26-11-2019, 05:49 PM
বিয়ের দশ-মাসের মধ্যেই বিধবা ময়না বাপের বাড়ি ফিরে আসে মুখ নীচু করে। অভিমানী দাদামশাই তখন তাকে এনে স্থাপিত করেন এই উইডো-পাড়ায়। সেই থেকে এখানে একা তপস্যিনীর মতো মুখ-বুজে দিন কাটাচ্ছিল ছাব্বিশের ভরা-যুবতী ময়না।… এদিকে বাপ-মায়ের অকাল-মৃত্যুর শোকে সমুও কেমন-যেন বিহ্বল, নির্বাক হয়ে যায়। সেইসময় সে প্রায়ই ঘন-ঘন অজ্ঞান হয়ে যেত। সপ্তা-দুয়েক হাসপাতালে কাটানোর পর, সমুর বাক্-শক্তি সাময়িকভাবে রূদ্ধ হয়ে যায়। সমুর বাবার দিকে আত্মীয়স্বজন তেমন-কেউ নেই। তাই ডাক্তার দাদামশাইকে বললেন: “সাংঘাতিক মেন্টাল-ট্রমায় ওর এমনটা ঘটেছে। ওকে একদম আলাদা কোনো পরিবেশে নিয়ে গিয়ে রাখুন। আস্তে-আস্তে দেখবেন, আবার সব নর্মাল হয়ে যাবে।…” দাদামশাই তখন সমুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সাতজেলিয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু দিদিমা তাকে দেখে কান্নাকাটি করাতে, সমু আবারও অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। তখন দাদামশাই সবদিক বিবেচনা করে সমুকে মাসি’র এখানে পাঠিয়ে দেন।…
এখন সমু আগের থেকে অনেকটা রি-কভার করতে পেরেছে নিজেকে। যদিও কথা এখনও সে যথেষ্ট কমই বলে। মাসি যত্ন সহকারে তার সবকিছুই দেখাশোনা করে। অথচ সমুকে জোর করে আপন করবার, বা কথা বলানোর চেষ্টা মাসি কখনও করেনি। এই স্বাভাবিকতাটুকুই সমুকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহয্য করেছে বেশী। সে আরেকটু সুস্থ হলেই সামনের বছর মোল্লাখালি-হাইকলেজে ভর্তি হবে; তেমনটাই ইচ্ছে গৌরচন্দ্রের।
শোক কারও দীর্ঘদিনের সঙ্গী হতে পারে না। একই দুঃখের স্মৃতি রোজ-রোজ ভাবলে সেটা একঘেয়ে হয়ে যায়। তাই সমুর মনে এখন আর সেই দগ্ধ-পোড়া মৃতদেহগুলোর বিকট স্মৃতি ততোটাও পীড়া দেয় না, যতটা প্রথম-প্রথম দিত। বাবা-মা’র না-থাকার সত্যিটা সমু এখন অনেকটাই হজম করে ফেলেছে। উল্টোদিকে ময়নার মনেও রাকেশ নামক সেই বুকে ঝড় তোলা প্রেমিকটির অকাল-মৃত্যুর কষ্ট এখন অনেকটাই প্রশমিত। জীবনে অভিজ্ঞতা নামক ঝড়-ঝাপটার সাক্ষী হয়ে, সে আজ অনেক-বেশী স্থিতধী ও ম্যাচিওর্ড। পান থেকে চুন খসলেই, সে আর এখন বাচ্চা-মেয়ের মতো বুক চাপড়ে কাঁদতে বসে না।
কাপড়-জামাগুলো মেলে দিয়ে মাসি ঘরে ঢুকে গেল। এখন বেলা তিনটে বাজে। মাসি এখন একটু গড়িয়ে নেবে। তারপর সাড়ে-পাঁচটার সময় হাত-মুখ ধুয়ে এসে, ভিজে-কাপড়েই সন্ধে দেবে তুলসী-মঞ্চের গোড়ায়। এই মাস-তিনেকে এসব প্রাত্যহিক রুটিনগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে সমুর। সে জানে, ভিজে কাপড়ে মাসি যখন সন্ধে দেয়, তখন মাসির পরণে ওই ফিনফিনে শাড়িটার ভীতর আর কোনো সায়া-ব্লাউজ কিচ্ছু থাকে না। মাসির সরু কোমড়ের নীচে উপচে পড়া উপত্যকার গায়ে লেপ্টে থাকে অসহায় শাড়িটা। মাসি নীচু হয়ে প্রদীপ জ্বালে যখন, তখন সিক্ত চুলগুলো বুকের খাঁজ গলে… সমু তখন নিজের ভিতর একটা অদম্য কাঠিন্য-দৃঢ়তা টের পায়। ফাগুণ-দুপুরের তপ্ত ধুলোয় তার বুক থেকে উঠে আসে একটা নিদারুণ দীর্ঘশ্বাস। এ দীর্ঘশ্বাস কোনো অতীত-শোকের জন্য নয়! এ তপ্ত-শ্বাসের ব্যাখ্যা হয়তো জানে ওই দক্ষিণের ঘন বনানী; যেখানে সবকিছুই নগ্ন, খোলা ও প্রাকৃতিক! যেখানে মানুষর সংযম-নিয়ম খাটে না; খাটে কেবল খুল্লামখুল্লা জঙ্গলের কানুন!...