা খারাপ পাবেন না? আমি এখন দিদিভাইয়ের দেওয়া ভিডিও গেম খেলব। মা তুমি কিন্তু বারণ কোর না”।
বিভাদেবী বললেন, “ঠিক আছে খেলগে যা”।
______________________________
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “তোর ভাল লেগেছে? ভাল করে কথা বলেছিস তো তার সাথে? না সেদিনের মত ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা ছিল তোর”?
রচনা বলল, “তোমাকে তো মিথ্যে বলতে পারব না দিদিভাই। একটু অস্বস্তি তো হচ্ছিলই। তবে সেদিনের মত অতটা নার্ভাস হইনি আজ”।
সীমন্তিনীর পরের প্রশ্ন, “তাহলে হবু শাশুড়ি মার সাথে আমার বোনটা আজ ভাল করেই কথা বলেছে। তা এত কথার মধ্যে তার কোন কথাটা তোর সবচাইতে ভাল লেগেছে বল তো শুনি”।
রচনা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, “তার কোন কথাই তো খারাপ লাগেনি দিদিভাই। তবে সেদিন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে, সেটার সাথে তার একটা কথা একেবারে মিলে গিয়েছে। উনি আমাকে বলেছেন যে ‘তুমি আমাকে কী বলে ডাকবে জানিনা রচনা, আমিও তোমাকে কি বলে ডাকব সেটা এখনও ভেবে ঠিক করতে পারিনি আমি। কিন্তু তোমাকে আমি আমার ছেলের বৌ না ভেবে আমার মেয়ে বলে ভাবব, আমার নিজের কোন মেয়ে নেই। ভগবান আমাকে দুটো ছেলেই দিয়েছেন, তাই তুমি আমার মেয়ে হয়েই থাকবে চিরদিন’। ওই কথাটাই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে গো দিদিভাই”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “বাঃ, আমিও তো মনে মনে তাই চাইছিলুম রে রচু। তোর শাশুড়ি মা তোকে যেন তার নিজের মেয়ের মত করে ভালবাসেন। তা তুই কি বলেছিস তাকে? তুইও তাকে নিজের মায়ের মতই ভাববি সেটা বলিস নি”?
রচনা বলল, “না দিদিভাই। সেটা বলতে পারিনি গো। আসলে কি জান দিদিভাই, ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসা এসব জিনিস তো বলে কয়ে বা ঢাক ঢোল পিটিয়ে হয় না। নিজের মনের ভেতর থেকে একটা তাগিদ জেগে না উঠলে বুঝি কাউকেই ভালবাসা যায় না, শ্রদ্ধা করা যায় না। তুমি প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলে সেদিন মনের ভেতর থেকে কে যেন বলেছিল, এ তোর পরম আপনজন। তাই তো সহজেই তোমাকে আমার দিদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। আর ওনাকে বিয়ের পর প্রথা মেনেই মা বলেই তো ডাকব। তবে প্রাণের ভেতর থেকে তাগিদটা না পেলে তাকে সত্যি সত্যি মায়ের জায়গায় বসাতে পারব কি না কে জানে। যদিও মনে মনে সে তাগিদ পাব বলেই আশা করছি আমি”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে সতীশের মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইল। দেখে সতীশের চোখে মুখেও বিস্ময়ের ছাপ। ফোনে বলল, “আমি জানিরে রচু। তুই তোর প্রাণের ভেতর থেকেই সে তাগিদটা অনুভব করবি। তোর শাশুড়ি সত্যিই খুব খুব ভাল রে। আমি জানি। তবে তুই তো আজ আমাকে অবাক করে দিলি রে! এমন সুন্দর করে কথাটা বললি যে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেলুম রে। ভাল থাকিস বোন। খুব খুব ভাল থাকিস তুই, আর তোরা সবাই”।
ফোন কেটে দিয়ে সীমন্তিনী সতীশের মুখের দিকে চাইতেই সতীশ অবাক গলায় বলে উঠল, “এ কি মেয়ে রে বড়দি? ভালবাসা ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে এখনকার যুগের একটা মেয়ে এমন কথা বলতে পারে! সেটা নিজে কানে না শুনলে কখনই বিশ্বাস করতুম না আমি”।
সীমন্তিনীও রচনার মুখে এমন কথা শুনবে বলে আশাই করে নি। কত গভীর মর্মাথের একটা কথা রচু কি সহজেই না বলে বুঝিয়ে দিল! মাত্র সতের বছরের একটা মেয়ের ভেতর এ উপলব্ধি কী করে এল? সে সতীশের কথার জবাবে বলল, “এখন বুঝতে পাচ্ছিস ভাই? কেন আমি রচুকে আমাদের ঘরের বৌ করে তুলবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছি? এমন ভাবনা ক’টা মেয়ের মনে আসতে পারে বল। আমি জানি রচু আমাদের সংসারটাকে সবদিক দিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ করে তুলবে। বাড়ির প্রত্যেকে ওকে ভালবাসতে বাধ্য হবে দেখিস। ও আমাদের সকলের চোখের মণি হয়ে উঠবে”।
সতীশ বলল, “হ্যারে বড়দি। এতদিন শুধু তোর আর মার মুখে ওর প্রশংসাই শুনেছি। আজ নিজের কানে ওর মুখের যে কথা শুনতে পেলুম, তাতে আমিও তোর কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হয়ে থাকতে পারছি না রে। আমার তো আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে এখনই ছুটে চলে যাই কালচিনি”।
সীমন্তিনী বলল, “তুই বড়মাকে ফোন করে বলে দে। রচুদের বাড়িতে ফোন করে বলে দিক যে ছেলের ভাই আর বোন তাদের বাড়ি যাচ্ছে শনিবার। আর এটা বলতে ভুলিস না, আমাদের নাম যেন না বলেন। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে আনছি ভাই”।
ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে সতীশের রুমে এসে দেখে সে তখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। সীমন্তিনীকে ঢুকতে দেখে সতীশ বলল, “এই যে বড়দি এসে গেছে মা। নাও দিদির সাথে কথা বল” বলে সীমন্তিনীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল।
সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বলল, “কিগো বড়মা? হবু বৌমার সাথে খুব কথা বললে আজ শুনলুম। তা কেমন লাগল তোমার বৌমাকে? তোমার মনের মত হয়েছে তো”?
সরলাদেবী বললেন, “আমি এখন বৌমার কথা ভাবছি না রে মা। আমি তো এখন তোর কথাই ভাবছি। তুই মাঠে না নামলে রচুকে কি আমরা পেতাম? তুই আমার জন্যে, তোর দাদাভাইয়ের জন্যে যা করলি তাতে তো আমরা সারা জীবনের জন্য তোর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব রে মা। আমাকে ক্ষমা করিস মা। কিন্তু এবার নিজের জীবনটা নিয়েও একটু ভাবিস। এটা তোর কাছে আমার মিনতি রে মা। বল, তুই আমার এ মিনতিটা রাখবি তো”?
সীমন্তিনী সরলাদেবীর কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বড়মা, তুমি তো জান মিথ্যে কথা বলা আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমি আর যাকে যা-ই বলি না কেন। তোমাকে কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারব না। তাই ও’কথা থাক না বড়মা। তোমার এ মেয়েটাকে তার তপস্যা নিয়ে থাকতে দাও না তুমি”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে সরলাদেবীও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন “জানিরে মা। কারুর কথায় তুই কিছু করবি নে। তুই তো শুধু তোর মনের কথা শুনিস। তবে তোর এই মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখিস। আর ঠিক আছে শোন, সতুকে নিয়ে তুই যখন পরের শনিবার কালচিনি যাচ্ছিস তাহলে ওকে কাল বাড়ি পাঠিয়ে দিস। শুক্রবার ওর সাথে আমি কিছু জিনিস পাঠিয়ে দেব। ওগুলো কালচিনিতে নিয়ে যাস তোরা সাথে করে। আর রচুকে বলিস, যেন আমায় ফোন করে”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে বড়মা। তবে শোন, আমি যে সতুকে নিয়ে কালচিনি যাব, সে কথাটা এত আগেই তাদের জানিও না। শুক্রবারে সতু বাড়ি থেকে রওনা দেবার পর তাদের ফোন করে কথাটা বোল।
তবে মনে রেখো বড়মা, তখনও কিন্তু তোমরা আমার আর সতুর নামটা তাদের জানাবে না। শুধু বলবে যে বাড়ি থেকে ছেলের ভাই আর বোন কালচিনি যাচ্ছে। আর তোমাকে আরেকটা কথা বলছি বড়মা। ছেলের হবু বৌয়ের সাথে তুমি একাই শুধু কথা বললে হবে না। তোমার দুই জা, তোমার স্বামী আর দেওররাও যেন মাঝে মাঝে রচুর সাথে কথা বলে। আমি চাই ফোনে ফোনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতে রচু তোমাদের সকলের সাথে খোলামেলা হয়ে উঠুক, তোমাদের সবাইকে নিজের কাছের লোক বলে ভাবতে শুরু করুক। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসে সব মেয়েই একটু দ্বিধান্বিত একটু শঙ্কান্বিত থাকে। স্বামীর বাড়ির লোকেরা কে কেমন, তার কথা বার্তাকে কে তারা কিভাবে নেবে, এসব নিয়ে সব নতুন বৌরাই বেশ টেনশনে থাকে। আমি চাইনে রচু যখন আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে আসবে, তখন ওর মনে কোন টেনশন থাকুক। সকলের সাথে ফোনে কথা বললে সকলের ব্যাপারেই ওর মনে একটা ধারণা জন্মে যাবে। আর আমি তো জানি, আমি সকলের চক্ষুশূল হলেও আমাদের বাড়ির লোকেরা সবাই সবাইকে ভালবাসতে পারে। ওদের বিয়েটা তো বছরখানেক বাদেই হবে। তাই আমি চাই এ বছর খানেকের মধ্যে জেঠু থেকে শুরু করে চন্দু পর্যন্ত সকলকেই যেন ও ফোনের মাধ্যমে চিনে উঠতে পারে। তাহলে বৌ হয়ে আমাদের বাড়িতে পা রাখবার সময় ওর মনে আর কোন দ্বিধা কোন সঙ্কোচ থাকবে না। ও জানবে যে বাপের বাড়ি ছেড়ে ও এমন একটা বাড়িতে আসছে যে সেখানে সবাই ওর পরিচিত। কেউই তার অচেনা নয়। আর এটা সম্ভব হবে ফোনে ফোনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতেই। তাই বাড়ির কেউ যদি নিজে ইচ্ছে প্রকাশ না-ও করে তুমি রচুর সাথে তাদের কথা বলাবে”।
সরলাদেবী বললেন, “তুই যে কত ভাল একটা মেয়ে সেটা তো আর আমার জানতে বাকি নেই রে মা। কিন্তু আজ তোকে যেন একটু অন্যভাবে চিনলাম আমি। ভালো থাকিস মা। সুখে থাকিস। রাখছি”।
সীমন্তিনী জানে, তার বড়মা এবার নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ কাঁদবেন। তার কথা ভেবে চোখের জল বাড়ির আর কেউ যে ফেলে না, সেটা সে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে। বড়মা আর কাকু চন্দ্রকান্তই শুধু এখনও সীমন্তিনীকে ভালবেসে যাচ্ছেন। কিন্তু এ’কথা ভেবে তার চোখেও কখনও জল আসে না। সে জানে এতে বাড়ির লোকদের কোন দোষ নেই। সব দোষ শুধু তার একারই। প্রাণের চেয়ে প্রিয় তার দাদাভাইয়েরও এতে কোন দোষ নেই।
**************
বিধুবাবু সকাল সকালই বাজারে চলে গেছেন। রাজগঞ্জ থেকে তার হবু বেয়ান জানিয়েছেন যে রতীশের এক বোন আর এক ভাই আজ তাদের বাড়ি আসছে। তারা দু’জনেই নাকি বাইরে পড়াশোনা করছে। দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে তারা নাকি তাদের হবু বৌদিকে দেখবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। তাই তারা আজ কালচিনি আসছে।
বিধুবাবু এবং তার স্ত্রী বিভাদেবী রতীশের সাথে রচনার সম্মন্ধ পাকা করে ফেলে খুব খুশী হয়েছেন। পাত্রের বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই বড় অমায়িক। তারা বুঝতে পেরেছেন যে তাদের ছোট মেয়ে রতীশদের বাড়িতে খুব স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে। কোন কিছুর অভাব নেই সে বাড়িতে। বড় মেয়ের মত দুর্ভোগ তাদের ছোট মেয়ের কপালে হবে না, এটা ভেবেই তারা খুশী। তারা স্বামী স্ত্রী রোজ রাতে রতীশদের বাড়ির লোকজনদের ভাল আন্তরিক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন।
রাজগঞ্জ যাবার আগে সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতে জোর করেই পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল। আসা যাওয়ার বাস, ট্রেন, রিক্সাভাড়া আর মিষ্টি কিনতে শ’ পাঁচেক টাকাও খরচ হয় নি। বাকি টাকাটা তার হাতেই রয়ে গেছে। তাই বিভাদেবীর কথাতেই তিনি সকাল সকাল বাজারে ছুটেছেন। আজ ভাল দেখে মাছ নিয়ে যাবেন রতীশের ভাই আর বোনকে খাওয়াবার জন্যে। বাজারের পথে যেতে যেতে তার সীমন্তিনীর কথা মনে পড়ল। মেয়েটা তাদের জন্য রচুর জন্য কত কী করছে। তিন তিনবার তাদের বাড়িতে এসে নানারকম ভাবে তাদের সাহায্য করেছে। রচুকে একটা দামী মোবাইল দিয়েছে। ছেলের বাড়ির সমস্ত খবরাখবর জানিয়েছে। তার বুদ্ধিমত চলেই বিনা পণে মেয়েকে অমন একটা সুন্দর পরিবারে বিয়ে দিতে পারছেন তারা। নইলে তো তার সাহসই হত না এগিয়ে যাবার। কিন্তু মেয়েটাকে শুধু ডাল ভাত ছাড়া আর কিছু খাওয়াবার সামর্থ্যই হয়নি তাদের। আজ যদি সেও আসত তাহলে কি ভালই না হত। ইশ মেয়েটাকে ফোন করে একবার আসতে অনুরোধ করা যেত। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আগের রাতেও তো মেয়েটা তাদের সাথে কথা বলেছে। বিভাদেবীই তো তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে রতীশের ভাই আর বোন আসছে। ইশ তখনও যদি কথাটা মাথায় আসত! কিন্তু রাতে রচনা বলছিল যে সীমন্তিনীকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন নাকি বেজে যাচ্ছে, কিন্তু সীমন্তিনীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বাজার থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ওকে ফোন করেও তো আর কোন লাভ হবে না।
বিভাদেবীও সকালের চা খেয়েই দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে শুরু দিয়েছেন। রাতে ছোলার ডাল ভিজিয়ে রেখেছিলেন। ডাল, কুমড়ো ভাজা, চালকুমড়োর ঘন্ট, আর সরসে বাটা দিয়ে ইলিশ ভাপার সাথে ছোলার ডালের রসা বানাবেন বলে ভেবেছেন। ছোলার ডালের রসাটা করতেই সবচেয়ে বেশী সময়ের প্রয়োজন। ডাল বেটে চপের মত আকৃতিতে ডেলা বানাতে হয়। তারপর সেটাকে গরম জলে রেখে শক্ত করে তুলতে হয়। তারপর ডেলা গুলোকে ছুড়ি দিয়ে চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে একটু ঘিয়ে ভেজে নিতে হয়। তারপর সেগুলো নিয়ে রসা বানাতে হয়। অনেকটাই সময় লেগে যায়। তবে রসাটা রচুই বানাবে বলে অত চিন্তা হচ্ছে না। শুধু ডালটা তিনি নিজে শিলনোড়ায় বেটে দেবেন। মেয়েকে আগে থেকেই রান্নাবান্না শিখিয়ে দিয়েছেন। বেশ ভালই রাঁধে রচু। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তার মেয়ের হাতের রান্না খেয়ে নিশ্চয়ই খুশী হবে। ডাল বাটতে বাটতে সীমন্তিনীর কথা মনে পড়ল তার। মেয়েটা তিন দিন এসেছে তাদের বাড়ি। কিন্তু ডাল ভাত ছাড়া আর কিছুই খাওয়াতে পারেননি তিনি। আজ তার স্বামীর হাতে কিছু পয়সা আছে ভাল করে বাজার করবার মত। আর সেটাও তো সীমন্তিনীর দৌলতেই। আজ যদি মন্তিও আসত তাহলে কী ভালই না হত। এমন ভাল মন্দ রান্না করার সুযোগ তো অনেক বছরের মধ্যে আসেনি। মেয়েটাকে খাওয়াতে পারলে তার মনটাও বেশ শান্তি পেত। রোজই তো মেয়েটা ফোন করে। কালও করেছিল। সকলের সাথে কথা বলেছে। তবে বলছিল এ সপ্তাহটা নাকি ক্লাস আর পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে। কিন্তু মেয়েটাকে তো আসবার কথা বলা হয়নি। আর শেষ যখন কথা হয়েছে তখন তো রতীশের ভাই বোনের আসার খবরটা জানাতে গিয়ে অন্য কিছু বলাই হয়ে ওঠেনি। পরে বাড়ির কেউই কথাটা মনে করেনি। মনে মনে তিনি নিজেই নিজেকে গালমন্দ করে রাতে রচুকে বলেছিলেন সীমন্তিনীকে ফোন করতে। কিন্তু রচু আর কথা বলতে পারেনি। সীমন্তিনী নাকি ফোন ধরেই নি। বিভাদেবী ভেবে অবাক হয়েছিলেন, এমনটা তো এতদিনে কখনও হয় নি। যখনই সীমন্তিনীকে ফোন করা হয়েছে তখনই তার সাথে কথা হয়েছে।
রচনার কলেজ নেই এখন। দিন কয়েক আগে এগারো ক্লাসের পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। বরাবরের মত রচনা এবারেও প্রথম হয়েছে। কলেজে গিয়ে রেজাল্ট পেয়ে সবার আগে সে সীমন্তিনীকে ফোন করেছিল। তার দিদিভাই ফোনে কথাটা শুনেই আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল। রচনা তার দিদিভাইকে বলেছে একদিন কালচিনি আসতে। এ’কথাও বলেছিল যে আজ রাজগঞ্জ থেকে রতীশের এক ভাই আর এক বোন আজ তাদের বাড়ি আসছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে ও বাড়ির প্রায় সকলের সাথেই কথা হয়েছে তার। শুধু রতীশের নিজের ভাই আর বড়কাকা শশীকান্তবাবুর মেয়ের সাথেই তার কথা হয়নি। তারা দু’জনেই বাইরে পড়াশোনা করছে। আজ নাকি তারাই আসবে রচনাদের বাড়ি। এখন আর রচনা আগের মত অতটা ঘাবড়াচ্ছে না। কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছিল, এ সময় তার দিদিভাই যদি তার পাশে থাকত তাহলে খুব ভাল হত। বাবা আর তার দিদিভাই যে রাজগঞ্জের ওই ছেলের সাথেই তার বিয়ে দেবে, এতে আর রচনার মনে কোন সন্দেহই নেই। আর প্রথমে দিদিভাইয়ের মুখে আর পরে মা বাবার মুখে ছেলের ও ছেলের বাড়ির সুখ্যাতি শুনে রচনাও মনে মনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছে। তার নিজের শ্বশুর বাড়ি দিদির শ্বশুর বাড়ির মত হবে না, এটা সে বুঝতে পেরেছে। আর দিদিভাই যা বলেছে তাতে তো মনে হয় ছেলেও দেখতে শুনতে ভালই হবে। তার মা বিভাদেবীও তো ছেলের অনেক প্রশংসা করেছেন। শুধু ছেলের ব্যাপারেই নয়, তার বাবা মা তো ছেলের বাড়ির সকলেরই প্রশংসা করেছেন। তবু রচনার মনের ভেতর আর একটা আশা ছিল, যে ব্যাপারে তার মা বাবা বা তার দিদিভাই প্রায় কিছুই বলেনি। সে ভেবেছিল কেউ না কেউ পাত্রের একটা ছবি নিশ্চয়ই তাকে দেখাবে। কিন্তু কেউই সেটা করেননি বলে মনে মনে একটু হতাশ হয়েছে সে। আর একটা চিন্তা তার মনে রয়ে গেছে। মা বলেছেন ছেলের বড় কাকার মেয়ে নাকি প্রায় ছেলের বয়সীই। মাত্র ছ’মাসের ছোট। বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে সে হবে রচনার বড় ননদ। ননদদের সাথে বৌদিদের নাকি প্রায় অহি নকুলের মত সম্পর্ক হয়ে থাকে। তাই বাবা মা রাজগঞ্জ থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই রচনা মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে, তার বড় ননদের সাথে যেন তার মনের মিল হয়। তার মনটা খুব চাইছে যে তার বড় ননদ যেন দিদিভাইয়ের মতই তাকে ভালবাসে। দিদিভাইয়ের মত একটা বড় ননদ তার কপালে জুটলে তার আর চিন্তার কিছু থাকবে না। তার সব স্বপ্নই তাহলে পূর্ণ হবে।
কুইজ কনটেস্টে যাবার দিন থেকে এই ক’টা দিনের মধ্যে তার জীবনে এমন সব ঘটণা ঘটে গেছে, যে সে একের পর এক চমৎকৃত হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে সীমন্তিনীর সাথে তার দেখা হওয়া। না, তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার ব্যাপারটাও কম চমকপ্রদ মোটেও নয় তার কাছে। কিন্তু তার পেছনেও তো সীমন্তিনীর হাত অনেকটাই আছে। তার দিদিভাই না থাকলে এমন একজন শিক্ষিত, সুন্দর দেখতে পাত্র, আর সেই সাথে এমন সুন্দর একটা শ্বশুর বাড়ির স্বপ্নও বুঝি সে দেখতে পেত না। অবশ্য রতীশকে সে এখনও দেখেনি। তার কোন ছবিও এখনও দেখেনি। তার খুব আশা ছিল যে মা বাবা নিশ্চয়ই ছেলের একটা ছবি চেয়ে আনবেন। কিন্তু তারা তা আনেননি। তবে তার দিদিভাইয়ের মুখে যতটা শুনেছে, তা থেকেই নিজের মনে রতীশের একটা অবয়ব তৈরী করে নিয়েছে সে। মাঝে মাঝে সে অবয়বটা তার চোখে সামনে ভেসে উঠে তাকেই যেন লজ্জিত করে ফেলে।
তার দিদিভাই নাকি ক্লাস আর টিউশন নিয়ে এ সপ্তাহটা খুব ব্যস্ত আছে। সামনেই নাকি একটা পরীক্ষা আছে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও রচনা তাকে আসতে বলতে পারেনি। কিন্তু রাতে মা বিভাদেবীর কথায় সে আবার সীমন্তিনীকে ফোন করেছিল। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সীমন্তিনীর সাথে আর কথা হয়নি। ফোনটা বেজে বেজেই থেমে যাচ্ছিল বারবার।
সকালে বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর রচনা ফোন করল সীমন্তিনীকে। এবারেও একই দশা। ফোনটা বেজে বেজে একসময় লাইন কেটে গেল। মনে মনে বেশ চিন্তা হচ্ছিল তার। এতদিনের মধ্যে একদিনও এমন হয়নি যে সীমন্তিনীকে ফোন করে সে তার সাথে কথা বলতে পারেনি। কাল রাত থেকে বারবার এমন হচ্ছে কেন, সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। সীমন্তিনী তার ফোন রিসিভ করবে না, এমনটা তো হতেই পারে না। তাহলে কি নেটওয়ার্কের কোন সমস্যা হচ্ছে কে জানে?
এমন সময় রান্নাঘর থেকে মা ডাকতেই সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বিভাদেবী মেয়েকে রান্নার কাজে একটু সাহায্য করতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে। মন্তিকে কি সকালে ফোন করেছিলিস”?
রচনা ছোলার ডালের ডেলা বানাতে বানাতে জবাব দিল, “একটু আগেই একবার করেছিলাম মা। কিন্তু এবারেও রাতের মতই দিদিভাইয়ের সাড়া পেলাম না। কেন যে এমনটা হচ্ছে কিছু বুঝতেই পাচ্ছি না”।
বিভাদেবী বললেন, “আমাদের কপালটাই বুঝি খারাপ রে মা। মেয়েটা এতবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। কোনদিন একটুখানি ভালমন্দ রেঁধে ওকে খাওয়াতে পারিনি। আজ ওরই দয়াতেই তোর বাবার হাতে দুটো পয়সা ছিল বলে রতীশের ভাইবোনের আসার উপলক্ষ্যে দুটো পদ রান্না করতে পারছি। মনটা খুব চাইছিল, ওর মুখেও আজ একটু খাবার তুলে দিতে। কিন্তু দেখ, ফোনটাই কাজ করছে না। ভাগ্যের দোষ ছাড়া আর কি বলব একে? আচ্ছা খোকা কি করছে রে? বেরিয়ে গেছে নাকি”?
রচনা জবাব দিল, “না মা, ভাই পড়ছে গো। আর বাইরে গেলে কি ও তোমাকে না বলে বেরোয় কখনও? আচ্ছা মা, একটা কথা বলবে? তুমি দিদিভাইকে মনে মনে খুব ভালবেসে ফেলেছ, তাই না মা”?
বিভাদেবী বললেন, “সে তো ওকে দেখার পর থেকেই ভালবেসে ফেলেছি রে। সত্যি অমন মেয়ে ক’টা হয়
বল তো? তবে ও আমাদের জন্য যা কিছু করছে তার জন্যে ওকে আরও বেশী ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু সেসব বলতে গেলে নিজেকেই স্বার্থপর বলে মনে হবে। কিন্তু এমন মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়েকে ভাল না বেসে থাকা যায়, বল? আর কী সুন্দর দেখতে! মনে হয় সাক্ষাৎ মা দুর্গা। ওর মার কথা ভেবে আমার সত্যিই হিংসে হয় রে। একেবারে রত্নগর্ভা মেয়ে। কিন্তু মন্তির কপালটা দেখ। সেদিন আমার কোলে মাথা পেতে শুয়ে কি বলেছিল, তোর মনে আছে? ওর মা নাকি কখনও ওভাবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নি! এমন একটা মেয়ে পেয়েও কোন মা তাকে আদর না করে থাকতে পারে”?
রচনা বলল, “দেখ মা, দিদিভাইকে দেখে আমারও মনে হয় সে আমার খুব আপন। তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের জন্যে দিদিভাই যা কিছু করেছেন সে’সবের জন্যই যদি আমরা তাকে ভালবেসে থাকি, তাহলে সকলেই আমাদের স্বার্থপর বলে ভাববে। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম, তখনই আমার তাকে খুব ভাল লেগেছিল। আর তার দু’দিন বাদেই কাবেরীর সাথে যখন আমাদের বাড়ি এসে হাজির হয়েছিলেন তখন তো খুশীতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমার অনেক অনেক কাছের একজন অনেকদিন বাদে আমার কাছে ফিরে এসেছেন। কিন্তু মা, দিদিভাইয়ের জীবনের কতটুকু কথা আর আমরা জানি বল? সে নিজে আমাকে অনেকবার বলেছে যে সে খুব খারাপ মেয়ে। সেদিন তোমার কোলে শোবার সময়েও তো বলছিল যে তার মা নাকি তাকে সবচেয়ে বড় অলক্ষ্মী বলে ভাবেন। তার মা যে কেন কোনদিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি, কেন তাকে অলক্ষ্মী বলে ভাবেন, সে’সব কথা তো আমাদের খুলে বলেনি। নিশ্চয়ই কোন কারন থেকে থাকবে এসবের পেছনে। কিন্তু সেসব নিয়ে ভেবে আমরা তো কোন কুল কিনারা বের করতে পারব না। তবে দিদিভাইয়ের মত মেয়ে লাখেও একটা খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। ভগবান যদি আমায় সুযোগ দেন, দিদিভাইয়ের সুখের জন্য আমি সব কিছু করার চেষ্টা করব”।
বিভাদেবী বললেন, “আমি তো সারা জীবনেও ওকে ভুলতে পারব না। কিন্তু ওর উজ্জ্বল মুখটার পেছনে একটা ব্যথাও যেন কোথাও জমা হয়ে রয়েছে, আমার এমনটাই মনে হয়। নইলে এমন অপরূপা বিদুষী একটা মেয়ের ছাব্বিশ বছর বয়স হতে চলল, অথচ তার বাবা মায়েরা তার বিয়ে দেন নি! এটা ভেবে কেন যেন ভাল লাগছে না রে”।
রচনা বলল, “আজকাল তো অনেক মেয়েই লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় মা। আর দিদিভাই লেখাপড়াতেও খুব ভাল। এখন এমএ পড়ছেন। এরপর তিনি আইপিএসে বসে পুলিশ অফিসার হবার স্বপ্ন দেখছেন। এতে দোষের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না মা। তবে বিয়ে সাদির ব্যাপারে মনে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। আমি অনেকবার ভাবলেও তার বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে পারিনি”।
এমন সময় বিধুবাবু বাড়িতে ঢুকে খুব খুশী হয়ে হাক ছাড়লেন, “রচু মা, কোথায় গেলি রে? দেখ আজ কি ভাল ইলিশ মাছ পেয়েছি রে! একেবারে পদ্মার ইলিশ। শিলিগুড়ি থেকে এনেছে এখানে” বলতে বলতে রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে এলেন। বিভাদেবী আর রচনাও ঘর থেকে বেরিয়ে মাছ দেখে খুব খুশী।
বিভাদেবী মাছটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের ভেতর ঢুকতেই বিধুবাবু রচনাকে বললেন, “ও তুইও বুঝি কাজে ব্যস্ত আছিস? তা হ্যারে মা। মন্তিমাকে কি আর ফোন করেছিলিস”?
রচনা জবাব দিল, “করেছিলাম বাবা। কিন্তু এবারেও কথা হয় নি”।
বিধুবাবু কলপাড়ের দিকে যেতে যেতে নিজে নিজেই বললেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার! এমনটা তো কখনও হয়নি”।
রচনা রান্নাঘরে ঢুকে আবার নিজের কাজে হাত দিল। খানিকক্ষণ বাদে কিংশুক রান্নাঘরে ঢুকতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “কিরে ভাই? পড়া শেষ হয়েছে তোর? এখন কি বেরোবি”?
কিংশুক বলল, “নারে ছোড়দি, আজ এ বেলা আর বেরোব না। তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। আমাকে না দেখলে তারা খারাপ পাবেন না? আমি এখন দিদিভাইয়ের দেওয়া ভিডিও গেম খেলব। মা তুমি কিন্তু বারণ কোর না”।
বিভাদেবী বললেন, “ঠিক আছে খেলগে যা”।
______________________________