Thread Rating:
  • 43 Vote(s) - 3.26 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram
#11
অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#02)

আমি মায়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দেই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে, সুব্রতর সাথে কি কথা হয়েছে সেটা শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। আমি জানালাম যে বড় বউদির কেমো শুরু হয়ে গেছে আর বৌদি ঘুমোচ্ছে। সেই সময়ে আমি বুঝতে পারি যে কেন সকাল বেলায় ছোটমা আমার বুক টিপে পরীক্ষা করছিলেন। আমি ছোটমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলি, এত ভালবাসে আমাকে?

ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “কাল তোকে হস্পিটাল নিয়ে যাবো।”

রাতে দাদারা হস্পিটাক থেকে ফিরে আসার পরে সবাই ঘরে বসে কথা বার্তা বলেন। আমার সেই ঘরে ঢোকা মানা ছিল। আমার সেই দিনের কথা মনে পরে যায়, আমি আর ও যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। সেইদিন প্রথম বার বড় বৌদি নিজের হেঁসেল ছেড়ে বাড়ির উঠান পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। আমি জানিনা, বড় বউদির সাথে ওর কি কথা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন বড় বউদির হাসি হাসি চোখ আমার ঝাপসা দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে।

আমি ছাদে উঠে এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সেদিন ঠিক যে জায়গায় ও দাঁড়িয়েছিল আর আমাকে চুমু খেয়েছিল। ওর সাথে দেখা করার জন্য মন আকুলি বিকুলি হয়ে ওঠে, কিন্তু একি সাথে ছোটমায়ের ভালোবাসা আর স্নেহ মমতা আমাকে পেছনে টেনে ধরে রাখে। ছোটমাকে ছেড়ে কি করে আমি চলে যেতাম, আমার জীবন যে ছোটমায়ের কাছে ঋণী। আমি কি করে ছোটমায়ের মান সন্মান এই সমাজের সামনে নিচু করে দিতাম শুধু মাত্র নিজের জন্য? আমি বাংলার গ্রামের সামান্য একটি মেয়ে, বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পদক্ষেপের আগে আমি শত বার মরে যেতাম যে।

আমার মাথায় চিন্তার বেড়ি যেন ঝনঝন করে ওঠে। বড় বউদির ক্যান্সার, আমার ভালোবাসার হারিয়ে যাওয়া আর ছোটমায়ের অকপট স্নেহ মমতা। আমার মাথা ঝিনঝিন করতে শুরু করে, চোখের সামনে অন্ধকার দেখি আর ধুপ করে ছাদের মেঝেতে লুটিয়ে পরে যাই।

চোখ খুলে দেখি যে আমি বিছানায় শুয়ে, মাথার কাছে মা বসে চারপাশে ছোটমা আর বাড়ির লোকে। মায়ের দুচখে জল, ব্যাথা ভরা চাহনি নিয়ে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় প্রশ্ন করে মা, “উলুপি আমার বাড়িতে এই সব কি ঘটে চলেছে?”

একমাত্র ছোটমা জানে আমার মনের ব্যাথার আসল কারন। ছোটমা বুঝতে পারে যে বড় বউদির ক্যান্সারের খবর আমার জ্ঞান হারানোর কারন নয়, আমার জ্ঞান হারানোর আসল সত্য অন্য কিছু।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর আমি চুপ করে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। ছোটমায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমার মুখ দেখে, হয়ত ছোটমায়ের মন কাঁদে তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য। কিন্তু নিজের মনের ভাব ছোটমা কোনদিন প্রকাশ করেননি। ছোটমা আমার পাসে এসে বসে বলেন যে পরের দিন আমাকে হসপিটাল নিয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন কোন এক অজুহাত দেখিয়ে আমাকে হসপিটাল যেতে দেওয়া হয় না।

দিনটা ছিল চতুর্থী, আকাশে বাতাসে যেন আগমনীর সুর ভেসে বেড়ায়, কিন্তু আমার মন ভারাক্রান্ত। ভালোবাসার বিচ্ছেদ আর বড় বউদির ক্যন্সার। আগমনীর সুরের সাথে বুকের ভেতরে বেদনার করুন বাঁশি বেজে ওঠে। আমি ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পেছনের দিকে যাই। সেই পুকুর পাড়, সেই আম কাঠালের বাগান, সব জায়গায় যেন ওর ছোঁয়া খুঁজে বেরাই আমি। এমনকি বাড়ির আনাচে কানাচে তেও যেন ওর ছোঁয়া লেগে আছে বলে মনে হয় আমার। আমি সেই পুকুর পাড়ের এককোণে ওর পোঁতা আম গাছের নিচে গিয়ে বসে পরি। আম গাছের গুঁড়ি ছুঁয়ে ওর হাতের পরশ অনুভব কররা প্রানপন চেষ্টা করি। এই আম গাছের তলায় এক দিন ও আমাকে চুমু খেয়েছিল, পাগল করে তুলেছিল এক শীতের রাতে। সেই চুম্বন আমার গালে, আমার কপালে আজও লেগে আছে। আমি নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাই, নীল আকাশের নিচে, সাদা মেঘের ভেলা ঘুরে বেড়ায়। বাতাসের সেই পুজোর গন্ধ আমার নাকে প্রবেশ করেনা, নাকে লেগে থাকে ওর গায়ের গন্ধ।

এমন সময়ে দুষ্টু বাড়ির দিক থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জানায়, “বড় জেঠিমা বাড়ি ফিরে এসেছে।”

আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি, বউদির ফেরার খবর শুনে বুকের ভেতরের বেদনা যেন কিছু টা কমে যায়। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেস করে দেখি যে সবাই খাবার ঘরে গোল করে বসে। মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা উত্তর দেন যে বৌদি নিজের ঘরে শুয়ে আছেন।

আমি বউদির ঘরে ঢুকে, সেই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলি। চোখের জল মুছে তাকিয়ে দেখি, বৌদি বিছানায় শুয়ে, গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। খুব রোগা হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে একটু হাসেন, মনে হয় যেন বউদির সেই হাসিতে কান্না ঝরছে। আমি বৌদিকে বলতে চেষ্টা করি, “বৌদি তোমাকে হাসতে হবে না, শুধু মাত্র তুমি আমার কাছে ফিরে এস।”

সেই ক্ষণের পরে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বড় বউদির পাশ ছেড়ে যাইনি। রাতেও আমি বউদির পাশে শুয়ে থাকতাম, যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায় সেই ভয়ে। বউদির বাম স্তন বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, কোমরে কেমো র থলি। কয়েকদিনের মধ্যে বৌদি কিছুটা শক্তি ফিরে পান। অন্তত বিছানায় উঠে বসতে পারতেন বা বাথরুম পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারতেন।

সেই দিন, নবমি। বউদির শরীর একটু ভালো ছিল। আমি বৌদিকে স্নান করিয়ে দেয়ার পরে মাথার চুল আঁচরে দেই। কেমোর জন্য মাথার অনেক চুল ঝরে গিয়েছিল।

বৌদি মিনমিন করে আমাকে বললেন, “পরী আমাকে একটু দুর্গা মন্দির নিয়ে যাবি?”

আমি উত্তর দিলাম, “নিশ্চয় বৌদি।”

বৌদি, “আজ বিকেলে?”

আমি, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি যাবো, তুমি যাবে, মা ছোটমা, সবাই তোমাকে নিয়ে যাবে।”

বিকেল গড়িয়ে আসে, আমি খুব খুশি ছিলাম, বৌদি অন্তত হাঁটতে পারছিলেন। আমি বৌদিকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলাম, লাল পাড় ঘিয়ে রঙের দামী তাঁতের শাড়ি। বৌদিকে দেখতে ঠিক মা দুর্গার মতন লাগছিল সেদিন। বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিছু পরে কষ্টে বললেন যে আলমারিতে একটা আকাশী নীল রঙের শাড়ি আছে, সেটা যেন আমি পরি। আমার বড়দা নাকি বউদির জন্য কিনেছিলেন সেই শাড়ি কিন্তু বৌদি আমাকে পড়তে বলে। আমি সেই শাড়ি পরে বউদির কাছে আসি। বাড়ির সবাই আমাকে সেই শাড়িতে দেখে বেশ খুশি হয়েছিল। মা আমার কপালে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করেন।

বড় বৌদি বিছানার ওপরে বসেছিলেন, সামনে একটা কাঠের বাক্স রাখা। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বড় বৌদি তাঁর সামনে বসতে বললেন। আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, চোখের চাহনি ঝাপসা হয়ে আসে বউদির।

আমি জিজ্ঞেস করি, “তুই কাঁদছ কেন বৌদি, তুমি ত এখন ঠিক হয়ে যাবে।”

কাকে কে প্রবোধ দেয়, হে ভগবান আমি জানতাম যে সেই প্রবোধ বাক্যের কোন মুল্য নেই। ঘড়ির কাঁটা অতি দ্রুত গতিতে ঘুরছে, হাতে সময় খুব কম। দম ফুরিয়ে এসেছে জীবনের কাটার, যেকোনো সময়ে থমকে যাবে হৃদপিণ্ড।

বৌদি আমাকে বলেন, “আমি দেখছি আমার সুন্দরী ননদকে।”

আমার হাতে সেই কাঠের বাক্স তুলে দিয়ে খুলতে বললেন। আমি খুলে দেখি যে সেটা বউদির গয়নার বাক্স। আমি হতভম্ব হয়ে বউদির দিকে তাকিয়ে থাকি। বৌদি কিছু না বলে সেই বাক্স থেকে একটা সোনার হাড় বের করে আমার গলায় পড়িয়ে দেয়। তারপরে এঁকে এঁকে বাকি গয়না গুলি আমাকে পড়িয়ে আমাকে সোনায় সাজিয়ে তোলে। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে আমার। শেষে আমার হাতে একটা মোটা বালা পড়িয়ে আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বলে সুমন্তদাকে ডাকতে। আমি সুমন্তদাকে ডেকে আনি।

বৌদি সুমন্তদাকে দেখে বলে, “দেখ তোমার বোনকে কত সুন্দরী দেখাচ্ছে। ঠিক যেন স্বগের পরী আমার সামনে বসে।”

বউদির হাবভাব দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে এক অজানা আশঙ্কায়। আমার গালে যখন হাত দিয়েছিলেন আমি সেই হাত গালের ওপরে চেপে ধরে থাকি। হটাত করে বৌদি কেঁপে ওঠেন, মনে হয় যেন শত সহস্র ঢেউ এসে বউদির শরীরে ধাক্কা দেয়। আমি দুহাতে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে মাকে ডাকি। সুমন্তদা বৌদিকে বিছানায় শুতে অনুরধ করেন।

বৌদি অতি কষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, “না বিছানায় নয়, আমাকে ওর কোলে শুতে দাও।”

আবার কেঁপে ওঠে বউদির বুক, ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত বের হতে শুরু হয়। বউদির ঠোঁট শুকিয়ে আসে। অতি কষ্টে ডান হাত তুলে আমার মাথায় রাখে।

আমি আমার শেষ শক্তি টুকু সঞ্চয় করে চেঁচিয়ে উঠি, “মা শিগগির এসো।”

সবাই দৌড়ে আসে।

বৌদি আমার মাথায় হাত চেপে ধরে বলেন, “তুই আমার পাসে আছিস, এই বারে আমি শান্তিতে শুতে পারব।”

আমি প্রাণপণে বৌদিকে বুকের সাথে চেপে ধরে জোরে বলি, “না না, তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পার না।”

বউদির বুকের রক্ত আমার শাড়ি, আমার বুক ভাসিয়ে দিয়েছিল। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, আমি চেপে ধরে বউদির উষ্ণতা অনুভব করার প্রানপন চেষ্টা করি। কিছু পরে বউদির হাত আমার মাথা থেকে এলিয়ে পরে যায়, কোলের ওপরে মাথা একপাসে বেঁকে যায়। গাছের ভাঙ্গা ডাল কোলে করে বসে থাকি আমি।

বড়দা আমার পাসে এসে আমার মাথা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। আমি কান্নার জন্য ঠিক ভাবে শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না। আমার কোলে অন্তিম নিদ্রায় শায়িত আমার প্রানের বৌদি, মৃত্যু কে বাধা দেওয়ার মতন ক্ষমতা আমার ছিলনা।

সুমন্তদা কেঁদে ওঠেন, “আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”

নবমির দিনে, আকাশে বাতাসে যখন আগমনীর সুর বাজে, আমি তখন আমার বউদির প্রাণহীন দেহ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমার সাধের, আমার পুজ্য মা দুর্গা কে একদিন আগেই বিসর্জন দিতে হয়।

আমি জানি, প্রতি বছর নতুন করে দুর্গা পুজো আসবে, কিন্তু আমার দেবী অন্নপূর্ণা, আমার পার্বতী বৌদি আমার কাছে কোনদিন আর ফিরে আসবে না।
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram - by Nefertiti - 04-11-2019, 12:18 PM



Users browsing this thread: 10 Guest(s)