28-11-2019, 01:44 PM
ওর জন্য আমি ভারতে ফিরে এসেছি আমার আসার ইচ্ছে ছিল না। ওর জন্য আমি এই কোম্পানি ছাড়ছি আমার ইচ্ছে ছিল না। এইটুকুই শুধু জেনে রাখ। আর না।‘ বলে পার্থ মুখ ঢেকে বসে রইল কিছুক্ষন। তারপর মুখ তুলে তাকাতে দেখলাম ওর চোখ লাল টকটকে জবার মত। কাঁদছিল। পার্থ কাঁদছিল। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু কোন কিছু আমাকে আটকে রাখছিল। কাকে সান্ত্বনা দেবো। সেই তো ঘুরে ফিরে থোড় বড়ি খারা আর খারা বড়ি থোড়। ঘুরে ফিরে সেই তনুই আসবে সামনে। অথচ কি চেহারাই না দেখিয়েছে ও। শেষে ব্ল্যাকমেল পর্যন্ত। না না কিছু বলা ঠিক হবে না ওদের সংসার নিয়ে। আমি শুধু বললাম, ‘দেখ পার্থ, এটা তোর বিবেচ্য বিষয়। তুই যত ভালো বুঝবি অন্য কেউ সেটা বুঝবে না। একটাই কথা বলতে পারি যেখানেই থাক ভালো থাকিস।‘ পার্থ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে, আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমার আবার ভালো থাকা। যাক গে, তোকে আর কাসুন্দি ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। চললাম দীপ। ভালো থাকিস। খুব সুন্দর সাইট চালিয়েছিস। আরও বড় হ।‘ না ও বলল মাঝে মধ্যে ফোন করিস না আমি বললাম মাঝে মাঝে ফোন করিস। ছেঁড়া পাতার মত আমাদের সম্পর্ক মাটিতে লুটোপুটি খেতে দেখলাম। পার্থ চলে যাবার পর আমি বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলাম, আজ একজন এখানে তো কাল ওখানে। এই ভাবে এই দুনিয়া চলে আসছে আর চলবেও। সম্পর্ক কারো সাথে বেশি দিন বাঁধা থাকে না। তাই যদি থাকতো তাহলে বিচ্ছেদ, বিরহ এই সব কথা বাংলা অভিধানে থাকতোই না, কিছুতেই না। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আমি ভারী পায়ে চলে এলাম আমার নিজের কেবিনে। সম্বিত ফিরল কাজী যখন খাবার কথা বলল। পার্থরা চলে গেছিল তারপরের দিনই। আমাকে কোন খবর পর্যন্ত দেয় নি। আমি যদিও জানতাম যে ওরা আজ চলে যাবে। কাজীই বলেছিল। মার্কেটে নাকি তনুর সাথে দেখা হয়েছিল। আমার কথা একবারও জিজ্ঞেস করে নি তনু কাজীর কাছে। শুধু বলেছিল ওরা যাচ্ছে, কাজী যেন ওদের না ভোলে। কিন্তু আমার মনটা কেন ভার সকাল থেকে? ওরা চলে গেল বলে? ওদের যাওয়াতে তো আমি খুশি হবোই। তনুর সাথে আর যে সঙ্গত করতে হবে না। স্নেহার মুখটা বড় চোখে ভাসছে। ইস, যদি একবার দেখতে পেতাম। ও হয়তো চেষ্টা করেছিল। ফোন করতেও চেয়েছিল হয়তো, মা দেয় নি সেই সুযোগ ওকে। খুব ভালো ছিল মেয়েটা। কেমন যেন নিজের মনে হতো। ও যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। আর কিই বা আমি ভাবতে পারি ওর জন্য? প্রায় একমাস বাদে অজয়ের কাছ থেকে খবর পেলাম ওরা আসামে রয়েছে। অজয়, ওরা চলে গেলেও, ও যায় নি। জয়া আর অজয় মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করতো। অজয় বলল কি এক কোম্পানিতে পার্থ ঢুকেছে একজন প্রোজেক্ট ম্যানেজার হয়ে। যাক এইবার তনু হয়তো বলতে পারবে দেখ তুই প্রোজেক্ট ম্যানেজার ছিলি এবার পার্থও একজন প্রোজেক্ট ম্যানেজার। হাসলাম মনে মনে। কি হিংসে করতো তনু আমি ইন চার্জ ছিলাম বলে, একা গাড়ী চরতাম বলে। কিন্তু না পার্থ আমায় ফোন করেছে না তনু। তনুর কাছ থেকে তো আশাই করি না। পার্থর কাছে আশা করেছিলাম। আমি তো ফোন করতে পারতাম না ওদের নতুন মোবাইল নাম্বার জানতাম না বলে কিন্তু আমার নাম্বার তো চেঞ্জ হয় নি। পার্থ তো করলেও করতে পারতো। কে জানে ও তো তনুর কথা ছাড়া দু পা হাঁটে না। সাহস হয় নি হয়তো তনু বারন করাতে। আস্তে আস্তে ওদের ছবি আবছা হয়ে আসতে শুরু করলো। তাড়াতাড়িই, কারন তনুর সেই ঘটনা তখনো মনের মধ্যে উঁকি মারত আর আমি চমকে উঠতাম এই ভেবে কি সর্বনাশ রাত ছিল সেদিন। অজয় চলে গেছে ট্র্যান্সফার হয়ে। ওদের খবর দেবার আর কেউ নেই। এই সব মিলে ভুলে যাবার সময় আরও নিকটে আসতে শুরু করেছিল। স্নেহার সেই রাতগুলোর কথা আমার আর মনে পরে না, কিন্তু ওর হাসি, ওর খুশি সব মনে পরে। কি খুশিই হতো যখন ও আমাকে দেখত। কিভাবে আমার হাত থেকে ল্যাপটপ কেড়ে নিতো। বছর খানেক পরে হঠাৎ অজানা নাম্বারে আমার কাছে ফোন এলো। তুলতেই শুনি স্নেহা, ‘হাই ডি, কেমন আছো?’ মনটা যেন কেমন হু হু করে উঠলো ওর গলা শুনে। সত্যি ওর গলা তো? আমি বললাম, ‘কে রে, স্নেহা বলছিস নাকি?’ স্নেহা হেসে বলে উঠলো, ‘বাব্বা, এই কয়েকদিনেই ভুলে গেলে আমাকে, আমার গলাকে? আমি কিন্তু তোমাকে ভুলি নি।‘ প্রথমেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই কোথা থেকে ফোন করছিস? তোর মা জানবে না তো?’ স্নেহা আমাকে থামিয়ে বলল, ‘আরে নারে বাবা। আমি মায়ের থেকে দূরে।‘ আমার কেমন যেন খটকা লাগলো, ‘মায়ের থেকে দূরে মানে? তুই কোথায়?’ স্নেহা ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমাতে বলে উঠলো, ‘উফফ, তোমায় নিয়ে আর পারা যায় না। সেই বাচ্চাই রয়ে গেলে বয়স বাড়লেও। মায়ের থেকে দূরে মানে একটা কলেজে পড়াই আমি। সেইখান থেকে ফোন করছি। মা থাকলে থোরি করতে পারতাম। তোমাকে ফোন করতে পারি নি বলে তুমি আমাকে ভুল বোঝো নিতো ডি?’ আমি বলে উঠলাম, ‘নারে, একদম না। আমি তো জানি তোর অবস্থা কি। কষ্ট হয়েছিল তোকে শেষ দেখতে পেলাম না।‘ স্নেহা তক্ষুনি বলে উঠলো, ‘আরে শেষ দেখা কি বলছ? এরই মধ্যে আমাকে মেরে ফেলতে চাও নাকি? শোন, একটা খবর তোমাকে দিচ্ছি। আর দুমাস বাদে আমার বিয়ে। ছেলে দেখে ফেলেছে মা বাবা। আমার তো ইচ্ছে ছিল তুমি দেখ। কিন্তু সেটা সম্ভব হোল না। তোমাকে পাবো কোথায়? তাই তুমি আমার বিয়েতে এসে আমাকে আশীর্বাদ দেবে। আর তোমার আসা চাই। আমি চাই তোমার সামনে আমার বিয়ে হোক। তোমাকে অর্কুটে ঠিকানা পাঠিয়ে দেবো। আর কোথায় বিয়ে জানো। তোমার ঘরের আসে পাশে।‘ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আশে পাশে মানে? কোথায়?’ স্নেহা বলল, ‘উহু, এখন না। বিয়েতে এলে তবেই বলবো।‘ আমি মজা করলাম, ‘কিন্তু ছেলে তো দেখলি, ছেলের ওটা দেখেছিস?’ স্নেহা হেসে উঠলো, ‘আবার অসভ্যতামো। তুমি আর শুধরাবে না।‘ আমি হেসে বললাম, ‘তোর সাথে তো হবেই না। প্রশ্নই নেই। আরও বরং অসভ্য হবো আমি।‘ স্নেহা আমাকে থামিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। বিয়ের দিন তুমি এসে ওরটা দেখে নিও আর ওকে শিখিয়ে দিও বউয়ের সাথে রাতে কি কি করতে হয়।‘ হাসতে লাগলো আমার প্রিয় স্নেহা খিলখিল করে। এইজন্য ওকে আমার এতো ভালো লাগে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেটার সাথে কথা টথা বলিস?’ স্নেহা জবাব দিল, ‘বলি মানে? ওর তো রোজ রাতে কথা না বললে নাকি ঘুম হয় না। দেখ এখনি এই পরে কি হবে কে জানে?’ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘স্মার্ট?’ স্নেহা যেন নিরাশ হয়ে জবাব দিলো, ‘কে জানে আমার ডি এর মত স্মার্ট হবে কিনা? তবে জানো তোমার মত লম্বা। কেমন চয়েস বোলো?’ আমি উত্তর দিলাম হেসে, ‘তোর থোরি চয়েস? তোর মা বাবার চয়েস।‘ সঙ্গে সঙ্গে স্নেহার উত্তর, ‘আমি হ্যাঁ না করলে মা বাবা থোরি ওকে বিয়ে করবে? সত্যি কথা বলবো ডি, আমি কিন্তু ওর লম্বা দেখে চয়েস করেছি। আমি আর অন্য কিচ্ছু দেখি নি। দেখে প্রথমেই মনে হয়েছে আমার ডি এর মত লম্বা।‘ আমি মজা করলাম আবার, ‘কিন্তু লম্বা হলে অনেক অসুবিধে যে।‘ স্নেহা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? কিসের অসুবিধে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘পাশাপাশি শুলে ওরটা তোর ঠ্যাঙে ঠেকবে।‘ স্নেহা জবাব দিলো, ‘আবার দুষ্টুমি করে? কেন তোমারটা পায়ে ঠেকেছিল বদমাশ একটা। খুব হিংসে হচ্ছে না?’ আমি বললাম, ‘তাতো হচ্ছেই। কিন্তু তোরা খুব সুখে থাক,......’ বন্ধ করে দিলো স্নেহা আমাকে। বলল, ‘না এখন নয়। আমার বিয়েতে এসে।‘ আরও কিছু কথা বলে স্নেহা রেখে দিলো ফোন। অর্কুটে স্নেহা ঠিকানা পাঠিয়েছিল। একসময় বিয়েও হয়ে গেল স্নেহার। আমার পক্ষে আর যাওয়া হয় নি। যেতে পারতাম কিনা জানি না কিন্তু তখন আমাকে কোম্পানির কাজে রাজস্থান চলে যেতে হয়েছিল প্রায় একমাস। ফিরে যখন এলাম তখন স্নেহার বিয়ে টিয়ে সব শেষ। সেই শেষ। আর স্নেহা ফোন করে নি। জানি আমি রাগে করে না। তনুরই তো মেয়ে। জেদ তো সমান হবেই। আমিও আর জানতে পারিনি ওরা কেমন আছে। আমি মনের থেকে এটা ঠিক জানতে পেরেছিলাম আমাকে বিয়েতে না পেয়ে স্নেহা খুশি হয় নি। ওর যে আমাকে দেখার খুব সখ ছিল। ওর বরকে দেখানোর সখ ছিল তার থেকে বেশি। জানি না স্নেহা আর স্নেহার বর কোথায় আছে, জানি না পার্থ আর তনু কোথায় আছে। একটা কথা জানি ওরা ছিল আমার জীবনে এতদিন গোপন আস্তানায়। আর ধরে না রাখতে পেরে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়েছি। এখন এটা আর গোপন নেই, সবার মধ্যে ছড়িয়ে রইল।
THE END
THE END