23-02-2020, 09:06 PM
(Update No. 12)
বিধুভূষন চক্রবর্তী নিতান্ত দরিদ্র এক ',। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকায় ছোট একটা পাহাড়ী জনপদের বাসিন্দা তিনি। জায়গাটা ভূটান সীমান্তের কাছাকাছি। পুরুষানুক্রমে যজমানি করেই তিনি তার পরিবারের ভরন পোষন করেন। পরিবার বলতে দু’টি মেয়ে আর একটি ছেলে সমেত তারা স্বামী-স্ত্রী। বিধুবাবুর স্ত্রী বিভাদেবী একসময়ে ওই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী গৃহবধূ ছিলেন। এখন দারিদ্র আর বয়সের ভারে তার শরীর অনেকটাই ভেঙে পড়লেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুন্দরী। বিভাদেবীর মমতাভরা হাতের ছোঁয়ায় অভাবী সংসারটা কোন রকমে গড়িয়ে গড়িয়ে চলত। বিধুবাবু নিজেও তরুণ অবস্থায় খুবই সুন্দর ছিলেন। এখন বয়সের ভারে, দারিদ্র আর সংসারের নানাবিধ দুশ্চিন্তায় তারও শরীর স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙে গেছে। বড় মেয়ে অর্চনা, ছোট মেয়ে রচনা আর ছেলে কিংশুক তিনজনই দেখতে শুনতে খুবই চমৎকার। আশেপাশের পাঁচ সাতটা গ্রামের মধ্যে অর্চনা আর রচনার মত সুন্দরী মেয়ে আর একটাও নেই। কিংশুক ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তিন ভাই বোনই সুন্দর দেহশ্রীর সাথে সাথে খুবই নম্র আর মিষ্টি স্বভাবের। দীন দরিদ্র হলেও বিধুবাবু আর বিভাদেবী তাদের সবক’টি ছেলেমেয়েকেই সুন্দর সংস্কারী করে তুলেছেন।
ছোট মেয়ে রচনা আর ছেলে কিংশুক পড়াশোনায় খুব চৌকশ। তারা দু’জনেই কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেত। বড়মেয়ে অর্চনা অন্য ভাই বোনের মত পড়াশোনায় পারদর্শিনী না হলেও ঘরকন্যার কাজে বলতে গেলে অতুলনীয়া। তার সুনম্র আচার ব্যবহার আর সুমিষ্ট কথায় গ্রামের সকলেই তাকে খুব স্নেহ করত, ভালবাসত। আর তার রূপের প্রশংসা তো আশেপাশের সকলের মুখেই প্রায় প্রচলিত ছিল। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ করতেই তার বাবা বিধুবাবু আর্থিক টানাপোড়েনের জন্যই তাকে আর পড়াতে পারেননি। তবে কলেজের পাট চুকিয়ে তাকে খুব বেশীদিন ঘরে বসে থাকতেও হয়নি। ২০০৫ সালে ঘটকের মাধ্যমেই পাশেরই এক পাহাড়ী গ্রামের এক দোজবর কলেজ শিক্ষকের সাথে বিধুবাবু তার বড় মেয়ে অর্চনার বিয়ে দিয়েছিলেন।
অর্চনার বয়স তখন মাত্র ষোল বছর। প্রাথমিক ভাবে বিধুবাবু এ বিয়েতে রাজি হতে চাইছিলেন না মূলতঃ দুটি কারনে। এক, পাত্রের বয়স তার মেয়ের বয়সের দ্বিগুণের চেয়েও বেশী। আর দুই, চল্লিশোর্ধ পাত্রটি বিপত্নীক আর তার বারো এবং দশ বছর বয়সী দুটো পূত্র সন্তানও বর্তমান ছিল। তার আগের পক্ষের স্ত্রী নাকি অসুখে ভুগে বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছিল। কিন্তু ভাল সরকারী কলেজের শিক্ষক, আর বাড়ি ঘর দোরের ভাল অবস্থা দেখে বিধুবাবু ভেবেছিলেন, যে মেয়েটা হয়ত সেখানে ভালই থাকবে। বাবার ঘরে ছোটবেলা থেকে সে যে দৈন্য দশার মধ্যে বড় হয়েছে, তেমন অবস্থায় তাকে পড়তে হবে না। মেয়ের হবু শ্বশুর শাশুড়ির আচার ব্যবহারও ভালই লেগেছিল তার। চেনাজানা ঘটক লোকটা তাকে সব দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়েতে মত দিতে বলেছিল। একদিকে দোজবর পাত্রের সাথে তার অমন মিষ্টি মেয়েটার বিয়ে দিতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে সংসারের অভাব অনটন দিনে দিনে এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছিল যে কোন কোনদিন ঘরে দু’বেলা রান্নাও হত না। তার ওপর আরেক মেয়ে ও ছেলের লেখাপড়ার খরচা। বিধুবাবু যেন কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। প্রায় নিরুপায় হয়েই যেচে আসা সম্মন্ধটিকে হাত ছাড়া না করে তিনি বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
দিদির বিয়ের সময় রচনার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। সবে সে ক্লাস এইটে উঠেছিল। কিন্তু ওইটুকু বয়সেই অভাবের সংসারে বড় হতে হতে সে মানসিক ভাবে অনেক পরিপক্কা হয়ে উঠেছিল। বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্যেও দিদির দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে সে অনেক বার আড়ালে আবডালে গিয়ে চোখের জল ফেলেছিল। মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিল যে তার দিদি যেন সুখে থাকে।
দ্বিরাগমন সেরে যাবার পর তার দিদি বা জামাইবাবু কেউই আর তাদের বাড়ি আসেনি কখনও। কিন্তু বিয়ের মাসদুয়েক বাদেই লোক মারফত দিদির লিখে পাঠানো একটা চিঠি পেয়ে রচনা জানতে পেরেছিল যে দিদি তার শ্বশুর বাড়িতে একেবারেই ভাল নেই। তার জামাইবাবু রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। মারধর করে। আর দিনের বেলায় তার শ্বশুর শাশুড়ি তো বটেই এমন কি তার সৎ ছেলে দুটোও দিদিকে নাকি যখন তখন গালমন্দ করে। তার অপরাধ ছিল, বাপের বাড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমানে দান সামগ্রী নিয়ে আসতে না পারা। বিয়ের একমাসের মধ্যেই দু’তিন দিন তার দিদিকে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। সারাদিন শ্বশুর শাশুড়ির গঞ্জনা আর মানসিক অত্যাচার আর রাতের বেলায় স্বামীর হাতে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনাই তার নিত্যদিনের প্রাপ্তি।
তখন থেকেই তার নিজের মনের ভেতর একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। তার পরিণতিও কি তার দিদির মতই হবে? মাধ্যমিক পাশ করলেই বাবা কি তারও এভাবে বিয়ে দিয়ে দেবেন? এমনই আধবুড়ো বিপত্নীক কোন দোজবরের সাথে? ভাবতে ভাবতে সে নিজেই কেঁপে উঠত। সে মনে মনে ভাবত, এমন বিয়ে হওয়ার চেয়ে সারাজীবন কূমারী হয়ে থাকাও বোধহয় ভাল। কিন্তু সে জানে, মা বাবার কথার বিরূদ্ধে যাবার ক্ষমতা, তার দিদির মত, তারও নেই। তাই রোজ সকাল সন্ধ্যা দু’বেলা ঠাকুরঘরে গিয়ে মনে মনে মিনতি করত, তার কপালে যেন এমনটা না হয়।
রচনা প্রথম বিভাগে জেলার মধ্যে প্রথম স্থান নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করবার পর বিধুবাবু মনে মনে ভেবেছিলেন ইচ্ছে থাকা সত্বেও তিনি আর রচনাকে পড়াতে পারবেন না। কিন্তু রচনাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল বিধুবাবুর এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। নিঃসন্তান প্রিন্সিপ্যাল রচনাকে ছোটবেলা থেকেই নিজের মেয়ের মত ভাল বাসতেন। তিনি রচনাকে তাদের কলেজেই এগার ক্লাসে ভর্তি করে বিধুবাবুকে বলেছিলেন যে রচনার জন্য সে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেবেন। তাই বিধুবাবুর ওপর কোন আর্থিক চাপ পড়বে না। আর নিতান্তই যদি স্কলারশিপের ব্যবস্থা না করতে পারেন, তাহলেও বিধুবাবুকে কিছু ভাবতে হবে না। তিনি নিজে রচনার পড়াশোনার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবেন।
****************
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস। ইন্টারকলেজ কুইজ কনটেস্টে কলেজ থেকে বাছাই করা ছ’জন ছাত্রকে নিয়ে রতীশকে তাদের জেলা শহরে যেতে হল। মন্তি আর সতীশ তো আগে থেকেই সেখানে থেকে পড়াশোনা করছিল। মন্তি এম এ ফাইনাল ইয়ারে আর সতীশের বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। মন্তি রতীশকে তার ভাড়া করা বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলেছে। কিন্তু একটা সরকারি গেস্ট হাউসে তাদের কলেজের সকলের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে রতীশ ছাত্রদের সাথেই সে গেস্ট হাউসেই থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রোগ্রামের প্রথম দিনেই একটি মেয়েকে দেখে রতীশ চমকে উঠেছিল। প্রথম রাউণ্ডের ফলাফল প্রকাশ হতেই দেখা গেল যে কালচিনি ব্লকের একটা কলেজের নাম ফলাফলের লিস্টে প্রথম স্থানে। আর সে টিমের গ্রুপ লিডারের নাম রচনা চক্রবর্তী। সেদিন রাতেই রতীশ মন্তিকে ফোন করে বলল, সে যেন পরের দিন সকালে সতীশকে সঙ্গে নিয়ে অডিটোরিয়ামে আসে। সৌভাগ্যক্রমে পরের দিন মন্তি আর সতীশ দু’জনেরই কলেজ ছুটি ছিল। সকাল ন’টার আগেই তারা দু’জন রতীশদের গেস্ট হাউসে চলে এল। রতীশের কলেজের ছাত্ররা সীমন্তিনী আর সতীশকে দেখে খুব খুশী হল। সবাই একসাথে দল বেধে ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে এসে হাজির হল সকাল দশটার আগেই। সবাইকে জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে রতীশ মন্তি আর সতীশকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বলল, “তোদের দু’জনকে একজনকে দেখাব বলে ডেকে এনেছি আমি। তোরাও তাকে দেখে তোদের মতামত জানাবি”।
সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কাকে দেখাবি দাদা”?
রতীশ বলল, “একটা মেয়ে। কালচিনি ব্লকের কোন একটা কলেজের ছাত্রী। আর ওই টিমের গ্রুপ লিডারের নাম রচনা চক্রবর্তী। এর বেশী কিছু আর জানিনা”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “মেয়েটাকে দেখে তোর ভাল লেগেছে দাদাভাই”?
রতীশের মুখ দিয়ে এবার আর যেন কথা সরতে চাইছিল না। দেরাদুনে থাকতেই মন্তি তাকে বুঝিয়েছিল যে রতীশকে অন্য কোন মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। আর কলেজে চাকরি পাবার পর থেকেই সীমন্তিনী যেন উঠে পড়ে লেগেছিল, তার দাদাভাইয়ের বিয়ে দিতে। রোজ ফোনে জিজ্ঞেস করত রতীশ কাউকে পছন্দ করেছে কি না। রতীশ বারবার মন্তির কথা শুনেও শোনে নি। আসলে মন্তিকে ভালবেসে সে নিজের মনের মণিকোঠার যে জায়গাটায় বসিয়েছিল, সেখান থেকে তার ছবিটাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কোনও মেয়েকে জায়গা দেবার কথা সে ভাবতেও পারত না। কিন্তু এই মেয়েটিকে প্রথমবার দেখেই তার মনটা যেন খুশীতে ভরে উঠেছিল। কিন্তু নিজে যেন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তাই তার ছোটবেলা থেকে সে যার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল, সেই মন্তিকে ডেকে এনেছে। কিন্তু যে মুখে অজস্রবার সে মন্তিকে ভালবাসার কথা বলেছে, সে মুখে অন্য কোন মেয়ের নাম উচ্চারণ করতে তার সঙ্কোচ হচ্ছিল। কিন্তু এ মূহুর্তে শুধু মন্তিই নয়, সতীশের মনেও যে একই প্রশ্ন উঠেছে তা সে জানত।
মাথা নিচু করে বলল, “দেখ মন্তি, তুইই বারবার করে আমাকে বলছিলিস কোন মেয়েকে পছন্দ করতে। কিন্তু আমার চোখে এমন মেয়ে আগে আর কখনও পড়ে নি। এ মেয়েটাকে দেখে প্রাথমিক ভাবে আমার ভাল লেগেছে বলেই তোদের ডেকে এনেছি। আমি তো শুধু কাল মেয়েটাকে দেখেছি। আমি ওর নাম, ঠিকানা, পরিচয় কিছুই জানিনা। কাল ফার্স্ট রাউণ্ডের সময় জানলাম যে ও কালচিনি ব্লকের কোন একটা কলেজের ছাত্রী। এর বেশী আর কিছুই আমি জানিনা। তোদেরকে ডেকেছি তোদের মতামত নেবার জন্য। আর তোরা দু’জনেও যেমন জানিস, তেমনি আমাদের বাড়ির সকলেও জানে যে তোর কথা ছাড়া আমি কোন কাজ করি না। তাই তোরা দু’জনে মেয়েটাকে দেখে তারপর তোদের যা বলার বলিস”।
দ্বিতীয় দিনের প্রতিযোগিতা শুরু হবার সাথে সাথে রতীশ মন্তি আর সতীশকে নিজের সাথে নিয়ে বসল। রচনাদের টিমের ছাত্ররা যখন ডায়াসে এসে বসল, তখন রতীশ সতীশ আর মন্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে
বলল, “একদম বাঁদিকের কোনায় বসে থাকা মেয়েটার কথা বলছিলাম আমি”।
মেয়েটাকে দেখে মন্তির খুব ভাল লাগল। সতীশেরও তাই মত। দ্বিতীয় রাউণ্ডেও মেয়েটা একাই প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পালা শেষ হতেই সীমন্তিনী রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদাভাই, তোকে কি সারাক্ষন এখানে বসে থাকতে হবে”?
রতীশ বলল, “তেমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। হলঘর থেকে আমি বেরোতেই পারি। কিন্তু আমাদের কলেজের টিমের পারফর্মেনস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ক্যাম্পাসের ভেতরেই থাকতে হবে। তারপর ছাত্রদের সাথে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারব”।
মন্তি বলল, “তাহলে চল দাদাভাই। আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে বসে একটু কথা বলি”।
তিনজনে ক্যান্টিনে এসে একটা টেবিলের তিনদিকে বসতেই সতীশ সবার আগে বলল, “বড়দি, আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে রে মেয়েটাকে। দাদার সাথে খুব ভাল মানাবে”।
মন্তি রতীশের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সতীশকে বলল, “সেটা তো ঠিকই বলেছিস রে সতু। মেয়েটা তো দেখতে শুনতে খুবই ভাল। কিন্তু জানিস তো? আজকাল কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পেছনে ভাল মন্দ ছেলেদের লাইন পড়ে যায়। প্রায় সব মেয়েই কোন না কোন ছেলের সাথে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এ মেয়েটার মুখে চোখে আমি অন্য একটা ছোঁয়া দেখতে পেয়েছি রে সতু। মেয়েটা খুবই লক্ষীমন্ত হবে। তবে কারুর সাথে প্রেমটেম করে কিনা সেটা বলা মুস্কিল। তবে দাদাভাইয়ের যখন পছন্দ হয়েছে, তবে মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতেই হচ্ছে। শোন সতু, কালচিনি কলেজের টিমটার সাথে টিচার কে এসেছেন, একটু খবর নিয়ে দেখ তো। মেয়েটার নাম ঠিকানা বা বাবার নাম এসব কিছু জানা যায় কিনা। আর আমি মেয়েটার একটা ছবি তুলে নেবার চেষ্টা করছি। আর কোনভাবে মেয়েটার সাথে ভাব করতে পারি কিনা দেখি। তাহলে হয়ত ভেতরের খবরগুলো জানা যাবে। আর দাদাভাই, তুইও যদি পারিস, কিছু খবরাখবর নে। তবে একটা কথা, মেয়েটার সাথে তোরা কেউ সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করিস না। বাকিটা আমি দেখছি”।
ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়েই সীমন্তিনী একা একদিকে চলে গেল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনীকে দেখা গেল ডেলিগেটসদের ঘরের সামনে। ঘরের ভেতর বিভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়ের জটলা। কালচিনি কলেজের টিম তাদের সেকেণ্ড রাউণ্ডের কুইজ শেষ করে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তারা সকলেই তাদের পারফর্মেন্সে উচ্ছ্বসিত। সীমন্তিনী অনেক কষ্টে ভিড় কাটিয়ে সেই দলের কাছে গিয়ে অন্য একটা মেয়ের কাছে গিয়ে বলল, “ভাই শোনো, কিছু মনে কোর না। তোমাদের সেকেণ্ড রাউণ্ডেও তোমরা খুব ভাল পারফর্ম করেছ। তাই তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে এলাম। কিছু মনে করছ না তো”?
মেয়েটা জবাব দিল, “না না দিদি, মনে করব কেন? বলুন কী বলতে চান”?
______________________________
(Update No. 13)
সীমন্তিনী বলল, “শোন ভাই। আমার নাম সীমন্তিনী। এখানে ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়ছি। ফাইনাল ইয়ার। তোমরা তো কালচিনি ব্লক থেকে এসেছ, তাই না”?
মেয়েটা বলল, “হ্যা দিদি। আমরা কালচিনি থেকেই এসেছি। কিন্তু আপনাকে দেখে তো কালচিনির মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না”।
সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “না ভাই আমি কালচিনির নই। আমার বাড়ি এখান থেকে একটু দুরে। বাসে যেতে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মিনিটের মত লাগে। কিন্তু তোমরা কালচিনির শুনেই তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। আসলে কি হয়েছে জানো। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ডুয়ার্সের কোন একটা ব্লক নিয়ে একটা রিপোর্টিং জমা দিতে হবে আমাকে। ওই প্রোজেক্ট ওয়ার্ক আর কি। আমাদের এক স্যার আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন যে কালচিনি ব্লকের ওপর একটা প্রতিবেদন লিখতে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাকে সেখানে গিয়ে সব কিছু দেখে শুনে রিপোর্টটা বানাতে হবে। কিন্তু অজানা অচেনা জায়গায় যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না। আর ওখানে চেনা পরিচিত কেউ নেই আমার। তাই ভাবলাম তোমাদের কাছ থেকে একটু খবরাখবর নিই। আচ্ছা তোমাদের ওখানে কি থাকবার মত কোন হোটেল টোটেল আছে”?
মেয়েটা বলল, “না দিদি। আমাদের জায়গাটা ব্লক হেড কোয়ার্টার হলেও খুবই অনুন্নত। কয়েকটা খাবার হোটেল অবশ্য আছে। কিন্তু থাকতে হলে কারুর বাড়ি ছাড়া একমাত্র সরকারি ডাক বাংলোই পাবেন। তবে আপনি যদি একা যান, তাহলে ওই সব ডাক বাংলোয় থাকাটা খুব ঝামেলার হয়ে উঠতে পারে। লোকাল এমএলএ আর তাদের দলবলের লোকেরা প্রায় সারাক্ষণই সেখানে আড্ডা মারতে থাকে। ড্রিঙ্ক করার পক্ষে সেসব জায়গা খুব উপযুক্ত। তাই একা কোন মেয়ের সেখানে না যাওয়াটাই উচিৎ”।
সীমন্তিনী যেন মেয়েটার কথা শুনে খুব হতাশ হল। এমন ভাব করে বলল, “ইশ, তাহলে তো ভারী মুস্কিল হল আমার। আচ্ছা আমি যদি সকালে গিয়ে কিছুটা কাজ করে আবার ফিরে আসতে চাই, তাহলে ফেরার গাড়ি পাব তো? আর কোন রাস্তায় কোনদিক দিয়ে যেতে হবে, তাও তো জানিনা”।
মেয়েটা বলল, “এখান থেকে কালচিনি যাবার দু তিনিটে রাস্তা আছে দিদি। তবে বেশীর ভাগ লোকই ভায়া আলিপুরদুয়ার আসা যাওয়া করে। অবশ্য নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে ঘূপগুড়ি, মাদারীহাট, বীরপারা হয়ে গেলে প্রায় পৌনে তিন ঘন্টায় কালচিনি পৌঁছে যাওয়া যায়। আর ডাইরেক্ট ট্রেনে যেতে হলে তো সময় আরও অনেক বেশী লাগে। এখান থেকে সেবক চালসা নাগরাকাটা বানারহাট হয়ে বাস কালচিনিতে পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা আট ঘন্টার মত সময় লেগে যায়। আর এখান থেকে বাসে আলিপুরদুয়ার যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। আর আলিপুরদুয়ার থেকে বাসে কালচিনিতে যেতে আরও এক ঘন্টার মত লাগে। তাই বাসে এখান থেকে আলিপুরদুয়ার হয়ে কালচিনি যেতে মোট চার ঘন্টার মত লাগে। আমরাও বাসে সে পথেই এসেছি। কিন্তু দিদি, আপনি যেমনটা চাইছেন তা বোধ হয় সম্ভব হবে না। এখান থেকে আমাদের জায়গায় যেতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লেগে যায়। আসা যাওয়াতেই তো আপনার আট ঘন্টা সময় চলে যাবে। আপনি সকালে এখান থেকে গিয়ে যদি দু’ তিন ঘন্টা থেকে সেখান থেকে ফিরে আসতে চান, তাহলে তো আপনার এখানে আসতে গভীর রাত হয়ে যাবে। আর রাতের বেলায় একা একজন মেয়ের পক্ষে এ’সব রাস্তায় চলাফেরা করা একেবারেই উচিৎ হবে না”।
সীমন্তিনী আরও মুষড়ে পড়ে বলল, “ওরে বাবা, না না, একা একা অজানা অচেনা রাস্তায় রাতের বেলায় জার্নি করার সাহসই হবে না আমার। ইশ, কি যে করি এখন আমি”।
এমন সময় রতীশের চোখে পড়া মেয়েটি এগিয়ে এসে সীমন্তিনী যার সাথে কথা বলছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে রে কাবেরী? কোন প্রব্লেম”?
কাবেরী তার দিকে চেয়ে বলল, “নারে রচনা তেমন কিছু নয়। আসলে এ দিদি একটু সমস্যায় পড়ে গেছে”।
রচনা ততক্ষণে দু’জনের কাছে এসে গেছে। সে হাতজোড় করে সীমন্তিনীকে নমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, “নমস্কার দিদি, আমি রচনা। রচনা চক্রবর্তী। আমি কি শুনতে পারি কি সমস্যা হয়েছে আপনার”?
রচনার অপূর্ব মিষ্টি গলার স্বর শুনে সীমন্তিনী চমকে উঠল। কিন্তু নিজেকে সংযত করে জবাব দিল, “ওঃ হ্যা, নমস্কার ভাই। আমি সীমন্তিনী। এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। আসলে একটা প্রোজেক্ট ওয়ার্ক করতে আমার কালচিনি যাবার দরকার হয়ে পড়েছে। কালচিনি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনা। তাই ওর কাছে একটু তোমাদের জায়গাটার ব্যাপারে খবর নিচ্ছিলাম, যে ওখানে গিয়ে কোথাও থাকবার জায়গা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ওর মুখে যা শুনছি তাতে তো যাবার সাহসই পাচ্ছিনা। তোমার বান্ধবী বলল, ওখানে নাকি সরকারী ডাক বাংলো ছাড়া আর কোন জায়গা নেই থাকবার। সে বাংলোতেও নাকি আমার পক্ষে রাত কাটানো ঠিক হবে না। আর এখান থেকে আপ ডাউন করেও আমার কাজটা করা সম্ভব নয়। তাই একটু চিন্তায় পড়ে গেছি ভাই। কিন্তু তোমাদের বিরক্ত করেও কোন লাভ হল না আমার। সরি ভাই। তোমরা কিছু মনে কোর না। আমি অযথাই তোমাদের সময় নষ্ট করলাম”।
রচনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ, দিদি, আপনি এমন করে বলছেন কেন? আমি বা আমার বান্ধবী কেউই কিছু মনে করিনি আমরা। কিন্তু দিদি, কাবেরী কিন্তু আপনাকে সত্যি কথাই বলেছে। মেয়েদের পক্ষে আমাদের ওখানের ডাক বাংলোয় থাকাটা কিন্তু একেবারেই সমীচীন নয়। আপনার যদি সেখানে যেতেই হয় তাহলে চেনা পরিচিত কারো বাড়িতে থেকেই আপনাকে নিজের কাজ সারতে হবে”।
সীমন্তিনী রচনার একটা হাত নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলল, “কাবেরীও তো সে’কথাই বলল আমাকে। কিন্তু আমি তো সেখানে কাউকে চিনিনে। তবে তোমরা দু’বান্ধবী সত্যিই খুব ভাল গো। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা আমার ওপর রাগ করবে। চেনা নেই জানা নেই, এভাবে এতক্ষণ ধরে তোমাদের সাথে কথা বলাতে তোমরা বিরক্ত তো হতেই পার। আমার উদ্দেশ্যটা হয়ত সফল হল না। তবু তোমাদের এমন মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তোমাদের দু’জনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। আমি কাল স্যারকে বলে দেব আমার পক্ষে ওই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। আমাকে যেন তিনি অন্য কোন প্রোজেক্ট দেন। আসি ভাই। আর তোমাদের বিরক্ত করব না। আমার শুভেচ্ছা রইল তোমাদের টিমের জন্য। তোমরা এ কনটেস্টে চ্যাম্পিয়ন হলে আমি খুব খুশী হব। আসি ভাই” বলে মিষ্টি করে একটু হেসে তাদের ছেড়ে একদিকে এগিয়ে গেল।
সেদিন রাতে সীমন্তিনী সতীশের পাশে বসে দু’জনে চা খেতে খেতে গল্প করছিল। সতীশ নিজের মোবাইলে তোলা রচনার ছবি দেখিয়ে সীমন্তিনীকে বলল, “বড়দি, মেয়েটার নাম রচনা চক্রবর্তী। কালচিনির একটা গ্রামে বাড়ি। তার বাবার নাম বিধুভূষণ চক্রবর্তী। তার পেশা যজমানী। যথেষ্ট সৎ এবং ভদ্রলোক। কিন্তু খুব গরীব। তার দু’মেয়ে আর একটি ছেলে। ছেলেটা ছোট। ক্লাস এইটে পড়ে। আর তাদের বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন তাদের বাবা মা আর দু’ভাই বোন। তবে কোন ছেলের সাথে কোন এফেয়ার আছে কিনা, সে খবরটা জানতে পারিনি রে”।
সীমন্তিনী শুনে বলল, “বাব্বা, তুই তো অনেক খবর যোগাড় করেছিস রে ভাই! আমি তো শুধু এটুকুই জেনেছি যে ও মেয়েটাই রচনা চক্রবর্তী। কিন্তু মেয়েটার গলার স্বরটা যে কী মিষ্টি না, তা তোকে বলে বোঝাতে পারব না রে ভাই। একটুখানি কথাও বলেছি তার সাথে। তাতে মনে হল বেশ ভদ্র”।
সতীশ বলল, “ওঃ আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছিরে বড়দি। মেয়েটা আর তার ছোট ভাই দু’জনেই লেখাপড়ায় খুব ভাল। দু’জনেই ক্লাসে ফার্স্ট হয় বছর বছর। আর মাধ্যমিকে সে এ ডিস্ট্রিক্টে ফার্স্ট পজিশন পেয়েছিল”।
সীমন্তিনী মোবাইলে রচনার ছবিটা ভাল করে দেখতে দেখতে বলল, “মেয়েটা বেশ সুন্দর, তাই নারে সতু?
জেঠু আর বড়মার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে তাই নারে”?
সতীশ বলল, “তাদের অপছন্দ হলেই বা কি? তোর যদি পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে তোর কথার ওপর আর কেউ কিছু বলবে ভেবেছিস? অবশ্য এটাও ঠিক, এ মেয়েকে শুধু মা বাবা কেন, যে দেখবে সেই পছন্দ করবে। আমার তো খুবই ভাল লেগেছে। হাইটটা আর ইঞ্চি দুয়েক বেশী হলে ফাটাফাটি হত। কিন্তু ওকে তো খাটোও বলা যায় না। পাঁচ চার সাড়ে চার হবে ডেফিনিটলি”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি দাদাভাইয়ের পছন্দ হয়েছে বলে। তবে হ্যা, তুই যেটা বললি, সেটাও ঠিক। আর ইঞ্চি দুয়েক হাইট বেশী হলে খুব ভাল হত। দাদাভাই আর আমি তো সমান। পাঁচ এগার। ওর যদি পাঁচ সাত আটের মত হত তাহলে আরো ভাল হত। কিন্তু একটা ব্যাপারেই সামান্য একটু খামতি থাকলেও মেয়েটা কিন্তু আর সব দিক দিয়েই একেবারে দাদাভাইয়ের উপযুক্ত। দেখতে চমৎকার মিষ্টি চেহারা। গায়ের রঙও খুব চমৎকার। হাঁসিটা তো অপূর্ব। একেবারে মন কেড়ে নেয়া হাঁসি। ওর হাঁসি দেখেই সবাই ওকে ভালবাসবে। তার ওপর কথাবার্তা, আচার ব্যবহারও ভাল। লেখাপড়ায় ভাল। আর মুখে একটা লক্ষী লক্ষী ভাব আছে। ভদ্র পরিবারের মেয়ে। আর কী চাই বল। শুধু হাইটটা নিয়ে কম্প্রোমাইজ করলেই মেয়েটা সবদিক দিয়েই দাদাভাইয়ের উপযুক্ত। হ্যা, ওর বাবার আর্থিক অবস্থাটা ভাল নয়। তাতে কি হল? দাদাভাই তো আর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরের পয়সায় খাবে না। তাই আমি কিন্তু মনে মনে মেয়েটাকে আমাদের বৌদি বানিয়ে নিতে রাজি হয়ে গেছিরে ভাই”।
সতীশও খুব খুশী হয়ে বলল, “তাহলে বাড়িতে ফোন করে মাকে খবরটা দিই, না কি বলিস”?
সীমন্তিনী বলল, “নারে সতু। এখনই নয়। এখন দাদাভাইকে বা বাড়ির কাউকে কিছু বলিস না। দ্যাখ এমন সুন্দরী আর গুণী মেয়ের পেছনে অনেক ছেলেই লাগতে পারে। কারো সাথে মেয়েটার প্রেম ভালবাসার কোন সম্পর্ক আছে কিনা, সেটা একটু খোঁজ খবর করে দেখতে হবে সবার আগে। আমি একটা প্ল্যান করেছি মনে মনে। তাতে যদি দেখি যে তেমন কিছু নেই, তাহলে ওই মেয়েটাই আমাদের বাড়ির বড়বৌ হবে দেখিস”।
সতীশ নিজের উচ্ছ্বাসকে সংযত করে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু সেটা তুই কিভাবে করবি বল তো বড়দি? কাউকে কি এ ব্যাপারে সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায়”?
সীমন্তিনী বলল, “না সেটা হয়ত যায় না রে ভাই। আর লজ্জা সঙ্কোচ ছেড়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও তার সত্যি জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তাই এটা জানতে একটা অন্য ফন্দি বের করতে হবে। আর সেটা আমি মনে মনে ভাবছি। কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত তুই রচনার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবি না, বুঝেছিস”?
সতীশ বলল, “তোর কথা অমান্য করার সাহস আমাদের পরিবারে কার আছে রে বড়দি? তুই যা বলছিস তাই হবে। কিন্তু কী ফন্দি আঁটছিস তুই, একটু বলবি আমাকে”?
সীমন্তিনী বলল, “আপাততঃ এটুকু বলতে পারি যে আমি কালচিনি যাচ্ছি। তারপরে কী করব সেটা এখনও ভাবিনি। শোন ভাই। তোর তো কাল বাড়ি যাবার কথা ছিল। তুই বড়মাকে ফোন করে জানিয়ে দে তুই কাল নয়, কয়েকদিন বাদে বাড়ি যাচ্ছিস। কুইজ কনটেস্ট তো কালই শেষ হচ্ছে। ওরা সকলে হয়ত কালই চলে যাবে। আমি পরশুদিন কালচিনি যাব। অবশ্য পরের দিনই ফিরে আসবার চেষ্টা করব। আমি ফিরে এলেই তুই বুঝতে পারবি আমাদের এরপর কী করতে হবে। তারপর বাড়ি গিয়ে কাকে কি বলবি তা তুই নিজেই বুঝতে পারবি। তাই তুই বড়মাকে ফোন করে আপাততঃ বলে দে যে তুই কাল বাড়ি যাচ্ছিস না। তিন চারদিন বাদে যাচ্ছিস। আর আমিও দাদাভাইকে সেভাবেই বলে দেব। দাদাভাইও তো কাল বিকেলেই চলে যাবে বলেছে”।
সতীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কালচিনি যাবি? একা”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যারে ভাই। দাদাভাইয়ের জন্য এটুকু করতে পারব না আমি? আর তুই ভাবিস না।
জানিস তো? আমি ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট পেয়েছি। যে কোন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা করতে পারব আমি। কালচিনি না গেলে আমি আসল খবরটা পাব না। তাই যেতে আমাকে হবেই। তুই আর দুটো দিন থাক এখানে। প্রয়োজনে আমাকে ফোন করিস। কিন্তু রচনার ব্যাপারে বাড়িতে বা দাদাভাইকে আপাততঃ কিচ্ছুটি বলিস না। আর আমি যে কালচিনি যাচ্ছি, এ’কথাটাও কাউকে বলবি না”।
**************
দু’দিন বাদে সীমন্তিনীকে দেখা গেল কালচিনি বাস স্ট্যাণ্ডে। বেলা তখন প্রায় বারোটা। সকাল আটটায় সে জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিল। বাস থেকে নেমেই সবার আগে সে কোন হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিতে চাইল। বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল তার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সে একটা ছোটখাট খাবার হোটেল খুঁজে পেল। খেয়ে দেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসবার আগেই হোটেলের কাউন্টারে বসে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করে রচনাদের বাড়ির হদিশ জেনে নিল। তারপর এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের দিকে একটা রাস্তায় সে কাবেরীকে দেখতে পেল। কাবেরী একটা ছোট ছেলের হাত ধরে ফুটপাথ ধরে একদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী একটু পা চালিয়ে কাবেরীর অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে পেছন থেকে কাবেরীর নাম ধরে ডাকল।
কাবেরী পেছন ফিরে সীমন্তিনীকে দেখে যার পর নাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আরে দিদি? আপনি এখানে”?
সীমন্তিনী হাঁপাতে হাঁপাতে ম্লান হেসে বলল, “আর বোলনা গো। কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয় আর কি”।
কাবেরী আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো সেদিন বললেন যে আপনি কালচিনি আসছেন না! আপনার স্যারকে বলে আপনার প্রোজেক্টটা চেঞ্জ করে নেবেন। তাহলে আজ আবার এখানে কেন এসেছেন আপনি? আর কোথায় উঠেছেন”?
সীমন্তিনী আবার একটু কষ্ট মিশ্রিত হাঁসি হেসে বলল, “উঠব আর কোথায় ভাই? তোমাকে বললাম না? কপালের দুর্ভোগ। স্যার কিছুতেই আমার প্রোজেক্টটা চেঞ্জ করতে রাজি হলেন না। আর সাতদিনের মধ্যে আমাকে রিপোর্ট জমা দিতে বললেন। তাই নিরূপায় হয়ে আমাকে আসতেই হল। অবশ্য ঘন্টা তিনেক হয়ে গেছে এখানে এসেছি। কিছু ম্যাটেরিয়ালসও নোট করেছি। বাস স্ট্যাণ্ডে শুনলাম বিকেল পাঁচটায় নাকি আলিপুরদুয়ার যাবার শেষ বাস। সেটাতেই যাব ভেবেছি। তোমার সাথে যে এভাবে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। এখানে তো আমি আর কাউকে চিনি না। তোমাকে দেখে তাই খুব ভাল লাগল গো। মনে হল অচেনা জায়গায় এসে নিজের কাউকে যেন খুঁজে পেলাম”।
কাবেরী বলল, “সে না হয় বুঝলুম দিদি। কিন্তু পাঁচটার বাসে গিয়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে জলপাইগুড়ি গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে তো বেশ রাত হয়ে যাবে আপনার”!
সীমন্তিনী বলল, “কি আর করা যাবে বল? আর তো কোন উপায় নেই। ফিরে তো যেতেই হবে। কিন্তু ওঃ। কনগ্রেচুলেশন। কুইজ কনটেস্টে তোমরা ফার্স্ট হয়েছ। দারুণ ব্যাপার” বলে কাবেরীর হাত ধরল।
কাবেরী হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দিদি। তবে রচনা আমাদের টিমে না থাকলে কিছুই হত না”।
সীমন্তিনী নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “ইশ তোমার সাথে দেখা হল। কিন্তু রচনার সাথে বোধহয় আর দেখা করা সম্ভব হবে না গো। ওর সাথে দেখা হলে খুব খুশী হতুম”।
কাবেরী সীমন্তিনীর হাত ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “আপনি যাবেন দিদি? রচনার বাড়ি এখান থেকে খুব বেশী দুরে নয়। অটোতে গেলে দশ মিনিটেই পৌঁছে যাব আমরা। আপনার বাস ধরতে তো এখনও প্রায় ঘন্টাখানেক দেরী আছে। চলুন না দিদি। রচনাও আপনাকে দেখে খুব খুশী হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “ওর সাথে দেখা হলে তো আমারও খুব ভাল লাগবে কাবেরী। কিন্তু এভাবে হুট করে কারো বাড়িতে যাওয়াটা কি ভাল দেখাবে বল”?
কাবেরী ততক্ষণে হাতের ঈশারায় একটা পথ চলতি অটো থামিয়ে দিয়েছে। অটোটা থামতেই সীমন্তিনীর হাত ধরে টানতে টানতে অটোতে উঠতে উঠতে কাবেরী বলল, “আপনাকে আমি ঠিক সময় মত বাস স্ট্যাণ্ডে পৌঁছে দেব দিদি। এখন সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি আসুন”।
রাস্তায় একটা মিষ্টির দোকানের সামনে অটো থামিয়ে সীমন্তিনী চটপট দু’বাক্স মিষ্টি কিনে নিল। অটোতে ফিরে এসে পাশের ছেলেটির দিকে ঈশারা করে বলল, “ও বুঝি তোমার ছোট ভাই”?
কাবেরী জবাব দিল, “হ্যা দিদি, ও আমার ভাই শিবতোষ”।
সীমন্তিনী একটা মিষ্টির বাক্স কাবেরীর হাতে দিয়ে বলল, “এটা রাখ। তোমাদের ভাই বোনের জন্য। এ দিদির তরফ থেকে একটু মিষ্টি খেও তোমরা”।
কাবেরী প্যাকেটটা হাতে নিয়ে একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “এ সবের কি দরকার ছিল দিদি”?
সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বলল, “বারে দিদি হয়ে ছোট ভাই বোনকে কিছু দেওয়া কি অপরাধ”?
কাবেরী তটস্থ হয়ে বলল, “না না দিদি, এমন কথা বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না প্লীজ”।
সীমন্তিনী আবার হেসে বলল, “তাহলে আর কথা বোল না। বাড়ি গিয়ে দু’ভাই বোনে মিলে খেতে খেতে এ দিদিটার কথা একটু মনে কোর”।
একটা পুরোন জীর্ন প্রায় বাড়ির সামনে এসে অটোটাকে থামতে বলে কাবেরী সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি আমরা এসে গেছি”।
অটো থেকে নামতে নামতে সীমন্তিনী বলল, “অটোর ভাড়া আমি চুকিয়ে দিচ্ছি কাবেরী। তুমি ডেকে দেখ তো রচনা বাড়ি আছে কিনা”?
কাবেরী বাইরে থেকেই চিৎকার করে রচনাকে ডাকল। অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী পেছন ফিরতেই রচনা বাড়ির গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সীমন্তিনীকে দেখেই প্রায় ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দিদি, আপনি? কবে এসেছেন? কখন এসেছেন? কাবেরীর দেখা কোথায় পেলেন? ইশ আপনাকে দেখে যে কী ভাল লাগছে! আমি তো ভাবতেই পারিনি, এখানে এভাবে আমাদের বাড়ি চলে আসবেন”!
সীমন্তিনীও রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আজ দুপুরেই এসেছি আমার প্রোজেক্টের কাজে। কিছুটা কাজ করতেও পেরেছি। হঠাৎ করেই রাস্তায় কাবেরীর সাথে দেখা হয়ে গেল। আর ওই আমাকে জোর করে তোমাদের বাড়ি নিয়ে এল। আসলে তোমাদের সাথে তো আর দেখা হয়নি আমার সেদিনের পর। তাই ফেরার বাস ধরবার আগে তোমাকে কনগ্রেচুলেশন জানাতেই শুধু এসেছি গো” বলে হাতে ধরা প্যাকেটটা রচনার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও তোমার জন্যে একটু মিষ্টি এনেছিলাম। কিন্তু আমি কিন্তু আজ আর বসতে পারব না গো ভাই। আমার যে আলিপুরদুয়ারের লাস্ট বাসটা ধরতেই হবে”।
রচনা সীমন্তিনীর হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “ইশ যাব বললেই আমি আপনাকে ছেড়ে দেব ভেবেছেন? আগে ঘরে এসে বসবেন তো। অতিথি বাড়ির দোরগোড়া থেকে ফিরে গেলে গৃহস্থের অকল্যান হয় যে। আসুন আসুন, আয় কাবেরী” বলে সকলকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সীমন্তিনী দেখতে পেল বারো তের বছরের একটা ছেলে একটা ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌতুহলী চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকাচ্ছে।
রচনা বাড়ির উঠোনে এসেই ‘মা মা’ বলে ডাকতেই আরেকটা ঘরের ভেতর থেকে একটা মলিন লাল পেড়ে শাড়ি পড়া এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মহিলার দিকে চোখ পড়তেই সীমন্তিনীর সারাটা শরীরে যেন এক শিহরণ বয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখটা অসাধারণ সুন্দর। বয়স বোধহয় চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মনে হচ্ছে তার সামনে বুঝি স্বয়ং মা দুর্গা দরিদ্র বেশে এসে হাজির হয়েছেন। সীমন্তিনীর ইচ্ছে করছিল তখনই ছুটে গিয়ে সেই অপরূপা মাতৃ রূপিনী মহিলার পায়ে লুটিয়ে পড়তে। সীমন্তিনী সেই অপরূপাকে দেখে একটা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল।
ss_sexy
বিধুভূষন চক্রবর্তী নিতান্ত দরিদ্র এক ',। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকায় ছোট একটা পাহাড়ী জনপদের বাসিন্দা তিনি। জায়গাটা ভূটান সীমান্তের কাছাকাছি। পুরুষানুক্রমে যজমানি করেই তিনি তার পরিবারের ভরন পোষন করেন। পরিবার বলতে দু’টি মেয়ে আর একটি ছেলে সমেত তারা স্বামী-স্ত্রী। বিধুবাবুর স্ত্রী বিভাদেবী একসময়ে ওই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী গৃহবধূ ছিলেন। এখন দারিদ্র আর বয়সের ভারে তার শরীর অনেকটাই ভেঙে পড়লেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুন্দরী। বিভাদেবীর মমতাভরা হাতের ছোঁয়ায় অভাবী সংসারটা কোন রকমে গড়িয়ে গড়িয়ে চলত। বিধুবাবু নিজেও তরুণ অবস্থায় খুবই সুন্দর ছিলেন। এখন বয়সের ভারে, দারিদ্র আর সংসারের নানাবিধ দুশ্চিন্তায় তারও শরীর স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙে গেছে। বড় মেয়ে অর্চনা, ছোট মেয়ে রচনা আর ছেলে কিংশুক তিনজনই দেখতে শুনতে খুবই চমৎকার। আশেপাশের পাঁচ সাতটা গ্রামের মধ্যে অর্চনা আর রচনার মত সুন্দরী মেয়ে আর একটাও নেই। কিংশুক ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তিন ভাই বোনই সুন্দর দেহশ্রীর সাথে সাথে খুবই নম্র আর মিষ্টি স্বভাবের। দীন দরিদ্র হলেও বিধুবাবু আর বিভাদেবী তাদের সবক’টি ছেলেমেয়েকেই সুন্দর সংস্কারী করে তুলেছেন।
ছোট মেয়ে রচনা আর ছেলে কিংশুক পড়াশোনায় খুব চৌকশ। তারা দু’জনেই কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেত। বড়মেয়ে অর্চনা অন্য ভাই বোনের মত পড়াশোনায় পারদর্শিনী না হলেও ঘরকন্যার কাজে বলতে গেলে অতুলনীয়া। তার সুনম্র আচার ব্যবহার আর সুমিষ্ট কথায় গ্রামের সকলেই তাকে খুব স্নেহ করত, ভালবাসত। আর তার রূপের প্রশংসা তো আশেপাশের সকলের মুখেই প্রায় প্রচলিত ছিল। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ করতেই তার বাবা বিধুবাবু আর্থিক টানাপোড়েনের জন্যই তাকে আর পড়াতে পারেননি। তবে কলেজের পাট চুকিয়ে তাকে খুব বেশীদিন ঘরে বসে থাকতেও হয়নি। ২০০৫ সালে ঘটকের মাধ্যমেই পাশেরই এক পাহাড়ী গ্রামের এক দোজবর কলেজ শিক্ষকের সাথে বিধুবাবু তার বড় মেয়ে অর্চনার বিয়ে দিয়েছিলেন।
অর্চনার বয়স তখন মাত্র ষোল বছর। প্রাথমিক ভাবে বিধুবাবু এ বিয়েতে রাজি হতে চাইছিলেন না মূলতঃ দুটি কারনে। এক, পাত্রের বয়স তার মেয়ের বয়সের দ্বিগুণের চেয়েও বেশী। আর দুই, চল্লিশোর্ধ পাত্রটি বিপত্নীক আর তার বারো এবং দশ বছর বয়সী দুটো পূত্র সন্তানও বর্তমান ছিল। তার আগের পক্ষের স্ত্রী নাকি অসুখে ভুগে বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছিল। কিন্তু ভাল সরকারী কলেজের শিক্ষক, আর বাড়ি ঘর দোরের ভাল অবস্থা দেখে বিধুবাবু ভেবেছিলেন, যে মেয়েটা হয়ত সেখানে ভালই থাকবে। বাবার ঘরে ছোটবেলা থেকে সে যে দৈন্য দশার মধ্যে বড় হয়েছে, তেমন অবস্থায় তাকে পড়তে হবে না। মেয়ের হবু শ্বশুর শাশুড়ির আচার ব্যবহারও ভালই লেগেছিল তার। চেনাজানা ঘটক লোকটা তাকে সব দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়েতে মত দিতে বলেছিল। একদিকে দোজবর পাত্রের সাথে তার অমন মিষ্টি মেয়েটার বিয়ে দিতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে সংসারের অভাব অনটন দিনে দিনে এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছিল যে কোন কোনদিন ঘরে দু’বেলা রান্নাও হত না। তার ওপর আরেক মেয়ে ও ছেলের লেখাপড়ার খরচা। বিধুবাবু যেন কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। প্রায় নিরুপায় হয়েই যেচে আসা সম্মন্ধটিকে হাত ছাড়া না করে তিনি বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
দিদির বিয়ের সময় রচনার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। সবে সে ক্লাস এইটে উঠেছিল। কিন্তু ওইটুকু বয়সেই অভাবের সংসারে বড় হতে হতে সে মানসিক ভাবে অনেক পরিপক্কা হয়ে উঠেছিল। বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্যেও দিদির দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে সে অনেক বার আড়ালে আবডালে গিয়ে চোখের জল ফেলেছিল। মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিল যে তার দিদি যেন সুখে থাকে।
দ্বিরাগমন সেরে যাবার পর তার দিদি বা জামাইবাবু কেউই আর তাদের বাড়ি আসেনি কখনও। কিন্তু বিয়ের মাসদুয়েক বাদেই লোক মারফত দিদির লিখে পাঠানো একটা চিঠি পেয়ে রচনা জানতে পেরেছিল যে দিদি তার শ্বশুর বাড়িতে একেবারেই ভাল নেই। তার জামাইবাবু রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। মারধর করে। আর দিনের বেলায় তার শ্বশুর শাশুড়ি তো বটেই এমন কি তার সৎ ছেলে দুটোও দিদিকে নাকি যখন তখন গালমন্দ করে। তার অপরাধ ছিল, বাপের বাড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমানে দান সামগ্রী নিয়ে আসতে না পারা। বিয়ের একমাসের মধ্যেই দু’তিন দিন তার দিদিকে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। সারাদিন শ্বশুর শাশুড়ির গঞ্জনা আর মানসিক অত্যাচার আর রাতের বেলায় স্বামীর হাতে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনাই তার নিত্যদিনের প্রাপ্তি।
তখন থেকেই তার নিজের মনের ভেতর একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। তার পরিণতিও কি তার দিদির মতই হবে? মাধ্যমিক পাশ করলেই বাবা কি তারও এভাবে বিয়ে দিয়ে দেবেন? এমনই আধবুড়ো বিপত্নীক কোন দোজবরের সাথে? ভাবতে ভাবতে সে নিজেই কেঁপে উঠত। সে মনে মনে ভাবত, এমন বিয়ে হওয়ার চেয়ে সারাজীবন কূমারী হয়ে থাকাও বোধহয় ভাল। কিন্তু সে জানে, মা বাবার কথার বিরূদ্ধে যাবার ক্ষমতা, তার দিদির মত, তারও নেই। তাই রোজ সকাল সন্ধ্যা দু’বেলা ঠাকুরঘরে গিয়ে মনে মনে মিনতি করত, তার কপালে যেন এমনটা না হয়।
রচনা প্রথম বিভাগে জেলার মধ্যে প্রথম স্থান নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করবার পর বিধুবাবু মনে মনে ভেবেছিলেন ইচ্ছে থাকা সত্বেও তিনি আর রচনাকে পড়াতে পারবেন না। কিন্তু রচনাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল বিধুবাবুর এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। নিঃসন্তান প্রিন্সিপ্যাল রচনাকে ছোটবেলা থেকেই নিজের মেয়ের মত ভাল বাসতেন। তিনি রচনাকে তাদের কলেজেই এগার ক্লাসে ভর্তি করে বিধুবাবুকে বলেছিলেন যে রচনার জন্য সে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেবেন। তাই বিধুবাবুর ওপর কোন আর্থিক চাপ পড়বে না। আর নিতান্তই যদি স্কলারশিপের ব্যবস্থা না করতে পারেন, তাহলেও বিধুবাবুকে কিছু ভাবতে হবে না। তিনি নিজে রচনার পড়াশোনার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবেন।
****************
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস। ইন্টারকলেজ কুইজ কনটেস্টে কলেজ থেকে বাছাই করা ছ’জন ছাত্রকে নিয়ে রতীশকে তাদের জেলা শহরে যেতে হল। মন্তি আর সতীশ তো আগে থেকেই সেখানে থেকে পড়াশোনা করছিল। মন্তি এম এ ফাইনাল ইয়ারে আর সতীশের বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। মন্তি রতীশকে তার ভাড়া করা বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলেছে। কিন্তু একটা সরকারি গেস্ট হাউসে তাদের কলেজের সকলের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে রতীশ ছাত্রদের সাথেই সে গেস্ট হাউসেই থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রোগ্রামের প্রথম দিনেই একটি মেয়েকে দেখে রতীশ চমকে উঠেছিল। প্রথম রাউণ্ডের ফলাফল প্রকাশ হতেই দেখা গেল যে কালচিনি ব্লকের একটা কলেজের নাম ফলাফলের লিস্টে প্রথম স্থানে। আর সে টিমের গ্রুপ লিডারের নাম রচনা চক্রবর্তী। সেদিন রাতেই রতীশ মন্তিকে ফোন করে বলল, সে যেন পরের দিন সকালে সতীশকে সঙ্গে নিয়ে অডিটোরিয়ামে আসে। সৌভাগ্যক্রমে পরের দিন মন্তি আর সতীশ দু’জনেরই কলেজ ছুটি ছিল। সকাল ন’টার আগেই তারা দু’জন রতীশদের গেস্ট হাউসে চলে এল। রতীশের কলেজের ছাত্ররা সীমন্তিনী আর সতীশকে দেখে খুব খুশী হল। সবাই একসাথে দল বেধে ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে এসে হাজির হল সকাল দশটার আগেই। সবাইকে জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে রতীশ মন্তি আর সতীশকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বলল, “তোদের দু’জনকে একজনকে দেখাব বলে ডেকে এনেছি আমি। তোরাও তাকে দেখে তোদের মতামত জানাবি”।
সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কাকে দেখাবি দাদা”?
রতীশ বলল, “একটা মেয়ে। কালচিনি ব্লকের কোন একটা কলেজের ছাত্রী। আর ওই টিমের গ্রুপ লিডারের নাম রচনা চক্রবর্তী। এর বেশী কিছু আর জানিনা”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “মেয়েটাকে দেখে তোর ভাল লেগেছে দাদাভাই”?
রতীশের মুখ দিয়ে এবার আর যেন কথা সরতে চাইছিল না। দেরাদুনে থাকতেই মন্তি তাকে বুঝিয়েছিল যে রতীশকে অন্য কোন মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। আর কলেজে চাকরি পাবার পর থেকেই সীমন্তিনী যেন উঠে পড়ে লেগেছিল, তার দাদাভাইয়ের বিয়ে দিতে। রোজ ফোনে জিজ্ঞেস করত রতীশ কাউকে পছন্দ করেছে কি না। রতীশ বারবার মন্তির কথা শুনেও শোনে নি। আসলে মন্তিকে ভালবেসে সে নিজের মনের মণিকোঠার যে জায়গাটায় বসিয়েছিল, সেখান থেকে তার ছবিটাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কোনও মেয়েকে জায়গা দেবার কথা সে ভাবতেও পারত না। কিন্তু এই মেয়েটিকে প্রথমবার দেখেই তার মনটা যেন খুশীতে ভরে উঠেছিল। কিন্তু নিজে যেন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তাই তার ছোটবেলা থেকে সে যার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল, সেই মন্তিকে ডেকে এনেছে। কিন্তু যে মুখে অজস্রবার সে মন্তিকে ভালবাসার কথা বলেছে, সে মুখে অন্য কোন মেয়ের নাম উচ্চারণ করতে তার সঙ্কোচ হচ্ছিল। কিন্তু এ মূহুর্তে শুধু মন্তিই নয়, সতীশের মনেও যে একই প্রশ্ন উঠেছে তা সে জানত।
মাথা নিচু করে বলল, “দেখ মন্তি, তুইই বারবার করে আমাকে বলছিলিস কোন মেয়েকে পছন্দ করতে। কিন্তু আমার চোখে এমন মেয়ে আগে আর কখনও পড়ে নি। এ মেয়েটাকে দেখে প্রাথমিক ভাবে আমার ভাল লেগেছে বলেই তোদের ডেকে এনেছি। আমি তো শুধু কাল মেয়েটাকে দেখেছি। আমি ওর নাম, ঠিকানা, পরিচয় কিছুই জানিনা। কাল ফার্স্ট রাউণ্ডের সময় জানলাম যে ও কালচিনি ব্লকের কোন একটা কলেজের ছাত্রী। এর বেশী আর কিছুই আমি জানিনা। তোদেরকে ডেকেছি তোদের মতামত নেবার জন্য। আর তোরা দু’জনেও যেমন জানিস, তেমনি আমাদের বাড়ির সকলেও জানে যে তোর কথা ছাড়া আমি কোন কাজ করি না। তাই তোরা দু’জনে মেয়েটাকে দেখে তারপর তোদের যা বলার বলিস”।
দ্বিতীয় দিনের প্রতিযোগিতা শুরু হবার সাথে সাথে রতীশ মন্তি আর সতীশকে নিজের সাথে নিয়ে বসল। রচনাদের টিমের ছাত্ররা যখন ডায়াসে এসে বসল, তখন রতীশ সতীশ আর মন্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে
বলল, “একদম বাঁদিকের কোনায় বসে থাকা মেয়েটার কথা বলছিলাম আমি”।
মেয়েটাকে দেখে মন্তির খুব ভাল লাগল। সতীশেরও তাই মত। দ্বিতীয় রাউণ্ডেও মেয়েটা একাই প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পালা শেষ হতেই সীমন্তিনী রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদাভাই, তোকে কি সারাক্ষন এখানে বসে থাকতে হবে”?
রতীশ বলল, “তেমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। হলঘর থেকে আমি বেরোতেই পারি। কিন্তু আমাদের কলেজের টিমের পারফর্মেনস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ক্যাম্পাসের ভেতরেই থাকতে হবে। তারপর ছাত্রদের সাথে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারব”।
মন্তি বলল, “তাহলে চল দাদাভাই। আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে বসে একটু কথা বলি”।
তিনজনে ক্যান্টিনে এসে একটা টেবিলের তিনদিকে বসতেই সতীশ সবার আগে বলল, “বড়দি, আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে রে মেয়েটাকে। দাদার সাথে খুব ভাল মানাবে”।
মন্তি রতীশের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সতীশকে বলল, “সেটা তো ঠিকই বলেছিস রে সতু। মেয়েটা তো দেখতে শুনতে খুবই ভাল। কিন্তু জানিস তো? আজকাল কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পেছনে ভাল মন্দ ছেলেদের লাইন পড়ে যায়। প্রায় সব মেয়েই কোন না কোন ছেলের সাথে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এ মেয়েটার মুখে চোখে আমি অন্য একটা ছোঁয়া দেখতে পেয়েছি রে সতু। মেয়েটা খুবই লক্ষীমন্ত হবে। তবে কারুর সাথে প্রেমটেম করে কিনা সেটা বলা মুস্কিল। তবে দাদাভাইয়ের যখন পছন্দ হয়েছে, তবে মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতেই হচ্ছে। শোন সতু, কালচিনি কলেজের টিমটার সাথে টিচার কে এসেছেন, একটু খবর নিয়ে দেখ তো। মেয়েটার নাম ঠিকানা বা বাবার নাম এসব কিছু জানা যায় কিনা। আর আমি মেয়েটার একটা ছবি তুলে নেবার চেষ্টা করছি। আর কোনভাবে মেয়েটার সাথে ভাব করতে পারি কিনা দেখি। তাহলে হয়ত ভেতরের খবরগুলো জানা যাবে। আর দাদাভাই, তুইও যদি পারিস, কিছু খবরাখবর নে। তবে একটা কথা, মেয়েটার সাথে তোরা কেউ সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করিস না। বাকিটা আমি দেখছি”।
ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়েই সীমন্তিনী একা একদিকে চলে গেল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনীকে দেখা গেল ডেলিগেটসদের ঘরের সামনে। ঘরের ভেতর বিভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়ের জটলা। কালচিনি কলেজের টিম তাদের সেকেণ্ড রাউণ্ডের কুইজ শেষ করে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তারা সকলেই তাদের পারফর্মেন্সে উচ্ছ্বসিত। সীমন্তিনী অনেক কষ্টে ভিড় কাটিয়ে সেই দলের কাছে গিয়ে অন্য একটা মেয়ের কাছে গিয়ে বলল, “ভাই শোনো, কিছু মনে কোর না। তোমাদের সেকেণ্ড রাউণ্ডেও তোমরা খুব ভাল পারফর্ম করেছ। তাই তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে এলাম। কিছু মনে করছ না তো”?
মেয়েটা জবাব দিল, “না না দিদি, মনে করব কেন? বলুন কী বলতে চান”?
______________________________
(Update No. 13)
সীমন্তিনী বলল, “শোন ভাই। আমার নাম সীমন্তিনী। এখানে ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়ছি। ফাইনাল ইয়ার। তোমরা তো কালচিনি ব্লক থেকে এসেছ, তাই না”?
মেয়েটা বলল, “হ্যা দিদি। আমরা কালচিনি থেকেই এসেছি। কিন্তু আপনাকে দেখে তো কালচিনির মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না”।
সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “না ভাই আমি কালচিনির নই। আমার বাড়ি এখান থেকে একটু দুরে। বাসে যেতে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মিনিটের মত লাগে। কিন্তু তোমরা কালচিনির শুনেই তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। আসলে কি হয়েছে জানো। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ডুয়ার্সের কোন একটা ব্লক নিয়ে একটা রিপোর্টিং জমা দিতে হবে আমাকে। ওই প্রোজেক্ট ওয়ার্ক আর কি। আমাদের এক স্যার আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন যে কালচিনি ব্লকের ওপর একটা প্রতিবেদন লিখতে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাকে সেখানে গিয়ে সব কিছু দেখে শুনে রিপোর্টটা বানাতে হবে। কিন্তু অজানা অচেনা জায়গায় যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না। আর ওখানে চেনা পরিচিত কেউ নেই আমার। তাই ভাবলাম তোমাদের কাছ থেকে একটু খবরাখবর নিই। আচ্ছা তোমাদের ওখানে কি থাকবার মত কোন হোটেল টোটেল আছে”?
মেয়েটা বলল, “না দিদি। আমাদের জায়গাটা ব্লক হেড কোয়ার্টার হলেও খুবই অনুন্নত। কয়েকটা খাবার হোটেল অবশ্য আছে। কিন্তু থাকতে হলে কারুর বাড়ি ছাড়া একমাত্র সরকারি ডাক বাংলোই পাবেন। তবে আপনি যদি একা যান, তাহলে ওই সব ডাক বাংলোয় থাকাটা খুব ঝামেলার হয়ে উঠতে পারে। লোকাল এমএলএ আর তাদের দলবলের লোকেরা প্রায় সারাক্ষণই সেখানে আড্ডা মারতে থাকে। ড্রিঙ্ক করার পক্ষে সেসব জায়গা খুব উপযুক্ত। তাই একা কোন মেয়ের সেখানে না যাওয়াটাই উচিৎ”।
সীমন্তিনী যেন মেয়েটার কথা শুনে খুব হতাশ হল। এমন ভাব করে বলল, “ইশ, তাহলে তো ভারী মুস্কিল হল আমার। আচ্ছা আমি যদি সকালে গিয়ে কিছুটা কাজ করে আবার ফিরে আসতে চাই, তাহলে ফেরার গাড়ি পাব তো? আর কোন রাস্তায় কোনদিক দিয়ে যেতে হবে, তাও তো জানিনা”।
মেয়েটা বলল, “এখান থেকে কালচিনি যাবার দু তিনিটে রাস্তা আছে দিদি। তবে বেশীর ভাগ লোকই ভায়া আলিপুরদুয়ার আসা যাওয়া করে। অবশ্য নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে ঘূপগুড়ি, মাদারীহাট, বীরপারা হয়ে গেলে প্রায় পৌনে তিন ঘন্টায় কালচিনি পৌঁছে যাওয়া যায়। আর ডাইরেক্ট ট্রেনে যেতে হলে তো সময় আরও অনেক বেশী লাগে। এখান থেকে সেবক চালসা নাগরাকাটা বানারহাট হয়ে বাস কালচিনিতে পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা আট ঘন্টার মত সময় লেগে যায়। আর এখান থেকে বাসে আলিপুরদুয়ার যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। আর আলিপুরদুয়ার থেকে বাসে কালচিনিতে যেতে আরও এক ঘন্টার মত লাগে। তাই বাসে এখান থেকে আলিপুরদুয়ার হয়ে কালচিনি যেতে মোট চার ঘন্টার মত লাগে। আমরাও বাসে সে পথেই এসেছি। কিন্তু দিদি, আপনি যেমনটা চাইছেন তা বোধ হয় সম্ভব হবে না। এখান থেকে আমাদের জায়গায় যেতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লেগে যায়। আসা যাওয়াতেই তো আপনার আট ঘন্টা সময় চলে যাবে। আপনি সকালে এখান থেকে গিয়ে যদি দু’ তিন ঘন্টা থেকে সেখান থেকে ফিরে আসতে চান, তাহলে তো আপনার এখানে আসতে গভীর রাত হয়ে যাবে। আর রাতের বেলায় একা একজন মেয়ের পক্ষে এ’সব রাস্তায় চলাফেরা করা একেবারেই উচিৎ হবে না”।
সীমন্তিনী আরও মুষড়ে পড়ে বলল, “ওরে বাবা, না না, একা একা অজানা অচেনা রাস্তায় রাতের বেলায় জার্নি করার সাহসই হবে না আমার। ইশ, কি যে করি এখন আমি”।
এমন সময় রতীশের চোখে পড়া মেয়েটি এগিয়ে এসে সীমন্তিনী যার সাথে কথা বলছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে রে কাবেরী? কোন প্রব্লেম”?
কাবেরী তার দিকে চেয়ে বলল, “নারে রচনা তেমন কিছু নয়। আসলে এ দিদি একটু সমস্যায় পড়ে গেছে”।
রচনা ততক্ষণে দু’জনের কাছে এসে গেছে। সে হাতজোড় করে সীমন্তিনীকে নমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, “নমস্কার দিদি, আমি রচনা। রচনা চক্রবর্তী। আমি কি শুনতে পারি কি সমস্যা হয়েছে আপনার”?
রচনার অপূর্ব মিষ্টি গলার স্বর শুনে সীমন্তিনী চমকে উঠল। কিন্তু নিজেকে সংযত করে জবাব দিল, “ওঃ হ্যা, নমস্কার ভাই। আমি সীমন্তিনী। এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। আসলে একটা প্রোজেক্ট ওয়ার্ক করতে আমার কালচিনি যাবার দরকার হয়ে পড়েছে। কালচিনি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনা। তাই ওর কাছে একটু তোমাদের জায়গাটার ব্যাপারে খবর নিচ্ছিলাম, যে ওখানে গিয়ে কোথাও থাকবার জায়গা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ওর মুখে যা শুনছি তাতে তো যাবার সাহসই পাচ্ছিনা। তোমার বান্ধবী বলল, ওখানে নাকি সরকারী ডাক বাংলো ছাড়া আর কোন জায়গা নেই থাকবার। সে বাংলোতেও নাকি আমার পক্ষে রাত কাটানো ঠিক হবে না। আর এখান থেকে আপ ডাউন করেও আমার কাজটা করা সম্ভব নয়। তাই একটু চিন্তায় পড়ে গেছি ভাই। কিন্তু তোমাদের বিরক্ত করেও কোন লাভ হল না আমার। সরি ভাই। তোমরা কিছু মনে কোর না। আমি অযথাই তোমাদের সময় নষ্ট করলাম”।
রচনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ, দিদি, আপনি এমন করে বলছেন কেন? আমি বা আমার বান্ধবী কেউই কিছু মনে করিনি আমরা। কিন্তু দিদি, কাবেরী কিন্তু আপনাকে সত্যি কথাই বলেছে। মেয়েদের পক্ষে আমাদের ওখানের ডাক বাংলোয় থাকাটা কিন্তু একেবারেই সমীচীন নয়। আপনার যদি সেখানে যেতেই হয় তাহলে চেনা পরিচিত কারো বাড়িতে থেকেই আপনাকে নিজের কাজ সারতে হবে”।
সীমন্তিনী রচনার একটা হাত নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলল, “কাবেরীও তো সে’কথাই বলল আমাকে। কিন্তু আমি তো সেখানে কাউকে চিনিনে। তবে তোমরা দু’বান্ধবী সত্যিই খুব ভাল গো। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা আমার ওপর রাগ করবে। চেনা নেই জানা নেই, এভাবে এতক্ষণ ধরে তোমাদের সাথে কথা বলাতে তোমরা বিরক্ত তো হতেই পার। আমার উদ্দেশ্যটা হয়ত সফল হল না। তবু তোমাদের এমন মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তোমাদের দু’জনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। আমি কাল স্যারকে বলে দেব আমার পক্ষে ওই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। আমাকে যেন তিনি অন্য কোন প্রোজেক্ট দেন। আসি ভাই। আর তোমাদের বিরক্ত করব না। আমার শুভেচ্ছা রইল তোমাদের টিমের জন্য। তোমরা এ কনটেস্টে চ্যাম্পিয়ন হলে আমি খুব খুশী হব। আসি ভাই” বলে মিষ্টি করে একটু হেসে তাদের ছেড়ে একদিকে এগিয়ে গেল।
সেদিন রাতে সীমন্তিনী সতীশের পাশে বসে দু’জনে চা খেতে খেতে গল্প করছিল। সতীশ নিজের মোবাইলে তোলা রচনার ছবি দেখিয়ে সীমন্তিনীকে বলল, “বড়দি, মেয়েটার নাম রচনা চক্রবর্তী। কালচিনির একটা গ্রামে বাড়ি। তার বাবার নাম বিধুভূষণ চক্রবর্তী। তার পেশা যজমানী। যথেষ্ট সৎ এবং ভদ্রলোক। কিন্তু খুব গরীব। তার দু’মেয়ে আর একটি ছেলে। ছেলেটা ছোট। ক্লাস এইটে পড়ে। আর তাদের বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন তাদের বাবা মা আর দু’ভাই বোন। তবে কোন ছেলের সাথে কোন এফেয়ার আছে কিনা, সে খবরটা জানতে পারিনি রে”।
সীমন্তিনী শুনে বলল, “বাব্বা, তুই তো অনেক খবর যোগাড় করেছিস রে ভাই! আমি তো শুধু এটুকুই জেনেছি যে ও মেয়েটাই রচনা চক্রবর্তী। কিন্তু মেয়েটার গলার স্বরটা যে কী মিষ্টি না, তা তোকে বলে বোঝাতে পারব না রে ভাই। একটুখানি কথাও বলেছি তার সাথে। তাতে মনে হল বেশ ভদ্র”।
সতীশ বলল, “ওঃ আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছিরে বড়দি। মেয়েটা আর তার ছোট ভাই দু’জনেই লেখাপড়ায় খুব ভাল। দু’জনেই ক্লাসে ফার্স্ট হয় বছর বছর। আর মাধ্যমিকে সে এ ডিস্ট্রিক্টে ফার্স্ট পজিশন পেয়েছিল”।
সীমন্তিনী মোবাইলে রচনার ছবিটা ভাল করে দেখতে দেখতে বলল, “মেয়েটা বেশ সুন্দর, তাই নারে সতু?
জেঠু আর বড়মার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে তাই নারে”?
সতীশ বলল, “তাদের অপছন্দ হলেই বা কি? তোর যদি পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে তোর কথার ওপর আর কেউ কিছু বলবে ভেবেছিস? অবশ্য এটাও ঠিক, এ মেয়েকে শুধু মা বাবা কেন, যে দেখবে সেই পছন্দ করবে। আমার তো খুবই ভাল লেগেছে। হাইটটা আর ইঞ্চি দুয়েক বেশী হলে ফাটাফাটি হত। কিন্তু ওকে তো খাটোও বলা যায় না। পাঁচ চার সাড়ে চার হবে ডেফিনিটলি”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি দাদাভাইয়ের পছন্দ হয়েছে বলে। তবে হ্যা, তুই যেটা বললি, সেটাও ঠিক। আর ইঞ্চি দুয়েক হাইট বেশী হলে খুব ভাল হত। দাদাভাই আর আমি তো সমান। পাঁচ এগার। ওর যদি পাঁচ সাত আটের মত হত তাহলে আরো ভাল হত। কিন্তু একটা ব্যাপারেই সামান্য একটু খামতি থাকলেও মেয়েটা কিন্তু আর সব দিক দিয়েই একেবারে দাদাভাইয়ের উপযুক্ত। দেখতে চমৎকার মিষ্টি চেহারা। গায়ের রঙও খুব চমৎকার। হাঁসিটা তো অপূর্ব। একেবারে মন কেড়ে নেয়া হাঁসি। ওর হাঁসি দেখেই সবাই ওকে ভালবাসবে। তার ওপর কথাবার্তা, আচার ব্যবহারও ভাল। লেখাপড়ায় ভাল। আর মুখে একটা লক্ষী লক্ষী ভাব আছে। ভদ্র পরিবারের মেয়ে। আর কী চাই বল। শুধু হাইটটা নিয়ে কম্প্রোমাইজ করলেই মেয়েটা সবদিক দিয়েই দাদাভাইয়ের উপযুক্ত। হ্যা, ওর বাবার আর্থিক অবস্থাটা ভাল নয়। তাতে কি হল? দাদাভাই তো আর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরের পয়সায় খাবে না। তাই আমি কিন্তু মনে মনে মেয়েটাকে আমাদের বৌদি বানিয়ে নিতে রাজি হয়ে গেছিরে ভাই”।
সতীশও খুব খুশী হয়ে বলল, “তাহলে বাড়িতে ফোন করে মাকে খবরটা দিই, না কি বলিস”?
সীমন্তিনী বলল, “নারে সতু। এখনই নয়। এখন দাদাভাইকে বা বাড়ির কাউকে কিছু বলিস না। দ্যাখ এমন সুন্দরী আর গুণী মেয়ের পেছনে অনেক ছেলেই লাগতে পারে। কারো সাথে মেয়েটার প্রেম ভালবাসার কোন সম্পর্ক আছে কিনা, সেটা একটু খোঁজ খবর করে দেখতে হবে সবার আগে। আমি একটা প্ল্যান করেছি মনে মনে। তাতে যদি দেখি যে তেমন কিছু নেই, তাহলে ওই মেয়েটাই আমাদের বাড়ির বড়বৌ হবে দেখিস”।
সতীশ নিজের উচ্ছ্বাসকে সংযত করে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু সেটা তুই কিভাবে করবি বল তো বড়দি? কাউকে কি এ ব্যাপারে সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায়”?
সীমন্তিনী বলল, “না সেটা হয়ত যায় না রে ভাই। আর লজ্জা সঙ্কোচ ছেড়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও তার সত্যি জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তাই এটা জানতে একটা অন্য ফন্দি বের করতে হবে। আর সেটা আমি মনে মনে ভাবছি। কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত তুই রচনার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবি না, বুঝেছিস”?
সতীশ বলল, “তোর কথা অমান্য করার সাহস আমাদের পরিবারে কার আছে রে বড়দি? তুই যা বলছিস তাই হবে। কিন্তু কী ফন্দি আঁটছিস তুই, একটু বলবি আমাকে”?
সীমন্তিনী বলল, “আপাততঃ এটুকু বলতে পারি যে আমি কালচিনি যাচ্ছি। তারপরে কী করব সেটা এখনও ভাবিনি। শোন ভাই। তোর তো কাল বাড়ি যাবার কথা ছিল। তুই বড়মাকে ফোন করে জানিয়ে দে তুই কাল নয়, কয়েকদিন বাদে বাড়ি যাচ্ছিস। কুইজ কনটেস্ট তো কালই শেষ হচ্ছে। ওরা সকলে হয়ত কালই চলে যাবে। আমি পরশুদিন কালচিনি যাব। অবশ্য পরের দিনই ফিরে আসবার চেষ্টা করব। আমি ফিরে এলেই তুই বুঝতে পারবি আমাদের এরপর কী করতে হবে। তারপর বাড়ি গিয়ে কাকে কি বলবি তা তুই নিজেই বুঝতে পারবি। তাই তুই বড়মাকে ফোন করে আপাততঃ বলে দে যে তুই কাল বাড়ি যাচ্ছিস না। তিন চারদিন বাদে যাচ্ছিস। আর আমিও দাদাভাইকে সেভাবেই বলে দেব। দাদাভাইও তো কাল বিকেলেই চলে যাবে বলেছে”।
সতীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কালচিনি যাবি? একা”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যারে ভাই। দাদাভাইয়ের জন্য এটুকু করতে পারব না আমি? আর তুই ভাবিস না।
জানিস তো? আমি ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট পেয়েছি। যে কোন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা করতে পারব আমি। কালচিনি না গেলে আমি আসল খবরটা পাব না। তাই যেতে আমাকে হবেই। তুই আর দুটো দিন থাক এখানে। প্রয়োজনে আমাকে ফোন করিস। কিন্তু রচনার ব্যাপারে বাড়িতে বা দাদাভাইকে আপাততঃ কিচ্ছুটি বলিস না। আর আমি যে কালচিনি যাচ্ছি, এ’কথাটাও কাউকে বলবি না”।
**************
দু’দিন বাদে সীমন্তিনীকে দেখা গেল কালচিনি বাস স্ট্যাণ্ডে। বেলা তখন প্রায় বারোটা। সকাল আটটায় সে জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিল। বাস থেকে নেমেই সবার আগে সে কোন হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিতে চাইল। বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল তার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সে একটা ছোটখাট খাবার হোটেল খুঁজে পেল। খেয়ে দেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসবার আগেই হোটেলের কাউন্টারে বসে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করে রচনাদের বাড়ির হদিশ জেনে নিল। তারপর এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের দিকে একটা রাস্তায় সে কাবেরীকে দেখতে পেল। কাবেরী একটা ছোট ছেলের হাত ধরে ফুটপাথ ধরে একদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী একটু পা চালিয়ে কাবেরীর অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে পেছন থেকে কাবেরীর নাম ধরে ডাকল।
কাবেরী পেছন ফিরে সীমন্তিনীকে দেখে যার পর নাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আরে দিদি? আপনি এখানে”?
সীমন্তিনী হাঁপাতে হাঁপাতে ম্লান হেসে বলল, “আর বোলনা গো। কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয় আর কি”।
কাবেরী আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো সেদিন বললেন যে আপনি কালচিনি আসছেন না! আপনার স্যারকে বলে আপনার প্রোজেক্টটা চেঞ্জ করে নেবেন। তাহলে আজ আবার এখানে কেন এসেছেন আপনি? আর কোথায় উঠেছেন”?
সীমন্তিনী আবার একটু কষ্ট মিশ্রিত হাঁসি হেসে বলল, “উঠব আর কোথায় ভাই? তোমাকে বললাম না? কপালের দুর্ভোগ। স্যার কিছুতেই আমার প্রোজেক্টটা চেঞ্জ করতে রাজি হলেন না। আর সাতদিনের মধ্যে আমাকে রিপোর্ট জমা দিতে বললেন। তাই নিরূপায় হয়ে আমাকে আসতেই হল। অবশ্য ঘন্টা তিনেক হয়ে গেছে এখানে এসেছি। কিছু ম্যাটেরিয়ালসও নোট করেছি। বাস স্ট্যাণ্ডে শুনলাম বিকেল পাঁচটায় নাকি আলিপুরদুয়ার যাবার শেষ বাস। সেটাতেই যাব ভেবেছি। তোমার সাথে যে এভাবে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। এখানে তো আমি আর কাউকে চিনি না। তোমাকে দেখে তাই খুব ভাল লাগল গো। মনে হল অচেনা জায়গায় এসে নিজের কাউকে যেন খুঁজে পেলাম”।
কাবেরী বলল, “সে না হয় বুঝলুম দিদি। কিন্তু পাঁচটার বাসে গিয়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে জলপাইগুড়ি গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে তো বেশ রাত হয়ে যাবে আপনার”!
সীমন্তিনী বলল, “কি আর করা যাবে বল? আর তো কোন উপায় নেই। ফিরে তো যেতেই হবে। কিন্তু ওঃ। কনগ্রেচুলেশন। কুইজ কনটেস্টে তোমরা ফার্স্ট হয়েছ। দারুণ ব্যাপার” বলে কাবেরীর হাত ধরল।
কাবেরী হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দিদি। তবে রচনা আমাদের টিমে না থাকলে কিছুই হত না”।
সীমন্তিনী নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “ইশ তোমার সাথে দেখা হল। কিন্তু রচনার সাথে বোধহয় আর দেখা করা সম্ভব হবে না গো। ওর সাথে দেখা হলে খুব খুশী হতুম”।
কাবেরী সীমন্তিনীর হাত ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “আপনি যাবেন দিদি? রচনার বাড়ি এখান থেকে খুব বেশী দুরে নয়। অটোতে গেলে দশ মিনিটেই পৌঁছে যাব আমরা। আপনার বাস ধরতে তো এখনও প্রায় ঘন্টাখানেক দেরী আছে। চলুন না দিদি। রচনাও আপনাকে দেখে খুব খুশী হবে”।
সীমন্তিনী বলল, “ওর সাথে দেখা হলে তো আমারও খুব ভাল লাগবে কাবেরী। কিন্তু এভাবে হুট করে কারো বাড়িতে যাওয়াটা কি ভাল দেখাবে বল”?
কাবেরী ততক্ষণে হাতের ঈশারায় একটা পথ চলতি অটো থামিয়ে দিয়েছে। অটোটা থামতেই সীমন্তিনীর হাত ধরে টানতে টানতে অটোতে উঠতে উঠতে কাবেরী বলল, “আপনাকে আমি ঠিক সময় মত বাস স্ট্যাণ্ডে পৌঁছে দেব দিদি। এখন সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি আসুন”।
রাস্তায় একটা মিষ্টির দোকানের সামনে অটো থামিয়ে সীমন্তিনী চটপট দু’বাক্স মিষ্টি কিনে নিল। অটোতে ফিরে এসে পাশের ছেলেটির দিকে ঈশারা করে বলল, “ও বুঝি তোমার ছোট ভাই”?
কাবেরী জবাব দিল, “হ্যা দিদি, ও আমার ভাই শিবতোষ”।
সীমন্তিনী একটা মিষ্টির বাক্স কাবেরীর হাতে দিয়ে বলল, “এটা রাখ। তোমাদের ভাই বোনের জন্য। এ দিদির তরফ থেকে একটু মিষ্টি খেও তোমরা”।
কাবেরী প্যাকেটটা হাতে নিয়ে একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “এ সবের কি দরকার ছিল দিদি”?
সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বলল, “বারে দিদি হয়ে ছোট ভাই বোনকে কিছু দেওয়া কি অপরাধ”?
কাবেরী তটস্থ হয়ে বলল, “না না দিদি, এমন কথা বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না প্লীজ”।
সীমন্তিনী আবার হেসে বলল, “তাহলে আর কথা বোল না। বাড়ি গিয়ে দু’ভাই বোনে মিলে খেতে খেতে এ দিদিটার কথা একটু মনে কোর”।
একটা পুরোন জীর্ন প্রায় বাড়ির সামনে এসে অটোটাকে থামতে বলে কাবেরী সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি আমরা এসে গেছি”।
অটো থেকে নামতে নামতে সীমন্তিনী বলল, “অটোর ভাড়া আমি চুকিয়ে দিচ্ছি কাবেরী। তুমি ডেকে দেখ তো রচনা বাড়ি আছে কিনা”?
কাবেরী বাইরে থেকেই চিৎকার করে রচনাকে ডাকল। অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী পেছন ফিরতেই রচনা বাড়ির গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সীমন্তিনীকে দেখেই প্রায় ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দিদি, আপনি? কবে এসেছেন? কখন এসেছেন? কাবেরীর দেখা কোথায় পেলেন? ইশ আপনাকে দেখে যে কী ভাল লাগছে! আমি তো ভাবতেই পারিনি, এখানে এভাবে আমাদের বাড়ি চলে আসবেন”!
সীমন্তিনীও রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আজ দুপুরেই এসেছি আমার প্রোজেক্টের কাজে। কিছুটা কাজ করতেও পেরেছি। হঠাৎ করেই রাস্তায় কাবেরীর সাথে দেখা হয়ে গেল। আর ওই আমাকে জোর করে তোমাদের বাড়ি নিয়ে এল। আসলে তোমাদের সাথে তো আর দেখা হয়নি আমার সেদিনের পর। তাই ফেরার বাস ধরবার আগে তোমাকে কনগ্রেচুলেশন জানাতেই শুধু এসেছি গো” বলে হাতে ধরা প্যাকেটটা রচনার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও তোমার জন্যে একটু মিষ্টি এনেছিলাম। কিন্তু আমি কিন্তু আজ আর বসতে পারব না গো ভাই। আমার যে আলিপুরদুয়ারের লাস্ট বাসটা ধরতেই হবে”।
রচনা সীমন্তিনীর হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “ইশ যাব বললেই আমি আপনাকে ছেড়ে দেব ভেবেছেন? আগে ঘরে এসে বসবেন তো। অতিথি বাড়ির দোরগোড়া থেকে ফিরে গেলে গৃহস্থের অকল্যান হয় যে। আসুন আসুন, আয় কাবেরী” বলে সকলকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সীমন্তিনী দেখতে পেল বারো তের বছরের একটা ছেলে একটা ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌতুহলী চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকাচ্ছে।
রচনা বাড়ির উঠোনে এসেই ‘মা মা’ বলে ডাকতেই আরেকটা ঘরের ভেতর থেকে একটা মলিন লাল পেড়ে শাড়ি পড়া এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মহিলার দিকে চোখ পড়তেই সীমন্তিনীর সারাটা শরীরে যেন এক শিহরণ বয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখটা অসাধারণ সুন্দর। বয়স বোধহয় চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মনে হচ্ছে তার সামনে বুঝি স্বয়ং মা দুর্গা দরিদ্র বেশে এসে হাজির হয়েছেন। সীমন্তিনীর ইচ্ছে করছিল তখনই ছুটে গিয়ে সেই অপরূপা মাতৃ রূপিনী মহিলার পায়ে লুটিয়ে পড়তে। সীমন্তিনী সেই অপরূপাকে দেখে একটা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল।
To be continued .........
___________________________________________________________________ss_sexy