18-01-2019, 12:04 PM
পর্ব ১৫- বাসা বদলঃ
সত্য বাবুঃ কেমন লাগলো সুবীর বাবু।
সুবীর বাবুর মুখ দিয়ে একটি শব্দ ও বেড়িয়ে আসছেনা। বহুক্ষন আগেই ওনার কণ্ঠনালী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। কি করে এই ভৌতিক স্থান হতে পরিত্রান পাবেন তাই ভেবে চলেছেন। সত্য বাবুর গল্পের শেষ অংশ টুকু কতটা সুবীর বাবুর মাথায় ঢুকল সে নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই যেতে পারে।
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু আপনি আশেপাশে যাদের দেখছেন তারা প্রত্যেকেই মৃতদেহ। আমিও একটি মৃতদেহ। কিন্তু আমরা কারুর অনিষ্ট করিনা। আত্মা ঠিক তখন ই কারুর অনিষ্ট করে যখন তার মধ্যে প্রতিশোধের জিঘাংসা বেঁচে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের ই মধ্যে সেই জিঘাংসা শেষ হয়ে গেছে। আপনি একবার চারপাশ তা দেখুন। হয়ত আপনার ভয় লাগবে কিন্তু দেখবেন কেউ ই ক্ষতিকর নয়।
সুবীর বাবু মাথা তুলে সোজা সত্য বাবুর দিকে তাকান। এতক্ষন সত্য বাবু ছিলেন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত। হথাত ই ওনার শরীর তা হাজার হাজার ক্ষতে ভর্তি হয়ে সুবীর বাবুর সামনে আসে। সুবীর বাবু প্রচণ্ড জোরে ওমা বলে চিৎকার করে ওঠেন।
সত্য বাবুঃ অনুগ্রহ করে আপনি ভয় পাবেন না সুবীর বাবু। আমরা সত্যি ই আপনার কোনও ক্ষতি করবনা। আপনি একটি বার দেখে নিন এখানে অনুরাধা, মৃত্যুঞ্জয় দেবেন্দ্র সবাই রয়েছে। আর আমি সত্যেন্দ্র। মৃত্যুঞ্জয়ের আদেশে গ্রামবাসীরা গনপ্রহার দিয়ে আমার এই অবস্থা করেছে।
সুবীর বাবু একবার চারপাশ তা তাকিয়ে দেখেন। সত্যি ই বীভৎস এক অবস্থা। অনুরাধার গলার কাছে এক গভীর ক্ষত সেখান থেকে রক্তের দাগ গোটা শরীরে বিদ্যমান। সুবীর বাবু ভয়ে আবার মুখ তা নিচে নামিয়ে নেন। এবার সুবীর বাবু বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ আমি অতি সামান্য এক মানুষ। আপনাদের সাথে আমার কোনও যোগ নেই। আমি কস্মিনকালেও আপনাদের কারুর কোনও ক্ষতি করিনি। আমাকে আপনারা ছেড়ে দিন। আমার স্ত্রী কন্যা আছে, সংসার আছে।
সত্য বাবুঃ আপনি অযথাই চিন্তা করছেন সুবীর বাবু। আমরা কেউ আপনার কোনও ক্ষতি করবনা। আর আপনার কোনও ক্ষতি হবেওনা, আমরা তা হতে দেবো ও না।
এবার সুবীর বাবু কিছুটা সস্তি পান। ভেজা গলায় বলে ওঠেন “তাহলে আমায় যেতে দিন আপনারা”
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু এই জমিদার বাড়ীতে আপনার কাজ মোটামুটি ভাবে শেষ। শুধু আপনাকে কিছু কথা বলে রাখতে চাই। আমরা কেউ অভিশপ্ত আত্মা নই। আমাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমাদের আত্মা মুক্তি পায়নি। কিন্তু আমাদের কোনও সুপ্ত বাসনা নেই তাই আমরা কারুর কোনও ক্ষতিও করিনা। কিন্তু এই ডায়েরীর একটা সুপ্ত বাসনা রয়েছে। এই ডায়েরি অভিশপ্ত। কেউ যেন এই ডায়েরি তে রোজ নতুন নতুন গল্প লেখে। সেই গল্প আবার অন্য কেউ পড়ে, আবার নতুন এক গল্প লেখা হয়। এভাবেই ডায়েরি তা হাত বদলে বদলে এই জমিদারবাড়ি তেই ফিরে আসে। যারাই এই ডায়েরি তা না নিয়ে এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে তারা প্রত্যেকেই এই জমিদারবাড়ি তে অপঘাতে মারা গেছে। আপনিও এই ভুল তা করবেন না। এই ডায়েরি তা নিজের ঘরে নিয়ে যান, এতে আপনার গল্প লেখা শুরু হবে। শুরু যদিও হয়ে গেছে। আমি আপনাকে সংক্ষেপে যতটুকু লেখা হয়েছে সে ব্যাপারে বলে দিচ্ছি। এবার গল্পের নাম ই অভিশপ্ত ডায়েরি। এই গল্প তা মোট ৩ তে খণ্ডে লেখা হবে। যার প্রথম খণ্ড টি সমাপ্ত হয়ে গেছে। এই জমিদারবাড়ি তে যা যা ঘটলো সেটা নিয়ে হবে দ্বিতীয় খণ্ড। কিছুদিনের মধ্যে এই দ্বিতীয় খণ্ড ও সমাপ্ত হয়ে যাবে। বাড়ী ফিরে যাওয়ার পর আপনার জীবনে কিছু পরিবর্তন হবে কিছু ঘটনা ঘটবে এগুলো নিয়ে লেখা হবে তৃতীয় খণ্ড। যেহেতু প্রথম খণ্ড তা লেখা হয়ে গেছে তাই আমি এর ব্যাপারে আপনাকে সংক্ষেপে বলে রাখি।
প্রথম খণ্ড মোট ২০ টি পর্বে লেখা হয়েছে। যার প্রথম পর্ব সাইদুলের নজর। সাইদুল এর আপনার স্ত্রী মালতীর ওপর এক কামাতুর দৃষ্টি রয়েছে তা নিয়েই এই পর্ব। এর পরের পর্ব গুলি হোল সুব্রতর আগমন ও সুব্রতর স্বর্গলাভ। আপনার ই সহকর্মী সুব্রত আপনাদের বাড়ীতে তিলোত্তমা কে পড়াতে আসেন এবং কালক্রমে উনি মালতী দেবীর অর্ধনগ্ন শরীর দেখতে পান। এর পর রাজুর প্রাপ্তি, রাজু ও সাইদুল। পাড়ার ছেলে রাজুর আপনার স্ত্রীর ওপর কুনজর রয়েছে এবং রাজু ও সাইদুল দুজনেই নিয়মিত স্নানরত অবস্থায় আপনার স্ত্রীর শরীর কে উপভোগ করে। এরপর রাজু ও তিলোত্তমা। রাজুর সাথে তিলত্তমার এক আত্মিক ঘনিষ্ঠতা হয়। তারপর শুধুই মানব বাবু আপনি ও মালতী দেবী। এই ঘটনা টি পুরোটাই আপনি জানেন। শুধু একটি জিনিস ই আপনি জানেন না। তা হোল সেদিন রাতে মানব মালতীর দেহকে ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিল। দুজনের ঠোঁট একে অপরকে স্পর্শ ও করেছিল। মালতী দেবীর স্তনের ও স্পর্শ ও আস্বাদন মানবের কপালে জোটে। কিন্তু মালতী দেবী বুঝে যান, যে উনি আপনি নয় মানব বাবু। তাই ওনাদের ও মিলন অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ঠিক দেবেন্দ্র ও অনুরাধার ই মত। তারপর তো আপনি সব ই জানেন। আপনার বাসাবদল ও এই জমিদারবাড়ি তে আগমন।
আমাদের দায়িত্ব মোটামুটি শেষ সুবীর বাবু। আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন সুবীর বাবু। আমি আজ প্রায় ৪০০ বছর ধরে এই ডায়েরি কে হাত বদল হতে দেখেছি। সাধারনত কিছু ভুল মানুষ করে থাকে তাই ডায়েরি তার নাম হয়ে গেছে অভিশপ্ত ডায়েরি। দুটি কথা মনে রাখবেন, প্রথমত ডায়েরি কখনো খুলে দেখবেন না। এই ডায়েরীর লেখক কে তা আমার জানা নেই, তবে পাঠক আপনি ই হবেন। তৃতীয় পর্ব লেখা শেষ হলে আপনাকে জানানো হবে তখন আপনি ডায়েরি পড়বেন তার আগে নয়। আর দ্বিতিয়ত এই ডায়েরীর কোনও চরিত্র যেমন মালতী দেবী বা অন্য কাউকে বা কোনও ঘটনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনার সংসারে চরম অভিশাপ নেমে আসবে।
এবার আপনি মুক্ত সুবীর বাবু।
সুবীর বাবু কোনরকমে উঠে দাঁড়ান। ওনার ঠিক পেছনেই বীভৎস রকম দেখতে কিছু শরীর দাঁড়িয়ে ছিল। পেছন থেকে সত্য বাবু আবার বলে ওঠেন
সত্য বাবুঃ তৃতীয় পর্বে অনেক বেশি রোমাঞ্চ থাকবে সুবীর বাবু। ডায়েরি পরার পর আপনি নিজের ওপর ই বিশ্বাস রাখতে পারবেন না।
কোনরকমে ডায়েরি তাকে বগলে চেপে সুবীর বাবু ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পড়েন। বারান্দায় তখন বহু দাসি ঘর পরিস্কারে ব্যস্ত। সুবীর বাবু ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামেন। যে বাড়ী তা কয়েক ঘণ্টা আগে একটা পোড়ো বাড়ী মনে হচ্ছিল সেটাই এখন সাঁঝবাতি আর আসবাবে চকমক করছে। সুবীর বাবু নিচে নেমে দৌড় শুরু করেন, পেছন থেকে ছুটে আসতে থাকে অট্টহাস্যের আওয়াজ। কতদুর অবধি ওই অট্টহাস্য ছুটে এসেছিল তা ওনার খেয়াল নেই। সুবীর বাবু সামনেই দেখেন সেই চায়ের দোকান টা। ওর সামনে বিশাল ভিড় জমে আছে। কোনরকমে ভিড় ঠেলে সুবীর বাবু সামনে এগিয়ে আসেন। একটা মৃতদেহ আর সেই মৃতদেহ কে ঘিরে বেশ কিছু মানুষ। সুবীর বাবু একজন কে জিগ্যেস করেন
সুবীর বাবুঃ কি হয়েছে? কে মারা গেছে?
ভদ্রলোকঃ আর বলবেন না মশাই। এই লোকটার একটা চা দোকান ছিল এখানে। কাল রাতে ওই পোড়ো বাড়ীতে কি করতে গেছিল কি জানি, আজ ওর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, কারখানার মাঠ থেকে।
সুবীর বাবু সামনে এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহর দিকে তাকাতেই ওনার মাথা ঘুরাতে শুরু করে, উনি মাথা ঘুরিয়ে ওখানেই পড়ে যান। কিছুক্ষন পর জল টল দেওয়ার পর ওনার হুঁশ ফেরে। সবাই ওনাকে ঘিরে ধরে জিগ্যেস করে “কি হয়েছে মশাই, এতো ভয় কেন পেয়ে গেলেন?” সুবীর বাবু বিড়বিড় করে বলে ওঠেন “আজ সকালে ঠিক সাড়ে ৭ তার সময় আমি এর থেকে চা খেয়েছিলাম” সবাই প্রচণ্ড জোরে হাঁসতে শুরু করেন। সুবীর বাবু আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বাসের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেন। বাস ধরে সোজা বালিগঞ্জ ও সেখান থেকে নিজের ফ্ল্যাট।
কলিং বেল টা দু তিন বার একনাগাড়ে বাজিয়ে দিলেন সুবীর বাবু। সঙ্গে সঙ্গে রূপসা এসে দরজা টা খুলে দিল।
রূপসাঃ ওহ বাবা তুমি এসে গেছো খুব ভালো হয়েছে। দেখনা মা কিরকম পাগলামি করছে।
সুবীর বাবু কিছুটা জোর করে ধাক্কা দিয়েই রূপসাকে সরিয়ে দেন। রূপসা সুবীর বাবুর এই আচরনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যান। সোজা নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে উনি বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ আমার জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। আমার শরীর ভালো নেই।
রূপসা রান্নাঘরে যায় জল আনতে। এদিকে সুবীর বাবু নিজের রুম টায় ঢুকে সবার আগে বইয়ের শেডে সবার নিচে ডায়েরি টা রেখে দেন। এদিকে সুবীর বাবুর শরীর খারাপ শুনে ওই ঘর থেকে তিলোত্তমা ও ছুটে আসে।
তিলত্তমাঃ কি হয়েছে বাবা। শরীর খারাপ লাগছে?
সুবীর বাবুঃ (রুপ্সার হাত থেকে জলের গ্লাস টা নিয়ে) আমায় আধ ঘণ্টা একা থাকতে দে।
রূপসা ও তিলোত্তমা নিজেদের রুমে চলে যায়। সুবীর বাবু চোখ বন্ধ করে সমস্ত কথা চিন্তা করতে শুরু করেন। উনি জানেন যা ঘটেছে সব ই সত্যি। সত্য বাবুর শেষ দুটো উপদেশ স্মরন করেন। মনে মনে বলেন এই পরিবারের আমি কর্তা। পরিবারের কল্যান সাধনে আমায় অনেক কঠিন সময়ের মোকাবিলা করতে হবে। নিজের মন কে শক্ত করেন। এতক্ষনে ওনার মনে হয় মালতী দেবী একবার ও ওনাকে দেখতে এখানে আসেন নি। কোথায় মালতী? আর রূপসা কিসব বলছিল, মালতী পাগলামি করছে এর মানে কি? সুবীর বাবু উঠে বসেন। মালতী দেবী, রূপসা ও তিলোত্তমা ভেতরের ঘরে ছিল। সুবীর বাবু সেদিকেই এগিয়ে যান। মালতী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ (কিছুটা গম্ভীর হয়ে) মালতী কি হয়েছে তোমার? রূপসা কি বলছে আমায়?
সুবীর বাবু যে বাড়ীতে এসেছেন তা হয়ত মালতী দেবী জানতেন না। মালতী দেবীর চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে। মালতী দেবী দৌড়ে এসে সুবীর বাবুর দুপা জড়িয়ে ধরে
মালতী দেবীঃ ওগো তুমি আমায় বাঁচাও। ওরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। এ ঘরে ভুত আছে। আমি একা থাকলেই কে যেন আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি এখানে থাকতে পারছি না। সারাক্ষন বাড়িতে একা থাকি। আমি সেলিমতলার ওই পুরনো বাড়ী তেই ফিরে যাবো। দরকার হলে আমি নিজেই মানব দার সাথে কথা বলব। আমি এখানে থাকতে পারবনা।
সুবীর বাবুর কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ পড়ে যায়। মনে মনে নিজেকে শান্ত করেন। মনে পড়ে যায় সত্য বাবুর সেই শেষ উপদেশের কথা। “এই গল্পের কোনও চরিত্র বা ঘটনা কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনার সংসারে চরম অভিশাপ নেবে আসবে” সুবীর বাবু বোঝেন ডায়েরীর দ্বিতীয় খণ্ড শেষ এবং তৃতীয় খণ্ড লেখার কাজ শুরু হচ্ছে। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর সুবীর বাবু মালতী দেবীর মাথায় হাত রেখে বলেন
সুবীর বাবুঃ মালতি কোনও চিন্তা করোনা। আমরা পুরনো বাড়ী তেই ফিরে যাবো।
সুবীর বাবুর এই কথা শুনে রূপসা ও তিলোত্তমা দুজনেই চমকে ওঠে।
(দ্বিতীয় খণ্ড শেষ)
সত্য বাবুঃ কেমন লাগলো সুবীর বাবু।
সুবীর বাবুর মুখ দিয়ে একটি শব্দ ও বেড়িয়ে আসছেনা। বহুক্ষন আগেই ওনার কণ্ঠনালী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। কি করে এই ভৌতিক স্থান হতে পরিত্রান পাবেন তাই ভেবে চলেছেন। সত্য বাবুর গল্পের শেষ অংশ টুকু কতটা সুবীর বাবুর মাথায় ঢুকল সে নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই যেতে পারে।
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু আপনি আশেপাশে যাদের দেখছেন তারা প্রত্যেকেই মৃতদেহ। আমিও একটি মৃতদেহ। কিন্তু আমরা কারুর অনিষ্ট করিনা। আত্মা ঠিক তখন ই কারুর অনিষ্ট করে যখন তার মধ্যে প্রতিশোধের জিঘাংসা বেঁচে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের ই মধ্যে সেই জিঘাংসা শেষ হয়ে গেছে। আপনি একবার চারপাশ তা দেখুন। হয়ত আপনার ভয় লাগবে কিন্তু দেখবেন কেউ ই ক্ষতিকর নয়।
সুবীর বাবু মাথা তুলে সোজা সত্য বাবুর দিকে তাকান। এতক্ষন সত্য বাবু ছিলেন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত। হথাত ই ওনার শরীর তা হাজার হাজার ক্ষতে ভর্তি হয়ে সুবীর বাবুর সামনে আসে। সুবীর বাবু প্রচণ্ড জোরে ওমা বলে চিৎকার করে ওঠেন।
সত্য বাবুঃ অনুগ্রহ করে আপনি ভয় পাবেন না সুবীর বাবু। আমরা সত্যি ই আপনার কোনও ক্ষতি করবনা। আপনি একটি বার দেখে নিন এখানে অনুরাধা, মৃত্যুঞ্জয় দেবেন্দ্র সবাই রয়েছে। আর আমি সত্যেন্দ্র। মৃত্যুঞ্জয়ের আদেশে গ্রামবাসীরা গনপ্রহার দিয়ে আমার এই অবস্থা করেছে।
সুবীর বাবু একবার চারপাশ তা তাকিয়ে দেখেন। সত্যি ই বীভৎস এক অবস্থা। অনুরাধার গলার কাছে এক গভীর ক্ষত সেখান থেকে রক্তের দাগ গোটা শরীরে বিদ্যমান। সুবীর বাবু ভয়ে আবার মুখ তা নিচে নামিয়ে নেন। এবার সুবীর বাবু বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ আমি অতি সামান্য এক মানুষ। আপনাদের সাথে আমার কোনও যোগ নেই। আমি কস্মিনকালেও আপনাদের কারুর কোনও ক্ষতি করিনি। আমাকে আপনারা ছেড়ে দিন। আমার স্ত্রী কন্যা আছে, সংসার আছে।
সত্য বাবুঃ আপনি অযথাই চিন্তা করছেন সুবীর বাবু। আমরা কেউ আপনার কোনও ক্ষতি করবনা। আর আপনার কোনও ক্ষতি হবেওনা, আমরা তা হতে দেবো ও না।
এবার সুবীর বাবু কিছুটা সস্তি পান। ভেজা গলায় বলে ওঠেন “তাহলে আমায় যেতে দিন আপনারা”
সত্য বাবুঃ সুবীর বাবু এই জমিদার বাড়ীতে আপনার কাজ মোটামুটি ভাবে শেষ। শুধু আপনাকে কিছু কথা বলে রাখতে চাই। আমরা কেউ অভিশপ্ত আত্মা নই। আমাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমাদের আত্মা মুক্তি পায়নি। কিন্তু আমাদের কোনও সুপ্ত বাসনা নেই তাই আমরা কারুর কোনও ক্ষতিও করিনা। কিন্তু এই ডায়েরীর একটা সুপ্ত বাসনা রয়েছে। এই ডায়েরি অভিশপ্ত। কেউ যেন এই ডায়েরি তে রোজ নতুন নতুন গল্প লেখে। সেই গল্প আবার অন্য কেউ পড়ে, আবার নতুন এক গল্প লেখা হয়। এভাবেই ডায়েরি তা হাত বদলে বদলে এই জমিদারবাড়ি তেই ফিরে আসে। যারাই এই ডায়েরি তা না নিয়ে এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে তারা প্রত্যেকেই এই জমিদারবাড়ি তে অপঘাতে মারা গেছে। আপনিও এই ভুল তা করবেন না। এই ডায়েরি তা নিজের ঘরে নিয়ে যান, এতে আপনার গল্প লেখা শুরু হবে। শুরু যদিও হয়ে গেছে। আমি আপনাকে সংক্ষেপে যতটুকু লেখা হয়েছে সে ব্যাপারে বলে দিচ্ছি। এবার গল্পের নাম ই অভিশপ্ত ডায়েরি। এই গল্প তা মোট ৩ তে খণ্ডে লেখা হবে। যার প্রথম খণ্ড টি সমাপ্ত হয়ে গেছে। এই জমিদারবাড়ি তে যা যা ঘটলো সেটা নিয়ে হবে দ্বিতীয় খণ্ড। কিছুদিনের মধ্যে এই দ্বিতীয় খণ্ড ও সমাপ্ত হয়ে যাবে। বাড়ী ফিরে যাওয়ার পর আপনার জীবনে কিছু পরিবর্তন হবে কিছু ঘটনা ঘটবে এগুলো নিয়ে লেখা হবে তৃতীয় খণ্ড। যেহেতু প্রথম খণ্ড তা লেখা হয়ে গেছে তাই আমি এর ব্যাপারে আপনাকে সংক্ষেপে বলে রাখি।
প্রথম খণ্ড মোট ২০ টি পর্বে লেখা হয়েছে। যার প্রথম পর্ব সাইদুলের নজর। সাইদুল এর আপনার স্ত্রী মালতীর ওপর এক কামাতুর দৃষ্টি রয়েছে তা নিয়েই এই পর্ব। এর পরের পর্ব গুলি হোল সুব্রতর আগমন ও সুব্রতর স্বর্গলাভ। আপনার ই সহকর্মী সুব্রত আপনাদের বাড়ীতে তিলোত্তমা কে পড়াতে আসেন এবং কালক্রমে উনি মালতী দেবীর অর্ধনগ্ন শরীর দেখতে পান। এর পর রাজুর প্রাপ্তি, রাজু ও সাইদুল। পাড়ার ছেলে রাজুর আপনার স্ত্রীর ওপর কুনজর রয়েছে এবং রাজু ও সাইদুল দুজনেই নিয়মিত স্নানরত অবস্থায় আপনার স্ত্রীর শরীর কে উপভোগ করে। এরপর রাজু ও তিলোত্তমা। রাজুর সাথে তিলত্তমার এক আত্মিক ঘনিষ্ঠতা হয়। তারপর শুধুই মানব বাবু আপনি ও মালতী দেবী। এই ঘটনা টি পুরোটাই আপনি জানেন। শুধু একটি জিনিস ই আপনি জানেন না। তা হোল সেদিন রাতে মানব মালতীর দেহকে ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিল। দুজনের ঠোঁট একে অপরকে স্পর্শ ও করেছিল। মালতী দেবীর স্তনের ও স্পর্শ ও আস্বাদন মানবের কপালে জোটে। কিন্তু মালতী দেবী বুঝে যান, যে উনি আপনি নয় মানব বাবু। তাই ওনাদের ও মিলন অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ঠিক দেবেন্দ্র ও অনুরাধার ই মত। তারপর তো আপনি সব ই জানেন। আপনার বাসাবদল ও এই জমিদারবাড়ি তে আগমন।
আমাদের দায়িত্ব মোটামুটি শেষ সুবীর বাবু। আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন সুবীর বাবু। আমি আজ প্রায় ৪০০ বছর ধরে এই ডায়েরি কে হাত বদল হতে দেখেছি। সাধারনত কিছু ভুল মানুষ করে থাকে তাই ডায়েরি তার নাম হয়ে গেছে অভিশপ্ত ডায়েরি। দুটি কথা মনে রাখবেন, প্রথমত ডায়েরি কখনো খুলে দেখবেন না। এই ডায়েরীর লেখক কে তা আমার জানা নেই, তবে পাঠক আপনি ই হবেন। তৃতীয় পর্ব লেখা শেষ হলে আপনাকে জানানো হবে তখন আপনি ডায়েরি পড়বেন তার আগে নয়। আর দ্বিতিয়ত এই ডায়েরীর কোনও চরিত্র যেমন মালতী দেবী বা অন্য কাউকে বা কোনও ঘটনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনার সংসারে চরম অভিশাপ নেমে আসবে।
এবার আপনি মুক্ত সুবীর বাবু।
সুবীর বাবু কোনরকমে উঠে দাঁড়ান। ওনার ঠিক পেছনেই বীভৎস রকম দেখতে কিছু শরীর দাঁড়িয়ে ছিল। পেছন থেকে সত্য বাবু আবার বলে ওঠেন
সত্য বাবুঃ তৃতীয় পর্বে অনেক বেশি রোমাঞ্চ থাকবে সুবীর বাবু। ডায়েরি পরার পর আপনি নিজের ওপর ই বিশ্বাস রাখতে পারবেন না।
কোনরকমে ডায়েরি তাকে বগলে চেপে সুবীর বাবু ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পড়েন। বারান্দায় তখন বহু দাসি ঘর পরিস্কারে ব্যস্ত। সুবীর বাবু ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামেন। যে বাড়ী তা কয়েক ঘণ্টা আগে একটা পোড়ো বাড়ী মনে হচ্ছিল সেটাই এখন সাঁঝবাতি আর আসবাবে চকমক করছে। সুবীর বাবু নিচে নেমে দৌড় শুরু করেন, পেছন থেকে ছুটে আসতে থাকে অট্টহাস্যের আওয়াজ। কতদুর অবধি ওই অট্টহাস্য ছুটে এসেছিল তা ওনার খেয়াল নেই। সুবীর বাবু সামনেই দেখেন সেই চায়ের দোকান টা। ওর সামনে বিশাল ভিড় জমে আছে। কোনরকমে ভিড় ঠেলে সুবীর বাবু সামনে এগিয়ে আসেন। একটা মৃতদেহ আর সেই মৃতদেহ কে ঘিরে বেশ কিছু মানুষ। সুবীর বাবু একজন কে জিগ্যেস করেন
সুবীর বাবুঃ কি হয়েছে? কে মারা গেছে?
ভদ্রলোকঃ আর বলবেন না মশাই। এই লোকটার একটা চা দোকান ছিল এখানে। কাল রাতে ওই পোড়ো বাড়ীতে কি করতে গেছিল কি জানি, আজ ওর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, কারখানার মাঠ থেকে।
সুবীর বাবু সামনে এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহর দিকে তাকাতেই ওনার মাথা ঘুরাতে শুরু করে, উনি মাথা ঘুরিয়ে ওখানেই পড়ে যান। কিছুক্ষন পর জল টল দেওয়ার পর ওনার হুঁশ ফেরে। সবাই ওনাকে ঘিরে ধরে জিগ্যেস করে “কি হয়েছে মশাই, এতো ভয় কেন পেয়ে গেলেন?” সুবীর বাবু বিড়বিড় করে বলে ওঠেন “আজ সকালে ঠিক সাড়ে ৭ তার সময় আমি এর থেকে চা খেয়েছিলাম” সবাই প্রচণ্ড জোরে হাঁসতে শুরু করেন। সুবীর বাবু আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বাসের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেন। বাস ধরে সোজা বালিগঞ্জ ও সেখান থেকে নিজের ফ্ল্যাট।
কলিং বেল টা দু তিন বার একনাগাড়ে বাজিয়ে দিলেন সুবীর বাবু। সঙ্গে সঙ্গে রূপসা এসে দরজা টা খুলে দিল।
রূপসাঃ ওহ বাবা তুমি এসে গেছো খুব ভালো হয়েছে। দেখনা মা কিরকম পাগলামি করছে।
সুবীর বাবু কিছুটা জোর করে ধাক্কা দিয়েই রূপসাকে সরিয়ে দেন। রূপসা সুবীর বাবুর এই আচরনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যান। সোজা নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে উনি বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ আমার জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। আমার শরীর ভালো নেই।
রূপসা রান্নাঘরে যায় জল আনতে। এদিকে সুবীর বাবু নিজের রুম টায় ঢুকে সবার আগে বইয়ের শেডে সবার নিচে ডায়েরি টা রেখে দেন। এদিকে সুবীর বাবুর শরীর খারাপ শুনে ওই ঘর থেকে তিলোত্তমা ও ছুটে আসে।
তিলত্তমাঃ কি হয়েছে বাবা। শরীর খারাপ লাগছে?
সুবীর বাবুঃ (রুপ্সার হাত থেকে জলের গ্লাস টা নিয়ে) আমায় আধ ঘণ্টা একা থাকতে দে।
রূপসা ও তিলোত্তমা নিজেদের রুমে চলে যায়। সুবীর বাবু চোখ বন্ধ করে সমস্ত কথা চিন্তা করতে শুরু করেন। উনি জানেন যা ঘটেছে সব ই সত্যি। সত্য বাবুর শেষ দুটো উপদেশ স্মরন করেন। মনে মনে বলেন এই পরিবারের আমি কর্তা। পরিবারের কল্যান সাধনে আমায় অনেক কঠিন সময়ের মোকাবিলা করতে হবে। নিজের মন কে শক্ত করেন। এতক্ষনে ওনার মনে হয় মালতী দেবী একবার ও ওনাকে দেখতে এখানে আসেন নি। কোথায় মালতী? আর রূপসা কিসব বলছিল, মালতী পাগলামি করছে এর মানে কি? সুবীর বাবু উঠে বসেন। মালতী দেবী, রূপসা ও তিলোত্তমা ভেতরের ঘরে ছিল। সুবীর বাবু সেদিকেই এগিয়ে যান। মালতী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন
সুবীর বাবুঃ (কিছুটা গম্ভীর হয়ে) মালতী কি হয়েছে তোমার? রূপসা কি বলছে আমায়?
সুবীর বাবু যে বাড়ীতে এসেছেন তা হয়ত মালতী দেবী জানতেন না। মালতী দেবীর চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে। মালতী দেবী দৌড়ে এসে সুবীর বাবুর দুপা জড়িয়ে ধরে
মালতী দেবীঃ ওগো তুমি আমায় বাঁচাও। ওরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। এ ঘরে ভুত আছে। আমি একা থাকলেই কে যেন আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি এখানে থাকতে পারছি না। সারাক্ষন বাড়িতে একা থাকি। আমি সেলিমতলার ওই পুরনো বাড়ী তেই ফিরে যাবো। দরকার হলে আমি নিজেই মানব দার সাথে কথা বলব। আমি এখানে থাকতে পারবনা।
সুবীর বাবুর কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ পড়ে যায়। মনে মনে নিজেকে শান্ত করেন। মনে পড়ে যায় সত্য বাবুর সেই শেষ উপদেশের কথা। “এই গল্পের কোনও চরিত্র বা ঘটনা কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনার সংসারে চরম অভিশাপ নেবে আসবে” সুবীর বাবু বোঝেন ডায়েরীর দ্বিতীয় খণ্ড শেষ এবং তৃতীয় খণ্ড লেখার কাজ শুরু হচ্ছে। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর সুবীর বাবু মালতী দেবীর মাথায় হাত রেখে বলেন
সুবীর বাবুঃ মালতি কোনও চিন্তা করোনা। আমরা পুরনো বাড়ী তেই ফিরে যাবো।
সুবীর বাবুর এই কথা শুনে রূপসা ও তিলোত্তমা দুজনেই চমকে ওঠে।
(দ্বিতীয় খণ্ড শেষ)