19-01-2019, 09:44 AM
পর্ব ২৫- ভু...উ...উ...উ...তঃ
বংশীর কানে নায়েবমশাই এর চাতুরির হাসিপূর্ণ কথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। এতো বছর ধরে তিলতিল করে যে পরিকল্পনা ও তৈরি করেছিল আর কয়েকটা মিনিট আগে অবধিও যা ধ্রুবসত্যি মনে হচ্ছিল হথাত ই যেন তা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে যেতে শুরু করে। অজস্র আশঙ্কা বংশীর মনে ঝড় উঠিয়ে দেয়। কি যে সত্য আর কি যে মিথ্যে এই হয়ত এই ইহজগতের সবচেয়ে বড় ছলনা। যা দেখা যায় যা শোনা যায় যা অনুভব করা যায় তা সবসময় সত্য হয়না, একটা ভ্রান্ত মরীচিকাও হয় অনেকসময়। কিন্তু বংশীও তো সুচাগ্র রাজনীতিক, রাজাও বটে। যদিও জঙ্গলের নিষিদ্ধ রাজ্যের রাজা তাও তো রাজা। নিজেকে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রন করে বংশী। বিপদে মানুষ যে আরও ভুল করে ফেলে তা বংশী খুব ই ভালো করে বোঝে। এই মুহূর্তে বংশীর চোখ মুখের অবস্থা দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে যে জমিদারবাবুর অন্তর্ধানে নয় অন্য কোনও অজানা কারনেই বংশী বেশি চিন্তিত। নিজের শরীরী ভাষা সম্বন্ধে বংশীও যথেষ্ট অবগত। অন্যমনস্ক ভাবটা কাটিয়ে বংশী পাশের দিকে তাকায়, এতক্ষন এখানেই নায়েবমশাই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওকে অন্যমনস্ক দেখে চলে গেছেন। মনে মনে বলে বংশী না ভয় পেলে বা বেশি চিন্তা করলে চলবে না। টমাস এর পর আমার যদি কোনও মুল্যবান গুটি থেকে থাকে তো তা হোল গার্গী ও প্রিয়া। গার্গী ও প্রিয়ার টোপ দিয়ে সুপ্রতীককে মুক্ত করা যাবে। আবার ওদের ই টোপ দিয়ে সুপ্রতীককে সিলিং সাহেবের সাথে যুদ্ধে উদ্যত করা যাবে। এই মুহূর্তে আমার একটাই কাজ যেভাবে হোক ওই দুই রুপসীকে খুঁজে বার করা। এতো অল্প সময়ের মধ্যে ওদের রাজ্যের বাইরে পাঠানো সম্ভব নয়। ওরা আশেপাশের কোনও গ্রামেই আছে। বংশী ভালো করে চিন্তা করতে শুরু করে নায়েবমশাই ছাড়া আর কে আছে যাকে সুপ্রতীক প্রচণ্ড বিশ্বাস করে। যার কাছে ওদেরকে পাঠিয়ে সুপ্রতীক নিশ্চিন্ত হতে পারে। কিছুই মাথায় আসেনা বংশীর।
সামনের দিকে তাকায় বংশী। বাহিরমহলে প্রচুর সিপাহী দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সম্ভবত যুদ্ধের মোহড়া দিচ্ছে। একটা ব্যাপার ভেবে অবাক হয়ে যায় বংশী। ওর পুরনো সাথীরা যাদের লাঠিয়াল হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল তারা কোথায়? যারা রয়েছে তারা তো সব ই হয় পুরনো পেয়াদা অথবা সিপাহী। বংশী জানে রহস্য কিছু একটা রয়েছে এবং সেই রহস্যই ওকে ফাঁস করতে হবে। বংশীর চোখ পড়ে নায়েবমশাই এর দিকে। সিপাহীদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নায়েবমশাই ওর ই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নায়েবমশাই এর মুখে সেই পরিচিত বাঁকা হাসিটা লেগেই আছে। এই হাসির মধ্যে যেন কত অজানা প্রশ্নের ই উত্তর লুকিয়ে আছে। বংশীর মনে এক অন্য সন্দেহ দানা বাঁধে। এরকম নয়ত নায়েবমশাই সব জানেন কিন্তু ওকে কিছু জানাচ্ছেনা। এরকম নয়ত টমাসকে হত্যা করার ব্যাপারটায় নায়েবমশাই ওকে সন্দেহ করেছে। আবার নিজেকে শান্ত করে বংশী। মনে মনে বলে আশঙ্কা করতে থাকলে সব গুলিয়ে যাবে। অঙ্কের সমাধান ও প্রায় করেই এসেছে, শুধু একটাই জায়গায় ও আঁটকে গেছে তা হোল প্রিয়া আর গার্গী। বংশী আবার নায়েবমশাই এর দিকে তাকায়, ওনার মুখে সেই চালাক হাসিটা তখন ও লেগে আছে। মনে মনে ঠিক করে বংশী, এভাবে নায়েবমশাই এর কাছে ধরা দিলে চলবে না। যেভাবে হোক গোপন ব্যাপারটা ওকে জানতে হবেই। বংশী জোর করে মুখে একটা হাসি এনে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
নায়েবমশাই এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বংশী একটু স্ফীত হেঁসে বলে
বংশীঃ আসলে নায়েবমশাই, প্রিয়াদিদি ও গার্গীদিদিকে নিয়ে আমি প্রচণ্ড চিন্তায় আছি। আপনি তো জানেন জমিদারবাবু আমাকে সমস্ত নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। ওনাদের যদি কিছু হয়ে যায় আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবোনা। আমি জানি নায়েবমশাই আপনি জানেন ওরা কোথায় আছে। হয়ত কোনও কারনে আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপনি যদি আমায় বলতেন তাহলে ওদের নিরাপত্তার জন্য আমি কিছু ব্যাবস্থা করতাম। সত্যি বলতে...
নায়েবমশাই এর মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, বংশীর একটা হাত ধরে ভেতর দিকে যেতে ইশারা করে। বংশীর ও মনে আশার আলো দেখা দেয়। বংশী ভাবতে শুরু করে নিশ্চয়ই এমন কিছু ব্যাপার আছে যার জন্য নায়েবমশাই কিছুতেই ওকে বলতে চাইছিলেন না। ওরা দুজনেই আবার অন্দরমহলে প্রবেশ করে। বংশীর দিকে তাকিয়ে নায়েবমশাই বলে ওঠেন
নায়েবমশাইঃ বংশী ওরা কোথায় আছে তা আমি সত্যি ই জানিনা।
এবার সত্যি ই বংশীর মাথা খারাপ হয়ে যায়, নায়েবমশাই এর অনুরুপ একটা হাসি ফেরত দিয়ে বংশী বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। নায়েবমশাই বংশীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেন। বংশী বোঝে এবার নায়েবমশাই ওকে কিছু বলবেন। বংশী ওখানে দাঁড়িয়ে যান। নায়েবমশাই সামান্য হেঁসে বলেন
নায়েবমশাইঃ বংশী, সুপ্রতীককে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছি। ওর যখন ৩ বছর বয়স তখন রানীমা মানে ওর মা মারা যায়। বিনা বিবেচনায় কোনও কাজ ই ও করেনা। ওর পরিকল্পনা আজ অবধি আমি কখনো ব্যর্থ হতে দেখিনি। ওকে আমি নিজে হাতে তৈরি করেছি বংশী।
নায়েবমশাই এর মুখে এই কথা শুনে বংশী কিছুটা চমকে যায়, পরিকল্পনা বলে কি উনি ওকেই ঠেস দিয়ে কিছু বলতে চাইলেন। মনে সাহস এনে বংশী বলে ওঠে
বংশীঃ তারমানে উনি আমায় বিশ্বাস করেন না তাইতো। তাহলে রানীমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমায় দিলেন কেন? যাই হোক নায়েবমশাই, রানীমা নিরাপদেই আছেন। আপনি এই মুহূর্তে লোক পাঠিয়ে ওনাকে আনার ব্যাবস্থা করুন। আমি জমিদারবাড়ির এই কাজ ছাড়তে চাই। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে বংশীও নেই।
নিজের এই অগ্নীবান ছুঁড়ে বংশী আশা করেছিল যে এবার কিছু একটা ফলাফল ও পাবে। কিন্তু ওর ধারনাকে ভুল প্রমান করে নায়েবমশাই আবার একটু হেঁসে বলে উঠলেন
নায়েবমশাইঃ বংশী, তুমি তো বহুদিন ডাকাত ছিলে, তুমি তো এই অঞ্চলের ই লোক। জমিদারবাড়ি সম্বন্ধে আগে থেকেই তুমি অনেক তথ্য জোগাড় করেছ। আচ্ছা তুমি কি জানো রানীমার বাপের বাড়ী কোথায়?
নায়েবমশাই এর কথা শুনে বংশী হতবাক হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওনার দিকে। সত্যি ই তো বংশী এই কথা কখনো ভাবেওনি, কারুর মুখে শোনেও নি। বংশী বুঝতে পারে কিছু একটা গণ্ডগোল রয়েছে, আর হয়ত ও নিজেই পাশা খেলার গুটিতে পরিনত হয়েছে। ওর এই ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নায়েবমশাই বলে ওঠে
নায়েবমশাইঃ আমিও তোমার ই মত সামান্য ভৃত্য বংশী। এরকম অনেক প্রশ্নই আছে যা করলে তুমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। চলো অল্প কিছু বলাই যাক। যাকে তুমি রানীমা বলে ভাবো সে আসলে এই বাড়ির বউ কিনা সেই নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। একদিন গভীর রাতে সুপ্রতীক ওকে বাড়িতে এনে তোলে। মাথায় লাল টিপ ও সিঁদুর। আমাদের প্রশ্নের কোনও জবাব কখনোই সুপ্রতীক দেয়নি। বংশী যে বয়সে তুমি কবাডি খেলতে কুস্তি লড়তে সে বয়সে সুপ্রতীক চাণক্যের অর্থশাস্ত্র পড়ত। ও এক অতি বিচক্ষন কূটনীতিক এবং শক্তিশালী পুরুষ। এই জমিদারবাড়ির ওপর অনেক অভিশাপ আছে তাকে দূর করতেই ওর জন্ম।
নায়েবমশাই এর কথাগুলো বংশীর কাছে খানিকটা রুপকথার মত মনে হয়। যে মানুষটাকে এতদিন ও শুধুই পাশার গুটি ভেবে এসেছে আসলে সে যে একজন প্রথিতযশা খেলোয়াড় তা ও আজকের আগে কখনোই বুঝতে পারেনি। আবার নায়েবমশাই বলে ওঠে
নায়েবমশাইঃ বংশী, তুমি বা আমি ওর সামনে নেহাত ই তুচ্ছ, সামান্য শিশু ভাবতে পারো। ও কি ভাবে ও কি করে তা বোঝার বা বিবেচনা করার ক্ষমতা আমাদের এই ক্ষুদ্র শরীরে নেই। বঙ্গদেশে প্রায় সমস্ত জায়গায় জমিদারির অবসান ঘটেছে। কিন্তু এখনো আমাদের জমিদারী বেঁচে রয়েছে, কখনো ভেবে দেখবে কি করে এই দুঃসাধ্য সাধন হোল। বংশী, সুপ্রতীক এযুগের চানক্য। যে সিলিং সাহেবকে নিয়ে তোমরা এতো চিন্তিত সেও সুপ্রতীককে সমীহ করে চলে। হয়ত তোমরা তা কখনো বুঝতে পারনি।
বংশী হতবাক হয়ে ওই স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নায়েবমশাই বংশীর কাঁধে একটা হাত রেখে বলেন
নায়েবমশাইঃ সুপ্রতীককে নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। ও সর্বশক্তিমান, ওর কোনও বিপদ ই হবেনা। তুমি বরং সৈন্যদের সাথে থাকো, আমি ভেতর থেকে আসি, কিছু অর্থের জোগান দিতে হবে।
নায়েবমশাই ভেতরে প্রবেশ করেন। বংশী বেশ কিছুক্ষন হতবাক হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বংশী বোঝে খেলাটা প্রচণ্ড কঠিন, অতটাও সহজ নয়। কিন্তু বংশীও বীর। সুপ্রতীকের বীরত্ব ওকে ভয় নয় লড়াই করার ই ইন্ধন জুগিয়েছে। এই মুহূর্তে ওকে আগে জানতে হবে গার্গী ও প্রিয়া কোথায়। বংশী দ্রুত জমিদারবাড়ি ত্যাগ করে গ্রামের দিকে যেতে শুরু করে। একেক করে পথচলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে বংশী। প্রথমেই এক সাধারন মহিলাকে ও জিজ্ঞেস করে “মা আপনি কি জমিদারবাড়ির দুই মেয়েকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখেছেন?” অদ্ভুতভাবে সেই মহিলা কোনও উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড প্রতিহিংসার সাথে বংশীর মুখের দিকে তাকায়। বংশী সামনে এগিয়ে চলে। বংশী খেয়াল করে বংশীকে রাস্তায় চলতে দেখে আশেপাশের লোকজন এক জায়গায় জড় হয়ে ওকে নিয়ে কিছু আলোচনা করছে। বংশী মনে করে এ বোধ হয় ওর মনের ভুল। বংশী আবার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে “বাবা আপনি কি জমিদারবাড়ির দুই মেয়েকে এই রাস্তায় যেতে দেখেছেন?” সেই ভদ্রলোক অত্যন্ত বাজেভাবে বংশীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে “ওরে পাপী তোর পতন হবেই রে। তোর দেহ শকুনে ছিরে ছিরে খাবে” এতক্ষনে বংশী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। আশেপাশের সমস্ত মানুষের দিকে তাকায়, সবাই বংশীর দিকে প্রচণ্ড প্রতিহিংসার সাথে তাকিয়ে থাকে। বংশী বোঝে ওর পেছনে এমন অনেক কিছুই ঘটেছে যা ও জানেনা, ও শুধু এটাই বোঝে যে এই মুহূর্তে ওর সমূহ বিপদ। জঙ্গল ই ওর একমাত্র ভরসা। বংশী, ছুটতে আরম্ভ করে জঙ্গলের দিকে। এক নিঃশ্বাসে কখন যে ও জঙ্গলের একদম ভেতরে প্রবেশ করে যায় তা ওর নিজের ও খেয়াল ছিলনা। বুকের পাঁজরগুলো কষ্টে যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল, সামনেই একটা গাছের নিচে বংশী বসে পড়ে। বংশী বোঝে যা ঘটছে বা যা ঘটবে তা সব ই সুপ্রতীক ও নায়েবমশাই এর পরিকল্পনা অনুযায়ী। এবং এই পরিকল্পনা ওর দীর্ঘ ৭ বছরের পরিকল্পনার থেকে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। দৃঢ়চেতা বংশী হারতে জানেনা, পাশাখেলায় সর্বস্ব খুইয়ে দিলেও এখনো এক অতি মুল্যবান সম্পত্তি ওর হাতে রয়ে গেছে তা হোল মালা। বিশ্রাম নিয়ে সময় নষ্ট করা যে মুর্খামি তা বংশী বোঝে। বংশী উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করে।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ও নিজের কুটীরের কাছে পৌঁছে যায়। বাইরের বাঁশের দরজাটা হাট করে খোলা, বাইরে থেকে বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে যে কুটিরের দরজাও খোলা। এক অনভিপ্রেত আশঙ্কা বংশীর মনে দানা বাঁধতে থাকে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে বংশী ভেতরে ঢোকে। কুটিরের দরজার সামনে গিয়ে দেখে সত্যি ই কেউ নেই। ওই অবস্থায় ই দীঘির পাড় বরাবর দৌড়াতে থাকে বংশী। ভালো করে কাঁটাগাছ দিয়ে ঘেরা নিজের নিরাপদ আশ্রয়টা খুঁজে দেখে বংশী, না কেউ নেই। আশঙ্কায় ও চিন্তায় ওর মাথা ছিরে যেতে শুরু করে। মনেমনে নিজেকে দোষারোপ করে বংশী, এতো বড় ভুল আমি কি করে করে ফেললাম। পুরো ব্যাপারটাই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল, ষড়যন্ত্র ওর! পরিকল্পনা ওর! গুটি ওর! কিন্তু খেলোয়াড় ও নয় খেলোয়াড় অন্য কেউ হয়ত সুপ্রতীক। ওর ই হাতে তৈরি সমস্ত ছকটা অন্য কেউ অপহরন করে নিল। বংশী সাহসী, ও জানে এখন একটাই উপায় এই জঙ্গলের মধ্যে যদি মালা সত্যি ই থেকে থাকে তাহলে ওকে খুঁজে বার করা। পাগলের মত ওখান থেকে বেরিয়ে বংশী জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করে। না কোনও পায়ের ছাপ না কোনও চিহ্ন। প্রায় ঘণ্টা ২-৩ অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বংশী হাল ছেড়ে দেয়। ও জানে মালা জমিদারবাড়িতে ফিরে গেছে এবং ওর ও জমিদারবাড়িতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ।
একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বংশী ভাবতে থাকে কিকরে সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো, ওর সাজানো পাশার চালটা কি করে অন্যের হাতে পড়ে গেলো। হতাশা বংশীকে চরমভাবে গ্রাস করে। কিন্তু বংশীও যথেষ্ট সাবধানী, সুপ্রতীককে অবজ্ঞা করে একবার যে ভুল ও করে ফেলেছে দ্বিতীয়বার ও আর তা করতে চায়না। জঙ্গলে ওর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়টা প্রকাশ্যে এসে গেছে। কিন্তু এটাই ওর একমাত্র আশ্রয় নয়। এই জঙ্গল ওর দেশ ওর রাজ্য। এরকম অন্তত আরও ১০ টা আশ্রয় এই জঙ্গলেই রয়েছে। এই মুহূর্তে ওকে রক্ষণাত্মক হয়ে যেতে হবে। যা গেছে তা যাক কিন্তু নতুন করে আর কিছু হারানো উচিত নয়। বংশীর খেয়াল পড়ে যায় ওর শেষ সম্বলটুকু যা দীঘির পাশের নারকোল গাছের কাছে পোঁতা আছে। বংশী আবার দৌড়াতে শুরু করে কারন খুব দ্রুত ওকে নিজের স্থান পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। এক নিঃশ্বাসে ও নিজের কুটিরে প্রবেশ করে যায়। কুটিরের পেছনে একটা শাবল আর কোদাল সবসময় রাখা থাকে। দ্রুত ওগুলো নিয়ে বংশী চলে যায় দীঘির পাড়ে নারকেল গাছের কাছে। দ্রুত মাটি খুঁড়তে শুরু করে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে আসে একটা চটের বস্তা। এতক্ষনের সমস্ত উৎকণ্ঠার অবসান হয়। দ্রুত বংশী বস্তার মুখের বাঁধন খুলে ভেতরে দেখে। ভেতরে ৪ টে কলসি ই রয়েছে। এগুলোই বংশীর শেষ সম্বল। ডাকাতি করে পাওয়া এই ৪ কলসি সোনা হীরে জহরতের আনুমানিক মুল্য সেই সময়েই কয়েক কোটি টাকা হবে। এতো হতাশার মধ্যেও বংশীর মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে, কারন ও হয়ত সবকিছু হারিয়ে ফেলেনি। মন মনে একবার বলে ওঠে “সুপ্রতীক বংশী এতো সহজে হার মানেনা, লড়াই এখনো বাকি রয়েছে” কিন্তু ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর, এই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হলনা। পেছন থেকে কিছুটা ইংরেজি ও কিছুটা ভাঙা বাংলায় এক তরুনের মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো
“হ্যালো বানসী! এই তো হামার গুপ্তধন!”
নিষ্ঠুর নির্ভীক বংশীও তাহলে ভয় পায়। আর পাবেওনা কেন? ও মানুষের সাথে লড়তে জানে, হিংস্র জানোয়ারের সাথে লড়তে জানে, কিন্তু অতৃপ্ত আত্মার সাথে? না তার সাথে লড়তে জানেনা। এই কণ্ঠ বংশীর অতি পরিচিত, এ ওর ই পাশাখেলার সবচেয়ে দামী গুটি বেচারা টমাসের। দুহাত দিয়ে কলসিগুলো শক্ত করে ধরে বংশী নিজের শরীরের কাঁপুনিকে লুকাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ভুতে ভয় তো সবাই পায়।
ইতিহাস হয়ত পাটিগণিত, বীজগনিত মেনে চলেনা। ইতিহাস মেনে চলে জটিল সম্ভাবনা তত্ব। মানুষ কখনোই নিজের ইতিহাস নিজে লিখতে পারেনা, ইতিহাস লেখে সময়, কারন মানুষ সময়ের ই দাস। বংশীর পতন কি ওর ই বন্য রাজপ্রাসাদে এক অতৃপ্ত আত্মার হাতে?
উত্তরটা কারুর ই জানা নেই, উত্তর জানে একমাত্র সময়। আর এই সময়কে অবজ্ঞা আমরা কেউ ই করতে পারিনা।
বংশীর কানে নায়েবমশাই এর চাতুরির হাসিপূর্ণ কথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। এতো বছর ধরে তিলতিল করে যে পরিকল্পনা ও তৈরি করেছিল আর কয়েকটা মিনিট আগে অবধিও যা ধ্রুবসত্যি মনে হচ্ছিল হথাত ই যেন তা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে যেতে শুরু করে। অজস্র আশঙ্কা বংশীর মনে ঝড় উঠিয়ে দেয়। কি যে সত্য আর কি যে মিথ্যে এই হয়ত এই ইহজগতের সবচেয়ে বড় ছলনা। যা দেখা যায় যা শোনা যায় যা অনুভব করা যায় তা সবসময় সত্য হয়না, একটা ভ্রান্ত মরীচিকাও হয় অনেকসময়। কিন্তু বংশীও তো সুচাগ্র রাজনীতিক, রাজাও বটে। যদিও জঙ্গলের নিষিদ্ধ রাজ্যের রাজা তাও তো রাজা। নিজেকে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রন করে বংশী। বিপদে মানুষ যে আরও ভুল করে ফেলে তা বংশী খুব ই ভালো করে বোঝে। এই মুহূর্তে বংশীর চোখ মুখের অবস্থা দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে যে জমিদারবাবুর অন্তর্ধানে নয় অন্য কোনও অজানা কারনেই বংশী বেশি চিন্তিত। নিজের শরীরী ভাষা সম্বন্ধে বংশীও যথেষ্ট অবগত। অন্যমনস্ক ভাবটা কাটিয়ে বংশী পাশের দিকে তাকায়, এতক্ষন এখানেই নায়েবমশাই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওকে অন্যমনস্ক দেখে চলে গেছেন। মনে মনে বলে বংশী না ভয় পেলে বা বেশি চিন্তা করলে চলবে না। টমাস এর পর আমার যদি কোনও মুল্যবান গুটি থেকে থাকে তো তা হোল গার্গী ও প্রিয়া। গার্গী ও প্রিয়ার টোপ দিয়ে সুপ্রতীককে মুক্ত করা যাবে। আবার ওদের ই টোপ দিয়ে সুপ্রতীককে সিলিং সাহেবের সাথে যুদ্ধে উদ্যত করা যাবে। এই মুহূর্তে আমার একটাই কাজ যেভাবে হোক ওই দুই রুপসীকে খুঁজে বার করা। এতো অল্প সময়ের মধ্যে ওদের রাজ্যের বাইরে পাঠানো সম্ভব নয়। ওরা আশেপাশের কোনও গ্রামেই আছে। বংশী ভালো করে চিন্তা করতে শুরু করে নায়েবমশাই ছাড়া আর কে আছে যাকে সুপ্রতীক প্রচণ্ড বিশ্বাস করে। যার কাছে ওদেরকে পাঠিয়ে সুপ্রতীক নিশ্চিন্ত হতে পারে। কিছুই মাথায় আসেনা বংশীর।
সামনের দিকে তাকায় বংশী। বাহিরমহলে প্রচুর সিপাহী দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সম্ভবত যুদ্ধের মোহড়া দিচ্ছে। একটা ব্যাপার ভেবে অবাক হয়ে যায় বংশী। ওর পুরনো সাথীরা যাদের লাঠিয়াল হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল তারা কোথায়? যারা রয়েছে তারা তো সব ই হয় পুরনো পেয়াদা অথবা সিপাহী। বংশী জানে রহস্য কিছু একটা রয়েছে এবং সেই রহস্যই ওকে ফাঁস করতে হবে। বংশীর চোখ পড়ে নায়েবমশাই এর দিকে। সিপাহীদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নায়েবমশাই ওর ই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নায়েবমশাই এর মুখে সেই পরিচিত বাঁকা হাসিটা লেগেই আছে। এই হাসির মধ্যে যেন কত অজানা প্রশ্নের ই উত্তর লুকিয়ে আছে। বংশীর মনে এক অন্য সন্দেহ দানা বাঁধে। এরকম নয়ত নায়েবমশাই সব জানেন কিন্তু ওকে কিছু জানাচ্ছেনা। এরকম নয়ত টমাসকে হত্যা করার ব্যাপারটায় নায়েবমশাই ওকে সন্দেহ করেছে। আবার নিজেকে শান্ত করে বংশী। মনে মনে বলে আশঙ্কা করতে থাকলে সব গুলিয়ে যাবে। অঙ্কের সমাধান ও প্রায় করেই এসেছে, শুধু একটাই জায়গায় ও আঁটকে গেছে তা হোল প্রিয়া আর গার্গী। বংশী আবার নায়েবমশাই এর দিকে তাকায়, ওনার মুখে সেই চালাক হাসিটা তখন ও লেগে আছে। মনে মনে ঠিক করে বংশী, এভাবে নায়েবমশাই এর কাছে ধরা দিলে চলবে না। যেভাবে হোক গোপন ব্যাপারটা ওকে জানতে হবেই। বংশী জোর করে মুখে একটা হাসি এনে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
নায়েবমশাই এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বংশী একটু স্ফীত হেঁসে বলে
বংশীঃ আসলে নায়েবমশাই, প্রিয়াদিদি ও গার্গীদিদিকে নিয়ে আমি প্রচণ্ড চিন্তায় আছি। আপনি তো জানেন জমিদারবাবু আমাকে সমস্ত নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। ওনাদের যদি কিছু হয়ে যায় আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবোনা। আমি জানি নায়েবমশাই আপনি জানেন ওরা কোথায় আছে। হয়ত কোনও কারনে আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপনি যদি আমায় বলতেন তাহলে ওদের নিরাপত্তার জন্য আমি কিছু ব্যাবস্থা করতাম। সত্যি বলতে...
নায়েবমশাই এর মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, বংশীর একটা হাত ধরে ভেতর দিকে যেতে ইশারা করে। বংশীর ও মনে আশার আলো দেখা দেয়। বংশী ভাবতে শুরু করে নিশ্চয়ই এমন কিছু ব্যাপার আছে যার জন্য নায়েবমশাই কিছুতেই ওকে বলতে চাইছিলেন না। ওরা দুজনেই আবার অন্দরমহলে প্রবেশ করে। বংশীর দিকে তাকিয়ে নায়েবমশাই বলে ওঠেন
নায়েবমশাইঃ বংশী ওরা কোথায় আছে তা আমি সত্যি ই জানিনা।
এবার সত্যি ই বংশীর মাথা খারাপ হয়ে যায়, নায়েবমশাই এর অনুরুপ একটা হাসি ফেরত দিয়ে বংশী বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। নায়েবমশাই বংশীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেন। বংশী বোঝে এবার নায়েবমশাই ওকে কিছু বলবেন। বংশী ওখানে দাঁড়িয়ে যান। নায়েবমশাই সামান্য হেঁসে বলেন
নায়েবমশাইঃ বংশী, সুপ্রতীককে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছি। ওর যখন ৩ বছর বয়স তখন রানীমা মানে ওর মা মারা যায়। বিনা বিবেচনায় কোনও কাজ ই ও করেনা। ওর পরিকল্পনা আজ অবধি আমি কখনো ব্যর্থ হতে দেখিনি। ওকে আমি নিজে হাতে তৈরি করেছি বংশী।
নায়েবমশাই এর মুখে এই কথা শুনে বংশী কিছুটা চমকে যায়, পরিকল্পনা বলে কি উনি ওকেই ঠেস দিয়ে কিছু বলতে চাইলেন। মনে সাহস এনে বংশী বলে ওঠে
বংশীঃ তারমানে উনি আমায় বিশ্বাস করেন না তাইতো। তাহলে রানীমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমায় দিলেন কেন? যাই হোক নায়েবমশাই, রানীমা নিরাপদেই আছেন। আপনি এই মুহূর্তে লোক পাঠিয়ে ওনাকে আনার ব্যাবস্থা করুন। আমি জমিদারবাড়ির এই কাজ ছাড়তে চাই। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে বংশীও নেই।
নিজের এই অগ্নীবান ছুঁড়ে বংশী আশা করেছিল যে এবার কিছু একটা ফলাফল ও পাবে। কিন্তু ওর ধারনাকে ভুল প্রমান করে নায়েবমশাই আবার একটু হেঁসে বলে উঠলেন
নায়েবমশাইঃ বংশী, তুমি তো বহুদিন ডাকাত ছিলে, তুমি তো এই অঞ্চলের ই লোক। জমিদারবাড়ি সম্বন্ধে আগে থেকেই তুমি অনেক তথ্য জোগাড় করেছ। আচ্ছা তুমি কি জানো রানীমার বাপের বাড়ী কোথায়?
নায়েবমশাই এর কথা শুনে বংশী হতবাক হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওনার দিকে। সত্যি ই তো বংশী এই কথা কখনো ভাবেওনি, কারুর মুখে শোনেও নি। বংশী বুঝতে পারে কিছু একটা গণ্ডগোল রয়েছে, আর হয়ত ও নিজেই পাশা খেলার গুটিতে পরিনত হয়েছে। ওর এই ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নায়েবমশাই বলে ওঠে
নায়েবমশাইঃ আমিও তোমার ই মত সামান্য ভৃত্য বংশী। এরকম অনেক প্রশ্নই আছে যা করলে তুমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। চলো অল্প কিছু বলাই যাক। যাকে তুমি রানীমা বলে ভাবো সে আসলে এই বাড়ির বউ কিনা সেই নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। একদিন গভীর রাতে সুপ্রতীক ওকে বাড়িতে এনে তোলে। মাথায় লাল টিপ ও সিঁদুর। আমাদের প্রশ্নের কোনও জবাব কখনোই সুপ্রতীক দেয়নি। বংশী যে বয়সে তুমি কবাডি খেলতে কুস্তি লড়তে সে বয়সে সুপ্রতীক চাণক্যের অর্থশাস্ত্র পড়ত। ও এক অতি বিচক্ষন কূটনীতিক এবং শক্তিশালী পুরুষ। এই জমিদারবাড়ির ওপর অনেক অভিশাপ আছে তাকে দূর করতেই ওর জন্ম।
নায়েবমশাই এর কথাগুলো বংশীর কাছে খানিকটা রুপকথার মত মনে হয়। যে মানুষটাকে এতদিন ও শুধুই পাশার গুটি ভেবে এসেছে আসলে সে যে একজন প্রথিতযশা খেলোয়াড় তা ও আজকের আগে কখনোই বুঝতে পারেনি। আবার নায়েবমশাই বলে ওঠে
নায়েবমশাইঃ বংশী, তুমি বা আমি ওর সামনে নেহাত ই তুচ্ছ, সামান্য শিশু ভাবতে পারো। ও কি ভাবে ও কি করে তা বোঝার বা বিবেচনা করার ক্ষমতা আমাদের এই ক্ষুদ্র শরীরে নেই। বঙ্গদেশে প্রায় সমস্ত জায়গায় জমিদারির অবসান ঘটেছে। কিন্তু এখনো আমাদের জমিদারী বেঁচে রয়েছে, কখনো ভেবে দেখবে কি করে এই দুঃসাধ্য সাধন হোল। বংশী, সুপ্রতীক এযুগের চানক্য। যে সিলিং সাহেবকে নিয়ে তোমরা এতো চিন্তিত সেও সুপ্রতীককে সমীহ করে চলে। হয়ত তোমরা তা কখনো বুঝতে পারনি।
বংশী হতবাক হয়ে ওই স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নায়েবমশাই বংশীর কাঁধে একটা হাত রেখে বলেন
নায়েবমশাইঃ সুপ্রতীককে নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। ও সর্বশক্তিমান, ওর কোনও বিপদ ই হবেনা। তুমি বরং সৈন্যদের সাথে থাকো, আমি ভেতর থেকে আসি, কিছু অর্থের জোগান দিতে হবে।
নায়েবমশাই ভেতরে প্রবেশ করেন। বংশী বেশ কিছুক্ষন হতবাক হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বংশী বোঝে খেলাটা প্রচণ্ড কঠিন, অতটাও সহজ নয়। কিন্তু বংশীও বীর। সুপ্রতীকের বীরত্ব ওকে ভয় নয় লড়াই করার ই ইন্ধন জুগিয়েছে। এই মুহূর্তে ওকে আগে জানতে হবে গার্গী ও প্রিয়া কোথায়। বংশী দ্রুত জমিদারবাড়ি ত্যাগ করে গ্রামের দিকে যেতে শুরু করে। একেক করে পথচলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে বংশী। প্রথমেই এক সাধারন মহিলাকে ও জিজ্ঞেস করে “মা আপনি কি জমিদারবাড়ির দুই মেয়েকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখেছেন?” অদ্ভুতভাবে সেই মহিলা কোনও উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড প্রতিহিংসার সাথে বংশীর মুখের দিকে তাকায়। বংশী সামনে এগিয়ে চলে। বংশী খেয়াল করে বংশীকে রাস্তায় চলতে দেখে আশেপাশের লোকজন এক জায়গায় জড় হয়ে ওকে নিয়ে কিছু আলোচনা করছে। বংশী মনে করে এ বোধ হয় ওর মনের ভুল। বংশী আবার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে “বাবা আপনি কি জমিদারবাড়ির দুই মেয়েকে এই রাস্তায় যেতে দেখেছেন?” সেই ভদ্রলোক অত্যন্ত বাজেভাবে বংশীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে “ওরে পাপী তোর পতন হবেই রে। তোর দেহ শকুনে ছিরে ছিরে খাবে” এতক্ষনে বংশী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। আশেপাশের সমস্ত মানুষের দিকে তাকায়, সবাই বংশীর দিকে প্রচণ্ড প্রতিহিংসার সাথে তাকিয়ে থাকে। বংশী বোঝে ওর পেছনে এমন অনেক কিছুই ঘটেছে যা ও জানেনা, ও শুধু এটাই বোঝে যে এই মুহূর্তে ওর সমূহ বিপদ। জঙ্গল ই ওর একমাত্র ভরসা। বংশী, ছুটতে আরম্ভ করে জঙ্গলের দিকে। এক নিঃশ্বাসে কখন যে ও জঙ্গলের একদম ভেতরে প্রবেশ করে যায় তা ওর নিজের ও খেয়াল ছিলনা। বুকের পাঁজরগুলো কষ্টে যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল, সামনেই একটা গাছের নিচে বংশী বসে পড়ে। বংশী বোঝে যা ঘটছে বা যা ঘটবে তা সব ই সুপ্রতীক ও নায়েবমশাই এর পরিকল্পনা অনুযায়ী। এবং এই পরিকল্পনা ওর দীর্ঘ ৭ বছরের পরিকল্পনার থেকে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। দৃঢ়চেতা বংশী হারতে জানেনা, পাশাখেলায় সর্বস্ব খুইয়ে দিলেও এখনো এক অতি মুল্যবান সম্পত্তি ওর হাতে রয়ে গেছে তা হোল মালা। বিশ্রাম নিয়ে সময় নষ্ট করা যে মুর্খামি তা বংশী বোঝে। বংশী উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করে।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ও নিজের কুটীরের কাছে পৌঁছে যায়। বাইরের বাঁশের দরজাটা হাট করে খোলা, বাইরে থেকে বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে যে কুটিরের দরজাও খোলা। এক অনভিপ্রেত আশঙ্কা বংশীর মনে দানা বাঁধতে থাকে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে বংশী ভেতরে ঢোকে। কুটিরের দরজার সামনে গিয়ে দেখে সত্যি ই কেউ নেই। ওই অবস্থায় ই দীঘির পাড় বরাবর দৌড়াতে থাকে বংশী। ভালো করে কাঁটাগাছ দিয়ে ঘেরা নিজের নিরাপদ আশ্রয়টা খুঁজে দেখে বংশী, না কেউ নেই। আশঙ্কায় ও চিন্তায় ওর মাথা ছিরে যেতে শুরু করে। মনেমনে নিজেকে দোষারোপ করে বংশী, এতো বড় ভুল আমি কি করে করে ফেললাম। পুরো ব্যাপারটাই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল, ষড়যন্ত্র ওর! পরিকল্পনা ওর! গুটি ওর! কিন্তু খেলোয়াড় ও নয় খেলোয়াড় অন্য কেউ হয়ত সুপ্রতীক। ওর ই হাতে তৈরি সমস্ত ছকটা অন্য কেউ অপহরন করে নিল। বংশী সাহসী, ও জানে এখন একটাই উপায় এই জঙ্গলের মধ্যে যদি মালা সত্যি ই থেকে থাকে তাহলে ওকে খুঁজে বার করা। পাগলের মত ওখান থেকে বেরিয়ে বংশী জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করে। না কোনও পায়ের ছাপ না কোনও চিহ্ন। প্রায় ঘণ্টা ২-৩ অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বংশী হাল ছেড়ে দেয়। ও জানে মালা জমিদারবাড়িতে ফিরে গেছে এবং ওর ও জমিদারবাড়িতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ।
একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বংশী ভাবতে থাকে কিকরে সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো, ওর সাজানো পাশার চালটা কি করে অন্যের হাতে পড়ে গেলো। হতাশা বংশীকে চরমভাবে গ্রাস করে। কিন্তু বংশীও যথেষ্ট সাবধানী, সুপ্রতীককে অবজ্ঞা করে একবার যে ভুল ও করে ফেলেছে দ্বিতীয়বার ও আর তা করতে চায়না। জঙ্গলে ওর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়টা প্রকাশ্যে এসে গেছে। কিন্তু এটাই ওর একমাত্র আশ্রয় নয়। এই জঙ্গল ওর দেশ ওর রাজ্য। এরকম অন্তত আরও ১০ টা আশ্রয় এই জঙ্গলেই রয়েছে। এই মুহূর্তে ওকে রক্ষণাত্মক হয়ে যেতে হবে। যা গেছে তা যাক কিন্তু নতুন করে আর কিছু হারানো উচিত নয়। বংশীর খেয়াল পড়ে যায় ওর শেষ সম্বলটুকু যা দীঘির পাশের নারকোল গাছের কাছে পোঁতা আছে। বংশী আবার দৌড়াতে শুরু করে কারন খুব দ্রুত ওকে নিজের স্থান পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। এক নিঃশ্বাসে ও নিজের কুটিরে প্রবেশ করে যায়। কুটিরের পেছনে একটা শাবল আর কোদাল সবসময় রাখা থাকে। দ্রুত ওগুলো নিয়ে বংশী চলে যায় দীঘির পাড়ে নারকেল গাছের কাছে। দ্রুত মাটি খুঁড়তে শুরু করে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে আসে একটা চটের বস্তা। এতক্ষনের সমস্ত উৎকণ্ঠার অবসান হয়। দ্রুত বংশী বস্তার মুখের বাঁধন খুলে ভেতরে দেখে। ভেতরে ৪ টে কলসি ই রয়েছে। এগুলোই বংশীর শেষ সম্বল। ডাকাতি করে পাওয়া এই ৪ কলসি সোনা হীরে জহরতের আনুমানিক মুল্য সেই সময়েই কয়েক কোটি টাকা হবে। এতো হতাশার মধ্যেও বংশীর মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে, কারন ও হয়ত সবকিছু হারিয়ে ফেলেনি। মন মনে একবার বলে ওঠে “সুপ্রতীক বংশী এতো সহজে হার মানেনা, লড়াই এখনো বাকি রয়েছে” কিন্তু ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর, এই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হলনা। পেছন থেকে কিছুটা ইংরেজি ও কিছুটা ভাঙা বাংলায় এক তরুনের মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো
“হ্যালো বানসী! এই তো হামার গুপ্তধন!”
নিষ্ঠুর নির্ভীক বংশীও তাহলে ভয় পায়। আর পাবেওনা কেন? ও মানুষের সাথে লড়তে জানে, হিংস্র জানোয়ারের সাথে লড়তে জানে, কিন্তু অতৃপ্ত আত্মার সাথে? না তার সাথে লড়তে জানেনা। এই কণ্ঠ বংশীর অতি পরিচিত, এ ওর ই পাশাখেলার সবচেয়ে দামী গুটি বেচারা টমাসের। দুহাত দিয়ে কলসিগুলো শক্ত করে ধরে বংশী নিজের শরীরের কাঁপুনিকে লুকাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ভুতে ভয় তো সবাই পায়।
ইতিহাস হয়ত পাটিগণিত, বীজগনিত মেনে চলেনা। ইতিহাস মেনে চলে জটিল সম্ভাবনা তত্ব। মানুষ কখনোই নিজের ইতিহাস নিজে লিখতে পারেনা, ইতিহাস লেখে সময়, কারন মানুষ সময়ের ই দাস। বংশীর পতন কি ওর ই বন্য রাজপ্রাসাদে এক অতৃপ্ত আত্মার হাতে?
উত্তরটা কারুর ই জানা নেই, উত্তর জানে একমাত্র সময়। আর এই সময়কে অবজ্ঞা আমরা কেউ ই করতে পারিনা।