24-01-2019, 02:45 PM
পর্ব ১৪- পরাজিত সৈনিকঃ
দোকানে মাল ডেলিভারি করতে করতে প্রায় রাত ৮ টা বেজে যায়। এতো যে দেরি হবে তা সত্যি ই সাইদুল ভাবতে পারেনি। মনে মনে বলে ১ ঘণ্টা বলেছিলাম তার বদলে ৩ ঘণ্টা লেগেছে, কিন্তু রূপসার ও নিশ্চয়ই সেরকম কোনও অসুবিধা হয়নি। তারকারন রূপসার তো কোনও ফোন ই আসেনি। দোকানের শাটার টা জোরে নামিয়ে লক করে বাজারের মধ্যে দিয়ে সামনে এগোতে থাকে সাইদুল। কিছুটা গেলেই বাজারের মাঝে দুদিকে সার দিয়ে ফুলওয়ালিরা বসে। বেশ কিছু রজনীগন্ধার ও গোলাপের মালা কিনে নেয় সাইদুল। আর একটা কাজ পড়ে থাকে তা হোল বাজার করা। বাড়িতে প্রায় কিছুই পড়ে নেই। সবজি বাজারে গিয়ে রাতের রান্নার জন্য দরকারি সবজি কিনে নিয়ে বেরিয়ে আসে সাইদুল। হাসিহাসি মুখে বস্তির রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দুপুরের সব ঘটনা ওর মনে পড়ে যেতে শুরু করে। হাতের আঙ্গুলটায় একটা কামড় দিয়ে বলে ওঠে “ধুস শালা, কেন যে এতো উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম। প্রথম বারেই ক্লিন বোল্ড। আর রূপসাটাও ভীষণ বদমাশ। বারবার রাজুর নাম বলে আমায় রাগিয়ে দিচ্ছিল। আজ আর আমি ওর কোনও ফাঁদেই পা দেবনা” এইসব বিড়বিড় করতে করতে কখন যে সাইদুল নিজের বাড়ির সামনেই চলে এসেছে তা ওর খেয়াল ও নেই। দরজাটা ভেজানো আছে। সাইদুল একটু জোরে থেলা দেয়।
প্রায় ঘাবড়ে গিয়ে রূপসা খাটের ওপর থেকে দৌড়ে বাইরের উঠোনের দিকে চলে যায়। সাইদুল কিছুটা অবাক ই হয়ে যায়। হথাত রুপ্সা এতো ভয় কেন পেয়ে গেলো?
“রূপসা আমি সাইদুল, এতো ভয় কেন পেয়ে গেলে”
আবার উঠোন থেকে সামনের দিকে এগিয়ে আসে রূপসা। রূপসার মুখের সেই পুরনো দুষ্টু হাঁসিটা নেই। কালো মেঘের মত গুরুগম্ভীর ওই মুখটার দিকে তাকাতে সাইদুলের খুব ভয় করে। সাইদুল খুব অবাক হয়ে যায়, রূপসার হয়েছে টা কি।
সাইদুলঃ কি হয়েছে রূপসা? আমি দেরি করে এলাম বলে রাগ করেছ? আরে বলনা যে পার্টিকে মাল ডেলিভারি করার কথা তারা এতো দেরি করে এলো। সত্যি সময়জ্ঞান যদি মানুষের একটু থাকতো তো...
রূপসাঃ ঘরে তো শাকসবজি কিছুই নেই। রান্না করতে হবে তো? বাজার থেকে কিছু এনেছ তুমি?
সাইদুলঃ (সাইদুল গুটি গুটি পায়ে রূপসার দিকে এগিয়ে যায়, দুহাতে রূপসার মুখকে চেপে ধরে) কি হয়েছে সোনা। আমার ওপর রাগ করেছ না? আরে আমি কি করব...
রূপসা কোনও কথা না বলে রাজুর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরের দিকে যেতে শুরু করে। সাইদুলের ও মেজাজ কিছুটা বিগড়ে যায়।
সাইদুলঃ আরে এতে এতো রাগ করার কি আছে? আমি তো তোমায় বলে গেছিলাম। আর যদি একা থাকতে খারাপ ই লাগত তাহলে আমায় একবার ফোন করতে পারতে। আমি দোকানে কাউকে বসিয়ে চলে আসতাম।
রূপসা কোনও উত্তর দেয়না। হতাশ সাইদুল ও চুপ করে খাটের ওপর বসে যায়। প্রেমে তো পড়ে গেছে, প্রেমিকার মন ও জয় করেছে কিন্তু সাইদুল এটা বোঝেনা মেয়ে সামলানো এর চেয়ে অনেক অনেক কঠিন। প্রথম পরিচয়ের সেই আবেগগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আর টার বদলে ক্ষনে ক্ষনে শুধুই ভুল বোঝাবুঝির ঘনঘটা। মনে মনে ভাবে সাইদুল, একবার রূপসার কাছে যাই ওকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে। মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে রূপসা ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত কিছু বলতে যাচ্ছিল সাইদুল। কিন্তু শুকনো মুখে রূপসা বলে ওঠে
রূপসাঃ তুমি কাকে ভালোবাসো সাইদুল? মানুষ রূপসাকে? নাকি সুন্দর দেহের অধিকারী সদ্য অষ্টাদশী রূপসাকে?
কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় সাইদুল। ক্লাস ৮ পর্যন্ত পড়াশুনা শেখা এক ছেলে এতো কঠিন এক প্রশ্নের কি জবাব দেবে? কিন্তু এটাও সত্যি যে ভালবাসতে গেলে স্বাক্ষর হতে হয়না। হয়ত উত্তরটা সাইদুল নয় সাইদুলের হৃদয় ই দিয়েছিল।
সাইদুলঃ তুমি এতো সুন্দরী না হলেও আমি তোমায় ই ভালবাসতাম। তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা রূপসা। তোমায় আমি কখনোই ভুলতে পারবোনা।
নিজের দুহাত দিয়ে আলতো করে সাইদুলের দুগাল কে স্পর্শ করে রূপসা। রূপসার দুই নয়নে যেন হাজারো যন্ত্রণা কষ্ট ঠিকরে বেরিয়ে আসে।
রূপসাঃ তুমি সত্যি বলছ সাইদুল? আমার এই শরীরটা যদি কোনও ভুল করে তাহলে তুমি শরীরটাকে ক্ষমা করে দেবে তো? এটা বিশ্বাস করবে তো যে এই পাপটা আমার মন করেনি, শরীর করেছে।
অশিক্ষিত সাইদুল এর অর্থ কি বুঝল তা ওই জানে। কিন্তু ওর দুদিকে মাথা নাড়ানো যে রূপসার প্রশ্নের উত্তর তা রূপসা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে।
রুপ্সাঃ (মুখে আবার সেই পুরনো হাঁসিটা ফিরিয়ে এনে) তুমি সত্যি ই আমায় ভালোবাসো সাইদুল। দাঁড়াও আজ আমি তোমায় আলুপোস্ত করে খাওয়াবো। জানতো বাবাকে যতবার আমি আলুপোস্ত রেঁধে খাওয়াই বাবা ততবার ই আমায় একটা চকলেট গিফট করে।
সাইদুলঃ (প্রচণ্ড তৃপ্তিতে হেঁসে উঠে) আমি না বাজার থেকে ফুল আর ফুলের মালা এনেছি।
রূপসাঃ (কিছুটা ভেংচি কেটে) ওহ ছেলের ন্যাকামো দেখলে গা জ্বলে যায়। ওসব হবেনা। আগে বিয়ে হোক তারপর।
হাঁসতে হাঁসতে রূপসা আবার রান্নাঘরের দিকে যেতে শুরু করে। হথাত সাইদুল বলে ওঠে “রূপসা তোমার ঘাড়ে ওটা কিসের দাগ?” রূপসা থমকে দাঁড়ায়, মুখে সেই কালো মেঘের ঘনঘটাটা আবার ফিরে আসে। সাইদুল সামনে এগিয়ে যায়। “এটা তো কোনও পোকায় বা জন্তুতে কামড়ানোর ক্ষত। কি হয়েছে রূপসা”
রূপসাঃ আর বলনা, তোমার বাড়িতে যা ইঁদুরের উপদ্রব। বাথরুম এ গেছিলাম বুঝতেই পারিনি। হথাত একটা ইঁদুর কোথা থেকে কিজানি আমার ঘাড়ে এসে উঠল।
সাইদুলঃ ওষুধ লাগাতে হবে তো। আর একটা ইঞ্জেক্সান ও নিতে হবে।
রূপসাঃ ও কাল সকালে দেখা যাবে। আজ আগে রান্না করি।
সাইদুল ও আর বাধা দেয়না। রূপসার রান্না করতে বেশ কিছুক্ষন সময় লাগবে বলে সাইদুল বাইরে বেরোয়। রূপসার ভয়ে সেই কোন সকাল থেকে একটা বিড়িও মুখে দেওয়া হয়নি। হাসিহাসি মুখে বস্তির ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। রাস্তাতেই আব্দুল চাচার সাথে দেখা। আব্দুল চাচা ওর আব্বার পুরনো বন্ধু। দেখা হলেই আম্মির ব্যাপারে সংসারের ব্যাপারে হাজার গণ্ডা প্রশ্ন শুরু করে দেন। কিন্তু সাইদুল কখনো ওনাকে উপেক্ষা করতে পারেনা। যতই হোক ওর পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে কথা। আজও পারলনা প্রায় ১০ টা মিনিট সময় আব্দুল চাচাই নিয়ে নিল। আব্দুল চাচা চলে যাওয়ার পর দোকানের কাছে গিয়ে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দেয় সাইদুল। ভালো করে শেষ টান টা অবধি আয়েশ করে টেনে আবার বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে।
বাড়ির কাছে এসে দেখে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। সাইদুল তো কিছুটা অবাক ই হয়ে যায়। এতটুকু সময়ের জন্য ও বাইরে গেলো আর রূপসা দরজাটা লাগিয়ে দিলো? সাইদুল দু তিনবার দরজায় টোকা দেয় কিন্তু ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসেনা। জোরে চেঁচাতেও ভয় লাগে ওর, কারন তাহলে বস্তির সবার নজরে পড়ে যাবে। এবার বেশ ৩-৪ বার জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা মারে সাইদুল। তাও ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসেনা। ১ মিনিট মত অপেক্ষা করে আবার ধাক্কা দিতে যায় সাইদুল কিন্তু তার আগেই ভেতর থেকে দরজাটা খুলে যায়। ওকে প্রায় অবাক করে দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায় রাজু।
হ্যাঁ করে কিছুটা আশঙ্কা ও কিছুটা রাগে রাজুর মুখের দিকে তাকায় সাইদুল।
রাজুঃ কি রে সাইদুল, এভাবে দরজা খুলে রেখে কেউ চলে যায়। বস্তিতে যদি জানাজানি হয়ে যায় কম কেলেঙ্কারি হবে বল তো।
সাইদুল কোনও উত্তর দেয়না, হনহন করে ভেতরে ঢুকে যায়। খাটের কাছে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকায়। ওখানে নিরুত্তাপের সাথে রূপসা দাঁড়িয়ে রান্না করে চলেছে।
রাজুঃ আর কখনো এভাবে দরজা খুলে বাইরে চলে যাবিনা, ভাগ্যিস আমি দেখতে এসেছিলাম তোকে। রূপসা আমি চলি গো অনেক কাজ পড়ে আছে।
রূপসাঃ না একটু দাঁড়িয়েই যাও রাজুদা, আমি চা বসিয়েছি। চা খেয়ে যেও।
কথাটা বলার জন্য রূপসা অনেকটাই বাইরে বেরিয়ে এসে, রূপসার নজর সাইদুলের সাথে মেলে। কিন্তু রূপসা নিজের নজর সরিয়ে নেয়। মনেমনে বলতে থাকে সাইদুল কেন রূপসা নিজের নজর সরিয়ে নিল, ওর মুখটা কেন আবার আগের মত বিষণ্ণ হয়ে গেছে? রাজু এতক্ষন এখানে এসেছে, অথচ আমি ৪-৫ বার দরজায় ধাক্কা দিয়েছি ও খুলল না কেন? হাজারো প্রশ্ন সাইদুলের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। এর উত্তর হয়ত সঠিক সময়েই সাইদুল পেয়ে যাবে।
রাজুঃ কিরে আম্মিকে ছেড়ে দিয়ে এলি। আম্মি ঠিকথাক পৌঁছেছে কিনা একবারও খোঁজ নিয়েছিস? জানি নিসনি। তোকে আমি চিনিনা আবার।
সাইদুলের পক্ষে আর ধৈর্য পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিলনা। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলে ওঠে সাইদুল “তুই এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা”
ততক্ষনে রূপসাও সামনে এগিয়ে এসেছে। ক্ষোভে অপমানে রাজু থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দেয়। সাইদুলকে প্রচণ্ড অবাক করে রূপসা বলে ওঠে
রূপসাঃ না রাজুদা, আমি চা বানিয়েছি তুমি চা খেয়েই তারপর যেও।
প্রচণ্ড ক্রোধে সাইদুল রূপসার দিকে তাকায়। কিন্তু এবার আর আগের বারের মত রূপসা নিজের নজর সরিয়ে নেয়না। রূপসার দৃপ্ত চোখের দিকে সাইদুল তাকাতে পারেনা। লজ্জায় ও পরাজয়ের গ্লানিতে কিছুটা দৌড়েই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে আবার সেই সিগারেট দোকানের সামনেই এসে পৌছায়। নতুন একটা সিগারেট- ৫ টা মিনিট সময়, ৫ টা টাকা দুটোই অপচয় হয়। কিন্তু মাথাটাও ঠাণ্ডা হয় সাইদুলের। “রূপসা হয়ত ভদ্রতার খাতিরেই এইরকম ব্যাবহার করেছিল” আবার নিজের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে সাইদুল। মনের মধ্যে আবার একটা হতাশা গ্রাস করে সাইদুলকে। বারবার ভাবতে থাকে এরকম না করলেই ভালো হত। রূপসা হয়ত আমাকে খারাপ ই ভেবেছে। আর ওই নোংরা ছেলেটার কাছে রূপসাকে ছেড়ে চলে আসা সত্যি ই আমার উচিত হয়নি। হন্তদন্ত করে নিজের বাড়ির দিকে ছুটে যায় সাইদুল। দরজাটা ভেজানোই ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখে রূপসা চুপ করে খাটের ওপর বসে আছে। সাইদুল প্রথমে নিজের মাথাটা নিচু করে বেশ কিছুক্ষনের জন্য। তারপর রূপসার দিকে আবার তাকায়, রূপসার করুন মুখটা দেখে ওর খুব মায়া হয়। ধীরেধীরে সামনে এগিয়ে রূপসার পায়ের কাছে বসে পরে।
সাইদুলঃ রূপসা, তুমি রাগ করেছ আমার ওপর না? বিশ্বাস কর সোনা, আমি এরকম করতে চাইনি। কেন যে মাথাটা...
রূপসাঃ (মাঝপথে সাইদুলের কথা আটকে, মুখে কিছুটা স্ফীত হাঁসি নিয়ে এসে) তুমি কোনও ভুল করনি সোনা। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও হয়ত এটাই করত। কিন্তু কি করবে, মানুষকে তো নিজের ভবিতব্য মেনেই নিতে হবে।
রূপসার এই কথার মধ্যে যে কি ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে, তা সত্যি সাইদুলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। রূপসার দুগালে স্নেহের স্পর্শ দিয়ে সাইদুল হথাত ই ওর নিচের রসালো ঠোঁটটা নিজের মুখের মধ্যে পুরে নেয়। কিন্তু রূপসার একটা নিস্প্রীহ ভাব সাইদুলকে অবাক করে। যেন কোনও মৃতদেহের সাথে ও চুম্বন করছে। দ্রুত নিজের দুই ঠোঁট বার করে বলে ওঠে “কি হয়েছে রূপসা? তুমি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছে। সাইদুলের দুকাঁধ শক্ত করে ধরে ওর দুটি অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে রূপসা। সাইদুল পারেনা ওই দুই নয়নে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। এ রূপসা একদম অচেনা, মুখের সেই মিষ্টতা, দুষ্টুমি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, তার বদলে পরিনত শান্ত এক নারী।
রূপসাঃ সাইদুল তোমার কি এখনো আমায় আদর করতে ইচ্ছে করে। আমার মুখটা কি এখনো আগের মত মিষ্টি? একবার ও মনে হোলনা এই রূপসা সেই রূপসা নয়, যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে? আমায় কি এখনো তুমি ভালবাসতে পারবে সাইদুল? আমি তো হেরে গেছি, নিজের শরীরের লোভের কাছে পরাজিত হয়ে নিজেই নিজেকে হারিয়ে দিয়েছি।
সাইদুলের বুকটা কেঁপে ওঠে। এ কোন কথা বলছে রূপসা? কিসের এই বিরহ? সাইদুল কিছুই বোঝেনা, শুধু আবেগের বশে নিজের মুখটা আবার রূপসার দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। “না সাইদুল, আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। রূপসা কি এখনো তোমার কাছে সেই আগের ই মত?” কিছুই বুঝতে পারেনা সাইদুল শুধু বোকার মত হুম বলে একটা শব্দ করে। “ওহ সাইদুল, আমার সাইদুল” বলে রূপসা জড়িয়ে ধরে সাইদুলকে। নিজের নিচের ঠোঁটটা সাইদুলের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এই ১০ টা মিনিটের চরম মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সাইদুল ও পাগলের মত রূপসার ঠোঁটকে আস্বাদন করতে শুরু করে।
রূপসার ঠোঁটের কনা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মিষ্টি রস, সাইদুলের জিভ, ঠোঁট দুই ই পাগলের মত সেই মিষ্টি মধুকে আস্বাদন করতে শুরু করে। নিজের নাকটা দিয়ে রূপসার নাককে ভালো করে ঘষে দিয়ে সাইদুল গাল বরাবর চুমু খেতে খেতে গলায় নেমে আসে।
রূপসাঃ না সাইদুল এখন ই নয়। আজ যে আমাদের ফুলশয্যা এতো সহজে আমি নিজের স্মৃতিকে নষ্ট করে দিতে চাইনা। আগে খাওয়া দাওয়া হোক তুমি তোমার মনের মত করে বিছানাটা সাজাও তারপর আমি একদম নতুন বউ এর মত তোমার কাছে আসব।
সাইদুলঃ (মনের আনন্দে হেঁসে ওঠে সাইদুল) ঠিক আছে সোনা ঠিক আছে। আমি ফুল দিয়ে এমনভাবে বিছানাটা সাজিয়ে দেবো যে তুমি পাগল হয়ে যাবে।
রূপসা মুচকি হাঁসতে হাঁসতে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। সাইদুল বিছানার চাদরটা পালটে নতুন চাদর পেতে দেয়। বালিশের ওয়াড় পালটে নতুন ওয়াড় পড়িয়ে দেয়। প্যাকেট থেকে মুঠো করে ফুল বার করে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়। আর রয়ে যায় একটা রজনিগন্ধার মালা। ওটা হাতে নিয়ে চুপিসারে রান্নাঘরের দিকে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রূপসাকে। রূপসা হয়ত বুঝতেও পারেনি সাইদুল এভাবে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে। রূপসার ঘাড়ে মুখ গুঁজে হয়ত সাইদুল এটাই বলতে যাচ্ছিল “সোনা এই মালাটা তোমার জন্য” কিন্তু তার আগেই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে রূপসা। সাইদুল কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে লক্ষ্য করে সেই ক্ষতটায় ও মুখ দিয়ে দিয়েছে। রূপসার দুচোখ বেয়ে জল টপটপ করে বেয়ে চলেছে।
সাইদুলঃ সরি রূপসা, আমি আসলে বুঝতে পারিনি। কাল ই তোমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো সোনা।
পেছনঘুরে প্রচণ্ড করুনভাবে সাইদুলের দিকে তাকায় রূপসা। সাইদুলের বুকটা হথাত ই যন্ত্রণায় টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে। কোনও এক অশুভ ঘটনা যে ঘটতে চলেছে তা সাইদুল খুব ভালোভাবেই বুঝে যায়। সাইদুলের দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে রূপসা। ওর দুচোখ বেয়ে জল পড়েই চলেছে।
রূপসাঃ আমি তোমায় কখনো ভালবাসিনি সাইদুল। সত্যি কখনো ভালবাসিনি। আমাদের মধ্যে কখনো সম্পর্ক হতেই পারেনা। আমরা যে দুই ভিন্ন মেরুর। একটা মেয়ে এতো সহজে কাউকে নিজের হৃদয় দেয়না। এক রাতের মধ্যে যে আমি তোমার বাড়িতে এসে উথেছি এটাও আমার ভালোবাসা নয় সাইদুল। আজ সত্যি আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি সত্যি ই তোমায় কখনো একমুহূর্তের জন্য ও ভালবাসিনি।
নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারেনা সাইদুল। হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে রূপসার মুখের দিকে। অস্পষ্টভাবে সাইদুলের মুখ দিয়ে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে আসে “কি বলছ তুমি? তুমি আমার ওপর রাগ করেছ? আমি তো অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছি রূপসা” সাইদুলের কথাগুলো রূপসার কানে পৌঁছেছে কিনা জানিনা। তবে রূপসার পরবর্তী কথাগুলো সাইদুলের কানে ভীষণভাবে পৌঁছে যায়।
রূপসাঃ এটা গত মঙ্গলবারের কথা। আমি যে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি তা মা জানত না। কি কারনে জানিনা মা, বাইরের দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল। আমি ভেতরে ঢুকে যাই। ঘরের মধ্যে থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ আসছিল। জানলা ফাঁক করে অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায় মা ও রাজুদাকে দেখে ফেলেছিলাম। রাগে অপমানে আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল, মনে হয়েছিল বাবাকে তক্ষুনি ফোন করে সব বলি। আমি পাশের ঘরেই লুকিয়ে থাকি। কিছুক্ষন বাদে রাজু বেরিয়ে যায়। আমি মায়ের সামনে যাই। মা আমায় দেখে ভেঙে পড়ে। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “তুমি কেন এরকম করলে?” মায়ের উত্তর ছিল “রাজুর শরীরে জাদু আছে” সেদিন মায়ের ওই উত্তর আমার জীবনটাই পালটে দেয়। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে, রাতে বিছানায় প্রায় প্রতি মুহূর্তে আমি রাজুর ওই নগ্ন শরীরটা কল্পনা করতাম। রাজু ঠিক চুম্বকের মত আমায় তোমার কাছে টেনে আনল। সাইদুল, আমার পিঠের এই ক্ষতটা রাজুর ই দাঁতে সৃষ্টি হয়েছে।
সাইদুলের হাত কিছুতেই রূপসার ওই নরম গালে আছড়ে পড়তে পারলো না। ক্ষনিকের জন্য ও ওর মনে হয়েছিল রূপসার ওই নোংরা মুখটায় সজোরে একটা চড় মারতে। কিন্তু পারলনা, ও যে রূপসাকে ভালবেসেছিল। সাইদুল রূপসার কাঁধে মাথা দিয়ে নিজের কষ্টগুলো ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু বেচারা ছেলেটা জানত না, ভালোবাসা বিত্ত, জাত, ধর্মের ঘেরাটোপ ছাড়া কখনো বাইরে বেরোয় না। ভালোবাসা মাটির কুঁড়ে ঘরে কখনোই আসেনা। ভালোবাসা বড়লোকের প্রসাধনী সামগ্রী।
পরাজিত সৈনিক, অলস পদচালনায় টলতে টলতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়। রূপসা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাইদুলের দিকে।
দোকানে মাল ডেলিভারি করতে করতে প্রায় রাত ৮ টা বেজে যায়। এতো যে দেরি হবে তা সত্যি ই সাইদুল ভাবতে পারেনি। মনে মনে বলে ১ ঘণ্টা বলেছিলাম তার বদলে ৩ ঘণ্টা লেগেছে, কিন্তু রূপসার ও নিশ্চয়ই সেরকম কোনও অসুবিধা হয়নি। তারকারন রূপসার তো কোনও ফোন ই আসেনি। দোকানের শাটার টা জোরে নামিয়ে লক করে বাজারের মধ্যে দিয়ে সামনে এগোতে থাকে সাইদুল। কিছুটা গেলেই বাজারের মাঝে দুদিকে সার দিয়ে ফুলওয়ালিরা বসে। বেশ কিছু রজনীগন্ধার ও গোলাপের মালা কিনে নেয় সাইদুল। আর একটা কাজ পড়ে থাকে তা হোল বাজার করা। বাড়িতে প্রায় কিছুই পড়ে নেই। সবজি বাজারে গিয়ে রাতের রান্নার জন্য দরকারি সবজি কিনে নিয়ে বেরিয়ে আসে সাইদুল। হাসিহাসি মুখে বস্তির রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দুপুরের সব ঘটনা ওর মনে পড়ে যেতে শুরু করে। হাতের আঙ্গুলটায় একটা কামড় দিয়ে বলে ওঠে “ধুস শালা, কেন যে এতো উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম। প্রথম বারেই ক্লিন বোল্ড। আর রূপসাটাও ভীষণ বদমাশ। বারবার রাজুর নাম বলে আমায় রাগিয়ে দিচ্ছিল। আজ আর আমি ওর কোনও ফাঁদেই পা দেবনা” এইসব বিড়বিড় করতে করতে কখন যে সাইদুল নিজের বাড়ির সামনেই চলে এসেছে তা ওর খেয়াল ও নেই। দরজাটা ভেজানো আছে। সাইদুল একটু জোরে থেলা দেয়।
প্রায় ঘাবড়ে গিয়ে রূপসা খাটের ওপর থেকে দৌড়ে বাইরের উঠোনের দিকে চলে যায়। সাইদুল কিছুটা অবাক ই হয়ে যায়। হথাত রুপ্সা এতো ভয় কেন পেয়ে গেলো?
“রূপসা আমি সাইদুল, এতো ভয় কেন পেয়ে গেলে”
আবার উঠোন থেকে সামনের দিকে এগিয়ে আসে রূপসা। রূপসার মুখের সেই পুরনো দুষ্টু হাঁসিটা নেই। কালো মেঘের মত গুরুগম্ভীর ওই মুখটার দিকে তাকাতে সাইদুলের খুব ভয় করে। সাইদুল খুব অবাক হয়ে যায়, রূপসার হয়েছে টা কি।
সাইদুলঃ কি হয়েছে রূপসা? আমি দেরি করে এলাম বলে রাগ করেছ? আরে বলনা যে পার্টিকে মাল ডেলিভারি করার কথা তারা এতো দেরি করে এলো। সত্যি সময়জ্ঞান যদি মানুষের একটু থাকতো তো...
রূপসাঃ ঘরে তো শাকসবজি কিছুই নেই। রান্না করতে হবে তো? বাজার থেকে কিছু এনেছ তুমি?
সাইদুলঃ (সাইদুল গুটি গুটি পায়ে রূপসার দিকে এগিয়ে যায়, দুহাতে রূপসার মুখকে চেপে ধরে) কি হয়েছে সোনা। আমার ওপর রাগ করেছ না? আরে আমি কি করব...
রূপসা কোনও কথা না বলে রাজুর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরের দিকে যেতে শুরু করে। সাইদুলের ও মেজাজ কিছুটা বিগড়ে যায়।
সাইদুলঃ আরে এতে এতো রাগ করার কি আছে? আমি তো তোমায় বলে গেছিলাম। আর যদি একা থাকতে খারাপ ই লাগত তাহলে আমায় একবার ফোন করতে পারতে। আমি দোকানে কাউকে বসিয়ে চলে আসতাম।
রূপসা কোনও উত্তর দেয়না। হতাশ সাইদুল ও চুপ করে খাটের ওপর বসে যায়। প্রেমে তো পড়ে গেছে, প্রেমিকার মন ও জয় করেছে কিন্তু সাইদুল এটা বোঝেনা মেয়ে সামলানো এর চেয়ে অনেক অনেক কঠিন। প্রথম পরিচয়ের সেই আবেগগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আর টার বদলে ক্ষনে ক্ষনে শুধুই ভুল বোঝাবুঝির ঘনঘটা। মনে মনে ভাবে সাইদুল, একবার রূপসার কাছে যাই ওকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে। মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে রূপসা ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত কিছু বলতে যাচ্ছিল সাইদুল। কিন্তু শুকনো মুখে রূপসা বলে ওঠে
রূপসাঃ তুমি কাকে ভালোবাসো সাইদুল? মানুষ রূপসাকে? নাকি সুন্দর দেহের অধিকারী সদ্য অষ্টাদশী রূপসাকে?
কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় সাইদুল। ক্লাস ৮ পর্যন্ত পড়াশুনা শেখা এক ছেলে এতো কঠিন এক প্রশ্নের কি জবাব দেবে? কিন্তু এটাও সত্যি যে ভালবাসতে গেলে স্বাক্ষর হতে হয়না। হয়ত উত্তরটা সাইদুল নয় সাইদুলের হৃদয় ই দিয়েছিল।
সাইদুলঃ তুমি এতো সুন্দরী না হলেও আমি তোমায় ই ভালবাসতাম। তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা রূপসা। তোমায় আমি কখনোই ভুলতে পারবোনা।
নিজের দুহাত দিয়ে আলতো করে সাইদুলের দুগাল কে স্পর্শ করে রূপসা। রূপসার দুই নয়নে যেন হাজারো যন্ত্রণা কষ্ট ঠিকরে বেরিয়ে আসে।
রূপসাঃ তুমি সত্যি বলছ সাইদুল? আমার এই শরীরটা যদি কোনও ভুল করে তাহলে তুমি শরীরটাকে ক্ষমা করে দেবে তো? এটা বিশ্বাস করবে তো যে এই পাপটা আমার মন করেনি, শরীর করেছে।
অশিক্ষিত সাইদুল এর অর্থ কি বুঝল তা ওই জানে। কিন্তু ওর দুদিকে মাথা নাড়ানো যে রূপসার প্রশ্নের উত্তর তা রূপসা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে।
রুপ্সাঃ (মুখে আবার সেই পুরনো হাঁসিটা ফিরিয়ে এনে) তুমি সত্যি ই আমায় ভালোবাসো সাইদুল। দাঁড়াও আজ আমি তোমায় আলুপোস্ত করে খাওয়াবো। জানতো বাবাকে যতবার আমি আলুপোস্ত রেঁধে খাওয়াই বাবা ততবার ই আমায় একটা চকলেট গিফট করে।
সাইদুলঃ (প্রচণ্ড তৃপ্তিতে হেঁসে উঠে) আমি না বাজার থেকে ফুল আর ফুলের মালা এনেছি।
রূপসাঃ (কিছুটা ভেংচি কেটে) ওহ ছেলের ন্যাকামো দেখলে গা জ্বলে যায়। ওসব হবেনা। আগে বিয়ে হোক তারপর।
হাঁসতে হাঁসতে রূপসা আবার রান্নাঘরের দিকে যেতে শুরু করে। হথাত সাইদুল বলে ওঠে “রূপসা তোমার ঘাড়ে ওটা কিসের দাগ?” রূপসা থমকে দাঁড়ায়, মুখে সেই কালো মেঘের ঘনঘটাটা আবার ফিরে আসে। সাইদুল সামনে এগিয়ে যায়। “এটা তো কোনও পোকায় বা জন্তুতে কামড়ানোর ক্ষত। কি হয়েছে রূপসা”
রূপসাঃ আর বলনা, তোমার বাড়িতে যা ইঁদুরের উপদ্রব। বাথরুম এ গেছিলাম বুঝতেই পারিনি। হথাত একটা ইঁদুর কোথা থেকে কিজানি আমার ঘাড়ে এসে উঠল।
সাইদুলঃ ওষুধ লাগাতে হবে তো। আর একটা ইঞ্জেক্সান ও নিতে হবে।
রূপসাঃ ও কাল সকালে দেখা যাবে। আজ আগে রান্না করি।
সাইদুল ও আর বাধা দেয়না। রূপসার রান্না করতে বেশ কিছুক্ষন সময় লাগবে বলে সাইদুল বাইরে বেরোয়। রূপসার ভয়ে সেই কোন সকাল থেকে একটা বিড়িও মুখে দেওয়া হয়নি। হাসিহাসি মুখে বস্তির ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। রাস্তাতেই আব্দুল চাচার সাথে দেখা। আব্দুল চাচা ওর আব্বার পুরনো বন্ধু। দেখা হলেই আম্মির ব্যাপারে সংসারের ব্যাপারে হাজার গণ্ডা প্রশ্ন শুরু করে দেন। কিন্তু সাইদুল কখনো ওনাকে উপেক্ষা করতে পারেনা। যতই হোক ওর পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে কথা। আজও পারলনা প্রায় ১০ টা মিনিট সময় আব্দুল চাচাই নিয়ে নিল। আব্দুল চাচা চলে যাওয়ার পর দোকানের কাছে গিয়ে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দেয় সাইদুল। ভালো করে শেষ টান টা অবধি আয়েশ করে টেনে আবার বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে।
বাড়ির কাছে এসে দেখে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। সাইদুল তো কিছুটা অবাক ই হয়ে যায়। এতটুকু সময়ের জন্য ও বাইরে গেলো আর রূপসা দরজাটা লাগিয়ে দিলো? সাইদুল দু তিনবার দরজায় টোকা দেয় কিন্তু ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসেনা। জোরে চেঁচাতেও ভয় লাগে ওর, কারন তাহলে বস্তির সবার নজরে পড়ে যাবে। এবার বেশ ৩-৪ বার জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা মারে সাইদুল। তাও ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসেনা। ১ মিনিট মত অপেক্ষা করে আবার ধাক্কা দিতে যায় সাইদুল কিন্তু তার আগেই ভেতর থেকে দরজাটা খুলে যায়। ওকে প্রায় অবাক করে দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায় রাজু।
হ্যাঁ করে কিছুটা আশঙ্কা ও কিছুটা রাগে রাজুর মুখের দিকে তাকায় সাইদুল।
রাজুঃ কি রে সাইদুল, এভাবে দরজা খুলে রেখে কেউ চলে যায়। বস্তিতে যদি জানাজানি হয়ে যায় কম কেলেঙ্কারি হবে বল তো।
সাইদুল কোনও উত্তর দেয়না, হনহন করে ভেতরে ঢুকে যায়। খাটের কাছে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকায়। ওখানে নিরুত্তাপের সাথে রূপসা দাঁড়িয়ে রান্না করে চলেছে।
রাজুঃ আর কখনো এভাবে দরজা খুলে বাইরে চলে যাবিনা, ভাগ্যিস আমি দেখতে এসেছিলাম তোকে। রূপসা আমি চলি গো অনেক কাজ পড়ে আছে।
রূপসাঃ না একটু দাঁড়িয়েই যাও রাজুদা, আমি চা বসিয়েছি। চা খেয়ে যেও।
কথাটা বলার জন্য রূপসা অনেকটাই বাইরে বেরিয়ে এসে, রূপসার নজর সাইদুলের সাথে মেলে। কিন্তু রূপসা নিজের নজর সরিয়ে নেয়। মনেমনে বলতে থাকে সাইদুল কেন রূপসা নিজের নজর সরিয়ে নিল, ওর মুখটা কেন আবার আগের মত বিষণ্ণ হয়ে গেছে? রাজু এতক্ষন এখানে এসেছে, অথচ আমি ৪-৫ বার দরজায় ধাক্কা দিয়েছি ও খুলল না কেন? হাজারো প্রশ্ন সাইদুলের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। এর উত্তর হয়ত সঠিক সময়েই সাইদুল পেয়ে যাবে।
রাজুঃ কিরে আম্মিকে ছেড়ে দিয়ে এলি। আম্মি ঠিকথাক পৌঁছেছে কিনা একবারও খোঁজ নিয়েছিস? জানি নিসনি। তোকে আমি চিনিনা আবার।
সাইদুলের পক্ষে আর ধৈর্য পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিলনা। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলে ওঠে সাইদুল “তুই এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা”
ততক্ষনে রূপসাও সামনে এগিয়ে এসেছে। ক্ষোভে অপমানে রাজু থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দেয়। সাইদুলকে প্রচণ্ড অবাক করে রূপসা বলে ওঠে
রূপসাঃ না রাজুদা, আমি চা বানিয়েছি তুমি চা খেয়েই তারপর যেও।
প্রচণ্ড ক্রোধে সাইদুল রূপসার দিকে তাকায়। কিন্তু এবার আর আগের বারের মত রূপসা নিজের নজর সরিয়ে নেয়না। রূপসার দৃপ্ত চোখের দিকে সাইদুল তাকাতে পারেনা। লজ্জায় ও পরাজয়ের গ্লানিতে কিছুটা দৌড়েই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে আবার সেই সিগারেট দোকানের সামনেই এসে পৌছায়। নতুন একটা সিগারেট- ৫ টা মিনিট সময়, ৫ টা টাকা দুটোই অপচয় হয়। কিন্তু মাথাটাও ঠাণ্ডা হয় সাইদুলের। “রূপসা হয়ত ভদ্রতার খাতিরেই এইরকম ব্যাবহার করেছিল” আবার নিজের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে সাইদুল। মনের মধ্যে আবার একটা হতাশা গ্রাস করে সাইদুলকে। বারবার ভাবতে থাকে এরকম না করলেই ভালো হত। রূপসা হয়ত আমাকে খারাপ ই ভেবেছে। আর ওই নোংরা ছেলেটার কাছে রূপসাকে ছেড়ে চলে আসা সত্যি ই আমার উচিত হয়নি। হন্তদন্ত করে নিজের বাড়ির দিকে ছুটে যায় সাইদুল। দরজাটা ভেজানোই ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখে রূপসা চুপ করে খাটের ওপর বসে আছে। সাইদুল প্রথমে নিজের মাথাটা নিচু করে বেশ কিছুক্ষনের জন্য। তারপর রূপসার দিকে আবার তাকায়, রূপসার করুন মুখটা দেখে ওর খুব মায়া হয়। ধীরেধীরে সামনে এগিয়ে রূপসার পায়ের কাছে বসে পরে।
সাইদুলঃ রূপসা, তুমি রাগ করেছ আমার ওপর না? বিশ্বাস কর সোনা, আমি এরকম করতে চাইনি। কেন যে মাথাটা...
রূপসাঃ (মাঝপথে সাইদুলের কথা আটকে, মুখে কিছুটা স্ফীত হাঁসি নিয়ে এসে) তুমি কোনও ভুল করনি সোনা। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও হয়ত এটাই করত। কিন্তু কি করবে, মানুষকে তো নিজের ভবিতব্য মেনেই নিতে হবে।
রূপসার এই কথার মধ্যে যে কি ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে, তা সত্যি সাইদুলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। রূপসার দুগালে স্নেহের স্পর্শ দিয়ে সাইদুল হথাত ই ওর নিচের রসালো ঠোঁটটা নিজের মুখের মধ্যে পুরে নেয়। কিন্তু রূপসার একটা নিস্প্রীহ ভাব সাইদুলকে অবাক করে। যেন কোনও মৃতদেহের সাথে ও চুম্বন করছে। দ্রুত নিজের দুই ঠোঁট বার করে বলে ওঠে “কি হয়েছে রূপসা? তুমি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছে। সাইদুলের দুকাঁধ শক্ত করে ধরে ওর দুটি অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে রূপসা। সাইদুল পারেনা ওই দুই নয়নে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। এ রূপসা একদম অচেনা, মুখের সেই মিষ্টতা, দুষ্টুমি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, তার বদলে পরিনত শান্ত এক নারী।
রূপসাঃ সাইদুল তোমার কি এখনো আমায় আদর করতে ইচ্ছে করে। আমার মুখটা কি এখনো আগের মত মিষ্টি? একবার ও মনে হোলনা এই রূপসা সেই রূপসা নয়, যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে? আমায় কি এখনো তুমি ভালবাসতে পারবে সাইদুল? আমি তো হেরে গেছি, নিজের শরীরের লোভের কাছে পরাজিত হয়ে নিজেই নিজেকে হারিয়ে দিয়েছি।
সাইদুলের বুকটা কেঁপে ওঠে। এ কোন কথা বলছে রূপসা? কিসের এই বিরহ? সাইদুল কিছুই বোঝেনা, শুধু আবেগের বশে নিজের মুখটা আবার রূপসার দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। “না সাইদুল, আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। রূপসা কি এখনো তোমার কাছে সেই আগের ই মত?” কিছুই বুঝতে পারেনা সাইদুল শুধু বোকার মত হুম বলে একটা শব্দ করে। “ওহ সাইদুল, আমার সাইদুল” বলে রূপসা জড়িয়ে ধরে সাইদুলকে। নিজের নিচের ঠোঁটটা সাইদুলের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এই ১০ টা মিনিটের চরম মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সাইদুল ও পাগলের মত রূপসার ঠোঁটকে আস্বাদন করতে শুরু করে।
রূপসার ঠোঁটের কনা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মিষ্টি রস, সাইদুলের জিভ, ঠোঁট দুই ই পাগলের মত সেই মিষ্টি মধুকে আস্বাদন করতে শুরু করে। নিজের নাকটা দিয়ে রূপসার নাককে ভালো করে ঘষে দিয়ে সাইদুল গাল বরাবর চুমু খেতে খেতে গলায় নেমে আসে।
রূপসাঃ না সাইদুল এখন ই নয়। আজ যে আমাদের ফুলশয্যা এতো সহজে আমি নিজের স্মৃতিকে নষ্ট করে দিতে চাইনা। আগে খাওয়া দাওয়া হোক তুমি তোমার মনের মত করে বিছানাটা সাজাও তারপর আমি একদম নতুন বউ এর মত তোমার কাছে আসব।
সাইদুলঃ (মনের আনন্দে হেঁসে ওঠে সাইদুল) ঠিক আছে সোনা ঠিক আছে। আমি ফুল দিয়ে এমনভাবে বিছানাটা সাজিয়ে দেবো যে তুমি পাগল হয়ে যাবে।
রূপসা মুচকি হাঁসতে হাঁসতে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। সাইদুল বিছানার চাদরটা পালটে নতুন চাদর পেতে দেয়। বালিশের ওয়াড় পালটে নতুন ওয়াড় পড়িয়ে দেয়। প্যাকেট থেকে মুঠো করে ফুল বার করে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়। আর রয়ে যায় একটা রজনিগন্ধার মালা। ওটা হাতে নিয়ে চুপিসারে রান্নাঘরের দিকে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রূপসাকে। রূপসা হয়ত বুঝতেও পারেনি সাইদুল এভাবে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে। রূপসার ঘাড়ে মুখ গুঁজে হয়ত সাইদুল এটাই বলতে যাচ্ছিল “সোনা এই মালাটা তোমার জন্য” কিন্তু তার আগেই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে রূপসা। সাইদুল কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে লক্ষ্য করে সেই ক্ষতটায় ও মুখ দিয়ে দিয়েছে। রূপসার দুচোখ বেয়ে জল টপটপ করে বেয়ে চলেছে।
সাইদুলঃ সরি রূপসা, আমি আসলে বুঝতে পারিনি। কাল ই তোমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো সোনা।
পেছনঘুরে প্রচণ্ড করুনভাবে সাইদুলের দিকে তাকায় রূপসা। সাইদুলের বুকটা হথাত ই যন্ত্রণায় টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে। কোনও এক অশুভ ঘটনা যে ঘটতে চলেছে তা সাইদুল খুব ভালোভাবেই বুঝে যায়। সাইদুলের দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে রূপসা। ওর দুচোখ বেয়ে জল পড়েই চলেছে।
রূপসাঃ আমি তোমায় কখনো ভালবাসিনি সাইদুল। সত্যি কখনো ভালবাসিনি। আমাদের মধ্যে কখনো সম্পর্ক হতেই পারেনা। আমরা যে দুই ভিন্ন মেরুর। একটা মেয়ে এতো সহজে কাউকে নিজের হৃদয় দেয়না। এক রাতের মধ্যে যে আমি তোমার বাড়িতে এসে উথেছি এটাও আমার ভালোবাসা নয় সাইদুল। আজ সত্যি আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি সত্যি ই তোমায় কখনো একমুহূর্তের জন্য ও ভালবাসিনি।
নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারেনা সাইদুল। হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে রূপসার মুখের দিকে। অস্পষ্টভাবে সাইদুলের মুখ দিয়ে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে আসে “কি বলছ তুমি? তুমি আমার ওপর রাগ করেছ? আমি তো অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছি রূপসা” সাইদুলের কথাগুলো রূপসার কানে পৌঁছেছে কিনা জানিনা। তবে রূপসার পরবর্তী কথাগুলো সাইদুলের কানে ভীষণভাবে পৌঁছে যায়।
রূপসাঃ এটা গত মঙ্গলবারের কথা। আমি যে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি তা মা জানত না। কি কারনে জানিনা মা, বাইরের দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল। আমি ভেতরে ঢুকে যাই। ঘরের মধ্যে থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ আসছিল। জানলা ফাঁক করে অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায় মা ও রাজুদাকে দেখে ফেলেছিলাম। রাগে অপমানে আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল, মনে হয়েছিল বাবাকে তক্ষুনি ফোন করে সব বলি। আমি পাশের ঘরেই লুকিয়ে থাকি। কিছুক্ষন বাদে রাজু বেরিয়ে যায়। আমি মায়ের সামনে যাই। মা আমায় দেখে ভেঙে পড়ে। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “তুমি কেন এরকম করলে?” মায়ের উত্তর ছিল “রাজুর শরীরে জাদু আছে” সেদিন মায়ের ওই উত্তর আমার জীবনটাই পালটে দেয়। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে, রাতে বিছানায় প্রায় প্রতি মুহূর্তে আমি রাজুর ওই নগ্ন শরীরটা কল্পনা করতাম। রাজু ঠিক চুম্বকের মত আমায় তোমার কাছে টেনে আনল। সাইদুল, আমার পিঠের এই ক্ষতটা রাজুর ই দাঁতে সৃষ্টি হয়েছে।
সাইদুলের হাত কিছুতেই রূপসার ওই নরম গালে আছড়ে পড়তে পারলো না। ক্ষনিকের জন্য ও ওর মনে হয়েছিল রূপসার ওই নোংরা মুখটায় সজোরে একটা চড় মারতে। কিন্তু পারলনা, ও যে রূপসাকে ভালবেসেছিল। সাইদুল রূপসার কাঁধে মাথা দিয়ে নিজের কষ্টগুলো ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু বেচারা ছেলেটা জানত না, ভালোবাসা বিত্ত, জাত, ধর্মের ঘেরাটোপ ছাড়া কখনো বাইরে বেরোয় না। ভালোবাসা মাটির কুঁড়ে ঘরে কখনোই আসেনা। ভালোবাসা বড়লোকের প্রসাধনী সামগ্রী।
পরাজিত সৈনিক, অলস পদচালনায় টলতে টলতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়। রূপসা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাইদুলের দিকে।