19-01-2019, 09:45 AM
পর্ব ২৭- নতুন সমীকরনঃ
অনেকক্ষণ ধরে একের পর এক রহস্যের ঘেরাটোপে পড়ে বংশীর শরীর এমনিতেই হাঁসফাঁস করছিল তার ওপর ওর কামনার দেবী মালাকে নিয়ে নতুন এক রহস্যের ইঙ্গিত। এতক্ষনে বংশী নির্ভয়ে বলে ওঠে
বংশীঃ রানীমা যে সবকিছুই জানেন তা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনা। আমি রানীমার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে কথা বলেছি। আমি জানি জমিদারবাবুকে নিয়ে উনি অত্যন্ত চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। যাই রহস্য থাক আমি জানি রানীমা নিষ্পাপ।
বংশীর মুখে এই সহজসরল কথা শুনে নায়েবমশাই ফিক করে হেঁসে ফেলেন।
নায়েবমশাইঃ বুঝলে বংশী সবকিছুর ই নষ্টের মুলে হোল নারী। শাস্ত্রে কি এমনি ই নারীকে নিয়ে এতোগুলো কথা লেখা আছে। আমি বামুনের ছেলে, বংশী। যাকে তোমরা রানীমা বল তাকে আমি কিছুতেই রানীমা বলে মানিনা।
অবাক হয়ে বংশী তাকিয়ে থাকে নায়েবমশাই এর দিকে।
নায়েবমশাইঃ তোমাদের রানীমার আসল নাম কাদম্বিনী। ওর এই পরিচয় এই অঞ্চলের কেউ ই জানেনা। একমাত্র আমি ই জানি। সুপ্রতীক কখনো আমায় এব্যাপারে কিছুই বলেনি, যতবার ই জিজ্ঞেস করেছি আমায় এড়িয়ে গেছে। আমার বাপু আবার রহস্য ভেদ করতে না পারলে খাবার হজম হয়না। আমিও নিজের লোকজনকে দিয়ে সমস্ত তথ্য জোগাড় করেই ছাড়লাম...
নায়েবমশাই এর এই কথার মধ্যে যে অন্যগানের সুর রয়েছে তা বিচক্ষন বংশীর বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। নায়েবমশাইকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বংশী বলে উঠল
বংশীঃ একি নায়েবমশাই, তাহলে তথ্য আমার মত আপনিও জোগাড় করেন। আপনি এতই যখন অনুগত তাহলে এই গোপনীয়তাটুকু বজায় রাখতেই পারতেন।
বংশীর কথা শুনে নায়েবমশাই এর মুখে সেই পুরনো বুদ্ধিদীপ্ত হাসিটা আবার ফুটে ওঠে।
নায়েবমশাইঃ বংশী, তুমি যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান তা আমি আগে থেকেই জানতাম। কম তথ্যতো তোমার ব্যাপারে আমিও জোগাড় করিনি। কিন্তু মনে হয়না তুমি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।
নায়েবমশাই এর এই ইঙ্গিতপূর্ণ বক্রোক্তি বংশীর শুনতে খারাপ লাগলেও, এতক্ষন বংশীর চারিপাশে যে কালো মেঘটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তা কেমন যেন সরে যেতে শুরু করল। বংশীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার করে বলতে লাগলো, না বংশী এতো তাড়াতাড়ি তোর পতন সম্ভব নয়। তুই মরলে যুদ্ধক্ষেত্রে মরবি, বীরের মত মরবি, এরকম কাপুরুষের মত মৃত্যু তোর জন্য নয়। সুচারু বংশীও অপেক্ষা করে নায়েবমশাই এর উত্তরের জন্য।
নায়েবমশাইঃ কি হোল বুঝলেনা তো কেন আমি নিজেকে তোমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বললাম। শুধু তোমার চেয়ে কেন সিলিং সাহেব বা সুপ্রতীকের চেয়েও আমি তোমায় বেশি বুদ্ধিমান মনে করি। জানো কেন?
কোনও উত্তর না দিয়ে বংশী শুধুই নায়েবমশাই এর মুখের দিকে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যদিও বংশীর মনে তখন অনেকরকম নতুন সম্ভাবনা শুরু হয়েছে। প্রতিটা পোড় খাওয়া রাজনীতিক ই জানেন, রাজনীতি শুধুই সম্ভাবনার খেলা মাত্র। বংশী অপেক্ষা করে থাকে।
নায়েবমশাইঃ তুমি জানতে তোমার প্রতিপক্ষ কারা। সিলিং সাহেব ও সুপ্রতীক। সুপ্রতীককে বধ করে ও সিলিং সাহেবের সাথে হাত মিলিয়ে তুমি ক্ষমতার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে চেয়েছিলে। অন্যদিকে সুপ্রতীকের শত্রু ছিল ঠাকুর ডাকাতের দল মানে তুমি ও তোমার দলবল এবং সুতানুটির অত্যাচারী ইংরেজ সিলিং সাহেব। প্রথমে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে শত্রুর সংখ্যা কমানো তারপর তোমাকে ব্যাবহার করে সিলিং সাহেবকে হাত করা, এই ছিল সুপ্রতীকের পরিকল্পনা। অপর দিকে সিলিং সাহেবের শত্রু একা সুপ্রতীক। ওকে শেষ করতে গেলে তোমার প্রয়োজন। আবার তোমার ওপর ও ওর বিশাল একটা বিশ্বাস ছিলনা, কারন সিলিং সাহেব ও তোমার ইতিহাসটা জানেন। তোমাদের রাজনীতিবোধ সত্যি মনে ধরার জন্য। কিন্তু বংশী, তুমি, সিলিং সাহেব ও সুপ্রতীক তিনজনেই একটা সাধারন ভুল করে ফেলেছ। জানো সেই ভুলটা কি?
বংশীর বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পাওয়া গেছে তা ভুল নয়, বংশীর বুঝতে আর কিছুই বাকি রইলনা কিন্তু তাও ও সমস্তকিছু নায়েবমশাই এর মুখ থেকে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল।
নায়েবমশাইঃ তোমাদের তিনজনের ই সাধারন ভুল হোল এটা যে তোমরা ভেবেছিলে লড়াইটা ত্রিমুখী। (কিছুটা চিৎকার করেই) লড়াইটা কখনোই ত্রিমুখী ছিলনা বংশী। লড়াইটা ছিল চতুর্মুখী। তোমরা কখনো আমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আননি। হয়ত এটাই তোমাদের ৩ জনের সবচেয়ে বড় ভুল।
কিছুটা ভান করার বেশে বংশী বলে ওঠে
বংশীঃ নায়েবমশাই, জমিদারির ওপর লোভ যে আপনার ও আছে তা সত্যিই আমি কখনো ভাবিনি।
নায়েবমশাইঃ কে বলল আমার জমিদারির ওপর লোভ আছে। এই বুড়ো বয়সে জমিদারির ইচ্ছে আমার নেই। আর আমাকে এরাজ্যের প্রজারাও সহজে মেনে নেবেনা। আমার লোভ অন্য জিনিসের ওপর।
আবার একটা নতুন রহস্যের আভাস। এবার সত্যি ই কিছুটা অবাক হয়ে বংশী জিজ্ঞেস করে
বংশীঃ অন্য জিনিসমানে কি? আপনার কিসের ওপর লোভ?
বংশীর কথা শুনে প্রচণ্ড জোরে হেঁসে ওঠে নায়েবমশাই। বংশীর কাঁধে জোরে নিজের হাতটা রেখে বলে ওঠেন
নায়েবমশাইঃ হ্যালো বানসি (আবার কিছুক্ষন হেঁসে নিয়ে) আজ আমি সত্যি ই তোমায় প্রচুর কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। একের পর এক রহস্য। সত্যি এটা তুমি বলেই সহ্য করতে পেরেছ অন্য কেউ হলে এতো সহজে সহ্য করতে পারতো না। চল এবার একএক করে সমস্ত রহস্য উন্মোচন করি। প্রথমেই আসি তোমাদের রানীমা অর্থাৎ কাদম্বিনীর কথায়। কাদম্বিনী কুলীন বামুনের মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল এক মরার খাটে শুয়ে থাকা বুড়োর সাথে। এখন রানীমাকে তোমরা যা দেখছ হয়ত সেই সময় এর চেয়েও সুন্দরী উনি ছিলেন। এই রকম সুন্দরী বউ দেখলে মরার আগে একটাবার কার ই না একটু ওইসব করতে ইচ্ছে হয় বল। ব্যাস নতুন কচি বউএর মুখ দেখে বুড়োর ও শরীর শক্ত হয়ে উঠল। বুড়োর সাধ হোল ফুলসজ্জা করার।
নারী বড়ই অদ্ভুত বংশী। এই নারীর জন্যই ইতিহাস এতো জটিল। পুরুষ মানুষ যে কেন নিজের মন নারীকে দিয়ে বসে কে জানে। এই বুড়োর ও তাই হোল। মনের কথা শুনে শরীরের অসুবিধাগুলো বেমালুম ভুলে গেলো। বুড়োবয়সে বীর্যপাতের চেষ্টা করলে যা হয় আরকি। নতুন বউএর শরীরটার ওপর ই পড়ে থেকে দেহত্যাগ করল।
সে তো বুড়োর মরার ই কথা ছিল। এতক্ষন অবধি কোনও অসুবিধাই ছিলনা। সমস্ত অসুবিধা শুরু হোল এরপর থেকে। বুড়োর ছিল অঢেল সম্পত্তি। সেইনিয়ে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কামড়া কামড়ি শুরু হয়ে যায়। যদিও বেশ কিছু বিচক্ষন লোকের মধ্যস্থতায় লড়াইটা থামে। আর এরপর ই গৃহীত হয় সেই ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত। কাদম্বিনী বেঁচে থাকলে হয় ওকে সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে নয় ওকে দেখভাল করে যেতে হবে। এরচেয়ে তো ওকে মেরে ফেলাই শ্রেয়। তো যেমন ভাবা তেমন কাজ। সতীদাহ প্রথার নাম শুনেছ বংশী? কাদম্বিনীকেও সতি বানিয়ে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হোল।
ব্যাস এখানেই আমাদের গল্পের নায়কের আবির্ভাব। কোনও এক কারনে সেদিন গঙ্গাঘাটে পবিত্র স্নান করার জন্য সুপ্রতীক ও উপস্থিত হয়েছিল। সুপ্রতীক ছোট থেকেই ইংরেজদের মিশনারি কলেজে মানুষ। এই সব বর্বর প্রথা ও কিছুতেই মানতে পারতো না। কিন্তু সমাজের ভয়ে কিছু করতেও পারতনা। চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ, প্রচণ্ড জোরে মানুষের চিৎকার, দুদিকে দুটো চিতায় আগুন লাগানো হয়েছে। হথাত একটা চিতার কাঠগুলো ঠেলে লাফিয়ে পড়ে কাদম্বিনী। রুদ্ধশ্বাসে সামনে দৌড়ায় আর পেছনে উন্মত্ত জনতা। এই দৃশ্য দেখে আধুনিক মনের সুপ্রতীক আর থাকতে পারেনা, দৌড়ে মেয়েটার হাত ধরে ওকে নিয়ে নিজের ঘোড়ার দিকে চলতে শুরু করে। বাকিরা ওদের লাগাম পাওয়ার আগেই সুপ্রতীক কাদম্বিনীকে নিয়ে জমিদারবাড়িতে পৌঁছে যায়। সেই কাদম্বিনীই আজ মালা। কোনোদিন অনুষ্ঠান মেনে ওদের বিয়ে হয়নি। এই কথা আমি স্বীকার করি বংশী, ওদের ভালোবাসা জন্মজন্মান্তরের। ওরা দুজনে দুজনের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
নায়েবমশাই এর এই নতুন রহস্যে বংশী সত্যি ই ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে যায়। এতো বড় একটা তথ্য যে ও এতদিন জানত না তা ও সত্যি ই বিশ্বাস করতে পারেনা। বংশীর মুখের এই ফ্যাকাসে অবস্থা দেখে নায়েবমশাই বলে ওঠেন
নায়েবমশাইঃ এই রে তোমার তো মন ভেঙে দিলাম মনে হচ্ছে। আমি আবার একটু পাষণ্ড ধরনের মানুষ। এইসব ভালোবাসা টাসা আমার পছন্দ নয়। তুমি যখন লুকিয়ে লুকিয়ে বাগানে হস্তমৈথুন করতে আমি তোমাকে দেখতাম। কেউ কখনো এটা জানল না যে তোমার মালার ওপর এতো বিচ্ছিরি একটা নজর রয়েছে। এই দেখো বংশী, সামান্য একটা ধন্যবাদ ও তুমি আমায় দিলেনা। আমি কিন্তু সুপ্রতীককে কিছুই বলিনি।
সুচারু বংশী খুব ভালো করেই জানে এই মুহূর্তে ও নায়েবমশাই এর পাশাখেলার গুটিতে পরিনত হতে চলেছে। কিন্তু একটাই আশার কথা তা হোল চরম সর্বনাশটা হয়ত ওর হচ্ছেনা। প্রান হয়ত ওর বেঁচেই যাবে। কিন্তু কতদিন সেব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বংশী কিছু না বলে শুধুই নায়েবমশাই এর দিকে তাকিয়ে থাকে।
নায়েবমশাইঃ এই তোমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধা। তোমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাওনা। আরে বাপু বিশ্বাস করেই দেখনা অন্য কোনও উপায় ও তো নেই। তোমার মালার ওপর নজর, টমাসকে হত্যা করা, নীলকুঠিতে সিলিং সাহেবের সাথে দেখা করা এই কোনও কথাই সুপ্রতীক জানেনা। আমি ওকে জানাইনি। ও তোমায় প্রথমদিন থেকেই সন্দেহ করে। যে জমিদারবাড়ির ওপর চরম আক্রোশ থেকে তোমার বন্য ডাকাত হওয়া, আবার একদিন হথাত সেই জমিদারবাড়িতেই অনুগত ভৃত্য হওয়া- এই দুটো ঠিক খাপ খায়না বংশী। কিন্তু এটা সন্দেহের পর্যায়েই রয়েছে। টমাসের হত্যার পর ও সুপ্রতীক সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের তালিকায় সবার আগে তোমাকেই রেখেছিল। কিন্তু আমি ওকে কখনোই বলিনি যে আমি নিজের চোখে তোমায় হত্যা করতে দেখেছি।
নায়েবমশাই এর কথাগুলো মন দিয়ে শোনার সাথে সাথে বংশীও নিজের পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করে দেয়। ও নিশ্চিত যে অন্তত আজ রাতের জন্য ও প্রানে বেঁচে যাচ্ছে। বংশীর মুখে এতক্ষনে একটা হাসি ফিরে আসে।
বংশীঃ নায়েবমশাই তাহলে সুতানুটির পরবর্তী জমিদার আপনি তাইতো?
প্রচণ্ড জোরে হেঁসে ওঠেন নায়েবমশাই। এই হাসির মধ্যে যে একটা বিশাল রহস্য লুকিয়ে আছে তা বংশী খুব ভালো করেই জানে। বংশীও অপেক্ষা করতে থাকে সেই রহস্য উন্মোচনের।
নায়েবমশাইঃ তুমি কি উন্মাদ বংশী? এই বুড়ো বয়সে জমিদারি? তাছাড়া এটা সবাই জানে যে ফিরিঙ্গীরা আর জমিদারদের পুরনো ক্ষমতা রাখতে দেবেনা। তাহলে জমিদার হয়ে কি লাভ বংশী?
বংশীর নজর স্থির হয়ে নায়েবমশাই এর চোখের দিকে। বংশীর মুখ দিয়ে একটাই অস্ফুট কথা ভেসে উঠল “তাহলে কি চাই আপনার?”
নায়েবমশাইঃ গুপ্তধন। হাঁ হাঁ গুপ্তধন। আমি ঠাকুরদার থেকে বাবার থেকে শুনেছি জমিদারবাড়ির কোনও এক জায়গায় প্রচুর গুপ্তধন লুকানো আছে। ঠাকুর ডাকাতের আবির্ভাব হওয়ার পর থেকেই জমিদারবাড়ির অধিকাংশ মনিরত্ন, গয়না, অর্থ সিন্দুক থেকে সরিয়ে ফেলে কোনও এক গুপ্তস্থানে রাখা হয়। সেই স্থানটা কোথায় তা জানে মাত্র একজন সে হোল সুপ্রতীক। ওর থেকে কথা বার করা সম্ভব নয়। আমি নিজে ব্যাক্তিগতভাবে বহুবার অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছু না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম একসময়। হথাত ই ঈশ্বর আমাকে সেই সুযোগ দিয়ে দিলেন। বংশী, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই গুপ্তস্থানের কথা মালা জানে। কারন সুপ্রতীকের জীবনের একমাত্র দুর্বলতা হোল মালা। তোমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি, পরেও রাখবো- শুধু একটাই কারনে।
বংশী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নায়েবমশাই এর দিকে।
নায়েবমশাইঃ আমাদের লক্ষ্য আলাদা। তাই আমরা শত্রু নই, আবার বন্ধুও নই। দুজন দুজনের ই কাজে লাগতে পারি। তুমি ই হবে সুতানুটির জমিদার, আর আমি পাবো গুপ্তধন। এর জন্য তোমায় মালাকে যেভাবে হোক বশ করতে হবে, ও তোমায় ঠিক বলবে গুপ্তধনের গুপ্তস্থান কোথায়। আপাতত তোমার এই ক্ষুদ্র গুপ্তধন আমার কাছেই থাক। তুমি আমার কাজ করে দাও ফেরত পাবে।
বংশীঃ সব ই বুঝলাম। আপনার কাছে আমাকে বশ করার ওষুধ আছে, কিন্তু আমি আর সুপ্রতীক যদি এক হয়ে যাই। মানে সুপ্রতীককে বশ করার কোনও ওষুধ কি আছে আপনার কাছে?
নায়েবমশাইঃ বংশী, রাজনীতিতে নতুন নতুন সব সমীকরণ তৈরি হয়। সবের জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। হাঁ ওকে বশ করার ওষুধ ও আছে। গ্রামের মানুষ যদি জানতে পারে, মালা আসলে সতী, তাহলে ধর্মান্ধ মানুষ ই ওকে শেষ করে দেবে আমায় কিছুই করতে হবেনা। তুমি তো প্রচণ্ড বদ লোক বংশী, আমি তোমায় যত উপকার করছি তুমি তত আমায় সন্দেহ করে চলেছ। আচ্ছা ছাড় এসব। মালাকে নিয়ে ভাবো (জিভটা বার করে একটা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি) কাল সকালে কি হবে তা কেউ ই জানেনা। কিন্তু আজ রাতে মালাকে একটু উলটে পালটে ভোগ করতে ক্ষতি কি। আমি ই মালাকে সুরঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছি। চলো তোমার সম্পত্তি তোমার ই হাতে তুলে দি।
অনেকক্ষণ ধরে একের পর এক রহস্যের ঘেরাটোপে পড়ে বংশীর শরীর এমনিতেই হাঁসফাঁস করছিল তার ওপর ওর কামনার দেবী মালাকে নিয়ে নতুন এক রহস্যের ইঙ্গিত। এতক্ষনে বংশী নির্ভয়ে বলে ওঠে
বংশীঃ রানীমা যে সবকিছুই জানেন তা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনা। আমি রানীমার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে কথা বলেছি। আমি জানি জমিদারবাবুকে নিয়ে উনি অত্যন্ত চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। যাই রহস্য থাক আমি জানি রানীমা নিষ্পাপ।
বংশীর মুখে এই সহজসরল কথা শুনে নায়েবমশাই ফিক করে হেঁসে ফেলেন।
নায়েবমশাইঃ বুঝলে বংশী সবকিছুর ই নষ্টের মুলে হোল নারী। শাস্ত্রে কি এমনি ই নারীকে নিয়ে এতোগুলো কথা লেখা আছে। আমি বামুনের ছেলে, বংশী। যাকে তোমরা রানীমা বল তাকে আমি কিছুতেই রানীমা বলে মানিনা।
অবাক হয়ে বংশী তাকিয়ে থাকে নায়েবমশাই এর দিকে।
নায়েবমশাইঃ তোমাদের রানীমার আসল নাম কাদম্বিনী। ওর এই পরিচয় এই অঞ্চলের কেউ ই জানেনা। একমাত্র আমি ই জানি। সুপ্রতীক কখনো আমায় এব্যাপারে কিছুই বলেনি, যতবার ই জিজ্ঞেস করেছি আমায় এড়িয়ে গেছে। আমার বাপু আবার রহস্য ভেদ করতে না পারলে খাবার হজম হয়না। আমিও নিজের লোকজনকে দিয়ে সমস্ত তথ্য জোগাড় করেই ছাড়লাম...
নায়েবমশাই এর এই কথার মধ্যে যে অন্যগানের সুর রয়েছে তা বিচক্ষন বংশীর বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। নায়েবমশাইকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বংশী বলে উঠল
বংশীঃ একি নায়েবমশাই, তাহলে তথ্য আমার মত আপনিও জোগাড় করেন। আপনি এতই যখন অনুগত তাহলে এই গোপনীয়তাটুকু বজায় রাখতেই পারতেন।
বংশীর কথা শুনে নায়েবমশাই এর মুখে সেই পুরনো বুদ্ধিদীপ্ত হাসিটা আবার ফুটে ওঠে।
নায়েবমশাইঃ বংশী, তুমি যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান তা আমি আগে থেকেই জানতাম। কম তথ্যতো তোমার ব্যাপারে আমিও জোগাড় করিনি। কিন্তু মনে হয়না তুমি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।
নায়েবমশাই এর এই ইঙ্গিতপূর্ণ বক্রোক্তি বংশীর শুনতে খারাপ লাগলেও, এতক্ষন বংশীর চারিপাশে যে কালো মেঘটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তা কেমন যেন সরে যেতে শুরু করল। বংশীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার করে বলতে লাগলো, না বংশী এতো তাড়াতাড়ি তোর পতন সম্ভব নয়। তুই মরলে যুদ্ধক্ষেত্রে মরবি, বীরের মত মরবি, এরকম কাপুরুষের মত মৃত্যু তোর জন্য নয়। সুচারু বংশীও অপেক্ষা করে নায়েবমশাই এর উত্তরের জন্য।
নায়েবমশাইঃ কি হোল বুঝলেনা তো কেন আমি নিজেকে তোমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বললাম। শুধু তোমার চেয়ে কেন সিলিং সাহেব বা সুপ্রতীকের চেয়েও আমি তোমায় বেশি বুদ্ধিমান মনে করি। জানো কেন?
কোনও উত্তর না দিয়ে বংশী শুধুই নায়েবমশাই এর মুখের দিকে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যদিও বংশীর মনে তখন অনেকরকম নতুন সম্ভাবনা শুরু হয়েছে। প্রতিটা পোড় খাওয়া রাজনীতিক ই জানেন, রাজনীতি শুধুই সম্ভাবনার খেলা মাত্র। বংশী অপেক্ষা করে থাকে।
নায়েবমশাইঃ তুমি জানতে তোমার প্রতিপক্ষ কারা। সিলিং সাহেব ও সুপ্রতীক। সুপ্রতীককে বধ করে ও সিলিং সাহেবের সাথে হাত মিলিয়ে তুমি ক্ষমতার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে চেয়েছিলে। অন্যদিকে সুপ্রতীকের শত্রু ছিল ঠাকুর ডাকাতের দল মানে তুমি ও তোমার দলবল এবং সুতানুটির অত্যাচারী ইংরেজ সিলিং সাহেব। প্রথমে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে শত্রুর সংখ্যা কমানো তারপর তোমাকে ব্যাবহার করে সিলিং সাহেবকে হাত করা, এই ছিল সুপ্রতীকের পরিকল্পনা। অপর দিকে সিলিং সাহেবের শত্রু একা সুপ্রতীক। ওকে শেষ করতে গেলে তোমার প্রয়োজন। আবার তোমার ওপর ও ওর বিশাল একটা বিশ্বাস ছিলনা, কারন সিলিং সাহেব ও তোমার ইতিহাসটা জানেন। তোমাদের রাজনীতিবোধ সত্যি মনে ধরার জন্য। কিন্তু বংশী, তুমি, সিলিং সাহেব ও সুপ্রতীক তিনজনেই একটা সাধারন ভুল করে ফেলেছ। জানো সেই ভুলটা কি?
বংশীর বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পাওয়া গেছে তা ভুল নয়, বংশীর বুঝতে আর কিছুই বাকি রইলনা কিন্তু তাও ও সমস্তকিছু নায়েবমশাই এর মুখ থেকে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল।
নায়েবমশাইঃ তোমাদের তিনজনের ই সাধারন ভুল হোল এটা যে তোমরা ভেবেছিলে লড়াইটা ত্রিমুখী। (কিছুটা চিৎকার করেই) লড়াইটা কখনোই ত্রিমুখী ছিলনা বংশী। লড়াইটা ছিল চতুর্মুখী। তোমরা কখনো আমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আননি। হয়ত এটাই তোমাদের ৩ জনের সবচেয়ে বড় ভুল।
কিছুটা ভান করার বেশে বংশী বলে ওঠে
বংশীঃ নায়েবমশাই, জমিদারির ওপর লোভ যে আপনার ও আছে তা সত্যিই আমি কখনো ভাবিনি।
নায়েবমশাইঃ কে বলল আমার জমিদারির ওপর লোভ আছে। এই বুড়ো বয়সে জমিদারির ইচ্ছে আমার নেই। আর আমাকে এরাজ্যের প্রজারাও সহজে মেনে নেবেনা। আমার লোভ অন্য জিনিসের ওপর।
আবার একটা নতুন রহস্যের আভাস। এবার সত্যি ই কিছুটা অবাক হয়ে বংশী জিজ্ঞেস করে
বংশীঃ অন্য জিনিসমানে কি? আপনার কিসের ওপর লোভ?
বংশীর কথা শুনে প্রচণ্ড জোরে হেঁসে ওঠে নায়েবমশাই। বংশীর কাঁধে জোরে নিজের হাতটা রেখে বলে ওঠেন
নায়েবমশাইঃ হ্যালো বানসি (আবার কিছুক্ষন হেঁসে নিয়ে) আজ আমি সত্যি ই তোমায় প্রচুর কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। একের পর এক রহস্য। সত্যি এটা তুমি বলেই সহ্য করতে পেরেছ অন্য কেউ হলে এতো সহজে সহ্য করতে পারতো না। চল এবার একএক করে সমস্ত রহস্য উন্মোচন করি। প্রথমেই আসি তোমাদের রানীমা অর্থাৎ কাদম্বিনীর কথায়। কাদম্বিনী কুলীন বামুনের মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল এক মরার খাটে শুয়ে থাকা বুড়োর সাথে। এখন রানীমাকে তোমরা যা দেখছ হয়ত সেই সময় এর চেয়েও সুন্দরী উনি ছিলেন। এই রকম সুন্দরী বউ দেখলে মরার আগে একটাবার কার ই না একটু ওইসব করতে ইচ্ছে হয় বল। ব্যাস নতুন কচি বউএর মুখ দেখে বুড়োর ও শরীর শক্ত হয়ে উঠল। বুড়োর সাধ হোল ফুলসজ্জা করার।
নারী বড়ই অদ্ভুত বংশী। এই নারীর জন্যই ইতিহাস এতো জটিল। পুরুষ মানুষ যে কেন নিজের মন নারীকে দিয়ে বসে কে জানে। এই বুড়োর ও তাই হোল। মনের কথা শুনে শরীরের অসুবিধাগুলো বেমালুম ভুলে গেলো। বুড়োবয়সে বীর্যপাতের চেষ্টা করলে যা হয় আরকি। নতুন বউএর শরীরটার ওপর ই পড়ে থেকে দেহত্যাগ করল।
সে তো বুড়োর মরার ই কথা ছিল। এতক্ষন অবধি কোনও অসুবিধাই ছিলনা। সমস্ত অসুবিধা শুরু হোল এরপর থেকে। বুড়োর ছিল অঢেল সম্পত্তি। সেইনিয়ে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কামড়া কামড়ি শুরু হয়ে যায়। যদিও বেশ কিছু বিচক্ষন লোকের মধ্যস্থতায় লড়াইটা থামে। আর এরপর ই গৃহীত হয় সেই ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত। কাদম্বিনী বেঁচে থাকলে হয় ওকে সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে নয় ওকে দেখভাল করে যেতে হবে। এরচেয়ে তো ওকে মেরে ফেলাই শ্রেয়। তো যেমন ভাবা তেমন কাজ। সতীদাহ প্রথার নাম শুনেছ বংশী? কাদম্বিনীকেও সতি বানিয়ে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হোল।
ব্যাস এখানেই আমাদের গল্পের নায়কের আবির্ভাব। কোনও এক কারনে সেদিন গঙ্গাঘাটে পবিত্র স্নান করার জন্য সুপ্রতীক ও উপস্থিত হয়েছিল। সুপ্রতীক ছোট থেকেই ইংরেজদের মিশনারি কলেজে মানুষ। এই সব বর্বর প্রথা ও কিছুতেই মানতে পারতো না। কিন্তু সমাজের ভয়ে কিছু করতেও পারতনা। চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ, প্রচণ্ড জোরে মানুষের চিৎকার, দুদিকে দুটো চিতায় আগুন লাগানো হয়েছে। হথাত একটা চিতার কাঠগুলো ঠেলে লাফিয়ে পড়ে কাদম্বিনী। রুদ্ধশ্বাসে সামনে দৌড়ায় আর পেছনে উন্মত্ত জনতা। এই দৃশ্য দেখে আধুনিক মনের সুপ্রতীক আর থাকতে পারেনা, দৌড়ে মেয়েটার হাত ধরে ওকে নিয়ে নিজের ঘোড়ার দিকে চলতে শুরু করে। বাকিরা ওদের লাগাম পাওয়ার আগেই সুপ্রতীক কাদম্বিনীকে নিয়ে জমিদারবাড়িতে পৌঁছে যায়। সেই কাদম্বিনীই আজ মালা। কোনোদিন অনুষ্ঠান মেনে ওদের বিয়ে হয়নি। এই কথা আমি স্বীকার করি বংশী, ওদের ভালোবাসা জন্মজন্মান্তরের। ওরা দুজনে দুজনের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
নায়েবমশাই এর এই নতুন রহস্যে বংশী সত্যি ই ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে যায়। এতো বড় একটা তথ্য যে ও এতদিন জানত না তা ও সত্যি ই বিশ্বাস করতে পারেনা। বংশীর মুখের এই ফ্যাকাসে অবস্থা দেখে নায়েবমশাই বলে ওঠেন
নায়েবমশাইঃ এই রে তোমার তো মন ভেঙে দিলাম মনে হচ্ছে। আমি আবার একটু পাষণ্ড ধরনের মানুষ। এইসব ভালোবাসা টাসা আমার পছন্দ নয়। তুমি যখন লুকিয়ে লুকিয়ে বাগানে হস্তমৈথুন করতে আমি তোমাকে দেখতাম। কেউ কখনো এটা জানল না যে তোমার মালার ওপর এতো বিচ্ছিরি একটা নজর রয়েছে। এই দেখো বংশী, সামান্য একটা ধন্যবাদ ও তুমি আমায় দিলেনা। আমি কিন্তু সুপ্রতীককে কিছুই বলিনি।
সুচারু বংশী খুব ভালো করেই জানে এই মুহূর্তে ও নায়েবমশাই এর পাশাখেলার গুটিতে পরিনত হতে চলেছে। কিন্তু একটাই আশার কথা তা হোল চরম সর্বনাশটা হয়ত ওর হচ্ছেনা। প্রান হয়ত ওর বেঁচেই যাবে। কিন্তু কতদিন সেব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বংশী কিছু না বলে শুধুই নায়েবমশাই এর দিকে তাকিয়ে থাকে।
নায়েবমশাইঃ এই তোমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধা। তোমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাওনা। আরে বাপু বিশ্বাস করেই দেখনা অন্য কোনও উপায় ও তো নেই। তোমার মালার ওপর নজর, টমাসকে হত্যা করা, নীলকুঠিতে সিলিং সাহেবের সাথে দেখা করা এই কোনও কথাই সুপ্রতীক জানেনা। আমি ওকে জানাইনি। ও তোমায় প্রথমদিন থেকেই সন্দেহ করে। যে জমিদারবাড়ির ওপর চরম আক্রোশ থেকে তোমার বন্য ডাকাত হওয়া, আবার একদিন হথাত সেই জমিদারবাড়িতেই অনুগত ভৃত্য হওয়া- এই দুটো ঠিক খাপ খায়না বংশী। কিন্তু এটা সন্দেহের পর্যায়েই রয়েছে। টমাসের হত্যার পর ও সুপ্রতীক সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের তালিকায় সবার আগে তোমাকেই রেখেছিল। কিন্তু আমি ওকে কখনোই বলিনি যে আমি নিজের চোখে তোমায় হত্যা করতে দেখেছি।
নায়েবমশাই এর কথাগুলো মন দিয়ে শোনার সাথে সাথে বংশীও নিজের পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করে দেয়। ও নিশ্চিত যে অন্তত আজ রাতের জন্য ও প্রানে বেঁচে যাচ্ছে। বংশীর মুখে এতক্ষনে একটা হাসি ফিরে আসে।
বংশীঃ নায়েবমশাই তাহলে সুতানুটির পরবর্তী জমিদার আপনি তাইতো?
প্রচণ্ড জোরে হেঁসে ওঠেন নায়েবমশাই। এই হাসির মধ্যে যে একটা বিশাল রহস্য লুকিয়ে আছে তা বংশী খুব ভালো করেই জানে। বংশীও অপেক্ষা করতে থাকে সেই রহস্য উন্মোচনের।
নায়েবমশাইঃ তুমি কি উন্মাদ বংশী? এই বুড়ো বয়সে জমিদারি? তাছাড়া এটা সবাই জানে যে ফিরিঙ্গীরা আর জমিদারদের পুরনো ক্ষমতা রাখতে দেবেনা। তাহলে জমিদার হয়ে কি লাভ বংশী?
বংশীর নজর স্থির হয়ে নায়েবমশাই এর চোখের দিকে। বংশীর মুখ দিয়ে একটাই অস্ফুট কথা ভেসে উঠল “তাহলে কি চাই আপনার?”
নায়েবমশাইঃ গুপ্তধন। হাঁ হাঁ গুপ্তধন। আমি ঠাকুরদার থেকে বাবার থেকে শুনেছি জমিদারবাড়ির কোনও এক জায়গায় প্রচুর গুপ্তধন লুকানো আছে। ঠাকুর ডাকাতের আবির্ভাব হওয়ার পর থেকেই জমিদারবাড়ির অধিকাংশ মনিরত্ন, গয়না, অর্থ সিন্দুক থেকে সরিয়ে ফেলে কোনও এক গুপ্তস্থানে রাখা হয়। সেই স্থানটা কোথায় তা জানে মাত্র একজন সে হোল সুপ্রতীক। ওর থেকে কথা বার করা সম্ভব নয়। আমি নিজে ব্যাক্তিগতভাবে বহুবার অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছু না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম একসময়। হথাত ই ঈশ্বর আমাকে সেই সুযোগ দিয়ে দিলেন। বংশী, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই গুপ্তস্থানের কথা মালা জানে। কারন সুপ্রতীকের জীবনের একমাত্র দুর্বলতা হোল মালা। তোমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি, পরেও রাখবো- শুধু একটাই কারনে।
বংশী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নায়েবমশাই এর দিকে।
নায়েবমশাইঃ আমাদের লক্ষ্য আলাদা। তাই আমরা শত্রু নই, আবার বন্ধুও নই। দুজন দুজনের ই কাজে লাগতে পারি। তুমি ই হবে সুতানুটির জমিদার, আর আমি পাবো গুপ্তধন। এর জন্য তোমায় মালাকে যেভাবে হোক বশ করতে হবে, ও তোমায় ঠিক বলবে গুপ্তধনের গুপ্তস্থান কোথায়। আপাতত তোমার এই ক্ষুদ্র গুপ্তধন আমার কাছেই থাক। তুমি আমার কাজ করে দাও ফেরত পাবে।
বংশীঃ সব ই বুঝলাম। আপনার কাছে আমাকে বশ করার ওষুধ আছে, কিন্তু আমি আর সুপ্রতীক যদি এক হয়ে যাই। মানে সুপ্রতীককে বশ করার কোনও ওষুধ কি আছে আপনার কাছে?
নায়েবমশাইঃ বংশী, রাজনীতিতে নতুন নতুন সব সমীকরণ তৈরি হয়। সবের জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। হাঁ ওকে বশ করার ওষুধ ও আছে। গ্রামের মানুষ যদি জানতে পারে, মালা আসলে সতী, তাহলে ধর্মান্ধ মানুষ ই ওকে শেষ করে দেবে আমায় কিছুই করতে হবেনা। তুমি তো প্রচণ্ড বদ লোক বংশী, আমি তোমায় যত উপকার করছি তুমি তত আমায় সন্দেহ করে চলেছ। আচ্ছা ছাড় এসব। মালাকে নিয়ে ভাবো (জিভটা বার করে একটা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি) কাল সকালে কি হবে তা কেউ ই জানেনা। কিন্তু আজ রাতে মালাকে একটু উলটে পালটে ভোগ করতে ক্ষতি কি। আমি ই মালাকে সুরঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছি। চলো তোমার সম্পত্তি তোমার ই হাতে তুলে দি।