24-01-2019, 02:50 PM
পর্ব ১৬- দ্বিতীয় টুইস্টঃ
সুবীর বাবুঃ অনুরাধা, দেবেন্দ্র, সত্যেন্দ্র, মৃত্যুঞ্জয় অর্থাৎ ঠাকুর ডাকাত, সুপ্রতীক, বংশী, মালা আরও কত চরিত্র। এদের কি কোনও অস্তিত্বই নেই? হথাত এদের কথা আমায় জানিয়ে কি লাভ মানব?
মানব বাবুঃ লাভ ক্ষতি আমিও জানিনা। কিন্তু এই গল্পটা একেবারে সত্যি। ডায়েরীর দুটো খণ্ড অর্থাৎ সুপ্রতীকের গল্প ও সত্যেন্দ্রের গল্প এটা হুবহু এক। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে এতটা সত্য এক ঘটনা এই লোকটা বলল বা কি করে। যতক্ষণ না মালটার হুঁশ ফিরছে ততক্ষন সত্যি এই রহস্যটা কিছুতেই ফাঁস হবেনা। যদিও এই গল্পের মধ্যে হাজারো ত্রুটি ছিল। যেমন ধর, কলকাতা শহরে কি আবার কোনও নীলকুঠি ছিল নাকি। নীলের চাষ তো হত জেলা অঞ্চলে। তো গল্পে এই নীলকুঠীর অস্তিত্ব এটা সত্যি ই সত্যবাবুর নিজমনে তৈরি। আবার ধর, জঙ্গল ও ডাকাত। ১৬০০ সালের দিকে কলকাতার আশেপাশে কোনও জঙ্গল ও ছিলনা ডাকাত ও ছিলনা।
সুবীর বাবুঃ হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস তুই। আমি ইতিহাসের লোক হয়েই বুঝতে পারলাম না। সত্যি কিকরে যে এরকম হোল?
মানব বাবুঃ সব তুই বিশ্বাস করেছিস তার কারন একটাই। ওই চাওয়ালার ভূত। ওই ভূতটাই এই গল্পের একমাত্র ভূত...
সুবীর বাবুঃ না রে আরও কতগুলো ভূত আমি দেখেছি। জমিদার বাড়িতে আমি নিজের চোখে অনুরাধা, সত্যেন্দ্র এদের আত্মা দেখেছি। যখন ভেতরে ঢুকেছিলাম বাড়িটা ছিল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। হথাত দেখি প্রচুর দাসী ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি এই সত্য বাবুও যে ভূত তাও আমি বিশ্বাস করেছিলাম কারন...
মানব বাবুঃ (প্রচণ্ড জোরে হেঁসে উঠে) আরে পাগল, ভুতেদের কি কাজ নেই তোর মত একটা গোবেচারা লোকের ক্ষতি করবে। যদি কোনও ভুতকে সামনে কখনো দেখিস, মনে রাখিস সে হয় তোর ওপর বদলা নিতে নয় তোকে উপকার করতেই এসেছে। এই যেমন ওই চাওয়ালার ভূতটাই ধর। তুই চা খেলি, চলে যাওয়ার সময় উনি কি বললেন “দাদা ওখানে যাবেন না, জমিদারবাড়ি থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনা” (একদম ওই চাওয়ালার মতই গলার স্বরে) কেন বলেছিল তুই এখন কিছু বুঝলি?
সুবীর বাবু কিছুটা চমকেই যান। মানব যে এতো ভালো অন্যের গলা নকল করতে পারে তা সত্যি ই ওনার জানা ছিলনা।
সুবীর বাবুঃ তুই এতো কিছু কিকরে জানলি রে মানব?
মানবের থেকে সমস্ত কিছু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরে সুবীর বাবুও নিজের সেই পুরনো মেজাজটা ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিলেন।
মানব বাবুঃ এটা তো একটা টুইস্ট বন্ধু। বললাম না একের পর এক টুইস্ট দেবো। সবার আগে তোকে বলি সত্য বাবু আসলে কে? ও না তার আগে তোকে একটা গল্প বলি, তুই অনেককিছুই বুঝে যাবি তাহলে।
সুবীর বাবু চুপ করে মানবের কথা শুনতে থাকেন।
মানব বাবুঃ ছোটবেলায় বাবার থেকে গল্প শুনেছিলাম সিনিয়ার পিসি সরকার নাকি তাজমহলকেই ভ্যানিস করে দিয়েছিলেন। আচ্ছা সুবীর আদৌ কি তাজমহলের মত এক অট্টালিকাকে ভ্যানিস করা যায়? উত্তরটা হোল না করা যায়না। তাহলে? উনি আসলে একটা কেমিক্যাল ব্যাবহার করেছিলেন। সবাই চোখের সামনে একটা ইলুশন দেখেছিল। এটাই ওনার ম্যাজিকের ভাষায় ভ্যানিশ। আর সাইকোলজিতে একেই বলে মাইন্ড ক্যাপচারিং। সত্য বাবুর কাছে অন্তত ৩টে ডায়েরী ছিল, প্রত্যেকটায় অনেক আগে থেকেই গল্প লেখা ছিল। আর গল্প গুলো তৈরি হয়েছিল মোট তিনজন মানুষের মতামত নিয়ে তাদের মধ্যে আমি একজন। যদিও তোর জীবনের ঘটনাগুলো গল্প হলেও জমিদার বাড়ির কথাগুলো একেবারেই গল্প নয়। কিন্তু কিকরে এতটা সত্য উনি লিখে ফেললেন এটাই একটা টুইস্ট।
সুবীর বাবুঃ আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বুঝিয়ে বল ভালো করে।
মানব বাবুঃ নিশ্চয়ই বলব বন্ধু। তুই সত্য বাবুকে খুব ভালো করে চিনিস। ওর নাম কলেজে বেশ কয়েকবার শুনেছিস। এমনকি একটি বইতেও পড়েছিস ওর ব্যাপারে। সত্য বাবুর আসল নাম সত্যব্রত দত্ত, কুখ্যাত...
“the brain study of a serial killer” আরে মানব এভাবে আমি ক্লিন বোল্ড হয়ে গেলাম। তাহলে কি সবকিছুর পেছনে আসলে...
সুবীর বাবু প্রচণ্ড উত্তেজনায় প্রায় ঝড়ের বেগে সমস্ত কথা বলে ফেললেন। কিন্তু ওনাকে নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে দিলেন না মানব বাবু।
মানব বাবুঃ না বন্ধু, কোনও সন্দেহের বশে নাম প্রকাশ করে আমার টুইস্টগুলো নষ্ট করা চলবে না। এখনো অনেক অনেক টুইস্ট বাকি রয়েছে বন্ধু। অপেক্ষায় থাকো। তবে তুই কিছুটা ঠিক ই অনুমান করেছিস। যাই হোক। এই সেই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার সত্যব্রত দত্ত। আমেরিকার এক বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার, সেখানেই নিজের গাইড এর স্ত্রীর সাথে প্রনয়ে জড়িয়ে পড়া। তারপর সাইকোলজিরই একের পর এক কনসেপ্ট লাগিয়ে গাইড, তার বাড়ির চাকর এমনকি বলতে লজ্জা হচ্ছে তাও ছোট্ট মেয়েটাকেও হত্যা করে। এমন ভয়ঙ্কর খুনির অপরাধ গোটা পৃথিবীর কেউ প্রমান করতে পারেনি। লোকের চোখে ধুলো দেওয়াই যে এর কাজ। সত্যি লোকটা জিনিয়াস। কিন্তু এইসব করতে গিয়ে একদিন সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। আর তারপর ই সেই বিখ্যাত প্রোজেক্ট “the brain study of a serial killer” কি অদ্ভুত না! বিজ্ঞান আর আইন একে অপরের বিপরীত হয়ে যায়। না লোকটা বেকসুর খালাস হয়ে যায়। কোনও শাস্তি ই পায়নি। তা এরকম এক লোক তোকে বোকা বানাবে না তো কাকে বানাবে?
জানি কিছুটা মাথায় ঢুকলেও এখনো পুরোটা তুই বুঝতে পারিসনি। আসতে আসতে হবে। কম জটিল ব্যাপার তো নয় এটা। একের পর এক টুইস্ট আসবে।
সুবীর বাবুঃ কিন্তু এই সত্য বাবু, হথাত আমার পেছনেই বা লাগতে গেলো কেন। আর আমার বাড়িতে ঘটে যাওয়া এতোগুলো ঘটনাও বা জানল কি করে। যেমন ধর মালতীকে সত্যি ই কোনও এক অশরীরী উত্তক্ত করত, সেকথা আমায় ও বলেওছিল। আর ধর, বর্ণালীর ব্যাপারটা। এটা তো আমি তুই আর মালতী ছাড়া আর কেউ জানেনা।
মানব বাবুঃ বর্ণালীর ঘটনাটা সত্য বাবুকে আমিই বলেছিলাম। আরে এই প্ল্যানটার সাথে আমিও তো জড়িয়ে ছিলাম রে। কিন্তু শালা... থাক। আর অশরীরীটার সৃষ্টিকর্তা কে? এটা এক বিশাল বড় টুইস্ট। সব বলব আগে বলে দি বর্ণালীর ব্যাপারটা। বর্ণালীকে কেন অতটা কষ্ট দিয়েছিলি সুবীর? আমিও তো ওকে ভালবাসতাম, কোনোদিন বলতে পারিনি। তারওপর ক্লাসের ফাস্ট বয়ের সাথে প্রেম বলে কথা। মেয়েটা ট্রেনের নীচে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে গেলো। ওইভাবে না বাঁচলেই ভালো হত। কি অসুবিধে ছিল তোর?
লজ্জায় মাথা নিচু করে নেন সুবীর বাবু।
সুবীর বাবুঃ বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। একদম নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম। বাবা প্রচণ্ড অশান্তি করেছিলেন। ভেবেছিলাম, জীবনে কিছু হয়ে যাই তারপর ওকে আবার নতুন করে সব বলব। শুধু এটাই বলেছিলাম “বর্ণালী আমি আর সম্পর্ক রাখতে পারব না। আমার পড়াশুনায় প্রচণ্ড ক্ষতি হচ্ছে” কিন্তু ভাবিনি এর জন্য...
মানব বাবুঃ তুই ভালবাসতে জানিস না সুবীর। আর ঠিক সেই কারনেই তুই ও প্রকৃত ভালোবাসা পেলিনা। তোর আমি কোনও ক্ষতি করতে চাইনি। বর্ণালী শেষ দিন অবধি আমার কাছেই ছিল। আমি ওকে দগ্ধে দগ্ধে মরতে দেখেছি রে। হয়ত সেই কারনেই আমার ও আর জীবনে কিছুই ছিলনা, শুধুই একটা প্রতিশোধ চেয়েছিলাম। কিন্তু আমিও পারলাম না। আসলে কি জানিস তো আমরা না নিজের না অন্যের ভাগ্য লিখে দিতে পারি। সব ই ওপরওয়ালার খেল। আমি শেষদিন অবধি বর্ণালীকে বলে গেছি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই, কিন্তু মেয়েটা তোকে ছাড়া কাউকেই... আমারও সংসার হলনা, বর্ণালীর হলনা তোর ও হলনা। মানুষ নিজের পাপের ফল ঠিক ই পায়রে।
মাথা নিচু করে নেয় সুবীর বাবু। চোখ দিয়ে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল নীচে পড়তে থাকে।
মানব বাবুঃ আমি তোকে একদম শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তোর সর্বনাশ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই... যাই হোক। তোর সাথে যা হয়েছে তাতে হয়ত একটা ছোট্ট ভুমিকা আমার আছে। কিন্তু আসল মাথা অন্য কেউ। তুই ও তা আসতে আসতে বুঝতে পারছিস।
এই গুরুগম্ভীর অবস্থাকে ভঙ্গ করে আবার সুবীর বাবুর মোবাইলটা বেজে ওঠে। হথাত মানব বাবু ইশারায় ওনাকে বিরত করেন। সুবীর বাবু বোঝেন মানব ওকে ফোনটা রিসিভ করতে নিষেধ করছে। তাও একবার ফোনটা হাতে নিয়ে সুবীর বাবু দেখেন এটা রূপসার ফোন।
মানব বাবুঃ সুবীর, আর হাতে সময় নেই। হয়ত এতক্ষনে পুলিশের বিশাল বাহিনী তোর বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে। আর সামান্য কোনও ভুল করা চলবে না। তুই এই মুহূর্তে খুনের আসামী। তোর কাছে কোনও প্রমান নেই। ডায়েরীর গল্পটা কেন ঠিক আজকেই তোকে বলা হোল তা তুই কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারবি। তুই বেশকিছু ভুল করে ফেলেছিস। তার মধ্যে অন্যতম, রূপসার কাছে বৌদিকে বেশ্যা বলা। রূপসাকে তুই নিজে ফোন কর, আর ও কিছু বলার আগেই ওকে বল যে বৌদিকে এরকম বলে তুই ঠিক করিস নি। আসলে একজন লোক বৌদির নামে কিছু কথা বানিয়ে বলেছে তাই তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। এবং তুই রাগের মাথায় ওই কথা বলে ফেলেছিস। যা বললাম ঠিক তাই কর নয়ত তোর বিপদ আরও বাড়বে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তুই একটা বিশাল রহস্য বুঝতে পারবি।
সুবীর বাবু অসহায়ের মতন মানব বাবুর কথা শুনে গেলেন। রূপসার কলটা ততক্ষনে কেটে গেছে। সুবীর বাবু নিজেই আবার রূপসার মোবাইলে কল করেন। রূপসা কিছু বলার আগেই উনি বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ মা রূপসা, বিশাল ভুল হয়ে গেছে। আসলে একটা বদ লোক তোর মায়ের নামে বানিয়ে বানিয়ে কিছু কথা বলল তাই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। কি করে যে এতো বাজে কথা আমার মুখ দিয়ে বেরোল আমি নিজেই জানিনা।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রূপসার কান্নার আওয়াজ আসতে থাকে। সুবীর বাবু যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পড়েন।
সুবীর বাবুঃ কি হয়েছে মা, তুই কাঁদছিস কেন। আর তিলোত্তমা কই।
ফোনটা তিলোত্তমা রূপসার হাত থেকে নিয়ে নেয়।
তিলোত্তমাঃ বাবা, মা যে এরকম করবে আমরা কখনো ভাবিনি। অথচ কিছুক্ষন আগে তোমাকেই আমরা কি কি ভেবে বসেছি। জানো মা আমাদের তোমার সম্বন্ধে কি বলেছে? তুমি সন্দেহবাতিক, তুমি মানসিক রুগী, তুমি...
ফোনটা রূপসা কেড়ে নেয় তিলোত্তমার থেকে।
রূপসাঃ বাবা, এক্ষুনি একবার টিভিটা খোল। তুমি সব বুঝে যাবে। মা কেন এরকম করল বাবা। মা তো তোমায় প্রচুর ভালোবাসতো। তুমি চিন্তা করোনা বাবা, আমরা দুবোন তোমার পাশেই আছি। মায়ের পাশে নয়।
ফোনটা কেটে দেয় সুবীর বাবু। ওনার সামনে সত্যি ই যে বিশাল এক বিপদ তা এবার উনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারেন। মানব বাবু ওনার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন
মানব বাবুঃ সুবীর যা হচ্ছে, তা মেনে নিবি। ঘাবড়ে যাবি না। কারন দুটো মেয়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তোর ওপর। চল টিভিটা খোল। এবার তুই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই প্রায় বুঝে যাবি।
মানব বাবু ও সুবীর বাবু দুজনেই টিভির ঘরের দিকে যেতে শুরু করেন।
সুবীর বাবু সাধারনত নিউজ ই দেখতে ভালবাসেন তাই টিভি তে নিউজের চ্যানেলটাই অন ছিল। টিভি অন হওয়া মাত্র নিউজ চ্যানেল ও সাথেসাথে প্রায় পাগল করে দেওয়া এক দৃশ্য। মানবের আগমন, সত্য বাবুর চাতুরি প্রকাশ পাওয়া এ যেন সুবীর বাবুর হৃদয়ে এক নতুন রক্ত সঞ্চালন ঘটিয়েছিল। যে স্ত্রীর জন্য উনি গর্ব বোধ করেন, সহকর্মীদের কাছে যার নামে এতো বড়াই করেন সে আর যাই হোক বেশ্যা নয়। মানুষের হৃদয় ও কি অদ্ভুত। ভাঙাগড়ার এক অদ্ভুত সমুদ্রে বারবার হারিয়ে যায়।
“ম্যাডাম, আপনি জানেন আপনি ঠিক কতবড় অভিযোগ করছেন? আপনার কাছে কোনও প্রমান আছে এর? আর কেন এতদিন পরে আপনি পুলিশে ডায়েরী করলেন। আপনি যদি সন্দেহ করেই থাকেন তো ৩ মাস আগে কেন পুলিশের কাছে এলেন না”
টিভির ক্যামেরা তখন তরুন সাংবাদিকের দিকে। অপর প্রান্তে কে বসে আছে তার অনুমান হয়ত মানব ও সুবীর বাবুর হুবহু এক। তরুন সাংবাদিক একের পর এক প্রশ্নবানে জর্জরিত করে চলেছেন কোনও এক অজানা মহিলাকে। ধীরেধীরে ক্যামেরার মুখ অন্যদিকে ঘোরে। সুবীর বাবুর আশঙ্কা যে এভাবে সত্যি হবে তা উনি কল্পনাও করতে পারেন নি। টিভি ক্যামেরায় ভেসে ওঠে ওনার ২০ বছরের বিবাহিত স্ত্রী মালতী দেবী।
মালতী দেবীঃ আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না, আমার মানসিক অবস্থা একদম ভালো নয়। (শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখটা মুছতে মুছতে) আমি অনেকদিন আগেই বুঝে গেছিলাম। কিন্তু ওনাকে খুব ভয় করে। উনি মানসিকভাবে সুস্থ নন, সবসময় কি এক অভিশপ্ত ডায়েরীর কথা বলে যান। কিসব জমিদার বাড়ির কথা বলেন। যতবার জিজ্ঞেস করি মানব দা কই, উত্তর দেন ওর ওপর ডায়েরীর অভিশাপ রয়েছে। আজ ৩ মাস হয়ে গেলো মানবদার কোনও খোঁজ নেই।
সাংবাদিকঃ তার মানে আপনি বলতে চান আপনার স্বামী, মানসিক উন্মাদ? এর আগে কখনো এটা আপনার মনে হয়নি? মানে শেষ কবে থেকে মনে হচ্ছে?
মালতী দেবীঃ (শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে) দেখুন, আমি নিজের স্বামীকে দোষারোপ করতে থানায় যাইনি। আমি তো শুধু মানবদাকে পাওয়া যাচ্ছেনা সেই অভিযোগ করতেই থানায় গিয়েছিলাম। এরপর যা হয়েছে তা তো পুলিশ ই করেছে। আমি শুধু ওনাদের বলেছি একটা প্রোজেক্ট এর কাজে জমিদার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই আমার স্বামীর মাথায় গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কখনো মানব দা কখনো বা পাড়ার ছেলেদের সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক চলছে বলে দাবী করে। আমার পাশে কেউ নেই, আমার মেয়েরাও আমার পাশে নেই। আমি একা মহিলা। আমায় যেতে দিন।
“ওকে ওকে ম্যাডাম। আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি এবার আসতে পারেন। এতক্ষন আপনারা দেখছিলেন বিখ্যাত গবেষক সুবীর সেনের স্ত্রী মালতী দেবী ঠিক কি ভয়ঙ্কর অভিযোগ এনেছেন নিজের স্বামীর নামে। পুলিশ ১ ঘণ্টার তল্লাশির পর ই জমিদারবাড়ির পেছনের মাঠ থেকে মাটি চাপা দেওয়া এক পচাগলা মৃতদেহ আবিস্কার করেছে। পরনের পোশাক দেখে মনে করা হচ্ছে, এই মৃতদেহ মানব বাবুর। এবং সন্দেহের বশে এই খুন......”
শেষ কয়েকটা কথা আর সত্যি ই সুবীর বাবুর মাথায় ঢুকল না। ভুতের ভয় ঠিক কি জিনিষ এর আগে সত্য বাবুর আবির্ভাবে উনি বুঝেছেন, কিন্তু ওনার গায়ের এই কাঁটা দেওয়া এটাই প্রমান করে যে উনি এতোবড় একটা টুইস্ট এর জন্য সত্যি ই প্রস্তুত ছিলেন না। একটা বরফের মত ঠাণ্ডা হাত সুবীর বাবুর কাঁধে এসে স্পর্শ করে। মনে সাহসের সঞ্চার করে কোনওরকমে সুবীর বাবু পেছন ফিরে তাকান। পেছনের দৃশ্য যেকোনো সাধারন মানুষের হার্টফেল করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ভুতের অভিজ্ঞতা তো সুবীর বাবুর কম হলনা। তাই উনি শুধুই আঁতকে উঠলেন।
ওনার পেছনে দাঁড়িয়ে একটা পচা গলা মৃতদেহ। চোখ বলে কিছুই নেই, শুধু দুটো গহ্বর। ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে নেন সুবীর বাবু। ওনার কানে ভেসে আসে একটা ভারী গলা “ভূত দেখলে মানুষ ভয় পাবেই রে। আর ভূত মানুষের কাছে মোট দুটো কারনে আসে। হয় উপকার করতে নয় ক্ষতি করতে। তোর জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। তাও আমি তোকে বাঁচাতে চাই, কারন তুই আমার বাল্যবন্ধু। চোখ খোল সুবীর, দেখ যাকে এতো ঘেন্না করতিস আজ সেই তোর জন্য এখানে উপস্থিত”
চোখ খোলেন সুবীর বাবু। মানব নিজের পুরনো রূপটা আবার ফিরে পেয়েছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সুবীর বাবু নিজেকে কোনরকমে নিয়ন্ত্রন করেন। কিন্তু আবারও একটা চোখ ধাঁধানো জিনিষ। মানবের হাতে লাল রঙের অতি পুরনো একটা ডায়েরী। সুবীর বাবুর চোখ একদম সেই ডায়েরীর ই দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন সুবীর বাবু।
মানব বাবুঃ (মুচকি হেঁসে) হ্যাঁ রে সুবীর, অভিশপ্ত ডায়েরী সত্যি ই আছে। জমিদারবাড়ির নবীনতম সদস্য আমি। যাওয়ার আগে তোর সাথে বংশী, সুপ্রতীক, মালা, অনুরাধা, মৃত্যুঞ্জয় সবার পরিচয় করিয়ে দেবো। এখন থেকে তো ডায়েরীর গল্পটা বলার দায়িত্ব আমার ওপর। আমি যে নবীনতম। এরপর কোন সুখী দম্পতির জীবনে এই ডায়েরীর অভিশাপ নেমে আসে কি জানি।
হ্যাঁ করে মানবের কথা শুনতে থাকেন সুবীর বাবু।
মানব বাবুঃ অবৈধ সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা তোদের মত শিক্ষিত লোকের ভাষায় adultery relation যতদিন থাকবে, মালতীরা যতদিন সুবীরদের ছেড়ে নতুন এক সঙ্গীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবে ততদিন এই ডায়েরী থাকবে।
সুবীর বাবুঃ কে সে?
মানব বাবুঃ একসাথে এতো টুইস্ট। সব এক এক করে বলব। ডায়েরীটা নিয়ে এখানে আসার কথা ছিল আমার। কিন্তু শালা সত্য বাবু নিজেই কেন কিভেবে যে এখানে চলে এলো। ঠিক আছে কোনও ব্যাপার নয়, পরের টুইস্ট গুলো তো আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু বন্ধু একটা কথা মনে রেখো ভগবানের ও সাধ্য নেই মানুষের ইতিহাস লেখা। তাই ডায়েরী তোর জীবন থেকেই লেখা হয়, ডায়েরী মেনে তোর জীবন নয়। তাই এটা অভিশপ্ত কিনা সেটা তো একেবারেই তোদের মত গবেষকদের ব্যাপার। (ডায়েরীটার একদম শেষদিকে পাতা উলটে) এই দেখ, পর্ব ১৬- দ্বিতীয় টুইস্ট লেখা হয়ে গেছে কিন্তু পর্ব ১৭ এর কোনও উল্লেখ নেই। আমার গল্প শেষ হবে আর ডায়েরী ও লেখা হয়ে যাবে।
সুবীর বাবুঃ অনুরাধা, দেবেন্দ্র, সত্যেন্দ্র, মৃত্যুঞ্জয় অর্থাৎ ঠাকুর ডাকাত, সুপ্রতীক, বংশী, মালা আরও কত চরিত্র। এদের কি কোনও অস্তিত্বই নেই? হথাত এদের কথা আমায় জানিয়ে কি লাভ মানব?
মানব বাবুঃ লাভ ক্ষতি আমিও জানিনা। কিন্তু এই গল্পটা একেবারে সত্যি। ডায়েরীর দুটো খণ্ড অর্থাৎ সুপ্রতীকের গল্প ও সত্যেন্দ্রের গল্প এটা হুবহু এক। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে এতটা সত্য এক ঘটনা এই লোকটা বলল বা কি করে। যতক্ষণ না মালটার হুঁশ ফিরছে ততক্ষন সত্যি এই রহস্যটা কিছুতেই ফাঁস হবেনা। যদিও এই গল্পের মধ্যে হাজারো ত্রুটি ছিল। যেমন ধর, কলকাতা শহরে কি আবার কোনও নীলকুঠি ছিল নাকি। নীলের চাষ তো হত জেলা অঞ্চলে। তো গল্পে এই নীলকুঠীর অস্তিত্ব এটা সত্যি ই সত্যবাবুর নিজমনে তৈরি। আবার ধর, জঙ্গল ও ডাকাত। ১৬০০ সালের দিকে কলকাতার আশেপাশে কোনও জঙ্গল ও ছিলনা ডাকাত ও ছিলনা।
সুবীর বাবুঃ হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস তুই। আমি ইতিহাসের লোক হয়েই বুঝতে পারলাম না। সত্যি কিকরে যে এরকম হোল?
মানব বাবুঃ সব তুই বিশ্বাস করেছিস তার কারন একটাই। ওই চাওয়ালার ভূত। ওই ভূতটাই এই গল্পের একমাত্র ভূত...
সুবীর বাবুঃ না রে আরও কতগুলো ভূত আমি দেখেছি। জমিদার বাড়িতে আমি নিজের চোখে অনুরাধা, সত্যেন্দ্র এদের আত্মা দেখেছি। যখন ভেতরে ঢুকেছিলাম বাড়িটা ছিল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। হথাত দেখি প্রচুর দাসী ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি এই সত্য বাবুও যে ভূত তাও আমি বিশ্বাস করেছিলাম কারন...
মানব বাবুঃ (প্রচণ্ড জোরে হেঁসে উঠে) আরে পাগল, ভুতেদের কি কাজ নেই তোর মত একটা গোবেচারা লোকের ক্ষতি করবে। যদি কোনও ভুতকে সামনে কখনো দেখিস, মনে রাখিস সে হয় তোর ওপর বদলা নিতে নয় তোকে উপকার করতেই এসেছে। এই যেমন ওই চাওয়ালার ভূতটাই ধর। তুই চা খেলি, চলে যাওয়ার সময় উনি কি বললেন “দাদা ওখানে যাবেন না, জমিদারবাড়ি থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনা” (একদম ওই চাওয়ালার মতই গলার স্বরে) কেন বলেছিল তুই এখন কিছু বুঝলি?
সুবীর বাবু কিছুটা চমকেই যান। মানব যে এতো ভালো অন্যের গলা নকল করতে পারে তা সত্যি ই ওনার জানা ছিলনা।
সুবীর বাবুঃ তুই এতো কিছু কিকরে জানলি রে মানব?
মানবের থেকে সমস্ত কিছু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরে সুবীর বাবুও নিজের সেই পুরনো মেজাজটা ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিলেন।
মানব বাবুঃ এটা তো একটা টুইস্ট বন্ধু। বললাম না একের পর এক টুইস্ট দেবো। সবার আগে তোকে বলি সত্য বাবু আসলে কে? ও না তার আগে তোকে একটা গল্প বলি, তুই অনেককিছুই বুঝে যাবি তাহলে।
সুবীর বাবু চুপ করে মানবের কথা শুনতে থাকেন।
মানব বাবুঃ ছোটবেলায় বাবার থেকে গল্প শুনেছিলাম সিনিয়ার পিসি সরকার নাকি তাজমহলকেই ভ্যানিস করে দিয়েছিলেন। আচ্ছা সুবীর আদৌ কি তাজমহলের মত এক অট্টালিকাকে ভ্যানিস করা যায়? উত্তরটা হোল না করা যায়না। তাহলে? উনি আসলে একটা কেমিক্যাল ব্যাবহার করেছিলেন। সবাই চোখের সামনে একটা ইলুশন দেখেছিল। এটাই ওনার ম্যাজিকের ভাষায় ভ্যানিশ। আর সাইকোলজিতে একেই বলে মাইন্ড ক্যাপচারিং। সত্য বাবুর কাছে অন্তত ৩টে ডায়েরী ছিল, প্রত্যেকটায় অনেক আগে থেকেই গল্প লেখা ছিল। আর গল্প গুলো তৈরি হয়েছিল মোট তিনজন মানুষের মতামত নিয়ে তাদের মধ্যে আমি একজন। যদিও তোর জীবনের ঘটনাগুলো গল্প হলেও জমিদার বাড়ির কথাগুলো একেবারেই গল্প নয়। কিন্তু কিকরে এতটা সত্য উনি লিখে ফেললেন এটাই একটা টুইস্ট।
সুবীর বাবুঃ আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বুঝিয়ে বল ভালো করে।
মানব বাবুঃ নিশ্চয়ই বলব বন্ধু। তুই সত্য বাবুকে খুব ভালো করে চিনিস। ওর নাম কলেজে বেশ কয়েকবার শুনেছিস। এমনকি একটি বইতেও পড়েছিস ওর ব্যাপারে। সত্য বাবুর আসল নাম সত্যব্রত দত্ত, কুখ্যাত...
“the brain study of a serial killer” আরে মানব এভাবে আমি ক্লিন বোল্ড হয়ে গেলাম। তাহলে কি সবকিছুর পেছনে আসলে...
সুবীর বাবু প্রচণ্ড উত্তেজনায় প্রায় ঝড়ের বেগে সমস্ত কথা বলে ফেললেন। কিন্তু ওনাকে নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে দিলেন না মানব বাবু।
মানব বাবুঃ না বন্ধু, কোনও সন্দেহের বশে নাম প্রকাশ করে আমার টুইস্টগুলো নষ্ট করা চলবে না। এখনো অনেক অনেক টুইস্ট বাকি রয়েছে বন্ধু। অপেক্ষায় থাকো। তবে তুই কিছুটা ঠিক ই অনুমান করেছিস। যাই হোক। এই সেই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার সত্যব্রত দত্ত। আমেরিকার এক বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার, সেখানেই নিজের গাইড এর স্ত্রীর সাথে প্রনয়ে জড়িয়ে পড়া। তারপর সাইকোলজিরই একের পর এক কনসেপ্ট লাগিয়ে গাইড, তার বাড়ির চাকর এমনকি বলতে লজ্জা হচ্ছে তাও ছোট্ট মেয়েটাকেও হত্যা করে। এমন ভয়ঙ্কর খুনির অপরাধ গোটা পৃথিবীর কেউ প্রমান করতে পারেনি। লোকের চোখে ধুলো দেওয়াই যে এর কাজ। সত্যি লোকটা জিনিয়াস। কিন্তু এইসব করতে গিয়ে একদিন সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। আর তারপর ই সেই বিখ্যাত প্রোজেক্ট “the brain study of a serial killer” কি অদ্ভুত না! বিজ্ঞান আর আইন একে অপরের বিপরীত হয়ে যায়। না লোকটা বেকসুর খালাস হয়ে যায়। কোনও শাস্তি ই পায়নি। তা এরকম এক লোক তোকে বোকা বানাবে না তো কাকে বানাবে?
জানি কিছুটা মাথায় ঢুকলেও এখনো পুরোটা তুই বুঝতে পারিসনি। আসতে আসতে হবে। কম জটিল ব্যাপার তো নয় এটা। একের পর এক টুইস্ট আসবে।
সুবীর বাবুঃ কিন্তু এই সত্য বাবু, হথাত আমার পেছনেই বা লাগতে গেলো কেন। আর আমার বাড়িতে ঘটে যাওয়া এতোগুলো ঘটনাও বা জানল কি করে। যেমন ধর মালতীকে সত্যি ই কোনও এক অশরীরী উত্তক্ত করত, সেকথা আমায় ও বলেওছিল। আর ধর, বর্ণালীর ব্যাপারটা। এটা তো আমি তুই আর মালতী ছাড়া আর কেউ জানেনা।
মানব বাবুঃ বর্ণালীর ঘটনাটা সত্য বাবুকে আমিই বলেছিলাম। আরে এই প্ল্যানটার সাথে আমিও তো জড়িয়ে ছিলাম রে। কিন্তু শালা... থাক। আর অশরীরীটার সৃষ্টিকর্তা কে? এটা এক বিশাল বড় টুইস্ট। সব বলব আগে বলে দি বর্ণালীর ব্যাপারটা। বর্ণালীকে কেন অতটা কষ্ট দিয়েছিলি সুবীর? আমিও তো ওকে ভালবাসতাম, কোনোদিন বলতে পারিনি। তারওপর ক্লাসের ফাস্ট বয়ের সাথে প্রেম বলে কথা। মেয়েটা ট্রেনের নীচে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে গেলো। ওইভাবে না বাঁচলেই ভালো হত। কি অসুবিধে ছিল তোর?
লজ্জায় মাথা নিচু করে নেন সুবীর বাবু।
সুবীর বাবুঃ বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। একদম নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম। বাবা প্রচণ্ড অশান্তি করেছিলেন। ভেবেছিলাম, জীবনে কিছু হয়ে যাই তারপর ওকে আবার নতুন করে সব বলব। শুধু এটাই বলেছিলাম “বর্ণালী আমি আর সম্পর্ক রাখতে পারব না। আমার পড়াশুনায় প্রচণ্ড ক্ষতি হচ্ছে” কিন্তু ভাবিনি এর জন্য...
মানব বাবুঃ তুই ভালবাসতে জানিস না সুবীর। আর ঠিক সেই কারনেই তুই ও প্রকৃত ভালোবাসা পেলিনা। তোর আমি কোনও ক্ষতি করতে চাইনি। বর্ণালী শেষ দিন অবধি আমার কাছেই ছিল। আমি ওকে দগ্ধে দগ্ধে মরতে দেখেছি রে। হয়ত সেই কারনেই আমার ও আর জীবনে কিছুই ছিলনা, শুধুই একটা প্রতিশোধ চেয়েছিলাম। কিন্তু আমিও পারলাম না। আসলে কি জানিস তো আমরা না নিজের না অন্যের ভাগ্য লিখে দিতে পারি। সব ই ওপরওয়ালার খেল। আমি শেষদিন অবধি বর্ণালীকে বলে গেছি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই, কিন্তু মেয়েটা তোকে ছাড়া কাউকেই... আমারও সংসার হলনা, বর্ণালীর হলনা তোর ও হলনা। মানুষ নিজের পাপের ফল ঠিক ই পায়রে।
মাথা নিচু করে নেয় সুবীর বাবু। চোখ দিয়ে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল নীচে পড়তে থাকে।
মানব বাবুঃ আমি তোকে একদম শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তোর সর্বনাশ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই... যাই হোক। তোর সাথে যা হয়েছে তাতে হয়ত একটা ছোট্ট ভুমিকা আমার আছে। কিন্তু আসল মাথা অন্য কেউ। তুই ও তা আসতে আসতে বুঝতে পারছিস।
এই গুরুগম্ভীর অবস্থাকে ভঙ্গ করে আবার সুবীর বাবুর মোবাইলটা বেজে ওঠে। হথাত মানব বাবু ইশারায় ওনাকে বিরত করেন। সুবীর বাবু বোঝেন মানব ওকে ফোনটা রিসিভ করতে নিষেধ করছে। তাও একবার ফোনটা হাতে নিয়ে সুবীর বাবু দেখেন এটা রূপসার ফোন।
মানব বাবুঃ সুবীর, আর হাতে সময় নেই। হয়ত এতক্ষনে পুলিশের বিশাল বাহিনী তোর বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে। আর সামান্য কোনও ভুল করা চলবে না। তুই এই মুহূর্তে খুনের আসামী। তোর কাছে কোনও প্রমান নেই। ডায়েরীর গল্পটা কেন ঠিক আজকেই তোকে বলা হোল তা তুই কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারবি। তুই বেশকিছু ভুল করে ফেলেছিস। তার মধ্যে অন্যতম, রূপসার কাছে বৌদিকে বেশ্যা বলা। রূপসাকে তুই নিজে ফোন কর, আর ও কিছু বলার আগেই ওকে বল যে বৌদিকে এরকম বলে তুই ঠিক করিস নি। আসলে একজন লোক বৌদির নামে কিছু কথা বানিয়ে বলেছে তাই তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। এবং তুই রাগের মাথায় ওই কথা বলে ফেলেছিস। যা বললাম ঠিক তাই কর নয়ত তোর বিপদ আরও বাড়বে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তুই একটা বিশাল রহস্য বুঝতে পারবি।
সুবীর বাবু অসহায়ের মতন মানব বাবুর কথা শুনে গেলেন। রূপসার কলটা ততক্ষনে কেটে গেছে। সুবীর বাবু নিজেই আবার রূপসার মোবাইলে কল করেন। রূপসা কিছু বলার আগেই উনি বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ মা রূপসা, বিশাল ভুল হয়ে গেছে। আসলে একটা বদ লোক তোর মায়ের নামে বানিয়ে বানিয়ে কিছু কথা বলল তাই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। কি করে যে এতো বাজে কথা আমার মুখ দিয়ে বেরোল আমি নিজেই জানিনা।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রূপসার কান্নার আওয়াজ আসতে থাকে। সুবীর বাবু যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পড়েন।
সুবীর বাবুঃ কি হয়েছে মা, তুই কাঁদছিস কেন। আর তিলোত্তমা কই।
ফোনটা তিলোত্তমা রূপসার হাত থেকে নিয়ে নেয়।
তিলোত্তমাঃ বাবা, মা যে এরকম করবে আমরা কখনো ভাবিনি। অথচ কিছুক্ষন আগে তোমাকেই আমরা কি কি ভেবে বসেছি। জানো মা আমাদের তোমার সম্বন্ধে কি বলেছে? তুমি সন্দেহবাতিক, তুমি মানসিক রুগী, তুমি...
ফোনটা রূপসা কেড়ে নেয় তিলোত্তমার থেকে।
রূপসাঃ বাবা, এক্ষুনি একবার টিভিটা খোল। তুমি সব বুঝে যাবে। মা কেন এরকম করল বাবা। মা তো তোমায় প্রচুর ভালোবাসতো। তুমি চিন্তা করোনা বাবা, আমরা দুবোন তোমার পাশেই আছি। মায়ের পাশে নয়।
ফোনটা কেটে দেয় সুবীর বাবু। ওনার সামনে সত্যি ই যে বিশাল এক বিপদ তা এবার উনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারেন। মানব বাবু ওনার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন
মানব বাবুঃ সুবীর যা হচ্ছে, তা মেনে নিবি। ঘাবড়ে যাবি না। কারন দুটো মেয়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তোর ওপর। চল টিভিটা খোল। এবার তুই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই প্রায় বুঝে যাবি।
মানব বাবু ও সুবীর বাবু দুজনেই টিভির ঘরের দিকে যেতে শুরু করেন।
সুবীর বাবু সাধারনত নিউজ ই দেখতে ভালবাসেন তাই টিভি তে নিউজের চ্যানেলটাই অন ছিল। টিভি অন হওয়া মাত্র নিউজ চ্যানেল ও সাথেসাথে প্রায় পাগল করে দেওয়া এক দৃশ্য। মানবের আগমন, সত্য বাবুর চাতুরি প্রকাশ পাওয়া এ যেন সুবীর বাবুর হৃদয়ে এক নতুন রক্ত সঞ্চালন ঘটিয়েছিল। যে স্ত্রীর জন্য উনি গর্ব বোধ করেন, সহকর্মীদের কাছে যার নামে এতো বড়াই করেন সে আর যাই হোক বেশ্যা নয়। মানুষের হৃদয় ও কি অদ্ভুত। ভাঙাগড়ার এক অদ্ভুত সমুদ্রে বারবার হারিয়ে যায়।
“ম্যাডাম, আপনি জানেন আপনি ঠিক কতবড় অভিযোগ করছেন? আপনার কাছে কোনও প্রমান আছে এর? আর কেন এতদিন পরে আপনি পুলিশে ডায়েরী করলেন। আপনি যদি সন্দেহ করেই থাকেন তো ৩ মাস আগে কেন পুলিশের কাছে এলেন না”
টিভির ক্যামেরা তখন তরুন সাংবাদিকের দিকে। অপর প্রান্তে কে বসে আছে তার অনুমান হয়ত মানব ও সুবীর বাবুর হুবহু এক। তরুন সাংবাদিক একের পর এক প্রশ্নবানে জর্জরিত করে চলেছেন কোনও এক অজানা মহিলাকে। ধীরেধীরে ক্যামেরার মুখ অন্যদিকে ঘোরে। সুবীর বাবুর আশঙ্কা যে এভাবে সত্যি হবে তা উনি কল্পনাও করতে পারেন নি। টিভি ক্যামেরায় ভেসে ওঠে ওনার ২০ বছরের বিবাহিত স্ত্রী মালতী দেবী।
মালতী দেবীঃ আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না, আমার মানসিক অবস্থা একদম ভালো নয়। (শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখটা মুছতে মুছতে) আমি অনেকদিন আগেই বুঝে গেছিলাম। কিন্তু ওনাকে খুব ভয় করে। উনি মানসিকভাবে সুস্থ নন, সবসময় কি এক অভিশপ্ত ডায়েরীর কথা বলে যান। কিসব জমিদার বাড়ির কথা বলেন। যতবার জিজ্ঞেস করি মানব দা কই, উত্তর দেন ওর ওপর ডায়েরীর অভিশাপ রয়েছে। আজ ৩ মাস হয়ে গেলো মানবদার কোনও খোঁজ নেই।
সাংবাদিকঃ তার মানে আপনি বলতে চান আপনার স্বামী, মানসিক উন্মাদ? এর আগে কখনো এটা আপনার মনে হয়নি? মানে শেষ কবে থেকে মনে হচ্ছে?
মালতী দেবীঃ (শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে) দেখুন, আমি নিজের স্বামীকে দোষারোপ করতে থানায় যাইনি। আমি তো শুধু মানবদাকে পাওয়া যাচ্ছেনা সেই অভিযোগ করতেই থানায় গিয়েছিলাম। এরপর যা হয়েছে তা তো পুলিশ ই করেছে। আমি শুধু ওনাদের বলেছি একটা প্রোজেক্ট এর কাজে জমিদার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই আমার স্বামীর মাথায় গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কখনো মানব দা কখনো বা পাড়ার ছেলেদের সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক চলছে বলে দাবী করে। আমার পাশে কেউ নেই, আমার মেয়েরাও আমার পাশে নেই। আমি একা মহিলা। আমায় যেতে দিন।
“ওকে ওকে ম্যাডাম। আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি এবার আসতে পারেন। এতক্ষন আপনারা দেখছিলেন বিখ্যাত গবেষক সুবীর সেনের স্ত্রী মালতী দেবী ঠিক কি ভয়ঙ্কর অভিযোগ এনেছেন নিজের স্বামীর নামে। পুলিশ ১ ঘণ্টার তল্লাশির পর ই জমিদারবাড়ির পেছনের মাঠ থেকে মাটি চাপা দেওয়া এক পচাগলা মৃতদেহ আবিস্কার করেছে। পরনের পোশাক দেখে মনে করা হচ্ছে, এই মৃতদেহ মানব বাবুর। এবং সন্দেহের বশে এই খুন......”
শেষ কয়েকটা কথা আর সত্যি ই সুবীর বাবুর মাথায় ঢুকল না। ভুতের ভয় ঠিক কি জিনিষ এর আগে সত্য বাবুর আবির্ভাবে উনি বুঝেছেন, কিন্তু ওনার গায়ের এই কাঁটা দেওয়া এটাই প্রমান করে যে উনি এতোবড় একটা টুইস্ট এর জন্য সত্যি ই প্রস্তুত ছিলেন না। একটা বরফের মত ঠাণ্ডা হাত সুবীর বাবুর কাঁধে এসে স্পর্শ করে। মনে সাহসের সঞ্চার করে কোনওরকমে সুবীর বাবু পেছন ফিরে তাকান। পেছনের দৃশ্য যেকোনো সাধারন মানুষের হার্টফেল করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ভুতের অভিজ্ঞতা তো সুবীর বাবুর কম হলনা। তাই উনি শুধুই আঁতকে উঠলেন।
ওনার পেছনে দাঁড়িয়ে একটা পচা গলা মৃতদেহ। চোখ বলে কিছুই নেই, শুধু দুটো গহ্বর। ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে নেন সুবীর বাবু। ওনার কানে ভেসে আসে একটা ভারী গলা “ভূত দেখলে মানুষ ভয় পাবেই রে। আর ভূত মানুষের কাছে মোট দুটো কারনে আসে। হয় উপকার করতে নয় ক্ষতি করতে। তোর জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। তাও আমি তোকে বাঁচাতে চাই, কারন তুই আমার বাল্যবন্ধু। চোখ খোল সুবীর, দেখ যাকে এতো ঘেন্না করতিস আজ সেই তোর জন্য এখানে উপস্থিত”
চোখ খোলেন সুবীর বাবু। মানব নিজের পুরনো রূপটা আবার ফিরে পেয়েছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সুবীর বাবু নিজেকে কোনরকমে নিয়ন্ত্রন করেন। কিন্তু আবারও একটা চোখ ধাঁধানো জিনিষ। মানবের হাতে লাল রঙের অতি পুরনো একটা ডায়েরী। সুবীর বাবুর চোখ একদম সেই ডায়েরীর ই দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন সুবীর বাবু।
মানব বাবুঃ (মুচকি হেঁসে) হ্যাঁ রে সুবীর, অভিশপ্ত ডায়েরী সত্যি ই আছে। জমিদারবাড়ির নবীনতম সদস্য আমি। যাওয়ার আগে তোর সাথে বংশী, সুপ্রতীক, মালা, অনুরাধা, মৃত্যুঞ্জয় সবার পরিচয় করিয়ে দেবো। এখন থেকে তো ডায়েরীর গল্পটা বলার দায়িত্ব আমার ওপর। আমি যে নবীনতম। এরপর কোন সুখী দম্পতির জীবনে এই ডায়েরীর অভিশাপ নেমে আসে কি জানি।
হ্যাঁ করে মানবের কথা শুনতে থাকেন সুবীর বাবু।
মানব বাবুঃ অবৈধ সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা তোদের মত শিক্ষিত লোকের ভাষায় adultery relation যতদিন থাকবে, মালতীরা যতদিন সুবীরদের ছেড়ে নতুন এক সঙ্গীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবে ততদিন এই ডায়েরী থাকবে।
সুবীর বাবুঃ কে সে?
মানব বাবুঃ একসাথে এতো টুইস্ট। সব এক এক করে বলব। ডায়েরীটা নিয়ে এখানে আসার কথা ছিল আমার। কিন্তু শালা সত্য বাবু নিজেই কেন কিভেবে যে এখানে চলে এলো। ঠিক আছে কোনও ব্যাপার নয়, পরের টুইস্ট গুলো তো আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু বন্ধু একটা কথা মনে রেখো ভগবানের ও সাধ্য নেই মানুষের ইতিহাস লেখা। তাই ডায়েরী তোর জীবন থেকেই লেখা হয়, ডায়েরী মেনে তোর জীবন নয়। তাই এটা অভিশপ্ত কিনা সেটা তো একেবারেই তোদের মত গবেষকদের ব্যাপার। (ডায়েরীটার একদম শেষদিকে পাতা উলটে) এই দেখ, পর্ব ১৬- দ্বিতীয় টুইস্ট লেখা হয়ে গেছে কিন্তু পর্ব ১৭ এর কোনও উল্লেখ নেই। আমার গল্প শেষ হবে আর ডায়েরী ও লেখা হয়ে যাবে।