24-02-2020, 09:06 PM
(Update No. 45)
শনিবার বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ সীমন্তিনী কালচিনি ষ্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে অটো স্ট্যাণ্ডের দিকে এগোতেই একপাশ থেকে রচনা তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনী প্রথমে দারুণভাবে চমকে উঠলেও ডানহাতের কনুইটা উচিয়ে ধরে পেছনে আঘাত হানবার আগেই তার পেছন থেকে কাউকে ‘দিদিভাই’ বলে ডাকতে শুনেই সে হাত নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চোখের একেবারে সামনে রচনার মুখটা দেখতে পেয়ে বলল, “রচু তুই? আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলিস তুই। ইশ, এখনও আমার বুকটা কাঁপছে। তুই ষ্টেশনে এসেছিস কেন? আমি তো একাই বাড়ি যেতে পারতুম”।
রচনা এবার সামনে ঘুরে এসে সীমন্তিনীর হাত ধরে হেসে বলল, “তুমি এত কষ্ট করে এতদুর আসছ, আর আমরা বাড়ি থেকে ষ্টেশন পর্যন্ত এটুকু রাস্তা আসতে পারব না? আর দেখ, আমি একা নই। ভাইও এসেছে আমার সাথে”।
সীমন্তিনী এতক্ষণে কিংশুককে দেখতে পেল রচনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর তার হাত ধরে টেনে কাছে এনে বলল, “কেমন আছ ভাই”?
কিংশুক খুশী গলায় বলল, “ভাল আছি দিদিভাই, আর তোমাকে দেখে তো এখন আরও ভাল লাগছে”।
সীমন্তিনী কিংশুকের গালটা আদর করে টিপে দিয়ে বলল, “চল রচু। এখানে বেশীক্ষণ এই ভিড়ের মধ্যে থাকা ঠিক হবে না। তা হ্যারে, মাসি মেসো সবাই ভাল আছেন তো”?
বিভাদেবী আর বিধুভূষন বাবু বেশ আগ্রহ সহকারে বাইরের বারান্দায় বসে প্রতীক্ষা করছিলেন সীমন্তিনীর জন্য। বিধুবাবু আজ তাড়াতাড়িই সকালের বাজার করে এনেছেন। বাজারে আজ খুব ভাল ইলিশ মাছ উঠেছিল। খুব লোভ হওয়া সত্বেও হাতে বেশী পয়সা ছিল না বলে, তা আর আনতে পারেন নি। আর বিভাদেবীও সীমন্তিনীর ফরমাশ মত মুগের ডাল রেঁধেছেন। সাথে একটা নিরামিষ তরকারী করেছেন। আর মিষ্টি কুমড়োর ফুলের বড়া বানাবার জন্যে সব কিছু তৈরী করে রেখেছেন। খাবার আগে আগে গরম গরম ভেজে দেবেন বলে।
গেটের বাইরে একটা অটো এসে থামতেই বিধুবাবু বললেন, “ওই তো এসে গেছে ওরা” বলে বারান্দা থেকে নামলেন। বিভাদেবীও স্বামীর পেছন পেছন রওনা হতেই কিংশুক ছুটে এসে বলল, “মা, দিদিভাই এসে গেছেন। এস এস”।
কিংশুক মায়ের হাত ধরে গেটের দিকে যেতে যেতে বলল, “মা দিদিভাইকে আজ যে কী সুন্দর লাগছেনা দেখতে, কি বলব তোমাকে”।
সীমন্তিনী অটো ভাড়া দিয়ে বাড়ির গেটের দিকে ফিরতেই রচনা তার হাত ধরে বলল, “এসো দিদিভাই”।
দু’পা এগোতেই বিভাদেবী সামনে এসে সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এসেছিস মা? আয়। হ্যারে রাস্তায় কোন অসুবিধে হয়নি তো”?
সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে প্রণাম করে বলল, “না মাসি, কোন সমস্যা হয়নি। আমার জন্যে মিষ্টি কুমড়ো ফুলের বড়া করেছ তো তুমি”?
বিভাদেবী হেসে বললেন, “হ্যারে হ্যা, করেছি। তুই আগে চানটা সেরে ফ্যাল। তারপরই খেতে দেব। কথাবার্তা যা আছে সে খাবার পর হবে। এই রচু, তোর দিদিভাইকে চানঘরের সবকিছু দেখিয়ে টেখিয়ে দিস। আর বালতি গুলোতে দু’বালতি জল তুলে দিস”।
বিধুবাবু বললেন, “জান মন্তি মা, তুমি যে সত্যি সত্যি আমাদের ডাকে চলে আসবে, সেটা মনে মনে আশা করলেও ঠিক ভরসা করে উঠতে পারছিলুম না। মুখে তো কতজনেই কতকিছু বলে। কিন্তু সে’সব কথা আর ক’জন মনে রাখে বল। তবে তুমি, আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছ যে তুমি আর দশজনের মত নও। যাও মা। ঘরে গিয়ে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে চান করে এস। খেয়েদেয়ে আমরা কথা বলব। আমার আবার বিকেলের দিকে এক যজমানের বাড়ি যেতে হবে শনিপূজো করতে। রচু, খোকা, তোরা আর দিদিভাইকে এখন বিরক্ত করিসনে যেন। কতটা পথ আসতে হয়েছে ওকে। ওর নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। আগে ওকে চানটান করে খেয়ে নিতে দে। যাও মা, ঘরে যাও”।
রচনার সাথে তার ঘরে ঢুকেই সীমন্তিনী দু’হাতে রচনার মুখটা অঞ্জলি করে ধরে বলল, “একটু দাঁড়া। আগে আমার মিষ্টি বোনটাকে দু’চোখ ভরে দেখে নিই একটু” বলে রচনার সুন্দর মুখটাকে দেখতে দেখতে বলল, “একি রে রচু? বিয়ের সম্মন্ধ আসতে না আসতেই দেখি তোর রূপ খুলতে শুরু করেছে রে! কী দারুণ লাগছে তোকে দেখতে রে? ইশ মেয়ে জীবনে আজ প্রথমবার আফশোস হচ্ছে রে। আমি ছেলে হলে নিজেই তোকে বিয়ে করে নিয়ে যেতুম রে”।
রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ধ্যাত দিদিভাই। আমার চেয়ে তুমি ঢের ঢের বেশী সুন্দরী। মা, বাবা, ভাই সবাই সে কথা বলেন”।
সীমন্তিনী রচনার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর করে একটা চুমু খেয়ে বলল, “তারা সবাই তোকে সব সময় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন বলেই তোর রূপ বিচার করেন না। কিন্তু আমার চোখে তুই আমার চেয়ে অনেক বেশী মিষ্টি, অনেক বেশী সুন্দরী”।
রচনা নিজেকে সীমন্তিনীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “হ্যা ঠিক আছে। এখন ও’সব কথা ছাড় দেখি। ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। তুমি চানে যেতে দেরী করলে কিন্তু আমিই মা বাবার কাছে বকুনি খাব এখন”।
বিভাদেবীর হাতের সাধারণ রান্নাও যে কতটা অসাধারণ হতে পারে, সে কথা সীমন্তিনী আরেকবার বুঝল। পরম তৃপ্তি সহকারে সে পেট ভরে খেল। তার মনে হল এমন সুস্বাদু খাবার সে বুঝি আর আগে কখনও খায়নি। বিধুবাবু আর বিভাদেবীর খাওয়া শেষ হবার পর কিংশুক সীমন্তিনীর কাছে এসে বলল, “ও দিদিভাই। এখন তো তুমি মা বাবার সাথে গল্প করতে বসবে জানি। আমি ততক্ষণে একটু মাঠে খেলে আসি”?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কী খেলতে যাবে ভাই? ক্রিকেট”?
কিংশুক বলল, “আজ ফুটবল খেলব গো দিদিভাই। ক্রিকেট ভাল লাগলেও বেশী খেলি না। অনেক সময় লাগে এক একটা ম্যাচ শেষ হতে। পড়াশোনার ক্ষতি হয়। আমি বেশীর ভাগ ব্যাডমিন্টন আর ফুটবলই খেলি সে জন্যে। বাবা বেরিয়ে যাবার আগেই বাড়ি চলে আসব। তুমি রাগ করবে না তো”?
সীমন্তিনী আদরের সুরে বলল, “ঠিক আছে ভাই। খেলে এসো তুমি। কিন্তু আমি তো বিকেলের শেষ গাড়িতে চলে যাব। তার আগে আসবে তো তুমি”?
কিংশুক হেসে বলল, “ও’সব কথা বলে আজ পার পাবেনা গো দিদিভাই। আজ তোমার যাওয়া হচ্ছে না। আজ রাতে তুমি আমাদের এখানেই থাকবে। মা-ই তোমাকে যেতে দেবেন না আজ, আমি জানি। তবে আমিও সন্ধ্যের আগেই চলে আসব। তারপর তোমার সাথে গল্প করব। আসছি আমি”।
কিংশুক বেরিয়ে যাবার প্রায় সাথে সাথেই বিধুবাবু বারান্দা থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি একটু শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবে মন্তিমা”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “না না মেসো। আমি দিনের বেলায় কখনও শুই না। তুমি এস না ভেতরে”।
বিধুবাবুর সাথে সাথে বিভাদেবীও ঘরে এসে ঢুকলেন। রচনা কিংশুকের পড়ার টেবিলের কাছ থেকে চেয়ারটা টেনে এনে বলল, “বাবা, তুমি এখানে বস। আমি মা আর দিদিভাই বিছানায় উঠে বসছি”।
সীমন্তিনী বলল, “রচু সেদিন ফোন করে বলল, কোন পাত্রপক্ষ নাকি ওকে দেখতে এসেছিল”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাগো মা। আর আমিই ওকে বলেছিলাম তোমাকে ফোন করতে। ক’দিন আগেই তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, যে রচুর কোন সম্মন্ধ এলে সবার আগে তোমাকে জানাব। তাই মনে হয়েছিল তোমাকে কথাটা জানান উচিৎ। কিন্তু সে’কথা শুনে তুমি যে সত্যি সত্যি চলে এসেছ, সে জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মা”।
সীমন্তিনী বলল, “মেসো, আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন তুমি? মেয়েকে কি কোন বাবা ধন্যবাদ দেন নাকি? ও’সব ছেড়ে আসল কথাটা বল দেখি। কে এসেছিল? তারা কোথাকার লোক? রচু তো জায়গার নামটাও ঠিক মত বলতে পারেনি আমাকে। বলল রাজাগাঞ্জ না রানিগঞ্জ। রানিগঞ্জ বলে তো একটা জায়গা আছে, দুর্গাপুরের কাছাকাছি। তা তারা কি সেখানকারই বাসিন্দা”?
বিধুবাবু বললেন, “না মা তা নয়। রচু বুঝি তোমাকে ঠিকমত বলতে পারেনি। যারা এসেছিলেন তারা
রাজগঞ্জের লোক। জলপাইগুড়ির খুব কাছেই নাকি জায়গাটা”।
সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “রাজগঞ্জ? সে তো আমাদেরই জায়গা গো মেসো। আমাদের আসল বাড়ি তো রাজগঞ্জেই। তা রাজগঞ্জের অনেক লোককেই তো আমি চিনি। ছেলের নাম কি বলেছে গো ওনারা”?
বিধুবাবু বললেন, “পাত্রের নাম তো বলল রতীশ ভট্টাচার্যি”।
সীমন্তিনী প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কি বললে? রতীশ ভট্টাচার্যি? তার বাবার নাম রতিকান্ত ভট্টাচার্যি”?
বিধুবাবুও সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “হ্যা মা। তাই। তুমি চেন নাকি তাদের”?
সীমন্তিনী আগের মতই উচ্ছ্বল গলায় বলল, “মেসো, চিনব না মানে? খুব ভাল করে চিনি গো। রতীশ আর আমি তো একসাথে কলেজে পড়তাম। আমার সহপাঠী ছিল। খুবই ভাল ছেলে। কিন্তু মেসো, ছেলেটা তো আমার বয়সীই। রচনার তো কেবল সতের চলছে। প্রায় বছর সাতেকের মত তফাৎ হবে দু’জনের”।
এবার বিভাদেবী বললেন, “স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সাত আট বছরের ব্যবধান থাকাই ভাল। এর বেশী হলেও খারাপ, আর ব্যবধান এর কম থাকাও ভাল নয়। তা মা, তুমি ওদের ব্যাপারে কতটা কি জান, সেটা বল তো”?
সীমন্তিনী বলল, “মাসি, ছেলের ব্যাপারে তো আমি একেবারে নিশ্চিত যে ও খুবই ভাল ও সৎ ছেলে। কলেজ জীবনে পড়াশোনায় খুব বেশী যে ভাল ছিল, তা নয়। তবে কখনও পরীক্ষায় ফেল টেলও করেনি। কিন্তু খেলাধুলো আর যোগা ব্যায়ামে খুব এক্সপার্ট ছিল। মাধ্যমিক পাশ করবার পর আমি জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলাম। আর রতীশ দেরাদুনে একটা কলেজে পড়তে গিয়েছিল। বছর চারেক আগে দেরাদুন থেকে ইকোনমিক্স অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। মাস খানেক আগেই ওর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল একদিন আমার। তখন ওর মুখেই শুনলাম যে ও নাকি বিএ পাশ করবার সাথে সাথে কয়েকটা বড় বড় যোগা ডিগ্রীও নিয়ে এসেছে। হরিদ্বারের একটা ইনিস্টিটিউট থেকে ওকে যোগাশাস্ত্রী না কি একটা যেন উপাধিও দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের ওখানের হায়ার সেকেণ্ডারী কলেজেই সে বছর দুয়েক ধরে টিচারী করছে। আমরাও ওই কলেজ থেকেই মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে এসেছিলুম। খুবই ভাল ছেলে মেসো। যেমন দেখতে, তেমনি চমৎকার গায়ের রং আর উচ্চতা। স্বাস্থ্যও খুল ভাল। লম্বায় আমার সমান সমান। ওকে নিজেদের জামাই করবার জন্যে আশেপাশের অনেক মেয়ের বাবামা-ই তো মুখিয়ে আছে। কিন্তু ওর বাড়ি থেকে না কি কেউ কোন সাড়া দেয়নি”।
বিধুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো তাহলে ওকে খুব ভাল ভাবেই চেনো মা। তা ওদের বাড়িঘর বা বাড়ির লোকজনেরা কেমন, সে বিষয়ে কিছু জানো তুমি”?
সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “কলেজে পড়ার সময় রতীশের সাথে মাঝে মধ্যেই ওদের বাড়ি যেতুম আমরা
মেসো। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করে আমিও জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলুম আর রতীশও দেরাদুন চলে গিয়েছিল বলে তারপর আর সেভাবে যাওয়া আসা হয়নি। তবে পূজো পার্বনে রতীশদের বাড়ির অনেকের সাথেই তো দেখা হয়। রতীশের মা তো আমাকে খুব ভালবাসেন। খুব ভাল ভদ্রমহিলা। ওহ উনি তো এসেছিলেন এখানে শুনেছি, তাই না”?
বিভাদেবী বললেন, “হ্যা মা। ছেলের বাবা, মা আর ছোটকাকু এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। ভদ্রমহিলাকে দেখে আমাদেরও বেশ ভাল লেগেছে। কিন্তু শুধু পাত্রপক্ষ আর ঘটকের মুখের কথায় বিশ্বেস করে আমাদের বড়মেয়েটার ওভাবে বিয়ে দিয়ে যে আমরা যে ভুল করেছি, তার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাইনে আমরা। আর তুমিও সেদিন আমাদের যেভাবে ভরসা দিয়েছ, তাতে আমরা চাই রচুর বিয়েটা আমরা একটু ভাল ভাবে খোঁজ খবর নিয়েই দেব”।
বিধুবাবু বললেন, “হ্যা মা। আমাদের সামর্থ্য বলতে তো প্রায় কিছুই নেই। আর যার কপালে বিধাতা যা লিখে দিয়েছেন, তাকে তো সেটাই ভোগ করতে হবে। রচুর কপালেও যদি অর্চুর মতো দুঃখই লেখা থাকে তাহলে তা আর কে খণ্ডাবে বল। কিন্তু একবার যে ভুলটা আমরা করেছি সেটা আর দ্বিতীয়বার করতে চাইনে। তারপর ওর কপালে যা আছে, তাই তো হবে”।
সীমন্তিনী একহাতে রচনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে আদর করে বলল, “মেসো। তোমাদের বড়মেয়ের বিয়ের আগে তোমাদের সাথে যদি আমার পরিচয় হত, তবে ব্যাপারটা হয়ত অন্যরকম হত। কিন্তু যা হবার ছিল সেটাই হয়েছে। কিন্তু রচুর ব্যাপারে যে আমি ভাল করে ছেলেপক্ষের খবরাখবর নেব এ’কথা তো সেদিনই তোমাদের বলেছিলাম আমি। আর সে জন্যেই আজ এসেছি আমি। তবে এ পাত্রের নাম শুনেই বলছি আমাকে আলাদা করে খুব বেশী খবর যোগাড় করতে হবে না। ওকে তো আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। শোনো মেসো। ছেলের বাবারা তিনভাই। সবাই জয়েন্ট ফ্যামিলীতে থাকে। তাদের বড়ভাইয়ের নাম রতিকান্ত ভট্টাচার্যি, মেজ ভাই শশীকান্ত বাবু, আর ছোট ভাই চন্দ্রকান্ত বাবু। বাড়ির তিন বৌয়ের মধ্যেও প্রচণ্ড ভাব ভালবাসা। রতিকান্তবাবুর দু’ ছেলে। বড়টিই হচ্ছে রতীশ। শশীকান্ত বাবুর এক মেয়ে এক ছেলে, আর চন্দ্রকান্তবাবুরও তাই এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেমেয়েগুলোও সবাই সবাইকে খুব ভালবাসে। ওদের পাড়ার অনেক লোকও বুঝতে পারে না ও বাড়ির ছেলে মেয়েরা কে কোন ঘরের। আমিও তো প্রথম প্রথম বুঝতে পারতুম না কে রতীশের নিজের ভাই বোন আর কে খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সবাইকে দেখেই মনে হত যেন এক মায়ের পেটের ভাইবোন সবাই। সবাই সবাইকে খুব ভালবাসে। অমন ভাল পরিবার আমাদের ও তল্লাটে বুঝি আর একটাও নেই। রাজগঞ্জের সকলেই একডাকে তাদের পরিবারকে চেনে। আর সে জন্যেই সব ', পরিবারই সে পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে চায়”।
বিভাদেবী খুব খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি বলছিস মা তুই”?
সীমন্তিনী বলল, “সত্যি বলছি মানে? তুমি কি ভাবছ আমি মিথ্যে কথা বলছি? আসলে রতীশের কথা শুনেই আমি এতটাই খুশী হয়েছি যে তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না মাসি। ওদের পরিবার সম্বন্ধে আমি এত কথা বলতে পারি যে রাত কাবার হয়ে যাবে। তোমরাই শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে উঠবে। আর এতকিছু বলছি বলেই হয়ত তোমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে”।
বিভাদেবী হাত বাড়িয়ে সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বললেন, “নারে মা, ও’কথা বলিসনে। জানিসনা? কথায় বলে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে দেখেই ভয় পায়। আমাদের অবস্থাও ঠিক তাইরে”।
বিধুবাবু বললেন, “হ্যা মন্তিমা। আমাদের অবস্থা ঠিক তাই। তুমি তোমার মাসির কথায় কিছু মনে করো না। আচ্ছা মা, তোমার কথায় তো বুঝতেই পারছি তুমি তাদের পরিবারকে খুব ভাল ভাবে চেনো। ওই পরিবারের লোকদের মধ্যে ভাব ভালবাসা খুব ভাল। তাই পরিবার নিয়ে আর মনে কোন চিন্তা রইল না। কিন্তু মা তাদের আর্থিক অবস্থা বা আচার ব্যবহার নিয়ে কিছু জানা আছে কি তোমার”?
সীমন্তিনী বলল, “মেসো ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই খুব অমায়িক গো। তোমরা তো তিনজনকে দেখেছ। তোমাদের কেমন লেগেছে তাদের”?
বিধুবাবু বললেন, “ওই তিনজনকে তো আমাদেরও খুব ভদ্র বলে মনে হয়েছে। আর বলতে বাঁধা নেই। বেশ অমায়িকও মনে হয়েছে। নইলে মেয়ে দেখতে এসে কেউ অতগুলো ফলমূল আর মিষ্টি নিয়ে আসে? হয়ত আমাদের হত দরিদ্র অবস্থার কথা শুনেই তারা ও’সব নিয়ে এসেছিলেন। আর এমন সময়ে এসেছিলেন যে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার নিয়েও আমাদের কোন দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। তারা দুপুরের খাবার খেয়েই এখানে এসেছিলেন। অমায়িক না হলে কি আর এমনটা কেউ করে”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যা মেসো, তুমি ঠিক বলেছ। শুধু রতীশের বড় কাকা, মানে শশীকান্ত বাবুই একটু বেশী গম্ভীর প্রকৃতির। আর শশীকান্তবাবুর ছেলে, মানে রতীশের মেজকাকার ছেলে। সেও অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনায় একটু কম কথা বলে। কিন্তু তাই বলে তাদেরও কেউ খারাপ বলতে পারবে না। ওই এলাকার সকলের সাথেই তাদের সকলেরই খুব ভাল সম্পর্ক। আর আর্থিক দিক দিয়ে বলছি। রাজগঞ্জ হাটে বেশ বড়সড় একটা নিজস্ব কমপ্লেক্সে তাদের তিন ভাইয়ের পাঁচটি বড় বড় দোকান। রতিকান্ত বাবুর বিশাল মুদি দোকান। শশীকান্ত বাবুর খুব বড় স্টেশনারী দোকান। আর ছোটভাই চন্দ্রকান্ত বাবুর একটা বড় ওষুধের দোকান, একটা পিসিও ফটোস্ট্যাটের দোকান আর একটা কম্পিউটারের দোকান আছে। সব ক’টা দোকানের ব্যবসাই খুব ভাল। তাই বুঝতেই পারছ তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই ভাল। আর ব্যবসা করলেও তারা লোক ঠকিয়ে টাকা উপার্জন করেন না বলে, যে কোন দোকানের চেয়ে তাদের তিন ভাইয়ের দোকান গুলোর ওপর লোকজনের একটা অন্য রকম আস্থা আছে। তাই তাদের দোকানের কাস্টমার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আর এলাকার সকলেই তাদের ওপর খুব বিশ্বাস করে। প্রত্যেকের দোকানেই দু’তিনজন করে কর্মচারী আছে। কয়েকটা কর্মচারী তো তাদের বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করে। এছাড়া বাড়িতে রান্নার লোক, কাজের ঝি, চাকর আর বাগানের মালীও আছে। জমিজমাও আছে বেশ কিছু। চাষ বাস করবার লোকও রেখেছে তারা। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা মেসো। ওই বাড়ির ছোট বড় কারুর ভেতরেই অহঙ্কার বলতে কিছু নেই। গরীব হোক পয়সাওয়ালা হোক সকলের সাথেই তারা সকলে একই রকম আন্তরিক ব্যবহার করে থাকে”।
বিধুবাবু বললেন, “তাই নাকি মা? আমার মেয়ে গুলোর জন্যে মনে মনে আমি যে এমনই পরিবার খুঁজে বিয়ে দিতে চাইছিলাম। অর্চুর জীবনটা আমি নিজে নষ্ট করে ফেলেছি। রচুকে যদি এমন একটা পরিবারের বৌ করে পাঠাতে পারি, তাহলে আমার চেয়ে খুশী আর কে হবে বল মা”।
বিভাদেবী বললেন, “হ্যাগো, ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু আমাদের রচু কি এত ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? ওরা যদি যৌতুক চেয়ে বসে তাহলে আমরা কী করব? আমরা যে ওকে পড়বার জন্যে দুটো ভাল শাড়িও দিতে পারব না”।
সীমন্তিনী বলল, “মাসি, তুমি এখনই ওসব নিয়ে ভাবছ কেন বল তো? আগে তোমরা সবাই ভাল করে ভেবে দেখ, ওই ছেলের সাথে রচুর বিয়ে দিতে তোমরা রাজি আছ কিনা। তারপর তো সেসব প্রশ্ন আসছে। তোমরা রাজি থাকলে, আমিও গিয়ে তাদের সাথে কথা বলব। তাদের সকলকেই তো আমি চিনি। আর আমাকেও তারা খুব স্নেহ করেন। রতীশ তো আমার সহপাঠী বন্ধু। আলাপ আলোচনা করে দেখা যাবে। আর এটা মনে রেখ, রচুকেও তো আমি আমার নিজের বোনের মত ভালবাসি। আমিও আমার সাধ্যমত সব কিছু করব। সব সময় তোমাদের পাশে থাকব আমি। তাই ও’সব নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা কোর না”।
বিধুবাবু বললেন, “মন্তি মা। তোমাকে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু এ মূহুর্তে কথাটা বললে সেটা শুনে তুমি হয়ত আমাকে চরম স্বার্থপর বলে ভাবতে পার। কিন্তু তবু বলছি মা। সেদিন তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমার মনে হয়েছিল আমার জীর্ন কূটিরে বুঝি সত্যি সত্যি এতদিনে মা লক্ষীর আগমন হয়েছে”।
সীমন্তিনী বলল, “ছিঃ ছিঃ মেসো। তুমি কেন এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিচ্ছ বল তো? আমার মা বাবা আমাকে বলেন আমি নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অলক্ষী মেয়ে। ছোটবেলা থেকে এ’কথা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি আমি। আচ্ছা, ওসব কথা ছাড়ো। শোন, আমাকে তো পাঁচটার বাসটা ধরতে হবেই। ছেলের বাড়ির ঠিকানাটা নেবার জন্যই শুধু এসেছিলুম। তা যে ছেলের কথা শুনলুম তাতে তো দেখছি আমাকে আর আলাদা করে কোন খবর যোগাড় করার চেষ্টাই করতে হবে না। আমার তো আগে থাকতেই এ ছেলের বাড়ির সকলের খবরাখবর জানা। তাই আর এখানে থাকবার প্রয়োজন নেই। তোমরা এক কাজ কর মাসি। দু’একটা দিন ভাল করে এ সম্মন্ধের ব্যাপারটা ভেবে দেখ। দাবি-দাওয়া যৌতুকের কথা ভেবে আগে থেকেই মুষড়ে পড়ো না। সেটা আপাততঃ না হয় আমার ওপর ছেড়ে দাও। তোমরা নিজেদের মনস্থির কর। আর যদি দেখ তোমরা মনস্থির করতে পেরেছ, তাহলে আমাকে একটু ফোন করে বলে দিও। আর ছেলের বাড়িতেও খবরটা জানিয়ে দিয়ে তোমরা গিয়ে ছেলের বাড়ি ঘর দেখে তার বাড়ির লোকজনদের সাথে কথা বার্তা বলে এস। বিয়েটা তো আর এখুনি হচ্ছে না। রচু বারো ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষাটা না দেওয়া অব্দি তো বিয়েটা হচ্ছে না। আর সে’কথা তো তাদের আগেই বলা হয়েছে। মনে হয় তারা সেটা মেনেও নেবেন। আর সেটা হলে হাতে তো বছর খানেক সময় পাচ্ছি আমরা। দাবি দাওয়া যৌতুক টৌতুক নিয়ে ভাববার বেশ কিছুটা সময় আমরা পাব। আর বললামই তো সে ব্যাপারটা আমি দেখব”।
______________________________
শনিবার বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ সীমন্তিনী কালচিনি ষ্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে অটো স্ট্যাণ্ডের দিকে এগোতেই একপাশ থেকে রচনা তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনী প্রথমে দারুণভাবে চমকে উঠলেও ডানহাতের কনুইটা উচিয়ে ধরে পেছনে আঘাত হানবার আগেই তার পেছন থেকে কাউকে ‘দিদিভাই’ বলে ডাকতে শুনেই সে হাত নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চোখের একেবারে সামনে রচনার মুখটা দেখতে পেয়ে বলল, “রচু তুই? আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলিস তুই। ইশ, এখনও আমার বুকটা কাঁপছে। তুই ষ্টেশনে এসেছিস কেন? আমি তো একাই বাড়ি যেতে পারতুম”।
রচনা এবার সামনে ঘুরে এসে সীমন্তিনীর হাত ধরে হেসে বলল, “তুমি এত কষ্ট করে এতদুর আসছ, আর আমরা বাড়ি থেকে ষ্টেশন পর্যন্ত এটুকু রাস্তা আসতে পারব না? আর দেখ, আমি একা নই। ভাইও এসেছে আমার সাথে”।
সীমন্তিনী এতক্ষণে কিংশুককে দেখতে পেল রচনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর তার হাত ধরে টেনে কাছে এনে বলল, “কেমন আছ ভাই”?
কিংশুক খুশী গলায় বলল, “ভাল আছি দিদিভাই, আর তোমাকে দেখে তো এখন আরও ভাল লাগছে”।
সীমন্তিনী কিংশুকের গালটা আদর করে টিপে দিয়ে বলল, “চল রচু। এখানে বেশীক্ষণ এই ভিড়ের মধ্যে থাকা ঠিক হবে না। তা হ্যারে, মাসি মেসো সবাই ভাল আছেন তো”?
বিভাদেবী আর বিধুভূষন বাবু বেশ আগ্রহ সহকারে বাইরের বারান্দায় বসে প্রতীক্ষা করছিলেন সীমন্তিনীর জন্য। বিধুবাবু আজ তাড়াতাড়িই সকালের বাজার করে এনেছেন। বাজারে আজ খুব ভাল ইলিশ মাছ উঠেছিল। খুব লোভ হওয়া সত্বেও হাতে বেশী পয়সা ছিল না বলে, তা আর আনতে পারেন নি। আর বিভাদেবীও সীমন্তিনীর ফরমাশ মত মুগের ডাল রেঁধেছেন। সাথে একটা নিরামিষ তরকারী করেছেন। আর মিষ্টি কুমড়োর ফুলের বড়া বানাবার জন্যে সব কিছু তৈরী করে রেখেছেন। খাবার আগে আগে গরম গরম ভেজে দেবেন বলে।
গেটের বাইরে একটা অটো এসে থামতেই বিধুবাবু বললেন, “ওই তো এসে গেছে ওরা” বলে বারান্দা থেকে নামলেন। বিভাদেবীও স্বামীর পেছন পেছন রওনা হতেই কিংশুক ছুটে এসে বলল, “মা, দিদিভাই এসে গেছেন। এস এস”।
কিংশুক মায়ের হাত ধরে গেটের দিকে যেতে যেতে বলল, “মা দিদিভাইকে আজ যে কী সুন্দর লাগছেনা দেখতে, কি বলব তোমাকে”।
সীমন্তিনী অটো ভাড়া দিয়ে বাড়ির গেটের দিকে ফিরতেই রচনা তার হাত ধরে বলল, “এসো দিদিভাই”।
দু’পা এগোতেই বিভাদেবী সামনে এসে সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এসেছিস মা? আয়। হ্যারে রাস্তায় কোন অসুবিধে হয়নি তো”?
সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে প্রণাম করে বলল, “না মাসি, কোন সমস্যা হয়নি। আমার জন্যে মিষ্টি কুমড়ো ফুলের বড়া করেছ তো তুমি”?
বিভাদেবী হেসে বললেন, “হ্যারে হ্যা, করেছি। তুই আগে চানটা সেরে ফ্যাল। তারপরই খেতে দেব। কথাবার্তা যা আছে সে খাবার পর হবে। এই রচু, তোর দিদিভাইকে চানঘরের সবকিছু দেখিয়ে টেখিয়ে দিস। আর বালতি গুলোতে দু’বালতি জল তুলে দিস”।
বিধুবাবু বললেন, “জান মন্তি মা, তুমি যে সত্যি সত্যি আমাদের ডাকে চলে আসবে, সেটা মনে মনে আশা করলেও ঠিক ভরসা করে উঠতে পারছিলুম না। মুখে তো কতজনেই কতকিছু বলে। কিন্তু সে’সব কথা আর ক’জন মনে রাখে বল। তবে তুমি, আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছ যে তুমি আর দশজনের মত নও। যাও মা। ঘরে গিয়ে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে চান করে এস। খেয়েদেয়ে আমরা কথা বলব। আমার আবার বিকেলের দিকে এক যজমানের বাড়ি যেতে হবে শনিপূজো করতে। রচু, খোকা, তোরা আর দিদিভাইকে এখন বিরক্ত করিসনে যেন। কতটা পথ আসতে হয়েছে ওকে। ওর নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। আগে ওকে চানটান করে খেয়ে নিতে দে। যাও মা, ঘরে যাও”।
রচনার সাথে তার ঘরে ঢুকেই সীমন্তিনী দু’হাতে রচনার মুখটা অঞ্জলি করে ধরে বলল, “একটু দাঁড়া। আগে আমার মিষ্টি বোনটাকে দু’চোখ ভরে দেখে নিই একটু” বলে রচনার সুন্দর মুখটাকে দেখতে দেখতে বলল, “একি রে রচু? বিয়ের সম্মন্ধ আসতে না আসতেই দেখি তোর রূপ খুলতে শুরু করেছে রে! কী দারুণ লাগছে তোকে দেখতে রে? ইশ মেয়ে জীবনে আজ প্রথমবার আফশোস হচ্ছে রে। আমি ছেলে হলে নিজেই তোকে বিয়ে করে নিয়ে যেতুম রে”।
রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ধ্যাত দিদিভাই। আমার চেয়ে তুমি ঢের ঢের বেশী সুন্দরী। মা, বাবা, ভাই সবাই সে কথা বলেন”।
সীমন্তিনী রচনার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর করে একটা চুমু খেয়ে বলল, “তারা সবাই তোকে সব সময় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন বলেই তোর রূপ বিচার করেন না। কিন্তু আমার চোখে তুই আমার চেয়ে অনেক বেশী মিষ্টি, অনেক বেশী সুন্দরী”।
রচনা নিজেকে সীমন্তিনীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “হ্যা ঠিক আছে। এখন ও’সব কথা ছাড় দেখি। ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। তুমি চানে যেতে দেরী করলে কিন্তু আমিই মা বাবার কাছে বকুনি খাব এখন”।
বিভাদেবীর হাতের সাধারণ রান্নাও যে কতটা অসাধারণ হতে পারে, সে কথা সীমন্তিনী আরেকবার বুঝল। পরম তৃপ্তি সহকারে সে পেট ভরে খেল। তার মনে হল এমন সুস্বাদু খাবার সে বুঝি আর আগে কখনও খায়নি। বিধুবাবু আর বিভাদেবীর খাওয়া শেষ হবার পর কিংশুক সীমন্তিনীর কাছে এসে বলল, “ও দিদিভাই। এখন তো তুমি মা বাবার সাথে গল্প করতে বসবে জানি। আমি ততক্ষণে একটু মাঠে খেলে আসি”?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কী খেলতে যাবে ভাই? ক্রিকেট”?
কিংশুক বলল, “আজ ফুটবল খেলব গো দিদিভাই। ক্রিকেট ভাল লাগলেও বেশী খেলি না। অনেক সময় লাগে এক একটা ম্যাচ শেষ হতে। পড়াশোনার ক্ষতি হয়। আমি বেশীর ভাগ ব্যাডমিন্টন আর ফুটবলই খেলি সে জন্যে। বাবা বেরিয়ে যাবার আগেই বাড়ি চলে আসব। তুমি রাগ করবে না তো”?
সীমন্তিনী আদরের সুরে বলল, “ঠিক আছে ভাই। খেলে এসো তুমি। কিন্তু আমি তো বিকেলের শেষ গাড়িতে চলে যাব। তার আগে আসবে তো তুমি”?
কিংশুক হেসে বলল, “ও’সব কথা বলে আজ পার পাবেনা গো দিদিভাই। আজ তোমার যাওয়া হচ্ছে না। আজ রাতে তুমি আমাদের এখানেই থাকবে। মা-ই তোমাকে যেতে দেবেন না আজ, আমি জানি। তবে আমিও সন্ধ্যের আগেই চলে আসব। তারপর তোমার সাথে গল্প করব। আসছি আমি”।
কিংশুক বেরিয়ে যাবার প্রায় সাথে সাথেই বিধুবাবু বারান্দা থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি একটু শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবে মন্তিমা”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “না না মেসো। আমি দিনের বেলায় কখনও শুই না। তুমি এস না ভেতরে”।
বিধুবাবুর সাথে সাথে বিভাদেবীও ঘরে এসে ঢুকলেন। রচনা কিংশুকের পড়ার টেবিলের কাছ থেকে চেয়ারটা টেনে এনে বলল, “বাবা, তুমি এখানে বস। আমি মা আর দিদিভাই বিছানায় উঠে বসছি”।
সীমন্তিনী বলল, “রচু সেদিন ফোন করে বলল, কোন পাত্রপক্ষ নাকি ওকে দেখতে এসেছিল”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাগো মা। আর আমিই ওকে বলেছিলাম তোমাকে ফোন করতে। ক’দিন আগেই তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, যে রচুর কোন সম্মন্ধ এলে সবার আগে তোমাকে জানাব। তাই মনে হয়েছিল তোমাকে কথাটা জানান উচিৎ। কিন্তু সে’কথা শুনে তুমি যে সত্যি সত্যি চলে এসেছ, সে জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মা”।
সীমন্তিনী বলল, “মেসো, আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন তুমি? মেয়েকে কি কোন বাবা ধন্যবাদ দেন নাকি? ও’সব ছেড়ে আসল কথাটা বল দেখি। কে এসেছিল? তারা কোথাকার লোক? রচু তো জায়গার নামটাও ঠিক মত বলতে পারেনি আমাকে। বলল রাজাগাঞ্জ না রানিগঞ্জ। রানিগঞ্জ বলে তো একটা জায়গা আছে, দুর্গাপুরের কাছাকাছি। তা তারা কি সেখানকারই বাসিন্দা”?
বিধুবাবু বললেন, “না মা তা নয়। রচু বুঝি তোমাকে ঠিকমত বলতে পারেনি। যারা এসেছিলেন তারা
রাজগঞ্জের লোক। জলপাইগুড়ির খুব কাছেই নাকি জায়গাটা”।
সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “রাজগঞ্জ? সে তো আমাদেরই জায়গা গো মেসো। আমাদের আসল বাড়ি তো রাজগঞ্জেই। তা রাজগঞ্জের অনেক লোককেই তো আমি চিনি। ছেলের নাম কি বলেছে গো ওনারা”?
বিধুবাবু বললেন, “পাত্রের নাম তো বলল রতীশ ভট্টাচার্যি”।
সীমন্তিনী প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কি বললে? রতীশ ভট্টাচার্যি? তার বাবার নাম রতিকান্ত ভট্টাচার্যি”?
বিধুবাবুও সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “হ্যা মা। তাই। তুমি চেন নাকি তাদের”?
সীমন্তিনী আগের মতই উচ্ছ্বল গলায় বলল, “মেসো, চিনব না মানে? খুব ভাল করে চিনি গো। রতীশ আর আমি তো একসাথে কলেজে পড়তাম। আমার সহপাঠী ছিল। খুবই ভাল ছেলে। কিন্তু মেসো, ছেলেটা তো আমার বয়সীই। রচনার তো কেবল সতের চলছে। প্রায় বছর সাতেকের মত তফাৎ হবে দু’জনের”।
এবার বিভাদেবী বললেন, “স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সাত আট বছরের ব্যবধান থাকাই ভাল। এর বেশী হলেও খারাপ, আর ব্যবধান এর কম থাকাও ভাল নয়। তা মা, তুমি ওদের ব্যাপারে কতটা কি জান, সেটা বল তো”?
সীমন্তিনী বলল, “মাসি, ছেলের ব্যাপারে তো আমি একেবারে নিশ্চিত যে ও খুবই ভাল ও সৎ ছেলে। কলেজ জীবনে পড়াশোনায় খুব বেশী যে ভাল ছিল, তা নয়। তবে কখনও পরীক্ষায় ফেল টেলও করেনি। কিন্তু খেলাধুলো আর যোগা ব্যায়ামে খুব এক্সপার্ট ছিল। মাধ্যমিক পাশ করবার পর আমি জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলাম। আর রতীশ দেরাদুনে একটা কলেজে পড়তে গিয়েছিল। বছর চারেক আগে দেরাদুন থেকে ইকোনমিক্স অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। মাস খানেক আগেই ওর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল একদিন আমার। তখন ওর মুখেই শুনলাম যে ও নাকি বিএ পাশ করবার সাথে সাথে কয়েকটা বড় বড় যোগা ডিগ্রীও নিয়ে এসেছে। হরিদ্বারের একটা ইনিস্টিটিউট থেকে ওকে যোগাশাস্ত্রী না কি একটা যেন উপাধিও দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের ওখানের হায়ার সেকেণ্ডারী কলেজেই সে বছর দুয়েক ধরে টিচারী করছে। আমরাও ওই কলেজ থেকেই মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে এসেছিলুম। খুবই ভাল ছেলে মেসো। যেমন দেখতে, তেমনি চমৎকার গায়ের রং আর উচ্চতা। স্বাস্থ্যও খুল ভাল। লম্বায় আমার সমান সমান। ওকে নিজেদের জামাই করবার জন্যে আশেপাশের অনেক মেয়ের বাবামা-ই তো মুখিয়ে আছে। কিন্তু ওর বাড়ি থেকে না কি কেউ কোন সাড়া দেয়নি”।
বিধুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো তাহলে ওকে খুব ভাল ভাবেই চেনো মা। তা ওদের বাড়িঘর বা বাড়ির লোকজনেরা কেমন, সে বিষয়ে কিছু জানো তুমি”?
সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “কলেজে পড়ার সময় রতীশের সাথে মাঝে মধ্যেই ওদের বাড়ি যেতুম আমরা
মেসো। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করে আমিও জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলুম আর রতীশও দেরাদুন চলে গিয়েছিল বলে তারপর আর সেভাবে যাওয়া আসা হয়নি। তবে পূজো পার্বনে রতীশদের বাড়ির অনেকের সাথেই তো দেখা হয়। রতীশের মা তো আমাকে খুব ভালবাসেন। খুব ভাল ভদ্রমহিলা। ওহ উনি তো এসেছিলেন এখানে শুনেছি, তাই না”?
বিভাদেবী বললেন, “হ্যা মা। ছেলের বাবা, মা আর ছোটকাকু এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। ভদ্রমহিলাকে দেখে আমাদেরও বেশ ভাল লেগেছে। কিন্তু শুধু পাত্রপক্ষ আর ঘটকের মুখের কথায় বিশ্বেস করে আমাদের বড়মেয়েটার ওভাবে বিয়ে দিয়ে যে আমরা যে ভুল করেছি, তার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাইনে আমরা। আর তুমিও সেদিন আমাদের যেভাবে ভরসা দিয়েছ, তাতে আমরা চাই রচুর বিয়েটা আমরা একটু ভাল ভাবে খোঁজ খবর নিয়েই দেব”।
বিধুবাবু বললেন, “হ্যা মা। আমাদের সামর্থ্য বলতে তো প্রায় কিছুই নেই। আর যার কপালে বিধাতা যা লিখে দিয়েছেন, তাকে তো সেটাই ভোগ করতে হবে। রচুর কপালেও যদি অর্চুর মতো দুঃখই লেখা থাকে তাহলে তা আর কে খণ্ডাবে বল। কিন্তু একবার যে ভুলটা আমরা করেছি সেটা আর দ্বিতীয়বার করতে চাইনে। তারপর ওর কপালে যা আছে, তাই তো হবে”।
সীমন্তিনী একহাতে রচনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে আদর করে বলল, “মেসো। তোমাদের বড়মেয়ের বিয়ের আগে তোমাদের সাথে যদি আমার পরিচয় হত, তবে ব্যাপারটা হয়ত অন্যরকম হত। কিন্তু যা হবার ছিল সেটাই হয়েছে। কিন্তু রচুর ব্যাপারে যে আমি ভাল করে ছেলেপক্ষের খবরাখবর নেব এ’কথা তো সেদিনই তোমাদের বলেছিলাম আমি। আর সে জন্যেই আজ এসেছি আমি। তবে এ পাত্রের নাম শুনেই বলছি আমাকে আলাদা করে খুব বেশী খবর যোগাড় করতে হবে না। ওকে তো আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। শোনো মেসো। ছেলের বাবারা তিনভাই। সবাই জয়েন্ট ফ্যামিলীতে থাকে। তাদের বড়ভাইয়ের নাম রতিকান্ত ভট্টাচার্যি, মেজ ভাই শশীকান্ত বাবু, আর ছোট ভাই চন্দ্রকান্ত বাবু। বাড়ির তিন বৌয়ের মধ্যেও প্রচণ্ড ভাব ভালবাসা। রতিকান্তবাবুর দু’ ছেলে। বড়টিই হচ্ছে রতীশ। শশীকান্ত বাবুর এক মেয়ে এক ছেলে, আর চন্দ্রকান্তবাবুরও তাই এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেমেয়েগুলোও সবাই সবাইকে খুব ভালবাসে। ওদের পাড়ার অনেক লোকও বুঝতে পারে না ও বাড়ির ছেলে মেয়েরা কে কোন ঘরের। আমিও তো প্রথম প্রথম বুঝতে পারতুম না কে রতীশের নিজের ভাই বোন আর কে খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সবাইকে দেখেই মনে হত যেন এক মায়ের পেটের ভাইবোন সবাই। সবাই সবাইকে খুব ভালবাসে। অমন ভাল পরিবার আমাদের ও তল্লাটে বুঝি আর একটাও নেই। রাজগঞ্জের সকলেই একডাকে তাদের পরিবারকে চেনে। আর সে জন্যেই সব ', পরিবারই সে পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে চায়”।
বিভাদেবী খুব খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি বলছিস মা তুই”?
সীমন্তিনী বলল, “সত্যি বলছি মানে? তুমি কি ভাবছ আমি মিথ্যে কথা বলছি? আসলে রতীশের কথা শুনেই আমি এতটাই খুশী হয়েছি যে তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না মাসি। ওদের পরিবার সম্বন্ধে আমি এত কথা বলতে পারি যে রাত কাবার হয়ে যাবে। তোমরাই শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে উঠবে। আর এতকিছু বলছি বলেই হয়ত তোমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে”।
বিভাদেবী হাত বাড়িয়ে সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বললেন, “নারে মা, ও’কথা বলিসনে। জানিসনা? কথায় বলে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে দেখেই ভয় পায়। আমাদের অবস্থাও ঠিক তাইরে”।
বিধুবাবু বললেন, “হ্যা মন্তিমা। আমাদের অবস্থা ঠিক তাই। তুমি তোমার মাসির কথায় কিছু মনে করো না। আচ্ছা মা, তোমার কথায় তো বুঝতেই পারছি তুমি তাদের পরিবারকে খুব ভাল ভাবে চেনো। ওই পরিবারের লোকদের মধ্যে ভাব ভালবাসা খুব ভাল। তাই পরিবার নিয়ে আর মনে কোন চিন্তা রইল না। কিন্তু মা তাদের আর্থিক অবস্থা বা আচার ব্যবহার নিয়ে কিছু জানা আছে কি তোমার”?
সীমন্তিনী বলল, “মেসো ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই খুব অমায়িক গো। তোমরা তো তিনজনকে দেখেছ। তোমাদের কেমন লেগেছে তাদের”?
বিধুবাবু বললেন, “ওই তিনজনকে তো আমাদেরও খুব ভদ্র বলে মনে হয়েছে। আর বলতে বাঁধা নেই। বেশ অমায়িকও মনে হয়েছে। নইলে মেয়ে দেখতে এসে কেউ অতগুলো ফলমূল আর মিষ্টি নিয়ে আসে? হয়ত আমাদের হত দরিদ্র অবস্থার কথা শুনেই তারা ও’সব নিয়ে এসেছিলেন। আর এমন সময়ে এসেছিলেন যে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার নিয়েও আমাদের কোন দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। তারা দুপুরের খাবার খেয়েই এখানে এসেছিলেন। অমায়িক না হলে কি আর এমনটা কেউ করে”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যা মেসো, তুমি ঠিক বলেছ। শুধু রতীশের বড় কাকা, মানে শশীকান্ত বাবুই একটু বেশী গম্ভীর প্রকৃতির। আর শশীকান্তবাবুর ছেলে, মানে রতীশের মেজকাকার ছেলে। সেও অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনায় একটু কম কথা বলে। কিন্তু তাই বলে তাদেরও কেউ খারাপ বলতে পারবে না। ওই এলাকার সকলের সাথেই তাদের সকলেরই খুব ভাল সম্পর্ক। আর আর্থিক দিক দিয়ে বলছি। রাজগঞ্জ হাটে বেশ বড়সড় একটা নিজস্ব কমপ্লেক্সে তাদের তিন ভাইয়ের পাঁচটি বড় বড় দোকান। রতিকান্ত বাবুর বিশাল মুদি দোকান। শশীকান্ত বাবুর খুব বড় স্টেশনারী দোকান। আর ছোটভাই চন্দ্রকান্ত বাবুর একটা বড় ওষুধের দোকান, একটা পিসিও ফটোস্ট্যাটের দোকান আর একটা কম্পিউটারের দোকান আছে। সব ক’টা দোকানের ব্যবসাই খুব ভাল। তাই বুঝতেই পারছ তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই ভাল। আর ব্যবসা করলেও তারা লোক ঠকিয়ে টাকা উপার্জন করেন না বলে, যে কোন দোকানের চেয়ে তাদের তিন ভাইয়ের দোকান গুলোর ওপর লোকজনের একটা অন্য রকম আস্থা আছে। তাই তাদের দোকানের কাস্টমার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আর এলাকার সকলেই তাদের ওপর খুব বিশ্বাস করে। প্রত্যেকের দোকানেই দু’তিনজন করে কর্মচারী আছে। কয়েকটা কর্মচারী তো তাদের বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করে। এছাড়া বাড়িতে রান্নার লোক, কাজের ঝি, চাকর আর বাগানের মালীও আছে। জমিজমাও আছে বেশ কিছু। চাষ বাস করবার লোকও রেখেছে তারা। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা মেসো। ওই বাড়ির ছোট বড় কারুর ভেতরেই অহঙ্কার বলতে কিছু নেই। গরীব হোক পয়সাওয়ালা হোক সকলের সাথেই তারা সকলে একই রকম আন্তরিক ব্যবহার করে থাকে”।
বিধুবাবু বললেন, “তাই নাকি মা? আমার মেয়ে গুলোর জন্যে মনে মনে আমি যে এমনই পরিবার খুঁজে বিয়ে দিতে চাইছিলাম। অর্চুর জীবনটা আমি নিজে নষ্ট করে ফেলেছি। রচুকে যদি এমন একটা পরিবারের বৌ করে পাঠাতে পারি, তাহলে আমার চেয়ে খুশী আর কে হবে বল মা”।
বিভাদেবী বললেন, “হ্যাগো, ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু আমাদের রচু কি এত ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? ওরা যদি যৌতুক চেয়ে বসে তাহলে আমরা কী করব? আমরা যে ওকে পড়বার জন্যে দুটো ভাল শাড়িও দিতে পারব না”।
সীমন্তিনী বলল, “মাসি, তুমি এখনই ওসব নিয়ে ভাবছ কেন বল তো? আগে তোমরা সবাই ভাল করে ভেবে দেখ, ওই ছেলের সাথে রচুর বিয়ে দিতে তোমরা রাজি আছ কিনা। তারপর তো সেসব প্রশ্ন আসছে। তোমরা রাজি থাকলে, আমিও গিয়ে তাদের সাথে কথা বলব। তাদের সকলকেই তো আমি চিনি। আর আমাকেও তারা খুব স্নেহ করেন। রতীশ তো আমার সহপাঠী বন্ধু। আলাপ আলোচনা করে দেখা যাবে। আর এটা মনে রেখ, রচুকেও তো আমি আমার নিজের বোনের মত ভালবাসি। আমিও আমার সাধ্যমত সব কিছু করব। সব সময় তোমাদের পাশে থাকব আমি। তাই ও’সব নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা কোর না”।
বিধুবাবু বললেন, “মন্তি মা। তোমাকে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু এ মূহুর্তে কথাটা বললে সেটা শুনে তুমি হয়ত আমাকে চরম স্বার্থপর বলে ভাবতে পার। কিন্তু তবু বলছি মা। সেদিন তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমার মনে হয়েছিল আমার জীর্ন কূটিরে বুঝি সত্যি সত্যি এতদিনে মা লক্ষীর আগমন হয়েছে”।
সীমন্তিনী বলল, “ছিঃ ছিঃ মেসো। তুমি কেন এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিচ্ছ বল তো? আমার মা বাবা আমাকে বলেন আমি নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অলক্ষী মেয়ে। ছোটবেলা থেকে এ’কথা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি আমি। আচ্ছা, ওসব কথা ছাড়ো। শোন, আমাকে তো পাঁচটার বাসটা ধরতে হবেই। ছেলের বাড়ির ঠিকানাটা নেবার জন্যই শুধু এসেছিলুম। তা যে ছেলের কথা শুনলুম তাতে তো দেখছি আমাকে আর আলাদা করে কোন খবর যোগাড় করার চেষ্টাই করতে হবে না। আমার তো আগে থাকতেই এ ছেলের বাড়ির সকলের খবরাখবর জানা। তাই আর এখানে থাকবার প্রয়োজন নেই। তোমরা এক কাজ কর মাসি। দু’একটা দিন ভাল করে এ সম্মন্ধের ব্যাপারটা ভেবে দেখ। দাবি-দাওয়া যৌতুকের কথা ভেবে আগে থেকেই মুষড়ে পড়ো না। সেটা আপাততঃ না হয় আমার ওপর ছেড়ে দাও। তোমরা নিজেদের মনস্থির কর। আর যদি দেখ তোমরা মনস্থির করতে পেরেছ, তাহলে আমাকে একটু ফোন করে বলে দিও। আর ছেলের বাড়িতেও খবরটা জানিয়ে দিয়ে তোমরা গিয়ে ছেলের বাড়ি ঘর দেখে তার বাড়ির লোকজনদের সাথে কথা বার্তা বলে এস। বিয়েটা তো আর এখুনি হচ্ছে না। রচু বারো ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষাটা না দেওয়া অব্দি তো বিয়েটা হচ্ছে না। আর সে’কথা তো তাদের আগেই বলা হয়েছে। মনে হয় তারা সেটা মেনেও নেবেন। আর সেটা হলে হাতে তো বছর খানেক সময় পাচ্ছি আমরা। দাবি দাওয়া যৌতুক টৌতুক নিয়ে ভাববার বেশ কিছুটা সময় আমরা পাব। আর বললামই তো সে ব্যাপারটা আমি দেখব”।
______________________________