23-02-2020, 09:38 PM
[সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#01, #02)]
সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#01)
সামনে গরমের ছুটি। একদিন রাতে খাওয়ার সময়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “আমি ভাবছিলাম এই গরমের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গেলে ভালো হয়, এই কোন পাহাড়ি জায়গায়। পরী কোথায় যেতে চাস, বল?”
আমি বড় শ্বাস নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি কোন পাহারে ঘুরতে যেতে চাই না।”
বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কেন, তুমি ত পাহাড় ভালোবাসো, হটাত কি হল?”
আমি সত্যি পাহাড় ভালোবাসি, আর সেই পাহাড় ওই আমাকে চিনিয়েছিল। সাথে যদি ভালোবাসার লোক না থাকে তাহলে পুস্প শয্যাও কণ্টকময় হয়ে ওঠে। আমি বাবুকে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি ভাবছিলাম গরমের ছুটিতে মায়ের কাছে যাবো।”
ছোটমা মাথা নেড়ে বলেন, “ঠিক আছে এই বার না হয় তুই গ্রামের বাড়ি যা, কিন্তু পরের বছর আমরা সবাই মিলে কোন পাহাড়ে বেড়াতে যাবো, এই ধর নৈনিতাল বা কৌসানি।”
আমি মনের ব্যাথা লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমাকে কি পরের বছর তোমাদের সাথে যেতেই হবে?”
আমি মজা করে বলি, “তোমাদের বয়স হয়েছে, তোমরা এখন ঘুরতে যাও একা একা।”
বাবু বললেন, “তুমি এখন আমাদের একমাত্র সন্তান, তোমাকে একা ছেড়ে কি করে যাই?”
বাবুর কি গলা ধরে এসেছিল সেই কথা বলার সময়ে, হয়ত হ্যাঁ, ঠিক বুঝতে পারিনি আমি। বাবু, “তুমি যদি আমাদের সাথে না যেতে চাও তাহলে আমরা কোথাও যাবো না।”
ডাইনিং টেবিলের আবহাওয়া কেমন ভারী হয়ে ওঠে ঘুরতে যাওয়ার কথা বার্তা নিয়ে। আমি ওকে ছাড়া পাহাড়ে ঘুরতে যাবার ইচ্ছে নেই, ওদিকে বাবু আর ছোটমা আমাকে ছাড়া ঘুরতে যাবেন না।
আমি শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া সামাল দিয়ে বলি, “ঠিক আছে ছোটমা, পরের বছর আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাবো।”
ছোটমা আমার মুখে হাসি দেখে খুশি হন। আমি ছোটমায়ের কাছে আব্দার করি, “ছোটমা আমার একটা ওয়াকম্যান চাই।”
বাবু আদর করে বললেন, “ওয়াকম্যান কেন সোনা মা, ওয়াকম্যান অনেক ছোটো। তোমার গান শুনতে ইচ্ছে হলে আমি তোমাকে পরের জন্মদিনে একটা হাজার ওয়াটের সোনির একটা বড় মিউসিক সিস্টেম কিনে দেব।”
আমার মনে হয়েছিল যেন বাবু কে জড়িয়ে ধরে টাকে চুমু খাই। বাবু বুঝে যান আমার মনের কথা আর হেসে ছোটমাকে বলেন, “দেখেছ আমার মেয়ে আবার হাসছে।”
দিনে দিনে আমার খুশি যেন বেড়ে চলে, একদিকে ওর কাছ থেকে সংবাদ পাওয়ার আশায় একদিকে ছোটমায়ের কাছে পাওয়া ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য। দিন যায়, কিন্তু ওর কাছ থেকে কোন সংবাদ আসে না। আমি আশা ছেড়ে দেই না, বুকে আশা বেঁধে রেখেছিলাম ও যখন বলেছে তখন একদিন না একদিন কোন সংবাদ নিশ্চয় আসবে।
গরমের ছুটিতে বাবু আমাকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসেন। বাবু বলেন যে অনেকদিন বাবু আমাদের গ্রামের বাড়িতে যায়নি তাই একবার মায়ের সাথে দেখা করতে চান। বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন কিন্তু বাবুর সাথে যেতে হবে শুনে কেমন মনে হয়, কেননা মাঝে মাঝে বেশ ভয় করতাম বাবুকে। সারা রাস্তা গাড়িতে বাবু খুব চুপচাপ ছিলেন। আমি বাবুর গম্ভীর মুখ দেখে অনুধাবন করতে চেষ্টা করি যে মনের মাঝে কি চলছে কিন্তু পেরে উঠিনা।
বিকেল বেলায় আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছাই। মা বাবুকে দেখে অবাক হয়ে যান, সাধারণত আমাকে ছাড়তে ছোটমা আসেন। বাবুকে দেখে মা তৎপর হয়ে ওঠেন কি করে কি করবেন। বাবুর আগমনে বাড়ি যেন মুখর হয়ে ওঠে। মৈথিলী আর মেঘনা বৌদি কি করে বাবু কে অভ্যর্থনা জানাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। আমি ওদের তৎপরতা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম।
আমি মাকে বলেছিলাম, “মা, এত তৎপর হয়ে উঠছ কেন, ইনি আমার বাবু, তুমি যেমন রাখবে সেই রকম থাকবেন।”
মা বলেন, “না তোর বাবু অনেক বড়লোক।”
আমি, “আমি জানি মা।”
মা, “তোর বাবু অনেক দিন পরে আমাদের বাড়ি এসেছেন।”
বাবু মা'কে দেখে বললেন, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
বাবুর কথা শুনে হটাত করে আমার চেহারার রক্ত উবে যায়। আমি বাবুর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করি, “বাবু দয়া করে আমার জীবন নরক বানিয়ে দিও না।”
আমি মায়ের হাত চেপে ধরে কানে কানে জিজ্ঞেস করি, “মা তোমরা কি নিয়ে কথা বলবে?”
মা আমাকে আসস্থ করে বলেন, “চিন্তা করিস না, তোর বাবু তোর ভালর জন্যই এসেছেন।”
মা সুমন্তদা আর শশাঙ্কদা কে ডেকে নিয়ে ঘরে চলে যান।
মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী বাবুকে অরুনয় করে বলে, “কাল সকালেও ত কথা বলা যেতে পারত।”
বাবু বলেন, “না মায়েরা। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, এখানে ত আমি রাত কাটাব না।”
বাবুর কথায় মা একটু আহত হয়ে বলেন, “অর্জুন, ওই কথা বলো না। আমরা কাল সকালেও কথা বলতে পারি।”
বাবু বললেন, “কাল সকালে আমার কিছু কাজ আছে তাই আজ রাতেই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।”
সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন বাবু। আমার বুকের মাঝে ঝড় শুরু হয়ে যায়। বাবু কি শেষ পর্যন্ত আমার বিয়ের কথা বলতে এসেছেন না মাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাতে এসেছেন। আমি আমার ব্যাগ নিয়ে আমার ঘরে চলে যাই। বিছানার ওপরে চুপ করে বসে থাকি, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
এমন সময়ে মৈথিলী দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, “আমি ভেতরে আসতে পারি?”
অনেক অনেক দিন পরে মৈথিলী আমার সাথে সেই প্রথম কথা বলেছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ওকে ঘরের মধ্যে আসতে বলি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছো?”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আমি ভালো আছি, তুমি তোমার খবর বল?”
আমি আমার মনের ভাব লুকিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমার খবর খুব ভালো, কলেজ ভালো চলছে, পড়াশুনা ভালো চলছে।”
মৈথিলী আমার পাসে বসে আমার গালে হাথ দিতে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার কলেজের কথা জিজ্ঞেস করছিনা পরী।”
আমি ওর মুখের দিকে তাকাই। ওর চোখে সেই পুরানো অপমানের প্রতিশোধের ছায়া ছিলনা, সেই চোখে কেমন এক মমতা মাখা ছিল। ওর চোখের চাহনি আমার সব ব্যাথা ভুলিয়ে দিয়েছিল, আমার বুক কেঁপে উঠেছিল আনমনে।
আমি ওকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করি, “কি জানতে চাও তুমি?”
গালে হাত বুলিয়ে আদর করে মৈথিলী, ওর হাতের ছোঁয়ায় যেন গলে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ও কেমন আছে?”
আমি ওকে উত্তর দিয়েছিলাম, “ভালোই আছে, আজকাল দিল্লীতে চাকরি করছে।”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম বটে, মন জানত যেখানেই থাক, ভালো যেন থাকে। সেই সময়ে আমি মৈথিলীর আচরনে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি, কি চায় ও, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। মৈথিলী কি আমার সাথে আবার কোন খেলা খেলছে? আমরা দুজনে অনেক গল্প করেছিলাম, প্রায় এক বছর পরে আমরা দুজনে প্রান খুলে কথা বলেছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু আমি নিজের বুকের ব্যাথা ওর সামনে মেলে ধরতে পারিনি ওর সেই পুরাতন আচরনের কথা ভেবে।
কিছু পরে মা আমাকে ডাক দিয়ে বলেন যে বাবু বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আমি নিচে এসে দেখি যে বাবুর খাওয়া শেষ। বাবু আমাকে জানালেন যে গরমের ছুটির পরে ছোটমা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি বাবুকে পায় হাথ দিয়ে প্রনাম করি।
আমি বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি মাকে কি বলেছ?”
বাবু আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, “যা কিছু বলেছি, সেটা তোমার ভালোর জন্যে বলেছি। তোমার মা তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে দেবে, চিন্তা করোনা।”
রাতের খাওয়ার পরে মা পান নিয়ে বসেছিলেন, আমি মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মা বাবু কি বলে গেলেন?”
মা পান মুখে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোর বাবু তোকে খুব স্নেহ করেন তাই না?”
আমি মাথা নাড়াই, “হ্যাঁ তা করেন।”
মা, “অর্জুন জানতে চেয়েছিলেন যে আমাদের বাড়ির ভাগ করা হয়েছে কি না, আর সেই ভাগের মধ্যে তোর কোন ভাগ আছে কি না।”
মায়ের কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যায় প্রথমে, বাবু কি চান, বাবু ত আমার বাবা নন যে আমাদের বাড়ির ভাগে আমার অংশ আছে কি না জানতে চাইবেন। আমি মনের রাগ লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাড়ির অংশ নিয়ে বাবু কি করবেন?”
মা বলেন, “অর্জুন জানাতে এসেছিলেন যে, তোর অংশ বিক্রি করে সব টাকা তোর নামে ফিক্সড ডিপসিট করে দিতে চান, যাতে ভবিষ্যতে তোর পড়াশুনা বা বিয়ের পরে তোর কাজে লেগে যায়। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অর্জুন এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবেছেন।”
আমার বুকের ওপরে থেকে যেন একটা বিশাল পাথর সরে যায়। মাঝে মাঝে ছোটমা আর বাবুকে বুঝতে বড় কষ্ট হয় আমার, সত্যি কি দিয়ে তৈরি এই দুজন মানুষ, হয়ত সব বাবা মা তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ঠিক এই রকম চিন্তা করে থাকেন, কিন্তু...?
আমি আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমার ঘরে ঢুকে পরে। আমার দিকে একটু অভিমান ভরে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর গালে আদর করি। আমার ওপরে যেন ওর অভিমান কমেনা, আমাকে জিজ্ঞেস করে, “অভি কাকু কেন আসেনি?”
আমি ওর চুলে বিলি কেটে উত্তর দিয়েছিলাম, “ও বাঃবা, সেই জন্য এত রাগ।”
দুষ্টু, “হ্যাঁ আমি তোমার ওপরে রেগে আছি। আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”
আমি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলাম, “এত রাগতে নেই। আমিও ভালো ভালো রাজা রানীর গল্প জানি।”
দুষ্টু শিশুসুলভ গলায় আমাকে বলে, “রাজা রানীর গল্প আমি জানি, আমি নতুন গল্প শুনতে চাই।”
আমি নিজের মনকে শান্তনা দিয়েছিলাম, আমিও যে নতুন গল্প শুনতে চাই দুষ্টু। আমি কি করে তোর অভি কাকুকে তোর কাছে নিয়ে আসি বলত, আমি নিজেই যে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
পরদিন সকালে আমি কল্যাণীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি কল্যাণীর কাছে সেই “অপটিক্স নোটবুক” ফিরে চেয়েছিলাম। কল্যাণী আমাকে দেখে অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কবে এলি বাড়িতে? তোকে দেখে অনেক আলাদা লাগছে এবারে, কি ব্যাপার অভিমন্যুর খবর পেয়েছিস নাকি?”
সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#01)
সামনে গরমের ছুটি। একদিন রাতে খাওয়ার সময়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “আমি ভাবছিলাম এই গরমের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গেলে ভালো হয়, এই কোন পাহাড়ি জায়গায়। পরী কোথায় যেতে চাস, বল?”
আমি বড় শ্বাস নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি কোন পাহারে ঘুরতে যেতে চাই না।”
বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কেন, তুমি ত পাহাড় ভালোবাসো, হটাত কি হল?”
আমি সত্যি পাহাড় ভালোবাসি, আর সেই পাহাড় ওই আমাকে চিনিয়েছিল। সাথে যদি ভালোবাসার লোক না থাকে তাহলে পুস্প শয্যাও কণ্টকময় হয়ে ওঠে। আমি বাবুকে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি ভাবছিলাম গরমের ছুটিতে মায়ের কাছে যাবো।”
ছোটমা মাথা নেড়ে বলেন, “ঠিক আছে এই বার না হয় তুই গ্রামের বাড়ি যা, কিন্তু পরের বছর আমরা সবাই মিলে কোন পাহাড়ে বেড়াতে যাবো, এই ধর নৈনিতাল বা কৌসানি।”
আমি মনের ব্যাথা লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমাকে কি পরের বছর তোমাদের সাথে যেতেই হবে?”
আমি মজা করে বলি, “তোমাদের বয়স হয়েছে, তোমরা এখন ঘুরতে যাও একা একা।”
বাবু বললেন, “তুমি এখন আমাদের একমাত্র সন্তান, তোমাকে একা ছেড়ে কি করে যাই?”
বাবুর কি গলা ধরে এসেছিল সেই কথা বলার সময়ে, হয়ত হ্যাঁ, ঠিক বুঝতে পারিনি আমি। বাবু, “তুমি যদি আমাদের সাথে না যেতে চাও তাহলে আমরা কোথাও যাবো না।”
ডাইনিং টেবিলের আবহাওয়া কেমন ভারী হয়ে ওঠে ঘুরতে যাওয়ার কথা বার্তা নিয়ে। আমি ওকে ছাড়া পাহাড়ে ঘুরতে যাবার ইচ্ছে নেই, ওদিকে বাবু আর ছোটমা আমাকে ছাড়া ঘুরতে যাবেন না।
আমি শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া সামাল দিয়ে বলি, “ঠিক আছে ছোটমা, পরের বছর আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাবো।”
ছোটমা আমার মুখে হাসি দেখে খুশি হন। আমি ছোটমায়ের কাছে আব্দার করি, “ছোটমা আমার একটা ওয়াকম্যান চাই।”
বাবু আদর করে বললেন, “ওয়াকম্যান কেন সোনা মা, ওয়াকম্যান অনেক ছোটো। তোমার গান শুনতে ইচ্ছে হলে আমি তোমাকে পরের জন্মদিনে একটা হাজার ওয়াটের সোনির একটা বড় মিউসিক সিস্টেম কিনে দেব।”
আমার মনে হয়েছিল যেন বাবু কে জড়িয়ে ধরে টাকে চুমু খাই। বাবু বুঝে যান আমার মনের কথা আর হেসে ছোটমাকে বলেন, “দেখেছ আমার মেয়ে আবার হাসছে।”
দিনে দিনে আমার খুশি যেন বেড়ে চলে, একদিকে ওর কাছ থেকে সংবাদ পাওয়ার আশায় একদিকে ছোটমায়ের কাছে পাওয়া ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য। দিন যায়, কিন্তু ওর কাছ থেকে কোন সংবাদ আসে না। আমি আশা ছেড়ে দেই না, বুকে আশা বেঁধে রেখেছিলাম ও যখন বলেছে তখন একদিন না একদিন কোন সংবাদ নিশ্চয় আসবে।
গরমের ছুটিতে বাবু আমাকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসেন। বাবু বলেন যে অনেকদিন বাবু আমাদের গ্রামের বাড়িতে যায়নি তাই একবার মায়ের সাথে দেখা করতে চান। বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন কিন্তু বাবুর সাথে যেতে হবে শুনে কেমন মনে হয়, কেননা মাঝে মাঝে বেশ ভয় করতাম বাবুকে। সারা রাস্তা গাড়িতে বাবু খুব চুপচাপ ছিলেন। আমি বাবুর গম্ভীর মুখ দেখে অনুধাবন করতে চেষ্টা করি যে মনের মাঝে কি চলছে কিন্তু পেরে উঠিনা।
বিকেল বেলায় আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছাই। মা বাবুকে দেখে অবাক হয়ে যান, সাধারণত আমাকে ছাড়তে ছোটমা আসেন। বাবুকে দেখে মা তৎপর হয়ে ওঠেন কি করে কি করবেন। বাবুর আগমনে বাড়ি যেন মুখর হয়ে ওঠে। মৈথিলী আর মেঘনা বৌদি কি করে বাবু কে অভ্যর্থনা জানাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। আমি ওদের তৎপরতা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম।
আমি মাকে বলেছিলাম, “মা, এত তৎপর হয়ে উঠছ কেন, ইনি আমার বাবু, তুমি যেমন রাখবে সেই রকম থাকবেন।”
মা বলেন, “না তোর বাবু অনেক বড়লোক।”
আমি, “আমি জানি মা।”
মা, “তোর বাবু অনেক দিন পরে আমাদের বাড়ি এসেছেন।”
বাবু মা'কে দেখে বললেন, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
বাবুর কথা শুনে হটাত করে আমার চেহারার রক্ত উবে যায়। আমি বাবুর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করি, “বাবু দয়া করে আমার জীবন নরক বানিয়ে দিও না।”
আমি মায়ের হাত চেপে ধরে কানে কানে জিজ্ঞেস করি, “মা তোমরা কি নিয়ে কথা বলবে?”
মা আমাকে আসস্থ করে বলেন, “চিন্তা করিস না, তোর বাবু তোর ভালর জন্যই এসেছেন।”
মা সুমন্তদা আর শশাঙ্কদা কে ডেকে নিয়ে ঘরে চলে যান।
মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী বাবুকে অরুনয় করে বলে, “কাল সকালেও ত কথা বলা যেতে পারত।”
বাবু বলেন, “না মায়েরা। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, এখানে ত আমি রাত কাটাব না।”
বাবুর কথায় মা একটু আহত হয়ে বলেন, “অর্জুন, ওই কথা বলো না। আমরা কাল সকালেও কথা বলতে পারি।”
বাবু বললেন, “কাল সকালে আমার কিছু কাজ আছে তাই আজ রাতেই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।”
সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন বাবু। আমার বুকের মাঝে ঝড় শুরু হয়ে যায়। বাবু কি শেষ পর্যন্ত আমার বিয়ের কথা বলতে এসেছেন না মাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাতে এসেছেন। আমি আমার ব্যাগ নিয়ে আমার ঘরে চলে যাই। বিছানার ওপরে চুপ করে বসে থাকি, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
এমন সময়ে মৈথিলী দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, “আমি ভেতরে আসতে পারি?”
অনেক অনেক দিন পরে মৈথিলী আমার সাথে সেই প্রথম কথা বলেছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ওকে ঘরের মধ্যে আসতে বলি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছো?”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আমি ভালো আছি, তুমি তোমার খবর বল?”
আমি আমার মনের ভাব লুকিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমার খবর খুব ভালো, কলেজ ভালো চলছে, পড়াশুনা ভালো চলছে।”
মৈথিলী আমার পাসে বসে আমার গালে হাথ দিতে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার কলেজের কথা জিজ্ঞেস করছিনা পরী।”
আমি ওর মুখের দিকে তাকাই। ওর চোখে সেই পুরানো অপমানের প্রতিশোধের ছায়া ছিলনা, সেই চোখে কেমন এক মমতা মাখা ছিল। ওর চোখের চাহনি আমার সব ব্যাথা ভুলিয়ে দিয়েছিল, আমার বুক কেঁপে উঠেছিল আনমনে।
আমি ওকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করি, “কি জানতে চাও তুমি?”
গালে হাত বুলিয়ে আদর করে মৈথিলী, ওর হাতের ছোঁয়ায় যেন গলে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ও কেমন আছে?”
আমি ওকে উত্তর দিয়েছিলাম, “ভালোই আছে, আজকাল দিল্লীতে চাকরি করছে।”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম বটে, মন জানত যেখানেই থাক, ভালো যেন থাকে। সেই সময়ে আমি মৈথিলীর আচরনে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি, কি চায় ও, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। মৈথিলী কি আমার সাথে আবার কোন খেলা খেলছে? আমরা দুজনে অনেক গল্প করেছিলাম, প্রায় এক বছর পরে আমরা দুজনে প্রান খুলে কথা বলেছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু আমি নিজের বুকের ব্যাথা ওর সামনে মেলে ধরতে পারিনি ওর সেই পুরাতন আচরনের কথা ভেবে।
কিছু পরে মা আমাকে ডাক দিয়ে বলেন যে বাবু বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আমি নিচে এসে দেখি যে বাবুর খাওয়া শেষ। বাবু আমাকে জানালেন যে গরমের ছুটির পরে ছোটমা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি বাবুকে পায় হাথ দিয়ে প্রনাম করি।
আমি বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি মাকে কি বলেছ?”
বাবু আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, “যা কিছু বলেছি, সেটা তোমার ভালোর জন্যে বলেছি। তোমার মা তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে দেবে, চিন্তা করোনা।”
রাতের খাওয়ার পরে মা পান নিয়ে বসেছিলেন, আমি মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মা বাবু কি বলে গেলেন?”
মা পান মুখে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোর বাবু তোকে খুব স্নেহ করেন তাই না?”
আমি মাথা নাড়াই, “হ্যাঁ তা করেন।”
মা, “অর্জুন জানতে চেয়েছিলেন যে আমাদের বাড়ির ভাগ করা হয়েছে কি না, আর সেই ভাগের মধ্যে তোর কোন ভাগ আছে কি না।”
মায়ের কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যায় প্রথমে, বাবু কি চান, বাবু ত আমার বাবা নন যে আমাদের বাড়ির ভাগে আমার অংশ আছে কি না জানতে চাইবেন। আমি মনের রাগ লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাড়ির অংশ নিয়ে বাবু কি করবেন?”
মা বলেন, “অর্জুন জানাতে এসেছিলেন যে, তোর অংশ বিক্রি করে সব টাকা তোর নামে ফিক্সড ডিপসিট করে দিতে চান, যাতে ভবিষ্যতে তোর পড়াশুনা বা বিয়ের পরে তোর কাজে লেগে যায়। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অর্জুন এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবেছেন।”
আমার বুকের ওপরে থেকে যেন একটা বিশাল পাথর সরে যায়। মাঝে মাঝে ছোটমা আর বাবুকে বুঝতে বড় কষ্ট হয় আমার, সত্যি কি দিয়ে তৈরি এই দুজন মানুষ, হয়ত সব বাবা মা তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ঠিক এই রকম চিন্তা করে থাকেন, কিন্তু...?
আমি আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমার ঘরে ঢুকে পরে। আমার দিকে একটু অভিমান ভরে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর গালে আদর করি। আমার ওপরে যেন ওর অভিমান কমেনা, আমাকে জিজ্ঞেস করে, “অভি কাকু কেন আসেনি?”
আমি ওর চুলে বিলি কেটে উত্তর দিয়েছিলাম, “ও বাঃবা, সেই জন্য এত রাগ।”
দুষ্টু, “হ্যাঁ আমি তোমার ওপরে রেগে আছি। আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”
আমি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলাম, “এত রাগতে নেই। আমিও ভালো ভালো রাজা রানীর গল্প জানি।”
দুষ্টু শিশুসুলভ গলায় আমাকে বলে, “রাজা রানীর গল্প আমি জানি, আমি নতুন গল্প শুনতে চাই।”
আমি নিজের মনকে শান্তনা দিয়েছিলাম, আমিও যে নতুন গল্প শুনতে চাই দুষ্টু। আমি কি করে তোর অভি কাকুকে তোর কাছে নিয়ে আসি বলত, আমি নিজেই যে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
পরদিন সকালে আমি কল্যাণীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি কল্যাণীর কাছে সেই “অপটিক্স নোটবুক” ফিরে চেয়েছিলাম। কল্যাণী আমাকে দেখে অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কবে এলি বাড়িতে? তোকে দেখে অনেক আলাদা লাগছে এবারে, কি ব্যাপার অভিমন্যুর খবর পেয়েছিস নাকি?”