16-01-2020, 02:48 AM
লক্ষণের শক্তিশেল
"আপ ক্যায়া গোর্খা হ্যায়?" আমার সামনের দীর্ঘকায় লোকটিকে, যার নাম করণ বলেছিল এজেন্ট বি-ওয়ান, হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলাম। করণ আর বাকী সবাইকে ছেড়ে আমরা রেল লাইনের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে কোনও এক দিকে যাচ্ছিলাম। আন্দাজ করেছিলাম হয়তো এটাই অবন্তীপুর যাওয়ার শর্টকাট। আমার সঙ্গী একই লয়ে কোনও ভাবে না থেমে জগিং করতে করতে চলেছে। আমি ওর পিছু পিছু ঘর্মাক্ত কলেবরে কখনও জোরে হেঁটে, কখনও দৌঁড়ে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটু নীরস প্রকৃতির লোক যাকে বলে, কথাবার্তা খুবই কম বলছে। করণের সাথে এদের কি সম্পর্ক আমি এখনো কিছুই বুঝে উঠতে না পারলেও ধরে নিয়েছিলাম যে এরা ভালো লোকই হবে। কি যেন বললো তখন করণ "এসএফএফ" আরেকটা "এস্ট্যাব্লিশম্যান্ট ২২", মনে মনে অনেক হাতড়েছি তারপরে। কোথাও একটা শুনেছি বা পড়েছি মনে হচ্ছে কিন্তু এর বেশী কিছু বেরোল না মাথা থেকে। করণ কি পয়সা দিয়ে ভাড়াটে সিকিউরিটি রেখেছিল নাকি? যা খেয়ালি আর পয়সাওয়ালা ছেলে, অনেক কিছুই করতে পারে। আর্মি বা আধাসামরিক বাহিনীর অনেকেই অবসর নেওয়ার পর প্রাইভেট বডিগার্ডের কাজ করে থাকে। আমার সাথীও সেরকম কিছু হতে পারে ভেবে একটু বাজিয়ে দেখব বলে ঠিক করলাম। তাছাড়া উত্তর দেওয়ার ছলে যদি একটু দাঁড়িয়ে যায় তাহলে একটু দম নিতে পারবো।
"নহি!" একটুকুও না থেমে ছোট্ট উত্তর দিল বি-ওয়ান। হ্যাঁ, গোর্খা নাও হতে পারে। নর্থ-ইস্টের পাহাড়ী লোকেদেরও এরকম মঙ্গোলয়েড ফিচার হয়। তবে সাধারণতঃ ওদের উচ্চতা ছয় ফিটের কাছাকাছি হয় না বলেই জানতাম। এর যেমন লম্বাচওড়া চেহারা তেমনি বাহারি নাম "বি-ওয়ান" ...হাহহ!
"তো ফির আপ কহাসে হ্যাঁয়? মতলব কৌনসী স্টেট।" শুকনো গলায় আমার কথাগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে শোনালো। বেশ চেঁচিয়েই বলতে হল এবার, অনেকটা এগিয়ে গেছে ও। এবার না দাঁড়ালে কুয়াশাতে একটু পরেই হারিয়েই ফেলবো।
চেঁচানোতে কাজ হয়েছে দেখলাম, লোকটা থেমে গিয়ে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো।
"সাব, মেরা আপনা দেশ তো দিলমে ম্যায়, ভগবান করে তো একদিন উসকী জমিন পে জরুর সর ঝুকানে কা মওকা মিলেগা। পর উসদিন তক ইয়ে ভারত হি মেরা দেশ আউর ইয়হী মেরি ওয়তন।" বললো লোকটা, "আপ থোড়া আওয়াজ নীচে নহি করেঙ্গে তো আপকো ইধার হি রোক দেনা পড়েগা।" ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসিটা সব সময়ই আছে দেখলাম।
ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পারলেও বেশ করে মাথা নেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চেঁচানোটা উচিত হয়নি বুঝতে পারলাম। কাছেপীঠে যদি আরও কেউ ওঁৎ পেতে থাকে তাহলে উঁচু গলার আওয়াজ তাদেরকে অকারণে আমন্ত্রন জানানো ছাড়া আর কিছু করবে না।
"থোড়া রুক যাও ভাই।" আমার বুকের ভিতর থেকে সাঁই সাঁই শব্দ করে কথাগুলো বেরিয়ে এলো। বালিগঞ্জের জিমে রোজ বিকেলে এক ঘণ্টা করে দৌঁড়ানো খুব একটা কাজে আসছে না দেখলাম। এতদিনের মাটন কাটলেট আর চিকেন চপ কি আর বিকেলের একঘণ্টার দৌঁড়ে ঝড়ানো যায়? তাও উদিতা জোর করে ঠেলে পাঠায় বলে যেতে হয়।
"দ্যো মিনট," বি-ওয়ান ভদ্রলোকের একটু দয়া হয়েছে বোধহয় আমার অবস্থা দেখে। সন্ধ্যে থেকে আমার ওপর দিয়ে যা ধকল যাচ্ছে তাতে দু' মিনিটেও খুব একটা উপকার হবে বলে মনে হল না।
ও নিশ্চিত আমার মুখের ভাব পড়ে ফেলেছিল। একটু ঝুঁকে আমার চোখে চোখ রেখে বললো, "আপকে বিবি ঊনকে কব্জে মে হ্যায়, জিতনী দের আপ ইধার করেঙ্গে উতনী হি মুশকিল সহেনী পড়েগী উনকো।"
এই প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রমে উদিতার ভাবনা মাথার এক কোণায় চলে গেছিলো। ওর এক কথায় যেন সেটা টনিকের মতো কাজ করলো। আমার সব ক্লান্তি, দুর্বলতা নিমেষে যেন উধাও হয়ে গেল কোথাও। আমার উদিতাকে কিছু শয়তান তুলে নিয়ে গেছে তাদের কোনও এক ধূর্ত মতলবসিদ্ধির জন্যে। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে ওর কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। বসে জিরানোর সময় নেই। সুরাজপুরে আসার প্রথম দিনের মধ্যেই যেরকম যৌন অত্যাচার আর লালসার নমুনা দেখেছি, অনেক দেরী না হয়ে যায় আমার উদিতাকে বাঁচাতে। ওকে যখন ছেড়ে এসেছি, ও শুধু অন্তর্বাস পড়ে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছিল। ওকে কি ওরা সেই অবস্থাতেই তুলে নিয়ে গেছে? তাহলে কি আর ওর শরীরকে ভোগ না করে ছাড়বে এই শয়তানগুলো? অম্লানদাই কেমন ক্ষুধার্ত কুকুরের মতন ওর পরনের সায়া তুলে দিয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল, আর এরা তো জানোয়ার বললেও কম হয়। বুকের কোনও এক কোণায় একটা হাহাকার যেন বেজে উঠলো। করণের কথা মতো আমরা অবন্তীপুর কোঠাতে যাচ্ছি, আর ও সুরাজপুরের বাকী জায়গাগুলো খুঁজে দেখবে বলেছে, না পেলে আমাদেরকে কোঠাতেই মিট করবে। ভগবানকে খুব করে ডাকলাম, "সব যেন ঠিক হয়ে যায়।"
"আপকি বন্দুক মুঝে দিজিয়ে," মাথার পিছন থেকে আমার সাথী বলে উঠলো, "থোড়া হল্কা হোঙ্গে তো আসানি হোগা।"
আমি বন্দুকটা চালান করে দিলাম ওর হাতে। সত্যিই ওটা আর বইতে পারছিলাম না। বেবাক বাংলায় অভ্যেস মতো বলে ফেললাম, "ধন্যবাদ।"
"আমি বাংলা জানি," ওর মুখে পরিস্কার বাংলা কথা শুনে হতচকিত হয়ে গেলাম, "চমকাবেন না আমি এরকম ভাবে আরও দশটা ভাষায় কথা বলতে পারি," হালকা হাসি মুখে বললো ও, "এ সবই আমাদের ট্রেনিংয়ের ফল।"
লোকটার কথায় আমার মাথায় বিদ্যুতের মতন চলে এলো ভাবনাগুলো। কলেজ-কলেজে পড়াশোনায় খারাপ ফল করিনি কোনোদিন। একবার কোনও কিছু পড়লে বা শুনলে ভুলতে পারতাম না সহজে। লোকটার একটু আগের কথাগুলো আমার কানে বাজছিল, ওর দেশ ওর হৃদয়ে, এখন ভারতে থাকে তাই ভারতই ওর বাসভূমি, কিন্তু মাতৃভূমি নয়। কারণ ওর দেশ এখন অন্য কারোর দখলে, "তিব্বত", আমি অস্ফূটে বলে ফেললাম। ১৯৫০-এ চীন দখল করে নিয়েছিল দক্ষিণে হিমালয় আর উত্তরে গোবি মরুভূমির মাঝের বৌদ্ধ গুম্ফা আর লামাদের প্রাগৈতিহাসিক শান্তিকামী দেশ তিব্বতকে। সেই সাথে চলে গেছিলো এশিয়ার দুই প্রাচীন সভ্যতা ভারত আর চীনের মাঝখানের একমাত্র বাফার যার গুরুত্ব একশো বছর আগে ইংরেজরা বুঝলেও বুঝিনি আমরা। ফলস্বরূপ বারো বছরের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে তীব্র সংঘাত আর রক্তপাত। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসা স্বাধীনতাকামী তিব্বতিদের নিয়ে তৈরী হয় "স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স" বা এসএফএফ। যার কাজ ঠিক করা হয়েছিল, ভবিষ্যতের কোনও এক ভারত-চীন যুদ্ধের সময়ে সীমানার ওপারে গিয়ে খবর জোগাড় করে আনা বা তেমন হলে চীনের সামরিক বাহিনীর উপরে গুপ্ত আঘাত হানা। পরবর্তী কালে চীনের সাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা কমে আসলে এসএফএফ-কে ভারতের আন্তরদেশীয় গুপ্তচর সংস্থার অংশ বানিয়ে দেওয়া হয় যার নাম হয় "এস্ট্যাব্লিশম্যান্ট ২২"। পাহাড় আর জঙ্গলের যুদ্ধে অত্যন্ত পটু এই অদৃশ্য আধাসামরিক বাহিনী একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের নিদর্শন রেখেছিল চট্টগ্রাম এলাকা স্বাধীন করতে। সব মনে পড়ে গিয়েছে আমার। বিআরও তে থাকাকালীন আর্মি জেনারেল ব্রার এর বইয়ে এদের কথা পড়েছিলাম। আজকের ঘটনার ঘনঘটায় মাথাটা খালি হয়ে গেছিলো, কিন্তু এখন সব পরিস্কার আমার চোখের সামনে।
"আপনি র-তে আছেন?" আমি ওর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে চলল এজেন্ট বি-ওয়ান। এই অদ্ভূত নামকরণের রহস্যও এখন বুঝতে পারলাম। ওর আসল নাম হয়তো ও নিজেই ভুলে গেছে। আমার এই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সিকিউরিটি ক্লীয়ারেন্স ওর নেই।
"আর করণ?" এটারও কোনও সাড়া আসবে না জেনেও বলে ফেললাম। আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতাও চলে গেছে যেন। ক্রমানুসারে একধাপ থেকে ওপর ধাপে উঠে যাচ্ছি আর তার সাথেসাথে আগের ঘটনাগুলোকে ফ্যালনা মনে হচ্ছে। করণের এখানে থাকার কারণ তাহলে কি? লাল পার্টি না রণবীর সেনা?
সত্তরের দশকের নকশালবাড়ীর ছোটো টাউনে যা শুরু হয়েছিল তা আজ দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। একের পর এক গ্রাম জেলাসদর লাল ডটে ঢাকা পড়েছে তার পর থেকে। রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির বেড়াজালে চাপা পড়ে যাওয়া পিছিয়ে পড়া গ্রাম-জঙ্গলের সহজ সরল মানুষগুলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। বিহার-ঝাড়খণ্ডের এই সব এলাকায় রণবীর সেনার তাণ্ডবের কথা সকলেই প্রায় জানে। প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় তারা ধীরে ধীরে রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। এখানে লাল পার্টির বাড়বাড়ন্তের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ কারণ এরা আর চরম দুর্নীতি। কিন্তু এসকলই তো আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে আর তার জন্যে তো আইবি আছে! এসএফএফ এখানে আজ রাতে কি করছে?
"আপনারা এখানে কেন? রণবীর সেনাকে আটকাতে? না লাল পার্টি?" আমি জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম এবারেও কি জবাব দেবে না?
"সবারই হদিশ আমরা রাখি বটে কিন্তু ওদের আটকানোটা আমাদের বর্তমান লক্ষ্য নয়। আজ রাতেই লাল পার্টি অবন্তীপুরের ইয়াদবের কোঠা, কয়লার খনি হামলা করবে। তার সাথেই শেষ হবে রণবীর সেনা।" বি-ওয়ান উত্তর দিল।
"কিন্তু লাল পার্টি তো থেকে যাবে এখানে? এতো সেই শাঁখের করাত হবে?" আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
"লাল পার্টির পিছনেই ওই সুরাজপুর জঙ্গলের ভিতরের ওয়াকিং ট্রেল ধরে এগিয়ে আসছে দু' কোম্পানী কোবরা কমান্ডো। আজ ভোরের মধ্যেই অবন্তীপুরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত এক্সিট পয়েন্টে বসবে পুলিশ আর সিআরপির ব্যারিকেড। লাল পার্টির অনেকেই হয়তো আজকেই গ্রেপ্তার হবে।" ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দিল ও।
তার মানে এক ঢিলে দুই পাখী। লাল পার্টিকে দিয়ে রণবীর সেনাকে খতম করা আর তারপরে তাদেরকেই গ্রেফতার করা। বেশ স্মার্ট প্ল্যান বলেই মনে হচ্ছে। তবু এর মধ্যে করণ আর এদের ভূমিকাটা স্পষ্ট হল না। লোকটা আবার আমার মনের ভাব পড়ে ফেললো। বললো, "এখনো ভাবছেন তো আমরা এখানে কি করছি? চীনা চাচা বলে কিছু শুনেছেন?"
আমি ঘাড় নেড়ে বোঝালাম এটা আমার একেবারেই অজানা। আন্দাজেই বলার চেষ্টা করলাম, "মাও জে দং-এর কথা বলছেন?"
বি-ওয়ান বললো, "নাহ, থাক পরে নিজেই জানতে পারবেন।"
আমাদের কথা আর বিশেষ এগোলো না। আমি উদিতার নিরাপত্তা নিয়ে আরও আরও অনেক বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। করণের আমার সাথে না আসার উদ্দেশ্য উদিতাকে অন্য জায়গায় খোঁজা নাকি ওর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে? খুব অভিমান হচ্ছিল ওর ওপরে। সব জেনেশুনেও কেন টেনে আনলো আমাদের এই বিপদের মধ্যে? উদিতাকে যদি এরা কোঠাতেই নিয়ে রাখে আর সেখানেই যদি আক্রমণ হয় তাহলে তো ঘোর বিপদ।
"আপ ক্যায়া গোর্খা হ্যায়?" আমার সামনের দীর্ঘকায় লোকটিকে, যার নাম করণ বলেছিল এজেন্ট বি-ওয়ান, হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলাম। করণ আর বাকী সবাইকে ছেড়ে আমরা রেল লাইনের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে কোনও এক দিকে যাচ্ছিলাম। আন্দাজ করেছিলাম হয়তো এটাই অবন্তীপুর যাওয়ার শর্টকাট। আমার সঙ্গী একই লয়ে কোনও ভাবে না থেমে জগিং করতে করতে চলেছে। আমি ওর পিছু পিছু ঘর্মাক্ত কলেবরে কখনও জোরে হেঁটে, কখনও দৌঁড়ে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটু নীরস প্রকৃতির লোক যাকে বলে, কথাবার্তা খুবই কম বলছে। করণের সাথে এদের কি সম্পর্ক আমি এখনো কিছুই বুঝে উঠতে না পারলেও ধরে নিয়েছিলাম যে এরা ভালো লোকই হবে। কি যেন বললো তখন করণ "এসএফএফ" আরেকটা "এস্ট্যাব্লিশম্যান্ট ২২", মনে মনে অনেক হাতড়েছি তারপরে। কোথাও একটা শুনেছি বা পড়েছি মনে হচ্ছে কিন্তু এর বেশী কিছু বেরোল না মাথা থেকে। করণ কি পয়সা দিয়ে ভাড়াটে সিকিউরিটি রেখেছিল নাকি? যা খেয়ালি আর পয়সাওয়ালা ছেলে, অনেক কিছুই করতে পারে। আর্মি বা আধাসামরিক বাহিনীর অনেকেই অবসর নেওয়ার পর প্রাইভেট বডিগার্ডের কাজ করে থাকে। আমার সাথীও সেরকম কিছু হতে পারে ভেবে একটু বাজিয়ে দেখব বলে ঠিক করলাম। তাছাড়া উত্তর দেওয়ার ছলে যদি একটু দাঁড়িয়ে যায় তাহলে একটু দম নিতে পারবো।
"নহি!" একটুকুও না থেমে ছোট্ট উত্তর দিল বি-ওয়ান। হ্যাঁ, গোর্খা নাও হতে পারে। নর্থ-ইস্টের পাহাড়ী লোকেদেরও এরকম মঙ্গোলয়েড ফিচার হয়। তবে সাধারণতঃ ওদের উচ্চতা ছয় ফিটের কাছাকাছি হয় না বলেই জানতাম। এর যেমন লম্বাচওড়া চেহারা তেমনি বাহারি নাম "বি-ওয়ান" ...হাহহ!
"তো ফির আপ কহাসে হ্যাঁয়? মতলব কৌনসী স্টেট।" শুকনো গলায় আমার কথাগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে শোনালো। বেশ চেঁচিয়েই বলতে হল এবার, অনেকটা এগিয়ে গেছে ও। এবার না দাঁড়ালে কুয়াশাতে একটু পরেই হারিয়েই ফেলবো।
চেঁচানোতে কাজ হয়েছে দেখলাম, লোকটা থেমে গিয়ে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো।
"সাব, মেরা আপনা দেশ তো দিলমে ম্যায়, ভগবান করে তো একদিন উসকী জমিন পে জরুর সর ঝুকানে কা মওকা মিলেগা। পর উসদিন তক ইয়ে ভারত হি মেরা দেশ আউর ইয়হী মেরি ওয়তন।" বললো লোকটা, "আপ থোড়া আওয়াজ নীচে নহি করেঙ্গে তো আপকো ইধার হি রোক দেনা পড়েগা।" ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসিটা সব সময়ই আছে দেখলাম।
ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পারলেও বেশ করে মাথা নেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চেঁচানোটা উচিত হয়নি বুঝতে পারলাম। কাছেপীঠে যদি আরও কেউ ওঁৎ পেতে থাকে তাহলে উঁচু গলার আওয়াজ তাদেরকে অকারণে আমন্ত্রন জানানো ছাড়া আর কিছু করবে না।
"থোড়া রুক যাও ভাই।" আমার বুকের ভিতর থেকে সাঁই সাঁই শব্দ করে কথাগুলো বেরিয়ে এলো। বালিগঞ্জের জিমে রোজ বিকেলে এক ঘণ্টা করে দৌঁড়ানো খুব একটা কাজে আসছে না দেখলাম। এতদিনের মাটন কাটলেট আর চিকেন চপ কি আর বিকেলের একঘণ্টার দৌঁড়ে ঝড়ানো যায়? তাও উদিতা জোর করে ঠেলে পাঠায় বলে যেতে হয়।
"দ্যো মিনট," বি-ওয়ান ভদ্রলোকের একটু দয়া হয়েছে বোধহয় আমার অবস্থা দেখে। সন্ধ্যে থেকে আমার ওপর দিয়ে যা ধকল যাচ্ছে তাতে দু' মিনিটেও খুব একটা উপকার হবে বলে মনে হল না।
ও নিশ্চিত আমার মুখের ভাব পড়ে ফেলেছিল। একটু ঝুঁকে আমার চোখে চোখ রেখে বললো, "আপকে বিবি ঊনকে কব্জে মে হ্যায়, জিতনী দের আপ ইধার করেঙ্গে উতনী হি মুশকিল সহেনী পড়েগী উনকো।"
এই প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রমে উদিতার ভাবনা মাথার এক কোণায় চলে গেছিলো। ওর এক কথায় যেন সেটা টনিকের মতো কাজ করলো। আমার সব ক্লান্তি, দুর্বলতা নিমেষে যেন উধাও হয়ে গেল কোথাও। আমার উদিতাকে কিছু শয়তান তুলে নিয়ে গেছে তাদের কোনও এক ধূর্ত মতলবসিদ্ধির জন্যে। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে ওর কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। বসে জিরানোর সময় নেই। সুরাজপুরে আসার প্রথম দিনের মধ্যেই যেরকম যৌন অত্যাচার আর লালসার নমুনা দেখেছি, অনেক দেরী না হয়ে যায় আমার উদিতাকে বাঁচাতে। ওকে যখন ছেড়ে এসেছি, ও শুধু অন্তর্বাস পড়ে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছিল। ওকে কি ওরা সেই অবস্থাতেই তুলে নিয়ে গেছে? তাহলে কি আর ওর শরীরকে ভোগ না করে ছাড়বে এই শয়তানগুলো? অম্লানদাই কেমন ক্ষুধার্ত কুকুরের মতন ওর পরনের সায়া তুলে দিয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল, আর এরা তো জানোয়ার বললেও কম হয়। বুকের কোনও এক কোণায় একটা হাহাকার যেন বেজে উঠলো। করণের কথা মতো আমরা অবন্তীপুর কোঠাতে যাচ্ছি, আর ও সুরাজপুরের বাকী জায়গাগুলো খুঁজে দেখবে বলেছে, না পেলে আমাদেরকে কোঠাতেই মিট করবে। ভগবানকে খুব করে ডাকলাম, "সব যেন ঠিক হয়ে যায়।"
"আপকি বন্দুক মুঝে দিজিয়ে," মাথার পিছন থেকে আমার সাথী বলে উঠলো, "থোড়া হল্কা হোঙ্গে তো আসানি হোগা।"
আমি বন্দুকটা চালান করে দিলাম ওর হাতে। সত্যিই ওটা আর বইতে পারছিলাম না। বেবাক বাংলায় অভ্যেস মতো বলে ফেললাম, "ধন্যবাদ।"
"আমি বাংলা জানি," ওর মুখে পরিস্কার বাংলা কথা শুনে হতচকিত হয়ে গেলাম, "চমকাবেন না আমি এরকম ভাবে আরও দশটা ভাষায় কথা বলতে পারি," হালকা হাসি মুখে বললো ও, "এ সবই আমাদের ট্রেনিংয়ের ফল।"
লোকটার কথায় আমার মাথায় বিদ্যুতের মতন চলে এলো ভাবনাগুলো। কলেজ-কলেজে পড়াশোনায় খারাপ ফল করিনি কোনোদিন। একবার কোনও কিছু পড়লে বা শুনলে ভুলতে পারতাম না সহজে। লোকটার একটু আগের কথাগুলো আমার কানে বাজছিল, ওর দেশ ওর হৃদয়ে, এখন ভারতে থাকে তাই ভারতই ওর বাসভূমি, কিন্তু মাতৃভূমি নয়। কারণ ওর দেশ এখন অন্য কারোর দখলে, "তিব্বত", আমি অস্ফূটে বলে ফেললাম। ১৯৫০-এ চীন দখল করে নিয়েছিল দক্ষিণে হিমালয় আর উত্তরে গোবি মরুভূমির মাঝের বৌদ্ধ গুম্ফা আর লামাদের প্রাগৈতিহাসিক শান্তিকামী দেশ তিব্বতকে। সেই সাথে চলে গেছিলো এশিয়ার দুই প্রাচীন সভ্যতা ভারত আর চীনের মাঝখানের একমাত্র বাফার যার গুরুত্ব একশো বছর আগে ইংরেজরা বুঝলেও বুঝিনি আমরা। ফলস্বরূপ বারো বছরের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে তীব্র সংঘাত আর রক্তপাত। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসা স্বাধীনতাকামী তিব্বতিদের নিয়ে তৈরী হয় "স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স" বা এসএফএফ। যার কাজ ঠিক করা হয়েছিল, ভবিষ্যতের কোনও এক ভারত-চীন যুদ্ধের সময়ে সীমানার ওপারে গিয়ে খবর জোগাড় করে আনা বা তেমন হলে চীনের সামরিক বাহিনীর উপরে গুপ্ত আঘাত হানা। পরবর্তী কালে চীনের সাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা কমে আসলে এসএফএফ-কে ভারতের আন্তরদেশীয় গুপ্তচর সংস্থার অংশ বানিয়ে দেওয়া হয় যার নাম হয় "এস্ট্যাব্লিশম্যান্ট ২২"। পাহাড় আর জঙ্গলের যুদ্ধে অত্যন্ত পটু এই অদৃশ্য আধাসামরিক বাহিনী একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের নিদর্শন রেখেছিল চট্টগ্রাম এলাকা স্বাধীন করতে। সব মনে পড়ে গিয়েছে আমার। বিআরও তে থাকাকালীন আর্মি জেনারেল ব্রার এর বইয়ে এদের কথা পড়েছিলাম। আজকের ঘটনার ঘনঘটায় মাথাটা খালি হয়ে গেছিলো, কিন্তু এখন সব পরিস্কার আমার চোখের সামনে।
"আপনি র-তে আছেন?" আমি ওর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে চলল এজেন্ট বি-ওয়ান। এই অদ্ভূত নামকরণের রহস্যও এখন বুঝতে পারলাম। ওর আসল নাম হয়তো ও নিজেই ভুলে গেছে। আমার এই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সিকিউরিটি ক্লীয়ারেন্স ওর নেই।
"আর করণ?" এটারও কোনও সাড়া আসবে না জেনেও বলে ফেললাম। আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতাও চলে গেছে যেন। ক্রমানুসারে একধাপ থেকে ওপর ধাপে উঠে যাচ্ছি আর তার সাথেসাথে আগের ঘটনাগুলোকে ফ্যালনা মনে হচ্ছে। করণের এখানে থাকার কারণ তাহলে কি? লাল পার্টি না রণবীর সেনা?
সত্তরের দশকের নকশালবাড়ীর ছোটো টাউনে যা শুরু হয়েছিল তা আজ দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। একের পর এক গ্রাম জেলাসদর লাল ডটে ঢাকা পড়েছে তার পর থেকে। রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির বেড়াজালে চাপা পড়ে যাওয়া পিছিয়ে পড়া গ্রাম-জঙ্গলের সহজ সরল মানুষগুলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। বিহার-ঝাড়খণ্ডের এই সব এলাকায় রণবীর সেনার তাণ্ডবের কথা সকলেই প্রায় জানে। প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় তারা ধীরে ধীরে রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। এখানে লাল পার্টির বাড়বাড়ন্তের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ কারণ এরা আর চরম দুর্নীতি। কিন্তু এসকলই তো আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে আর তার জন্যে তো আইবি আছে! এসএফএফ এখানে আজ রাতে কি করছে?
"আপনারা এখানে কেন? রণবীর সেনাকে আটকাতে? না লাল পার্টি?" আমি জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম এবারেও কি জবাব দেবে না?
"সবারই হদিশ আমরা রাখি বটে কিন্তু ওদের আটকানোটা আমাদের বর্তমান লক্ষ্য নয়। আজ রাতেই লাল পার্টি অবন্তীপুরের ইয়াদবের কোঠা, কয়লার খনি হামলা করবে। তার সাথেই শেষ হবে রণবীর সেনা।" বি-ওয়ান উত্তর দিল।
"কিন্তু লাল পার্টি তো থেকে যাবে এখানে? এতো সেই শাঁখের করাত হবে?" আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
"লাল পার্টির পিছনেই ওই সুরাজপুর জঙ্গলের ভিতরের ওয়াকিং ট্রেল ধরে এগিয়ে আসছে দু' কোম্পানী কোবরা কমান্ডো। আজ ভোরের মধ্যেই অবন্তীপুরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত এক্সিট পয়েন্টে বসবে পুলিশ আর সিআরপির ব্যারিকেড। লাল পার্টির অনেকেই হয়তো আজকেই গ্রেপ্তার হবে।" ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দিল ও।
তার মানে এক ঢিলে দুই পাখী। লাল পার্টিকে দিয়ে রণবীর সেনাকে খতম করা আর তারপরে তাদেরকেই গ্রেফতার করা। বেশ স্মার্ট প্ল্যান বলেই মনে হচ্ছে। তবু এর মধ্যে করণ আর এদের ভূমিকাটা স্পষ্ট হল না। লোকটা আবার আমার মনের ভাব পড়ে ফেললো। বললো, "এখনো ভাবছেন তো আমরা এখানে কি করছি? চীনা চাচা বলে কিছু শুনেছেন?"
আমি ঘাড় নেড়ে বোঝালাম এটা আমার একেবারেই অজানা। আন্দাজেই বলার চেষ্টা করলাম, "মাও জে দং-এর কথা বলছেন?"
বি-ওয়ান বললো, "নাহ, থাক পরে নিজেই জানতে পারবেন।"
আমাদের কথা আর বিশেষ এগোলো না। আমি উদিতার নিরাপত্তা নিয়ে আরও আরও অনেক বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। করণের আমার সাথে না আসার উদ্দেশ্য উদিতাকে অন্য জায়গায় খোঁজা নাকি ওর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে? খুব অভিমান হচ্ছিল ওর ওপরে। সব জেনেশুনেও কেন টেনে আনলো আমাদের এই বিপদের মধ্যে? উদিতাকে যদি এরা কোঠাতেই নিয়ে রাখে আর সেখানেই যদি আক্রমণ হয় তাহলে তো ঘোর বিপদ।