10-11-2019, 06:52 PM
(This post was last modified: 23-11-2019, 08:58 PM by Johnny Da. Edited 6 times in total. Edited 6 times in total.)
আমার স্পষ্ট মনে পরে! তখন আমার বয়স বারো কি তেরো! চট্টগ্রাম রেল ষ্টেশনে একটা কুলির কাজই খোঁজছিলাম। রেজিষ্টার্ড কুলি ছিলাম না বলে, অন্য সব কুলিরা ধূর ধূর বলে গালি গালাজ করে, ষ্টেশন এলাকা থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলো।
পৃথিবীর মানুষ সব কিছুই সহ্য করতে পারে, গালি-গালাজ, ভর্ৎসনা সবই। তবে ক্ষুধার জ্বালা বোধ হয় কেউই সহ্য করতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালায় পাগল হয়ে মানুষ, কিইবা না করতে পারে! চুরি ডাকাতি, এমন কি খুন খারাবী পর্য্যন্ত। নাহ, আমি কোন চুরি ডাকাতি করিনি। ষ্টেশন এলাকা থেকে বেড় হয়ে, অন্যমনস্ক পথ ধরেই হেঁটে চলেছিলাম। চোখের সামনে যাকেই পেয়েছি, হাত পা ধরেই বলেছি, বাবা দুইটা টাকা, মাগো দুইটা টাকা, এক টুকরা পারুটি খাবো! অথচ, কারোরই মন গললো না। সবাই ধূর ধূর করেই আমাকে সরিয়ে দিয়ে, নিজের পথই দেখলো।
নুপুর সিনেমাটা পেরিয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। সারি সারি করে সাজানো ফলের দোকান গুলো। দেখে জিভে পানি আসছিলো ঠিকই, অথচ কিছুই করার ছিলো না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সাজানো ফলগুলোই শুধু দেখছিলাম। আরো দেখলাম, মাঝ বয়েসী এক মহিলাও ফল কিনে রিক্সায় উঠার চেষ্টা করছিলো। ক্ষুধার জ্বালায় এতটাই দিশহারা ছিলাম যে, আমি তার পা টেনে ধরেই বললাম, মা, দুইটা টাকা দেবেন?
মহিলা রিক্সায় উঠতে গিয়েও থেমে দাঁড়ালো। আমার দিকে মায়াবী চোখেই তাঁকালো। খানিকটা ক্ষণ চেয়ে থেকে, স্নেহ ভরা গলাতেই বললো, দুই টাকা দিয়ে কি করবি?
আমি বললাম, তিন দিন কিছু খাইনি, এক টুকরা পারুটি খাবো!
মহিলা আমার দিকে বেশ কিছুটা সময় ফ্যাল ফ্যাল করেই তাঁকিয়ে রইলো। তারপর বললো, এক টুকরা পারুটি খাবি? তারপর? রাতে কি খাবি?
আমি অনিশ্চিতভাবেই বললাম, জানিনা মা! ক্ষুধা মা, খুব ক্ষুধা!
মহিলা বললো, ক্ষুধা তো বুঝলাম, করিস কি? তোর বাবা মা নেই?
মহিলার কথার কোন উত্তর দিতে পারলাম না। মাত্র পাঁচ ছয়দিন আগেই আমি আমার মা বাবার সাথে, চাঁদপুর থেকে লঞ্চে করে মামার বাড়ীতেই রওনা হয়েছিলাম। কে জানতো লঞ্চডুবি হবে! হাসপাতালের বিছানাতেই জেনেছিলাম, মা বাবার লাশগুলোই নাকি উদ্ধার করতে পেরেছে। আর আমাকে উদ্ধারকারীরাই উদ্ধার করে, হাসপাতালেই এনে রেখেছিলো। কে জানতো, আমি আমার সর্বস্ব হারিয়ে বেঁচে থাকবো! উদ্ধারকারীরা আমার জীবন বাঁচিয়েও দায় দায়ীত্ব নেবে না। আমার চোখ বেয়ে শুধু জল গড়িয়েই পরলো। মহিলা বললো, উঠ, আমার সাথে রিক্সায় উঠ!
আমি মহিলার সাথেই রিক্সায় উঠলাম। রিক্সায় চলার পথেই মহিলা বললো, বাসায় কাজ করতে পারবি?
আমি এক কথায় বললাম, জী পারবো।
রিয়াজুদ্দীন বাজারের ফলের দোকানগুলোর সামনে একটি রিক্সায় চড়ে, অজানা অচেনা এক মহিলার সাথে যেখানে এসে পৌঁছেছিলাম, সেটি ছিলো শহরের এক অভিজাত আবাসিক এলাকা। আমার পূর্ব স্মৃতিশক্তি তখন খানিকটা লোপই পেয়ে গিয়েছিলো। রিক্সা থেকে নেমে মহিলার পিছু পিছু পাগলের মতোই ছুটেছিলাম, এক টুকরো পারুটি খাবার আশায়।
খানিকটা গরম ছিলো বই কি! ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত দেহে ফিরে আসা মহিলা, বসার ঘরে আমাকে রেখেই ভেতরে ঢুকে গেলো। ক্ষুধার জ্বালায় সাংঘাতিক ধরনের অস্থিরই ছিলাম আমি। এমনি অস্থির ছিলাম যে, পারলে নিজের গায়ের চামড়াও কামড়ে কামড়ে খেয়ে, পেটটাকে আগে শান্তি দিই, তেমনি এক অস্থিরতা! অথচ, খুব সহজে ভেতর থেকে মহিলা আর ফিরে আসছিলো না।
ক্ষুধার সময়, প্রতিটি মুহুর্তই বোধ হয়, এক যুগের মতোই লাগে। মহিলা কত যুগ পরে ফিরে এলো হিসেব করে বলার মতো নয়। তবে, তার হাতের ট্রে টা দেখে, যুগ যুগ সময়ের কথা ভুলে গেলাম আমি সাথে সাথেই। ট্রে ভর্তি খাবার গুলোর দিকেই আমার নজরটা পরেছিলো। মহিলা টি পয়ের উপর ট্রে টা নামিয়ে রেখে, বললো, নে খা! এক টুকরা পারুটিই তো খেতে চেয়েছিলি! দেখি কত খেতে পারিস!
ক্ষুধার্ত মানুষ বুঝি অন্ধের মতোই থাকে। আমি কোন দিক না তাঁকিয়েই, ট্রেতে রাখা ন্যুডুলস এর বাটিটা থেকে গোগ্রাসেই কয়েক দফা ন্যুডুলস পেটে পুরে নিলাম। তারপরই ওপাশের বেতের চেয়ারে বসা মহিলার দিকে এক নজর তাঁকালাম।
পেটটা তখন খানিকটা ভর্তিই হয়ে উঠেছিলো। দেহের শিরায় উপশিরায় রক্ত চলাচলটাও নুতন করে চালু হয়ে উঠেছিলো। মস্তিষ্কের ভেতরটাও তেমনি স্বাভাবিক হয়ে উঠে আসছিলো। বেতের চেয়ারে বসা মহিলাকে দেখে আমি রীতীমতো অবাকই হলাম।
আয়তাকার চেহারা। সরু ঠোট এর উপর চৌকু নাক! চোখ দুটি টানা টানা। গালের ত্বক অসম্ভব ধরনের মসৃণ! আর ভেজা ঠোটগুলো বোধ হয়, পৃথীবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এক জোড়া ঠোট! খানিকটা স্বাস্থ্যবতী মহিলার পরনে, কালো রং এর ব্রা আর প্যান্টিই শুধু। খুব আরাম করেই, পায়ের উপর পা তুলে রেখে, আমার খাবার খাওয়াটাই শুধু দেখছিলো তন্ময় হয়ে! আমিও খানিকটা ক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করেই তাঁকিয়ে রইলাম মহিলার দিকে। মহিলা বললো, কিরে, ভালো হয়নি?
আমি আবারো খাবার খাওয়া শুরু করে বললাম, খুবই স্বাদ হয়েছে মা!