28-01-2020, 11:35 PM
আমি বিজয়দার মুখের দিকে তাকালাম। ওনাকে যথেষ্ট গম্ভীর লাগছে। আমি কিছু বলার আগেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘বিপ্লব বাবু এবার আপনি যান। আপনার অফিস আছে। পুলিশকে পুলিশের কাজটা করতে দিন’ আমিও একটু অসম্মানিত বোধ করলাম। আর কথা না বাড়িয়ে স্কুটারটা স্টার্ট দিয়ে পেছন দিকে চলতে শুরু করলাম। একটার পর একটা বাস, ফুটব্রিজ পেরিয়ে চলেছি কিন্তু মস্তিস্কে রয়েছে এই কাহিনীর সবচেয়ে রহস্যজনক চরিত্র, বিজয়দা। বিজয়দা যে খুব একটা সহজ সরল মানুষ নন তা আমি প্রথম দিনই বুঝে গেছিলাম। যেদিন থানায় আমাদের সকলকে ডেকে পাঠালেন, আমাকে দেখার পর জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার নাম?’ আমি প্রায় পিলে চমকে গেছিলাম। বিজয়দার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগে। তারপর আর ওনার সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু সেই প্রথম সাক্ষাৎটি এতটাই ঘটনাবহুল ছিল যে যেকোনো সাধারন মানুষই আমৃত্যু তা মনে রাখবেন আর বিজয়দা তো পুলিশ অফিসার। পুলিশের স্মৃতিশক্তি সাধারন মানুষের থেকে একটু বেশীই উর্বর হয়। বিজয়দা আসলে কি সত্যিই খলনায়ক? কেন আমার মন বারবার ওনাকে সন্দেহ করছে। অথচ থানায় ওনার সাথে দেখা করার সময় বা ওনার বেমালুম আমার কথা ভুলে যাওয়া এগুলোর পরেও আমি ওনাকে সন্দেহ করিনি। যেকোনো উপায়ে আমায় এই সন্দেহের বেড়াজাল থেকে বাইরে আসতে হবে। কিন্তু উপায় কি? সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড় করাতে হোল। হথাত মাথায় এলো, বিজয়দা, রমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলেছেন। রমার কাছে এই কথাগুলো অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে ও রমা নিজের ডায়েরিতে তা লিখে রাখবে। সুতরাং বিজয়দার চরিত্র বিশ্লেষণ একমাত্র রমার ডায়েরী থেকেই সম্ভব। কিন্তু পরপর ৩ দিন অফিস কামাই করেছি আর আজ যেহেতু একবার অফিসে চলে গেছি তাই কামাই করা সম্ভব নয়। সুতরাং বাড়ি ফিরেই ওই ডায়েরী থেকে বিজয়দার রহস্যটা উদ্ঘাতন করতে হবে। সোজা অফিসের দিকে চলতে শুরু করলাম। আরও একটা রহস্য রয়ে গেছে। চিনুর ম্যাসেজ। ও আমায় কি বোঝাতে চাইল ওটা বলে। ‘Ranjan100isshan’ ‘25thmagh’ রঞ্জনই যে শান তা আমি জানি, কিন্তু আমার ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী কেন উল্লেখ করল ও। আর রঞ্জনের নামের পাশের ওই ১০০ কথাটারও বা মানে কি? হয়ত এর উত্তর আমি পেয়ে যেতাম যদি চিনু জীবিত থাকতো। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ব্যাঙ্কের সামনে চলে এসেছি খেয়াল নেই। লিফট দিয়ে ওপরে উঠে ভেতরে উঁকি মারতেই দেখি ম্যানেজার বাবু অলরেডি চলে এসেছেন। পরপর ৩ দিন কামাই করেছি আজ আবার সকাল সকাল এসে বেরিয়ে গেছি; জানি কপালে প্রচুর দুঃখ রয়েছে। গুটি গুটি পায়ে নিজের টেবিলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এমনসময় হথাত ম্যানেজার স্যার এর ডাক। ‘বিপ্লব বাবু, একটু আমার কেবিনে এসে দেখা করে যাবেন’ হ্যাঁ, আজ আমার গাঁড় ফাটাবে মালটা। আবার স্যাক করে দেওয়ার হুমকি, ইংরিজিতে অখাদ্য কিছু গালাগাল ইত্যাদি। টেবিলে গিয়ে সিস্টেমটা অন করেই ম্যানেজারের কেবিনের দিকে যেতে শুরু করলাম। ‘মে আই কাম ইন স্যার?’ ভেতর থেকে খ্যারখ্যারে গলায় আওয়াজ এলো ‘হ্যাঁ, আসুন’। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কখন শুরু হবে টাইফুন তার অপেক্ষায়। ‘হ্যাঁ, বিপ্লব বাবু যার জন্য ডাকা। আজ অফিসে স্টাফ প্রচুর কম। আপনাকে ২-৩ টে সেকশন সামলাতে হবে একসাথে। কিছুক্ষন পরেই এক ভদ্রলোক আসবেন, নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে...’ আমি ওনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে বলে উঠলাম ‘স্যার, আমি তো এই কাজগুলো খুব একটা জানিনা’ ম্যানেজার বাবু প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন ‘জানিনা মানে। ১০ বছরের অপর ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন আর বলছেন জানিনা’ আমি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওনার বুঝি একটু মায়াই হোল আমার প্রতি। ‘ওকে, আমি কিছু পেপার পাঠাচ্ছি, ওগুলো পড়ে নিন, সব বুঝে যাবেন’ আমি চুপচাপ নিজের টেবিলে গিয়ে বসে গেলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত কাগজপত্র চলে এলো। আমিও কাগজগুলো খুলে ভালো করে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। ‘একটা ইউসার নেম ও একটা পাসওয়ার্ড। ইউসারনেম ও পাসওয়ার্ড এ লেটার এর পাশাপাশি অঙ্কও থাকা বাধ্যতামুলক। যেমন prokashroy এটা সঠিক ইউসারনেম নয় কারন এরমধ্যে শুধুই লেটার রয়েছে কোন ডিজিট বা অঙ্ক নেই, কিন্তু prokashroy345 একটি সঠিক ইউসার নেম। একিভাবে password112 একটি সঠিক পাসওয়ার্ড হলেও password সঠিক পাসওয়ার্ড নয় কারন এরমধ্যে কোন অঙ্ক নেই। হাতদুটো একবার মাথার ওপর তুলে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলাম ‘প্রদোষ মিত্তিরের জয় হোক’। দু একজন স্টাফ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আমি সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরন করে নিলাম। ওরা তো আর জানেনা আমার মাথায় মাঝে মধ্যেই প্রদোষ মিত্তির ভর করে। মনে হয় আমি যা ভাবছি তা সঠিক। কিন্তু যা ভাবছি তা অত্যন্ত সন্তর্পণে করতে হবে। এর জন্য দরকার এর পরের স্টেপগুলো ভালো করে বোঝা। ‘আপনাকে এমন অনেক কাস্টমারকে হ্যান্ডেল করতে হতে পারে, যিনি টেকনিক্যাল ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ। মানে ধরুন ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে জানেন না, ফোনের সিম যে নেট ব্যাঙ্কিং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাও বোঝেন না। এইরকম মানুষজন মাঝেমধ্যেই বিভিন্নরকম অসুবিধের সম্মুখীন হন। হয় তারা ইউসার নেম নয় পাসওয়ার্ড ভুলে যান। প্রতিটি ইউসারের আকাউন্তকে অ্যাকসেস করার জন্য ব্যাঙ্কেরও একটি প্রসেস আছে। খালি ব্যাঙ্কারকে সেই কাস্টমারের ইউসারনেম ও পাসওয়ার্ড জানতে হবে’ চোখদুটো চকচক করছিল আমার। আজ একটা অপারেশনে নামবো। হথাত দেখি এক ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দারিয়েছেন। ‘আপনিই কি বিপ্লববাবু, আমাকে ম্যানেজারবাবু পাঠিয়েছেন’ বুঝলাম ইনিই সেই যার দয়ায় কিছুটা ভাগ্যের জোরে আজ আমি ব্যাংকার অফ দা ইয়ার হতে চলেছি। জীবনে কখনো কোন কাস্টমারের সাথে এতো ভালো ব্যাবহার করিনি। দাঁতগুলো বাইরে বার করে হেঁসে ওনাকে বসতে বললাম। ‘আরে আর বলবেন না। আমি লোহার বিজনেস করি। আমরা কি আর এইসব নেট ফেট বুঝি। ছেলের জন্যই সব করতে হচ্ছে’ কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হয়েই ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনার ছেলে কি করে? কোথায় থাকে?’ ‘আরে আর কি বলব ছেলের তো বিশাল ব্যাপার! কিছুতেই ১১-১২ এ সাইন্স পাচ্ছিল না, লাইন করে কলেজে সাইন্স পাইয়ে দিলাম। আজকাল তো আবার ইঞ্জিনিয়ার না হলে পাড়ায় মুখ দেখানো যায়না। বললাম, ব্যাটা ভালো করে পড়। ওই যে কিসব জয়েন্ট ফয়েন্ট হয়না, বললাম সেগুলো দে। শালা তাতেও ডাহা ফেল। ৩-৪ টে লিস্ট বার করল গরমেনট, ওর শালা নাম নেই। তারপর এক বন্ধু বলল প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে নাকি ম্যানেজমেন্ট কোটা থাকে। এই দশ বিশ লাখ ডোনেশন দিতে হয়’ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ‘সেরকমই একটা কলেজে গেছিলাম বলে নেট ব্যাঙ্কিং এ টাকা দিতে হবে তাই একটা বানাতে এলাম’ আমার মনের কথাতো আর ওনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, উনি এটাও বুঝলেন না আমি কেন এতো হাসিখুশি রয়েছি। আনন্দে ওনার দুহাত জড়িয়ে ধরলাম। ‘আপনার ছেলে তো দাদা আর ৩-৪ বছরেই ভিআইপি হয়ে যাচ্ছে। আমার একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে। আমি একটা গরীব ছেলেদের জন্য এনজিও চালাই। বলবেন চাকরি পাওয়ার পর যেন কিছু দান করে’ সেই ভদ্রলোকের হাঁসি তো বাঁধ মানেনা। সত্যিই পয়সায় বেচে যাওয়া শিক্ষাব্যাবস্থার মেধা ওনার ছেলে, এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। সেই ভদ্রলোককে নেট ব্যাঙ্কিং এর আকাউন্ত ক্রিয়েট করে দিয়ে আমিও চললাম নিজের অপারেশনে। অপারেশন কমপ্লিট করতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লেগে গেলো। মনে মনে একবার বিড়বিড় করে উঠলাম ‘বিপ্লব পোদ্দার ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার’। শালা এতদিন পরে নিজেকে সত্যি হিরো হিরো লাগছিল। প্রায় ঘণ্টা ৬-৭ একটা সিগারেট ধরাইনি। তাই আমি অফিসের বাইরে চলতে শুরু করলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে সুখটান দিয়ে চলেছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে একেকটা ঘটনা। তখন সবেসবে চাকরি পেয়েছি, এক ব্যাক্তি এসে প্রায় পায়ে পড়ে গেলো। ‘দাদা, ছেলেটা জয়েন্টে দারুন র*্যাঙ্ক করেছে। গরমেনট কলেজে চান্স পেয়েছে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা লোণ চাই। আমি রিক্সা চালাই দাদা। আপনাদের হাতে তো এতো টাকা, দাদা আমায় এইকটা টাকা যেভাবে হোক দিয়ে দিন। ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করতে না পারলে কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না দাদা’। মুখের ওপর বলেছিলাম ‘না দাদা, এখানে আপনাদের মত নিম্নবিত্তকে লোণ দেওয়ার কোন স্কিম নেই’। তার ঠিক ২ বছর পর আমার ছেলেটা মারা গেছিল। শালা এ্যাম্বুলেন্সে যখন ছেলেটা হেঁচকি তুলছিল, বিচি শুকিয়ে গেছিল একদম। মনে হচ্ছিল সেই রিক্সাওয়ালাটা পাশে বসে বলে চলেছিল ‘দেখ রে মাদারচোঁদ, ছেলের কষ্ট কেমন লাগে’। শালা ছেলের মৃত্যুর চেয়েও বোধ হয় বেশী কষ্ট ছেলের ক্যারিয়ার নিজের চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যেতে দেখা। দৌড় দৌড় শুধু ইঁদুর দৌড়। এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে অন্য কেউ পাছায় লাথি মেরে বেরিয়ে যাবে। শুধু দৌড়াতে হবে। কি পেলাম এই দৌড়ে, ছেলেটাকেই তো বাঁচাতে পারলাম না। বউটা শালা দুরারোগ্য রোগের রুগী হয়ে গেলো। যদি আমার বাপের একটা দু নাম্বারি বিজনেস থাকতো? যদি আমি মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মাতাম? তাহলে কি আমায় সত্যিই এই দিন দেখতে হত? শালা উচ্চবিত্তের ছেলে মেধাবী না হয়েও ম্যানেজমেন্ট কোটায় ইঞ্জিনিয়ার আর নিম্নবিত্তের ছেলে মেধাবী হয়েও রিক্সা চালায়। ১০ শতাংশ মানুষ, রোজ বাকি ৯০ শতাংশের পোঁদ মেরে চলেছে, আর আমরাও ভাগ্য, ঈশ্বর ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে রোজ ওই ১০ শতাংশের দিকে পোঁদটা সুন্দরভাবে এগিয়ে দিচ্ছি। না, আমি নগন্য। আমি শুধুই থিওরি চোঁদাতে পারি। এইসব আতলামি করতে করতেই মগজটা হথাত অন্য অভিমুখে ঘুরে গেলো। অফিসের সামনে বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম হয়েছে। সার দিয়ে একের পর এক গাড়ি দাঁড়িয়ে। তারই মধ্যে একটা সাদা রঙের আম্বাসাডার গাড়ি। এই গাড়িটা আমি প্রচণ্ড ভালো করে চিনি। এটা শর্মাজীর। কাঁচটা সামান্যই নীচের দিকে নামানো। তাও বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে গাড়ির মধ্যে সাজুগুজু করা কোন এক সুন্দরী রমনী রয়েছে। কে সে? এইকি জুলি? একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওইদিকে। গাড়ির কাঁচটা ধীরে ধীরে নীচে নামছে। আমিও জানি আজ এই মুহূর্তেই হয়ত আমি এতো বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকা রহস্যের পর্দা ফাঁস করতে পারবো। গাড়ির কাঁচটা একটু একটু করে নীচে নামছে আর আমারও মনের সেই ইচ্ছেটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। জুলি কে? হথাত গাড়িটা বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো। আমি কিছু বোঝার আগেই সিগন্যালটা গ্রিন হয়ে গেলো ও গাড়িটা অনেক আগে এগিয়ে গেলো। জানি এই সুযোগ হয়ত আর জীবনে দ্বিতীয়বার পাবনা। রাস্তা বরাবর দৌড়াতে শুরু করলাম, সামনেই একটা নো রিফিউসাল ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। অন্য কেউ চেপে বসার আগেই আমায় ওটায় চেপে বসতে হবে। ভাগ্য আমারই পক্ষে ছিল। খুব সহজেই ট্যাক্সিটা পেয়ে গেলাম। ‘দাদা, ওই সামনের গাড়িটাকে ফলো করুন। টাকা নিয়ে ভাববেন না’। শালা টাকার লোভ কেই বা ছাড়তে পারে। আমার ট্যাক্সিটাও প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। শত চেষ্টা করেও আমি গাড়ির ভেতরে যে মহিলা আছে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছিনা। আমাদের গাড়িটা প্রচণ্ড স্পীডে শর্মাজীর গাড়িটাকে ফলো করতে শুরু করল। প্রায় আধ ঘণ্টা আমরা পিছু নিয়ে চলেছি। আবার বাঁধ সাধল সেই ট্রাফিক সিগন্যাল। শালা, এইবার ভাগ্য বিশাল জোরে একটা লাথি মারল। ওদের গাড়িটা সিগন্যাল রেড হওয়ার বেশ কিছু আগেই পার হয়ে গেছিল। মনে হয়না ৫ মিনিটের আগে আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো। সুতরাং জুলি কে সেই রহস্য আমার পক্ষে আর সমাধান করা সম্ভব নয়। রমাকি জুলি? না রমা জুলি নয়? রমার ডায়েরী বা রমার চিঠি এই দুটো থেকেই আমি বুঝেছি, রমা জুলি নয়, কিন্তু জুলি রমার পরিচিত কেউ। কিন্তু কে সে? এরকম নয়ত রমা ছলনা করছে। রমা আমায় ঠকাচ্ছে! নিজেরই মনে একবার বলে উঠলাম ‘না, রমা আমার সাথে এরকম করতে পারেনা’। জানি ওদের আর ধরতে পারবো না, কিন্তু রমাই কি জুলি? এই রহস্যটা সমাধান এখনো সম্ভব। যদি শর্মাজীর গাড়িতে রমা থেকে থাকে তাহলে ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে ও কিছুতেই রিসিভ করতে পারবেনা। যা ভাবা তাই কাজ, সঙ্গে সঙ্গে আমার ল্যান্ড লাইন নাম্বারটায় ফোন লাগিয়ে দিলাম। মনে সন্দেহ রয়েছে, দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে কিন্তু হৃদয় বারবার করে বলে চলেছে ‘না রমা, বাড়িতেই আছে’। ক্রিং ক্রিং করে রিং হয়ে চলেছে। প্রতিটা রিং এর প্রতিধ্বনি আমার বুকের মধ্যে হচ্ছে। আমার হৃদয় বারবার করে বলে চলেছে ‘রমা তুমি ঘরের যে প্রান্তেই থাকো আগে ফোনটা রিসিভ কর’ অন্তত ২০ বার ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হোল, কিন্তু কেউ ফোনটা রিসিভ করলনা। রমার দিদি মিতা কোথায়? ওরা দুই বোন মিলে আবার কোথাও বেরয়নি তো? এই শোকের পরিবেশে বাইরে ঘুরতে যাওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক। আমি আবার একবার কল করলাম। কিন্তু বারবার রিং হওয়ার পরও কেউ ফোনটা রিসিভ করলনা। নিজেরই অজান্তে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘রমা তুমি কোথায়?’ এদিকে সিগন্যালটা আবার গ্রীন হয়ে গেছে। ড্রাইভার গাড়িটা একটু বাঁদিক করে পার্ক করে আমায় জিজ্ঞেস করল ‘স্যার, এবার কোথায় যাবো’। হতাশায়, ভয়ে আমার দুই চোখ জলে ভোরে উঠেছে। ‘ঈশ্বর যেন আমার সন্দেহ সত্যি না হয়। যেন রমা বাড়িতেই থাকে’ মনে মনে বলে উঠলাম। দেখি ড্রাইভারটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কিছু প্রবলেম হয়েছে স্যার?’ ওর কথায় আমার হুঁশ ফিরল। কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম ‘ভাই, আমি স্যার নই। তোমারই মত খেটে খাওয়া এক মানুষ। কলকাতার এই রাস্তাগুলো তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝ। ওই গাড়িটার মধ্যে আমার জীবন রয়েছে। ওই গাড়িটা খুঁজে না পেলে আমি বাঁচব না’ দেখলাম ড্রাইভারটা বেশ কিছুক্ষন আবেগপ্রবণ হয়ে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘চিন্তা করবেন না দাদা, এই রাস্তাটা সোজা বাইপাসের দিকে গেছে। আমি ওইদিকেই যাচ্ছি’ গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। শ্রান্ত শরীরে আমিও হেলান দিয়ে পড়ে থাকলাম। সত্যিই কি রমার ওই চিঠি বা রমার ডায়েরী এসব শুধুই আমার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য! বারবার করে নিজের মনে প্রশ্ন করতে লাগলাম।