24-02-2020, 09:01 PM
(Update No. 43)
সীমন্তিনী হাঁপ ছেড়ে বলল, “ও এই কথা। তা এ তো ভাল কথাই বলেছে। একদম ঠিক কথা বলেছে”।
সরলাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “কি বলছিস তুই? ঠিক কথা বলেছে? আমার তো মনে হয় ও মেয়ে মনে মনে কাউকে ভালবেসে রেখেছে। তাকেই বিয়ে করবে। তাই সোজাসুজি না বলে এভাবে আমাদের বিদেয় করেছে”।
সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “বড়মা, এখন দিন কাল পাল্টেছে। তোমাদের জমানায় যা হত এখনকার ছেলেমেয়েরা কি আর তেমন করে? আর তুমি কি জান? আঠারো বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা এখন আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। রচনার বয়স এখন মাত্র সতের বছর। ও এগার ক্লাসে পড়ছে। বারো ক্লাস পার হতে হতে ওর আঠারো বছর হয়ে যাবে। বিয়েটা তো তখনই সম্ভব হবে”।
সরলাদেবী বললেন, “তাই নাকি? এখন দেশে এমন আইন হয়েছে”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাগো বড়মা। আর আমিও তো মনে মনে তাই চাইছি। মেয়েটা লেখাপড়ায় এত ভাল। মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। বিয়ের পর আমাদের সংসারে এসে ও আর পড়তে পারবে কিনা তা তো এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আমি তো চাইব ও অন্ততঃ গ্রেজুয়েশনটা কমপ্লিট করুক। তাই বিয়েটা বছর খানেক বাদে হলে তো হায়ার সেকেণ্ডারিটা ও কমপ্লিট করে নিতে পারবে বিয়ের আগে। আঠারো বছর পার না হলে আমরাও ওকে ঘরের বৌ করে ঘরে আনব না। আর তাই তো বলছি, ও একদম ঠিক কথাই বলেছে”।
সরলাদেবী বললেন, “ও, কিন্তু সতু তো আমাদের এ কথাগুলো বলেনি। আর সেটাই যদি হত তাহলে এত তাড়াহুড়ো করে আমাদের যাবার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল”?
সীমন্তিনী বলল, “বড়মা তুমি এটাও বুঝতে পাচ্ছ না? আরে আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়াটা আইনতঃ অপরাধ, সেটা তো ঠিক। কিন্তু বিয়ের কথাবার্তা বলতে তো দোষ নেই। বিয়ে পাকাপাকি করতেও বাঁধা নেই। আর অমন সুন্দরী মেয়ের পেছনে যে কত ছেলে কত ছেলের মা বাবারা লাইন দিয়ে আছে কে জানে। কথাটা পাকা হয়ে গেলেই তো আমাদের উদ্দেশ্যটা সিদ্ধি হত। সে জন্যেই তাড়াহুড়ো করে তোমাদের ওখানে যেতে বলেছিলুম আমি”।
সরলাদেবী বললেন, “ওমা, তা এ কথাগুলো সতু কেন খুলে বলেনি আমাদের? কিন্তু তা সত্বেও মেয়েটার
আরেকটা কথাও যে মনে খচখচ করছে রে। মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি মা বাবার পছন্দ করা পাত্রকেই বিয়ে করবে তাহলে সে আর ভাববার জন্য সময় চাইল কেন”?
সীমন্তিনী বলল, “ও নিয়ে কিচ্ছু ভেব না তুমি বড়মা। মেয়েটা কেন তোমাদের কাছে ক’টা দিন সময় চেয়েছে, সেটা বোধ হয় আমি জানি। তাই বলছি তুমি যেটা ভাবছ সেটা সত্যি নয়”।
সরলাদেবী এবার খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি বলছিস তুই মন্তি”?
সীমন্তিনী বলল, “তুমি তো তোমার এ মেয়েটাকে চেন বড়মা। সত্যি কথা অন্যায় হলেও বুক ফুলিয়ে সে সেটা স্বীকার করতে পারে। আর তোমার কাছে সে কখনও মিথ্যে বলেনি, এ’কথাও তো তুমি জান। আজও যে মিথ্যে বলছি না এটা তুমি বিশ্বাস করতে পার। আর যেখানে আমার দাদাভাইয়ের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, সেখানে আমি মিছে কথা বলতে পারি বলে তুমি বিশ্বাস কর”?
সরলাদেবী বললেন, “জানিরে মা জানি। তোকে কি আমি চিনি না? তোর দাদাভাইয়ের সুখের জন্য গত পাঁচ ছ’টা বছর ধরে তুই তো অনেক কিছুই করে যাচ্ছিস। অন্য কারো কাছে প্রকাশ করতে না পারলেও আমি নিজে তো জানি সেই ছোট্ট বেলা থেকে তোর দাদাভাইই তোর প্রাণ। কিন্তু রচনার সময় চেয়ে নেবার পেছনে কারনটা কী হতে পারে বল তো মা”?
সীমন্তিনী বলল, “শোন বড়মা। রচনার খুব হিতৈষী একজন দিদি আছে। আর সে দিদিকে ও কথা দিয়েছে যে কোন জায়গা থেকে তার বিয়ের কোন সম্মন্ধ এলে, সে বিয়েতে মত দেবার আগে ওর সেই দিদির সাথে পরামর্শ করবে। আর ওর সেই দিদিটা কালচিনিতে থাকে না। আর ওদের বাড়িতে ফোনও নেই, যে চট করেই সে দিদির সাথে ফোনে কথা বলবে। বাইরের কোন পিসিও থেকে ফোন করবার মত পয়সাও হাতে না থাকতে পারে। হয়ত চিঠিতেই লিখে জানাবে। তাই ক’টা দিন সময় তো ওকে নিতেই হবে”।
সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই এত সব কথা জানলি কি করে? কে বলেছে তোকে এসব কথা? আর এ জন্যই যে সে সময় চেয়েছে তা-ই বা বলছিস কি করে”?
সীমন্তিনী দুষ্টুমি করে বলল, “বারে জানব না কেন বড়মা? তোমার এই অলক্ষ্মী মেয়েটাই যে ওর সেই দিদি গো। আর সে জন্যেই তো ও বাড়িতে গিয়ে আমার আর সতুর নাম তোমাদের মুখে আনতে বারণ করেছিলাম আমি। তুমি দেখো। ওরা ঠিক দু’একদিনের মধ্যেই আমাকে ফোন করতে পারে। আর ফোন করতে না পারলে চার পাঁচ দিনের মধ্যেই আমি ওর চিঠি পাব”।
সরলাদেবী প্রায় শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললেন, “কী বলছিস তুই মন্তি? সত্যি? তুই একবার মেয়েটার সাথে দেখা করেই ওকে এমনভাবে আপন করে নিয়েছিস? ও তোর ওপর এতোটা ভরসা করতে শুরু করেছে”?
সীমন্তিনী বলল, “তুমি কিগো বড়মা? তখন থেকে শুধু মেয়েটা মেয়েটা করে বলে যাচ্ছ? নাম ধরে বলতে তোমার কষ্ট হলে বড়বৌমাও তো বলতে পার? তুমি এখন থেকে সেটা অভ্যেস করতে পার। আর পারলে আগামী বছরের পাঁজি খুঁজে পেলে ফাল্গুন মাসের প্রথম পনের দিন বাদে একটা বিয়ের দিন ঠিক করে রাখ। তখন রচনার আঠারো বছরও হয়ে যাবে, আর ওর বারো ক্লাসের পরীক্ষাও শেষ হয়ে যাবে। আর তুমিও কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারবে তোমাদের কাছে রচনা সময় চেয়ে নেবার পেছনে যে কারনের কথা আমি বললাম, সেটা ঠিক না ভুল”।
সরলাদেবী খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠে বললেন, “সত্যি বলছিস মা তুই? আমার তো খুশীতে নাচতে ইচ্ছে করছে রে। আমি কাল সকালেই রতুকে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে পূজো দেব”।
সীমন্তিনী বলল, “দিও বড়মা। রচুকে আমি যতটুকু চিনেছি তাতে আমি তোমাকে কথা দিলাম ও-ই তোমার বড়ছেলের বৌ হয়ে তোমার ঘরে যাবে। তুমি দেখে নিও। এটা তোমার কাছে তোমার এই অবাধ্য মেয়ের প্রতিজ্ঞা”।
সরলাদেবী বললেন, “তোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক মা”।
তার গলা শুনেই সীমন্তিনী বুঝতে পেল বড়মা খুশীতে কেঁদে ফেলেছেন। সেও জবাবে বলল, “ফুল চন্দন চাইনে গো বড়মা। আমি শুধু তোমার স্নেহ পেলেই খুশী হব। আচ্ছা বড়মা, এখন রাখছি। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম বলে রাতের রান্না করিনি। এবার সেটা না করলে আমাকে আজ রাতে না খেয়েই ঘুমোতে হবে”।
সরলাদেবী বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা মা। রাখছি আমি। তুই না খেয়ে ঘুমোসনা লক্ষীটি। তোর বড়মার দিব্যি রইল। আর ভাল থাকিস মা। কাল কথা বলব আবার” বলে ফোন রেখে দিলেন।
************
পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে সীমন্তিনী ব্যাগের ভেতর থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে সুইচ অন করল। ক্লাসে থাকলে মোবাইল অফ করে রাখতে হয়। ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে যেতে যেতেই হঠাৎ তার মোবাইলটা দু’বার রিং হয়েই থেমে গেল। কেউ বুঝি মিসকল দিল। ফোনটা বের করে দেখে সত্যি সত্যি একটা আননোন নাম্বার থেকে মিসকল এসেছে একটা। এ মিসকল তাকে কে দিল? রচনাই কি তার কোন বন্ধুর মোবাইল থেকে এ মিসকল দিয়েছে? না অন্য কেউ? ভাবতে ভাবতেই সে নাম্বারে কল করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ও’পাশ থেকে একটা মেয়ের গলা শোনা গেল, “তুমি দিদিভাই তো”?
সীমন্তিনী বলল, “দিদিভাই মানে? কে বলছেন”?
ওপাশ থেকে জবাব এল, “দিদিভাই আমি রচু বলছি গো”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে জবাব দিল, “রচু তুই? সত্যি বলছিস তো? আমি তো ভাবতেই পাচ্ছি না”?
রচনাও খুব খুশী গলায় জবাব দিল, “হ্যা গো দিদিভাই। আধঘন্টা থেকে তোমাকে ফোন করবার চেষ্টা করছিলাম। বার বার শুধু শুনছিলাম যে ফোন সুইচ অফ সুইচ অফ। এই মাত্র শুধু একটা কল ঢুকেছিল”।
সীমন্তিনী বলল, “সরি রে রচু সোনা। তোকে কথাটা বোধহয় বলিনি আমি। একটু আগে ক্লাসের ভেতর ছিলাম। আর ক্লাসে ঢোকার আগে ফোন সুইচ অফ করতে হয়, এটাই নিয়ম। তাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে ফোনটা অন করেছিলাম। তখনই তোর মিসকলটা পেলাম। তা কার ফোন থেকে করেছিস? এটা কি কোন পিসিওর ফোন নাকি রে”?
রচনা বলল, “নাগো দিদিভাই, এটা আমার এক বান্ধবীর ফোন। তোমাকে একটা কথা জানাবার আছে বলেই ওর ফোন থেকে তোমাকে মিসকল দিয়েছিলাম। তা তুমি কি ব্যস্ত আছ এখন”?
সীমন্তিনী বলল, “যাক আমার কথাটা তাহলে মনে রেখেছিস। খুব খুশী হলাম। আর এখন ক্লাস শেষ হয়ে গেছে বলে ফ্রীই আছি। বল কি বলবি। তবে আগে বল মাসি মেসো আর ভাই কেমন আছে”।
রচনা বলল, “হ্যা দিদিভাই, সকলেই ভাল আছে। কিন্তু কাল একটা ঘটণা ঘটে গেছে। তোমাকে সেটাই জানাব বলে ফোন করেছি”।
সীমন্তিনী বলল, “হুমমম মনে হচ্ছে কোন পাত্রপক্ষের ব্যাপার। তাই কি”?
রচনা লাজুক গলায় বলল, “হ্যা গো দিদিভাই। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ কোন এক রাজাগঞ্জ না রানিগঞ্জ, এমনই কোন একটা জায়গা থেকে কাল এক ছেলের মা বাবা আর কাকা আমাদের বাড়ি এসে হাজির। ভাগ্যিস তারা খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছিলেন। নইলে আমরা তো খুব লজ্জায় পড়ে যেতাম। আচ্ছা তুমিই বল তো দিদিভাই, এভাবে খবর না দিয়ে কেউ মেয়ে দেখতে আসে”?
সীমন্তিনী মনে মনে বেশ মজা পেলেও মুখে বলল, “ওমা সেকি? এভাবে আগে থেকে যোগাযোগ না করে কেউ মেয়ে দেখতে আসে নাকি? লোকগুলো তো ভারী অভদ্র। মুখে ঝামা ঘসে দিতে পারলি না? তাহলে হয়ত একটু ভদ্রতা শিখত তারা”।
রচনা বলল, “নাগো দিদিভাই, ঠিক তা নয়। লোকগুলো একেবারেই অভদ্র ছিল না। তারা নাকি তাদের কোন এক পরিচিতের মুখে আমার কথা শুনে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আর আগে খবর না দিয়ে ওভাবে হঠাৎ চলে এসেছেন বলে তারা আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। আর তারা সকলেই খুব ভদ্র আর বিনয়ী ছিলেন। আর জান দিদিভাই, তারা হাতে করে অনেকগুলো প্যাকেটে করে মিষ্টি আর ফলমূল এনেছিলেন। আর কথাবার্তা শুনেও তাদের বেশ ভদ্র বলেই মনে হয়েছে। আর ছেলের মা ভদ্রমহিলা তো খুবই ভাল। আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে এমনভাবে আমাকে আদর করছিলেন যে তোমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। তুমিও সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে আমাকে ওভাবে আদর করেছিলে”?
সীমন্তিনী একটা ক্লাসঘরের পাশে ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলল, “হুমমম বুঝতে পাচ্ছি। হবু শ্বশুর শাশুড়ি আর খুড়শ্বশুরকে আমার বোনটা পছন্দই করেছে। তা ছেলেও এসেছিল? সে কেমন দেখতে রে, কি করে”?
রচনা বলল, “ছেলে নিজে আসেনি গো দিদিভাই। তবে শুনলাম সে নাকি তাদের স্থানীয় একটা কলেজেই শিক্ষকতা করেন। হাজার কুড়ির মত বেতন পায়। তবে তাদের জয়েন্ট ফ্যামিলীতে অনেক সদস্য। ছেলের বাবা কাকারা তিন ভাই। তাদের সকলের স্ত্রী আর দু’জন করে ছেলে মেয়ে আছে। বাড়িতে নাকি কাজের লোক আছে চারজন। তারা ঘরের বাইরের বাগানের কাজ টাজ সামাল দেয়। কিছু আবাদী জমিজমাও নাকি আছে তাদের। একজন রান্নার লোকও আছেন। তাদের তিন ভাইয়ের সবারই আলাদা আলাদা দোকান। ছেলের বাবার মুদি আর কসমেটিক্সের দোকান। বড়কাকার স্টেশনারী দোকান আর ছোটকাকার ওষুধের দোকান, পিসিও ফটোস্টেটের দোকান, কম্পিউটারের দোকান আরও কত কি যেন বলছিলেন”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসছিল। রচনা একটু থামতে সে জিজ্ঞেস করল, “পাত্রের নাম কি? আর তার ভাইবোন ক’জন? তারা কে কি করছে”?
রচনা আবার একটু লাজুক গলায় বলল, “তারা কেউ তাদের বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের নাম বলেছেন বলে মনে পড়ছে না দিদিভাই। তবে পাত্রের নামটা বলেছেন। তার নাম নাকি রতীশ ভট্টাচার্যি। যে দু’জন ভদ্রলোক এসেছিলেন তাদের মধ্যে বড়জনের ছেলে সে। আর ছেলের মা-ও তো এসেই ছিলেন। ছেলের নিজের ভাই আর তার খুড়তুতো ভাইবোনেরা সকলেই পড়াশোনা করছে। তবে তাদের কারুর নামটাম শুনিনি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তোর পছন্দ হয়েছে? আর মেসো মাসি কি বলছেন”?
রচনা বলল, “তোমার কথা আমাদের সকলেরই মনে ছিল। পাত্রের কথা আর পাত্রের বাড়ি ঘরের কথা শুনে তো বাবা মা দু’জনেই বেশ খুশী হয়েছেন। কিন্তু তারাও তোমার কথা ভেবেই তাদের প্রস্তাবে সরাসরি হ্যাঁ না কিছু বলেননি। শেষে আমিই তাদেরকে বলে দিয়েছি যে আমরা কয়েকদিন ভেবে তারপর তাদেরকে জানাব। আর আরেকটা কথা বলেছি আমি। বলেছি যে আমার বারো ক্লাসের পড়া শেষ না হলে আমি বিয়ে করব না। আচ্ছা দিদিভাই, আমি ভুল কিছু বলিনি তো”?
সীমন্তিনী বলল, “না, একদম ঠিক বলেছিস। কিন্তু এই পাত্রটির ব্যাপারে তোর নিজের কি মত? তোর ভাল লেগেছে”?
রচনা বলল, “বারে সেটা আমি কি করে বলব দিদিভাই? আমি কি ছেলেকে দেখেছি নাকি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কেন? তারা ছেলের কোন ছবিও তো নিয়ে যেতে পারতেন তোদের দেখাতে”?
রচনা বলল, “বাবা সে’কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তারা বলেছিলেন যে কোন ছবি টবি আনেন নি”।
সীমন্তিনী একটু দুষ্টুমি করে বলল, “ও মা! এ আবার কেমন কথা? ছেলে নিজে আসেনি, তার অভিভাবকেরা ছেলের একটা ছবিও নিয়ে যায়নি। আর বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে চলে এলেন তারা? অবশ্য তুই নিজেও তো আমাকে বলেছিলিস যে ছেলেকে না দেখেও তুই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবি”?
রচনা বলল, “সেটা কি সব ছেলের ব্যাপারে বলেছি নাকি আমি? সেটা আমি শুধু তোমাকেই বলেছিলাম। তোমার পছন্দ করা পাত্রকে আমি না দেখেই বিয়ে করতে রাজি হব বলে বলেছিলাম। তাই বলে এ ক্ষেত্রেও কি তেমনটা করব নাকি আমি? সম্মন্ধটা তুমি আনলে আমি নিশ্চিন্তে রাজি হয়ে যেতুম”।
সীমন্তিনী মনে মনে হেসে বলল, “হুম, বেশ ভাল খবর। তা তোর কথা শুনে পাত্র পক্ষের লোকেরা কি বললেন? তারা তোর শর্ত মেনে বছরখানেক অপেক্ষা করতে রাজি আছেন”?
রচনা বলল, “না সে কথা তারা বলেননি। তবে সকলেই যে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন সেটা বুঝেছি। তারা শুধু তাদের বাড়ির নাম ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে চলে গেছেন”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে রচু। শোন। এ শনিবারে আমার ক্লাস নেই। আমি কালচিনি যাচ্ছি। তারপর মাসি মেসো আর তোর সাথে কথা বলব”।
রচনা খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “তুমি আসবে দিদিভাই? সত্যি বলছ”?
সীমন্তিনী বলল, “আসব না মানে? তুই কি ভেবেছিস সেদিন আমি তোকে আর মাসি মেসোকে যা বলে এসেছিলাম, তা শুধু আমার মুখের কথা? তোর জন্য পাত্র বেছে বের করবার দায়িত্ব আমি কাঁধে নিয়েছি। সে দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যাব এখন? এ পাত্রের ব্যাপারে আমাকে খোঁজ খবর নিতে হবে না? নাকি তুই আমাকে বারণ করতে চাইছিস”?
রচনা মুখ ভার করে বলল, “বারণ করব বলছ কেন দিদিভাই? তুমি বলেছিলে বলেই তো আমি তোমাকে মিসকল দিয়েছিলাম। তোমাকে সেদিন থেকেই আমার বড় কাছের বড় আপন বলে মনে হচ্ছে। তাই আমিও তোমাকে আমার মনের সব গোপন কথা খুলে বলেছিলাম। তুমিই বলেছিলে যে আমার কোন সম্মন্ধ এলে তাদের কোন রকম কথা দেবার আগে যেন তোমাকে জানাই। আমার কথা রাখবার জন্যেই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমিও তো আমার কথা রাখব বলেই কালচিনি যেতে চাইছি। ছেলেটার বাড়ির ঠিকানাটা না পেলে আমি খোঁজটা নেব কি করে বল তো? আর যাচ্ছি বলার পরেও সব কিছু জেনেও তুই
যদি আবার প্রশ্ন করিস, তাহলে আর কি বলব বল”?
রচনা আদুরে ভঙ্গীতে বলল, “উমমম দিদিভাই, তুমি আমার লেগপুল করছ না? যাও, আমি আর তোমাকে কিচ্ছু বলব না”।
সীমন্তিনী বলল, “শোন রচু সোনা, অনেকক্ষণ কথা বলা হয়েছে। যার ফোনে কথা বলছিস, সে নিশ্চয়ই এবার বিরক্ত হচ্ছে। তাই আজ কথা শেষ করছি। আমি শনিবার আলিপুরদুয়ার থেকে সকাল দশটার ট্রেন ধরব। মাসিকে বলিস আমার জন্যে যেন সেদিনের মত মুগ ডাল আর মিষ্টি কুমড়োর ফুলের বড়া বানিয়ে রাখেন। আর তাদের দু’জনকে আমার প্রণাম জানাস। ভাইকে আমার হয়ে একটু আদর করে দিস। রাখছি”।
***************