19-01-2019, 09:23 AM
পর্ব ৫- সাইদুলের পরিবর্তনঃ
সুবীর বাবুঃ সত্য বাবু আমার আর শুনতে ইচ্ছে নেই। এই ৩ মাসে ঠিক যা যা অভিশাপ আমার জীবনে নেমে এসেছে আমি তা মাথা পেতে নিলাম। কিন্তু নিজের ই প্রিয়জনদের ব্যাপারে আমি কোনও অপ্রিয় কথা শুনতে চাইনা। যা হয়েছে তার জন্য আমি ই দায়ী, আমি যদি জমিদারবাড়ি তে না যেতাম...
সত্য বাবুঃ আরে না সুবীর বাবু আপনি কেন নিজেকে দোষারোপ করছেন। যা ঘটছে তা শুধুই এই ডায়েরি তার জন্য। আমি আপনি আমরা সবাই তো শুধু মাত্র এই ডায়েরিটার দাস, তাই নয় কি।
সুবীর বাবু কোনও উত্তর দিলেন না, মাথা নিচু করে শুধু বসে থাকলেন। সুবীর বাবুর এই অবস্থা দেখে সত্য বাবুর প্রচণ্ড মায়া হোল।
সত্য বাবুঃ আপনার এই মানসিক অবস্থা দেখে আমিও আর থাকতে পারছি না সুবীর বাবু। আপনি আমার কথাগুলো অনুগ্রহ করে মন দিয়ে শুনুন। সুবীর বাবু আমি যদি আপনাকে না বলে দিতাম যে আমি ই সত্যেন্দ্র, আপনি কি কখনো জানতে পারতেন সত্য ও সত্যেন্দ্র একি মানুষ। চোখে দেখা বা কানে শোনা কথা সবসময় সত্যি হয়না। আমি ব্যাক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে বলতে পারি যে এই ডায়েরি কখনো কারুর ক্ষতি করেনি। শুধু একটা চরম মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। কিন্তু সবশেষে খুব সুখের সমাপ্তি হয়। আপনিও আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। আপনার যেমন এই মুহূর্তে সব কিছু ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে, ঠিক একি ভাবে ডায়েরীর কথাগুলো ও সম্পূর্ণ ওলট পালট হয়ে গিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। না আপনাকে আর আমি রহস্যের মধ্যে রাখতে চাইনা। সুবীরবাবু সবশেষে সব ই শুভ হবে।
সুবীর বাবুঃ আমি কখনো কারুর কোনও ক্ষতি করিনি, আমার ই কেন এরকম হোল। নিজের স্ত্রী কন্যাদের সম্মান নিয়ে প্রশ্নঃ আর আপনি বলছেন সব শুভ হবে।
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু আপনি বিচক্ষন মানুষ। আপনি তো জানেন ধৈর্য ধরলে সব ই পাওয়া যায়। সুবীর বাবু আমায় আমার কর্তব্য পালন করতে দিন। আমি আর বেশিক্ষন নিজের শরীর ধরে রাখতে পারছিনা।
সুবীর বাবু আবার চুপ করে গেলেন। সত্য বাবু আবার নিজের গল্প শুরু করলেন।
সত্য বাবুঃ সাইদুল রূপসার কলেজ থেকে বাড়ী ফেরার পথে বহুবার রাজুর ফোন এসেছে, কিন্তু প্রতিবার ই সাইদুল ফোন রিসিভ করেনি। রাজুর চিন্তা বাড়তে থাকে, বারবার মনে হতে থাকে সাইদুলের বুঝি কোনও বিপদ হয়েছে। রাজু বস্তি পেরিয়ে রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই সাইদুল ওখানে এসে পৌছায়। তখনও সাইদুলের ঠোঁটে কেটে যাওয়ার দাগ, বাঁ দিক টায় তখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। রাজু দৌড়ে এগিয়ে যায় সাইদুলের কাছে।
রাজুঃ একি রে সাইদুল, কোনও বিপদ হয়েছে নাকি তোর? কে তোকে মেরেছে এইভাবে? আমায় নাম বল আমি তারপর দেখছি কি করা যায়।
পুরো রাস্তায় সাইদুল শুধু ভাবতে ভাবতে এসেছে ওর কি করা উচিত তা নিয়ে। একবার মন বলেছে প্রানের বন্ধুকে সব সত্যি কথা বলতে, আবার একবার মন সদ্য যুবতীর হৃদয়ের স্পর্শ চাইছে। সাইদুল বেশিদুর পড়াশুনা শেখেনি, যদি শিখত তাহলে হয়ত মনে মনে একটিবার ও বলত “একেই বলে ধর্মসঙ্কট”। সাইদুল নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় বাবার মারা যাওয়ার কথা, কত কষ্ট করে ও নিজের আর বাড়ীর সবার জন্য দুবেলার ভাত জোগাড় করেছে, কত মানুষের অপমান সহ্য করেছে। কেউ ওকে কখনো বোঝেনি। শিশুমনের মান-অভিমানগুলো কবে যে মরে গেছিল হয়ত ও নিজেও তা ভুলে গেছে। আজ এতদিন পর কেউ যেন ওর জীবনে এলো যার ওপর অকারনে রাগ করা যায়, যার সাথে অকারনে ঝগড়া করা যায়। আর রাজু, রাজুতো শুধুই মালতীদেবীদের বাড়ীর দিকে নজর রাখার জন্য ওকে ব্যাবহার করেছে। কোথায় ছিল রাজু ওর সেই কষ্টের দিনগুলোতে। সাইদুল মনে মনে সব ঠিক করে নেয়।
সাইদুলঃ আরে কিছু নয়রে। মেয়েটা কলেজ এর ছেলে দিয়ে মার খাইয়েছে। শালা গরিবের ছেলে হয়ে যেমন গেছিলাম চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে। শালা আমার যা শিক্ষা হয়ে গেলো রে, সত্যি আর কখনো ওই পথে পা মারাচ্ছিনা।
রাজু কোনও উত্তর দিলনা। শুধুই ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। সাইদুল চোখ টা সরিয়ে নিল।
সাইদুলঃ রাজু তুই এবার বাড়ী যা। সেই কোন দুপুরে বেড়িয়েছি। মা খুব চিন্তা করছে আমি বরং বাড়ী যাই।
সাইদুল, রাজুকে এড়িয়ে সাইকেল টা নিয়ে চলে যেতে শুরু করে। রাজু সাইদুল কে চেনে, রাজু জানে সাইদুল ওকে মিথ্যে কথা বলছে। রাজু একদৃষ্টিতে সাইদুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাজুঃ ওরা তোকে শুধুই মারল, পুলিসের হাতে তুলে দিলনা?
সাইদুল জানে রাজু ওকে সন্দেহ করছে। সাইদুল পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্য একটু চেঁচিয়েই বলে উঠল
সাইদুলঃ কেন বলত, আমি কি এখন থানায় থাকলে তুই বেশি খুশি হতিস। শোন রাজু, তোর এইসব আইদিয়াতে আমি আর নেই। আমি গরিবের ছেলে, খেটে খাই। আমার কিছু হয়ে গেলে আমার সংসার টা কে দেখবে।
সাইদুল আর ওখানে দাঁড়াল না। খুব জোরে জোরে হেঁটে ওখান থেকে বেড়িয়ে চলে গেলো। রাজু একবার মুচকি হাসল সাইদুলের দিকে তাকিয়ে। রাজুও আর ওখানে দাঁড়াল না। বাজারের দিকে চলতে শুরু করল।
এদিকে সাইদুল বাড়ী পৌঁছে হাত পা ধুয়ে মোবাইল টা নিয়ে বসে যায়। মোবাইলে ম্যাসেজ লেখে “কি করছ রূপসা? আমার না তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে” কিন্তু ব্যাস ওই অতটুকুই। ম্যাসেজ টা পাঠাবে কি পাঠাবে না সেই নিয়েই শুধু দোনোমনা করতে শুরু করে। ঠিক সেইমুহূর্তেই ওর মোবাইলে একটা ম্যাসেজ চলে আসে। “সাইদুল, ফ্রি আছো এখন। আমার খুব জরুরি কিছু কথা আছে তোমার সাথে” সাইদুল আনন্দে প্রায় লাফিয়েই ওঠে। ভেতর থেকে আম্মি বেড়িয়ে এসে বলে “কি হয়েছে সাইদুল এরকম করছিস কেন?” সাইদুল কোনরকমে আম্মিকে বুঝিয়ে ভেতরে পাঠায়। মোবাইল থেকে রূপসার নাম্বার টা বার করে সাথে সাথে ফোন লাগিয়ে দেয়। একবার রিং হওয়ার পর ই ফোন কেটে যায়। সাইদুল কিছুটা অবাক ই হয়ে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওপাশ থেকে ফোন আসে। সাইদুল ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে ওটা রূপসার। সঙ্গে সঙ্গে ফোন টা রিসিভ করে নেয়।
সাইদুলঃ কি হয়েছে রূপসা? আমার ফোন টা কেটে কেন দিলে তুমি? কিছু প্রবলেম হয়েছে?
রূপসাঃ বেশ করেছি কেটে দিয়েছি। আমার কথা বলার ইচ্ছে হয়েছে আমি ফোন করব, তুমি কেন করবে।
মানুষ প্রেমে পড়লে মনের ও মাথার অবস্থা ঠিক কি হয় তা সাইদুল কিছুক্ষন আগেই জেনেছে। কিন্তু নিজের প্রিয়তমা যখন এইভাবে আবেগমেশানো গলায় উত্তর দেয় তখন যে ঠিক কি আনন্দ হয় তা সাইদুল আগে জানত না। একবার ওপরের দিকে তাকায় সাইদুল। সাদা ধবধবে একটা পূর্ণিমার চাঁদ। আর এই মুহূর্তে সাইদুলের হাতে গোটা চাঁদ তাই রয়েছে। এই এতোগুলো ফিলিংস এর মাঝে সাইদুল প্রায় ভুলেই গেছিল যে রূপসা কে উত্তর দিতে হবে। ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে রূপসার মধুর মত মিষ্টি একটা কণ্ঠ ভেসে ওঠে
রূপসাঃ এই জানো আমি কিছু খাইনি। আমায় না বন্ধুরা, দিদিরা সবাই খুব বকেছে। সবাই বলেছে আমি এক নাম্বারের পচা মেয়ে। পচাই তো। নয়ত এভাবে একটা মিষ্টি ছেলেকে কেউ মার খাওয়ায়।
সাইদুল বুঝে গেছে ওর পক্ষে আর নিজেকে সামলানো সম্ভব নয়। হয়ত ওই মুহূর্তেই মনে মনে ও বলে উঠেছিল “ইস যদি পেটে একটু বিদ্যে থাকতো তাহলে একটা কবিতা শুনিয়ে দিতাম” সত্যি ই যদি জীবনটা সিনেমার মত হত। আব্বা বেঁচে থাকা অবস্থায় ও হলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে কত সিনেমা দেখত। লাস্ট দেখেছিল ম্যায়নে পেয়ার কিয়া। এই মুহূর্তে সাইদুল ম্যায়নে পেয়ার কিয়ার সালমান এর জায়গায় নিজেকে রেখে ফেলেছে। আবার রূপসার মিষ্টি একটা কথা, রাজুর যেন মনটা জুড়িয়ে গেলো যেন এক পশলা বৃষ্টির জল ছিটকে এসে ওর গায়ে লাগলো।
রূপসাঃ এই দেখো আমি কি বদমাশ মেয়ে। খালি নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার তো বাড়ী পৌছাতে অনেক দেরি হোল, তুমি কি কিছু খেয়েছ? প্লিজ বলনা তুমি কিছু খেয়েছ?
সাইদুল জানে আর বেশি ভাবনা চিন্তা করলে চলবে না এবার একটা ভালো করে জবাব দিতে হবে নয়ত সব কেঁচিয়ে যাবে।
সাইদুলঃ না খাইনি। কেন খাবো? তুমি আগে খাও তবে আমি খাবো।
রূপসাঃ এমা তুমি এখনো খাওনি। প্লিজ খেয়ে নাও আগে। কোন দুপুরে আমার মত একটা বাঁদর কে দেখার জন্য তুমি বেড়িয়েছিলে। প্লিজ খেয়ে নাও।
সাইদুলঃ না আগে তুমি খাবে নয়ত আমি খাবার নিয়ে তোমার কাছেই আসব আর তোমায় জোর করে খাইয়ে দেবো।
রূপসাঃ (খিলখিল করে হেসে) হ্যাঁ এসে দেখইনা কিকরে তুমি জোর করে আমায় খাওয়াও আমিও দেখব। জানো আমায় বাবা, মা, তিলোত্তমা সবাই ভয় পায়। আমায় কেউ জোর করতে পারেনা। আমি খুব খুব খুব বদমাশ।
সাইদুলঃ তাইনাকি। কে বেশি বদমাশ দেখা যাবে। আমি আসছি।
রূপসাঃ এই না, না সাইদুল...
রূপসার কথা শেষ হতে না হতেই সাইদুল ফোন টা কেটে দেয়। রূপসা নিজের ই মনে খুব জোরে হেঁসে ওঠে। এদিকে সাইদুল ও সাইকেল টা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে, সোজা ময়রার দোকানে এসে ১০ টা কচুরি ও ১০ টা জিলিপি নেয়। রাজু কিছুটা দুরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্ত কিছু রাজুর নজরে পড়ে। মেয়েদের ব্যাপারে রাজুর মত অভিজ্ঞতা খুব ই কমজনের আছে। রাজু একটা সন্দেহ করেছিল যে সাইদুল ওকে মিথ্যে বলেছে। এখন রাজু নিশ্চিত হয়ে যায় যে সাইদুল শুধু মিথ্যেই নয় একটা বিশাল ব্যপার ওর থেকে লুকিয়েছে। সাইদুলের খাবার নেওয়া হয়ে যায় ও সাইদুল খুব দ্রুত ওখান থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
রাজুর পক্ষেও চুপ করে সবকিছু দেখে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। রাজুও পাশের দোকান থেকে একটা সাইকেল জোগাড় করে সাইদুলের পিছু নেয়।
১০ মিনিট পর সাইদুল কলেজ এর গেট এ প্রবেশ করে। তখন ও রাস্তায় ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছিল। রাস্তার ধারের নিয়নের আলোয় চারপাশটা প্রচণ্ড রোম্যান্টিক মনে হচ্ছিল সাইদুলের। তীব্র গতিতে সাইদুলের সাইকেল ছুটতে থাকে গার্লস হোস্টেলের দিকে। আর ঠিক টার কিছুটা পেছনেই রাজুও সাইকেল নিয়ে সাইদুলকে ফলো করতে থাকে। রূপসা জানত যে সাইদুল আসবে। রূপসা ও হোস্টেলের গেট থেকে বেড়িয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাইদুল রূপসাকে দেখতে পায়। একটা নীল রঙের সালোয়ারে চাঁদের আলোয় তখন রূপসাকে ডানাকাটা পরীর মতই লাগছিল। সাইদুল সাইকেল থেকে দুদিকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সাইদুলের মুখে একটা স্ফীত হাসি, নজর সোজা রূপসার দিকে। রূপসার ও মুখে একটা খুব খুব খুব মিষ্টি হাসি। রাজু অনেকটা পেছনে একটা গাছের নিচে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সুবীর বাবুঃ সত্য বাবু আমার আর শুনতে ইচ্ছে নেই। এই ৩ মাসে ঠিক যা যা অভিশাপ আমার জীবনে নেমে এসেছে আমি তা মাথা পেতে নিলাম। কিন্তু নিজের ই প্রিয়জনদের ব্যাপারে আমি কোনও অপ্রিয় কথা শুনতে চাইনা। যা হয়েছে তার জন্য আমি ই দায়ী, আমি যদি জমিদারবাড়ি তে না যেতাম...
সত্য বাবুঃ আরে না সুবীর বাবু আপনি কেন নিজেকে দোষারোপ করছেন। যা ঘটছে তা শুধুই এই ডায়েরি তার জন্য। আমি আপনি আমরা সবাই তো শুধু মাত্র এই ডায়েরিটার দাস, তাই নয় কি।
সুবীর বাবু কোনও উত্তর দিলেন না, মাথা নিচু করে শুধু বসে থাকলেন। সুবীর বাবুর এই অবস্থা দেখে সত্য বাবুর প্রচণ্ড মায়া হোল।
সত্য বাবুঃ আপনার এই মানসিক অবস্থা দেখে আমিও আর থাকতে পারছি না সুবীর বাবু। আপনি আমার কথাগুলো অনুগ্রহ করে মন দিয়ে শুনুন। সুবীর বাবু আমি যদি আপনাকে না বলে দিতাম যে আমি ই সত্যেন্দ্র, আপনি কি কখনো জানতে পারতেন সত্য ও সত্যেন্দ্র একি মানুষ। চোখে দেখা বা কানে শোনা কথা সবসময় সত্যি হয়না। আমি ব্যাক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে বলতে পারি যে এই ডায়েরি কখনো কারুর ক্ষতি করেনি। শুধু একটা চরম মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। কিন্তু সবশেষে খুব সুখের সমাপ্তি হয়। আপনিও আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। আপনার যেমন এই মুহূর্তে সব কিছু ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে, ঠিক একি ভাবে ডায়েরীর কথাগুলো ও সম্পূর্ণ ওলট পালট হয়ে গিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। না আপনাকে আর আমি রহস্যের মধ্যে রাখতে চাইনা। সুবীরবাবু সবশেষে সব ই শুভ হবে।
সুবীর বাবুঃ আমি কখনো কারুর কোনও ক্ষতি করিনি, আমার ই কেন এরকম হোল। নিজের স্ত্রী কন্যাদের সম্মান নিয়ে প্রশ্নঃ আর আপনি বলছেন সব শুভ হবে।
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু আপনি বিচক্ষন মানুষ। আপনি তো জানেন ধৈর্য ধরলে সব ই পাওয়া যায়। সুবীর বাবু আমায় আমার কর্তব্য পালন করতে দিন। আমি আর বেশিক্ষন নিজের শরীর ধরে রাখতে পারছিনা।
সুবীর বাবু আবার চুপ করে গেলেন। সত্য বাবু আবার নিজের গল্প শুরু করলেন।
সত্য বাবুঃ সাইদুল রূপসার কলেজ থেকে বাড়ী ফেরার পথে বহুবার রাজুর ফোন এসেছে, কিন্তু প্রতিবার ই সাইদুল ফোন রিসিভ করেনি। রাজুর চিন্তা বাড়তে থাকে, বারবার মনে হতে থাকে সাইদুলের বুঝি কোনও বিপদ হয়েছে। রাজু বস্তি পেরিয়ে রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই সাইদুল ওখানে এসে পৌছায়। তখনও সাইদুলের ঠোঁটে কেটে যাওয়ার দাগ, বাঁ দিক টায় তখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। রাজু দৌড়ে এগিয়ে যায় সাইদুলের কাছে।
রাজুঃ একি রে সাইদুল, কোনও বিপদ হয়েছে নাকি তোর? কে তোকে মেরেছে এইভাবে? আমায় নাম বল আমি তারপর দেখছি কি করা যায়।
পুরো রাস্তায় সাইদুল শুধু ভাবতে ভাবতে এসেছে ওর কি করা উচিত তা নিয়ে। একবার মন বলেছে প্রানের বন্ধুকে সব সত্যি কথা বলতে, আবার একবার মন সদ্য যুবতীর হৃদয়ের স্পর্শ চাইছে। সাইদুল বেশিদুর পড়াশুনা শেখেনি, যদি শিখত তাহলে হয়ত মনে মনে একটিবার ও বলত “একেই বলে ধর্মসঙ্কট”। সাইদুল নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় বাবার মারা যাওয়ার কথা, কত কষ্ট করে ও নিজের আর বাড়ীর সবার জন্য দুবেলার ভাত জোগাড় করেছে, কত মানুষের অপমান সহ্য করেছে। কেউ ওকে কখনো বোঝেনি। শিশুমনের মান-অভিমানগুলো কবে যে মরে গেছিল হয়ত ও নিজেও তা ভুলে গেছে। আজ এতদিন পর কেউ যেন ওর জীবনে এলো যার ওপর অকারনে রাগ করা যায়, যার সাথে অকারনে ঝগড়া করা যায়। আর রাজু, রাজুতো শুধুই মালতীদেবীদের বাড়ীর দিকে নজর রাখার জন্য ওকে ব্যাবহার করেছে। কোথায় ছিল রাজু ওর সেই কষ্টের দিনগুলোতে। সাইদুল মনে মনে সব ঠিক করে নেয়।
সাইদুলঃ আরে কিছু নয়রে। মেয়েটা কলেজ এর ছেলে দিয়ে মার খাইয়েছে। শালা গরিবের ছেলে হয়ে যেমন গেছিলাম চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে। শালা আমার যা শিক্ষা হয়ে গেলো রে, সত্যি আর কখনো ওই পথে পা মারাচ্ছিনা।
রাজু কোনও উত্তর দিলনা। শুধুই ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। সাইদুল চোখ টা সরিয়ে নিল।
সাইদুলঃ রাজু তুই এবার বাড়ী যা। সেই কোন দুপুরে বেড়িয়েছি। মা খুব চিন্তা করছে আমি বরং বাড়ী যাই।
সাইদুল, রাজুকে এড়িয়ে সাইকেল টা নিয়ে চলে যেতে শুরু করে। রাজু সাইদুল কে চেনে, রাজু জানে সাইদুল ওকে মিথ্যে কথা বলছে। রাজু একদৃষ্টিতে সাইদুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাজুঃ ওরা তোকে শুধুই মারল, পুলিসের হাতে তুলে দিলনা?
সাইদুল জানে রাজু ওকে সন্দেহ করছে। সাইদুল পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্য একটু চেঁচিয়েই বলে উঠল
সাইদুলঃ কেন বলত, আমি কি এখন থানায় থাকলে তুই বেশি খুশি হতিস। শোন রাজু, তোর এইসব আইদিয়াতে আমি আর নেই। আমি গরিবের ছেলে, খেটে খাই। আমার কিছু হয়ে গেলে আমার সংসার টা কে দেখবে।
সাইদুল আর ওখানে দাঁড়াল না। খুব জোরে জোরে হেঁটে ওখান থেকে বেড়িয়ে চলে গেলো। রাজু একবার মুচকি হাসল সাইদুলের দিকে তাকিয়ে। রাজুও আর ওখানে দাঁড়াল না। বাজারের দিকে চলতে শুরু করল।
এদিকে সাইদুল বাড়ী পৌঁছে হাত পা ধুয়ে মোবাইল টা নিয়ে বসে যায়। মোবাইলে ম্যাসেজ লেখে “কি করছ রূপসা? আমার না তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে” কিন্তু ব্যাস ওই অতটুকুই। ম্যাসেজ টা পাঠাবে কি পাঠাবে না সেই নিয়েই শুধু দোনোমনা করতে শুরু করে। ঠিক সেইমুহূর্তেই ওর মোবাইলে একটা ম্যাসেজ চলে আসে। “সাইদুল, ফ্রি আছো এখন। আমার খুব জরুরি কিছু কথা আছে তোমার সাথে” সাইদুল আনন্দে প্রায় লাফিয়েই ওঠে। ভেতর থেকে আম্মি বেড়িয়ে এসে বলে “কি হয়েছে সাইদুল এরকম করছিস কেন?” সাইদুল কোনরকমে আম্মিকে বুঝিয়ে ভেতরে পাঠায়। মোবাইল থেকে রূপসার নাম্বার টা বার করে সাথে সাথে ফোন লাগিয়ে দেয়। একবার রিং হওয়ার পর ই ফোন কেটে যায়। সাইদুল কিছুটা অবাক ই হয়ে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওপাশ থেকে ফোন আসে। সাইদুল ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে ওটা রূপসার। সঙ্গে সঙ্গে ফোন টা রিসিভ করে নেয়।
সাইদুলঃ কি হয়েছে রূপসা? আমার ফোন টা কেটে কেন দিলে তুমি? কিছু প্রবলেম হয়েছে?
রূপসাঃ বেশ করেছি কেটে দিয়েছি। আমার কথা বলার ইচ্ছে হয়েছে আমি ফোন করব, তুমি কেন করবে।
মানুষ প্রেমে পড়লে মনের ও মাথার অবস্থা ঠিক কি হয় তা সাইদুল কিছুক্ষন আগেই জেনেছে। কিন্তু নিজের প্রিয়তমা যখন এইভাবে আবেগমেশানো গলায় উত্তর দেয় তখন যে ঠিক কি আনন্দ হয় তা সাইদুল আগে জানত না। একবার ওপরের দিকে তাকায় সাইদুল। সাদা ধবধবে একটা পূর্ণিমার চাঁদ। আর এই মুহূর্তে সাইদুলের হাতে গোটা চাঁদ তাই রয়েছে। এই এতোগুলো ফিলিংস এর মাঝে সাইদুল প্রায় ভুলেই গেছিল যে রূপসা কে উত্তর দিতে হবে। ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে রূপসার মধুর মত মিষ্টি একটা কণ্ঠ ভেসে ওঠে
রূপসাঃ এই জানো আমি কিছু খাইনি। আমায় না বন্ধুরা, দিদিরা সবাই খুব বকেছে। সবাই বলেছে আমি এক নাম্বারের পচা মেয়ে। পচাই তো। নয়ত এভাবে একটা মিষ্টি ছেলেকে কেউ মার খাওয়ায়।
সাইদুল বুঝে গেছে ওর পক্ষে আর নিজেকে সামলানো সম্ভব নয়। হয়ত ওই মুহূর্তেই মনে মনে ও বলে উঠেছিল “ইস যদি পেটে একটু বিদ্যে থাকতো তাহলে একটা কবিতা শুনিয়ে দিতাম” সত্যি ই যদি জীবনটা সিনেমার মত হত। আব্বা বেঁচে থাকা অবস্থায় ও হলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে কত সিনেমা দেখত। লাস্ট দেখেছিল ম্যায়নে পেয়ার কিয়া। এই মুহূর্তে সাইদুল ম্যায়নে পেয়ার কিয়ার সালমান এর জায়গায় নিজেকে রেখে ফেলেছে। আবার রূপসার মিষ্টি একটা কথা, রাজুর যেন মনটা জুড়িয়ে গেলো যেন এক পশলা বৃষ্টির জল ছিটকে এসে ওর গায়ে লাগলো।
রূপসাঃ এই দেখো আমি কি বদমাশ মেয়ে। খালি নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার তো বাড়ী পৌছাতে অনেক দেরি হোল, তুমি কি কিছু খেয়েছ? প্লিজ বলনা তুমি কিছু খেয়েছ?
সাইদুল জানে আর বেশি ভাবনা চিন্তা করলে চলবে না এবার একটা ভালো করে জবাব দিতে হবে নয়ত সব কেঁচিয়ে যাবে।
সাইদুলঃ না খাইনি। কেন খাবো? তুমি আগে খাও তবে আমি খাবো।
রূপসাঃ এমা তুমি এখনো খাওনি। প্লিজ খেয়ে নাও আগে। কোন দুপুরে আমার মত একটা বাঁদর কে দেখার জন্য তুমি বেড়িয়েছিলে। প্লিজ খেয়ে নাও।
সাইদুলঃ না আগে তুমি খাবে নয়ত আমি খাবার নিয়ে তোমার কাছেই আসব আর তোমায় জোর করে খাইয়ে দেবো।
রূপসাঃ (খিলখিল করে হেসে) হ্যাঁ এসে দেখইনা কিকরে তুমি জোর করে আমায় খাওয়াও আমিও দেখব। জানো আমায় বাবা, মা, তিলোত্তমা সবাই ভয় পায়। আমায় কেউ জোর করতে পারেনা। আমি খুব খুব খুব বদমাশ।
সাইদুলঃ তাইনাকি। কে বেশি বদমাশ দেখা যাবে। আমি আসছি।
রূপসাঃ এই না, না সাইদুল...
রূপসার কথা শেষ হতে না হতেই সাইদুল ফোন টা কেটে দেয়। রূপসা নিজের ই মনে খুব জোরে হেঁসে ওঠে। এদিকে সাইদুল ও সাইকেল টা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে, সোজা ময়রার দোকানে এসে ১০ টা কচুরি ও ১০ টা জিলিপি নেয়। রাজু কিছুটা দুরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্ত কিছু রাজুর নজরে পড়ে। মেয়েদের ব্যাপারে রাজুর মত অভিজ্ঞতা খুব ই কমজনের আছে। রাজু একটা সন্দেহ করেছিল যে সাইদুল ওকে মিথ্যে বলেছে। এখন রাজু নিশ্চিত হয়ে যায় যে সাইদুল শুধু মিথ্যেই নয় একটা বিশাল ব্যপার ওর থেকে লুকিয়েছে। সাইদুলের খাবার নেওয়া হয়ে যায় ও সাইদুল খুব দ্রুত ওখান থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
রাজুর পক্ষেও চুপ করে সবকিছু দেখে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। রাজুও পাশের দোকান থেকে একটা সাইকেল জোগাড় করে সাইদুলের পিছু নেয়।
১০ মিনিট পর সাইদুল কলেজ এর গেট এ প্রবেশ করে। তখন ও রাস্তায় ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছিল। রাস্তার ধারের নিয়নের আলোয় চারপাশটা প্রচণ্ড রোম্যান্টিক মনে হচ্ছিল সাইদুলের। তীব্র গতিতে সাইদুলের সাইকেল ছুটতে থাকে গার্লস হোস্টেলের দিকে। আর ঠিক টার কিছুটা পেছনেই রাজুও সাইকেল নিয়ে সাইদুলকে ফলো করতে থাকে। রূপসা জানত যে সাইদুল আসবে। রূপসা ও হোস্টেলের গেট থেকে বেড়িয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাইদুল রূপসাকে দেখতে পায়। একটা নীল রঙের সালোয়ারে চাঁদের আলোয় তখন রূপসাকে ডানাকাটা পরীর মতই লাগছিল। সাইদুল সাইকেল থেকে দুদিকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সাইদুলের মুখে একটা স্ফীত হাসি, নজর সোজা রূপসার দিকে। রূপসার ও মুখে একটা খুব খুব খুব মিষ্টি হাসি। রাজু অনেকটা পেছনে একটা গাছের নিচে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।