19-01-2019, 09:48 AM
পর্ব ২৯- বিবেক দংশনঃ
নিজেকে দ্রুত সামলে নেয় বংশী, মালার শরীর থেকে নিজেকে কিছুটা দুরত্বে নিয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বংশী। যে শরীরটাকে একটিবার স্পর্শ করার জন্য ও পাগল হয়ে যেত আজ সেই শরীর ই ওকে বটবৃক্ষের মত আশ্রয় দিয়ে হতাশার করুন তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বংশী। একি মালা, নাকি কোনও দেবী। মনে মনে বলে ওঠে বংশী “কেন স্পর্শ করলে এই পাপের শরীরটা, তুমি তো পবিত্র দেবী, গঙ্গা তুমি। যুগে যুগে মানুষ তোমার দিকে আঙুল তুলেছে, বলেছে তুমি অপবিত্র, তুমি তো তা নও মালা” বংশীর হৃদয়ের কোনও এক কোনে এক তীব্র অভিমান লুকিয়ে আছে, সেই অভিমান সুপ্রতীকের জন্য। মনে মনে বলে ওঠে বংশী “সুপ্রতীক তুমি আজও আমার কাছে হারলে, তোমার মালাকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দয়া করলাম। তুমি তো রাজা। আমার মত সামান্য এক জীবকে বোকা বানানোর জন্য নিজের স্ত্রীকে ব্যবহার করলে? এ তুমি কেমন রাজা সুপ্রতীক? যদি আজও আমি জানোয়ার থাকতাম, যদি মালার শরীরটা মাটিতে ফেলে পিষে দিতাম তুমি কি তাকে গ্রহন করতে? তুমি কে মালা? তুমি কি সিতা না তুমি পাঞ্চালী? কেন তোমাদের প্রতিদিন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে?”
মালা চেয়েছিল এক অনুতপ্ত মানুষের আশ্রয় হতে, মালা চেয়েছিল এক দুর্বল মানুষের আশ্রয় হতে। মালা কি অপরাধ করে ফেলল? যতই হোক পরপুরুষকে স্পর্শ এতো ধর্মের বিরোধী? হয়ত এই প্রশ্নগুলোই মালার মনে ঘুরপাক খেয়ে চলেছিল। উত্তরটা মালা পেয়েছিল কিনা জানিনা। বস্ত্রহরণের পর শুধু কৃষ্ণের দুই চরন স্পর্শ, অথবা মাটির বুক চিরে পাতালে প্রবেশ করা এই তো ওদের ভবিতব্য। পাণ্ডবের সভায় দাঁড়িয়ে পাঞ্চালী চিৎকার করে যুধিষ্ঠিরকে বলছে আমি পন্য নই, আমি পাশাখেলার বাজি নই- এতো স্বপ্নাতীত সুবীরবাবু। ওদের অভিমান করার অধিকার আছে, প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। আমাদের ধর্ম, রামায়ন, মহাভারত এই তো আমাদের শিখিয়ে এসেছে। ঠিক বলছি তো সুবীরবাবু। কেন জানেন? রামায়ন মহাভারত দুই ই তো পুরুষের রচনা, ওরা কি আর নারীর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দেবে। আর যদি কোনও নারী চায় চিরাচরিত এই সত্যের বিরধিতা করতে তাকে তো আমরা চিতার আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছি। হয়ত মালার ওইভাবে বংশীকে জড়িয়ে ধরা আপনার ও চোখে অপরাধ, আমি জানি অপরাধ। কিন্তু সুবীরবাবু মালা এর জন্য অনুতপ্ত নয়। হাজারো বার অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিতে মালা এভাবেই বংশীকে জড়িয়ে ধরবে। মালা পবিত্র, গঙ্গার মত পবিত্র। সুবীরবাবু মালতি ও মালা হতে চেয়েছিল, আপনারাই ওকে মালা হতে দেননি, কখনো সমাজ, কখনো পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করে ওকে মালা হতে দেননি। যাই হোক ছাড়ুন আমরা বরং গল্পে চলে আসি।
নতুন এক বীরের জন্ম হয় এই জঙ্গলে যার নাম বংশী, একজন মানুষ বংশী, যে জানে কাল ই তার মৃত্যু আসন্ন। নিজের চোখের সামনে মৃত্যুর বিভীষিকা দেখতে পেয়েছিল বংশী। মরার আগে একটিবার ভালো কিছু করতে চায় বংশী। বংশী নিজের বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় মালার সম্মান রক্ষা করে মালাকে সুপ্রতীকের কাছে ও পৌঁছে দেবে। শুধু মালার ই কথা ভেবে ও জমিদারবাড়িকে রক্ষা করবে। এতক্ষনে মালাও শান্ত হয়। ও জানে ওর মাতৃআশ্রয়ে বংশী নিরাপদ, বংশীর হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। বংশীর দিকে তাকিয়ে মালা বলে ওঠে
মালাঃ বংশী তুমি সকাল থেকে কিছু খাওনি। নায়েবমশাই কিছু খাবার দিয়ে গেছেন। কুটিরের মধ্যে রাখা আছে, আমি নিয়ে আসছি।
মালার দিকে তাকিয়ে একবার হাসে বংশী। এই হাসির মধ্যে সামান্য কোনও কুটিলতা ছিলনা, ছিল শুধুই প্রশান্তি।
বংশীঃ আমি কিছুক্ষন পরে খাবো রানীমা। আগে আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। জানিনা আপনি কিভাবে গ্রহন করবেন। বলতে পারেন কিছু সত্যি কথা বলতে চাই। এগুলো জানা আপনার দরকার।
মালা শান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে বংশীর দিকে। হয়ত সিলিং সাহেবের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েও এতো বড় সত্য বংশীর মুখ থেকে নির্গত হতনা, কিন্তু বিবেকের দংশন যে বড়ই জ্বালা দেয়। মাথা উঁচু করে বংশী বলে ওঠে
বংশীঃ রানীমা, সিলিং সাহেবের ভাই টমাসকে আমি ই হত্যা করেছি। জমিদারবাড়ির সবচেয়ে বড় শত্রু আমি। যা করেছি সব শুধুই জমিদারবাড়ির আর জমিদারবাবুর ক্ষতি করার জন্য।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে বংশী। মালা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বংশীর দিকে। বংশী পারেনা ওই শান্ত শীতল নজরের সাথে নিজের নজর মিলিয়ে দিতে। মাথা নীচু করে লজ্জায় দাঁড়িয়ে থাকে বংশী।
মালাঃ কেন এরকম করলে বংশী? তোমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার বদলা নেওয়ার জন্য তুমি নিজেও তো অন্যায় ই করলে বংশী। জমিদারবাড়ির শত্রু কে আমি জানিনা কিন্তু বংশীর সবচেয়ে বড় শত্রু বংশী নিজেই। তুমি ভালো মানুষ হতে পারতে বংশী। অন্যায় আমার সাথেও কম হয়নি।
বংশীর হৃদয়টা মালার কথায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে জমে থাকা একরাশ অভিমান বাইরে বেরিয়ে আসে
বংশীঃ আপনার পাশে জমিদারবাবু ছিলেন, জমিদারবাবুর পাশে আপনি ছিলেন। আমার পাশে কে ছিল রানীমা? ক্ষিদের যন্ত্রণা কি তাকি আপনি বোঝেন? ভালোবাসা, সংসার, প্রেম এতো শুধুই বড়লোকের সম্পত্তি রানিমা। আমাদের তো বেঁচে থাকার জন্যই বাঁচা। আমাদের কি আর এতো ভালমন্দের বিচার করলে চলে। আমি আপনাকে দেখে, আপনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালমানুষটাকে দেখে পাল্টাইনি রানিমা। আপনি হয়ত এখনো বিশ্বাস করেননা, আমি সত্যি ই নিজের মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। বংশীর চালাকি ফাঁস হয়ে গেছে। আমি শেষ রানিমা।
মালা কোনও উত্তর দিতে পারেনা। একবার বংশীর দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নেয়।
বংশীঃ কিন্তু আমায় কাপুরুষ ভাববেন না। আমি চাইলে এখনো লড়ে যেতে পারতাম। শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি লড়তে জানি। কেউ হয়ত বিশ্বাস করবেনা, কিন্তু এটা সত্যি এই রনক্ষেত্রে যোদ্ধা অনেকে, কিন্তু মানুষ একজন ই। সে আপনি রানীমা। আপনার চোখের সরলতা আমি দেখেছি। সুরঙ্গের অন্ধকার থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আপনি যখন বাইরে এলেন কে যেন আমার ভেতর থেকে বলে উঠল “কি দরকার বংশী, কি লাভ এই লড়াইতে?” আমি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিনি, আমি শুধু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। মানুষ তো একজন ই, সেটা আপনি রানীমা।
অবাক হয়ে বংশীর দিকে তাকায় মালা। একটা কথাও ওর মুখ ফুটে বাইরে আসেনা। মালা যে ধর্মসঙ্কটে পড়ে গেছে। কারপক্ষ ও নেবে? নিষ্ঠাবতী পত্নীর দায়িত্ব সমস্ত কিছু সুপ্রতীককে বলে বংশীকে শাস্তি দেওয়া। আর মানবিক মালার দায়িত্ব এই নতুন বংশীর পাশে থাকা, মায়ের মত আগলে রাখা।
বংশীঃ না রানীমা, আমি আপনার থেকে কিছুই চাইনা, প্রানভিক্ষাও না। কাল সকালেই আমি সিলিং সাহেবের কাছে গিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করবো। এতেই সবার মুক্তি। জমিদারবাবু নিজের প্রজাদের মনে আগের জায়গা ফিরে পাবেন, সিলিং সাহেবের সাথে শুরু হওয়া এই দ্বন্দের ও অবসান ঘটবে। আমি মুক্তি চাই রানীমা। আমি মৃত্যুকে আলীঙ্গন করতে চাই রানীমা।
আর পারেনা মালা, বংশীর দিকে এগিয়ে আসে। বংশীর দুহাত ধরে বলে ওঠে “তুমি মানুষ বংশী, তুমি প্রকৃত মানুষ। তুমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও” মাথা নিচু করে বংশী বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত হতাশা, মান অভিমান কাটিয়ে বলে ওঠে
বংশীঃ আমি বেইমানি করেছি একটা অবিচারের জায়গা থেকে। আমি আপনার নজরে, জমিদারবাবুর নজরে খারাপ। কিন্তু রানীমা, আমার চেয়েও বড় জানোয়ার একজন রয়েছে। যে প্রতিমুহূর্তে জমিদারবাড়ির সর্বনাশ করে চলেছে।
নির্বাক হয়ে বংশীর দিকে তাকিয়ে থাকে মালা, হয়ত ওর এই নীরবতা একটাই কথা বলে চলেছে “কে সেই বেইমান বংশী? কে সে”
বংশীঃ ঠাকুর ডাকাতের দল তৈরি হওয়ার পর থেকেই জমিদারবাড়িতে টাকাপয়সা, গয়না এইসব রাখা নিরাপদ ছিলনা। তখন থেকেই শুরু হয় গোপন কোনও স্থানে এইসব সম্পত্তি সরিয়ে ফেলার কাজ। এই গুপ্তধনের গল্প সুতানুটির আকাশে বাতাসে এখনো ঘুরে বেড়ায়। এই গুপ্তধনের ই লোভ জমিদারবাড়ির সবচেয়ে বড় শত্রুর জন্ম দেয়। সে আর কেউ নয় আমাদের নায়েবমশাই। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী, আমি তো খলনায়ক হয়েছি একটা অসুস্থ সমাজের জন্য আর নায়েবমশাই সবকিছু পেয়েও শুধুই অর্থের লোভে জানোয়ার হয়েছেন।
প্রায় চমকে ওঠে মালা। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে “নায়েবমশাই!” বংশীর কথা প্রথমবারেই হয়ত মালার বিশ্বাস হয়না কিন্তু মালা জানে বংশী মিথ্যে বলছেনা।
বংশীঃ রানীমা, নায়েবমশাই সব জানেন। উনি ইচ্ছে করেই আপনাকে জমিদারবাড়িতে নিয়ে যাননি। ওই মিষ্টি হাসিটার অন্তরালের লোকটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর। আমাদের হাতে সময় খুব কম রানীমা। এই জঙ্গলে আমার সাথে আপনাকে একা রেখে দেওয়ার পেছনেও নায়েবমশাইএর নিশ্চয়ই কোনও চাল আছে। কাল ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমাদের এখান থেকে রওনা দিতে হবে।
স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে মালা। এই যুদ্ধক্ষেত্র ও চায়নি, এই রাজনীতি এতো মিথ্যাচার এও ও চায়নি। ও চেয়েছিল দুদণ্ড শান্তি আর নিজের স্বামীর একটু ভালোবাসা। হয়ত জীবনটা এরকম ই হয়। নিজেকে শান্ত করে মালা। যে লোকটা আজ জমিদারবাড়ির সবচেয়ে বড় বন্ধু কাল অবধি সেই ছিল ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর বন্ধু ভেবে যাকে ওরা নির্ভর করে চলেছে সেই হোল সবচেয়ে বড় শত্রু। এই জটিলতা থেকে মালা একটু মুক্তি চায়। সতির চিতা থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সময় ও একবার ও ভাবেনি যে বেঁচে যাবে। এক মহানুভব পুরুষ ওকে রক্ষা করেছিল। প্রান বাঁচলেও ভাবেনি ওর আশ্রয় হবে। অবশেষে আশ্রয়ের সাথে সাথে স্ত্রীর মর্যাদাও ও পেয়ে যায়। মালা চেয়েছিল সেই মহান মানুষটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে। ভাবেনি এতবড় দুর্দিনের মধ্যে তার মনের মানুষকে পড়ে যেতে হবে। কে মিত্র কে যে শত্রু তা নিয়ে আর ভাবার মানসিক শক্তি মালার শরীরে অবশিষ্ট নেই। মালা শুধু এটাই জানে ওর শত্রু একজন, শুধুই একজন, সে হোল সমাজ। এই সমাজ ই ওকে সতি বলে চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এই সমাজ ই একটা মৃত্যুশয্যার বৃদ্ধর স্ত্রী বানিয়ে ওর জীবনটা শেষ করেছিল। হয়ত মনে মনে একবার বলে মালা “ভগবান আর কতকাল আমরা এভাবে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে যাবো”
মালার এই ভাবুক মুখটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে বংশী। বংশীর হৃদয়ে বিবেক যন্ত্রণার আর সামান্য কণাটুকু অবশিষ্ট নেই। নিজের সমস্ত পাপ মালার সামনে উদ্রেক করে ও আজ মুক্ত। মরতেও ওর আর কোনও ভয় নেই। মালার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে
বংশীঃ রানিমা কোনও চিন্তা করবেন না। আমি থাকতে জমিদারবাবুর বা আপনার কোনও বিপদ ই হবেনা। আপনি নিশ্চিন্তে কুটিরের মধ্যে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমিও খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নি। কাল ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমরা এখান থেকে চলে যাবো।
বংশীর দিকে তাকিয়ে একবার স্ফীত একটা হাসি হাসে মালা। বংশী জানে এই হাসির মধ্যে হয়ত সেই প্রানবন্ততা নেই কিন্তু রয়েছে গভীর বিশ্বাস। দীঘির দিকে এগিয়ে যায় বংশী। একটা ফুরফুরে হাওয়া ওপাশ থেকে বয়ে আসছিল, বংশী জানেনা এই বাতাস ওর জীবনের শেষ আমেজ কিনা। নিজের বিবেকের কাছে জয়ী হয়ে সেই প্রানবন্ত হাওয়ার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দেয় বংশী। কতক্ষন যে এভাবে ও ছিল নিজেও খেয়াল করেনি, পেছন ঘুরে দেখে মালা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে খাবারের পাত্র। বংশীর দিকে তাকিয়ে মালা বলে ওঠে
মালাঃ খেয়ে নাও বংশী। কাল যা হবে তা কাল ই দেখা যাবে। কিন্তু এখন খেয়ে নাও।
মালার হাত থেকে খাবারের পাত্রটা গ্রহন করে বংশী। সামান্য হেঁসে মালা ফিরে যায় কুটিরের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বংশী। ওপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে “পরের জন্মে আমায় মানুষ করে পাঠিও ভগবান” বেশকিছুক্ষন ওখানে দাঁড়ানোর পর বংশীও কুটিরের দিকে যেতে শুরু করে। কুটিরের ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটা দিয়ে বোঝা যায় মালা শুয়ে পড়েছে। বাইরের চাতানে বংশীও নিজের শরীরটা ফেলে দেয়। সারাদিনের ক্লান্তি হতাশা ধীরেধীরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চোখ দুটো বুজে আসে।
ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। সমস্ত জঙ্গল জুড়ে পাখিদের কুহুতান শুরু হয়ে গেছে। ধীরেধীরে উঠে বসে বংশী। ঘুমের আবরণটা শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দীঘির দিকে এগিয়ে যায়। হাতে আঁচলা করে জল নিয়ে ভালো করে মুখে ঝাপটা দেয়। ওদের খুব দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে ওরা? জমিদারবাড়ি? যদি কালরাতে বংশীকে মালার কাছে ছেড়ে দেওয়াটা নায়েবমশাই এর কোনও ষড়যন্ত্র হয় তাহলে? হথাত ই বংশীর পিঠে প্রচণ্ড শক্ত একটা লোহার নল স্পর্শ করে। প্রায় চমকে গিয়ে পেছনঘুরে দেখে বংশী। হয়ত এরকম ই একটা কোনও আশঙ্কা করেছিল বংশী। বংশীর ঠিক পেছনে সিলিং সাহেব, পেছনে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিশাল একটা দল। আর কিছুটা দূরে সেই পরিচিত শয়তানি হাসিটার সাথে নায়েবমশাই। হয়ত বংশী জানত এরকম ই কিছু একটা হবে, তাই হয়ত স্বাভাবিক ভীতিবোধটা প্রকাশ না করে নায়েবমশাইকে অনুরুপ একটা হাসি ফেরত দিল। ওর এই হাসি সিলিং সাহেবের যে সহ্য হবেনা তা ও জানত।
সিলিং সাহেবঃ বংশী, আর কোনও চালাকি নয়। জমিদারের বউকে আমার হাতে তুলে দাও। তার বদলে আমি তোমায় প্রানভিক্ষা দিতে পারি।
ভাবলেশহীন হয়ে দীঘির পাড়ে একিভাবে বসে রইল বংশী।
নিজেকে দ্রুত সামলে নেয় বংশী, মালার শরীর থেকে নিজেকে কিছুটা দুরত্বে নিয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বংশী। যে শরীরটাকে একটিবার স্পর্শ করার জন্য ও পাগল হয়ে যেত আজ সেই শরীর ই ওকে বটবৃক্ষের মত আশ্রয় দিয়ে হতাশার করুন তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বংশী। একি মালা, নাকি কোনও দেবী। মনে মনে বলে ওঠে বংশী “কেন স্পর্শ করলে এই পাপের শরীরটা, তুমি তো পবিত্র দেবী, গঙ্গা তুমি। যুগে যুগে মানুষ তোমার দিকে আঙুল তুলেছে, বলেছে তুমি অপবিত্র, তুমি তো তা নও মালা” বংশীর হৃদয়ের কোনও এক কোনে এক তীব্র অভিমান লুকিয়ে আছে, সেই অভিমান সুপ্রতীকের জন্য। মনে মনে বলে ওঠে বংশী “সুপ্রতীক তুমি আজও আমার কাছে হারলে, তোমার মালাকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দয়া করলাম। তুমি তো রাজা। আমার মত সামান্য এক জীবকে বোকা বানানোর জন্য নিজের স্ত্রীকে ব্যবহার করলে? এ তুমি কেমন রাজা সুপ্রতীক? যদি আজও আমি জানোয়ার থাকতাম, যদি মালার শরীরটা মাটিতে ফেলে পিষে দিতাম তুমি কি তাকে গ্রহন করতে? তুমি কে মালা? তুমি কি সিতা না তুমি পাঞ্চালী? কেন তোমাদের প্রতিদিন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে?”
মালা চেয়েছিল এক অনুতপ্ত মানুষের আশ্রয় হতে, মালা চেয়েছিল এক দুর্বল মানুষের আশ্রয় হতে। মালা কি অপরাধ করে ফেলল? যতই হোক পরপুরুষকে স্পর্শ এতো ধর্মের বিরোধী? হয়ত এই প্রশ্নগুলোই মালার মনে ঘুরপাক খেয়ে চলেছিল। উত্তরটা মালা পেয়েছিল কিনা জানিনা। বস্ত্রহরণের পর শুধু কৃষ্ণের দুই চরন স্পর্শ, অথবা মাটির বুক চিরে পাতালে প্রবেশ করা এই তো ওদের ভবিতব্য। পাণ্ডবের সভায় দাঁড়িয়ে পাঞ্চালী চিৎকার করে যুধিষ্ঠিরকে বলছে আমি পন্য নই, আমি পাশাখেলার বাজি নই- এতো স্বপ্নাতীত সুবীরবাবু। ওদের অভিমান করার অধিকার আছে, প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। আমাদের ধর্ম, রামায়ন, মহাভারত এই তো আমাদের শিখিয়ে এসেছে। ঠিক বলছি তো সুবীরবাবু। কেন জানেন? রামায়ন মহাভারত দুই ই তো পুরুষের রচনা, ওরা কি আর নারীর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দেবে। আর যদি কোনও নারী চায় চিরাচরিত এই সত্যের বিরধিতা করতে তাকে তো আমরা চিতার আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছি। হয়ত মালার ওইভাবে বংশীকে জড়িয়ে ধরা আপনার ও চোখে অপরাধ, আমি জানি অপরাধ। কিন্তু সুবীরবাবু মালা এর জন্য অনুতপ্ত নয়। হাজারো বার অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিতে মালা এভাবেই বংশীকে জড়িয়ে ধরবে। মালা পবিত্র, গঙ্গার মত পবিত্র। সুবীরবাবু মালতি ও মালা হতে চেয়েছিল, আপনারাই ওকে মালা হতে দেননি, কখনো সমাজ, কখনো পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করে ওকে মালা হতে দেননি। যাই হোক ছাড়ুন আমরা বরং গল্পে চলে আসি।
নতুন এক বীরের জন্ম হয় এই জঙ্গলে যার নাম বংশী, একজন মানুষ বংশী, যে জানে কাল ই তার মৃত্যু আসন্ন। নিজের চোখের সামনে মৃত্যুর বিভীষিকা দেখতে পেয়েছিল বংশী। মরার আগে একটিবার ভালো কিছু করতে চায় বংশী। বংশী নিজের বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় মালার সম্মান রক্ষা করে মালাকে সুপ্রতীকের কাছে ও পৌঁছে দেবে। শুধু মালার ই কথা ভেবে ও জমিদারবাড়িকে রক্ষা করবে। এতক্ষনে মালাও শান্ত হয়। ও জানে ওর মাতৃআশ্রয়ে বংশী নিরাপদ, বংশীর হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। বংশীর দিকে তাকিয়ে মালা বলে ওঠে
মালাঃ বংশী তুমি সকাল থেকে কিছু খাওনি। নায়েবমশাই কিছু খাবার দিয়ে গেছেন। কুটিরের মধ্যে রাখা আছে, আমি নিয়ে আসছি।
মালার দিকে তাকিয়ে একবার হাসে বংশী। এই হাসির মধ্যে সামান্য কোনও কুটিলতা ছিলনা, ছিল শুধুই প্রশান্তি।
বংশীঃ আমি কিছুক্ষন পরে খাবো রানীমা। আগে আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। জানিনা আপনি কিভাবে গ্রহন করবেন। বলতে পারেন কিছু সত্যি কথা বলতে চাই। এগুলো জানা আপনার দরকার।
মালা শান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে বংশীর দিকে। হয়ত সিলিং সাহেবের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েও এতো বড় সত্য বংশীর মুখ থেকে নির্গত হতনা, কিন্তু বিবেকের দংশন যে বড়ই জ্বালা দেয়। মাথা উঁচু করে বংশী বলে ওঠে
বংশীঃ রানীমা, সিলিং সাহেবের ভাই টমাসকে আমি ই হত্যা করেছি। জমিদারবাড়ির সবচেয়ে বড় শত্রু আমি। যা করেছি সব শুধুই জমিদারবাড়ির আর জমিদারবাবুর ক্ষতি করার জন্য।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে বংশী। মালা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বংশীর দিকে। বংশী পারেনা ওই শান্ত শীতল নজরের সাথে নিজের নজর মিলিয়ে দিতে। মাথা নীচু করে লজ্জায় দাঁড়িয়ে থাকে বংশী।
মালাঃ কেন এরকম করলে বংশী? তোমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার বদলা নেওয়ার জন্য তুমি নিজেও তো অন্যায় ই করলে বংশী। জমিদারবাড়ির শত্রু কে আমি জানিনা কিন্তু বংশীর সবচেয়ে বড় শত্রু বংশী নিজেই। তুমি ভালো মানুষ হতে পারতে বংশী। অন্যায় আমার সাথেও কম হয়নি।
বংশীর হৃদয়টা মালার কথায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে জমে থাকা একরাশ অভিমান বাইরে বেরিয়ে আসে
বংশীঃ আপনার পাশে জমিদারবাবু ছিলেন, জমিদারবাবুর পাশে আপনি ছিলেন। আমার পাশে কে ছিল রানীমা? ক্ষিদের যন্ত্রণা কি তাকি আপনি বোঝেন? ভালোবাসা, সংসার, প্রেম এতো শুধুই বড়লোকের সম্পত্তি রানিমা। আমাদের তো বেঁচে থাকার জন্যই বাঁচা। আমাদের কি আর এতো ভালমন্দের বিচার করলে চলে। আমি আপনাকে দেখে, আপনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালমানুষটাকে দেখে পাল্টাইনি রানিমা। আপনি হয়ত এখনো বিশ্বাস করেননা, আমি সত্যি ই নিজের মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। বংশীর চালাকি ফাঁস হয়ে গেছে। আমি শেষ রানিমা।
মালা কোনও উত্তর দিতে পারেনা। একবার বংশীর দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নেয়।
বংশীঃ কিন্তু আমায় কাপুরুষ ভাববেন না। আমি চাইলে এখনো লড়ে যেতে পারতাম। শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি লড়তে জানি। কেউ হয়ত বিশ্বাস করবেনা, কিন্তু এটা সত্যি এই রনক্ষেত্রে যোদ্ধা অনেকে, কিন্তু মানুষ একজন ই। সে আপনি রানীমা। আপনার চোখের সরলতা আমি দেখেছি। সুরঙ্গের অন্ধকার থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আপনি যখন বাইরে এলেন কে যেন আমার ভেতর থেকে বলে উঠল “কি দরকার বংশী, কি লাভ এই লড়াইতে?” আমি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিনি, আমি শুধু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। মানুষ তো একজন ই, সেটা আপনি রানীমা।
অবাক হয়ে বংশীর দিকে তাকায় মালা। একটা কথাও ওর মুখ ফুটে বাইরে আসেনা। মালা যে ধর্মসঙ্কটে পড়ে গেছে। কারপক্ষ ও নেবে? নিষ্ঠাবতী পত্নীর দায়িত্ব সমস্ত কিছু সুপ্রতীককে বলে বংশীকে শাস্তি দেওয়া। আর মানবিক মালার দায়িত্ব এই নতুন বংশীর পাশে থাকা, মায়ের মত আগলে রাখা।
বংশীঃ না রানীমা, আমি আপনার থেকে কিছুই চাইনা, প্রানভিক্ষাও না। কাল সকালেই আমি সিলিং সাহেবের কাছে গিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করবো। এতেই সবার মুক্তি। জমিদারবাবু নিজের প্রজাদের মনে আগের জায়গা ফিরে পাবেন, সিলিং সাহেবের সাথে শুরু হওয়া এই দ্বন্দের ও অবসান ঘটবে। আমি মুক্তি চাই রানীমা। আমি মৃত্যুকে আলীঙ্গন করতে চাই রানীমা।
আর পারেনা মালা, বংশীর দিকে এগিয়ে আসে। বংশীর দুহাত ধরে বলে ওঠে “তুমি মানুষ বংশী, তুমি প্রকৃত মানুষ। তুমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও” মাথা নিচু করে বংশী বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত হতাশা, মান অভিমান কাটিয়ে বলে ওঠে
বংশীঃ আমি বেইমানি করেছি একটা অবিচারের জায়গা থেকে। আমি আপনার নজরে, জমিদারবাবুর নজরে খারাপ। কিন্তু রানীমা, আমার চেয়েও বড় জানোয়ার একজন রয়েছে। যে প্রতিমুহূর্তে জমিদারবাড়ির সর্বনাশ করে চলেছে।
নির্বাক হয়ে বংশীর দিকে তাকিয়ে থাকে মালা, হয়ত ওর এই নীরবতা একটাই কথা বলে চলেছে “কে সেই বেইমান বংশী? কে সে”
বংশীঃ ঠাকুর ডাকাতের দল তৈরি হওয়ার পর থেকেই জমিদারবাড়িতে টাকাপয়সা, গয়না এইসব রাখা নিরাপদ ছিলনা। তখন থেকেই শুরু হয় গোপন কোনও স্থানে এইসব সম্পত্তি সরিয়ে ফেলার কাজ। এই গুপ্তধনের গল্প সুতানুটির আকাশে বাতাসে এখনো ঘুরে বেড়ায়। এই গুপ্তধনের ই লোভ জমিদারবাড়ির সবচেয়ে বড় শত্রুর জন্ম দেয়। সে আর কেউ নয় আমাদের নায়েবমশাই। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী, আমি তো খলনায়ক হয়েছি একটা অসুস্থ সমাজের জন্য আর নায়েবমশাই সবকিছু পেয়েও শুধুই অর্থের লোভে জানোয়ার হয়েছেন।
প্রায় চমকে ওঠে মালা। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে “নায়েবমশাই!” বংশীর কথা প্রথমবারেই হয়ত মালার বিশ্বাস হয়না কিন্তু মালা জানে বংশী মিথ্যে বলছেনা।
বংশীঃ রানীমা, নায়েবমশাই সব জানেন। উনি ইচ্ছে করেই আপনাকে জমিদারবাড়িতে নিয়ে যাননি। ওই মিষ্টি হাসিটার অন্তরালের লোকটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর। আমাদের হাতে সময় খুব কম রানীমা। এই জঙ্গলে আমার সাথে আপনাকে একা রেখে দেওয়ার পেছনেও নায়েবমশাইএর নিশ্চয়ই কোনও চাল আছে। কাল ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমাদের এখান থেকে রওনা দিতে হবে।
স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে মালা। এই যুদ্ধক্ষেত্র ও চায়নি, এই রাজনীতি এতো মিথ্যাচার এও ও চায়নি। ও চেয়েছিল দুদণ্ড শান্তি আর নিজের স্বামীর একটু ভালোবাসা। হয়ত জীবনটা এরকম ই হয়। নিজেকে শান্ত করে মালা। যে লোকটা আজ জমিদারবাড়ির সবচেয়ে বড় বন্ধু কাল অবধি সেই ছিল ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর বন্ধু ভেবে যাকে ওরা নির্ভর করে চলেছে সেই হোল সবচেয়ে বড় শত্রু। এই জটিলতা থেকে মালা একটু মুক্তি চায়। সতির চিতা থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সময় ও একবার ও ভাবেনি যে বেঁচে যাবে। এক মহানুভব পুরুষ ওকে রক্ষা করেছিল। প্রান বাঁচলেও ভাবেনি ওর আশ্রয় হবে। অবশেষে আশ্রয়ের সাথে সাথে স্ত্রীর মর্যাদাও ও পেয়ে যায়। মালা চেয়েছিল সেই মহান মানুষটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে। ভাবেনি এতবড় দুর্দিনের মধ্যে তার মনের মানুষকে পড়ে যেতে হবে। কে মিত্র কে যে শত্রু তা নিয়ে আর ভাবার মানসিক শক্তি মালার শরীরে অবশিষ্ট নেই। মালা শুধু এটাই জানে ওর শত্রু একজন, শুধুই একজন, সে হোল সমাজ। এই সমাজ ই ওকে সতি বলে চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এই সমাজ ই একটা মৃত্যুশয্যার বৃদ্ধর স্ত্রী বানিয়ে ওর জীবনটা শেষ করেছিল। হয়ত মনে মনে একবার বলে মালা “ভগবান আর কতকাল আমরা এভাবে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে যাবো”
মালার এই ভাবুক মুখটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে বংশী। বংশীর হৃদয়ে বিবেক যন্ত্রণার আর সামান্য কণাটুকু অবশিষ্ট নেই। নিজের সমস্ত পাপ মালার সামনে উদ্রেক করে ও আজ মুক্ত। মরতেও ওর আর কোনও ভয় নেই। মালার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে
বংশীঃ রানিমা কোনও চিন্তা করবেন না। আমি থাকতে জমিদারবাবুর বা আপনার কোনও বিপদ ই হবেনা। আপনি নিশ্চিন্তে কুটিরের মধ্যে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমিও খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নি। কাল ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমরা এখান থেকে চলে যাবো।
বংশীর দিকে তাকিয়ে একবার স্ফীত একটা হাসি হাসে মালা। বংশী জানে এই হাসির মধ্যে হয়ত সেই প্রানবন্ততা নেই কিন্তু রয়েছে গভীর বিশ্বাস। দীঘির দিকে এগিয়ে যায় বংশী। একটা ফুরফুরে হাওয়া ওপাশ থেকে বয়ে আসছিল, বংশী জানেনা এই বাতাস ওর জীবনের শেষ আমেজ কিনা। নিজের বিবেকের কাছে জয়ী হয়ে সেই প্রানবন্ত হাওয়ার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দেয় বংশী। কতক্ষন যে এভাবে ও ছিল নিজেও খেয়াল করেনি, পেছন ঘুরে দেখে মালা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে খাবারের পাত্র। বংশীর দিকে তাকিয়ে মালা বলে ওঠে
মালাঃ খেয়ে নাও বংশী। কাল যা হবে তা কাল ই দেখা যাবে। কিন্তু এখন খেয়ে নাও।
মালার হাত থেকে খাবারের পাত্রটা গ্রহন করে বংশী। সামান্য হেঁসে মালা ফিরে যায় কুটিরের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বংশী। ওপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে “পরের জন্মে আমায় মানুষ করে পাঠিও ভগবান” বেশকিছুক্ষন ওখানে দাঁড়ানোর পর বংশীও কুটিরের দিকে যেতে শুরু করে। কুটিরের ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটা দিয়ে বোঝা যায় মালা শুয়ে পড়েছে। বাইরের চাতানে বংশীও নিজের শরীরটা ফেলে দেয়। সারাদিনের ক্লান্তি হতাশা ধীরেধীরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চোখ দুটো বুজে আসে।
ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। সমস্ত জঙ্গল জুড়ে পাখিদের কুহুতান শুরু হয়ে গেছে। ধীরেধীরে উঠে বসে বংশী। ঘুমের আবরণটা শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দীঘির দিকে এগিয়ে যায়। হাতে আঁচলা করে জল নিয়ে ভালো করে মুখে ঝাপটা দেয়। ওদের খুব দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে ওরা? জমিদারবাড়ি? যদি কালরাতে বংশীকে মালার কাছে ছেড়ে দেওয়াটা নায়েবমশাই এর কোনও ষড়যন্ত্র হয় তাহলে? হথাত ই বংশীর পিঠে প্রচণ্ড শক্ত একটা লোহার নল স্পর্শ করে। প্রায় চমকে গিয়ে পেছনঘুরে দেখে বংশী। হয়ত এরকম ই একটা কোনও আশঙ্কা করেছিল বংশী। বংশীর ঠিক পেছনে সিলিং সাহেব, পেছনে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিশাল একটা দল। আর কিছুটা দূরে সেই পরিচিত শয়তানি হাসিটার সাথে নায়েবমশাই। হয়ত বংশী জানত এরকম ই কিছু একটা হবে, তাই হয়ত স্বাভাবিক ভীতিবোধটা প্রকাশ না করে নায়েবমশাইকে অনুরুপ একটা হাসি ফেরত দিল। ওর এই হাসি সিলিং সাহেবের যে সহ্য হবেনা তা ও জানত।
সিলিং সাহেবঃ বংশী, আর কোনও চালাকি নয়। জমিদারের বউকে আমার হাতে তুলে দাও। তার বদলে আমি তোমায় প্রানভিক্ষা দিতে পারি।
ভাবলেশহীন হয়ে দীঘির পাড়ে একিভাবে বসে রইল বংশী।