14-02-2020, 07:32 AM
আমি আর নিতে পারছিলাম না। কানে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম: “প্লিজ স্যার, চুপ করুন!” তারপর নিজের অজান্তেই একটা বিস্ফারিত কান্নার হাহাকার আমার গলা দিয়ে বের হয়ে এলো: “কোথায়, কোথায়, কোথায় আমার সোনাদি? আমার হতভাগিনী সোনাদিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনারা?” মাসিমা আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললেন: “তোমার মধ্যে এই ভালোবাসার বারুদটার এমনভাবে ফেটে পড়ারই অপেক্ষা করছিলাম আমরা। কারণ তোমার হাতেই তো ওর বাকি জীবনটার ভালো-মন্দ নির্ভর করছে! এতোক্ষণে বুঝলাম, আমার সমু ঠিক লোককেই বাসায় নিয়ে আসতে পেরেছে!...” মাসিমার এই ইর্-রিলেভ্যান্ট কথার মাথা-মুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে না পেরে আমি যখন পাজলড্ দৃষ্টিতে দু’জনের দিকেই তাকাচ্ছি, তখন স্যার আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন: “বুঝলে ব্রাদার, এখানে আনবার পর, এই মাস ছ’য়েক-এ ওর সাইকোলজিকাল কাউন্সেলিং-সহ অনেকরকম চিকিৎসাই করিয়েছি। আমার থেকেও বেশী করেছে মাসি। নিজের মেয়ের চেয়েও বোধ করি বেশী করে বুকে আগলে রেখে সেবা করেছে ওর। মেয়েটির প্রতি এই ক’দিনেই মাসির দরদ-ভালোবাসার বহর, চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না।…” মাসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন: “কিন্তু এতো কিছুর পরও ও ঠিক স্বাভাবিক হল না। মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারিনি। সারাক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে চেয়ে বসে থাকত। প্রায়সই রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলত, দুঃস্বপ্ন দেখে। তারপর একদিন…” স্যার মাসিমার কথাটার খেই ধরে নিলেন: “মাস-দুয়েক আগে হবে। তুমি একদিন ইকলেজ ফেরতা আমার বাড়িতে কিছু একটা দিতে এসেছিলে। তখন বিকেল। মাসি প্রতিদিনের মতো ওকে নিয়ে ছাদে বেড়াচ্ছিল সে-সময়। হঠাৎ তোমাকে ওই এক-ঝলক সদরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই, হঠাৎ মেয়েটির মধ্যে আশ্চর্য একটা চাঞ্চল্য, ছটফটানি শুরু হল। অনেকদিন পর ওর চোখ দিয়ে দরদর করে জলের ধারা নামতে লাগল। কিন্তু বুক ফাটলেও মুখ ফুটল না।…” মাসিমা বললেন: “সেদিন সারা রাত কেঁদে-কেঁদে ওর ভোরের দিকে জ্বর চলে এসেছিল। আমি বাধ্য হয়ে সমুকে বললাম, ছেলেটিকে আবারও যেকোনো ছুতোয় বাড়িতে ডাক; সম্ভব হলে আজই! ওর মধ্যেই এই অভাগীর কোনো অসম্পূর্ণ অতীত নিশ্চই লুকিয়ে আছে!…” তাঁতি-স্যার হাসলেন: “মনে করে দেখো, আমি পরদিনই তোমাকে বাড়িতে ডেকে এনেছিলাম, ফালতু একটা অজুহাতে, পিএফ-এর হিসেব কষবার ছুতোয়। নীচের বসার ঘরে বসিয়ে, মোবাইল-ক্যামেরায় তোমার সঙ্গে সেলফিও তুলেছিলাম।…” মাসিমা বললেন: “সেই দিনের পর থেকে ওর মধ্যে আস্তে-আস্তে একটা পরিবর্তনের আঁচ টের পেলাম। চোখের দৃষ্টিটা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগল। বিকেলে ছাদে উঠলেই, ঠায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে তোমাকে খুঁজতো। আমার মোবাইল থেকে তোমার আর সমুর সেলফি-ছবিটা বের করে আপন-মনে হাত বোলাতো।… ব্যাপার-স্যাপার দেখে, আমি সমুকে বললাম, তোমার ব্যাপারে সিরিয়াসলি খোঁজখবর করতে।…” স্যার বললেন: “মাসির তাগাদায় আমি তাই কলকাতাতেও ছুটেছিলাম। ভীমাবতী এই ক’মাসে নিয়মিত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ওঁর সোর্স থেকেই সায়ন্তীর নাম, আর ওর মানিকতলার বাড়ির খোঁজ পাই। কিন্তু সায়ন্তীর বাবা তো স্বীকারই করতে চাইলেন না, তাঁর কোনো মেয়ে ছিল বলে! নিজের সন্তানের উপর মানুষের এতোটা নির্দয় অভিমান এতোদিন পরেও যে থাকতে পারে, সেটা ওই পাষাণ মানুষটাকে না মিট্ করলে, সত্যিই আমার পক্ষে ভাবা কঠিন হতো।…” মাসিমা বললেন: “সমু কলকাতায় গিয়ে বিশেষ-কিছু সুবিধে করতে পারল না। এদিকে একটা খারাপ খবর এলো, ইউ-পি-র ইলেকশান ডিউটিতে কোনো একটা গণ্ডগোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন শ্রীমতী ভীমাবতী মনু।…” স্যার যোগ করলেন: “তখন মাসি আমাকে পরামর্শ দিল, তোমাকে যে করে হোক, এ বাড়িতে এনে রাখতে হবে! প্রতিদিন চোখের উপর তোমাকে দেখলে যদি কিছু একটা মিরাকল্ ঘটে।… যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। তোমার ভাড়া-বাড়ির সমস্যার কথা শুনেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রায় লুফে নিয়ে এলাম তোমাকে এখানে। তারপর…”
সমাপ্ত
মাসিমা হঠাৎ খাট থেকে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে এগোতে-এগোতে বললেন: “সপ্তাহ-খানেক আগে ও প্রথম ঠিক মতো কথা বলেছে। ও সবই বলেছে আমাকে। তোমার কথা… ওর কথা… তোমাদের কথা। ও কাল থেকে সারারাত ধরে অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্যে। এসো, এসো আমার সঙ্গে…”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পায়ে-পায়ে মাসিমার পিছু-পিছু সিঁড়ি ভেঙে তিনতলার ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরটা কেমন যেন নিভু-নিভু অন্ধকার। সাত-সকালেও চারদিকে জানালা-দরজা সব বন্ধ। সহজে ঘরের মধ্যে দৃষ্টি চলে না। মাসিমা আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে, বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তখনই ঘরের আলোটা ফটাস্ করে জ্বলে উঠল। ধাঁধিয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে কোনোমতে দেখলাম, সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক ক্ষয়িষ্ণু নারী মুর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের মাঝখানে। সে যেন বহু অতীত কোনো কালে আমার পরিচিতা কেউ ছিল। ওই শুকনো মুখ, ক্ষয়াটে-ফ্যাকাসে চেহারা, চোখের নীচে কালি, কঙ্কালসার দেহের আনাচে-কানাচে ক্ষত-বিক্ষত যৌবনের চিহ্ন – এই অবয়বের অনেক-অনেক নীচে কোথাও আমার সেই রূপকথার পরী চাপা পড়ে গেছে।…
উলঙ্গিনী ধীর পদক্ষেপে আমার দিকে এগিয়ে এলো। ওই ভীষণ রুগ্ন চেহারাটায় দুটো অতি-স্ফীত বুকই কেবল প্রকটভাবে জাজ্জ্বল্যমান। সেই নরম বুক-দুটো আমার বুকে ঠেকিয়ে, আমার শ্বাসে নিজের তপ্ত শ্বাস মিশিয়ে দিল নগ্নিকা। আমি অবোধ-বালকের মতো, ওই স্তন-ভার নিজের মুঠোর নিস্পেষণে পুড়ে নিলাম বিনা আমন্ত্রণেই। নগ্নিকা আমার মাথাটা দু-হাত দিয়ে তুলে ধরে, অনুচ্চ-কন্ঠে বলে উঠল: “আমি অসূচী… অপবিত্র… নোঙরা!...” আমি প্রত্যুত্তরে শুধু বলতে পারলাম: “আমি তোমাকে আজও পাগলের মতো ভালোবাসি!... যেকোনো শর্তের ঊর্ধ্বে… জীবনের শেষতম বিন্দু দিয়েও!...”
তারপর সব কথা নিভে গেল। অন্ধকার আরও গাঢ় হল। আর আমি ক্রমশ হারিয়ে গেলাম আমার প্রিয় রূপকথার সেই আবহমান খরস্রোতায়… অনেকদিন পর… বহুযুগ নির্বাসনের পর।…সমাপ্ত