Thread Rating:
  • 14 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
বিপ্লব পোদ্দার- ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার- complete
#19


বিপ্লব কি আমায় এখনো আগের মতই ভালোবাসে? উফ সেইদিনগুলো ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। ছেলেটার মধ্যে কোন দেখনদারির ব্যাপার ছিলনা। ও ছিল এবং অবশ্যই এখনো আছে, প্রচণ্ড সহজ, সরল ও সাধারন। আজকের বিপ্লব সেদিন ছিল আমার বিপ্লবদা। এক নাম্বারের লোফার একটা। হাতিবাগানের সবকটা চা, সিগারেটের দোকানে একনামে ওকে সবাই চিনত। ও ছিল দাদার বন্ধু। দাদার মুখে ওর নাম শুনে শুনে আমার বুকের ভেতরে কবেই যে বিপ্লব জায়গা করে নিয়েছিল তা আমি জানিনা। আমার ওকে মোটেও ভালো লাগত না, ইস কি বিচ্ছিরি এক মুখ দাড়ি, সবসময় পাড়ায় একটা মস্তান মস্তান ভাব। তবে খুব হ্যান্ডসাম ছিল। দাদা ছিল মিঠুনের অন্ধ ভক্ত। সিনেমাটার নাম মনে নেই। তবে গানটা মিঠুনেরই ছিল। দাদার একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার ছিল। ওটাতে দাদা, যখন বাবা বাড়ি থাকতো না, গান শুনত। আমিও আবদার করতাম দাদা, এই গানটা একটু চালা, ওই গানটা একটু চালা। আমি সাধারনত একটু সফট মেলোডি গান পছন্দ করতাম। এই আমাদের সময়ে কিশোর কুমারের যে গানগুলো ব্যাপক হিট ছিল সেগুলো। কিন্তু নিজের পছন্দের বিপরীতের একটা গান হথাতই আমার মনে ধরে যায়। কেন? হুমম, না এই কথাটা এই ব্রহ্মাণ্ডে আমি ছাড়া কেউ জানেনা। ইস যদি বিপ্লব কোনদিন জানতে পেরে যায় না, আমার খুব লজ্জা হবে ওর সামনে। না, আমার কোন আফসোস নেই এর জন্য। আমি অর্থাৎ সেদিনের আমি, রমা মুখার্জি, কি সুচিত্রাদির চেয়ে কোন অংশে কম ছিলাম। তুমি বাপু রমা মুখুজ্জেকে পটাবে আর তোমায় কাঠখড় পোড়াতে হবেনা। কষ্ট করতে হবেনা চাঁদু। যারা সেই রমাকে চেনে তারাই জানে রমার জন্য ঠিক কি কি সম্বন্ধ এসেছিল। আইএএস অফিসার থেকে কলেজের প্রফেসর। কিন্তু রমা মুখুজ্জে আবার যাকে তাকে পাত্তা দেয়না। রমা আগে বাজায়, তারপর বোঝে এটা ঢোল না নিরেট সোনা, তারপর কোন ছেলেকে পাত্তা দেয়। রঞ্জন, তুমি কিন্তু আমায় স্পর্শ করে কথা দিয়েছ তুমি কখনো আমার ডায়েরী পড়বে না। তুমি সত্যি আমার ডায়েরী পড় না তো রঞ্জন? প্লিস রঞ্জন, কোনোদিন আমার ডায়েরী তোমার হাতে এলেও পড়বে না। তাহলে তোমার রমা না সত্যিই তোমার সামনে মুখ দেখাতে পারবেনা, লজ্জাবতী লতার মত নুইয়ে তোমার বুকে মাথা গুঁজে দেবে।
জানো রঞ্জন সেই রাতটা, অর্থাৎ সেই কালী পুজোর ভাসানের পর থেকে না আমার মনটা কেমন কেমন করত। তখন আমি কিসে পড়ি, এই ক্লাস ১০। এখনো মনে আছে, বুলটি দৌড়ে দৌড়ে এলো আর প্রায় হাফাতে হাফাতে বলল ‘চলরে ছুটকি বিপ্লবদা নাচবে। চল সবাই দেখতে যাচ্ছে তুই যাবি না’। আমি নাক কুঁচকে বলেছিলাম ‘ইস, ওই ল্যারাল্যাপ্পাদের নাচ আমি দেখতে যাবো। আমি যাবনা তুই যা’ বুলটি আর দাঁড়ায়নি। বিশ্বাস কর বাবা আমায় এমন শাসনে রাখত যে কি বলব। জীবনে কখনো যে পুজোর ভাসানে ছেলেরা নাচবে আর আমি তা দেখতে যাবো, এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। বেশকিছুক্ষন আমি পড়াশুনা করার চেষ্টা করলাম। নীচে তোমরা এতো ব্যোম ফাটাচ্ছিলে যে পড়াশুনা করা দুরস্ত হয়ে গেছিল। কি আর করতাম, বাড়িতে তো কেউ ছিলনা, তাই ছাদে উঠলাম নীচে কি হচ্ছে তা দেখার জন্য। তখন মাইকে তারস্বরে বাজছে ‘বাহো মে বোতল......ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম ঝুম’। আমার নজর নীচের দিকে। তোমার পরনে একটা সুতির ছাপা জামা আর ভেলভেট প্যান্ট। জামার সবগুলো বোতাম খোলা, ভেতরের নীল হাফ কাটা গেঞ্জীটা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছিল। সত্যি বলছি, বাড়িতে তো আর টিভি ছিলনা। জীবনে কোনোদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখব এটা ভাবতেও পারিনি। তাই আমি কখনো মিঠুনকে দেখিনি। অবশ্য দেখিনি বললে মিথ্যে বলা হবে। দাদা, লুকিয়ে নিজের রুমে মিঠুনের ফটো রাখত। সেখানে দুএক বার দেখেছি আমি মিঠুনকে। আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি মিঠুনকে। ওর চেয়ে উত্তমদা অনেক ভালো দেখতে। কিন্তু বিশ্বাস কর সেইদিন থেকে মিঠুনই আমার সবচেয়ে পছন্দের।
এই তুমি তখন সিদ্ধি খেয়েছিলে না? আমি জানি তুমি সিদ্ধি খেয়েছিলে। আমায় বুলটি বলেছিল, তোমরা ভাসানে সিদ্ধি খাও। আর, সেদিন দাদা বাড়ি ফেরার পর বাবা খুব মেরেছিল। আমায় কিছু বলেনি কিন্তু আমি জানি দাদা সিদ্ধি খেয়েছিল বলেই বাবা মেরেছিল।
আমি ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে তোমায় দেখছিলাম। দেখে মনে হচ্ছিল তোমায় যেন পাড়ার ছেলেরা ভাড়া করে নিয়ে এসেছে নাচার জন্য। আমি না এর আগে কখনো তোমায় নাচতে দেখিনি। এইসব জিনিষ বাবা একদম পছন্দ করেনা, তাই আমিও করিনা। কিন্তু কেন জানিনা, আমার তোমার থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। এই বন্ধ ঘরের রমা মুখুজ্জে যেন দৌড়ে গিয়ে তোমায় ছুঁতে চাইছিল। তারপরই সেই বিপত্তি। হথাত দেখি তুমি নাচ থামিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে। তুমি এরকম প্রায়ই দেখতে না। আমি কিন্তু সেদিনের আগে কখনো জানতাম না। তোমার দুই চোখ যেন আমায় বশ করে ফেলেছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম ওখান থেকে সরে যেতে, কিন্তু পারিনি। কি যে দেখেছিলাম ওই দুই চোখে জানিনা। হুম, সেদিনই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
বিপ্লব, কেন এই একি কথা আমি ডায়েরীর প্রতিটা পাতার শুরুতে লিখি? আমার কাছে তো পুরনো ডায়েরীটা এখনো আছে। আমার ভয় লাগে যদি সেইসময়ের ডায়েরীগুলো হারিয়ে যায়, তাহলে হয়ত আমি এটাই ভুলে যাবো, আমি কেন তোমায় ভালোবাসি। হ্যাঁ, বিপ্লব সেদিন ছিল প্রথমদিন যেদিন থেকে আমার ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় শুধু তোমাকে চিঠি লিখতাম, ডায়েরী লিখতাম না। আমার হৃদয়টা যে তোমায় সঁপে দিয়েছিলাম সেদিনই। বিপ্লব আমি কি এই কথাগুলোও ভুলে যাবো? আমি জানিনা। প্রতিদিন ডায়েরীটা লেখার আগে আমি হিসেব করতে চেষ্টা করি ঠিক কতক্ষনের কথা আমার মনে আছে। জানি তুমি শুনলে আঁতকে উঠবে। আমার মাত্র ১ ঘণ্টার চেয়ে একটু কম সময়ের কথা মনে থাকে। আমি কি করব বিপ্লব? আমার কিছু হয়ে গেলে তোমার কি হবে।
আরও কিছুকথা আমি লিখে রাখি। যদি ডায়েরীটা তোমার হাতে কোনোদিন পড়ে, তুমি ওদের খুঁজে বার করবে। শানের ডান হাতে একটা পোড়া দাগ রয়েছে। বাকিদের মুখগুলো আমার মনে নেই। তবে মোট ৪ জন ছিল। তুমি হয়ত ভাবো বাবাই এর মৃত্যুতে আমার এই অবস্থা। যদি তুমি জানতে! আমারও পুরোপুরি কিছু মনে নেই। তবে কিছু একটা হয়েছিল, মোট ৪ জন লোক ছিল। একজনকে এর মধ্যেই আমি চিনতে পেরে গেছি। এবং জুলি আসলে... ৬ মাস আমি কারুর সাথে কথা বলিনি, বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলাম। বরাবরের মত আরও একটা কথা আমি ডায়েরীতে লিখে রাখছি।
দিদির বিয়ে যখন হয় তখন আমি সবে সবে কলেজে ভর্তি হই। রঞ্জনদাকে বরাবরই একটু অদ্ভুত লাগে। আমার রুমে ঢোকার আগে দাদাও আগে দরজায় টোকা মেরে অনুমতি নিয়ে তবেই ঢুকত। কিন্তু রঞ্জনদা কখনোই অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ওর ব্যাবহার আমার অত্যন্ত অদ্ভুত ধরনের মনে হত। জানো যখন বাড়িতে তোমার সাথে প্রেমের কথা জানাজানি হয়, বিশাল ঝামেলা হচ্ছিল। বাবা, আমায় পাগলের মত ভালবাসতো। আমি জানতাম আমি যদি কখনো বাবাকে বুঝিয়ে বলি বাবা ঠিকই বুঝে যাবে। জানো বাবা বুঝে গেছিল। ঠিক সেইদিনই সন্ধ্যেবেলা দিদি ও রঞ্জনদা আমাদের বাড়িতে এসেছিল। হথাত ই পরদিন সকালে বাবা বলে আমার জন্য ছেলে দেখেছে পরের মাসে আমায় দেখতে আসবে। আর সেই জন্যই তোমায় এতো তাড়া দিয়ে একটা চাকরি জোগাড় করতে বললাম ও বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম।
রঞ্জনদাকে আমার বরাবরই একটু অদ্ভুত ধরনের লাগে। দিদির সাথে আমার আগের সপ্তাহে কথা হয়েছিল। দিদি বলেছিল যে রঞ্জনদা পরের সপ্তাহে শুক্রবার কলকাতায় কোন কাজে যাবে ও আমাদের বাড়িতে রবিবার আসবে। আমি ডায়েরিতে তা লিখেও রেখেছিলাম। অথচ, সেদিন ফোনে আমায় বলল ও এয়ারপোর্ট থেকে আসছে। তারপরই আমি গিয়ে ডায়েরীটা দেখলাম। অবাক লাগলো। আবার দিদিকে ম্যাসেজ করলাম। দিদি বলল কই তোকে তো বলিনি যে শুক্রবার কলকাতা যাচ্ছে। অথচ আমার ফেসবুকে এখনো সেই ম্যাসেজটা রয়েছে। রঞ্জনদাকে আমার সত্যিই খুব অদ্ভুত লাগে।
বাকিটা খুব দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। রমা বাথরুমে আছে, হয়ত এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বে। ও যদি জানে সত্যিই আমি ওর ডায়েরী পড়ি তাহলে খুব কষ্ট পাবে। যা যা পড়লাম তা আগে আমায় অন্য জায়গায় লিখে রাখতে হবে। এ এক অদ্ভুত কাজ আমার, রোজকার রুটিন।
রঞ্জন বেরোনোর আগে আমায় যা বলে গেলো তার অর্থ আমি এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। ওর মুখের সেই বিস্ময়কর হাঁসি, কোমলশীতল মানসিকতা এইসবই একটা জিনিষ ই আমাকে বিশ্বাস করায় রঞ্জনের মাথায় ঠিক এই মুহূর্তে কি রয়েছে তা জানা অবশ্যই দরকার। এসবই ভাবছিলাম হথাত দেখি আমার মোবাইলে একটা ফোন এসেছে। হাতে মোবাইলটা তুলে দেখি বিজয়দার নাম্বার। রিসিভ করলাম।
“বিপ্লব বাবু, নিশ্চয়ই বাড়ির ভেতরে আছেন। আগে একটু বাইরে নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ান। আমি কিছু কথা বলছি”
আমিও বুঝলাম ওনার কথাটা ১০০ ভাগ খাঁটি, এই মুহূর্তেই আমায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে হবে। লিফট দিয়ে নেমে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দুরের মাঠটার কাছে গেলাম। একটা বড় গাছ দেখে তার তলায় দাঁড়িয়ে আবার বললাম
‘হ্যাঁ বিজয়দা বলুন। আমারও কিছু কথা আছে। আগে আপনি বলে নিন। তারপর আমি বলছি’
বিজয়দা এক নিঃশ্বাসে নিজের কথাগুলো বলা শুরু করলেন ‘বিপ্লব বাবু, প্লিস আমার ব্যাবহারে কিছু মনে করবেন না। আমি যে কি লেবেলের ডিপ্রেশনে ভুগছি তা যদি আপনাকে জানাতে পারতাম’ সত্যি আজকের বিজয়দার ব্যাবহার আমারও ভালো লাগেনি। কাজের চাপ, মুড অফ এইসব তো আমারও থাকে। কিন্তু তাই বলে বন্ধুর সাথে বাজে ব্যাবহার! এ আমি জীবনে কখনোই করিনি।
“আরে, ছিঃ ছিঃ বিজয়দা, এ আপনি কি বলছেন। আপনার ব্যাবহারে আমি ক্ষুব্ধ হব? আরে আমি আপনাকে আপনজন মনে করি। আপনি নিজের মনের কথাটা খুলে বলুন। আমি সব শুনছি” আমারও প্রচণ্ড দরকার, বিজয়দা ও পুলিশ এই মুহূর্তে কি ভাবছে তা জানার। বিজয়দার উত্তরটাও সাথে সাথে চলে এলো-
“আরে কি বলব, বিপ্লব বাবু, সামনেই মিউনিসিপ্যালিটি ইলেকশন। ওপর মহলের চাপ রয়েছে প্রচণ্ড। আমাকে আজ থেকেই কেসটার চার্জসিট তৈরি করার অর্ডার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাশন ছাড়া আর কেউ জানেনা মনীন্দ্র বাবুর ও রবির খুনটা ইন্টার লিঙ্কড। অর্থাৎ এটা একটি সিরিয়াল মার্ডার এর কেস। আমি তো ওনাদের সম্পূর্ণ ইচ্ছেটা বুঝতে পারিনি। তবে এটা উপলব্ধি করেছি যে ওনারা চাইছেন তড়িঘড়ি করে কেসটা ধামাচাপা দিয়ে দিতে। এখনো সেভাবে মিডিয়া এই কেসটা কভার করেনি। বাইচান্স যদি বুঝতে পারে, এটা একটা সিরিয়াল মার্ডার কেস, তাহলে মিডিয়ার নজর সম্পূর্ণ ঘুরে যাবে। আমাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে যে যতটুকু তথ্য প্রমান রয়েছে তা দিয়েই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে। এবার আপনিই বলুন, আমার কাছে যা ম্যাটেরিয়াল আছে তা দিয়ে কি এই কেসটা কোর্টে ঠিকঠাক সাজাতে পারবো? গ্রেফতার করার ৯০ দিনের মাথায় সবাই জামিন পেয়ে যাবে। পুলিশও যে কাজ করতে চায় এটাই কেউ বুঝতে চায়না”
আমিও বুঝলাম বিজয়দার হতাশাটা অতি স্বাভাবিক। কিছুটা সহানুভুতির সুরে আমি বললাম ‘কোন চিন্তা করবেন না বিজয়দা। এই কেসকে সল্ভ করতে ঠিক যা যা হেল্প আমার দরকার আপনি তা সবই পাবেন। আমার তরফ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা আপনি আশা করতে পারেন’
‘বিপ্লববাবু, আপনাকে সত্যি একটা কথা বলছি। এই কেসটা খুব জটিল। সন্দেহের তালিকায় অনেককেই রাখা যায়। কিন্তু সবার ওপরে আপনার স্ত্রীর জামাইবাবু রঞ্জনবাবু। রঞ্জনবাবু রবিবার নয় শুক্রবার কলকাতায় এসেছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র এইটুকু তথ্য দিয়ে তো চার্জশিট তৈরি করা যায়না! আমার কাছে সেই অর্থে কোন প্রমান নেই। তবে আমার মন বলছে কিছুনা কিছু তথ্য আপনার ঘরেই লুকিয়ে আছে। যদি একটিবার আপনি আমাকে ঘরটা সার্চ করতে দেন’
আমিও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি কখন সার্চ করবেন আমায় বলুন। সেরকমভাবে আমিও আপনাকে হেল্প করবো’ বুঝলাম আমার কথায় উনি যথেষ্ট আশ্বস্ত হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে উত্তরটা ভেসে এলো ‘আমি চাই গভীর রাতে সার্চ করতে। নিশ্চয়ই এই ফ্ল্যাটে ওদের কোন এজেন্ট রয়েছে। যার মাধ্যমে কে কখন আপনার বাড়িতে আসছে তার খবর ওরা পেয়ে যাচ্ছে। রাতে আসলে শুধু একজনকেই ম্যানেজ করতে হবে সে হোল ‘আপনাদের ফ্ল্যাটের নাইট গার্ড। সে আমি ম্যানেজ করে নেবো। কিন্তু এটাও সত্যি যে আশেপাশের কোন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আমাদের দেখতে পাবেনা’
এই ব্যাপারটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। আমার বাড়িতে ওনারা মাঝরাতে আসবেন তার মানে এটাই যে আমাকে আজ রমা ও রঞ্জনকে নিয়ে রাতটা অন্য কোথাও কাটাতে হবে। ব্যাপারটা আমার পক্ষেও ম্যানেজ করা খুব কঠিন। ভাবছিলাম কি উত্তর দেবো বিজয়দাকে। ওনাকে না বলতেও মন যাচ্ছিল না। সলিউশনটা উনিই দিলেন।
‘কোলাঘাটে আমার এক বন্ধুর বাগান বাড়ি আছে। এখান থেকে ট্যাক্সিতে কোলাঘাট যেতে আপনার আর কি এমন সময় লাগবে! ট্যাক্সির ভাড়াও না হয় আমরা মানে পুলিশ দিয়ে দেবো। ওখানে আপনার খাওয়া খরচা সবই ফ্রি’ ওনাকে থামিয়ে আমিই বললাম ‘আরে ছিঃ ছিঃ বিজয়দা, আপনি কি আমাকে এতই ছোট মনে করেন! নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাবো আর খরচা নেবো আপনার থেকে। আমায় খালি একটু সময় দিন, আসলে বোঝেনই তো ওয়াইফকে ম্যানেজ করাও তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমি আগে রমার সাথে কথা বলি তারপর আপনাকে সবই জানাবো’
বিজয়দা যেন প্রান খুলে এতক্ষন পর কথা বললেন ‘আরে বিপ্লব বাবু সত্যিই আপনি আমায় বাঁচালেন। মেনি মেনি থ্যাঙ্কস টু ইউ’ ‘আমায় প্লিস কিছুক্ষন সময় দিন’ আমার কথা শুনে উনি শুধু ‘ওকে টেক ইউর টাইম’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন। ‘হ্যালো হ্যালো বিজয়দা...’ ধুস আসল কথাটাই তো বলা হয়নি ওনাকে। আবার ভাবলাম ফোনটা লাগাই। লাইনটা বিজি আসতে শুরু করল। এই তো আমার সাথে কথা বলছিলেন এরইমধ্যে আবার কার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। আরও ৩-৪ বার প্রায় ২-৩ মিনিট ধরে ওনাকে ট্রাই করলাম কিন্তু কিছুতেই পেলাম না। নাহ, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে নেই। এবার ওপরেই যাওয়া যাক। যতই হোক, রমা তো এই মুহূর্তে ঘরে একা রয়েছে।
মাঠ থেকে রাস্তার ওপর উঠে এলাম, দেখি রঞ্জন আসছে। মনে হয় আমায় দেখতে পায়নি। আমি মাঠের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকলাম। রঞ্জনের কানে ফোন, খুব মনোযোগ দিয়ে কারুর সাথে কথা বলছে। আমি ওর পিছু নিলাম। বাইচান্স যদি আমায় দেখতে পেয়ে যায়, সর্বনাশের একাকার। কান পেতে ও কি কথা বলছে তা শোনার চেষ্টা করলাম। আমি শুধু রঞ্জনেরই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম, ফোনের অপরপ্রান্তের কথাগুলো কিছুতেই আমার কানে আসছিলনা। মন দিয়ে শুনতে লাগলাম ও হিসেব না মেলা সুদ আসলের অঙ্কটা মেলানোর চেষ্টা করলাম।
‘আরে দাদা, আপনার সাথে কি আমার পরিচয় আজকের। সেই কবে থেকে আপনাকে আমি চিনি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করব না তো কাকে করব’
‘আরে, কি মুশকিল দাদা, আজ অবধি আমার হয়ে এতোগুলো কাজ আপনি করলেন। আপনি তো জানেনই আমি ফুল পেমেন্ট অ্যাডভান্সে করি। আর যতই হোক, আপনাদের তো হাতে রাখতেই হবে নয়ত এই মার্কেটে বিজনেসটা করব কি করে?’
‘আরে না না দাদা। ওকি বুঝবে এইসব রহস্য। আসল কেসটাই ওর মাথায় এখনো ঢোকেনি। ও এখনো সেই একি জায়গায় পড়ে রয়েছে’
‘জুলি? হ্যাঁ, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ওকে স্টেটের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আগে একটু হাওয়া খাক, তারপর এদিকের পরিবেশ একটু শান্ত হলে না হয় নিয়ে আসবো। আরে হ্যাঁ দাদা, জুলি আপনাকে ফ্রি সার্ভিস দেবে’
‘(প্রচণ্ড জোরে অট্টহাসির সাথে) আরে দাদা আমার, আপনার প্ল্যানিং নিয়ে কি আমি কখনো প্রশ্ন তুলেছি? কি যে বলেন আপনি। হ্যাঁ, হ্যাঁ আজ রাতেই অ্যাডভান্স করে দেবো। কি? ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক। ঠিক আছে আমি এই বিকেলের দিকে আপনার সাথে মিট করছি। তখনই না হয় অ্যাডভান্স করে দেবো’ ‘ওকে, ওকে...’ বুঝলাম ফোনটা রাখার সময় হয়েছে। আমিও কিছুটা জোরে পা চালিয়ে জিরো ফ্লোরের মুখটায় লুকিয়ে পড়লাম। রঞ্জন মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে লিফট এর দিকে চলে গেলো।
পকেটে আমার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ভাগ্যিস ভাইব্রেশন মোডে রেখেছিলাম। নয়ত ফোনের আওয়াজ পেয়েই রঞ্জন বুঝে যেত আমি ওকে ফলো করছিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে আমি আবার এক্সিট এর দিকে চলে গেলাম। হ্যাঁ, জানতাম বিজয়দাই ফোন করেছে। আবার সেই গাছতলায় গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে এলো বিজয়দার কিছুটা অনুতপ্ত কণ্ঠস্বর।
‘আরে, এক্সত্রিমলি সরি। ওপরতলা থেকে ফোন এসেছিলো। রিসিভ না করলে বুঝতেই তো পারছেন, সুন্দরবনেও ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারি। (বিকট একটা হাঁসি) (আমার কেন জানিনা বিজয়দাকেও খুব অচেনা লাগছিল। যেন লোকটা ভয়ঙ্কর একটা আনন্দের মধ্যে রয়েছে। সেই আনন্দটা কিসের! আমি হেল্প করব এটা বলায় নাকি অন্য কোনকিছু?) আপনাকে অনেকক্ষণ ওয়েট করিয়ে রেখেছিলাম। প্লিস বলুন আপনি কি বলতে চান’
আমি তখনও আনমনেই রয়েছি। বারবার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা কেমন নাড়া দিয়ে উঠছে। বারবার মনে একটাই প্রশ্ন জাগছে ‘রঞ্জন কার সাথে কথা বলল এতক্ষন’। নিজেকে সংবরন করলাম। দীপালী আমার বন্ধু আর বিজয়দা ওর স্বামী। বিজয়দা নিজের থেকেই আমার কাছে এসেছিলেন, মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই আমার নিখোঁজ বউকে খুঁজে বার করে দিয়েছে। না ও সেই ব্যক্তি নয় যার সাথে রঞ্জন এতক্ষন কথা বলল।
আমি বললাম ‘বিজয়দা, আমি আপনাকে এমন একটি তথ্য দিতে চাই যা এই কেসটা সম্পূর্ণ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবে। বলতে পারেন কিছুটা দ্বিধাবোধ থেকেই আমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আপনার থেকে লুকিয়ে গেছিলাম’
ওপাশ থেকে ভেসে এলো বিজয়দার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ‘বিপ্লববাবু, যা জানেন সব আমায় জানান। আমি শুনতে চাই’ না আমিও ঠিক করলাম সব কথা বিজয়দাকে খুলে বলব ‘বিজয়দা, রঞ্জনের আসল বিজনেসটা কিন্তু সেই আফ্রিকান বিষের। আপনি এব্যাপারে কিন্তু একটা বিশাল প্রমান পেতে পারেন। যা আপনার পরবর্তী ক্ষেত্রে চার্জশিট বানাতে কাজে লেগে যাবে’ ‘কি বলছেন আপনি, এতদিন কেন আপনি এটা লুকিয়েছিলেন। এতদিনে তো আমি রঞ্জনকে লকআপের ভেতরেই ঢুকিয়ে দিতাম’ আমি কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম ‘আসলে প্রথমে আমার রঞ্জনের ওপর সন্দেহ হয়নি। এছাড়া রঞ্জন আমার সম্বন্ধী হয়’ উনি বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলে উঠলেন ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, বিপ্লব বাবু। আমার মনে হয় এবার আমি পুরো কেসটাই সাজিয়ে দেবো’ আমি শুধু হুম করে একটা উত্তর দিলাম। বিজয়দা অভিজ্ঞ পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমার দ্বিধাবোধ ধরতে ওনার বেশী সময় লাগলো না।
“বিপ্লববাবু, আমার মনে হচ্ছে, আপনি আরও কিছু গোপন করছেন আমাদের থেকে। দেখুন, আপনি বুঝুন এই কেসে কিন্তু আপনি ভীষণভাবেই জড়িয়ে আছেন। আপনি যে শুধুই আমাকে হেল্প করছেন তা কিন্তু নয়। নিজেরও ভালো করছেন। বলুন বিপ্লব বাবু, আপনি কি গোপন করছেন”
হ্যাঁ, আমি একটা ব্যাপার সত্যিই গোপন করছি আর তা হোল শর্মাজীর দ্বিতীয় প্রপসাল। এই ব্যাপারটা যদি আমি বিজয়দাকে বলি তাহলে কেসটা যে উনি অনেকটাই সল্ভ করে দেবেন সে ব্যাপারে আমি ১০০ ভাগ সিওর। কিন্তু, এর সাথে যে জড়িয়ে আছে আমার ব্যাঙ্কিং প্রফেশন। কি করে নিজের পেশার সাথে বেইমানি করি। আমার যে পেট চলে এই কাজটা করে। আমি অর্থাৎ বিপ্লব পোদ্দার কেন ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার তার ও তো উত্তর অনেকটাই এই শর্মাজীর প্রপসালের সাথে জড়িয়ে আছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই আবার বিজয়দার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ‘প্লিস বিপ্লব বাবু প্লিস। যা জানেন আমায় জানান’ না মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম ‘বিজয়দা, আমি আর সেরকম কিছুই জানিনা’ এরপর আর একটু ফর্মাল কথাবার্তা বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভাবছিলাম বিজয়দাকে কি সবকিছু বলা উচিত? ঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। আপাতত একটাই করনীয়ঃ রমাকে ভালো করে বুঝিয়ে ঘুরতে যাওয়ায় রাজী করানো। জানি রঞ্জন ঠিকই রাজী হয়ে যাবে। পেছন ঘুরে ফ্ল্যাটের দিকে যেতে যাবো, দেখি অনেকটা দূরে রঞ্জন দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে।
‘কি বিপ্লব ফোনে কথা বলছিলে?’ ওকে দেখে আমার গা জ্বলছিল। উত্তর দিলাম ‘হুম’। আবার মুচকি হেঁসে রঞ্জন বলল ‘বিপ্লব, তুমি আমায় এতো এড়িয়ে চলছ কেন? আমি ডায়েরীর রহস্যটা জানি, কিন্তু তারমানে এই তো নয় আমি তোমার কোন ক্ষতি করব। বিপ্লব, আমি তোমার আরও একটি রহস্য আজ উদ্ঘাতন করেছি’ আমি শকড। আবার একটা মুচকি হাঁসি হেঁসে রঞ্জন বলল ‘তুমি, নেট থেকে রোজ দু তিনটে করে কাকোল্ড গল্প পড়ো তাইতো। আজ সকালে তো তুমি ধরাই পড়ে গেলে আমার হাতে। না বিপ্লব, কাকোল্ড হওয়াটা কোন অন্যায় নয়। আজকাল তো কলকাতা শহরেও এসব আকছার ঘটে চলেছে। সবই একটু গোপনে করতে হয়’
ভয়ঙ্কর এক অনুশোচনার সাথে আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। যেন আমার ব্রেনে কোন সেন্সর বসানো আছে এবং সেই সেন্সরকে প্রতি মুহূর্তে রঞ্জন সেন্স করে চলেছে।
Like Reply


Messages In This Thread
RE: বিপ্লব পোদ্দার- ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার- complete - by samss400 - 09-02-2020, 02:35 PM



Users browsing this thread: 4 Guest(s)