04-11-2019, 12:14 PM
(This post was last modified: 04-11-2019, 12:25 PM by Nefertiti. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
[অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#01, #02), ভগ্ন হৃদয়ের সান্তনা]
অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#01)
ততদিনে শশাঙ্কদা টেলিফোনের জন্য আবেদন করে দিয়েছিলেন আর গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন চলে আসে। তারপর থেকে মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন কথা হত।
না সেই জুলাই মাসের পরে আমাকে কোনদিন ফোন করেনি ও। হয়ত করেছিল জানিনা আর ফোন হয়ত বা করেছিল কিন্তু ছোটমা বা বাবু হয়ত ফোন ধরেছিলেন আর আমাকে হয়ত দেওয়া হয়নি। আমি একদিন বাবুর ফোনের ডায়রিতে ব্যানারজি কাকুর ফোন নাম্বার খুঁজতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম অরুন্ধতির সাথে দেখা করতে, কিন্তু পারিনি, সেই চেষ্টাও বৃথা গেল আমার। আমি জানিনা কেন ও আমার সাথে দেখা করেনি। ও চলে যাওয়ার পরে ছোটমা ওর আর অরুন্ধতির সম্পর্কের কথা হাজার বার আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি ছোটমাকে সত্যি কথা জানাই যে আমি ওকে ভালবাসতাম আর ও আমাকে ভালবাসত। জানিনা, হয়ত আমার মাথায় হাত দিয়ে করা প্রতিজ্ঞার ফলে ও অনেক ব্যাথিত হয়েছিল আর তাই হয়ত মনে প্রানে চাইত যে আমার কোন ক্ষতি না হোক। হয়ত বা ওই অরুন্ধুতিকে আমার সাথে দেখা করতে বারন করেছিল বা হয়ত অরুন্ধুতি আমাকে ফোন করেছিল কিন্তু আমি সেই ফোনের উত্তর দিতে পারিনি।
মহালয়ার দুদিন পরের ঘটনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি বাথরুমে দাঁত ব্রাস করছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে ওঠে। বাবু অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েন, আর সেদিন বাবু সকাল সকাল বাজারে সেরে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। ফোন যখন বেজে ওঠে তখন বাবু ফোনের কাছেই ছিলেন আর ছোটমা রান্না ঘরে ছিলেন। বাথরুম থেকে আমি ওদের কথা শুনতে পাই।
বাবু, “পরীকে কি এই সব কথা জানাতে হবে?”
ছোটমা, “না এখুনি ওকে এই সব কথা জানিয়ে দরকার নেই। বাড়ি গিয়ে অবস্থা বুঝে দেখি তারপরে। আমি চাই না আমার মেয়ের এই পুজোর ছুটি এখুনি মাটি হয়ে যাক। দেখি পুজোর ছুটিতে কোথাও বেড়াতে বেড়িয়ে যাবো।”
আমি দাঁত ব্রাস করতে করতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ওদের কাছে এলাম। আমি জিজ্ঞেস করি, “কি হয়েছে?”
ছোটমা মাথা নাড়িয়ে কথা চেপে বললেন, “না কিছু হয়নি।”
বাবু আমার পাসে এসে দাঁড়িয়ে ছোটমাকে বললেন, “উলুপি, আমার মনে হয় পরীকে জানিয়ে দেওয়া উচিত।”
ছোটমা আমাকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে গাউন খুলতে নির্দেশ দিলেন, আমি ছোটমায়ের আচরনে অবাক হয়ে যাই। ছোটমা নিজেই আমার গাউনের ওপরের কয়েকটা বোতাম খুলে বুকের ওপরে হাত দিয়ে নেড়ে চেরে কি যেন দেখলেন। আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরি ছোটমায়ের আচরনে। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার বুকের বোঁটা থেকে কোন কিছু তরল বের হয় কিনা। আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে না বের হয় না।
ছোটমা আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নে, আমরা গ্রামের বাড়িতে যাবো।”
ছোটমায়ের আচরনে আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিলাম, আবার তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মন খুব উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিল। প্রথমেই আমার মায়ের কথা চিন্তা হয়েছিল, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি যে বাড়িতে কার কি হয়েছে।
ছোটমা উত্তর দিলেন, “তোর মা ভালো আছেরে সোনা মা। পুজোর ছুটি ত আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে আমি ভাবলাম কয়েক দিন আগেই তোকে বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
ছোটমা বাবুকে ট্যাক্সি ডাকতে বলে দিলেন। ট্যাক্সি চেপে আমি আর ছোটমা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ট্যাক্সিতে চেপে ছোটমা আমার কলেজের কথা আমার বন্ধু বান্ধবীদের কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি মাথা নেড়ে উত্তর দেই, কিন্তু মনের কোন এক গহিন কোনে সংশয় থেকে যায়। আমার মা ঠিক আছেন তাহলে বাড়ির অন্য কারুর কি কিছু হয়েছে। ছোটমা আমাকে কিছুতেই জানাতে দেয় না সেই কথা।
কথা ঘুরিয়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “নতুন বান্ধবী হল তোর?”
আমি বুঝে গেছিলাম যে আমার মনের উদ্ভিগ্নতা কম করার জন্য ছোটমা কথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে কথার রেশ টানছেন, সেই জন্য ত আমার দিদি আমার মা।
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “ছোটমা, কলেজে কি আর আধ খানা বান্ধবী হয়, সবাই ওখানে বন্ধু বান্ধবী।”
ছোটমা মাথা নাড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে বলেন, “সোনা মা, কলজের জীবন কলেজের জীবনের থেকে অনেক আলাদা। কলেজে সবাই মতলবি হয়, সবাই যেন বন্ধুতার বদলে কিছু চায়। এটা তোর গ্রাম নয় রে সোনা মা, এটা কোলকাতা, এখানে মানুষ মানুষকে তখনি চেনে যখন ওপর জনের কাছ থেকে কিছু পাবার আশা থাকে।”
আমি ছোটমাকে জানাই আমার দুটি ভালো বান্ধবীর ব্যাপারে, তিস্তা সরকার আর ডেলিসা খাতুন। ছোটমা বললেন, “পুজোর পরে ওদের বাড়িতে ডাক একদিন।”
আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে।"
আমি একটু ইতস্তত করে ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “ছোটমা, আমার কিছু বলার আছে।”
ছোটমা, “কি?”
আমি, “ছোটমা, আমার একটা সেলফোন চাই। আমার কলেজের বন্ধু বান্ধবীদের কাছে সেলফোন আছে ওদের সামনে কেমন যেন মনে হয় আমার। প্লিস ছোটমা।”
ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ঠিক আছে, পরের জন্মদিনে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”
আমি, “না ছোটমা, অনেক দেরি আমার জন্মদিন আসার।”
গত আগস্টে আমার জন্মদিন ছিল, পরের জন্মদিন মানে প্রায় এক বছর অপেক্ষা করা, আমার যেন তর সইছিল না। আমি মাথা নেড়ে আব্দার করে বলি, “না না ছোটমা আমার এখুনি চাই।”
ছোটমা, “ঠিক আছে, এই ক্রিস্টমাসে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”
আমি খুশিতে নেচে উঠে ছোটমায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই, “আমার আদরের ছোটমা।”
ছোটমা কলেজের টিচার, ছেলে মেয়েদের মানসিকতা নিয়ে প্রতি নিয়ত থাকতে হয়। ছোটমা জানতেন কি করে আমার মন ভুলান যায়, তাই আমার ছোটমাকে এত ভালো লাগত। কিন্তু কোন এক সময়ে মনে হত, কি করে ছোটমা ওর প্রতি অত নিষ্ঠুর আচরন করেছিলেন, কি করে নিজের ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
দুপুর নাগাদ আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেছিলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম। বাড়ির সবাই যেন আমাদের পথ চেয়ে বসেছিল। লক্ষ্য করলাম যে মা খাওয়ার ঘরে বসেছিল, মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী পাশেই দাঁড়িয়েছিল। দুপুর বেলা দেখে বাড়িতে শশাঙ্কদা আর সুব্রতদা ছিলেন না, বড়দা হয়ত মাঠে গেছেন আর পার্বতী বৌদি হয়ত বড়দা কে খাবার দিতে গেছেন। আমাকে দেখে মা আর মেঘনা বৌদি একটু হাসলেন।
আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, “কার কি হয়েছে?”
মা আমাকে উত্তর দিলেন, “পরী, তুই অনেক দূর থেকে এসেছিস, খেয়ে দেয়ে নে তারপরে কথা হবে। কারুর কিছু হয়নি এখানে সবাই ঠিক আছে।”
শেষের কথাগুলি বলার সময়ে মায়ের গলা কেন জানিনা কেঁপে উঠেছিল। চেহারার বেদনার ছায়া দেখেও আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা যে ঝড় আসছে।
ছোটমা বাড়িতে ঢুকে মাকে নিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে পরে। আমি মেঘনা বৌদিকে প্রশ্ন করাতে বৌদি সেই একি উত্তর দিলেন। আমি শেষ পর্যন্ত মৈথিলীকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু মৈথিলী আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমাকে দেখে দৌড়ে এসে কোলে চাপে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই। দুষ্টুর প্রথম প্রস্ন আমাকে জর্জরিত করে তোলে, “পিসি, তুমি একা কেন? অভি কাকু কোথায়?”
অনেক দিন পরে ওর মুখে সেই নাম শুনে মন হুহু করে কেঁদে ওঠে। মনে হল যেন পায়ের তলার মাটি নড়ে উঠেছে। দুষ্টুকে প্রাণপণে বুকের কাছে জড়িয়ে ওর নরম গালে ঠোঁট চেপে ধরি।
আমি অর দিকে ম্লান হেসে ঝাপসা চাহনি নিয়ে বলি, “পরের বার আসবে। অনেক দুরে গেছে চাকরি করতে নতুন চাকরি তাই এবারে পুজোর ছুটি পায়নি।”
আমি ওকে প্রবোধ দিলাম বটে, কিন্তু মনের মাঝে নিজেকে কি বলে প্রবোধ দেব সেই চিন্তা করি।
দুষ্টুর মুখে তারপরের বাক্য আমার পায়ের তলার মাটি নাড়িয়ে দিয়েছিল, “বড় জেঠিমা বুকে ব্যাথা নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি।”
আমি দুষ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার বুকের মাঝে আগে থেকেই এক প্রবল ঝড় বইছিল তার ওপরে ওই খবর শুনে আমার বুক ফেটে যায়। আমি ওকে কোলে নিয়েই দৌড়ে যাই ঘরে, যে ঘরে ছোটমা আর মা বসেছিলেন। পার্বতী বৌদি, সর্বদা আমার ভালো চেয়েছিলেন, সে কথা আমাকে ও বলেছিল।
আমি ছোটমা আর মায়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠি, “দুষ্টু কি বলছে, মা? তোমরা দুজনে আমার কাছ থেকে কি লুকিয়ে রেখেছ?”
আমি ভুলে গেছিলাম যে আমার কোলে দুষ্টু, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “কেন ছোটমা আমার বুক ধরে চেক করছিল?”
মা আমার কোল থেকে দুষ্টুকে নিয়ে অন্য ঘরে যেতে বলে। আমি লক্ষ্য করলাম যে ছোটমা আড়ালে নিজের চোখ মুছে নিলেন। আমি ছোটমায়ের কাছে এগিয়ে এসে পায়ের কাছে বস পরি।
ছোটমা আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “তোর বড় বৌদি ঠিক আছে। একটু বুকের ব্যাথা হয়েছে তাই ওকে নিয়ে হস্পিটালে গেছে, বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে তোর বড় বৌদি।”
আমি বিশ্বাস করিনা, “কিন্তু সকালে আমার বুক টিপে কি দেখছিলে তুমি?”
ছোটমা, “কিছু না এমনি একটু চেক করছিলাম।”
আমি ছোটমায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারিনা যে বড় বউদির শুধু মাত্র একটু বুক ব্যাথা হয়েছে, “না, তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে কথা বলছ।”
মা ছোটমায়ের দিকে ইশারা করে যাতে আমাকে কিছু না জানানো হয়, আমি সেই ইশারা লক্ষ্য করি আর বড় ব্যাথা জাগে বুকের ভেতরে সেই দেখে। আমি কাতর চোখে ছোটমাকে প্রশ্ন করি, “প্লিস ছোটমা, বল না কি হয়েছে।”
ছোটমা বুক ভরা এক নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলেন, “পার্বতীর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে।”
আমার ছোটো পাখীর মতন বুকে আর কত ঝড় আসবে সেটা বুঝে পাইনা। আমি ছোটমায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ফেলি। আমি চিৎকার করে উঠি, “না এ হতে পারে না।”
ছোটমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “জ্যাতস হি ধুব মৃত্যু, ধ্রুভম জন্ম ম্রিতশ্যচ, তস্মাদ অপরিহার*্যথে, নঃ ত্বম সচিতুম অরহসি।”
আমি সেই সংস্কৃত শ্লোক শুনে রেগে যাই, চিৎকার করে বলি, “ছোটমা তোমার সংস্কৃত শ্লোক কি আমার পার্বতী বৌদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে? আমি রক্ত মাংসের ছোটো একটি মেয়ে। আমাকে শুধু এই টুকু বল, কেন আমার জীবনের সব রঙ মুছে যায় বারে বারে।”
ছোটমা আমার মুখ খানি আঁজলা করে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বলেন, “সোনা মা, তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, জীবনের অনেক কিছু তোর এখন বোঝা উচিত।”
আমি মাথা দুলিয়ে জোরে বলি, “না না না, আমি এখুনি বউদির কাছে যেতে চাই।” ছোটমা আমাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেন সেদিন।
বিকেল হয়ে সন্ধ্যে গড়িয়ে আসে, দাদারা কেউ ফেরে না দেখে আমি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। বুকের মাঝে চরম সত্যি কথা শোনার জন্য মন বেঁধে তৈরি হয়ে নেই। এক সেকেন্ড যেন আমার কাছে এক বছরের মতন মনে হয়। এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে, আমি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরি, ওপর পাসে সুব্রত।
আমাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “তুই এখানে কখন এলি?”
আমি জোর গলায় বলি, “আগে আমাকে বল যে বৌদি কেমন আছে?”
সুব্রত, “মাকে ফোন দে।”
আমি চেঁচিয়ে উঠি, “না আমি মাকে ফোন দেব না, আমি কি এই বাড়ির কেউ নই যে আমাকে বউদির কথা বলা যাবেনা?”
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, আমি চোখ চেপে বন্ধ করে থাকি চরম খবর শোনার জন্য। সুব্রত বলে, “বৌদি এখন ঘুমাচ্ছে, তাঁর কেমথেরাপি শুরু হয়ে গেছে। এবারে মাকে একটু ফোন দে।”
অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#01)
ততদিনে শশাঙ্কদা টেলিফোনের জন্য আবেদন করে দিয়েছিলেন আর গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন চলে আসে। তারপর থেকে মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন কথা হত।
না সেই জুলাই মাসের পরে আমাকে কোনদিন ফোন করেনি ও। হয়ত করেছিল জানিনা আর ফোন হয়ত বা করেছিল কিন্তু ছোটমা বা বাবু হয়ত ফোন ধরেছিলেন আর আমাকে হয়ত দেওয়া হয়নি। আমি একদিন বাবুর ফোনের ডায়রিতে ব্যানারজি কাকুর ফোন নাম্বার খুঁজতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম অরুন্ধতির সাথে দেখা করতে, কিন্তু পারিনি, সেই চেষ্টাও বৃথা গেল আমার। আমি জানিনা কেন ও আমার সাথে দেখা করেনি। ও চলে যাওয়ার পরে ছোটমা ওর আর অরুন্ধতির সম্পর্কের কথা হাজার বার আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি ছোটমাকে সত্যি কথা জানাই যে আমি ওকে ভালবাসতাম আর ও আমাকে ভালবাসত। জানিনা, হয়ত আমার মাথায় হাত দিয়ে করা প্রতিজ্ঞার ফলে ও অনেক ব্যাথিত হয়েছিল আর তাই হয়ত মনে প্রানে চাইত যে আমার কোন ক্ষতি না হোক। হয়ত বা ওই অরুন্ধুতিকে আমার সাথে দেখা করতে বারন করেছিল বা হয়ত অরুন্ধুতি আমাকে ফোন করেছিল কিন্তু আমি সেই ফোনের উত্তর দিতে পারিনি।
মহালয়ার দুদিন পরের ঘটনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি বাথরুমে দাঁত ব্রাস করছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে ওঠে। বাবু অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েন, আর সেদিন বাবু সকাল সকাল বাজারে সেরে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। ফোন যখন বেজে ওঠে তখন বাবু ফোনের কাছেই ছিলেন আর ছোটমা রান্না ঘরে ছিলেন। বাথরুম থেকে আমি ওদের কথা শুনতে পাই।
বাবু, “পরীকে কি এই সব কথা জানাতে হবে?”
ছোটমা, “না এখুনি ওকে এই সব কথা জানিয়ে দরকার নেই। বাড়ি গিয়ে অবস্থা বুঝে দেখি তারপরে। আমি চাই না আমার মেয়ের এই পুজোর ছুটি এখুনি মাটি হয়ে যাক। দেখি পুজোর ছুটিতে কোথাও বেড়াতে বেড়িয়ে যাবো।”
আমি দাঁত ব্রাস করতে করতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ওদের কাছে এলাম। আমি জিজ্ঞেস করি, “কি হয়েছে?”
ছোটমা মাথা নাড়িয়ে কথা চেপে বললেন, “না কিছু হয়নি।”
বাবু আমার পাসে এসে দাঁড়িয়ে ছোটমাকে বললেন, “উলুপি, আমার মনে হয় পরীকে জানিয়ে দেওয়া উচিত।”
ছোটমা আমাকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে গাউন খুলতে নির্দেশ দিলেন, আমি ছোটমায়ের আচরনে অবাক হয়ে যাই। ছোটমা নিজেই আমার গাউনের ওপরের কয়েকটা বোতাম খুলে বুকের ওপরে হাত দিয়ে নেড়ে চেরে কি যেন দেখলেন। আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরি ছোটমায়ের আচরনে। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার বুকের বোঁটা থেকে কোন কিছু তরল বের হয় কিনা। আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে না বের হয় না।
ছোটমা আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নে, আমরা গ্রামের বাড়িতে যাবো।”
ছোটমায়ের আচরনে আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিলাম, আবার তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মন খুব উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিল। প্রথমেই আমার মায়ের কথা চিন্তা হয়েছিল, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি যে বাড়িতে কার কি হয়েছে।
ছোটমা উত্তর দিলেন, “তোর মা ভালো আছেরে সোনা মা। পুজোর ছুটি ত আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে আমি ভাবলাম কয়েক দিন আগেই তোকে বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
ছোটমা বাবুকে ট্যাক্সি ডাকতে বলে দিলেন। ট্যাক্সি চেপে আমি আর ছোটমা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ট্যাক্সিতে চেপে ছোটমা আমার কলেজের কথা আমার বন্ধু বান্ধবীদের কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি মাথা নেড়ে উত্তর দেই, কিন্তু মনের কোন এক গহিন কোনে সংশয় থেকে যায়। আমার মা ঠিক আছেন তাহলে বাড়ির অন্য কারুর কি কিছু হয়েছে। ছোটমা আমাকে কিছুতেই জানাতে দেয় না সেই কথা।
কথা ঘুরিয়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “নতুন বান্ধবী হল তোর?”
আমি বুঝে গেছিলাম যে আমার মনের উদ্ভিগ্নতা কম করার জন্য ছোটমা কথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে কথার রেশ টানছেন, সেই জন্য ত আমার দিদি আমার মা।
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “ছোটমা, কলেজে কি আর আধ খানা বান্ধবী হয়, সবাই ওখানে বন্ধু বান্ধবী।”
ছোটমা মাথা নাড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে বলেন, “সোনা মা, কলজের জীবন কলেজের জীবনের থেকে অনেক আলাদা। কলেজে সবাই মতলবি হয়, সবাই যেন বন্ধুতার বদলে কিছু চায়। এটা তোর গ্রাম নয় রে সোনা মা, এটা কোলকাতা, এখানে মানুষ মানুষকে তখনি চেনে যখন ওপর জনের কাছ থেকে কিছু পাবার আশা থাকে।”
আমি ছোটমাকে জানাই আমার দুটি ভালো বান্ধবীর ব্যাপারে, তিস্তা সরকার আর ডেলিসা খাতুন। ছোটমা বললেন, “পুজোর পরে ওদের বাড়িতে ডাক একদিন।”
আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে।"
আমি একটু ইতস্তত করে ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “ছোটমা, আমার কিছু বলার আছে।”
ছোটমা, “কি?”
আমি, “ছোটমা, আমার একটা সেলফোন চাই। আমার কলেজের বন্ধু বান্ধবীদের কাছে সেলফোন আছে ওদের সামনে কেমন যেন মনে হয় আমার। প্লিস ছোটমা।”
ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ঠিক আছে, পরের জন্মদিনে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”
আমি, “না ছোটমা, অনেক দেরি আমার জন্মদিন আসার।”
গত আগস্টে আমার জন্মদিন ছিল, পরের জন্মদিন মানে প্রায় এক বছর অপেক্ষা করা, আমার যেন তর সইছিল না। আমি মাথা নেড়ে আব্দার করে বলি, “না না ছোটমা আমার এখুনি চাই।”
ছোটমা, “ঠিক আছে, এই ক্রিস্টমাসে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”
আমি খুশিতে নেচে উঠে ছোটমায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই, “আমার আদরের ছোটমা।”
ছোটমা কলেজের টিচার, ছেলে মেয়েদের মানসিকতা নিয়ে প্রতি নিয়ত থাকতে হয়। ছোটমা জানতেন কি করে আমার মন ভুলান যায়, তাই আমার ছোটমাকে এত ভালো লাগত। কিন্তু কোন এক সময়ে মনে হত, কি করে ছোটমা ওর প্রতি অত নিষ্ঠুর আচরন করেছিলেন, কি করে নিজের ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
দুপুর নাগাদ আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেছিলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম। বাড়ির সবাই যেন আমাদের পথ চেয়ে বসেছিল। লক্ষ্য করলাম যে মা খাওয়ার ঘরে বসেছিল, মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী পাশেই দাঁড়িয়েছিল। দুপুর বেলা দেখে বাড়িতে শশাঙ্কদা আর সুব্রতদা ছিলেন না, বড়দা হয়ত মাঠে গেছেন আর পার্বতী বৌদি হয়ত বড়দা কে খাবার দিতে গেছেন। আমাকে দেখে মা আর মেঘনা বৌদি একটু হাসলেন।
আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, “কার কি হয়েছে?”
মা আমাকে উত্তর দিলেন, “পরী, তুই অনেক দূর থেকে এসেছিস, খেয়ে দেয়ে নে তারপরে কথা হবে। কারুর কিছু হয়নি এখানে সবাই ঠিক আছে।”
শেষের কথাগুলি বলার সময়ে মায়ের গলা কেন জানিনা কেঁপে উঠেছিল। চেহারার বেদনার ছায়া দেখেও আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা যে ঝড় আসছে।
ছোটমা বাড়িতে ঢুকে মাকে নিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে পরে। আমি মেঘনা বৌদিকে প্রশ্ন করাতে বৌদি সেই একি উত্তর দিলেন। আমি শেষ পর্যন্ত মৈথিলীকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু মৈথিলী আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমাকে দেখে দৌড়ে এসে কোলে চাপে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই। দুষ্টুর প্রথম প্রস্ন আমাকে জর্জরিত করে তোলে, “পিসি, তুমি একা কেন? অভি কাকু কোথায়?”
অনেক দিন পরে ওর মুখে সেই নাম শুনে মন হুহু করে কেঁদে ওঠে। মনে হল যেন পায়ের তলার মাটি নড়ে উঠেছে। দুষ্টুকে প্রাণপণে বুকের কাছে জড়িয়ে ওর নরম গালে ঠোঁট চেপে ধরি।
আমি অর দিকে ম্লান হেসে ঝাপসা চাহনি নিয়ে বলি, “পরের বার আসবে। অনেক দুরে গেছে চাকরি করতে নতুন চাকরি তাই এবারে পুজোর ছুটি পায়নি।”
আমি ওকে প্রবোধ দিলাম বটে, কিন্তু মনের মাঝে নিজেকে কি বলে প্রবোধ দেব সেই চিন্তা করি।
দুষ্টুর মুখে তারপরের বাক্য আমার পায়ের তলার মাটি নাড়িয়ে দিয়েছিল, “বড় জেঠিমা বুকে ব্যাথা নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি।”
আমি দুষ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার বুকের মাঝে আগে থেকেই এক প্রবল ঝড় বইছিল তার ওপরে ওই খবর শুনে আমার বুক ফেটে যায়। আমি ওকে কোলে নিয়েই দৌড়ে যাই ঘরে, যে ঘরে ছোটমা আর মা বসেছিলেন। পার্বতী বৌদি, সর্বদা আমার ভালো চেয়েছিলেন, সে কথা আমাকে ও বলেছিল।
আমি ছোটমা আর মায়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠি, “দুষ্টু কি বলছে, মা? তোমরা দুজনে আমার কাছ থেকে কি লুকিয়ে রেখেছ?”
আমি ভুলে গেছিলাম যে আমার কোলে দুষ্টু, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “কেন ছোটমা আমার বুক ধরে চেক করছিল?”
মা আমার কোল থেকে দুষ্টুকে নিয়ে অন্য ঘরে যেতে বলে। আমি লক্ষ্য করলাম যে ছোটমা আড়ালে নিজের চোখ মুছে নিলেন। আমি ছোটমায়ের কাছে এগিয়ে এসে পায়ের কাছে বস পরি।
ছোটমা আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “তোর বড় বৌদি ঠিক আছে। একটু বুকের ব্যাথা হয়েছে তাই ওকে নিয়ে হস্পিটালে গেছে, বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে তোর বড় বৌদি।”
আমি বিশ্বাস করিনা, “কিন্তু সকালে আমার বুক টিপে কি দেখছিলে তুমি?”
ছোটমা, “কিছু না এমনি একটু চেক করছিলাম।”
আমি ছোটমায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারিনা যে বড় বউদির শুধু মাত্র একটু বুক ব্যাথা হয়েছে, “না, তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে কথা বলছ।”
মা ছোটমায়ের দিকে ইশারা করে যাতে আমাকে কিছু না জানানো হয়, আমি সেই ইশারা লক্ষ্য করি আর বড় ব্যাথা জাগে বুকের ভেতরে সেই দেখে। আমি কাতর চোখে ছোটমাকে প্রশ্ন করি, “প্লিস ছোটমা, বল না কি হয়েছে।”
ছোটমা বুক ভরা এক নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলেন, “পার্বতীর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে।”
আমার ছোটো পাখীর মতন বুকে আর কত ঝড় আসবে সেটা বুঝে পাইনা। আমি ছোটমায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ফেলি। আমি চিৎকার করে উঠি, “না এ হতে পারে না।”
ছোটমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “জ্যাতস হি ধুব মৃত্যু, ধ্রুভম জন্ম ম্রিতশ্যচ, তস্মাদ অপরিহার*্যথে, নঃ ত্বম সচিতুম অরহসি।”
আমি সেই সংস্কৃত শ্লোক শুনে রেগে যাই, চিৎকার করে বলি, “ছোটমা তোমার সংস্কৃত শ্লোক কি আমার পার্বতী বৌদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে? আমি রক্ত মাংসের ছোটো একটি মেয়ে। আমাকে শুধু এই টুকু বল, কেন আমার জীবনের সব রঙ মুছে যায় বারে বারে।”
ছোটমা আমার মুখ খানি আঁজলা করে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বলেন, “সোনা মা, তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, জীবনের অনেক কিছু তোর এখন বোঝা উচিত।”
আমি মাথা দুলিয়ে জোরে বলি, “না না না, আমি এখুনি বউদির কাছে যেতে চাই।” ছোটমা আমাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেন সেদিন।
বিকেল হয়ে সন্ধ্যে গড়িয়ে আসে, দাদারা কেউ ফেরে না দেখে আমি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। বুকের মাঝে চরম সত্যি কথা শোনার জন্য মন বেঁধে তৈরি হয়ে নেই। এক সেকেন্ড যেন আমার কাছে এক বছরের মতন মনে হয়। এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে, আমি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরি, ওপর পাসে সুব্রত।
আমাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “তুই এখানে কখন এলি?”
আমি জোর গলায় বলি, “আগে আমাকে বল যে বৌদি কেমন আছে?”
সুব্রত, “মাকে ফোন দে।”
আমি চেঁচিয়ে উঠি, “না আমি মাকে ফোন দেব না, আমি কি এই বাড়ির কেউ নই যে আমাকে বউদির কথা বলা যাবেনা?”
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, আমি চোখ চেপে বন্ধ করে থাকি চরম খবর শোনার জন্য। সুব্রত বলে, “বৌদি এখন ঘুমাচ্ছে, তাঁর কেমথেরাপি শুরু হয়ে গেছে। এবারে মাকে একটু ফোন দে।”