22-01-2019, 10:48 AM
পর্ব ১১- রহস্যময়ীঃ
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু ভেবে দেখুন সাইদুলের জবানবন্দিতে কিছু পুরনো ঘটনা শুনতে শুনতেই আমরা সুপ্রতীকের গল্পে চলে গিয়েছিলাম। কেনই বা সুপ্রতীক, মালা, বংশী, সিলিং সাহেব এই গল্পের মাঝে হথাত করেই উদয় হয়ে গেলেন তা একদম শেষে আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলব, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা চলে যাবো সাইদুলের সেই ভাবনায়। রূপসার কলেজ থেকে ফিরে এসে সাইদুল ও রাজুর মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং কিছু আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আসলে যতই কামুক হোক যতই নষ্ট ছেলে হোক ওরা, আসলে তো আপনার গল্পে খলনায়ক ওরা ছিলনা, খলনায়ক একজন ই তিনি আর কেউ নয় স্বয়ং মানব বাবু। একটা কথা প্রচণ্ড সত্যি রাজুর তিলোত্তমার প্রতি যে ভালোবাসা বিন্দু বিন্দু আকারে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়েছিল তার মধ্যে সামান্য কোনও ভেজাল ছিলনা। রাজুর মত এক পাষণ্ডের পাষাণ হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চার তো তিলোত্তমা করেই দিয়েছিল, কিন্তু সেই হৃদয়কে ভেঙে খান খান শুধু আপনি ই করেছেন। যাই হোক সত্যি হয়ত রাজুর আপনার ওপর কোনও ক্রোধ ই ছিলনা। কিন্তু এটাও সত্যি রাজুর হৃদয় থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গিয়ে জন্ম নেয় এক শত্রুতার, আপনার পরিবারের কিছু ক্ষতি করার জিঘাংসার। আর সেই জিঘাংসায় আগুন জ্বালিয়ে দেন আপনি নিজেই, আর সাথে কিছুটা মানবের উসকানি। যাই হোক আমরা চলে যাই আবার সাইদুলের কাছে।
সাইদুলের আম্মির পরের দিন দেশের বাড়ি যাওয়ার কথা, এদিকে ও আবার রূপসাকেও নিজের বাড়িতে আমন্ত্রন জানিয়ে ফেলেছে। ও জানে রূপসা ঠিক ই আসবে, কারন ওর ই মত রূপসাও ওকে প্রচুর ভালোবাসে। কিন্তু মনের মানুষকে নিজের দরিদ্র রাজপ্রাসাদে দেখতে পাওয়ার আনন্দকেও ছাপিয়ে যায় কিছু আশঙ্কা। যে আশঙ্কাগুলো সাইদুলের বুকে ধারালো তরোয়ালের মত বিদ্ধ হচ্ছিল। মালতী দেবীকে রাজুর আর সাইদুলের একসাথে ভোগ করা, সাইদুলের পরিবার ও রূপসার পরিবারের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার চরম বৈষম্য, রাজুর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা এবং আরও অনেককিছু। মালতী দেবী কি ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারলে রূপসাকে কিছুই বলবেন না? রূপসা কি মালতী দেবীর সমস্ত কথা বিশ্বাস করবে? রাজু কি এতো সহজে ওকে ছেড়ে দেবে, কারন তিলোত্তমার হৃদয় না পাওয়ার জ্বালা ওকে প্রতি মুহূর্তে কুড়ে কুড়ে খায়? হাজারো প্রশ্ন সাইদুলের মস্তিস্কে কিলবিল করতে শুরু করে। বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম কিছুতেই আসেনা। পাশে পড়ে থাকা মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখে প্রায় ১ টা বেজে গেছে। জোর করে চোখটা বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করে কারন কাল ওকে অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। হথাত ওকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে। আবার ফোনটা হাতে নিয়ে সাইদুল দেখে এটা রূপসার ফোন। এতো রাতে রূপসার ফোন কেন এই ভাবতে ভাবতেই সাইদুল ফোনটা রিসিভ করে।
সাইদুলঃ হ্যালো, রূপসা কি হয়েছে ঘুম আসছেনা বুঝি?
রুপসাঃ না ঘুম আসছেনা। তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব তোমায়?
সাইদুলঃ হ্যাঁ হ্যাঁ বলই না কি বলবে।
রূপসাঃ আচ্ছা তোমার বন্ধু রাজু ও কেমন গো? অনেকবার তো তোমায় আর রাজুকে একসাথেই দেখেছি। ছেলেটার বডিটা খুব্ব সুন্দর। উম সাইদুল তুমি আবার রাগ করছ না তো তোমাকে তোমার বন্ধুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি এতো সুখ্যাতি করছি সেজন্য।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে সাইদুল। রূপসা যে ওকে হথাত রাজুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে তা ভ্রুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সাইদুল। সাইদুলের কিছুটা ভয় লাগতে শুরু করে। রাজুর তো এই পাড়ায় খুব বদনাম, রূপসা আবার বাজে কিছু শোনেনি তো রাজুর ব্যাপারে। মনে মনে বলে “শালা কি করতে যে এরকম একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম, একের পর এক প্রবলেম” সাইদুল কিছু বলে ওঠার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে রূপসা বলে ওঠে
রূপসাঃ তখন আমারা কলেজে পড়তাম। আমার এক বান্ধবী ছিল রিয়া। ওই প্রথম আমাকে রাজুদাকে দেখায়। একটা লাল টিশার্ট পড়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল কলেজের পাস দিয়ে। কলেজের মেয়েরা তো ওকে দেখার জন্য প্রায় হুড়োহুড়ি করতে শুরু করে দিয়েছিল। আমি ওদের দেখাদেখি পেছন পেছন গেছিলাম। সত্যি যেকোনো মেয়েই পাগল হয়ে যাবে ওকে দেখে। উফ কি বডি। তুমি তো ওর বন্ধু তুমি কি ওর মত একটু বডি বানাতে পারনা। রোগাটে গড়ন আমার একদম পছন্দ নয়।
সাইদুলের মাথায় এমনিতেই দুশ্চিন্তার শেষ ছিলনা তার ওপর রূপসার এই অদ্ভুত ধরনের আচরন। হথাত করেই সাইদুলের মাথাটা গরম হয়ে যায়।
সাইদুলঃ রাজু আমার খুব ভালো বন্ধু, আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকিনা। কিন্তু ওর এতো ভালো বন্ধু হয়েও বলছি, ও ভালো শুধুই বন্ধু হিসেবে। মেয়েদেরকে ও কি চোখে দেখে তা শুধু আমি ই জানি। আর আমিও সত্যি বুঝে পাইনা মেয়েরা কেন এই ধরনের ছেলেকে বেশি পছন্দ করে। ভালো ছেলে পৃথিবীতে কত আছে অথচ...
রূপসাঃ এবাবা সাইদুল তুমি এরকম বাচ্চাদের মত রাগ করছ কেন সোনা। শোন না প্লিস আমার কথাটা, আমি যা বলেছি তুমি তা বুঝতে পারনি। আমার না ঘুম আসছে না, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না শোনা। জানো কাল তোমার বাড়িতে আসব আমার শরীরে এখন থেকেই উত্তেজনা হচ্ছে। সাইদুল তোমার ঠোঁটদুটো বিশাল মিষ্টি, তুমি জানো আমি না একটা রাক্ষসী, কখনো পুরুষের স্পর্শ পাইনি। তুমি আমায় রক্তের স্বাদ দিয়েছ। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু একটা পচা স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এই বিচ্ছিরি স্বপ্নটা আমি কলেজেও দেখেছিলাম। তাই তো রাজুর কথা বললাম।
সাইদুলঃ স্বপ্ন? কি স্বপ্ন? আর হথাত করে আমায় রাজুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছ কেন? রাজু আমার বন্ধু। কিন্তু ও বস্তির ছেলে, ভীষণ বাজে একটা ছেলে আমি ওকে তোমার সামনে আনব না। ও একটা নোংরা ইতর ছেলে।
রূপসাঃ তুমিও তো বস্তির ছেলে, কিন্তু তুমি কত ভালো। রাজুও ভালো তুমি ওকে ভুল ভেবেছ।
সাইদুলঃ দেখো রূপসা, আমি তোমায় স্পষ্টভাবে বলছি, আজ আমার আর রাজুর খুব ঝগড়া হয়েছে। তুমি আমার জীবনে এসেছ আমি সব অতীতের ঘটনাকে এমনকি রাজুকেও ভুলতে চাই। এই বস্তিতে আমি থাকতে চাইনা। প্রচুর পরিশ্রম করব টাকা জমাবো আর তোমাদের মত পাকা বাড়িতে থাকবো। তারপর আমাদের বিয়ে হবে। আমি তোমার সাথে ঘর বেঁধে সুখি হতে চাই রূপসা।
রূপসাঃ আমিও তো তাই চাই সাইদুল। আমায় ভুল বুঝনা আমি রাজুর নাম তোমার সামনে ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে একটা পুরনো দুষ্টু স্বপ্ন কেমন করে কিজানি আমার জীবনে আবার ফিরে এলো। আর তোমায় না বললে কাকে বলব সোনা। তুমি ই তো আমার সব। আসলে রাজুর জন্য ক্লাসের বাকি মেয়েরা পাগল ছিল, ওদের কথা শুনতে শুনতে আমার ও কেমন একটা রাজুর ব্যাপারে আগ্রহ জন্মায়। ব্যাস এতটুকুই।
অনেকক্ষণ নিজের ধৈর্য পরীক্ষা দিয়েছে সাইদুল। আর পারেনা নিজেকে ঠিক রাখতে।
সাইদুলঃ দেখো রূপসা, তোমার যদি রাজুর মত ছেলেদের পছন্দ হয় তাহলে এটা খুব সত্যি যে আমাকে তোমার কখনোই পছন্দ হবেনা আর আমাকে ভালো ও বাসতে পারবে না তুমি। তুমি ভালো থেকো আমি ফোনটা রাখি।
মুহূর্তের মধ্যে ফোনটা কেটে দেয় সাইদুল। সাইদুলের কপাল দিয়ে তিরতির করে ঘাম ঝরে পড়তে থাকে। এ কোন রূপসা, যাকে কয়েকটা মুহূর্ত আগে নিজের হৃদয় উজাড় করে দিয়ে এসেছিল সেই রূপসা? সেই রূপসা তো এরকম হতে পারেনা। রূপসাই তো ওকে বলেছে যে সাইদুলের জন্য ও নিজের প্রাণটাও দিতে পারে। নিজের ই মনে তৈরি হওয়া বিপরীতমুখী একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে যেতে থাকে সাইদুল। কেন বারবার রূপসা রাজুর নাম ওর কাছে করছিল। ওর কথার মধ্যে কি কোনও যৌন ইঙ্গিত রয়েছে নাকি শুধুই ওর সাথে নেহাত ই ইয়ার্কি করার জন্য এরকম বলল। একটার পর একটা মিনিট অতিক্রান্ত হয়। সাইদুল ও শান্ত হয় ধীরে ধীরে। যতই হোক ভালোবাসা বলে কথা। মনে মনে বলে সাইদুল ওর এভাবে সত্যি ই ফোন টা কেটে দেওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এখনো কেন রূপসার কোনও ফোন এলনা? এবার সাইদুলের চিন্তা হতে শুরু করে। তাহলে কি রূপসা ওর সাথে মশকরা করছিল? সাইদুলের এভাবে রেগে যাওয়ায় কি রূপসা কষ্ট পেলো?
ফোনটা হাতে নিয়ে রূপসার নাম্বারে আবার ডায়াল করে সাইদুল, কিন্তু নাম্বার ব্যাস্ত। এতরাতে কারসাথে কথা বলছে রূপসা? সাইদুল জানে এতো রাতে নিশ্চয়ই রূপসা নিজের বাবা মার সাথে কথা বলবে না, কোনও বান্ধবীর সাথে কথা বলছে হয়ত। ২-৩ মিনিট অপেক্ষা করে আবার ফোন করে রূপসাকে। আবার নাম্বার ব্যস্ত। রূপসা কার সাথে কথা বলছে এই ভাবতে ভাবতে সাইদুলের চিন্তায় মনটা উথাল পাথাল হয়ে যেতে থাকে। প্রায় ১-২ মিনিট ছাড়া ছাড়াই চেষ্টা করে যায় সাইদুল কিন্তু প্রতিবার একি কথা ব্যাস্ত। হাজারো দুশ্চিন্তায় সাইদুলের মাথা ধরে যায়, আসলে সারাদিনে ধকল তো কম যায়নি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেও খেয়াল করেনি। ঘুম ভাঙ্গে ফোনের আওয়াজে। হাতে ফোনটা নিয়ে দেখে রূপসার ফোন, রাত প্রায় দেড়টা বেজে গেছে। চরম ক্লান্তির সাথে সাইদুল ফোন টা রিসিভ করে।
সাইদুলঃ এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিলে? কখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তোমার এই ব্যাবহারটা আমার একদম ভালো লাগলো না রূপসা। তুমি জাননা আজ সারাদিনে থিক কি পরিমান কষ্ট আমার হয়েছে?
রূপসাঃ (কিছুটা ধরা ধরা গলায়) তুমি ভীষণ পচা ছেলে। তুমি কিছুই বুঝলে না কেন হথাত এই মাঝ রাতে আমি তোমায় ফোন করতে গেলাম। তুমি কি ভাবলে আমি অন্য ছেলের... না থাক, আমার আর আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না সাইদুল। গুড নাইট।
হথাত ফোনটা কেটে দিলো রূপসা। রূপসার কান্নাভেজা কণ্ঠ তখনও সাইদুলের কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বারবার নিজেকে দোষারোপ করে সাইদুল। মনের মানুষকে কাঁদিয়ে দেওয়া, কষ্ট দেওয়া এযে এক প্রেমিকের কাছে ঠিক কতবড় শাস্তি তা শুধু একজন পুরুষ ই বোঝেন। মনে মনে একবার বলে ওঠে সাইদুল “শালা সত্যি ই আমি বস্তির ছেলে মাথায় সবসময় আজেবাজে চিন্তা ঘোরে, ও হয়ত কিছু অন্য বলতে যাচ্ছিল বুঝলাম আলাদা কিছু, শালা সত্যি বদ ছেলেগুলোর সাথে মিশে মিশে আমার ও মাথা খারাপ হয়ে গেছে”
হাতে মোবাইলটা নিয়ে রূপসার নাম্বারে ডায়াল করে সাইদুল। একবার রিং হওয়ার পর ই রূপসা কেটে দেয়। সাইদুলের মাথা খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে বলে “শালা বিশাল ভুল করে ফেলেছি, ইস কেন যে বললাম এরকম, আমি সত্যি ই ফালতু একটা ছেলে” বারবার চেষ্টা করতে থাকে সাইদুল কিন্তু ফলাফল ওই একি। একবার রিং হওয়ার পর ই ফোনটা কেটে দেয় রূপসা। হাতের আঙুলগুলো মুখে পুড়ে কামরাতে থাকে সাইদুল, বিড়বিড় করে বলে ওঠে “আরে রূপসা প্লিস প্লিস প্লিস একটিবার আমায় কিছু একটা বলার সুযোগ দাও” প্রায় ১০ মিনিট লাগাতার সাইদুল রূপসার মোবাইলে চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু রূপসা বারবার ফোনটা কেটে দেয়। হতাশায় ক্লান্তিতে চোখদুটো বুজে নেয় সাইদুল। হথাত ই মোবাইলটা বেজে ওঠে, কোনওকিছু না বুঝেই সাইদুল ফোনটা রিসিভ করে বলে ওঠে
“আমায় ক্ষমা করে দাও রূপসা, আমি তোমায় ভুল বুঝিনি। আসলে সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম হয়ত তাই এরকম উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি, প্লিস একটু আমার কথাটা শোন তুমি, প্লিস ফোনটা কেটোনা”
“কিরে বাল কি আলবাল কথা বলে যাচ্ছিস। ঘুমিয়ে গেছিস কিনা দেখার জন্য ফোন করলাম। একবার বাইরে আয়না একটু কথা বলব। একটাবার আয় আজ তোর সাথে এতো ঝগড়া করলাম তাই আমারও ঘুম আসছেনা”
ঠিক এই কথাটা এই মুহূর্তে সাইদুল শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। এই মুহূর্তেই একবার রূপসার সাথে কথা বলা খুব দরকার, অথচ রাজুর ফোন, না বলেও উপায় নেই। সাইদুল মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয় “ঠিক আছে বাইরে দাঁড়া আমি আসছি” ধীরে ধীরে উঠে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোয় সাইদুল। কিছুটা দুরেই রাজু দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরের চাতানটায় গিয়ে বসে সাইদুল, রাজুও ওর দিকে এগিয়ে আসে। “নে বিড়ি খা” সাইদুলের দিকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে দেয় রাজু। দুজনেই দুটো বিড়ি জ্বালিয়ে চুপ করে বসে থাকে। প্রায় ১ টা মিনিট কারুর মুখ দিয়ে কোনও কথা নেই। নীরবতাটা রাজুই ভাঙে।
রাজুঃ এতো রাতে তোকে ডাকতাম না রে! (সাইদুলের দিকে আরও কিছুটা সরে এসে, সাইদুলকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজু) আমায় ক্ষমা করে দে ভাই। আমি বিশাল ভুল করেছি। তুই তোর ভালোবাসা পেয়েছিস আমি মাঝে আসার কে? আমি তোর সাথে আছি রে সাইদুল। তোকে বোঝাতে পারব না রে সাইদুল আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি।
রাজুর এভাবে ওর পাশে দাঁড়ানো, আবার পুরনো বন্ধুকে এভাবে কাছে টেনে নেওয়া এতে যে সাইদুল ও ভীষণভাবে খুশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে কি করে রূপসার রাগ ভাঙানো যায়। ওকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় ই রাজু বলে ওঠে
রাজুঃ কিরে সাইদুল? ভাই তুই এখনো আমার ওপর রেগে আছিস না রে? তুই তো জানিস রে ভাই আমি কিরকম মাথাগরম পাবলিক। আবার রাগ নেমে গেলেও যে আমি সেই পুরনো রাজু তাও তো তুই জানিস রে।
সাইদুলঃ ধুর বোকা, আমি কি মেয়ে নাকি যে রাগ করে থাকবো। আমি জানতাম একদিন তুই আমার পাশে ঠিক ই থাকবি। আসলে জানিস তো কিছুক্ষন আগেই না রূপসার সাথে খুব ঝামেলা হয়ে গেছে। শালা সারাদিন খাটাখাটনির পর কার ই বা মাথার ঠিক থাকে বল তো? খুব বাজে ব্যাবহার করে দিয়েছি রে। খুব রেগে আছে আমার ওপর।
রাজুঃ ধুর বাল। শুধু এই কারনে তুই এরকম মাগির মত মুখ করে বসে...
রাজুর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সাইদুলের ফোনটা বেজে ওঠে। হ্যাঁ এটা রূপসার ই ফোন। সাইদুলের মুখে সেই পুরনো হাঁসিটা আবার ফিরে আসে। রাজু হাত নেড়ে ইশারা করে ওকে ভেতরে গিয়ে কথা বলতে বলে। সাইদুল ফোনটা রিসিভ করেই ভেতরে চলে যায়।
রূপসাঃ আমার দিব্যি করে আগে বল যে আর কোনোদিন আমায় এভাবে ভুল বুঝবে না। আগে বল তবে কথা বলব নয়ত নয়।
সাইদুলঃ আমার ভুল হয়ে গেছে রূপসা আর কখনো এরকম হবেনা। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।
বেশ কিছুক্ষন উভয়পক্ষই চুপচাপ। “হুম ঠিক আছে” রূপসার কণ্ঠ থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
রূপসাঃ কি পড়ে আছো এখন? আর বলতো আমি কি পড়ে আছি? (খিলখিল করে হেঁসে ওঠে রূপসা, রূপসার এই হাঁসি এক পুরুষকে অনেক কিছু ইঙ্গিত ই দিতে পারে। সেই ইঙ্গিত বুঝতে সাইদুলের ও দেরি হয়না)
সাইদুলঃ আমি না খালি গায়ে আছি, শুধু একটা বারমুন্দা পড়ে আছি। আর তুমি একটা সাদা রঙের ম্যাক্সি পড়ে আছো। কি গো ঠিক বললাম তো।
রূপসাঃ (আবার সেই খিল খিল করে দুষ্টুমি ভরা হাসিটার সাথে) মোটেও ঠিক বলনি। তুমি যদি এখন আমার রুমে থাকতে না... উম। সাইদুল তুমি আমায় পাগল করে দেবে তো বিয়ের পর?(ফোনের দুই প্রান্তেই তপ্ত নিঃশ্বাসের টাইফুন শুরু হয়ে যায়) ওহ সাইদুল আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। আমার খুব লজ্জা করছে বলতে। আমি না কিছুই পড়ে নেই। শুধু একটা পাতলা হলুদ চাদর আমার শরীরে ঢাকা দেওয়া। তুমি যদি থাকতে এখানে...উফ। জানো তোমায় তখন কেন উল্টোপাল্টা কথা বলছিলাম। মেয়েদের ও না তোমাদের মত...(আবার খিলখিল করে সেই হাঁসিটা, এদিকে সাইদুলের নিম্নদেশে বারমুন্দার ওপর ইতিমধ্যেই সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ তৈরি হয়ে গেছে, একটা সাপ ফোঁসফোঁস করতে শুরু করে দিয়েছে) আমি না খুব অসভ্য জানো তো। কিন্তু তোমার সাথেই তো অসভ্যতামি করব কি গো বল। একটা কাজ করবে? কাল একটু যদি বাড়ি থেকে আম্মিকে অন্য কোথাও পাঠাতে পারো না, তাহলে এই বদমাশ রূপসা তোমায় নিজের সব ভালোবাসা উজাড় করে দেবে। কাল আমি তোমার সামনে আসব নতুন বউ এর বেশে, তোমায় পাগল করে দেবো আমি। আমাকে এবার পুজায় বাবা একটা হলুদ সাড়ি দিয়েছে। ওটা পড়ে একদম তোমার বউ সেজে তোমার বাড়িতে আসব। কি গো কিছু বল তুমি?
সাইদুলঃ তুমি আমার যা অবস্থা করেছ, উফ শরীরটা আনচান করছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি... রূপসা আমার শোনা কাল আমার বাড়িতে কেউ থাকছে না। কাল পরশু দুদিন ই আমার বাড়ি ফাঁকা। আমিও সেই হলুদ সাড়িতে আমার বউকে দেখতে চাই। আজ রাতে আমি আর ঘুমাতে পারব না রূপসা। আমি কি আসব তোমার হোস্টেলে।
রূপসাঃ ধুর অসভ্য, যা হওয়ার কাল ই হবে। এখন শুয়ে পড়ো, আমাদের আবার স্বপ্নের মধ্যে দেখা হবে। ওখানে একে অপরকে আদর করব, কেমন। কিন্তু প্র্যাক্তিকাল ক্লাস কাল। কাল কিন্তু ঠিক ৮ টায় আমি হাওড়া চলে আসছি। ওকে বাই উম্মম্মম্মম (ফোন কিস)।
ফোন রেখে দেয় রূপসা। কালকের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সাইদুল।
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু ভেবে দেখুন সাইদুলের জবানবন্দিতে কিছু পুরনো ঘটনা শুনতে শুনতেই আমরা সুপ্রতীকের গল্পে চলে গিয়েছিলাম। কেনই বা সুপ্রতীক, মালা, বংশী, সিলিং সাহেব এই গল্পের মাঝে হথাত করেই উদয় হয়ে গেলেন তা একদম শেষে আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলব, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা চলে যাবো সাইদুলের সেই ভাবনায়। রূপসার কলেজ থেকে ফিরে এসে সাইদুল ও রাজুর মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং কিছু আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আসলে যতই কামুক হোক যতই নষ্ট ছেলে হোক ওরা, আসলে তো আপনার গল্পে খলনায়ক ওরা ছিলনা, খলনায়ক একজন ই তিনি আর কেউ নয় স্বয়ং মানব বাবু। একটা কথা প্রচণ্ড সত্যি রাজুর তিলোত্তমার প্রতি যে ভালোবাসা বিন্দু বিন্দু আকারে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়েছিল তার মধ্যে সামান্য কোনও ভেজাল ছিলনা। রাজুর মত এক পাষণ্ডের পাষাণ হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চার তো তিলোত্তমা করেই দিয়েছিল, কিন্তু সেই হৃদয়কে ভেঙে খান খান শুধু আপনি ই করেছেন। যাই হোক সত্যি হয়ত রাজুর আপনার ওপর কোনও ক্রোধ ই ছিলনা। কিন্তু এটাও সত্যি রাজুর হৃদয় থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গিয়ে জন্ম নেয় এক শত্রুতার, আপনার পরিবারের কিছু ক্ষতি করার জিঘাংসার। আর সেই জিঘাংসায় আগুন জ্বালিয়ে দেন আপনি নিজেই, আর সাথে কিছুটা মানবের উসকানি। যাই হোক আমরা চলে যাই আবার সাইদুলের কাছে।
সাইদুলের আম্মির পরের দিন দেশের বাড়ি যাওয়ার কথা, এদিকে ও আবার রূপসাকেও নিজের বাড়িতে আমন্ত্রন জানিয়ে ফেলেছে। ও জানে রূপসা ঠিক ই আসবে, কারন ওর ই মত রূপসাও ওকে প্রচুর ভালোবাসে। কিন্তু মনের মানুষকে নিজের দরিদ্র রাজপ্রাসাদে দেখতে পাওয়ার আনন্দকেও ছাপিয়ে যায় কিছু আশঙ্কা। যে আশঙ্কাগুলো সাইদুলের বুকে ধারালো তরোয়ালের মত বিদ্ধ হচ্ছিল। মালতী দেবীকে রাজুর আর সাইদুলের একসাথে ভোগ করা, সাইদুলের পরিবার ও রূপসার পরিবারের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার চরম বৈষম্য, রাজুর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা এবং আরও অনেককিছু। মালতী দেবী কি ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারলে রূপসাকে কিছুই বলবেন না? রূপসা কি মালতী দেবীর সমস্ত কথা বিশ্বাস করবে? রাজু কি এতো সহজে ওকে ছেড়ে দেবে, কারন তিলোত্তমার হৃদয় না পাওয়ার জ্বালা ওকে প্রতি মুহূর্তে কুড়ে কুড়ে খায়? হাজারো প্রশ্ন সাইদুলের মস্তিস্কে কিলবিল করতে শুরু করে। বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম কিছুতেই আসেনা। পাশে পড়ে থাকা মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখে প্রায় ১ টা বেজে গেছে। জোর করে চোখটা বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করে কারন কাল ওকে অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। হথাত ওকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে। আবার ফোনটা হাতে নিয়ে সাইদুল দেখে এটা রূপসার ফোন। এতো রাতে রূপসার ফোন কেন এই ভাবতে ভাবতেই সাইদুল ফোনটা রিসিভ করে।
সাইদুলঃ হ্যালো, রূপসা কি হয়েছে ঘুম আসছেনা বুঝি?
রুপসাঃ না ঘুম আসছেনা। তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব তোমায়?
সাইদুলঃ হ্যাঁ হ্যাঁ বলই না কি বলবে।
রূপসাঃ আচ্ছা তোমার বন্ধু রাজু ও কেমন গো? অনেকবার তো তোমায় আর রাজুকে একসাথেই দেখেছি। ছেলেটার বডিটা খুব্ব সুন্দর। উম সাইদুল তুমি আবার রাগ করছ না তো তোমাকে তোমার বন্ধুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি এতো সুখ্যাতি করছি সেজন্য।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে সাইদুল। রূপসা যে ওকে হথাত রাজুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে তা ভ্রুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সাইদুল। সাইদুলের কিছুটা ভয় লাগতে শুরু করে। রাজুর তো এই পাড়ায় খুব বদনাম, রূপসা আবার বাজে কিছু শোনেনি তো রাজুর ব্যাপারে। মনে মনে বলে “শালা কি করতে যে এরকম একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম, একের পর এক প্রবলেম” সাইদুল কিছু বলে ওঠার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে রূপসা বলে ওঠে
রূপসাঃ তখন আমারা কলেজে পড়তাম। আমার এক বান্ধবী ছিল রিয়া। ওই প্রথম আমাকে রাজুদাকে দেখায়। একটা লাল টিশার্ট পড়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল কলেজের পাস দিয়ে। কলেজের মেয়েরা তো ওকে দেখার জন্য প্রায় হুড়োহুড়ি করতে শুরু করে দিয়েছিল। আমি ওদের দেখাদেখি পেছন পেছন গেছিলাম। সত্যি যেকোনো মেয়েই পাগল হয়ে যাবে ওকে দেখে। উফ কি বডি। তুমি তো ওর বন্ধু তুমি কি ওর মত একটু বডি বানাতে পারনা। রোগাটে গড়ন আমার একদম পছন্দ নয়।
সাইদুলের মাথায় এমনিতেই দুশ্চিন্তার শেষ ছিলনা তার ওপর রূপসার এই অদ্ভুত ধরনের আচরন। হথাত করেই সাইদুলের মাথাটা গরম হয়ে যায়।
সাইদুলঃ রাজু আমার খুব ভালো বন্ধু, আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকিনা। কিন্তু ওর এতো ভালো বন্ধু হয়েও বলছি, ও ভালো শুধুই বন্ধু হিসেবে। মেয়েদেরকে ও কি চোখে দেখে তা শুধু আমি ই জানি। আর আমিও সত্যি বুঝে পাইনা মেয়েরা কেন এই ধরনের ছেলেকে বেশি পছন্দ করে। ভালো ছেলে পৃথিবীতে কত আছে অথচ...
রূপসাঃ এবাবা সাইদুল তুমি এরকম বাচ্চাদের মত রাগ করছ কেন সোনা। শোন না প্লিস আমার কথাটা, আমি যা বলেছি তুমি তা বুঝতে পারনি। আমার না ঘুম আসছে না, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না শোনা। জানো কাল তোমার বাড়িতে আসব আমার শরীরে এখন থেকেই উত্তেজনা হচ্ছে। সাইদুল তোমার ঠোঁটদুটো বিশাল মিষ্টি, তুমি জানো আমি না একটা রাক্ষসী, কখনো পুরুষের স্পর্শ পাইনি। তুমি আমায় রক্তের স্বাদ দিয়েছ। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু একটা পচা স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এই বিচ্ছিরি স্বপ্নটা আমি কলেজেও দেখেছিলাম। তাই তো রাজুর কথা বললাম।
সাইদুলঃ স্বপ্ন? কি স্বপ্ন? আর হথাত করে আমায় রাজুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছ কেন? রাজু আমার বন্ধু। কিন্তু ও বস্তির ছেলে, ভীষণ বাজে একটা ছেলে আমি ওকে তোমার সামনে আনব না। ও একটা নোংরা ইতর ছেলে।
রূপসাঃ তুমিও তো বস্তির ছেলে, কিন্তু তুমি কত ভালো। রাজুও ভালো তুমি ওকে ভুল ভেবেছ।
সাইদুলঃ দেখো রূপসা, আমি তোমায় স্পষ্টভাবে বলছি, আজ আমার আর রাজুর খুব ঝগড়া হয়েছে। তুমি আমার জীবনে এসেছ আমি সব অতীতের ঘটনাকে এমনকি রাজুকেও ভুলতে চাই। এই বস্তিতে আমি থাকতে চাইনা। প্রচুর পরিশ্রম করব টাকা জমাবো আর তোমাদের মত পাকা বাড়িতে থাকবো। তারপর আমাদের বিয়ে হবে। আমি তোমার সাথে ঘর বেঁধে সুখি হতে চাই রূপসা।
রূপসাঃ আমিও তো তাই চাই সাইদুল। আমায় ভুল বুঝনা আমি রাজুর নাম তোমার সামনে ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে একটা পুরনো দুষ্টু স্বপ্ন কেমন করে কিজানি আমার জীবনে আবার ফিরে এলো। আর তোমায় না বললে কাকে বলব সোনা। তুমি ই তো আমার সব। আসলে রাজুর জন্য ক্লাসের বাকি মেয়েরা পাগল ছিল, ওদের কথা শুনতে শুনতে আমার ও কেমন একটা রাজুর ব্যাপারে আগ্রহ জন্মায়। ব্যাস এতটুকুই।
অনেকক্ষণ নিজের ধৈর্য পরীক্ষা দিয়েছে সাইদুল। আর পারেনা নিজেকে ঠিক রাখতে।
সাইদুলঃ দেখো রূপসা, তোমার যদি রাজুর মত ছেলেদের পছন্দ হয় তাহলে এটা খুব সত্যি যে আমাকে তোমার কখনোই পছন্দ হবেনা আর আমাকে ভালো ও বাসতে পারবে না তুমি। তুমি ভালো থেকো আমি ফোনটা রাখি।
মুহূর্তের মধ্যে ফোনটা কেটে দেয় সাইদুল। সাইদুলের কপাল দিয়ে তিরতির করে ঘাম ঝরে পড়তে থাকে। এ কোন রূপসা, যাকে কয়েকটা মুহূর্ত আগে নিজের হৃদয় উজাড় করে দিয়ে এসেছিল সেই রূপসা? সেই রূপসা তো এরকম হতে পারেনা। রূপসাই তো ওকে বলেছে যে সাইদুলের জন্য ও নিজের প্রাণটাও দিতে পারে। নিজের ই মনে তৈরি হওয়া বিপরীতমুখী একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে যেতে থাকে সাইদুল। কেন বারবার রূপসা রাজুর নাম ওর কাছে করছিল। ওর কথার মধ্যে কি কোনও যৌন ইঙ্গিত রয়েছে নাকি শুধুই ওর সাথে নেহাত ই ইয়ার্কি করার জন্য এরকম বলল। একটার পর একটা মিনিট অতিক্রান্ত হয়। সাইদুল ও শান্ত হয় ধীরে ধীরে। যতই হোক ভালোবাসা বলে কথা। মনে মনে বলে সাইদুল ওর এভাবে সত্যি ই ফোন টা কেটে দেওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এখনো কেন রূপসার কোনও ফোন এলনা? এবার সাইদুলের চিন্তা হতে শুরু করে। তাহলে কি রূপসা ওর সাথে মশকরা করছিল? সাইদুলের এভাবে রেগে যাওয়ায় কি রূপসা কষ্ট পেলো?
ফোনটা হাতে নিয়ে রূপসার নাম্বারে আবার ডায়াল করে সাইদুল, কিন্তু নাম্বার ব্যাস্ত। এতরাতে কারসাথে কথা বলছে রূপসা? সাইদুল জানে এতো রাতে নিশ্চয়ই রূপসা নিজের বাবা মার সাথে কথা বলবে না, কোনও বান্ধবীর সাথে কথা বলছে হয়ত। ২-৩ মিনিট অপেক্ষা করে আবার ফোন করে রূপসাকে। আবার নাম্বার ব্যস্ত। রূপসা কার সাথে কথা বলছে এই ভাবতে ভাবতে সাইদুলের চিন্তায় মনটা উথাল পাথাল হয়ে যেতে থাকে। প্রায় ১-২ মিনিট ছাড়া ছাড়াই চেষ্টা করে যায় সাইদুল কিন্তু প্রতিবার একি কথা ব্যাস্ত। হাজারো দুশ্চিন্তায় সাইদুলের মাথা ধরে যায়, আসলে সারাদিনে ধকল তো কম যায়নি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেও খেয়াল করেনি। ঘুম ভাঙ্গে ফোনের আওয়াজে। হাতে ফোনটা নিয়ে দেখে রূপসার ফোন, রাত প্রায় দেড়টা বেজে গেছে। চরম ক্লান্তির সাথে সাইদুল ফোন টা রিসিভ করে।
সাইদুলঃ এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিলে? কখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তোমার এই ব্যাবহারটা আমার একদম ভালো লাগলো না রূপসা। তুমি জাননা আজ সারাদিনে থিক কি পরিমান কষ্ট আমার হয়েছে?
রূপসাঃ (কিছুটা ধরা ধরা গলায়) তুমি ভীষণ পচা ছেলে। তুমি কিছুই বুঝলে না কেন হথাত এই মাঝ রাতে আমি তোমায় ফোন করতে গেলাম। তুমি কি ভাবলে আমি অন্য ছেলের... না থাক, আমার আর আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না সাইদুল। গুড নাইট।
হথাত ফোনটা কেটে দিলো রূপসা। রূপসার কান্নাভেজা কণ্ঠ তখনও সাইদুলের কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বারবার নিজেকে দোষারোপ করে সাইদুল। মনের মানুষকে কাঁদিয়ে দেওয়া, কষ্ট দেওয়া এযে এক প্রেমিকের কাছে ঠিক কতবড় শাস্তি তা শুধু একজন পুরুষ ই বোঝেন। মনে মনে একবার বলে ওঠে সাইদুল “শালা সত্যি ই আমি বস্তির ছেলে মাথায় সবসময় আজেবাজে চিন্তা ঘোরে, ও হয়ত কিছু অন্য বলতে যাচ্ছিল বুঝলাম আলাদা কিছু, শালা সত্যি বদ ছেলেগুলোর সাথে মিশে মিশে আমার ও মাথা খারাপ হয়ে গেছে”
হাতে মোবাইলটা নিয়ে রূপসার নাম্বারে ডায়াল করে সাইদুল। একবার রিং হওয়ার পর ই রূপসা কেটে দেয়। সাইদুলের মাথা খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে বলে “শালা বিশাল ভুল করে ফেলেছি, ইস কেন যে বললাম এরকম, আমি সত্যি ই ফালতু একটা ছেলে” বারবার চেষ্টা করতে থাকে সাইদুল কিন্তু ফলাফল ওই একি। একবার রিং হওয়ার পর ই ফোনটা কেটে দেয় রূপসা। হাতের আঙুলগুলো মুখে পুড়ে কামরাতে থাকে সাইদুল, বিড়বিড় করে বলে ওঠে “আরে রূপসা প্লিস প্লিস প্লিস একটিবার আমায় কিছু একটা বলার সুযোগ দাও” প্রায় ১০ মিনিট লাগাতার সাইদুল রূপসার মোবাইলে চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু রূপসা বারবার ফোনটা কেটে দেয়। হতাশায় ক্লান্তিতে চোখদুটো বুজে নেয় সাইদুল। হথাত ই মোবাইলটা বেজে ওঠে, কোনওকিছু না বুঝেই সাইদুল ফোনটা রিসিভ করে বলে ওঠে
“আমায় ক্ষমা করে দাও রূপসা, আমি তোমায় ভুল বুঝিনি। আসলে সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম হয়ত তাই এরকম উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি, প্লিস একটু আমার কথাটা শোন তুমি, প্লিস ফোনটা কেটোনা”
“কিরে বাল কি আলবাল কথা বলে যাচ্ছিস। ঘুমিয়ে গেছিস কিনা দেখার জন্য ফোন করলাম। একবার বাইরে আয়না একটু কথা বলব। একটাবার আয় আজ তোর সাথে এতো ঝগড়া করলাম তাই আমারও ঘুম আসছেনা”
ঠিক এই কথাটা এই মুহূর্তে সাইদুল শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। এই মুহূর্তেই একবার রূপসার সাথে কথা বলা খুব দরকার, অথচ রাজুর ফোন, না বলেও উপায় নেই। সাইদুল মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয় “ঠিক আছে বাইরে দাঁড়া আমি আসছি” ধীরে ধীরে উঠে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোয় সাইদুল। কিছুটা দুরেই রাজু দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরের চাতানটায় গিয়ে বসে সাইদুল, রাজুও ওর দিকে এগিয়ে আসে। “নে বিড়ি খা” সাইদুলের দিকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে দেয় রাজু। দুজনেই দুটো বিড়ি জ্বালিয়ে চুপ করে বসে থাকে। প্রায় ১ টা মিনিট কারুর মুখ দিয়ে কোনও কথা নেই। নীরবতাটা রাজুই ভাঙে।
রাজুঃ এতো রাতে তোকে ডাকতাম না রে! (সাইদুলের দিকে আরও কিছুটা সরে এসে, সাইদুলকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজু) আমায় ক্ষমা করে দে ভাই। আমি বিশাল ভুল করেছি। তুই তোর ভালোবাসা পেয়েছিস আমি মাঝে আসার কে? আমি তোর সাথে আছি রে সাইদুল। তোকে বোঝাতে পারব না রে সাইদুল আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি।
রাজুর এভাবে ওর পাশে দাঁড়ানো, আবার পুরনো বন্ধুকে এভাবে কাছে টেনে নেওয়া এতে যে সাইদুল ও ভীষণভাবে খুশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে কি করে রূপসার রাগ ভাঙানো যায়। ওকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় ই রাজু বলে ওঠে
রাজুঃ কিরে সাইদুল? ভাই তুই এখনো আমার ওপর রেগে আছিস না রে? তুই তো জানিস রে ভাই আমি কিরকম মাথাগরম পাবলিক। আবার রাগ নেমে গেলেও যে আমি সেই পুরনো রাজু তাও তো তুই জানিস রে।
সাইদুলঃ ধুর বোকা, আমি কি মেয়ে নাকি যে রাগ করে থাকবো। আমি জানতাম একদিন তুই আমার পাশে ঠিক ই থাকবি। আসলে জানিস তো কিছুক্ষন আগেই না রূপসার সাথে খুব ঝামেলা হয়ে গেছে। শালা সারাদিন খাটাখাটনির পর কার ই বা মাথার ঠিক থাকে বল তো? খুব বাজে ব্যাবহার করে দিয়েছি রে। খুব রেগে আছে আমার ওপর।
রাজুঃ ধুর বাল। শুধু এই কারনে তুই এরকম মাগির মত মুখ করে বসে...
রাজুর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সাইদুলের ফোনটা বেজে ওঠে। হ্যাঁ এটা রূপসার ই ফোন। সাইদুলের মুখে সেই পুরনো হাঁসিটা আবার ফিরে আসে। রাজু হাত নেড়ে ইশারা করে ওকে ভেতরে গিয়ে কথা বলতে বলে। সাইদুল ফোনটা রিসিভ করেই ভেতরে চলে যায়।
রূপসাঃ আমার দিব্যি করে আগে বল যে আর কোনোদিন আমায় এভাবে ভুল বুঝবে না। আগে বল তবে কথা বলব নয়ত নয়।
সাইদুলঃ আমার ভুল হয়ে গেছে রূপসা আর কখনো এরকম হবেনা। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।
বেশ কিছুক্ষন উভয়পক্ষই চুপচাপ। “হুম ঠিক আছে” রূপসার কণ্ঠ থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
রূপসাঃ কি পড়ে আছো এখন? আর বলতো আমি কি পড়ে আছি? (খিলখিল করে হেঁসে ওঠে রূপসা, রূপসার এই হাঁসি এক পুরুষকে অনেক কিছু ইঙ্গিত ই দিতে পারে। সেই ইঙ্গিত বুঝতে সাইদুলের ও দেরি হয়না)
সাইদুলঃ আমি না খালি গায়ে আছি, শুধু একটা বারমুন্দা পড়ে আছি। আর তুমি একটা সাদা রঙের ম্যাক্সি পড়ে আছো। কি গো ঠিক বললাম তো।
রূপসাঃ (আবার সেই খিল খিল করে দুষ্টুমি ভরা হাসিটার সাথে) মোটেও ঠিক বলনি। তুমি যদি এখন আমার রুমে থাকতে না... উম। সাইদুল তুমি আমায় পাগল করে দেবে তো বিয়ের পর?(ফোনের দুই প্রান্তেই তপ্ত নিঃশ্বাসের টাইফুন শুরু হয়ে যায়) ওহ সাইদুল আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। আমার খুব লজ্জা করছে বলতে। আমি না কিছুই পড়ে নেই। শুধু একটা পাতলা হলুদ চাদর আমার শরীরে ঢাকা দেওয়া। তুমি যদি থাকতে এখানে...উফ। জানো তোমায় তখন কেন উল্টোপাল্টা কথা বলছিলাম। মেয়েদের ও না তোমাদের মত...(আবার খিলখিল করে সেই হাঁসিটা, এদিকে সাইদুলের নিম্নদেশে বারমুন্দার ওপর ইতিমধ্যেই সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ তৈরি হয়ে গেছে, একটা সাপ ফোঁসফোঁস করতে শুরু করে দিয়েছে) আমি না খুব অসভ্য জানো তো। কিন্তু তোমার সাথেই তো অসভ্যতামি করব কি গো বল। একটা কাজ করবে? কাল একটু যদি বাড়ি থেকে আম্মিকে অন্য কোথাও পাঠাতে পারো না, তাহলে এই বদমাশ রূপসা তোমায় নিজের সব ভালোবাসা উজাড় করে দেবে। কাল আমি তোমার সামনে আসব নতুন বউ এর বেশে, তোমায় পাগল করে দেবো আমি। আমাকে এবার পুজায় বাবা একটা হলুদ সাড়ি দিয়েছে। ওটা পড়ে একদম তোমার বউ সেজে তোমার বাড়িতে আসব। কি গো কিছু বল তুমি?
সাইদুলঃ তুমি আমার যা অবস্থা করেছ, উফ শরীরটা আনচান করছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি... রূপসা আমার শোনা কাল আমার বাড়িতে কেউ থাকছে না। কাল পরশু দুদিন ই আমার বাড়ি ফাঁকা। আমিও সেই হলুদ সাড়িতে আমার বউকে দেখতে চাই। আজ রাতে আমি আর ঘুমাতে পারব না রূপসা। আমি কি আসব তোমার হোস্টেলে।
রূপসাঃ ধুর অসভ্য, যা হওয়ার কাল ই হবে। এখন শুয়ে পড়ো, আমাদের আবার স্বপ্নের মধ্যে দেখা হবে। ওখানে একে অপরকে আদর করব, কেমন। কিন্তু প্র্যাক্তিকাল ক্লাস কাল। কাল কিন্তু ঠিক ৮ টায় আমি হাওড়া চলে আসছি। ওকে বাই উম্মম্মম্মম (ফোন কিস)।
ফোন রেখে দেয় রূপসা। কালকের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সাইদুল।